আমার চন্দ্রাবতী পর্ব-২৫

0
765

#আমার_চন্দ্রাবতী
লেখিকা- সালসাবিল সারা

২৫.
–“ইন্টার শেষ করো,এরপর বাড়িতে নিয়ে যাবো আমার বউ করে।”
মনের গহীনে কথাটি বিঁ’ধে আছে বাজেভাবে।দিন গেলো,সপ্তাহ গেলো,মাস গেলো,অথচ মনের মাঝে এই কথাটির তীব্রতা কমলো না।বরং বারংবার সেই লোকের কথাটি হাতছানি দিচ্ছে মেয়েটির অন্তরে।দুআ হাতের আঙুলে হিসাব কষলো।লোকটা গ্রাম ত্যাগ করলো ঠিক পাঁচমাস তিনদিন পূর্বে। তার ফিরে আসার কোনো নাম নিশানা নেই।এইদিকে মানবী চলন্ত ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছে না।মনের মানুষটার কথা বড্ড মনে পড়ছে প্রেয়সীর।এতদিন না এসে কিভাবে পারলো সেই পাষাণ লোকটা! খেলার জন্যেই লোকটা এতো ব্যস্ত।একটার পর একটা সিরিজ/টি টোয়েন্টি/টেস্ট খেলতে ব্যস্ত সেই পুরুষ।দেশ বিদেশে ঘুরছে তাই।মাঝে দিয়ে এক মাস ডালিয়াকে নিয়ে বাহিরের দেশে চিকিৎসার জন্যে গিয়েছিলো।অস্ত্রোপচারের পর, ডালিয়া এখন সুস্থ হয়েছেন।একমাত্র ছেলে হওয়ায় সবকিছু নিজেরই দেখতে হয়।লোকটা তার সকল কর্ম একা হাতেই সামলাতে প্রস্তুত। শুধু এই অসহায় দুআর জন্যেই হয়তো তার কোনো সময় নেই!মনটা আঁধারে ছেয়ে গেলো রমণীর। ফোনে খোঁজ খবর নেওয়া আর বাস্তবে এসে সম্মুখে খোঁজ খবর নেওয়া সম্পূর্ণই আলাদা বিষয়।
দুআ চায়,ইয়াদ আসুক।এসে নিজের সবটা দিয়ে দুআর অভিমান ভেঙে গুঁড়িয়ে দিক।নিজেকে অনেক বুঝাতে চাই সে,লোকটা ব্যস্ত।কিন্তু,পরক্ষণে তার মনে ভাবনা আসে;সবার জন্যে সবটা করতে পারলে দুআকে একনজর দেখতে আসা কি এতটাই দুষ্কর?এতটাই কঠোর?অভিমানী প্রেমিকার অভিমানের পাল্লা ভারী হয়।
মুঠোফোন বন্ধ করে রেখেছে আজ দুদিন যাবত।অতীতের স্মৃতি তাই আজকাল বেশি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মনের অন্তরালয়ে।মাইশা দুইদিন যাবতই ফোন হাতে এসেছিল দুআর নিকট।বিনিময়ে দুআ ফিরিয়ে দিয়েছিল ভাবীকে।সেই কঠোর মনের পুরুষের সাথে কথা বলতে নারাজ দুআ।
ক্লাস শেষ, অথচ কোনো হুঁশ জ্ঞান নেই মেয়েটার।রামিসা চিমটি কাটলো দুআর হাতে।ব্যথায় বিরক্তি নিয়ে তাকালো সে রামিসার পানে,
–“চিমটি কাটলি কেনো?”
–“কোথায় হারিয়েছিস?”
রামিসা সন্দেহভাজন দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো।
–“তোর শ্বশুরবাড়িতে।”
দুআ উঠে ব্যাগ চাপলো কাঁধে।
মাহি ভনিতা করে বলে উঠলো,
–“ছি ছি রামিসা।আমাদের না বলেই শ্বশুরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিস?আজব মানুষ।”
দুআ সম্মুখে হাঁটছে।পেছনে দুজন ঝগড়া করার তালে এগিয়ে আসছে দুআর নিকট।সঞ্জয় প্রথম বেঞ্চের কিনারায় দাঁড়িয়ে রইলো।তিন বান্ধুবী এলে চারজন হলো এক জোট।

