আমার তুমি পর্ব-১৩+১৪

0
380

#আমার তুমি
#পর্বঃ১৩

তুলতুলের পুরনো একটা স্বভাব। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে নিজের হ্মতি করে ফেলে। সায়ানকে ওভাবে কথা শোনানোর পর থেকেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না তুলতুল। বারবার সায়ানের বিধস্ত চেহারাটা ভেসে উঠছে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কেনো এমন দোটানায় পড়লো তুলতুল? কেনো এখানে আসতে গেলো?
ফ্লোরে হাঁটু মুরে বসে নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ে তুলতুল। হাতে মুখে অজস্র নখের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে। এতেও শান্ত হয় নি। ড্রেসিং টেবিলের ওপরে থাকা নতুন ব্লেট টা নিয়ে ইচ্ছে মতো হাতে আঘাত করে। আঘাত গুলো খুব গভীর না তবু চামড়া কেটে গেছে। গলগল করে রক্ত ঝড়ছে।

“আমি কি করবো? কেনো আসলেন আমার জীবনে আপনি? আমাকে শেষ করে দিলেন। আমি মানসিক রোগি হয়ে যাচ্ছি। জীবনটা থেমে গেছে আমার। বাঁচার ইচ্ছে গুলোও মরে যাচ্ছে।
আমি বাবাকে কখনোই কষ্ট দিতে পারবো না। ইফাদকে ঠকাতে পারবো না। তিনটা বছর ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন উনি। আমি স্বার্থপর হতে পারবো না। আমার বাবা আমাকে সার্থপর হতে শেখায় নি।
আপনাকে ওভাবে কথা না শোনালে আমি আমার পিছু ছাড়তেন না। মাফ করে দিয়েন আমায়।

কান্না করতে করতে বিরবির করে তুলতুল।

🥀🥀🥀🥀

সারা রাত বাসায় ফেরে নি সায়ান। সকাল বেলা ঢুলুঢুলু পায়ে বাসায় ফেরে। মমতা বেগম দরজা খুলে দেয়। সায়ানকে দেখে বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে ওনার।

” ভাই কি হয়েছে তোর?
সায়ানের বুকে হাত রেখে বলেন উনি।

“আমি খাবো দাদু। আমাকে খাইয়ে দাও

বলে সায়ান ড্রয়িং রুমে থাকা সোফায় গা এগিয়ে দেয়। শানও ভাইয়ের চিন্তায় সারা রাত ঘুমায় নি। সুমুও ঘুমায় নি। সোহেল মিয়া আর সাহেদা বেগমকে ওরা বলেছে সায়ান বন্ধুর বাসায় গেছে। তাই তারা নিঃচিন্তে ঘুমিয়েছে।

শান মলিন মুখে ভাইয়ের পাশে এসে বসে।
সুমু সায়ানের পায়ের কাছে হাঁটু মুরে বসে। সুমুর চোখ দুটো ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। এখনো পানি টলমল করছে দুই চোখে।
কলিং বেলের আওয়াজেই ওরা ছুটে এসেছে।
সায়ান ভাই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে।

” ভাইয়া তোর কষ্ট হলে আমাদেরও কষ্ট হয়। কি হয়েছে তোর বল?
কাল তুলতুল ওইভাবে বাসায় আসলো। কাউকে কিছু না বলে দরজা দিয়ে দিলো। তুইও বাসায় ফিরলি না।

সায়ান হাতের ইশারায় সুমুকে কাছে আসতে বলে। সুমু ফুঁপিয়ে কেঁদে ভাইয়ের কাছে এসে ভাইকে জড়িয়ে ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে।

“আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না রে। ওকে বল না আমার হতে। আমাদের সুন্দর একটা পরিবার হবে। বোঝা না ওকে।
সায়ান ধরে আসা গলায় বলে।
সায়ানের কথা শুনে সুমুর কান্নার আওয়াজ বেরে যায়। কতোটা ভালোবাসলে মানুষ এভাবে বলতে পারে।

” সব ঠিক হয়ে যাবে ভাইয়া।
শান সায়ানের মাথার কাছে কাঁথা ঠেকিয়ে বলে।
তিন ভাইবোনই একটা মেয়ের জন্য কাঁদছে।
এদের চোখের পানির মূল্য কি দিতে পারবে তুলতুল? পাবে কোথাও এতোটা ভালোবাসা?

