আমার নিঠুর মনোহর পর্ব-৩০ এবং প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি

0
202

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ত্রিশ

পরিক্ষার হলে ঢুকতেই হল সুপারের সাথে জোরেশোরে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে যায় নিহা৷ মাটিতে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়ে উপরে তাকাতেই ভুলে যায়। এমনিতেই আজ হলে ঢুকতে দেরি হয়ে গেছে। অলরেডি পরিক্ষার খাতা ও প্রশ্ন দিয়ে দেওয়া হয়েছে সবাইকে। নিহা কোনরকমে দৌড়াদৌড়ি করে ভেতরে ঢুকে। আর এমন সময় কারোর সাথে ধাক্কা লাগাতেই মেজাজ বিগড়ে যায়। হাতের ব্যাথা জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে ঝাড়ি মে’রে বলে উঠে,
“কোন শালা রে! দেখে চলতে পারিস না? চোখ কই থাকে, শালি নাগিন? তো…!”
বাকি কথাটুকু বলা শেষ করার আগেই উপরে তাকাতেই নিহার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে ভয়ে চোখ দুটো মার্বেলের মতো বড় হয়ে গেলো। কলিজাটা মনে হয় এক্ষুনি বের হয়ে আসবে। মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু চারদিকে একবার নজর বুলালো। সবাই ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। শুধু তারিনের চোখে মুখে ভয়। কারণ নিহার সামনে স্বয়ং হল সুপার দাঁড়ানো। এই লোকটাকে পরিক্ষার প্রথম দিন থেকে দেখে আসছে। একদম গম্ভীর, রাগী স্বভাবের লোক। নিজের অবস্থানে খুব স্ট্রং ও সৎ। তারিন নিহার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠল,
“ওরে নিহু! আজ তুই শেষ। এইজন্যই বার বার বলি নিজের মুখটাকে একটু কন্ট্রোল করতে। এখন কি হবে? যদি নিহার পরিক্ষা বাতিল করে দেয়?”
ভেবেই তারিন ভয়ে আঁতকে উঠল। নিহা ভয়ে ঢোক গিলছে। ভয়ে কান্না করে দেওয়ার উপক্রম। কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। হল সুপারের নাম নেওয়াজ। নেওয়াজের মুখে প্রচন্ড রাগ আর জেদ। নিহাকে ভয় পেতে দেকে নেওয়াজ নিজের রাগটাকে গিলে ফেলল। রাগী স্বরেই বলল,
”উঠো।”
নিহা তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে আবার পড়ে যেতে নিলেই নেওয়াজ ধরে ফেলে। নিহাকে কোনোরকমে দাঁড় করিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
”পরিক্ষা শুরু কয়টায়?”
নিহা ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়,
”দশটায়।”
নেওয়াজ পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
”এখন কয়টা বাজে?”
নিহা হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকায়। দেখলো সময় প্রায় দশটা বিশ। তাই ভয় ও অসহায় চোখে নেওয়াজের দিকে তাকালো একবার। মিনমিনে স্বরে বলে উঠল,
”দশটা বিশ।”
নেওয়াজ সঙ্গে সঙ্গে বলল,
”এতক্ষণ লেট হলো কেনো?”
নিহা উত্তর দিলো,
”স্যার, আমাদের গাড়ি অর্ধেক পথে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমাকে ভীষণ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। অনেক কষ্টে এখানে এসেছি।”
নিহা ভেবেছিলো ধাক্কা লাগায় নেওয়াজ বেশ রেগে যাবে। বকাবকি করবে হয়তো। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে নেওয়াজ ঠান্ডা স্বরে বলল,
”তাড়াতাড়ি গিয়ে সিটে বসো।”
তারপর পরিক্ষার রুমে থাকা গার্ডদের বলল,
”উনাকে তাড়াতাড়ি খাতা আর প্রশ্ন দিন।”
বলেই বের হয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার থেমে গেলো। বলল,
”উনাকে এক্সার্টা দশ মিনিট দিবেন।”
তারপর নিহার উদ্দেশ্যে মিনমিন করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল,
”শুনো ওটা শালি হবে না। শালা হবে। নেক্সট টাইম ঠিক করে নিও। ঠিক আছে? যাও এখন।”
বলেই সে ধপধপ করে পা ফেলে চলে গেলো। আর নিহা কিছু সময় থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পরিক্ষার কথা খেয়ালে আসতেই তাড়াতাড়ি গিয়ে সিটে বসে।



