আমার নিঠুর মনোহর ২ পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
197

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_শেষ [প্রথমাংশ]

৮মাসের বড় পেট নিয়ে যখন চোখের সামনে তারিন পা পিছলে ওয়াশরুমে পড়ে গেলো, তখন মনে হলো এই বুঝি ওর বেঁচে থাকার সময় ফুরিয়ে এসেছে। জোরে চিৎকার করারও সুযোগ পেলো না। নিচে পড়ে যাওয়ার টাইমে বেসিনের সাথে মাথায় আঘাত লাগলো। নিচে পড়ে যাওয়ার পর এক মুহূর্ত চোখ খুলে রাখতে পারলো না। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসার আগে শরীরে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে অস্ফুটে স্বরে ‘মাস্টার মশাই’ বলে ডেকে উঠলো। অতঃপর চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসলো। তামজিদ তারিনকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে ছাদে গিয়েছিলো জামা কাপড় আনতে। রুমে ঢুকে একবার ‘তারিন’ বলে ডাকলো। কিন্তু ওপাশ থেকে শব্দ আসলো না। তামজিদ বাসায় থাকলে তারিনকে নিয়ে একসাথে গোসল করে। আজকেও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। গোসল করার জন্যই ছাদে জামা-কাপড় আনতে গিয়েছিলো। আর তারিন টয়লেট ব্যবহারের জন্য আগে ঢুকেছে। তামজিদ পুনরায় একবার ডেকে বলে উঠল,
“তোমার হয়েছে? তাহলে আমি ঢুকি?”
এবারও ওপাশ থেকে শব্দ আসলো না। ভেতর থেকে পানির শব্দ ভেসে আসছে। তা শুনে তামজিদ ভাবলো তারিন পানির শব্দে হয়তো শুনতে পাচ্ছে না। তবুও মনের মধ্যে খচখচ করছে একটু। তাই একদম দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা হালকা খুলে ডাকলো,
“ও সোনা। শুনতে পাচ্ছো? আসবো?”
নাহ! এবারও কোনোরকমে শব্দ কানে আসলো না। তামজিদ এবার পুরো দরজাটা খুলে ফেললো। মেঝের দিকে চোখ যেতেই কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। মাথা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করলো। ওয়াশরুমের সারা ফ্লোর জুড়ে রক্তের ছড়াছড়ি। তারিনের পড়নের জামাটাও রক্তে লাল হয়ে আছে। মেয়েটার কোনো হুঁশ নেই। একদম চুপচাপ হয়ে শুয়ে আছে ফ্লোরে। কী আশ্চর্য এভাবে শুয়ে আছে কেনো? ওর তো ঠান্ডা লেগে যাবে। উফ! আর পারলো না এই দৃশ্যটা সহ্য করতে। গলা দিয়েও শব্দও বের হচ্ছে না। হাত পা চলছে না। কি হলো? শরীর কি অবশ হয়ে গেলো? মস্তিষ্ক কি কাজ করছে না? স্বপ্ন দেখছে? এটা কি স্বপ্ন? এমন বিদঘুটে একটা স্বপ্ন হতে পারে? তামজিদ একবার চোখ বন্ধ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবার চোখ মেলে তাকাতেই কেমন যেনো বুকের ভেতর প্রচন্ড ব্যাথায় কাতর হয়ে গেলো। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ‘তারু’ বলে চিৎকার করে উঠলো। কোনোরকমে গিয়ে তারিনকে আগে কোলে তুলে নিলো। সাথে সাথে হাতটা রক্তে মেখে গেলো। তামজিদের চিৎকার শুনে তানহা, তারিনের মা, আমজাদ সাহেব সবাই হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলেন। উনারা সবাই একসাথে ড্রয়িং রুমে ছিলেন। তামজিদের চিৎকার শুনে একসাথে দৌড়ে আসলেন। তারিনের যখন ৬মাস তখন থেকেই তারিনের মা এখানে এসে থাকেন। তানহাও প্রায় ১৫দিন যাবৎ এখানে এসেছে। সবাই মিলে তারিনকে একদম পুতুলের মতো যত্নে রেখেছিলো। আর আজ হঠাৎ কি হয়ে গেলো! তারিনের মা একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তানহাও কাঁদছে। তামজিদ তারিনকে বুকে চেপে ধরলো। তানহা তাড়াতাড়ি নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে তারিনের মাথা প্যাঁচিয়ে দিলো। তানহা চিৎকার করে আমহাজ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
“বাবা, তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে বলো।”
আমজাদ সাহেব ছুটলেন সেদিকে। তানহা এবার তামজিদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাই, ওর প্রচন্ড ব্লিডিং শুরু হয়েছে। তাড়াতাড়ি ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। এখন এভাবে ভেঙে পড়ার সময় নয়। তাড়াতাড়ি চল, ভাই।”
তামজদের কান অব্দি কথাগুলো যেতেই তামজিদ উঠে দাঁড়ালো। তারিনকে পাজকোলে তুলে ছুটলো গাড়ির দিকে। তামজিদ, তারিনসহ গাড়িতে উঠে বসলো আমজাদ সাহেব, তারিনের মা।



“ও কাকা, তাড়াতাড়ি চালান। আর কত দূর? আল্লাহ রাস্তা শেষ হয় না কেন? আল্লাহ! তুমি এমন কেন করলা? কি পাপ করছিলাম আমি? আল্লাহ! আমার পাপের শাস্তি এভাবে দিলা? ও বাবা! কি করব আমি? কি হবে এখন? আমার বউ! আমার তারিন! আমার ছোট্ট প্রাণ!”