মমতা বেগম খাবার নিয়ে আসে।

“তোরা কাঁদছিস কেনো?
দাদিকে দেখে সবাই শান্ত হয়ে যায়। সায়ান উঠে বসে।

মমতা বেগম সায়ানের পাশে বসে। দুপুর আর রাতে কেউ কিছুই খায় নি। উনি ভাত মেখে তিনজনকেই খাইয়ে দেয়।

দুপুরে তৌফিক রহমান আসে। তুলতুল বাবা আসার খবর পেয়ে গোছল করে নিজেকে পরিপাটি করে রুম থেকে বের। তৌফিক রহমানের ঠোঁটের কোনে লেগে আছে এক চিলতে হাসি।

সোফায় আয়েশ করে বসে সোহেল মিয়া মমতা বেগম আর সাহেদা বেগমের সাথে কথা বলছে।
শান আর সুমু একটু দুরে দাঁড়িয়ে আছে।

” ইফাদ দিয়ে গেলো আমাকে। একদম ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ কিনে লান্স করিয়ে দিয়ে গেছে। কপাল করে এতো ভালো জামাই পেয়েছি আমি।

তৌফিক রহমান দশটা কথা বললে তার মধ্যে নয়টা ইফাদকে নিয়ে। খুব বিরক্ত লাগছে সুমু আর শানের।

তুলতুল গুটিগুটি পায়ে বাবার পাশে এসে বসে। মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে নেয় তৌফিক রহমান। কতোদিন পরে দেখলো।

“তোমাকে আমি একটা কথা বলতে চাই আমি।

মমতা বেগম বেশ রয়েসয়ে বলে।

” হ্যাঁ বলুন না।
তৌফিক রহমান এক গাল হেসে বলে।

“আমার সায়ান ভালোবাসে তুলতুলকে। বিয়ে করতে চায় ওকে।

তৌফিক রহমানের হাসিমাখা মুখটা চুপসে যায়। কেঁপে ওঠে তুলতুল। বুকটা ধুপধাপ করছে।

“আমার মেয়ের বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে।

” বিয়ে তো হয়ে যায় নি। খুব ভালো থাকবে তুলতুল এখানে। ভাই একটু দয়া কর। তুলতুলকে ছাড়া আমার আব্বা ভালো থাকবে না।
সাহেদা বেগম কেঁদে ফেলে।

তৌফিক রহমান উঠে দাঁড়ায়। রাগে চোয়াল শক্ত করে ফেলে।
“আমারই ভুল হয়েছে এখানে ওকে পাঠানো। তোদের চিন্তা ভাবনা এতোটা নিচে। তোরা এতো সার্থপর। আমি ভাবতে পারছি না৷
একটু দম নিয়ে আবার বলে।

“আমার মেয়ের শশুড় বাড়ি দেখেছিস? বিশাল বাড়ি। আর তোরা তো এখানে ভাড়া থাকিস। কতো বড়ঘড়ে আমার মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছি আন্দাজও করতে পারবি না। এরকম আবদার করার আগে ভেবে দেখলি না?
কি আছে তোদের?
বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার শখ?
রাগে কাঁপছে তৌফিক রহমান। তুলতুল মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে।

লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে সাহেদ বেগম হোসেন মিয়া আর মমতা বেগম।

” আংকেল এতো অহংকার ভালো না। আমার ভাইয়া সরকারি চাকরি করে। আমাদেরও বাড়ি আছে। ভাইয়া আর বাবার চাকরির সুবিধার্থে এখানে থাকি আমরা। এতোটা টাকার লোভ ভালো না। তুলতুল ভাইয়ার সাথে ভাো থাকবে।
বলো তুলতুল?
শান চোখ মুখ শক্ত করে বলে।

“চুপ করো তুমি। কতো বড় সাহস। ছি ছি ছি
আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছো।
আমার তুলতুল ইফাদের সাথে ভালো থাকবে। কোন দিক দিয়ে তোমার ভাই ইফাদের থেকে ভালো বল আমায়।
তেড়ে এসে বলে তৌফিক রহমান।
ভয় পেয়ে যায় সবাই।