পরিক্ষা শেষ করে তারিন নিহার থেকে সবটা শুনে দুজনে হাসতে হাসতে হেলেদুলে পড়ছে। তামজিদ এখনো আসেনি। তাই নিহা আর তারিন রাস্তার পাসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে আর দুজনে গল্প করছে। তারিনের শরীর আজ সকাল থেকেই বড্ড খারাপ লাগছে। শুধু আজ না বেশ কয়েকদিন যাবৎ তারিনের মাথা যন্ত্রণা বেড়ে গেছে। শরীর ও বেশ দূর্বল লাগে ইদানীং। এক মাস হলো পরিক্ষা চলছে। তারিন এতদিন এই শরীর খারাপটাকে এত পাত্তা দেয়নি। কাউকে বুঝতেও দেয়নি। তানহা কয়েকদিন হলো শশুড় বাড়ি গিয়েছে। পরিক্ষার পড়া, সংসার সামলানো সব তারিনের একা হাতে করতে হচ্ছে। তাই তারিন ভেবেছিলো হয়তো এইজন্য শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু দিন দিন শরীর খারাপ বেড়েই চলেছে। তাই তারিনের এবার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। পরিক্ষা এখনো ২টা বাকি। তারপর প্রাকটিকাল ও বাকি আছে। সব মিলিয়ে তারিনের এবার নিজেকে অসহায় লাগছে। মনে মনে চিন্তা করল একবার ডাক্তার দেখাতেই হবে। ভাবলো আজ তামজিদকে সবটা বলবে। তারিনকে হঠাৎ চুপ করে যেতে দেখে নিহা হালকা ধাক্কা মে’রে বলল,
”কিরে, তুই কোন জগতে হারিয়ে গেলি?”
তারিন হালকা হেসে বলল,
“কোথাও না। বল।”
নিহা তারিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু হয়েছে তোর?”
তারিন হাসলো। জবাব দিলো,
“কি হবে?”
নিহা পুনরায় বললো,
“মুখটা শুকনো লাগছে। চোখ গুলোও কেমন লাগছে। শরীর খারাপ?”
তারিন বলল,
“না। রাত জেগে পড়েছিলাম তো। তাই ঘুম আসতাছে।”
নিহাও বিশ্বাস করে নিলো। ওদের কথার মাঝেই তামজিদ সেখানে এসে উপস্থিত হয়। এসেই তারিনের গালে হাত রেখে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“শরীর ঠিক আছে?”
তারিন হেসে ফেললো। এই মানুষটা চোখ দেখে মনের কথা বুঝে ফেলে সবসময়। তারিন বলল,
“একদম ঠিক আছি, জনাব। চলুন যাই এবার। ”
তারপর নিহাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ওরাও বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।



