আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব-৪৩

0
9

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_তেতাল্লিশ


ভুল! ছোট্ট একটি শব্দ। এবং এর ধরণ দুই প্রকার স্বেচ্ছায় ও অনিচ্ছায়।
পরিস্থিতি মোতাবেক ভুল ছোটো নাকি বড় সেটা হিসাব কষার আগেই বদলে যায় কারো কারো জীবন। বদলে যায় কিছু সম্পর্কের বাঁধন। ঠিক এমন কিছুই ঘটেছিল রিমির সঙ্গেও। শুধুমাত্র তার করা জেদের কারণে।
জেদ সব সময় ভালো কিছু বয়ে আনে এমন নয়। ধ্বংসের আরেক নাম জেদ। জেদ যেমন ভালো কিছু করতে আগ্রহী করে তোলে তেমনি কারো ধ্বংসের কারণও হয় জেদ!
সেদিন রিমি সত্যি সত্যি তার জেদে অটল ছিল। ভাবে নি ভাইয়ের কথা, ভাবে নি বাবা-মায়ের কথা। সে পাষাণের পরিচয় দিয়ে সেই মুহূর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এরপর অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায় নি।
বছর তিনেক আগে জানা গেছে সে ইতালিতে আছে। জব করে। একাই থাকে। ম্যাককে বিয়ে করেছিল কিন্তু সেই সম্পর্ক টিকে নি। এরপর আর বিয়ে করে নি। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে না। বাসা থেকেও কেউ আর মনে রাখে নি রিমি নামের কেউ ছিল। সেদিন সন্মান বাঁচাতে রিদওয়ান আর কুহুই শুধু বর-বউ সেজেছিল। তাদের আবার বিয়ে হয়েছিল। মুখে ফুটে তুলতে হয়েছিল মিথ্যা হাসি। সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হয়েছিল মিথ্যের বাণী। একবুক কষ্ট চেপে বলতে হয়েছিল রিমি অসুস্থ হসপিটালে নিতে হয়েছে। তাদের বিয়েটা পরে হবে। এইকথা শুনে কানাঘুষা হলেও কিছুই করার ছিল না তাদের। অনুষ্ঠান শেষে কুহু ফিরে গিয়েছিল তাদের বাড়ি। বন্ধ করে দিয়েছিল সমস্ত যোগাযোগ। দেখা তো দূর কথাও বলত না রিদওয়ানের সঙ্গে। মেডিসিনও খেতো না। বাইরে বের হতো না। ধীরে ধীরে পূর্বের সমস্যাগুলো দেখা দিচ্ছিল। ভাইয়ের সামনে যেত না। আর ডাকলেও জবাব দিতো না। রুপক কতদিন বোনকে ডেকেছে। ডাকতে ডাকতে হাউমাউ করে কেঁদেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা ওর রুমের বাইরে বসে থেকেছে। এসবের জন্য নিজেকে দোষী ভাবতে বারণ করেছে। কিন্তু সে কারো কথায় শুনতো না। রিদওয়ান রোজ আসত। ডাকত। কথা বলার অনুরোধ করতো। রাত বিবেতে গাড়ি নিয়ে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। অন্ধকার বেলকনিতে বসে কুহু দেখত। রুপক বাড়ি না থাকলে রুম বের হতো সে। মাঝেমধ্যে মুখোমুখি হয়ে গেলে ডুকরে কাঁদত শুধু। মাফ চাইত বারবার। এভাবে দুইমাস পর হঠাৎ একদিন কুহু তার মাকে বলে, ‘আম্মু আমার শরীর ভালো নেই। আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাও। আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি আম্মু।’