” আমি ইফাদকে পছন্দ করি। ওর সাথেই ভালো থাকবো সুখে থাকবো। তোমরা কেনো আমাকে ফোর্স করছো?
তুলতুল বাবার হাত ধরে থামিয়ে শক্ত গলায় বলে।

চমকে ওঠে সাহেদা বেগম সোহেল মিয়া মমতা বেগম সহ সবাই।

“তুলতুল তুই
সাহেদা বেগম বলতে যায়। তুলতুল বলতে দেয় না।

” বাবা চল এখান থেকে। আমি আর এক মুহুর্তও এখানে থাকবো না। চলো তুমি

তুলতুল তৌফিক রহমানের হাত ধরে টেনে বলে।

“আর আপনাদের সাইকো ছেলেকে বলে দেবেন। কখনো যেনো তার ছায়া টাও আমায় দেখতে না হয়। ঠিক মতো মানুষ করতে পারো নি তুমি ফুপি। এখন একটু চাপকে সিধে করো। নাহলে ভবিষ্যতে তুলতুল কেনো রাস্তার পাগলরাও তার দিকে ফিরে তাকাবে না।

বলেই তুলতুল রুমে চলে যায়।

” সাহেদা ভালোই ফাঁদ পেতেছিলি। বিয়েতে কিন্তু সবাই যাবি তোরা। তোদের দেখাবে আমার মেয়ের শশুড় বাড়ি। পরিচয় করিয়ে দেবে আমায় জামাইয়ের সাথে। দেখি কতো বড় বাড়ি। এমপির ছেলে বুঝলি। পুরো জেলায় আমার একটা নাম ডাক হয়েছে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে যাস।

সাহেদা বেগম তাচ্ছিল্য হাসে।

“তুই আজকে আমাদের অপমান করলি। এমন দিন আসবে তুই নিজে আমাদের পায়ে পড়বি।
তুই শুধু শাসনই করতে পারিস। তুলতুল ঠিকি অভিযোগ করতো। একটুও ভালোবাসা দিতে পারিস নি তুই আর ভাবি। মেয়ের চোখ দেখেও বুঝতে পারলি না। কতো কিছু বলছে ওই চোখ।

” চুপ থাক তুই। আমার মেয়েকে আমার থেকে বেশি কেউ চেনে না৷ আমার জন্য আমার মেয়ে সব করতে পারে। এমনটাই শিখিয়েছি ছোট থেকে।

তুলতুল দরজার আড়াল থেকে সবটা শোনে।
দুচোখ ভর্তি পানি থাকার পরও ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

“এতো কেনো বুঝো তুমি আমায় ফুপি? তুমি আমার মা হলে খুব কি হ্মতি হতো?

সায়ান এতখন নিজের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিলো সবটা। তাচ্ছিল্য হাসে সায়ান।
” পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট মানুষটা আমি। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমার জন্য আমার বাবা মা দাদি অপমানিত হলো। ভালোবাসা কোথা থেকে কোথায় এনে দাঁড় করালো আমায়।

সায়ান মনে মনে খুব ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।

তুলতুল লাগেজ নিয়ে আসতেই
তৌফিক রহমান তুলতুলের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে তুলতুল সায়ানের রুমের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এক পলক দেখার ইচ্ছা জেগে ছিলো মনে।

“ভালোবেসেছিলাম আপনাকে, আপনার পাগলামি গুলোকে।
কিন্তু আমার নিয়তি আর ভাগ্য আমাদের এক সাথে থাকতে দিলো না।

আর হয়ত কখনো দেখার হবে না। এখানেই হয়ত থেমে গেলো সায়ান তুলতুলের অসমাপ্ত ভালোবাসা।

সবাই ধম মেরে গেছে। কি হয়ে গেলো এটা?
হঠাৎ সায়ানের রুম থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ আসে। ওরা তো ভুলেই গেছিলো সায়ান বাড়িতে।

শান দৌড়ে সায়ানের রুমের দরজার কাছে যায়। দরজা বন্ধ।
এক্সট্রা চাবি এনে দ্রুত দরজা খোলে শান।
সবার আগে সায়ানের রুমে মমতা বেগম ঢোকে।

“ভাইইইইইইইইই রে
বলেই পড়ে যায় মমতা বেগম।
সায়ানের হাত থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। হাতের শিরা কেটে ফেলেছে। পাশেই এক পাতা ঘুমের ঔষধ ফাঁকা পড়ে আছে।

