#আমার_সংসার
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৫
দেখতে দেখতে কেটে গেলো দুটো দিন। পাল্টে গেছে অনেক কিছু। স্বাচ্ছন্দ,স্বাভাবিক জিবন হঠাৎ’ই কেমন জটিল হয়ে গেলো। ভাবতেই চোখ ভিজে উঠলো আমার। কতটা অবহেলা করছেন উনি আমায়! এতটা কি কাম্য? হয়তো কম’ই অবহেলা পাচ্ছি! দুদীনে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি উনি। কেন? এত বড় অপরাধী আমি? ঠোঁট কামড়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। বিছানার চাদর খামচে বাঁধভাঙা নদীর মতো হু হু করে কেঁদে উঠলাম। বুক হাহাকার করছে আমার। কারো গলায় ধ্যান ছুটলো,
‘ কি রে? তুই এখানে এখনো বসে আছিস? জানিস না বাড়িতে এখন কত কাজ? ‘
তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে তাকালাম। তনু আপু দাড়িয়ে আছেন দরজায়। শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে প্রবেশ করলো আপু। আবারো তাড়া দিয়ে বললো,
‘ বাড়িতে কত কাজ জানিস? কাল না তোর রিসিপশন পার্টি? আর তুই এভাবে বসে থাকবি? উঠ, তোকে চাচী ডাকছে। ‘
‘ মামী আমায় ডাকছে? ‘
আঁচল ছেড়ে তিক্ন দৃষ্টিতে তাকায় তনু আপু। বলে,
‘ তো আমি মিথ্যে বলছি? ‘
‘ আচ্ছা আমি আসছি। ‘
‘ সিয়া দাড়াতো। ‘
থেমে গেলাম। পিছু ফিরে দেখলাম এখনো আঁচল ঠিক করছে আপু। ওভাবেই বললো,
‘ তোর মুখ চোখ ফোলা কেন? ‘
শুকনো ঠোক গিলে চোখ মুছে তাকালাম আপুর দিকে। চিবুক দুটি প্রসারিত করে বললাম,
‘ কই? ঠিকি’ই তো আছি। ‘
আঁচল ছেড়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আপু। বেশ কিছুক্ষণ খুতিয়ে তাকিয়ে থেকে বললো,
‘ না মনে হলো। তুই যা। ‘
রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম। মামীরা নিচে আছেন। সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামতেই দেখা মিললো সিয়াম ভাইয়ার। ডেকোরেশন এর লোকদের সবটা বোঝাচ্ছেন উনি। পুরো বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনে ভরে উঠেছে। ছোট ছোট ছেলে,মেয়ে এসেছে। পাড়ার অনেক মহিলা এসেছেন কাজে হাত লাগাতে। কখন সিয়াম ভাইয়া পাশ কাটিয়ে গেলো বুঝতেই পেলাম না। শূন্য দৃষ্টিতে উপরে তাকালাম একবার। উনি ফিরেও চাইলেন না। আজও কথা বলবেন না উনি? আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে? মন চাইছে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে। এ ও সম্ভব হবে কোনদিন? আগে তো এমন হতো না। আমিকি ভালোবাসে ফেলললাম?
‘ সিয়া ওখানে কি? এদিকটায় আয়। ‘
মামীর ডাকে ধ্যান ছুটলো আমার। মামী রান্নাঘর থেকে হাঁক ছাড়ছে। গেলাম সেখানে। প্লেট ভর্তি সাদা ভাত আর হাঁসের মাংস বেড়ে আমার হাতে ধরে কড়া গলায় বলে উঠলো মামী,
‘ কি রে তুই? সায়েম বলে গেলো সিয়াম নাকি সকাল থেকে খায়নি? তুই একবার খেয়াল রাখবি না? এটা নিয়ে সিয়ামকে দিবি। যাহ্! ‘
‘ পারলে খাইয়ে দিবা সিয়া আপু। ‘ কথাটি কর্নকুহরে পৌছাতেই পিছু ফিরলাম। সিনথি বড়দের সাথে বসে মালা গাঁথতে গাঁথতে বলে উঠলো। হেঁসে উঠলো সবাই। একরাস লজ্জা নিয়েই স্হান ত্যাগ করলাম। এটাই সুযোগ তার সাথে কথা বলার। খুব জোরে উপরে চলে আসলাম। রুমের দরজায় গিয়ে আঁটকে গেলাম আমি। উনি দরজা লাগিয়ে দিয়েছেন। টোকা দিতেই আওয়াজ এলো,
‘ কে? ‘
কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘ আ..আমি, সিয়া! ‘