তামজিদ কিছুক্ষণ পর পর ড্রাইভের উদ্দেশ্যে এভাবে তাড়া দিচ্ছে। আর তারিনকে বুকে আঁকড়ে ধরে যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছে। পাগলের প্রলাপ যাকে বলে। প্রায় ২০মিনিটের মাথায় ওরা এসে পৌঁছালো হসপিটালে। হসপিটালের ভেতরে ঢুকতেই নার্সরা এসে তারিনের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলো। তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনলো। ডাক্তার এসে তারিনের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি পার্লস চেক করলো। তামজিদ অস্ফুট সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“ও ও বেঁচে আছে, আংকেল?”
“বেঁচে আছে তবে…।”
বলেই তিনি থেমে গেলেন। অতঃপর আঁতঙ্কিত সুরে নার্সদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ওহ মাই গড! নার্স তাড়াতাড়ি ও.টি রেডি করো। ওকে নিয়ে যাও।”
জুনিয়র ডাক্তার, নার্সরা তারিনকে নিয়ে যাওয়ার সময় তামজিদ তারিনের হাত ধরে পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদছিলো। ডাক্তার ইউসুব তামজিদকে খুব ভালো করেই চিনেন। কারণ তিনি আমজাদ সাহেবের বন্ধু। তামজিদের অবস্থা দেখে আমজাদ সাহেব ডাঃ ইউসুবের হাত জোড়া প্যাঁচিয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। কান্নারত স্বরে বললেন,
“আমার মেয়েটার যেনো কিছু না হয় দেখিস।”
ইউসুব সাহেব মিনমিনে স্বরে বলল,
“আল্লাহকে ডাকো। তারিনের অবস্থা মোটেও ভালো না। যেকোনো খবরের জন্য প্রস্তুত থাকো।”
বলেই তিনি চলে গেলেন। তামজিদ হাটু ভেঙে বসে পড়লো। আমজাদ সাহেব গিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রাখতেই তামজিদ বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বাবা! আমার বউ! আমার বাচ্চা! আমার তারিন। আমি কিভাবে বাঁচবো, বাবা? আমি কিসের জন্য বাঁচবো? কত যত্ন করে আমার ঘরের পুতুলকে সাজিয়ে রেখেছিলাম। আজ সেই পুতুল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো অথচ আমি কিছু করতে পারলাম না। সব আমার জন্য হয়েছে তাইনা বাবা? সব দোষ আমার। আমি আমার চাঁদকে যত্নে রাখতে পারিনি। আমি ব্যর্থ স্বামী। ব্যর্থ পুরুষ।”
বলেই আবার কাঁদতে লাগলো। এর মধ্যেই তানহা এসে পৌঁছালো সাথে রিহাব, রাফি, রামিম ও এসেছে। তামজিদের পাগলের মতো অবস্থা দেখে ওরা তিনজন দৌড়ে আসলো এদিকে। তামজিদকে শান্ত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তানহা তারিনের মাকে সামলাচ্ছে। রিহাব তামজিদকে চেয়ারে বসাতে বসাতে স্বান্তনা দিয়ে বলে উঠল,
“কাঁদিস না, ভাই। আমাদের বোনের কিছু হবে না। ও একদম ঠিক হয়ে যাবে।”
রাফিও তালে তাল মিলিয়ে বলল,
“ছোট বেলা থেকে বোনের অভাবে অভাবে বড় হয়েছি। কত আফসোস করেছি একটা বোন নেই বলে। এত বছর পর এসে আল্লাহ আমার বোনের অভাব পূরণ করেছিলো। উপরওয়ালা দিয়ে আবার নিশ্চয়ই কেড়ে নিবে না, বল? একদম চিন্তা করিস না। আমার বোন একদম ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।”
বলেই রাফিও কেঁদে দিলো। সবার চোখের পানি। এভাবেই কেটে গেলো কিছু। সবাই অপেক্ষা ও ভীতিগ্রস্ত চেহারাপানে বসে আছে করিডোরে।



তারিনকে ও.টিতে নেওয়া হয়েছে মিনিট বিশ হবে। তামজিদ এখনো কাঁদছে। চোখের জলে সবকিছু ধোয়াশা হয়ে আসছে তবুও কাঁদছে। হঠাৎ করেই ও.টি রুম থেকে তামজিদের ডাক পড়লো। ইউসুব সাহেব তামজিদের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলেন,
“তারিনের ডেলিভারি এক্ষুনি করাতে হবে নয়তো আমার মা, বাচ্চা কাউকেই বাঁচাতে পারবো না।”
তামজিদ শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো। কিছু বলতে পারলো না। রাফি প্রশ্ন করলো,
“তারিনের এখন কি অবস্থা? আর বেবি ঠিক আছে তো?”
