আমার হৃদয়ে সে পর্ব-১৪

0
878

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১৪

ফোনটা রাখার পর আমার ভেতরে চাপা একটা রাগ ফুঁসে উঠে।সে আমাকে কল দিয়ে তাগাদা করবে তার অফিসে যেতে বলবে আর আমি হন্তদন্ত ছুট লাগাবো!আসলে অভি এখনো আমাকে ভাবে টা কি?আমি তার হাতের পুতুল?আগে যা বলতো,যা শুনাতো তা বাধ্য মেয়ের মতন মেনে নিয়েছি বলো এখনো তা মেনে নিব?! নো!এই পারিসা এখন আর সেই পারিসা না!আপনি বোধহয় বুঝতে এখনো ভুল করতেছেন অভি!পরদিন অভির অফিসে সত্যিই আর যাই নি।না যাওয়াতে ভাবলাম কল করবে আবার।করেনি।

২০.
এখন সন্ধে। ড্রয়িং পেপারসগুলো পুরো বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সেই ড্রয়িং পেপারসের একটাতে আমি একে একে রংতুলি করে যাচ্ছি।আজ হুট করে ইচ্ছে হয়েছিল একটু প্রাকটিকাল ড্রয়িং করতে।ল্যাপটপে ত এ’কটা দিন করেছি এতে খুব তেঁতো হয়ে গেছি।কাগজে করলে একটা প্রাণবন্ততা বলে ব্যাপার আছে। যা অল্যামিনিয়াম পর্দায় ফিল হয় না।ড্রয়িং করতে অনেকটাই করে ফেলেছি।জাস্ট কপি কালারটা লাগালেই ওকে।

“পারিসা?দরজাটা খোল তো একটু?”

খালামণি শব্দ শুনে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দিই।খালামণি ভেতরে আসেন।এসেই খালামণি চোখমুখ কেমন উদ্বিগ্নতা উদ্বিগ্নতা দেখাচ্ছে।বললাম,

“খালামণি কিছু বলবে?”
“পারিসা,অভি এসেছে!”

“পারিসা অভি এসেছে”-তিনটা শব্দ আমার কান বরাবর মস্তিষ্কে ঠুকতেই আমার চমকে যাওয়া অবস্থা।বেসামাল চমকে যাওয়া অবস্থা!চোখমুখ তীব্র কুঁচকে আসে।আকাসময় বিস্ময় নিয়ে বললাম,

” মানে?কখন এসেছে?!”
“মাত্র!”
“কেন এসেছে কারণ জিজ্ঞেস করেছো?”
“করেছি।ওতকিছু বলে নি।বললো আমাদের দেখতে এসেছে।অনেক দিন দেখে নি তাই।তবে ওর হাবভাবে ওরকম কিছু স্পষ্ট হলো না।আমার যতটা মনে হচ্ছে ও তোর সাথেই দেখা করতে এসেছে!”
“কিন্তু খালামণি..!”
“দ্হয়তো কোনো কারণ আছে দেখা করার।কারণ কারণ ছাড়া ওর এখানে আসার প্রশ্নই আসে না।আচ্ছা শোন?তুই থাক রুমে।আমি ওর সাথে কথা বলে দেখি!”

বলে খালামণি দ্রুতপদে বেরিয়ে যান।আমার মাথাটা এখন ঝিমঝিম করতেছে।কপালের চওড়া রগটা দপদপ করছে বারংবার!টাল সামলাতে পারলাম না।বিছানার উপর ছিটকে বসে পড়লাম!এটা কী?ও এখানে কেন?কি চাই ওর?কী চাই?ভাবনার মাঝে খালামণি আবার আমার রুমে আসেন,

“পারিসা?অভি সত্যিই তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।আজ নাকি তোর তার অফিসে যাওয়ার কথা ছিল।তুই যাস নি।তাই এসেছে।কি নাকি ইম্পর্ট্যান্ট প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলবে।”
“আমিতো বুঝতেছি না ওর সাথে আমার কিসের ইম্পর্ট্যান্ট প্রজেক্ট নিয়ে কথা আবার?সবতো গতকালকেই মিটমাট করে এসেছি!”
“সেটাই ত বুঝতে পারছি না।তারপরও দেখ কথা বলে।কথা বললে ত আর সমস্যা না।”