একথা শুনে ইসমত আরা বেগম মেয়েকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তারপর তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। তখন আশার প্রদীপ হয়ে জানা যায় কুহু প্রেগনেন্ট। খবর শুনে দৌড়ে আসেন নিলুফা ইয়াসমিন এবং আতিকুল রহমান। রিদওয়ান তখন হতভম্ব। এত সর্তক থাকার পরেও কিভাবে সম্ভব? তাছাড়া ডাক্তার তাদের বারণ করেছিল মেডিসিন চলাকালীন কুহু যেন কনসিভ না করে। এতে বাচ্চার এবং মা দু’জনেরই ক্ষতি হতে পারে। এরপর রিদওয়ান সঙ্গে সঙ্গে’ই যোগাযোগ করে ডেইজির সঙ্গে। ডেইজি দুটো অপশন দেয় বাচ্চা এবোশন করতে হবে নয়তো মেডিসিন বন্ধ করতে হবে। কুহু জীবনেও এবোশন করতে রাজি হবে না। আর মেডিসিন বন্ধ করলে কুহুর সমস্যা বাড়বে। একথা শুনে রিদওয়ানের পাগলপ্রায় অবস্থা। খুঁজতে থাকে অন্য কোনো পথ। এবোশনের কথা চিন্তা করলে ওর বুক কেঁপে ওঠে। দম বন্ধ হয়ে আসে।
আবার কুহুর কথা ভাবলে মনে হয় এটাই বেস্ট অপশন। এভাবে ভাবতে ভাবতে কেটে যায় এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ পর সে হঠাৎ করে ছুটে আসে কুহুদের বাসায়। কুহু জানত না রিদওয়ান এসেছে। বমি করে ক্লান্ত হয়ে পানি নিতে বের হয়েছিল। ড্রয়িংরুমে কারো শব্দ না শুনে ধরে নিয়েছিল
বাসায় কেউ নেই। থাকলেও যার যার রুমে হয়তো। রুম থেকে বেরিয়ে পানি নিয়ে যেতে যেতেই রিদওয়ানের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। দৌড়ে গিয়ে দরজা আঁটকানোর আগে রিদওয়ানও দৌড় দেয়। দরজার ফাঁকে হাত রাখে কুহুর দরজা আঁটকাতে গেলে চাপা লাগে রিদওয়ানের হাতে। রিদ ব্যথাতুর শব্দ করে ওঠে। কাঠের দরজায় দুইআঙুল থেতলে গেছে। সেটা দেখে কুহু দরজা ছেড়ে দেয়। দুই পা পেছনে সরে যায়। রিদওয়ান রুমে ঢুকে হাত ঝাড়তে থাকে। ব্যথায় হাত টনটন করছে। কুহু হাতের জগটা এগিয়ে দেয় পানিতে হাতটা চুবানোর জন্য। রিদওয়ান হাসে। কষ্টমাখা হাসি ঠোঁটে এঁটে বলে, ‘শরীরের কষ্ট চোখে পড়ল? এতদিন যে ভেতরটা বিশ্রীভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল সেটা দেখলে কি করতে?’
কুহু মুখ ফিরিয়ে নিলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজা খুলে বের হতে গেলে রিদওয়ান আঁটকে দিলো। জাপটে ধরল শক্ত করে। কুহু মিনমিন করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
– ‘ এন্টিসেপটিক নিয়ে আসি হাতটা থেতলে গেছে, রক্ত ঝরছে।’
-‘লাগবে না।’
-‘না লাগলেও ছাড়ুন। সব সম্পর্ক চুকে বুকে গেছে। এখানে কি?’
-‘বললেই হলো চুকে বুকে গেছে? এখানে কি, মনেটা কি? আমার বউ বাচ্চা যেখানে আমিও তো সেখানেই থাকব, তাই না?’
-‘বাচ্চা শুধুই আমার। আর কারো না।’
-‘এ কেমন অবিচার? রাত জেগে পরিশ্রম করলাম আমি আর ফুল কেডিড নিবে তুমি?’
-‘বেহায়া কথাবার্তা না বলে ছাড়ুন আমায়। ভালো লাগছে না এসব।’
-‘একদিন ধরে বুকটা খাঁ খাঁ করছে। একটু থাকো না এভাবে? থাকলে কি হবে, বলো? ধরো জড়িয়ে ধরে থাকব। আর কিচ্ছু না, প্রমিস।’
কুহু এবার সত্যিই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুনতে থাকল দ্রুত গতিতে চলা রিদওয়ানের হার্টবিট। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর রিদওয়ান বলল,
-‘বমি কি খুব বেশি হয়? ডাক্তারের কাছে আর গিয়েছিলে?’