ইউসুব সাহেব তামজিদকে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“তুমি কাকে চাও?”
তামজিদ প্রশ্নোত্তর চোখে তাকালো। কাকে চাই মানে? তাহলে কি বাবা হওয়ার স্বপ্ন এখানেই শেষ করতে হবে? তামজিদ থেমে থেমে প্রশ্ন করলো,
“মানে?”
ডাক্তার জানালেন,
“মা বা বাচ্চা কাকে চাও?”
তামজিদ এক পা পিছিয়ে পড়লো। মাথার উপর আকাশটা যেনো ভেঙে পড়েছে৷ কী আশ্চর্য! এই ৮মাসের সব শখ, আহ্লাদ, আনন্দ, স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হবে? আর মেয়েটা যে এই সুখের জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিলো! তার কি হবে? কিভাবে মনকে মানাবে? মা বাবা হওয়ার স্বপ্নটা এভাবে ভেঙে গেলো। নিয়তি এত নিষ্ঠুর কেন?

#চলবে

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_শেষ [শেষাংশ]

পাঁচ বছরের একটা মেয়ে ‘ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ’ এর ক্যাম্পাসে ছুটে বেড়াচ্ছে। তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে তামজিদ। মেয়েটা হাসছে আর বলছে,
“আমাকে ধরতে পারবে না।”
বলেই হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছে। তামজিদ কিছুদূর গিয়ে থেমে গেলো। বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লো। মেয়েটা হঠাৎ পেছন ফিরে তামজিদকে বসে পড়তে দেখে থেমে গেলো। ভয় পেয়ে দৌড়ে আসলো। তামজিদের দুই গালে হাত রেখে ভয় পাওয়া সুরে প্রশ্ন করলো,
“তোমার কি কষ্ট হচ্ছে, বাবা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? মাম্মা কে ডাকবো? মাম্মা তো ডাক্তার তোমাকে একদম ঠিক করে দিবে। দাঁড়াও আমি মাম্মাকে ডাকছে।”
মেয়েটার কথা শুনে তামজিদ হেসে ফেললো। মেয়েকে এক টানে নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়ে চুমু খেলো কপালে। এইতো তার প্রাণ। বেঁচে থাকার
সম্বল। এই প্রাণ থাকলে সুস্থ হওয়ার জন্য কোনো ডাক্তার, কবিরাজ লাগে না। তামজিদ হালকা হেসে বলে উঠল,
“এই যে আমার রিন্তাহা এসে পড়েছে আমার আর কোনো কষ্ট নেই। আমার মা থাকতে আমি কষ্টে থাকবো এটা কখনো হবে না।”
রিন্তাহা হেসে তামজিদের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল,
“তুমি খুব দুষ্টু হয়ে গেছো বাবা। মাম্মাকে বলব তোমার পিট্টি দিতে।”
তামজিদ পুনরায় হেসে ফেললো। ঠোঁট উল্টে বলল,
“আমার ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম। আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
এবার বাবা মেয়ে একসাথে হেসে উঠলো। তামজিদ রিন্তাহার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“চলো ভেতরে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। তুমি মাম্মার অনুষ্ঠান দেখবে না?”