দাঁড়িয়ে থাকলাম সং হয়ে।আমার কোনো রকম ভাবান্তর না দেখে খালামণি এগিয়ে আসেন।পিঠে আলতো হাত রেখে বলেন,

“ও আপাতত আমাদের গেস্ট!ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হবে না।ওর অফিসে ও তোর সাথে যতটুকু সৌজন্যতা দেখিয়েছে তুইও দেখাবি।ব্যাস্ এটুকুই!মানে যোগ-বিয়োগে ফুঁসিয়ে এই আর কি।রাগ-ক্রোধ সব তো মনেই।”

তাকালাম খালামণির দিকে।খালামণির কোনো কথাই অযৌক্তিক নয়।কথাতে লজিক থাকেই।তাছাড়া তার সাথে ত আমি অফিসেই দুই,তিনবারের মতন কথা বলেছি।এখন বললে সমস্যা কি?খালামণিকে বললাম,
“ঠিক আছে।”

তারপর খালামণির পেছনে পেছন হেঁটে গেলাম।খালামণি আমার সামনে থেকে ক্রস কেঁটে কিচেনে ঢুকলেন।আমি সোঁজা অভির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।রসহীন গলায় বলে উঠলাম,

“কেন ডাকলেন আমাকে?”

এতক্ষণ পর ও আমার উপস্থিতি বুঝলো।মাথা তুলে তাকালো।তাকানোর স্থায়িত্ব একটু বেশিই গড়ালো।আমি নড়ে উঠলাম,

“কেন ডেকেছেন,বলুন?”

কথাটি বলামাত্রই কোনো কথা নেই,বার্তা নেই অভি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সোঁজা আমার ডানহাতটা চাপড়ে ধরলো!ওর আকস্মিক এমন কান্ডে আমার চোখজোড়া তীব্র বড় হয়ে যায়।কিচেন থেকে খালামণিও ব্যাপারটা খেয়াল করে বেশ অবাক হলেন।বললাম,
“মানে কী?হাত ধরলেন কেন!”

অভি এবার ভাবলেশহীন ভাবে হাঁটু গুঁজে নিচে বসে পড়লো!
“আই’ম সরি,পারিসা!”

অত্যন্ত কাতর জড়ানো ওর কন্ঠস্বর।আমি চোখজোড়া আরো বড় করে ফেললাম।বললো,
“তোমার ভার্সিটির ওই সিনিয়র ছেলেটার সাথে তোমাকে ভুল বুঝে ফেললাম।কুলাঙ্গারটা তোমাকে নিয়ে যে এতটা খারাপ কিছু বলছে আর আমি তা সাথে সাথে বিশ্বাস করে ফেলেছি এখন নিজের কাছে নিজেকেই ঘৃণা লাগছে!খুব জঘন্যভাবে ঘৃণা লাগছে!
আমি কেন সেদিন তোমাকে না জিজ্ঞেস করে ওর কথাই বিশ্বাস করে নিলাম!এটুকু বিবেল কি আমার ছিল না?
এতটা বিবেকহীন কবে হলাম আমি?!কবে!”

বলতে বলতে অভি যেন আরো ভেঙ্গে পড়লো।আমি হাতটা জোরে ঝাঁকিয় সরিয়ে আনলাম।অভি অপ্রস্তুতনায় ওপড়লো।বললাম,
“অতঃপর আপনি কার থেকে সিউর হলেন যে রিয়াজের সাথে আমার কোনোরকম এফেয়ার ছিল না?”
“রিয়াজের থেকে!ও আজ আমার অফিসে আমার সাথে ও দেখা করতে এসেছে।এসেই বললো সব!”
“বর্তমানে আমার অবস্থান দেখেই কি এসব বানিয়ে বললেন? রিয়াজ জাস্ট একটা এক্সকিউজ মাত্র!?”

