#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৩৪
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
বসার ঘরে পিনপতন নীরবতা। রিজভী তার ভাইদের বোঝাতে ব্যর্থ। তারা কোনোভাবেই তাদের বাবার দায়িত্ব নিবে না। মাকে নিতে তাদের যদিও কোনো অসুবিধা নেই। তার কারণও আছে। মা এখনও শক্ত-সামর্থ্য। যেকোনো কাজই করতে পারে। কোনো কাজ করতে দিলে না ও করতে পারে না। ছেলেদের সংসারে আছে এই তো অনেক। স্বামীর সাথে বনিবনা তার কোনো কালেই ছিল না। তারপর যখন আবার রিজভী বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল,তখন আর তাদের মধ্যে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল না। তাই স্বামীকে নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই তার। নীরবতা ভেঙে আজগর সাহেব বলে,”তাইলে কি আমি পশ্চিম পাশের ভিটায় মাটি ফালানোর কাম শুরু করুম? ঐ পাড়ার হাসুর মা আছে, জামাই তো মরছে।আমি কইলে ও কাম করবো বাড়ির। তোর বাপের অসুবিধা হইবো না। কি করুম তাইলে?”
রিজভী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে হিসেব মিলাতে ব্যর্থ। নিজে একা একা অভিমান করে জীবনটাকে শেষ করেছে সে। কিন্তু পিছনে ফেলে আসা মানুষগুলোর কথা সে একবারও ভাবেনি। তার দায়িত্ব কেউ নেয়নি। কিন্তু সে কাউকে ফেলে দিবে না। নিজেকে সোফায় এলিয়ে দিয়ে বলে,” আমি আর কি বলবো? বাবা তো আমার ভাগের জমি আমার নামে আলাদা করেই রেখেছে। তাছাড়া আমার মায়ের জমি আর দাদীর জমিও তো আমার নামেই আছে। অর্ধেকটা আমি রিতুকে দিয়েছি। দাদীর অংশে আমি বাড়ি বানাবো। সেখানে বাবা থাকবে। বছরে মাঝে মাঝে আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে গ্রামে গেলে সেখানে থাকবো। কিছু ধানি জমিও আমার নামে রাখবো। যেহেতু তোমরা কেউ রিতুকে জমি দাওনি, আমি আমার ভাগে থেকে তাই অর্ধেকই ওকে দিয়েছি। আমি কারো উপর দাবি রাখতে চাইনা। আমিও চাই না কেউ আমার উপর দাবি রাখুক। তোমরা আমার ভাই। তোমরা আমার কাছে চেয়েছো, আমি মানা করিনি। তোমাদেরও দিয়েছি। বিনিময়ে আমি চেয়েছিলাম তোমরা বাবাকে দেখে রাখো। তোমরা সেটাও করছো না। তাহলে আর কি করার! আমি তাহলে আপাতত একটা বাড়ি বানাই ওখানে। যেহেতু বাবা এখানে আসবে না। আর রিতুর ভাগের একটা জমি আমি শুধু বিক্রি করবো। সেই টাকা দিয়ে আমি ওকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দিব৷ যাতে ও নিজের বাড়িতে থাকতে পারে। সেখানে চাইলে ও নিজের কোনো ব্যবসাও খুলতে পারে। ও কিছু না করলেও আমি ওর দায়িত্ব নিব। ওর বাকি জমিগুলো বর্গা দিবো। কারো কোনো দ্বিমত আছে?”
মায়ার মেজো কাকা বলে,”কোনো সমস্যা নাই মিয়াভাই। আপনার ইচ্ছা। ছোটর ও কোনো সমস্যা থাকার কথা না।”
রিজভী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রিতুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”তোর কিছু বলার আছে?”
কৃতজ্ঞতায় রিতুর চোখ চিকচিক করে উঠে। মাথা নিচু করে বলে,”সারাজীবন অন্যের বাড়িতে থাকছি মিয়াভাই। জীবনে দুইটাই আশা ছিল। আমার রিজারে মানুষ করমু আর নিজের একটা ঘরে থাকমু। আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি সেলাই জানি মিয়াভাই। সেলাই করে নিজের সবটা চালাইতে পারবো। আমারে তুমি একটা ঘরের ব্যবস্থা কইরা দাও শুধু। ”
রিতুর কথা শুনে আজগর আলী বলে,”তাইলে আমি সামনে মাস থিকাই শুরু কইরা দিই মাটি ফালানোর কাম। কি কস রিজভী? ভিটাটা উঁচা করোন লাগবো। নাইলে পানি উঠবো। গঞ্জে যায়ে লোকগো খবর দিওন লাগবো। কি রকম ঘর বানাবি?”