রিন্তাহা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ, দেখবো তো। চলো। চলো।”
বলেই তামজিদ হাত ধরে দৌড় শুরু করলো। মেয়েটা এত চঞ্চল হয়েছে। একদম মায়ের মতো। এক মিনিটও চুপচাপ থাকে না। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করবে। কিন্তু সিড়ি দিয়ে উঠতে চাইবে না। সিড়ির সামনে গেলেই ঠোঁট উল্টে বলবে,
“আমাকে কেউ কোলে নেয়না। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। কেউ আদর করে না।”
তখন তামজিদ মেয়ের এমন আবদার শুনে না হেসে পারে না। অতঃপর আদরের রাজকন্যাকে গল্প শুনাতে শুনাতে সিড়ি দিয়ে কোলে তুলে উপরে নিতে হয়। হ্যাঁ, আপনারা ঠিকি ধরেছে রিন্তাহা তামজিদ আর তারিনের মেয়ে। পুরো নাম রিন্তাহা রুহি। তামজিদ রিন্তাহা বলে ডাকলেও তারিন সবসময় রুহিমনি ডাকে। তামজিদ আর রিন্তাহা এসে বসলো দর্শক সাড়িতে। তারিনের আজ এম.বি.বি.এস পরিক্ষার চূড়ান্ত রেজাল্ট বের হওয়ার দিন। সেইজন্যই আজ কলেজে বিশাল আয়োজন করা হয়েছে৷ তামজিদ, রিন্তাহা তারিনকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যই এসেছে। তারিন ভেতরে আছে। তামজিদ রিন্তাহার সাথে গল্প করতে করতে ডুব দিলো অতীতের ঘটনায়…
“আমরা মা অথবা বাচ্চা দুজনের একজনকে বাঁচাতে পারবো। তোমার হাতে খুব বেশি সময় নেই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাড়াতাড়ি নাও প্লিজ।”
তামজিদ ডাক্তাদের কথা শুনে চোখ দুটো খোলা রাখতে পারলো না। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে তড়িৎ গতিতে জবাব দিলো,
“আমার তারিনকে চাই। প্লিজ, আংকেল। আমার তারিনকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আমি সারাজীবন নিঃসন্তান থাকবো তবুও আমার তারিনকে চাই।”
বলেই বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো। ডাক্তার কিছু না বলে সোজা ভেতরে চলে গেলো। তামজিদ কাঁদছে। চিৎকার করে কাঁদছে৷ রাফি, রামিম, রাহিম সবাই ওকে স্বান্তনা দিতে গিয়ে নিজেরাই কেঁদে ফেলছে বার বার। তানহা নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বার বার চোখে ভাসছে তারিনের মেয়েকে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন, শখ, আহ্লাদ। তারিনের মা জ্ঞান হারিয়েছে তাই তাকে বেডে নিয়ে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। তামজিদ কাঁদতে কাঁদতে আমজাদ সাহেবকে আঁকড়ে ধরে বলে উঠল,
“বাবা, আমার বাচ্চা! আমার বাবা হওয়ার স্বপ্ন এভাবে ভেঙে গেলো কেনো? তারিনকে আমি কি জবাব দিবো? যে মেয়েটা এই আট মাস কষ্ট করলো। নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিলো তাকে আমি কি জবাব দিবো? যখন ওর জ্ঞান ফিরবে আমাকে প্রশ্ন করবে, ‘আমার বাচ্চা কোথায়?’ তখন আমি কি জবাব দিবো? কি বলবো? আমাকে তারিন সবসময় বলতো যদি কখনো এমন পরিস্থিতি আসে তখন যেনো আমি বাচ্চাকে বেছে নেই। বাবা, আমি সারাজীবন নিঃসন্তান হয়ে বাঁচতে পারবো। কিন্তু তারিনকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আমি কি করবো, বাবা?”