-‘(…)’
-‘চুপ কেন, কিছু বলো?’
-‘(…)’
-‘এখানে আমার কি দোষ বলো তো? কি করেছি আমি? আমাকে কেন শাস্তি দিচ্ছো তুমি? তুমি জানো, তোমাকে বুকে না জড়ালে আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। তুমি পাশে না থাকলে খেতে পারি না, কোনো কাজে মন বসাতে পারি না। তোমার অনুপস্থিতিতে রুম শূন্য শূন্য লাগে, দম বন্ধ লাগে আমার। আর এসব জানতে বলে এত কঠিন শাস্তি দিচ্ছো, তাই না? তবে একটাবার ভেবে দেখেছো শাস্তিটা আসলেই আমার প্রাপ্য কি না!’
-‘ বাসায় যান।’
-‘তুমিও চলো।’
-‘তাহলে আমার ভাইয়ের সুখ ফিরিয়ে দিন। হাসি ফিরিয়ে দিন।’
-‘আমি তোমার ভাইয়ার সুখ কেড়ে নিয়েছি? নাকি তাদের বলেছিলাম সম্পর্কে জড়াতে? তারা সম্পর্কে জড়ালো, বিয়ের কাহিনি করল, সরল মনে তাদের সাপোর্ট করেছিলাম আমি। যদি জানতাম রিমির মনে এসব ছিল তাহলে সাপোর্ট করতাম? নাকি বাবার অমতে এনগেজমেন্ট সেরে ফেলতাম? রুপক আমার বন্ধু। তাকে কি আমি ভালোবাসি না? কখনো মনে হয়েছে আমি তার খারাপ চাই? এসব ঘটনায় তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি। মনখুলে দু’টো কথা বলতেও পারি না, আমার কষ্ট লাগে না? খারাপ লাগে না? একবার আমার জায়গায় নিজেকে বসাও, মাথা ঠান্ডা করে ভাবো।’
-‘বমি পাচ্ছে আমার, সরুন।’
একথা বলে কুহু ছটফটিয়ে উঠল। রিদওয়ান ছেড়ে দিলো। কুহু দৌড়ে গেল ওয়াশরুমে। গলগল করে বমি করে, কুলি করে, মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল আড়াআড়িভাবে। রিদওয়ান বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে এসে কুহুর উপরে শুয়ে পড়ল। সম্পূর্ণ ভর দিলো না কুহুর উপর। শুধু কপালে আদুরে চুমু এঁকে বলল,
-‘এত সর্তক থাকার পরেও কীভাবে কী হলো?’
-‘ কনসিভ করার শখ জেগেছিল লোক ভাড়া করে এনেছিলাম।’
-‘ছিঃ! একথা কখন বললাম?’
-‘বলতে হবে কেন? কথার টোনেই তো সব বোঝা যাচ্ছে। কিভাবে কি? ডাউট করছেন আমাকে? এই ক’মাসে কারো সঙ্গে শুয়েছি নাকি জানতে চান, তাই তো? হ্যাঁ’ শুয়েছি, বেশ করেছি। যৌবন জ্বালায় জ্বলছিলাম কি না।’
-‘হায় আল্লাহ! এই পাগলকে নিয়ে আমি কই যাব? বলি এক, বুঝে আরেক।’
একথা বলে রিদওয়ান কুহুর গলায় মুখ গুঁজে দিলো। শ্বাস টেনে নিলো পরিচিত সেই ঘ্রাণ। তারপর ছোটো ছোটো চুমু এঁকে পাশে শুয়ে তাকিয়ে রইল কুহুর দিকে। কুহু চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে।
চোখের নিচে কালি। রাতজাগার চিহ্ন হয়ে ধরে দিচ্ছে। রিদওয়ান এক হাতে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে আর একটু এগিয়ে এলো। কুহুর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে আসন্ন ঝড় উঠবে জেনেও বলল,
-‘ কুহু! খুব ভালোবাসি তো। ঠিক কতটা ভালোবাসি উপলব্ধি করেছো কখন? বলো? তবে রাগ বাগ যা ইচ্ছে করো দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ!
ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়।’
-‘(…)’
-‘ডেইজির সঙ্গে কথা বলেছি। সে একটা উপায় বলে দিয়েছে।’
-‘কি উপায়?’
-‘এ..এবো..এবোশন।’
-‘ওহ।’
-‘করবে? আমার কাছে সবার আগে তুমি এরপর..! ‘
-‘(..)’
-‘আমরা পরেও আবার বাচ্চা নিতে পারব। তাছাড়া তোমার বয়স কম। কনসিভের দীর্ঘ জার্নিটা সামলে উঠতে পারবে না।’
-‘ইন্টিমেন্ট হওয়ার আগে মনে ছিল না, আমার বয়স কম? তখন ঠিকই তো হামলে পড়েছিলেন। বুঝে নিয়েছিলেন স্বামীর অধিকার। তখন যখন ভার্জিনি লস করতে এসব কিছু স্মরণ হয় নি, তাহলে আজ কেন? ওহো, দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছেন? নিতে কে বলেছে?’

রিদওয়ান হতভম্ব। শুধু হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কুহুর দিকে। একথা জবারে কী বলা উচিত ভেবে পাচ্ছে না সে। এমন তো না যে কুহুর সঙ্গে জোরাজুরিতে করেছিল বা কখনো করেছে। যা হয়েছে দু’জনের স্বেচ্ছায় সম্মতিতে। তাহলে আজ একথা কেন? কেন বার বার আঙুল উঠছে তার দিকে? কেন ছোট করছে তাকে? সে কি জানে না কুহুর এক একটা পিন মারা কথায় কতটা কষ্ট হচ্ছে তার। কুহু তার স্ত্রী। ভোগ্যপন্য নয়। কখনো রুডলি স্পর্শও করে নি কখনো। বরং তাকে খুশি রাখতে সর্বদা অপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। অথচ কুহু তাকে খোঁচা মারতে গিয়ে নিজেকে বারবার
ছোট করে ফেলছে। মোদ্দাকথা, এই বোকা মেয়েটাকে কে বোঝাবে যে,
কনসিভ আর ইন্টিমেন্টের ধকল এক নয় নিশ্চয়ই! ইন্টিমেন্টের ধকল ছিল ক্ষণিকের আর কনসিভের দখলটা দীর্ঘ দশ মাসের।রিদওয়ান উঠে বসল। এসে থেকে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু কুহু এমন এমন কথা বলছে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়ছে। তবুও সে
ধৈর্য্য ধরে আছে। অতঃপর সে কষ্টমাখা হাসি ঠোঁটে এঁটে বলল,
-‘ ফিরে চলো।’
-‘ বার বার ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন কেন? বললাম তো, যাব না আমি। ওহ বুঝেছি, শরীরে টান পড়েছে বুঝি?’
-‘শরীরের টান টাকার বিনিময়েও মেটানো যায়। মনের টানের কি করব? আর এভাবে কথা বলিও না কুহু, নিজেকে এখন পুরুষ ভাবতেও প্রচন্ড ঘৃণা লাগছে। আজ নিজের জন্য আফসোসও হচ্ছে, বউয়ের শরীর ছুঁতে পারলেও তার মনটা ছুঁতে পারি নি। মন ছুঁতে পারলে হয়তো এমন ঘৃণ্য কথাগুলো আজ শুনতে হতো না।’
-‘আমি খারাপ। আমার কথাবার্তা ঘৃণিত। আমার কাছে তো না আসলেই হয়।’
রিদওয়ান উঠে দাঁড়াল। এরপর দরজার দিকে যেতে যেতে জবাব দিলো,
-‘কেন আসি, বলার অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়ই? তবে তুমি মানুষটা খুবই ছোটো। কিন্তু তোমার কথার ধাঁচ আমার হৃদয় এফোড় ওফোড় করার দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।’

To be continue……..!!