দরজা খুলে দিলেন উনি। এরপর বিছানায় উল্টোদিক হয়ে বসে পড়লেন। ক্ষিন স্বরে বললাম,
‘ মামী খাবার পাঠিয়েছেন। ‘
কোল হেলদোল নেই। একচোখে কিছু দেখছেন উনি। আবারো বললাম, ‘ শুনছেন? ‘
তবুও তাকালো না ভাইয়া। না! এবার আমাকেই কিছু করতে হবে। কথা বলতেই হবে আমায়। উনিকি কথা না বলে খুব ভালো আছেন? জানতেই হবে! প্লেট পাশের টেবিলে রেখে ওনার সম্মুখে গিয়ে দাড়ালাম আমি। উনি তবুও তাকালো না আমার দিকে। হলকা হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছে সিয়াম ভাইয়া। তার শরীর ঘামে একাকার। কর্কশ গলায় বললাম,
‘ কেন এমন করছেন আপনি? ‘
……
‘ আপনি কি বুঝতে পারছেন না আমার কষ্ট হচ্ছে? ‘
তবুও চুপ রইলো ভাইয়া। ধপ করে বসে পড়লাম তার পায়ের কাছে। চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে। চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলাম,
‘ এমন করবেন না! আমি আর পারছি না। দুদিন কথা বলেননি আপনি। আমি সত্যিই বলছি! আমার কষ্ট হচ্ছে! খুব কষ্ট হচ্ছে! বিশ্বাস করুন। ‘
তার চোখের দিকে তাকালাম। ডান চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। চোখদুটি বুঝতে অক্ষম আমি। পারছি না কিছু বুঝতে। পারছি না তার মুখ ফুটিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করাতে। বুক ছাড়খাড় হয়ে আসছে। দুদীনে কতবার চেষ্টা করেছি আমি। পারিনি! ব্যার্থ আমি!
‘ এর থেকে বেশি কষ্ট যে আমায় পেতে হচ্ছে সিয়া! ‘
কথা বলেছেন উনি। মন ছেঁয়ে নামলো প্রশান্তির ঢেউ! ছুটে গিয়ে তার গালে হাত রাখলাম। বুক বিষিয়ে উঠছে ব্যাথায়। দুদিন পর মুখ ফুটে কথা বললো ভাইয়া। তার গালে হাত রাখতেই উনি তাকালেন আমার দিকে। আটকানো গলায় বললাম,
‘ কেন এমন করছেন আপনি? কথা কেন বলছেন না? ‘
‘ তোর কষ্ট হচ্ছে? ‘ নিষ্প্রাণ স্বর ওনার। অস্ফুটস্বরে বললাম,
‘ হুম। ‘
‘ তুই তো আমাকে ভালোই বাসিস না। তাহলে কষ্ট কেন হচ্ছে তোর? ‘
জড়িয়ে নিলাম ওনাকে। বললাম,
‘ জানিনা। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। এমন আর করবেন না! ‘
‘ করবো! ‘
আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলাম ওনাকে। কান্নার বেগ বাড়লো আমার। উনি ফের বললেন,
‘ খুব কষ্ট হচ্ছিলো তোর? ‘
কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘ হুম। ‘
‘ আমারো হচ্ছিলো। ‘
মাথা তুলে তাকালাম আমি। উনি একচোখে আমার দিকেই তাকিয়ে। ঠোঁট উল্টে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
‘ তাহলে কথা কেন বলছিলেন না আপনি? ‘
‘ জানিনা। ‘
‘ ইচ্ছে করে করছিলেন। আমায় কষ্ট দিতে তো আপনার ভালোই লাগে। ‘
উনি চুপ করে রইলেন। ছাড়লাম না ওনাকে। উনি আলতো করে হাত রাখলেন মাথায়। ক্ষিন স্বরে বললেন,
‘ ভালোবেসে ফেলেছিস? ‘
সাথেসাথে ছেড়ে দিলাম। শুকনো ঠোগ গিলে পিছিয়ে গেলাম আমি। কোথথেকে জড়তা ঘিরে নিলো আমায়। গলা শুকিয়ে আসছে। উনি ঘোর লাগা চোখে তাকালেন আমার দিকে। বললেন,
‘ সত্যি করে বললে আজ থেকে কথা বলবো। বাসিস ভালো আমায়? ‘ বড়ো করুন শোনালো কন্ঠ। অস্ফুটস্বরে বললাম,
‘ জানিনা। ‘
‘ এটা কোন উত্তর নয়! বল হ্যা নাকি না? ‘
মুখচোখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। না চাইতেও ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু কি বলবো? ওনার সাথে কথা না বলার যে কষ্টটা আমার হয়েছে এটাকি ভালোবাসা? জানিনা তো আমি! তাহলে বলবো কি করে?