আমজাদ সাহেব ছেলেকে স্বান্তনা দিতে ভুলে গেলো। কিছু মুহূর্ত পর বাপ ছেলে কান্নাকাটি ভুলে হপিটালের এক কোনে নামাজের বিছানায় বসে পড়লো। তামজিদ হাত তুলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছে। যতক্ষণ ও.টি রুমের লাইট না নিভলো ততক্ষণে তামজিদ নামাজের বিছানা ছেড়ে উঠলো না। প্রায় ঘন্টা খানেক পর ও.টি রুমের লাইট নিভতেই রাফি চিৎকার তামজিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“তামজিদ, তাড়াতাড়ি আয়।”
তামজিদ কোনোরকমে উঠে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো। বুকটা ধকধক করছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তামজিদ বুকে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। আর পারছে না৷ শরীর সায় দিচ্ছে না৷ দরজা খুলে নার্সকে একটা বাচ্চা কোলে তুলে নিয়ে বের হতেই তামজিদ কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। বুকের ভেতরে থাকা হৃদযন্ত্রটা বেরিয়ে আসচ্ছে। উপস্থিত সবাই অবাক পানে তাকিয়ে আছে। নার্স এগিয়ে এসে হাসি মুখে বাচ্চাটা তামজিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার মেয়ে হয়েছে।”
সবার মুখে চিলতে হাসি ফুটলো। তামজিদ হাসছে না। এখনো নিশ্চুপ। শুধু অবাক পানে তাকিয়ে নার্সের দিকে। বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েও থেমে গেলো৷ হঠাৎ করে মস্তিষ্কে ডাক্তারের বলা কথাটা ভেসে আসলো ’ডাক্তার তো বলেছিলো যেকোনো একজনকে বাঁচানো যাবে’। তামজিদ হাত সরিয়ে ফেললো। ভয়ার্ত স্বরে নার্সকে প্রশ্ন করল,
“আমার বউ? আগে বলুন আমার বউ কেমন আছে? ও ঠিক আছে? সুস্থ আছে? বলুন না? আপনারা তো বলেছিলেন যেকোনো একজনকে বাঁচানো যাবে। আমি তো আমার বউকে চেয়েছিলাম। তাহলে এই বাচ্চা?”
তামজিদের কথা শুনে নার্স অবাক পানে চেয়ে রইলো। এমনো কোনো স্বামী হয়? যার কাছে নিজের সন্তানের থেকেও স্ত্রীর জীবন সবথেকে বেশি দামী। মনে মনে ভাবলো কতখানি ভাগ্য নিয়ে জন্মালে একটা মেয়ে এমন স্বামী পায়। নার্সকে চুপ থাকতে দেখে তামজিদ এবার চিৎকার করে বলে উঠল,
“উত্তর দিচ্ছেন না কেন? বলেন আমার তারিন কেমন আছে? সুস্থ আছে তো?”
নার্স তামজিদের ধমক খেয়ে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলল তার আগেই ইউসুব সাহেব বলে উঠলেন,
“আমাদের বউমা একদম সুস্থ আছে, তামজিদ।”
তামজিদের কর্নকুহরে কথাটা পৌঁছাতেই চকিতে তাকালো সেদিকে। ইউসুব সাহেবের হাস্যজ্বল মুখ দেখে কিছু সময় থমকে তাকালো।। ইউসুব সাহেব কাছে এসে তামজিদ জড়িয়ে ধরে বললেন,
“তোমার দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেন নি। কবুল করেছেন। তোমার স্ত্রী, সন্তান দুজনেই সুস্থ আছে। সাধারণ আট মাসে যেসব বাচ্চাদের জন্ম হয় তাদের জন্মের পর বিভিন্ন জটিল সমস্যা দেখা দেয়। তবে তোমার বাচ্চার বয়স আট মাস দুই সপ্তাহ কেটেছে তাই ভাগ্যগুনে তোমার বাচ্চা সুস্থ আছে বেশ, আলহামদুলিল্লাহ। তবে পড়ে যাওয়ার ফলে বেবির কিছুটা আঘাত লেগেছে যার কারণে ওর কিছু প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দরকার৷ তাই আমরা বেবিকে সপ্তাহ খানেক ‘নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট’ এ রাখবো। আশা করি সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দুজনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।”
তামজিদের বুকের উপর থাকা পাথরটা যেনো এক নিমিশেই সরে গেলো। এবার যেনো শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেললো। উপস্থিত সবার মুখে খুশির ঝলক ফুটলো। রাফি, রামিম, রাহিম তো কোলাকুলি শুরু করে দিয়েছে। রাফি এগিয়ে এসে তামজিদকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
“কংগ্রাচুলেশনস, দোস্ত। বাবা হয়ে গেছিস, শালা। এবার মিষ্টি খাওয়া তাড়াতাড়ি।”
রাহিম এসে তামজিদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“মিষ্টি পরে খাওয়াইস শালা, আগে আমার ভাগনিকে কোলে নে। দেখ কেমন করে কান্না করছে।”
তামজিদ খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। এক নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো বাচ্চাটার দিকে। নার্সের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিতেই নার্স হেসে বাচ্চাটাকে তামজিদকের কোলে তুলে দিলো। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই তামজিদ হুঁ হুঁ করে কান্না করে উঠলো। বাচ্চাটার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে আলতো করে বুকে সাথে লাগিয়ে বলে উঠল,
“মা! আমার মা! তুই নিজেও জানিস না তুই আমাকে এ পৃথিবী ভর্তি খুশি এনে দিয়েছিস।”



“বাবা! বাবা! ও বাবা! কাঁদছো কেন তুমি? কষ্ট হচ্ছে বাবা? মাম্মাকে ডাকবো?”