বাসায় আসতে আসতে দুটো বেজে গেছে। তারিন বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে আমজাদ সাহেবকে খাবার দিয়ে, রুমে গিয়ে গোসল সেরে নিলো। নামাজ পড়ে গিয়ে সবার জন্য খাবার টেবিলে সাজাতে সাজাতে তারিনের মনে হচ্ছে ওর চারদিক ঘুরছে। কোনোরকমে চেয়ারে মাথা ধরে বসে পড়লো। এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে গিলে ফেললো। নিজেকে নিয়ে দ্বিধা দন্ডের মাঝে হুট করে তারিনের খেয়াল হলো ওর পিরিয়ডের ডেট আরো ৪/৫দিন আগেই পেরিয়ে গেছে। এই নিয়ে দুইমাস যাবৎ পিরিয়ড হচ্ছে না___কথাটা মনে হতেই তারিনের বুক কেঁপে উঠল। মস্তিষ্ক জানান দিলো এক নতুন বার্তা। তারিনের মন বলছে তারিনের জীবনে নতুন কেউ আসতে চলেছে। তারিনের দেহে আরেকটা দেহের সৃষ্টি হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই তারিনের হাত ওর পেটের উপর চলে যায়। অজানা এক ভালো লাগা শরীর ছুঁয়ে যায়। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে ভাবলো,
“আমার ছোট্ট প্রাণ আসছে তবে?”
কিন্তু যখনি সংসার, পড়ালেখা নিজের স্বপ্নের কথা মাথায় আসলো তখনি তারিনের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। তামজিদের কথা স্মরণ হতেই ভয় শুরু হলো। তামজিদ এখন কিছুতেই এই খবরে খুশি হবেনা। তামজিদ প্রতিবার নিজ দায়িত্বে তারিনকে পিল খাইয়েছে। কিন্তু গত দুইমাস যাবৎ তারিন একটা পিলও খায়নি। ইনিয়েবিনিয়ে তামজিদের থেকে নিয়ে সেগুলো ওয়াশরুমে ফেলে দিয়েছে। এসব তামজিদ জানতে পারলে তুলকালাম বাজাবে। তারিন বসে বসে ভাবনায় পড়ে গেলো কি করবে এখন? কার সাথে শেয়ার করবে এসব? তানহাও নেই। কি করবে ভেবে না পেয়ে নিহাকে সব বলার জন্য ধাতস্থ হলো। তামজিদ খাবার রুমে এসে তারিনকে এমন আনমনে হয়ে ভাবতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
”কি ভাবছো এভাবে? পরিক্ষা ঠিকঠাক দিয়েছো?”
তারিন ধড়ফড়িয়ে উঠল। হেসে জবাব দিলো,
”হ্যাঁ হ্যাঁ। ”
তামজিদের কেমন যেনো তারিনের আচরণে সন্দেহ হচ্ছে। সন্দিহান স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
”তুমি কি ঠিক আছো?”
তারিন আগের ন্যায় মেঁকি হেসে বলল,
”হ্যাঁ ঠিক আছি। খাওয়া শুরু করুন।”
তামজিদ ভাত মাখতে মাখতে পুনরায় আগের ন্যায় জিজ্ঞেস করলো,
”তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো?”
তারিন ভয়ে ভয়ে হাসলো। বলল,
”আরে না। কি লুকাবো? সব ঠিক আছে, জনাব।”
অত:পর একটু চুপ থেকে এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠল,
”মাস্টার মশাই, আমরা পরিক্ষা শেষ হলে সাজেক যাবো। নিয়ে যাবেন, প্লিজ। আমরা তো বিয়ের পর কোথাও ঘুরতে যাইনি।”
তারিনের বাচ্চামো স্বর শুনে তামজিদ হাসলো। বললো,
”নিয়ে যাবো। আগে পরিক্ষাগুলো শেষ করো। তারপর অল্পদিনের জন্য গিয়ে ঘুরে আসবো। কারণ আবার এডমিশনের জন্য কোচিং শুরু হয়ে যাবে তোমার। আমি ভালো একটা কোচিং সেন্টার খুঁজে রাখবো। পরিক্ষা শেষ হলেই ভর্তি করে দিবো। এই এডমিশনের জার্নিটা অনেক কঠিন হবে, মনে রেখো কিন্তু। তাই আগের থেকেই মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখো।”
তারিন কথাগুলো শুনে আরো এক ধাপ ভয়ে মুচড়ে গেলো। খাবার গলা দিয়ে নামছে না। গা গুলিয়ে আসছে বার বার। অদ্ভুত একটা বিদঘুটে গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। কিন্তু তামজিদ সামনে দেখে তারিন কোনোরকমে খাবার গুলো পানি দিয়ে দিয়ে গিলে শেষ করলো।



রাতের সব কাজ শেষ করে, তারিন বই নিয়ে পড়তে বসলো। তামজিদ বিছানার উপর নিজের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু আজকে তারিন কিছুতেই পড়ায় মন দিয়ে পারছেনা। নিহাকে বিকেলে সবটা বলেছে। নিহা বলেছে কাল সকালে একটা প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে আসবে টেস্ট করার জন্য। সকাল কখন হবে সেই চিন্তায় ঘুম হবে না আজ বেশ বুঝতে পারছে। পরিক্ষা আবার ৩দিন পর। তাই তামজিদ বলে উঠল,
”এখন আর পড়তে হবেনা। এমনিতেই সকালে উঠে সব কাজ করেছো, রান্না করে সব গুছিয়ে রেখে আবার পরিক্ষা দিতে গিয়েছো। আবার এসে এত কাজ করলে এখন এসে শুয়ে পড়ো। কাল জাহেলা আপাকে ফোন করবে দেখবে সে কবে আসবে। নয়তো তোমার উপর অনেক চাপ পড়ে যাচ্ছে। ”
তারিন প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। শুধু ছোট্ট করে,
”ঠিক আছে।”
বলে বই গুছিয়ে রাখলো। বিছানা ঝেড়ে দুজনে একসাথে শুয়ে পড়লো। তামজিদ তারিনকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
”ঘুমাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
তারিন চোখ বন্ধ করে নিলো ঠিকি। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা। বরং হাসফাস লাগছে।