–“দুআ,তাসনিমের কি খবররে?”
সঞ্জয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
–“জেলে এখনো।”
দুয়ার শান্ত জবাব।
–“বেইল হবে না?”
পুনরায় প্রশ্ন করলো সঞ্জয়।
–“কেনো রে মিস করছিস ঔ শাঁক’চুন্নিকে তুই!
আজব।”
মাহি মুখ বাঁকালো।

–“আরে না।ইয়াদ ভাই আর রিজোয়ান ভাই সেই কেইস ঠুকেছে।এতো জলদি বের হবে না।আর বের হলেও চাচী আর কখনো আমাদের সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস পাবে না।ইয়াদ ভাই আর রিজোয়ান ভাইয়ের সামনে এলেই তার বিপদ নির্ধারিত।”
রামিসা উত্তর দিলো সবলীলভাবে।

দুআ নিরব দর্শকের মতো কর্ণধারণ করছে সব।সেই জ’ঘন্য মহিলার ব্যাপারে ভাবতেও দুআর বিবেকে বড় ধরনের বাঁ’ধা আসছে।

ঝালমুড়ির চার ঠোঙ্গা নিয়ে সঞ্জয় গোল চত্বরের বাম পাশে অবস্থানরত তিন রমণীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।একে একে তাদের হাতে ধরিয়ে দিলো ঝালমুড়ির ঠোঙা।
মুখে ঝালমুড়ি পুরতেই সঞ্জয় দুআর নিকট প্রশ্ন ছুড়লো পুনরায়,
–“দুইমাস পরে ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম।তোর নায়ক তোকে প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি অবস্থায় রেখে গিয়েছিল।তুই দ্বিতীয় বর্ষে উঠলে তবেই উনি পুনরায় আসবে।এটাই কি উনার টার্গেট?”
দুআ সঞ্জয়ের পানে চেয়ে রইলো।দৃষ্টিতে তার উদাসীনতা।ফিচেল কণ্ঠে জবাব দিল,
–“জানিনা।”

–“তোদের মাঝে সব ঠিক আছে তো,আজব?”
মাহির প্রশ্নে দুআ কিছু বলতে চাইলো কিন্তু রামিসা তাকে বলতে না দিয়ে নিজেই মুখ কুচঁকালো আর বলে,
–“ওদের আবার কি হবে?নায়িকা রেগেছেন নায়কের অনুপস্থিতির কারণে।ভাইয়া যে ব্যস্ত এটা এই মেয়ে বুঝে না।”
–“হ্যাঁ,দুনিয়ার সব কাজ করতে পারে।শুধু আমার বেলায় যতো খামখেয়ালী?আমি কি বাচ্চা?আমি কিছু বুঝিনা?উনি আমাকে ভুলে গিয়েছেন।”
দুআর কণ্ঠে অভিমানী ছাপ।
–“বাজে বকিস না।ইয়াদ ভাইয়া জানলে তোর অবস্থা দুরবস্থা করবে,আজব।”
মাহির কপালে ভাঁজ পড়লো।
–“উনি আমাকে চিনে না এখন।বাহিরের অনেক সুন্দর মেয়ের পাশে এই দাগযুক্ত দুআ কিছুই না।উনি আমাকে ছাড়া ভালো আছেন।”
ঝালমুড়ির প্রতি অনীহা দেখিয়ে দুআ কথাটা বলেই উঠে পড়লো ঝালমুড়ির ঠোঙা সঞ্জয়ের হাতে ধরিয়ে।সম্মুখে পা ফেলতেই শুনলো রামিসার ফোন বাজছে।তাতে দুআর কি?সে থামলো না।এলোমেলো পায়ে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা।অভিমানের পাল্লাটা কমছে না কেনো?লোকটাকে ভিডিও কলেও আর দেখতে ইচ্ছা করে না দুআর।সামনাসামনি তার নিকটে থাকতে প্রেমিকার মনটা বড্ড আনচান করছে, তা কি সে খেলোয়াড় লোকটা বুঝে?বুঝে না।