রিজভী আনমনে জবাব দেয়,”আমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিলো আমি একটা ঘর বানাবো। তার স্বপ্নের ঘর। ঘরে সবই থাকবে। কোনো এককালে নানার সাথে ঢাকায় এসে এইরকম ফ্ল্যাটবাড়ি দেখেছিল। যাতে কোনো কাজের জন্য গ্রামের মতো ঘরের বাইরে যেতে না হয়। সেইরকম বাড়িই বানাবি। বুঝলি?”
“হো। বুঝছি।”
“তবে, ছাদ দিবি না। টিনের চালা দিবি। দুইতালা বিল্ডিং এর উপরে টিনের চালা দিবি। টাকাপয়সা নিয়ে কোনো কিছু ভাববি না। আমিও মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসবো। তোকে ছাড়া আর কাউকেই ভরসা করতে পারছিনারে বন্ধু।”
কথাটা বলেই নিজের রুমের দিকে উঠে যায় সে। ভাইদের দিকে ফিরেও তাকায় না। সে জানে, এখন হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে তারা। কিন্তু তার পিছনে ঘুরতে ইচ্ছে করছেনা তার।
★★★
“তুমি তো বলছিলা আমারে ঢাকার শহর ঘুরায়া দেখাবা। কবে দেখাইবা?” ছলছল নয়নে সোহাগকে জিজ্ঞেস করে রিজা।
বাবার সামনে বেশ বিব্রতবোধ করে সোহাগ। সামনে মায়ার বাবা-মাও আছে। ইচ্ছে করছে কানের নিচে দুটো থাপ্পড় মারতে রিজাকে। কিন্তু কিছুই বলে না সে।
আজগর আলী সোহাগকে বলে,”ওদের নিয়া তো ঘুরবারও পারোস মাঝে মাঝে। সাব্বির বাবা তো ঘুরার জন্য অস্থির। আজকেই নিয়ে যা না।”
সোহাগ কিছু বলার আগেই রিজভী বলে,”মায়াদেরও নিয়ে যাও সোহাগ। তোমার বাবার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। এই কয়েকটা দিন আমার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেল। আবারও যাবে। তোমার বাবা তো জার্নি করে এসেছে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিক। বাচ্চারা বাসায় থাকলে সম্ভব না। মায়ার কাকারা তো চলেই গেল। ওদের তো রাখতে পারলাম না। এই কয়েকদিন তোমাকেও সময় দিতে পারলাম না। তুমি কি ওদের নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে আসতে পারবে? যদি তোমার সময় হয় আর কি!”
সোহাগ মায়ার কথা শুনেই বলে,”কোনো সমস্যা নাই চাচা। আমি ফ্রিই আছি।”
“তুমি যেইখানে থাকো, আমারে সেইখানে নিয়া যাইবা সোহাগ ভাই? তোমার ভার্সিটিতে? ”
সোহাগ কিছু বলার আগে আবার আজগর আলী বলে,”হো। নিয়া যাইবোনে। তুমি যেইহানে কইবা, সেইহানেই নিয়া যাইবো মা। যাও, তোমার বোনগোরে রেডি হইবার কও। তুমি তো রেডিই দেখতাছি।”
রিজার প্রতি আজগর আলীর অন্যরকম একটা মমতা কাজ করে। বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত মেয়েটাকে তার খুবই ভালো লাগে। সে একসময় চেয়েছিল মেয়েটিকে দত্তক নিতে যাতে রিতু নিজের জীবন সাজাতে পারে নতুনভাবে। কিন্তু না রিতু, আর না রিতুর মা, কেউই রাজি হয়নি। তবুও রিজাকে সে পছন্দ করে। নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে। এখন তো তাও মেয়েটার একটা গতি হয়েছে। মেয়েটা বড় হয়েছে। এখন কত কিছুর দরকার তার। রিজভীর কাছে আসায় সে এখন নিশ্চিন্ত। মেয়েটার এখন হয়তো একটা সুন্দর ভবিষ্যত হবে।
★★★