সকালে নামাজ পড়েই তারিন কিছুক্ষণ পড়ালেখা করে নিত্যদিনের মতো কাজে লেগে পড়লো। সারারাত ছটফটিয়ে পার করেছে। সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রাখলো। এর মাঝে নিজে এক কাপ চা খেয়ে নিলো। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। তামজিদের কাজ আছে তাই আগেই নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় তারিনকে বার বার সাবধান করে দিয়ে গেছে। আমজাদ সাহেবকেও বলে গেছে একটু খেয়াল রাখতে। তামজিদ চলে যেতেই তারিন নিহাকে কল দিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে বলে। প্রায় এক ঘন্টা পর নিহা আসে। তারিনকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দেয়। সাথে বলে,
“চিন্তা করিস না। যা হবে ভালোর জন্য হবে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”
আধাঘন্টা হবে তারিন এখনো ভেতরেই। এদিকে নিহা চিন্তায় হাসফাস করতে করতে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে,
”তুই ঠিক আছিস, তারু? এখনো বের হচ্ছিস না কেনো?”
ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ না আসাতে নিহা আরো ভয় পেয়ে যায়। তারিন ঠিক আছে কিনা এই ভেবে চিন্তায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এর মধ্যেই তারিন দরজা খুলে বের হতেই নিহা আগে কয়েকটা ঝাড়ি মে’রে রাগ ঝেড়ে নিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
”কিটটা কোথায়?”
তারিন নিহার সামনে কিটটা ধরতেই দেখলো সেটা পজেটিভ দেখাচ্ছে। দেখেই নিহা খুশিতে লাফিয়ে উঠে তারিনকে জড়িয়ে ধরে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
”আমি খালামনি হমু, দোস্ত। আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! এক্ষুনি দুলাভাইরে একটা ফোন দিয়ে খুশির খবরটা দেই।”
তারিন নিশ্চুপ হয়ে আছে। ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে। এটা কষ্টের কান্না না। খুশির কান্না। মা হওয়ার খুশি। নতুন প্রাণ দেহে বয়ে বেড়ানোর খুশি। এই খুশির কাছে দুনিয়ার সব দু:খ, বেদনা, ভয় কিছু না। সব ভয় যেনো এক নিমিশেই হাওয়া হয়ে গেলো। তারিন নিহাকে বলল,
”বাসায় আসুক৷ সারপ্রাইজ দিবো। এখন বলার দরকার নেই।”
নিহাও সেটা বুঝলো। অনেকক্ষণ তারিনের সাথে গল্পগুজব করে ফোন আসতেই বাসায় চলে গেলো। তারিন খুশিতে দিশেহারা হয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভাবলো তামজিদকে একটা বড়সড় সারপ্রাইজ দিবে। তাই সব কাজ শেষ করে গোসল করে নিলো। তামজিদের পছন্দের রঙের একটা শাড়ি পড়লো। চুলগুলো ছেড়ে রাখলো পিঠ জুড়ে। হাতে চুড়ি পড়লো ম্যাচিং করে৷ হালকা পাতলা সেজে নিলো। তামজিদকে ফোন করে জানতে পারলো তামজিদ রাস্তায় আছে। তাই ড্রয়িং রুমে বসে দরজার বেল পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।