হঠাৎই দুআ খেয়াল করলো রামিসা তার কানে ফোন চেপে ধরলো। বাঁকা নয়নে রামিসা দুআর উদ্দেশ্যে বললো,
–“জরুরী ফোন।”
দুআ মোবাইল ধরলো।তবে,রামিসা মোবাইল দিয়ে একপ্রকার পালিয়ে গেলো যেনো।দুআ ক্ষীণ দৃষ্টিতে রামিসার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো কেবল।মেয়েটা তার বাকি বন্ধুগণের নিকট থামলো।

–“আসসালামুআলাইকুম,কে?”
দুআর মলিন স্বর।
–“ইয়াদ।”
দুআ নীরব।এই লোকটার কণ্ঠ শুনলো সে ঠিক দুদিন পর।দুআর নীরবতা আন্দাজ করতে পেরে ইয়াদ পুনরায় কিছু বললো।এইবার ইয়াদের কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট,
–“খবরদার যদি ফোন কেটে’ছো।আমাকে তোমার কি মনে হয়?আমি নাচছি দেশ বিদেশে?কি পরিমাণ স্ট্রেসে আছি জানো তুমি?এতো রাগ/জিদ কাকে দেখাচ্ছো?ভুলে যাচ্ছো,আমার রাগ দেখে তোমার অবস্থা কি হয়েছিলো!তোমার উপর আমার রাগ ঝারলে সেই রাগে গুঁড়িয়ে যাবে তুমি।বাসায় গিয়ে মোবাইল চালু করবে।অনেক নাটক করেছো তুমি।”
শেষের কথাটা যেনো দুআর ভেতরটা চুরমার করে দিলো।সে নাটক করছে?কেমন নাটক?প্রেমিক পুরুষকে দেখতে চাওয়ার আকাঙ্খা তার কাছে নাটক মনে হয়?জলরাশির আগমন হলো।শুভ্র মুখে রক্তিম আভা।টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক বিন্দু অশ্রু।গলাটাও ভারী ভারী।কথা যেনো এই গলা দিয়ে কিছুতেই বেরুবে না আজ।

দুআর নিশ্চুপ আভাসে,ইয়াদের রাগ তিরতির করে বাড়ছে।অতঃপর রাগ সঞ্চার করতে না পেরে বাজখাঁই গলায় সে বলে উঠলো,
–“স্পিক আপ,দুআ!আদারওয়াইজ,আমি তোমার সামনে এলে টেনে হিচঁড়ে আমার বাসায় নিয়ে আসবো।তোমার বাবা-মা বা ভাই কারো পরোয়া আমি করবো না তখন।”
দুআর কান্নার বাঁধ ভাঙলো।ঝাপসা নজরে নিরাপদ বসার জায়গা খুঁজে সেথায় চললো মেয়েটা।কলেজের মাঝে দাঁড়িয়ে কান্না করাটা বড্ড বেমানান।অশ্রু সংযত করে কোনোভাবে মেয়েটা আওড়ালো কয়েক বাক্য,
–“আমি যাবো না আপনার কাছে।কখনোই যাবো না।আমার সবকিছু আপনার কাছে যদি নাটক মনে হয়,
তাহলে নাটকই শ্রেয়।”