হঠাৎ করে কথাগুলো কানে যেতেই তামজিদ হুঁশে ফিরে আসলো। খেয়াল করলো তামজিদের চোখ দুটো ভেজা। অতীত মনে করতে গিয়ে আরো একবার চোখে জল এসে পড়েছে। কী খুশির দিন ছিলো সেদিনটা! যতবার মনে করে ততবার নিজের ইমোশনটাকে সামলে রাখতে পারে না। সেদিনের পর তারিনের সুস্থ হতে প্রায় মাস খানেক লেগেছিলো। তারপর এই যে হেসে খেলে কেটে গেলো পাঁচ বছর। সময় কত দ্রুত চলে যায়। স্রোতের ন্যায় চলে যায়। চাইলেও ধরে রাখা যায়না। রিন্তাহার যখন ৩মাস তখন থেকে তারিন পুনরায় পড়া শুরু করে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। সন্তান, সংসার, পড়ালেখা সব একসাথে সামলে নেওয়া এত সহজ না। খুব কঠিন৷ কত রাত মেয়েটা জেগে কাটিয়েছে। সারাদিনের ধকল শেষ করেও রাতে মেয়েকে নিয়ে জেগে কাটিয়েছে সকালে আবার কলেজে ছুটেছে। সব তামজিদ নিজের চোখে দেখেছে। আজ মেয়েটার খুশির দিন। স্বপ্ন পূরণের দিন৷ ভেবেই তামজিদের পৃথিবী ভর্তি করা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতে মন চাচ্ছে। হঠাৎ করে কাঁধে কারোর স্পর্শ পেতেই তামজিদ হকচকিয়ে তাকালো। পাশ ফিরে তারিনকে দেখে হেসে ফেললো। তারিন একটু চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কোনো সমস্যা মাস্টার মশাই? চোখে জল কেন?”
তামজিদ কিছু বলার আগেই রিন্তাহা বলে উঠল,
“বাবার কষ্ট হচ্ছে, মাম্মা। দেখো না এইযে কাঁদছে বাবা।”
বলেই ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেললো। তামজিদ সাথে সাথে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“আমার কিছু হয় নি, মাম্মা। চোখে একটু ময়লা পড়েছিলো তাই পানি পড়ছিলো। তুমি কেঁদো না, মা।”
কত কি শুনিয়ে রিন্তাহাকে শান্ত করলো। তারিন এতক্ষণ ওদের দিকেই তৃপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। মেয়েটা একদম তামজিদের মতো হয়েছে। বাবাকে সে আকাশ সমান ভালোবাসে। বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। তারিনকে ছেড়ে এক রাত অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারলেও বাপকে ছাড়া পারবে না। কতদিন তামজিদ রিন্তাহাকে কোলে নিয়ে কলেজ করেছে হিসেব নেই। তারিন এবার তামজিদের পাশে বসতে বসতে বলল,
“হ্যাঁ বুঝি তো এখন মাম্মা কেউ না৷ বাবাকেই সব ভালোবাসা দেওয়া হচ্ছে। যাও তোমাদের সাথে আমার আড়ি।”
এই বলে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলো। তা দেখে রিন্তাহা মুখে হাত দিয়ে হাসতে লাগলো। তামজিদকে বলল,
“দেখেছো বাবা, মাম্মা কেমন ছোট বেবিদের মতো রাগ করছে।”
বলেই আবার হেসে উঠলো। তামজিদ হেসে রিন্তাহা কিছু একটা ইশারা করলো। এই ইশারার সাথে রিন্তাহা পূর্ব পরিচিত। তাই সে বুঝলো তামজিদ কি বুঝিয়েছে। রিন্তাহা তারিনের থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“তোমাকে আমরা অনেক ভালোবাসি, মাম্মা।”
বলেই তামজিদ আর রিন্তাহা দুজন তারিনের দুই গালে একসাথে চুমু খেলো। তারিনও এই ব্যাপারটার সাথে পূর্ব পরিচিত তাই নিজেকে সামলাতে পারলো না৷ হেসে ফেললো। রিন্তাহাকে কোলে তুলে নিলো। তামজিদ এক হাতে দুইজনকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।


অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। তারিন ভয়ে বার বার শিউরে উঠছে। তামজিদ আর রিন্তাহা তারিনের দুহাত শক্ত করে ধরে আছে। তামজিদ তারিনের ভয়ার্ত চেহারাপানে তাকিয়ে বলল,