ওরা হতবাক হয়ে গেছে। সুমু চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে যায়। দরজা খুলে আশেপাশের বাড়ির লোকজনদের ডাকে।

সাহেদা বেগম সোহেল মিয়া হতবাক হয়ে গেছে। কিছু বলা করা করার মতো অবস্থা তাদের নেই।

শান এম্বুলেন্স কল করে।

দাদিমা আর সায়ানকে হাসপাতালে পাঠিয়ে শান ছুটে তুলতুলের কাছে। সায়ান যদি ঙ্গান ফিরে তুলতুলকে দেখতে চায়। তুলতুলকে না দেখে যদি আবার ভুল কিছু করে বসে। এটা হতে দেবে না শান। তুলতুলকে ফিরিয়ে আনবেই।

খুব দ্রুত গতিতে বাইক চালাচ্ছে শান। হঠাৎ একটা টাক এসে ধাক্কা মারে শানের বাইকে।
ছিটকে পড়ে যায় শান। মাথাটা গাছের সাথে বাড়ি খায়।

চলবে

#আমার তুমি
#পর্বঃ১৪
#তানিশা সুলতানা

গাজিপুর বড় শপিং মলের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ইফাদ করে তৌফিক রহমান শপিং মলে গেছেন। বাড়ির সবার জন্য কিছু কিনতে। তুলতুলকে অনেক জোর করলেও ও যেতে নারাজ। তাই ওনারা বাধ্য হয়েই তুলতুলকে রেখেই চলে গেছে।
তুলতুল জানালা দিয়ে ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনের মধ্যে কু গাইছে। শপিং মলের সামনের বড় কড়ই গাছে একটা কাক বসে কা কা করছে।
কাকের ডাকটা কলিজায় গিয়ে বিঁধছে তুলতুলের। এ যেনো এক অশুভ সংকেত। যদিও তুলতুল এসবে বিশ্বাসই না। তবুও কেনো জানি আজকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে কাটা তুলতুলকেই উদ্দেশ্য করে কিছু বলছে। কিন্তু তুলতুল সেটা বুঝতে পারছে না।

আচ্ছা সায়ান ঠিক আছে তো?
বুকের পা পাশে হাত দেয় তুলতুল। ওই মানুষটার যেনো কিছু না হয়। পৃথিবীর সব সুখ ওই মানুষ টার হোক।

ওই বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে আর কাঁদে নি তুলতুল। মনকে বুঝিয়েছে। আশা ছাড়ে। অগাধ বিশ্বাস আবার সবটা ঠিক হয়ে যাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

“যে তোমার নয় তাকে শত শক্তি দিয়েও
ধরতে রাখতে পারবে না…..
তাই আমিও দুরে চলে গেলাম।
হোক না সেটা অনিচ্ছায়,
তবে ভেবো না আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি
আমি বিশ্বাস করি,
একদিন আবার সবটা ঠিক হয়ে যাবে।
আমি তোমার #আমার তুমি হয়ে থেকো যাবো
ইনশাআল্লাহ

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুলতুল।
ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয় সবটা। আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর নাইলে কারো শক্তি নেই সবটা ঠিক করার।

🥀🥀
দুই ছেলে আর মা কে আইসিসিউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিন জন মানুষেরই জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। কোনো বাবা মায়ের পহ্মেই এটা মেনে নেওয়া সম্ভব না। কিন্তু সাহেদা বেগম শক্ত হয়ে বসে আছে। কাঁদছেন না উনি। যেনো পাথর হয়ে গেছে।
খুব ইচ্ছে কাউকে দোষী বলার। কাউকে ইচ্ছে মতো কথা শুনিয়ে নিজেকে একটু শান্তনা দেওয়ার।
কিন্তু কাকে দোষ দেবে?
তুলতুলকে না কি নিজের ভাগ্যকে?
ভাগ্যে এমনটা ছিলো বলেই এমনটা হয়েছে। তুলতুল তো শুধুমাত্র একটা নমুনা।

তবে এমনটা না হলেও পারতো।
এক্সিডেন্ট করার পরেই ট্রাকটা পালিয়ে যায়। রাস্তায় থাকা মানুষরা শানকে দেখতে পায়।
রাস্তায় কর্মরত মানুষরা শানকে ধরে হাসপাতালে এনেছে। সায়ানের ফোনের কল লিস্ট থেকে নাম্বার খুঁজে সুমুকে কল করে। ভাগ্য ক্রমে শানকে ওই হাসপাতালেই আনা হয় যেখানে সায়ান আর মমতা বেগম ছিলো।