প্রায় আধাঘন্টা পর দরজার বেল পড়তেই তারিন তড়িঘড়ি করে গিয়ে দরজা খুলতেই তামজিদ অবাক হয়ে গেলো। বিস্ময়ে চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেলো মুহূর্তেই। একবার তারিনের উপর থেকে নিচ অব্দি দেখে বিস্মিত স্বরে বলে উঠল,
”মাশ-আল্লাহ! আকাশের চাঁদ আমার ঘরে নেমে এসেছে আজ।”
বলেই তারিনের কপালে বড় করে চুমু খেলো। পুনরায় বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
”কি ব্যাপার? আজ এভাব আমার হার্ট দূর্বল করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছো কেনো?”
তারিন হাসলো উত্তর দিলো না। তামজিদের হাতের ব্যাগের টা এনে টেবিলে রাখলো। তামজিদ দরজা লাগিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তারিন এক গ্লাস পানি সামনে দিয়ে বললো,
”একটা গুড নিউজ দেওয়ার আছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিন। তারপর দিবো।”
তামজিদ গ্লাসের পানিটুকু শেষ করতেই তারিন গ্লাসটাকে রেখে তামজিদের সামনে যেতেই তামজিদ তারিনকে কাছে টেনে তারিনের নাকে নাক ঘষে বলল,
”আমাকে পাগল করার ধান্দায় নেমেছো?”
তারিন হাসলো। বলল,
”পুরানো পাগলকে নতুন করে পাগল করার কি আছে?”
তামজিদ হেসে তারিনের ঘাড়ে মুখ গুঁজতেই তারিন ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দিয়ে বলল,
”তাড়াতাড়ি যা বলেছি তা করুন৷ আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা।”
তারপর তামজিদকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে জামাকাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলো। তামজিদের গোসল, নামাজ শেষ হতেই তারিন তামজিদকে টেনে বেলকনিতে নিয়ে গেলো। তারিনের হাত দুটো পেছনে। তামজিদ সেদিকে খেয়াল করে জিজ্ঞেস করে,
”এবার বলো কি গুড নিউজ?”
তারিন লাজুক হাসলো। বললো,
”চোখ বন্ধ করুন।”
তামজিদও সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো। সেকেন্ডের মাথায় কপালে তারিনের নরম ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে বলল,
”নিজেকে সামলানো বড্ড কঠিন করে ফেলছো, আমার চাঁদ।”
তারিন শব্দ করেই হাসলো। প্রেগন্যান্সি কিটটা তামজিদের চোখের সামনে ধরে বলল,
”এবার চোখ খুলুন।”
তামজিদ ফট করে চোখ খুলতেই সামনে থাকা পজেটিভ কিটটা দেখে যেনো ওর মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। চোখে মুখে থাকা হাসি আর আনন্দটা মুহূর্তেই রাগে পরিনত হলো। তামজিদের মুখের রিয়েকশন দেখে তারিনের মুখের হাসিটাও গায়েব হয়ে গেলো। তামজিদ রাগী স্বরে প্রশ্ন করল,
“এটা কি?”
তারিন ভয় পেলেও নিজেকে সামলে নিলো। হাসি মুখে উত্তর দিলো,
”আপনি বাবা হতে যাচ্চেন, মাস্টার মশাই। আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।”
তারিনের কথা শেষ হতে না হতেই তামজিদ সপাটে একটা থা’প্পড় বসিয়ে দিলো তারিনের গালে। তারিনের বাহু চেপে ধরে রাগে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
”এসব কি হ্যাঁ? এসব কি করে হলো? তোমাকে আমি বার বার করে বলেছিলাম এখন কোনোরকম রিস্ক না নিতে? তবুও তুমি আমার কথা শুনলে না? আমার কথার কোনো গুরত্ব নেই তোমার কাছে? আমার এত এত সেক্রিফাইস, স্বপ্ন তুমি এভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিলে? একদম ঠিক করো নি, তারিন। একদম না। আমার সব বিশ্বাস, ভরসা শেষ করে দিলে। আমি কিছুতেই তোমাকে ক্ষমা করবো না। আজ থেকে তুমি আর আমার কোনোরকম সাপোর্ট পাবেনা। একদম পাবেনা।”
তারিন হতভম্ব হয়ে তামজিদের তাকিয়ে আছে। তামজিদের চোখ থেকে পানি ঝরছে। কথাগুলো শেষ করেই তামজিদ এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। হনহনিয়ে চলে গেলো বাড়ির বাইরে। তামজিদ চলে যেতেই তারিন দেয়াল ঘেষে বসে পড়লো ধপ করে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। এত এত খুশি স্বপ্ন এক মুহূর্তই নষ্ট হয়ে গেলো। তাহলে কি আজ থেকে তারিন সব হারালো? কোনো নতুন ঝড়ের মুখোমুখি হতে চললো জীবন?

#প্রথম_পরিচ্ছেদের_সমাপ্তি