“তোমার এত স্ট্রাগল বিফলে যাবে না। টেনশন নিও না। আল্লাহ ভরসা।”
রিন্তাহাও মাকে সাপোর্ট করছে। একটা মেয়ের এর থেকে বেশি আর কি লাগে? একে একে সব উত্তীন ছাত্র-ছাত্রীদের নাম বলছে সবাই স্ট্রেজে গিয়ে সার্টিফিকেট নিচ্ছে, নিজেদের স্ট্রাগলের কথা বলছে। একে একে যখন এক নাম্বার হওয়া ছাত্রীর নাম বললো তখন তারিন কেঁপে উঠলো। নিজের নাম শুনে খুশিতে তামজিদকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে উঠলো। রিন্তাহাও বুঝেছে ওর মাম্মা পরিক্ষায় পাশ করেছে তাই খুশিতে সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাত তালি দিতে লাগলো। তামজিদের চোখের কোনেও পানি। স্ট্রেজে তারিনকে ডাকতেই তামজিদ তারিনের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“যাও নিজের ভেতরে জমানো কথাগুলো বলে আসো। আজ তোমার দিন। স্বপ্ন পূরণে দিন।”
তারিন রিন্তাহার কপালে চুমু খেয়ে স্ট্রেজে উঠলো। সার্টিফিকেট, মেডেল দেওয়া শেষ হতেই সঞ্চালনায় থাকা ব্যক্তিটা এসে তারিনের হাতে স্পিকার দিয়ে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলো। তারিনের হাত কাঁপছে। তবুও কোনোরকমে শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় স্পিকার নিয়ে বলা শুরু করলো,
“ এইযে আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে তার পেছনের গল্পটা মোটেও সহজ ছিলো না। কতশত বাঁধার সাথে লড়াই করেছি তা শুধু আমি জানি আর আমার মাস্টার মশাই জানেন। হ্যাঁ, আজ আমি যতটুকু তার সম্পূর্ণ ক্রেডিট আমার স্বামীর। আমার মাস্টার মশাইয়ের জন্যই আজ আমি এত দূর। তবে আরো রয়েছে আমার তানহা আপু, আমার শশুড় মশাই, আমার ভাইয়েরা। কিন্তু তবুও সম্পূর্ণ ক্রেডিট আমি এই মানুষটাকেই দিবো৷ যে আমার জন্য নিজের মায়ের সাথে লড়েছেন। নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েছেন। নিজের সারাজীবনের সম্বল টুকু আমার পেছনে ঢেলেছেন শুধু মাত্র আমার স্বপ্নের জন্য। জানেন, আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজের বাবা হওয়ার স্বপ্নটাকে অব্দি পূরণ করতে চায়নি। যেদিন শুনেছিলো আমি মা হবো সেদিন সেকি রাগ! (হাসলো সামান্য) কত কষ্টে মানিয়েছিলাম। তারপর মা হলাম। নতুন এক লড়াই শুরু হলো। সংসার, বাচ্চা, পড়ালেখার যাতাকলে পিষে কবেই আমি নামক মেয়েটা হারিয়ে যেতাম যদি এই মানুষটা না থাকতো। আমার কষ্টে এই মানুষটা কতরাত কেঁদেছে হিসাব নেই। তিন মাসের একটা বাচ্চাকে নিয়ে পড়ালেখা শুরু করা কি সহজ বিষয় ছিলো? সহজ হয়েছে শুধুমাত্র এই মানুষটার জন্য। মাস্টার মশাই, বলেছিলাম না আপনার সামনে একদিন ডাক্তার হয়ে দাঁড়াবো। আমি আমার কথা রেখেছি। আমি পেরেছি আপনার, আমার দুজনের স্বপ্ন পূরণ করতে। পেরেছি আমি।”
বলেই কেঁদে দিলো। তামজিদের চোখের কোনেও পানি। এখানেই তো একটা পুরুষের স্বার্থকতা। তারিন স্পিকারটা রেখে নেমে আসলো স্টেজ থেকে। সবাই একসাথে হাত তালি দিয়ে উঠলো। তারিন স্টেজ থেকে নামতেই দেখলো তানহা, মাইশা, আমজাদ সাহেব, তারিনের বাবা, মা ও তামজিদের বন্ধুরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। তারিন দৌড়ে সেদিকে যেয়ে তানহা কে জড়িয়ে ধরলো। তামজিদ রিন্তাহাকে কোলে নিয়ে আসলো সেদিকে৷ একে একে উপস্থিত সবাই তারিনকে কংগ্রেস করলো। সবার আজ খুশির দিন৷ এর মধ্যেই জুঁই তারিনকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
“আজকে আমাদের বোন সবাইকে ট্রিট দিবে। কি রাজি তো?”