‘ দুদীন তো তোর চোখের পানি শুকায়ইনি। এইতো বলছিলি তোর নাকি খুব কষ্ট হচ্ছে? আর এখন উত্তর দিতে এতটা সময় লাগছে কেন? এটাই ভালোবাসা সিয়া। স্বীকার কর! ‘
আরও গুটিয়ে গেলাম আমি। হাত পা শিরশির করছে।খানিক সময় নিয়ে চোখ বুজে বলেই ফেললাম,
‘ বাসি, ভালোবাসি আপনাকে। ‘
মাথা নিচু করে অবশেষে বলেই ফেললাম। তড়িৎ গতিতে উঠে দাড়ালেন ভাইয়া। তার চোখমুখে যেন প্রান পেলো। চোখদুটির কোনে এক বিন্দু পানি জমে উঠেছে ইতিমধ্যে। মুখে হাসির ঝলক নিয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে নিলেন আমায়। তার বুকে মাথা রেখতেই বুক প্রসান্তিতে ভরে উঠলো। দুটি হৃদপিণ্ড বরাবর লাফাচ্ছে। দুটি বুকের একই শব্দের প্রতিধ্বনি দেয়া-নেয়া নিরাবেগে ব্যাস্ত। উনি আহ্লাদি হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘ সত্যিই ভালোবাসিস তুই? ‘
‘ হুম। ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে! অনেক ভালোবেসে ফেলেছি! ‘
_____
বাড়িতে এক চিলতে পরিমান জায়গা নেই। আনাচে কানাচে আত্মীয়-স্বজনে ভরে উঠেছে। একটু পর পার্টি শুরু হবে। আলোকসজ্জায় সজ্জিত পুরো বাড়ি। রজনীগন্ধার মালা দিয়ে সাজানোয় পুরো বাড়ি গন্ধে ম ম করছে। আব্বু কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। আমি অপেক্ষায় আছি বান্ধবীগুলোর। ওদের সেই সকালে ফোন করে বলেছি যেন ঠিক সময়ে চলে আসে। অথচ এখনো হদিস নেই তাদের। সামনে পেলে সবকটার দাঁত ভাঙমো আমি! দেখতে দেখতেই চলে এলেন সকল মহারানী। প্রিয় আজ নীল রঙা শার্ট পড়েছে। আর তন্নি পড়েছে লেহেঙ্গা। তিশা পড়েছে শাড়ি। আমি ভ্রুকুটি করে চেঁচিয়ে বললাম,
‘ আপনাদের এখন আসার সময় হলো? সেদিন তো মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলি, কেন তোদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি। আর এখন দাওয়াত দেয়ায় পরও তোরা লেট? সামি কই? ‘
তিশা সাথেসাথে ব্যাঙ্গ করে উঠলো, ‘ আরে ওর কথা ছাড়তো। ওর জন্যই তো দেড়ি। ও এলোনা। ওদের বাড়ি অব্ধি গিয়েছিলাম, ছেলে মোটেই রাজি নয় আসতে। ‘
চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, ‘ তোরা জোর করেও তো আনতে পারতি নাকি? ‘
তন্নি মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলো, ‘ সরি গো, তোর দোস্তকে তুই ডাক! ‘
‘ দাড়া। ‘ বলেই সামিকে ফোন দিলাম কয়েকবার। ও রিসিভ করছে না। এবারে অনলাইনে গেলাম, ও আছে নেটে। মেসেজ দিলাম,
-কি রে তুই আসবি না?
ও সিন করলো। বললো,
-না।
-কেন? আয় ভাই, তুই না আসলে আমাদের রিসিপশন পূর্ণ’ই হবে না! প্লিজ আয়।
অনেকক্ষণ আর মেসেজ আসলো না। আশাহত হয়ে নেট অফ করবো তখনি টুং করে আসলো মেসেজ। চেক করতে গিয়ে শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। ও লিখেছে,
-আজ একটা কথা বলি সিয়া,তুই আমায় বন্ধুর চোখে দেখলেও আমি তোকে সে চোখে দেখিনি কখনো। আর এটা তুই জানেও কিভাবে বলতে পারছিস হ্যা? তোকে ভালোবাসি আমি! প্লিজ! আমি পারবো না যেতে।
এই ছেলেটার শিক্ষা প্রয়োজন নয় কি? আপনারাই বলেন? বললাম আমি,
-কাল দেখা কর!
#চলবে…..