কান্নারত প্রেমিকার কণ্ঠে রাগের পরিমাণ যেনো হ্রাস পাচ্ছে প্রেমিক পুরুষের।মেয়েটাকে বেশি কথা শুনিয়ে দিয়েছে সে?ভেতর থেকে উত্তর এলো না কোনো।তবে এইবার কণ্ঠস্বর বড্ড মোলায়েম হলো ইয়াদের,
–“তাই চন্দ্র!আসবে না আমার কাছে?ঠিক আছে এসো না।তবে আমি এইবার তোমার কাছে আসলে একেবারের জন্যে নিয়ে আসবো। কারো কোনো বাঁধা, নির্দেশনা আমি কিছুই মানবো না।”
–“বললেই হলো?আমি যাবো না।আপনি কি জোর করবেন?”
দুআর কান্নার ভাব কমছে।
–“আলবৎ করবো।শুধু জোর না উঠিয়ে আনবো। ইয়াদকে চেনো না তুমি।”
ইয়াদ হাসলো নিশব্দে।তার প্রেয়সী জানেই না,
কথোপকথনে একজনের রাগ কমেছে তো আরেকজনের অভিমান।
–“ইয়াদকে চেনার দরকার নেই আমার।ইয়াদ আমাকে ছাড়া ভালোই আছে।এতো সুন্দরীর ভিড়ে এই দুআ কিছুই না।”
মুখ বাঁকালো প্রেয়সী।
–“তারপর?”
ইয়াদের হাসি এবার অট্টহাসি।
–“মজা নিচ্ছেন আপনি আমার?হাসি দিয়েই বুঝা যায়,মানুষ কতো সুখে আছে।এইযে আমি দুঃখী,আর আপনি সুখী।”
দুআ মুখে হাত রাখলো।তার হাসি পেলো হঠাৎ।
–“এতো উদ্বিগ্ন দেখা করার জন্যে?ভুলে যেও না শেষ কথাটা কি ছিলো?পরবর্তী দেখায় ভালোবাসার স্পর্শে ছুঁয়ে দিবো সম্পূর্ণ মুখশ্রী,বাদ যাবে না মুখের নি’ষিদ্ধ জায়গাটাও।তাই তোমার চেয়ে আমার অবস্থা বেশি খারাপ হচ্ছে দেখা করার জন্যে।বুঝতেই পারছো,আমি কতটা ব্যাকুল,তোমার সামনে যেতে।”
দুআ লজ্জা পেলো না।বরং ভরকে গেলো তৎক্ষণাৎ,
–“এইসব খেজুরে আলাপ আপনি নিজের কাছেই রাখুন।দেখাসাক্ষাৎ এর খবর নেই,আপনি আছেন অন্যতালে।আপনি বেশ খা’রাপ।”
–“কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই।বিদায়কালে কি কি বলেছ আমার সবকিছু মনে আছে।আমি তোমার সামনে বসে থাকবো।এরপর দেখবো,তুমি কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকো।তুমি কি ভেবেছো,পাঁচমাস দেখা হয়নি বলে সব ভুলে গেলাম আমি?”
ইয়াদ কথা বলার ছলে বিছানায় শুয়ে পড়লো উপুড় হয়ে।

–“নিশ্চয় সব কথা ফোনে রেকর্ড করেছিলেন সেদিন?”
–“ফোনে না হৃদয়ে রেকর্ড করেছিলাম,চন্দ্র। ইউ ডোন্ট নো, হাউ মাচহ আই মিস ইউ!একবার দেখা পায় তোমার,আই প্রমিজ সকল রাগ পুষিয়ে দিবো।”
এইবার প্রেমিকা একদম অভিমানমুক্ত হলো।ভালো’ লাগা আর লাজে তার গালখানা যেনো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
–“রাখছি আমি।আর হ্যাঁ,আমি মোবাইল একদমই চালু করবো না;যতদিন না আপনি নিজ থেকে এসে আমার সামনে আসবেন।ভালো থাকবেন আর নিজের খেয়াল রাখবেন দয়া করে।রাখছি।”
দুআ ফোন কে’টে দিলো।উত্তেজিত প্রেমিকার নজর দেখলো না,ইয়াদ তার বাংলাদেশী সিম থেকে ফোন দিয়েছে।

দুআর সকল অভিমান গললো বরফের ন্যায়।তবে সে মনে মনে ঠিক করেছে,এতো সহজে সে ঐ লোকের সামনে ধরা দিবে না।দুআর মনে অশান্তির স্থলে জমা হলো শান্তি।লোকটা তার কিছুই ভুলেনি।তার নিবেদিত একটা বুলিও লোকটার অন্তর থেকে মুছেনি।দুআ হাসলো।প্রাণ খুলে হাসলো।ইয়াদের জন্যে তৈরিকৃত অনুভূতি,দুআর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর পবিত্র অনুভূতি।