তারিনও হেসে রাজি হয়ে গেলো। কতগুলো বছর পর সবাই একসাথে হয়েছে। সবাই এক এক করে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো৷ তারিন রিন্তাহাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। পাশে তামজিদ। রিন্তাহাদের ক্যাম্পাসে একটা কাঠগোলাপের গাছ আছে। সেখানে অঝোরে কাঠগোলাপ ফুটেছে। ক্যাম্পাস এসেই রিন্তাহা ফুলের দিকে ইশারা করে আবদার করল,
“বাবা, ফুল দাও। ফুল নিবো।”
তামজিদ মেয়ের আবদার ফেলতে পারলো না। নিজে গাছে চড়ে গিয়ে ফুল ছিড়ে আনলো। দুই থোকা ফুল এনে এক থোকা রিন্তাহার হাতে দিয়ে চুমু খেয়ে বলল,
“আমার জীবন্ত দুই ফুলের কাছে এই অসামান্য কাঠগোলাপের সৌন্দর্য ও হার মানবে।”
অতঃপর হাঁটু গেড়ে বসলো মাঠের মাঝে। হাতে থাকা ফুলগুলো তারিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“আমার রানী, রিন্তাহার খেলার সাথী ও আমার দ্বিতীয় সন্তান ডাউনলোড করার জন্য হলেও আমার নতুন করে তোমাকে চাই। হবে কি আমার দ্বিতীয় সন্তানের জননী?”
তামজিদের বন্ধুরা সবাই এতক্ষণ দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেও এবার কাছে এসে একসাথে সবাই চিৎকার করে বলে উঠল,
“স্যা ইয়েস, তারিন। স্যা ইয়েস।”
তারিন হেসে ফেললো। রিন্তাহা কি বুঝলো কে জানে? ওদের দেখাদেখি ও নিজেও বলা শুরু করল,
“মাম্মা, স্যা ইয়েস। স্যা ইয়েস।”
তামজিদের হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে তারিন বলে উঠল,
“স্যরি মাস্টার মশাই, দশ বছর পর দেখা করবেন। আসছি।”
বলেই হাঁটা শুরু করলো। তামজিদ চুপসানো মুখে মাথা চুলকাতে লাগলো। তা দেখে তামজিদের সব বন্ধুরা এগিয়ে আসলো। দুইদিক দিয়ে সবাই মিলে তামজিদকে ঘিরে ফেললো। রাহিম ভাবুক স্বরে বলল,
“মামা, তোর কি মনে হয় দশ বছর পরে তোর এই ভরা যৌবন ঠিকঠাক কাজ করবো? আমার তো মনে হয় সেই আগের মতো আবার যৌবনে ঝং পইড়া যাইবো।”
বলেই উধাও রাহিম। এক দৌড়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো। বাকিরা সবাই হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলো। তারিন সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে৷ তামজিদ গোমড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকায় তারিন এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। এবার রিন্তাহা আর তারিন দুজনে তামজিদের দুই গালে চুমু খেলো৷ একসাথে জড়িয়ে ধরলো তামজিদকে। এই সুন্দর দৃশ্যটা রাফি ফোন ক্যামেরায় ক্যাপচার করতে মিস করলো না। রিন্তাহা কোল থেকে নেমে পড়লো। বাবা মায়ের মাঝে এসে দাঁড়ালো৷ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
“আমাকে কেউ আদর করে না।”
তামজিদ আর তারিন মেয়ের অভিনয় দেখে হেসে ফেললো৷ ওরা দুজনেই এবার হাটু ভেঙে বসে একসাতে রিন্তাহার গালে চুমু খেলো। রিন্তাহা ছোট ছোট দুই হাতে বাবা-মাকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো৷ ব্যস! সুখে থাকার জন্য আর কি চাই? জীবনে সুখ মরিচিকা। কখন আসবে যাবে ঠিক নেই। তাই সুখের সময়টাকে উপভোগ করাই শ্রেয়!

#সমাপ্ত