আমার বাহুডোরে আবদ্ধ তুমি পর্ব-২০

0
371

#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ২০

ফুচকা, ঝালমুড়ি, চানাচুর আর চা-কফির আড্ডা দিতে দিতেই বিকেল গরিয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। তা দেখে সবাইকে তাড়া দেয় আলভি।

-‘ অনেক তো আড্ডা দেওয়া হলো। এবার তবে বাড়ি ফেরা যাক।

-‘ আরও কিছুক্ষণ থাকি না? ভালোই তো লাগছে।

আলভির কথায় দ্বিমত পোষণ করে রিশতা। পরে সবার জোড়াজুড়িতে ফেরার জন্য রাজি হতে হয় রিশতার। এদিক ওদিক খুঁজে আদ্রিশকে না পেয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে সবাই। এমনকি আড্ডার সময়টাতেও আদ্রিশ ছিল না তাদের মাঝে। অবশেষে গাড়ির কাছে পৌছাতেই দেখা মেলে আদ্রিশের। ড্রাইভিং সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সে।

আদ্রিশকে এখানে দেখে ধমকের সুরে আলভি বলল

-‘ তুই এখানে কেন? জানিস আমরা তোকে খুঁজে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।

আদ্রিশ কোনো প্রকার বাক্য বিনিময় না করে গাড়ি স্টার্ট দেয় আর ইশারায় বসতে বলে। গাড়ি ছুটে চলে ‘খান বাড়ির’ উদ্দেশ্যে।

সন্ধ্যের ঠিক আগ মুহুর্তে অর্থাৎ গোধূলি লগ্নে নীড়ে ফেরা পাখিদের মতো বাসায় এসে পৌঁছালো আদ্রিশরা। আকাশে এখো কিছুটা আলোক ছটা দেখা যাচ্ছে। পথিমধ্যে সবাই আনন্দ ফূর্তি হাসি তামাশা করলেও আদ্রিশের মাঝে কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া ছিল না। আদ্রিশ চুপচাপ ড্রাইভ করে বাড়ি পৌঁছায়। বাড়িতে ফিরেই কারো সাথে কোনো কথায় না জড়িয়ে ধুপধাপ পা ফেলে নিজের কক্ষে চলে যায়। হুট করে আদ্রিশের এমন আচরণে অবাক হয় সবাই। অরনী অবশ্য কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছে বিষয়টা।

ওদের সবাইকে দেখে এগিয়ে আসেন লাবিবা রহমান। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন

-‘ ঘুরে এসে কেমন লাগছে এখন?

রিশতা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ভালো।’

হুট করে অরনীর পাশে আরাভকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে অরনীকে শুধালেন

-‘ অরনী মা, তোমার পাশে এই ছেলেটা কে?

আরাভের দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখে হাসির রেখা প্রশস্ত করে কোনো ভনিতা ছাড়া স্বাভাবিক স্বরেই অরনী বলল

-‘ আমার হাসবেন্ড।

লাবিবা রহমান কিছুটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আরাভের দিকে। অরনী বিবাহিতা, এ বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না। হুট করে এমন কিছু শোনাতে বেশ অবাক হলেন। অরনী বুঝতে পেরে হেসে ফেলে বলল

-‘ আসলে আন্টি, আমাদের বিয়েটা হুট মুহূর্তে হয়েছিল তাই জানানো হয়নি। গুটিকতক মানুষ—আদ্রিশ আর রিশতা ছাড়া তেমন কেউ এ ব্যপারে জানত না।

লাবিবা রহমান ভ্রু কুচকে বললেন

-‘ হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ?

থতমত খেয়ে যায় অরনী। এ মুহুর্তে কি বলবে তা ভেবে পাচ্ছে না সে। তারা যে পালিয়ে বিয়ে করেছিল এ কথা কি করে বলবে লাবিবা রহমানকে?

তিনি আর এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে, সোফার এক কোণে চুপ করে বসে থাকা মেহরুনের পাশে গিয়ে বসলেন। মেহরুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই, লাবিবা রহমানের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ না করেই চট করে উঠে দাঁড়ায় মেহরুন। অবাক হন তিনি।

অরনীর উদ্দেশ্যে মেহরুন গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-‘ আমি এখন রুমে যাচ্ছি আপু। তোমাদের কারো কিছু প্রয়োজন পড়লে আমায় ডেকো।

কথাটা বলেই আর উত্তরের অপেক্ষা না করে গটগট পায়ে এগিয়ে যায় আদ্রিশের কক্ষে মেহরুন। মেহরুনের হুট করে এভাবে চলে যাওয়াতে আঘাত পান তিনি। অশ্রু সিক্ত নয়নে তিনি চেয়ে থাকেন মেয়ের প্রস্থানের দিকে।

অরনী এগিয়ে এসে লাবিবা রহমানের কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দিয়ে বলল

-‘ চিন্তা করবেন না, আন্টি। ঠিক হয়ে যাব সব। মেহরুন সুস্থ, তবে এখনও পুরোপুরি রিকোভার হয়নি। আর কিছুটা সময় লাগবে। তারপর দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।

ছলছল চোখে তাকান অরনীর দিকে তিনি। অরনী চোখের ইশারায় আশস্ত করে তাকে। তার নিজেকে এখন বড় অপরাধী মনে হয়। তার জন্যই তো মেয়েটার এমন অবস্থা আজ। সেদিন যদি সে মেয়েটাকে অবিশ্বাস করে কটাক্ষের বাণী না শোনাত তাহলে হয়তো মেয়েটা আজ সুস্থ থাকত। ঠিকই আছে এটাই তার প্রাপ্য। এই ভেবেই তিনি নিজেকে দোষারোপ করছেন আর চোখের পানি ফেলছেন।