বান্ধুবির মন ভালো দেখে সকলের মুখশ্রীর অবস্থা পুনরায় হাস্যোজ্বল হলো।একে অপরের নিকট বিদায় নিয়ে যে যার যার স্থানে দিলো রওনা।
ড্রাইভার এবং অন্য কর্মচারীর সাথে এখন জেনিও আসে দুআকে কলেজ থেকে নিতে।ইদ্রিস জমিদারের নির্দেশ এটা।শত্রু তার যেভাবে বাড়ছে,একমাত্র মেয়ের প্রতি যতো সচেতন হওয়া প্রয়োজন ঠিক ততটাই সচেতন হচ্ছে সে।
.
বট গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ইশফাকের অবয়ব।হাত তার মুষ্টিবদ্ধ।দুআর নাগাল সে কোনোকালে পাবে বলে মনে হয় না।রাগে,অভিমানে হুঁশ খোয়ায় সে।কিন্তু,কিছু যে করার নেই।তার বাবাও ইদ্রিসের হুমকিতে নুয়ে পড়েছে।ইশফাকের আফসোস হয় দুআ কেনো একা একা আসা যাওয়া করে না।মেয়েটাকে বিছানায় নেওয়ার একটা মাত্র ইচ্ছা তার। সেই ইচ্ছা আর এই জনমে পূরণ হবে বলে অন্তরে শায় দিচ্ছে না ইশফাকের।তবে ইশফাক মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,এই বাবা বা মেয়ের মধ্যে যেকোনো একজনের ক্ষতি সে করবেই। যেমনই ক্ষতি হোক না সেটা।মৃত্যু পর্যন্তও গড়াতে পারে সেই ক্ষতি।ইশফাক হাসলো নিভৃতে।

————————————-
ইয়াদের সতর্ক বার্তার মধ্যেও দুআ নিজের পরিকল্পনায় অটল।সে মোবাইল চালু করেনি একটিবার।যতো দরকারি কথা ছিল,সব সেরেছে সে মাইশার ফোনে।আগে তার অভ্যাস ছিলো তন্দ্রা কে’টে যাওয়ার পরপরই মোবাইল হাতড়ে প্রেমিকের পাঠানো ভালোবাসায় সিক্ত মেসেজ দেখার।কিন্তু, এখন সেই অভ্যাসের পরিবর্তন হলো।ঘুম থেকে উঠেই দুআ আল্লাহ্ এর নিকট দোয়া করে,লোকটা যেনো দ্রুত তার সাথে সাক্ষাৎ করে।মনটা যে একেবারে খাঁ খাঁ করছে সেই লোককে দেখা ব্যতীত।
গোসল সেরে নিচে নামলো মেয়েটা।বসার ঘরে তার বাবা,রিজোয়ান উপস্থিত।দুইজন দুই প্রান্তে বসে আছে।কথার শব্দ নেই কোনো।

খাওয়ার টেবিলে যেতেই আহেলী,মাইশা,বড় কাকী সকলে তার দৃষ্টিতে এলো।দ্রুত সেথায় পা বাড়ালো দুআ,
–“কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে?”
–“ঢাকায় যাবো। ডালিয়া ফোন করেছে।সবাইকে যেতে বললো। বড় দাওয়াত নাকি।”
বড় কাকী নাস্তা মুখে পুরে দিয়ে বললো।দুআর মনে কোনো ভাবনা নেই।মা যেতে বললে যাবে,নয়তো না।এমনিও যে মানুষটার অপেক্ষা করছিল সে,মানুষটাই তো দেশে নেই।অগত্য দুআ যাক বা না যাক এই নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই আপাতত।চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে দুআ আওড়ালো,
–“কে কে যাচ্ছো?”

–“কে কে যাচ্ছো মানে?ছোট আব্বা ছাড়া সবাই যাচ্ছে।”
মাইশা হেসে বললো দুআর প্রশ্নে।

–“ওহ আচ্ছা।আমি আর বড় কাকীর তো গিয়েই একদিনের বিশ্রাম দরকার হবে।তাই অযথা গিয়ে শরীর খারাপ করে কি লাভ?”
দুআ মন খারাপ করে বললো।কারণ,সেথায় গেলে যে প্রেমিক পুরুষের জন্যে মনটা আরো ব্যাকুল হয়ে উঠবে।তার ঘর,তার বাড়ি,তার সবকিছু,অথচ সেই নেই।এই শূন্যতা দুআকে সম্পূর্ণ গ্রাস করবে বলে মনে হলো প্রেয়সীর।