অভি চোখ কড়া করে ফেললো।আমি হেসে উঠলাম।তারপর হাসি থামিয়ে বললাম,
“সম্পর্ক সৃষ্টি হয় একে-অপরের বিশ্বাস এবং ভরসার উপর। সেই সম্পর্কটা শুরু হবার আগেই যদি একে-অপরের মাঝে অবিশ্বাস শব্দটা জড়িয়ে যায় তাহলে সম্পর্কা খুবই তিক্ত হয়ে যায়।তবে এদের যুগলবন্দী অপর মানুষটা কিন্তু চেষ্টা করে সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে।ধৈর্য্য নিয়ে মাসের পর মাস,বছরের পর বছর চায় সম্পর্কটা ঠিক করতে।এতদসত্ত্বেও যদি সে ব্যর্থ হয় তাহলে সে মানুষটা খুব তেতো হয়ে যায়।মানুষ ভাবে যে সবসময় মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সাময়িকের জন্যে ক্ষুণ্ণ হলেও পরে তার মাঝে কোনো আড়ষ্টতা থাকে না।সে ঠিক আগের মতন হয়ে যায়।আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি সেরকমই একজন!তাহলে ভুল মিস্টার অভি!কারণ যে অন্যের কথা বিশ্বাস করে বাসর রাতে সদ্য স্ত্রীকে এক পলক না অবিশ্বাস করে ফেলে!সে পরে আর বিশ্বাস করবে কি না তার গেরান্টি নেই!যারা খুব সহজে অবিশ্বাস করে খুব সহজে তা আবার শুধলাতে আসে এদের মাঝে ব্যক্তিত্বের ভাবটা খুবই কম থাকে ।এসব এদের জাস্ট সময়ের আক্রোশতা।আক্রোশতা টা কেঁটে গেলে অন্য আরেকটা বিষয়েও ভুল বুঝে বসবে।আবার অবিশ্বাস করবে।এদের বিশ্বাস নেই।আপনি ক্ষমা করবেন আমাকে।আর হ্যাঁ,এই সময়টার জন্যেই অপেক্ষা করেছিলাম জাস্ট!দেখলাম মেসেজ দিয়ে আমার থেকে সবগুলো ব্যাপার ক্লিয়ার করে দেওয়ার পরও আমাকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিটা থাকে কি না?কিন্তু না।এখন দেখলাম থেকেই গেলো।ওই যে রিয়াজ এসে বললো, আবার সেই রিয়াজের কথাতেই বিশ্বাস হলো।দারণ আপনি,মিস্টার অভি?ভীষণ রকম দারণ!”

“আমি জানি।হ্যাঁ,আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি।বিশ্বাস করো আমি এসব ইচ্ছে করে করিনি।এসব কেনজানি হয়ে গেলো নিজেও জানি না।আর হঠাৎ করে বাসর রাতে ঢোকার আগে ওমন কথা কে ই নিতে পারে,বলো?তারসাথে তোমার এবং তার একসাথে পিক ছিল।তা দেখে ত রাগটা আরো বেড়ে গেলো!আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম।উন্মদা মনে কি করলাম..আই’ম ভেরী আপসেট!”
“তো এখন আপসেট করছেন তা আমাকে বলছেন কেন?আপসেট হলে আমি কি করতে পারি?”

আমার মুখে রুক্ষতা।চোখের কিণার কাণারে রাগের দগ্ধতা!মুখে কোথাও কোনো দুঃখের চিহ্ন টুকু নেই।অভি গভীর মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।এরমাঝে খালামণি আসেন।টি-টেবিলের উপর ট্রে রাখেন।অভি ট্রে-এর তাকায়।তারপর খালামণির দিকে।বলে,

“আমি কিছুই খাবো না,আন্টি!চলে যাচ্ছি!”

বলে চলে গেলো।অত্যন্ত ব্যথিত মনে চলে গেল হয়তো।হ্যাঁ,এদের এরকম নাটকের ব্যথা মন অল্প কিছুদিন থাকবে। পরে আবার আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে।খালামণি বলেন,

“এখন না বলে পরেও বলতে পারতিস এসব কথা।মেহমান মানুষ আসছে। আগে খেতো।”

আমি সরাসরি খালামণির মুখের দিকে তাকাই।খালামণি চোখ নামিয়ে নেন।আমি খালামণিকে আর কিছু বললাম না।রুমে চলে এলাম।দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করলাম।ওড়নাটা রুমের একদিকে ছিটকে ফেলে বিছানায় বেসামাল বসে দুইহাত দিয়ে পুরো মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলাম।

চলবে….