সুমু বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। যখন শুনেছে শান এক্সিডেন্টে করেছে তখন থেকে আরও ভেঙে পড়েছে। কলিজার টুকরো দুই ভাইকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারছে না।

“ওই মেয়েটা কোনোদিনও ভালো থাকবে না।
সোহেল মিয়ার কথা শুনে কেঁপে ওঠে সাহেদা বেগম। এতখন পাথরের মতো বসে থাকা মানুষটা ডুকরে কেঁদে ওঠে।

” এটা তুমি কি বলছো? এভাবে বলো না।
সোহেল মিয়ার মুখ চেপে ধরে বলে সাহেদা বেগম।
উওর দেয় না সোহেল মিয়া। হাসপাতালের করিডোরে হাঁটু মুরে বসে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে।

কালকেও তো সবটা ঠিক ছিলো আজকে কেনো সব তছনছ হয়ে গেলো? এটা কি হয়ে গেলো? কেনো হলো এমনটা?

একটু পরে পরপর তিনটে ইমারজেন্সি কেবিনের লাইট বন্ধ হয়ে যায়। দৌড়ে এগিয়ে যায় সোহেল মিয়া আর সাহেদা বেগম। বিষন্ন মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন ডাক্তার।
ডাক্তারকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না কারোরই।

শান মাথায় খুব গুরুতর আঘাত পেয়েছে। হাঁটা চলা করতে পারবে না অনেকদিন। কবে কথা বলতে পারবে এটাও ডাক্তার শিওর বলতে পারছে না।
সায়ান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে এখন ভালো আছে।
কিন্তু মমতা বেগম আর পৃথিবীতে নেই।

দুনিয়া থেমে যায় সাহেদা বেগমের আর সোহেল মিয়ার।কি করবে অসহায় দুজন বাবা মা বা অসহায় দুজন সন্তান। এই মুহুর্তে ওনাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। কাঁধে হাত রেখে বলার মতো কেউ নেই যে “ভেঙে পড়ো না সবটা ঠিক হয়ে যাবে”

সাহেদা বেগমের এই মুহুর্তে পরিবারকে খুব দরকার। দুই ভাই দুই ভাই ওনারা। এখনো মা বাবা বেঁচে আছে।

হাউমাউ করে কাঁদছে সুমু সোহেল মিয়া আর সাহেদা বেগম। সায়ানের এখনো ঙ্গান ফেরে নি।
ডাক্তার ঘুমের ঔষধ দিয়েছে ওকে। কাল সকালের আগে আর ঘুম ভাঙবে না।

কেউ চিরকাল পৃথিবীতে থাকবে না। জন্ম যখন নিয়েছি মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই ভোগ করতে হবে। তবুও আমরা প্রিয়জনের মৃত্যু সয্য করতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে কান্না আসে। কিন্তু আমরা বুঝতেই চায় না কান্না করলে ওই মানুষটা আর ফিরবে না।

দুই ছেলেকে হাসপাতালে রেখে মায়ের লাশটা নিয়ে মানিকগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সাহেদা বেগম আর সোহেল মিয়া। সুমুকে রেখে যায় ভাইদের খেয়াল রাখার জন্য।

সুমুরা যেখানে ভাড়া থাকে সেই বাড়িওয়ালার মেয়ে নিশা আর ছেলে শোভন সুমুর সাথে থেকে যায়। ওনারা যখন জানতে পেরেছে শান আর সায়ানের তখনই ছুটে চলে এসেছে।
শেষ পর্যন্ত পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে দেখে সুমুর কান্নার গতি বেরে যায়।
আজকে কোথায় গেলো আশিক? কেনো আসলো না ও? ও কি জানে না? কিন্তু সুমু তো ওকে কল করেছিলো রিসিভ করে নি। অনেক গুলো টেক্সট করেছে। রিপ্লাই পায় নি।
বিপদ দেখে পালিয়ে গেলো?
আশিকের প্রতি মনের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি হয় সুমুর।