–“এই চুপ।আমরা একদিন আগেই যাচ্ছি।মাইশা বিয়ের পর আর যায়নি মামীর বাসায়।তাই আমরা দাওয়াতের একদিন আগেই যাবো।ডালিয়া সব সুন্দর করে পরিকল্পনা করেছে।রাতভর বিশ্রাম নিলে সব অসুস্থতা পালাবে।”
বড় কাকী পুনরায় জবাব দিলো।
–“তুমি যাবে না,এই কথাটি ভুলেও বলবে না।কতো মানুষ তোমার জন্যে অপেক্ষায় আছে। ফোনটাও চালু করছো না।”
মাইশার চালাকি জবাব।
–“ফোন চালু করে কিই বা হবে?আমি জানি,সেই কতো মানুষ একমাত্র মারিয়া।বাদ দাও সেইসব।আমরা কখন যাবো?”
দুআ প্রশ্ন ঘুরালো অন্যথায়।
–“আজ বিকালে।”
–“আজকেই?”
দুআ চমকালো কিঞ্চিৎ।
–“হ্যাঁ।তুই আজকে এত প্রশ্ন করছিস কেনো? সাধারণত কোথাও যাওয়ার নাম নিলেই তোর অস্থিরতা কমে না।আজ কি হলো?”

মাইশা হাসলো বিকট শব্দে,
–“ছোট আম্মা,তুমি জানো না তোমার মেয়ের কষ্ট।”

দুআ কিঞ্চিৎ লজ্জিত আবার বেশ ভরকে গেলেও বটে।মাইশা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে!

দুআর আঁখির আয়তন ছোট হলো,
–“ভাবী,অসহায় মানুষের সাথে মশকারি কিন্তু ভালো না।”
–“উম,সরি সরি ননদিনী।”
মাইশা পুনরায় হাসলে দুআ নিজেও হেসে উঠলো।মাইশা আসার পর দুআর প্রাণ খুলে হাসার তীব্রতা বাড়লো শতগুণে। বাড়িতে মেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি হলে বাড়িটা সর্বদা কলরবে ভরপুর থাকে।এইযে মাইশা আসার পর,দুই মেয়ে মিলেই সারা বাড়ি হইচই করে মাতিয়ে রাখে সর্বক্ষণ।
——————————
ইদ্রিস জমিদার ব্যতিত দুআ এবং বাকি সবাই ঢাকায় পৌঁছালো রাত বারোটা নাগাদ।প্রায় সাত ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়েছে তাদের ঢাকায় পৌঁছাতে।সবার সাথে কুশল বিনিময়ের ইতি টেনে দুআ শুয়ে পড়লো মারিয়া সমেত।চোখ জোড়া বুঁজে আসছে তার ক্লান্তিতে।এক পর্যায়ে ক্লান্তির ভারে নুইয়ে পড়লো ভারী নেত্রপল্লব।প্রশান্তির তন্দ্রায় শায়িত হলো মেয়েটা।

দুআ তন্দ্রায় শায়িত হতেই মারিয়া মুঠোফোনে ফোন লাগালো। অপর পাশ হতে কল রিসিভ করতেই মারিয়া ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“ভাইয়া,চাঁদ ভাবী ঘুমিয়ে পড়েছে।”

মারিয়ার বুলিতে ইয়াদের অধরে দেখা মিললো নিশ্চয়তার হাসি,
–“এসির পাওয়ার বাড়িয়ে রেখো।বেশি ঠান্ডায় ওর সর্দি হয়।”
–“ঠিক আছে ভাইয়া।”
মারিয়া মৃদু হেসে ফোন রাখলো।অতঃপর দুআর তনু ঢেকে দিল তুলতুলে কম্বলে। এসির পাওয়ারটাও বাড়িয়ে দিলো মারিয়া।ভাইয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা যেনো মারিয়ার ফরজ কাজগুলোর মাঝে অন্যতম!