‘এই আদ্রিশ আর মেহরুনকে নিয়ে পারেনা সে। মেহরুন না হয় অসুস্থ। কিন্তু আদ্রিশের এমন করার কি মানে। এতো বড় হলো কিন্তু দুজনের ছেলে মানুষি স্বভাবটা এখনও গেলো না। এদের নিয়ে আর পারা যায় না। কয়দিন পর বাচ্চার বাপ মা হবে তখন তো বাচ্চাদের সাথে বাচ্চামো করবে। এই চার বাচ্চারে সামলানোর দায়িত্ব আবার তা ঘাড়ে না বর্তায়।’ এই ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অরনী।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট ফুঁকেই চলেছে আদ্রিশ। সিগারেটের ধোঁয়ায় চারপাশের পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠছে যেন। জলন্ত সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে নেয়। মুখ থেকে ধোঁয়া বের করে, লাইটারের সাহায্যে আরও একটা সিগারেট ধরায়। আদ্রিশের সিগারেট খাওয়ার মতো খারাপ অভ্যেস তেমন নেই বললেই চলে। কিন্তু আজ যেন কোনো বাঁধ মানছে না। একটা পর একটা সিগারেট ধরিয়েই চলেছে। অতিমাত্রায় ধোঁয়ার কারণে কাশি উঠে যায় আদ্রিশের। কাশতে কাশতে একেবারে নাজেহাল অবস্থা হচ্ছে তার।

জলন্ত সিগারেটটার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে আদ্রিশ। হাতের মুঠোয় চেপে ধরল জলন্ত সিগারেটটা। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে সে। দেয়ালে মাথা হেলান দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রয় কিছুক্ষণ। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। সব ছেড়ে ছুড়ে বনবাসে চলে যেতে মন চায় তার। আর কি করলে বউয়ের পাত্তা পাবে, তা ভেবে পায় না আদ্রিশ।

সিগারেটের আগুনে হাতের কিছুটা অংশ পুড়ে গেছে। তা দেখে মলিন হাসে সে। আকাশের পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তাচ্ছিল্যের সুরে আওড়াল

-‘ তুমি তো দিলে না আমায়
ভালোবাসা এক বিন্দু
তোমার জন্য আমি খুলে দিলাম
ভালোবাসার সিন্ধু
দিচ্ছি নিজেকে বুঝ
তোমার সাথে দেখা হয় রোজ
তুমি তো নাও না আমার খোজ
আড়ালে আমি শতবার
তোমায় ভালোবাসি পাগলের মতো।

আনমনে এতোটুকু বলে চোখের কোণে জমে থাকা পানিটুকু মুছে নেয় আদ্রিশ। পুরুষ মানুষের যে কাঁদতে নেই! আরেকটা সিগারেট ধরাতেই কারো পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে। পায়ের আওয়াজটা তিব্র থেকে তিব্র হচ্ছে। বেলকনির দিকেই এগিয়ে আসছে শব্দটা।

পুরো রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে মেহরুন। বাইরের রোড লাইটের আবছা আলোতে যতটুকু দেখা যায়, তাতে রুমে কারো অস্তিত্ব নজরে আসেনি মেহরুনের। আদ্রিশকে কোথায় না পেয়ে তাই বেলকনির পথে পা বাড়ায় মেহরুন।

বেলকনির পথে অগ্রসর হতেই সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ নাকে এসে ঠেকে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে নাক ঢেকে ফেলল মেহরুন। সেই সাথে কিছুটা অবাকও হয় বটে। তার জানা মতে, আদ্রিশ তো সিগারেট খায় না তবে এতো বিশ্রী গন্ধ কেন?

বেলকনিতে আদ্রিশকে বিধস্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠে মেহরুন। দৌড়ে গিয়ে আদ্রিশের সামনে বসে। আদ্রিশের এক গালে হাত ঠেকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে মেহরুন বলল

-‘ কি হয়েছে? এমন লাগছে কেন আপনাকে?

মেহরুনের দিকে ফিরে তাকায় আদ্রিশ। মলিন হেসে বলল

-‘ এখন পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছো তো, মেহরুন?

আদ্রিশের কথা শুনে রাগ হয়ে মেহরুনের। দাঁতে দাঁত চেপে তাই বলল

-‘ নাহ্ সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছি। আপনি একজন ডাক্তার হয়েও এসব ছাইপাঁশ খাচ্ছেন, লজ্জা করে না আপনার? জানেন না, ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

মেহরুনের কথা শুনে মজা পেল আদ্রিশ। বউয়ের এমন শাসন শোনার জন্য হলেও সে সিগারেট খাবে বারবার। হাসি পেলেও মুখে কিছুটা গাম্ভীর্যের রেশ টেনে বলল

-‘ ক্ষতি হলে আমার হবে, তোমার তাতে কি?

মেহরুন এবার আদ্রিশের অনেকটা কাছাকাছি চলে আসে। মুখে তার দুষ্ট হাসি ফুটে ওঠে। ভড়কে যায় আদ্রিশ। বউয়ের একটু এটেশন পাওয়ার জন্য এসব করা, এবার আবার তার মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি না পড়ে যায়। মেহরুন আদ্রিশের আরও কাছে এসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কাজটা করে বসল…😵

#চলবে~