মমতা বেগমের বরাবরের ইচ্ছে ছিলো স্বামীর পাশে নিজের কবরটা হবে। মায়ের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়েই নিজেদের বাড়ির দিকে ছোঁটে ওনারা। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছিলেন তিনি।
সায়ানের জন্মের পর সায়ানকে বুকে আগলে রেখেছেন। স্বামী হারানোর ব্যাথাটা সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে গেছিলেন।

মমতা বেগমের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা কানাডা থাকে। একদিনের মধ্যে সে আসতে পারবে না। শেষ বার মায়ের সামনে থেকে দেখতে পারে না তিনি। শুধু দুর থেকে ভিডিও কলেই দেখেছে।

🥀🥀🥀
তুলতুল গ্রামে গিয়ে একদম শান্ত হয়ে গেছে। যদিও তুলতুল আগেও শান্ত ছিলো। সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না। ইফাদ ডিরেক্টলি না করে দিয়েছে পড়ালেখার ব্যাপারটা। বলে দিয়েছে আর পড়তে হবে না তুলতুলকে।
মা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। বাবা হাই স্কুলের টিচার। শিক্ষি বাবা মায়ের সন্তান হওয়ার পরও বাবা মা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারলো

দাদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলো তুলতুল। দাদি তুলতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

“তুই খুব ভাগ্যবতি রে ছেমড়ি। এতো ভালো বর পাচ্ছিস।

তুলতুল তাচ্ছিল্য হাসে।

” যদি আমি ভাগ্যবতী হয় তাহলে বলবো
এমন লাইফ যেনো কারোর না হয়…
বলেই তুলতুল এক দৌড়ে চলে যায়।

আয়শা বেগম তুলতুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

🥀🥀🥀

পনেরো দিন চলে গেছে। শান এখন কথা বলতে পারে। কিন্তু বেশিখন বসে থাকতে পারে না। হাঁটতে পারে না। সায়ান পুরোপুরি সুস্থ।
একদম পাল্টে গেছে সায়ান। গম্ভীর, প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না।
কথায় কথায় হাসে না। যেনো হাসতেই ভুলে গেছে সায়ান।
দাদিমার মৃত্যুটা আরও বেশি দাগ কেটে গেছে সায়ানের মনে।
শানকে এখনো জানানো হয় নি দাদিমার মৃত্যুর খবরটা।

শান আর সুমুর পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে। সুমুর চোখের নিচে কালি জমে গেছে। পনেরো দিনে অনেকটা শুকিয়ে গেছে।সায়ান দুই ভাই বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
যখনই শান একটু খানি বসে ঢলে পড়ে যায় সুমু কেঁদে ওঠে। শান মুখে খাবার নিয়ে যখন গিলতে পারে না সুমু হাউমাউ করে কাঁদে। দাদিমার কথা মনে পড়লেও কেঁদে ওঠে। ঘুমের ঘোরেও সায়ান ভাইয়া বলে চেঁচিয়ে ওঠে।

সোহেল মিয়া অফিসে গেছেন। সাহেদা বেগম রান্না করছে।
সায়ান ঘুমন্ত দুই ভাই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

“আমার বোনকে মানসিক রোগী বানিয়েছিস তুই। আমার ভাইকে মৃত্যু যন্ত্রণা উপভোগ করিয়েছিস। আমার দাদিমাকে মেরে ফেলেছিস।
আমাদের জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছিস। এখন তোকে আমি ভালো থাকতে দেবো?

মরণ হয়ে আসবো তোর শহরে। আমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছিস তার থেকেও তিনগুণ বেশি কষ্ট দেবো তোকে।
প্রতিটা সেকেন্ডে তোকে মৃত্যু যন্ত্রণা উপভোগ করাবো আমি।
এতোদিন আমার ভালোবাসা দেখেছিস। এখন ঘৃণাটাও দেখবি।
বিয়ে করাচ্ছি তোকে। এমন বিয়ে করাবো না সারা দুনিয়া মনে রাখবে বেইমান + হিরো ইফাদের বিয়ের কথা।

হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে সায়ান।
চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে রক্ত জমেছে। কপালের রগ টানটান হয়ে ফুলে উঠেছে। নাকটা ফুলিয়েছে।
সেবা মিলিয়ে ভীষণ ভয়ংকর লাগছে সায়ানকে।

চলবে