হুট করেই খুললো দুআর নেত্রপল্লব। অশ্রুসজল নজরে চারিদিকে দৃষ্টি জ্ঞাপন করছে রমণী।খানিক পূর্বে সে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো,মাঝরাতে ইয়াদের মতোই একজনের অবয়ব এসেছিল এই কামরায়।সেই অবয়বের স্পর্শ দুআর ললাট আর হাতে এখনো অনুভব করছে যেনো।অথচ সেটা ছিলো কেবলই স্বপ্ন।ইয়াদকে স্বচক্ষে দেখার তৃষ্ণায় এতো তৃষ্ণার্ত প্রেয়সী,সে ঠাহর করতে পারছে না কিছুই।স্বপ্নটাও তার বাস্তবের লাহান লাগছে।কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্ন।তীব্র তন্দ্রার ঘোরে সেটাও তার বাস্তবের ন্যায় মনে হচ্ছে বারংবার।দুই আঁখির বাঁধ ভাঙলো।অশ্রু লেপ্টে যাচ্ছে গালে।এই মুহূর্তে লোকটার সাথে কথা বলা ভীষন জরুরী প্রেয়সীর।নাহলে যে দম ফেলাটাও দায় লাগছে তার!

প্রেমিক পুরুষের জন্যে আজ ভেতরটা তোলপাড়।সেই তোলপাড়ের শব্দ যেনো বাহির থেকেও শ্রুতিমান!

মারিয়া বাথরুম থেকে বেরুতেই দুআ উঠে বসলো। গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুজল হাতের উল্টোপিঠে মুছতেই ভাঙ্গা স্বরে মেয়েটা অনুরোধ করলো মারিয়াকে,
–“তোমার ভাইয়াকে একটা ফোন দিবে,মারু?আমার মোবাইলটা আনা হয়নি।”
–“আরে ভাইয়া তো…”
মারিয়া নিজের বাক্য শেষ করলো না।মনে হলো,মেয়েটা এক বড় বোমা ফাটাতে যাচ্ছিলো এই মুহূর্তে।নিজেকে সংযত করে পুনরায় সে বললো,
–“অবশ্যই চাঁদ ভাবী।একটু অপেক্ষা করো।”

মারিয়া ফটাফট কল লাগলো ইয়াদকে,
–“ভাইয়া,চাঁদ আপু তোমার সাথে কথা বলবে।”

মারিয়া মুঠোফোন দিলো দুআর হাতের মুঠোয়।মুচকি হেসে কামরা ত্যাগ করলো মারিয়া।

–“হ্যালো,চন্দ্র?বলো?”
ইয়াদ প্রশ্ন করতে ব্যস্ত এবং তার প্রেয়সী ব্যস্ত প্রেমিকের কণ্ঠস্বর শুনে ফুপিয়ে কান্না করতে।

–“এই মেয়ে?কি হলো?কান্না করছো কেনো?”
ইয়াদের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
–“আপ..আপনি চলে আসুন না,ইয়াদ।আমার ভালো লাগে না তো।এইযে আপনার বাসায় এসেছি,মনে হচ্ছে চারিদিকে আপনি আর আপনি।কিন্তু সত্যিকারে নেই আপনি।আমার সহ্য হচ্ছে না এই দহন।”
দুআ কান্নার বেগ বাড়লো।
–“আমি আসলে কিন্তু,বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হবে;চন্দ্র।পাঁচমাস দেখা না হওয়ার শোধ আমি কিন্তু তোমায় দেখতে পেলে সাথে সাথেই তুলে নিবো।তখন আমাকে যেনো কেউ নির্ল’জ্জ না বলে।”
ইয়াদের কণ্ঠে ঠাট্টার সুর।
–“উম,আমি কিছুই বলবো না।চলে আসুন না আপনি।আমি সত্যি কিচ্ছুটি বলবো না আপনাকে।আমি শুধু আপনার অস্তিত্ব অনুভব করতে চাই।”
মোলায়েম হলো প্রেমিকের হৃদয়।প্রেমিকার বক্তব্যে ইয়াদ ফিচেল কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“অতি শীঘ্রই চমকে যাবে তুমি।চেয়েও বাহুডোর থেকে মুক্তি পাবে না।”
ইয়াদের কণ্ঠে গোয়েন্দার আভাস।

অনুষ্ঠান জাঁকজমোক।অতিথির আগমন আরম্ভ।

জিয়া পরিবারের স্বজনদের সাদরে গ্রহণ করছে।অতিথির মাঝে একজনকে দেখে আঁখি চিকচিক করলো জিয়ার।মানুষটার সামনে গিয়েই এক হাত নাড়িয়ে বলে উঠলো,
–“ইশফাক!কত্তদিন পরে এসেছো এই বাসায়।আঙ্কেল,
আন্টি আসেনি?”

চলবে…..