সন্ধ্যার আকাশে মিটিমিটি তারারা জ্বলছে আর নিভছে। কিন্তু রিজা চুপচাপ বসে আছে। যতোটা আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে সে ঘুরতে বের হয়েছিল, তার কোনো কিছুই আর তাকে স্পর্শ করতে পারছেনা তাকে। সবকিছুই কেমন ম্লান লাগছে তার। একটু দূরে মায়া আর কবিতা বসে বসে গল্প করছে। তাদের পাশের বসে সাব্বির নিজের মতো খেলছে। সে চেয়েছিল সোহাগ এর সাথে সাথে থাকতে। সোহাগ মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু এখানে এসে পুরোই হতাশ সে। সোহাগ তার মেয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করছে। কই তার সাথে তো এইভাবে গল্প করেনা? মেয়েগুলোর দিকে আড়চোখে তাকালো সে। নাহ, এতো সাজেনি তো তারা। মায়া আর কবিতার মতো সিম্পলই আছে। তাহলে তাদের প্রতি এতো কিসের আকর্ষণ তার? তবে কি মায়া আপুর কথাই ঠিক? শহরের ছেলেরা কি তবে আলাদা? তবে যে শাহিদা আপু তার প্রেমিকের জন্য সেজেগুজে স্কুলে যেতো রোজ? তাদের তো বিয়ে হলো। সেও তো সাজে। শুধু সোহাগ ভাইয়ের জন্য। তবে কেন সোহাগ ভাই আজ তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না? সোহাগ ভাই কি তবে শহরে এসে বদলে গেছে? তারও কি এখন ঐরকম মেয়েই পছন্দ? সামনে থাকা টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু উঠিয়ে আকাশ পরিমাণ ক্ষোভ নিয়ে নিজের লিপস্টিক মুছতে থাকে সে। সোহাগ তার দিকে তবু ফিরেও তাকায় না।সে তার মেয়ে বান্ধবীদের নিয়ে ব্যস্ত। আর মাঝেমধ্যে মেয়েগুলো মায়ার দিকে তাকিয়ে সোহাগকে কি যেন বলছে। অতশত বুঝেনা রিজা। সে শুধু চায় সোহাগ তার হবে। শুধুই তার হবে।
★★★
“কবিতা তোমাকে আর কিছু কি বলেছে মায়া?” স্টিয়ারিং এ হাত ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে কাব্য৷
“কোন ব্যাপারে স্যার?”
“আমার বন্ধুর ব্যাপারে।”
মায়া হাসে। হেসে বলে,”সারাদিনই বলে। নতুন করে আলাদা আর কি বলবে?”
“তোমার মনে হয় কবিতা সিরিয়াস?”
“১০০%।”
“তাহলে আর কি? ঘটকালি শুরু করবে নাকি?” বলেই হাসে কাব্য।
মায়াও হাসে। হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,” ভালো কাজ। পূন্যের কাজ। খারাপ তো না।”
আবারও একপ্রস্থ হেসে নেয় দুজন।
“তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“ওহ, হ্যাঁ, বলতে চেয়েছিলাম আমি নিজেই। আপনি সেদিন কি যেন একটা কোচিং সেন্টার এর কথা বলছিলেন। আমি জয়েন করতে চাই। আসলে আমার মনে হচ্ছে, সবগুলো সাবজেক্টই সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। না হলে পরে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলবো।”
কাব্য প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললো,”হ্যাঁ, অবশ্যই। অনেক সিট খালি আছে। তুমি চাইলে কালকে থেকেই জয়েন করতে পারো।”
“ওকে। আমি চেষ্টা করবো।”
“মায়া, হাওয়াই মিঠাই খাবে?”
“এখন?”
“হ্যাঁ, দুটো মিনিট বসো আমি আসছি।”
মায়া কিছু বলার আগেই কাব্য বের হয়ে যায় গাড়ি থেকে।
মায়া চুপচাপ বসে থাকে গাড়ির ভিতর। অনেকটা অস্বস্তি লাগছে তার। সাবিহা ঘুরতে আসলে আজ আর এইসব হতো না। কবিতাকে এনে আবার মেয়েটার ভাইয়ের গাড়িতেই উঠতে হলো। এই রিজাটাও একটা মহা বদ। সাব্বিরকে নিয়ে রিকশায় উঠে পড়লো সোহাগের সাথে। কেন? তার সাথে আসলে কি হতো? সবসময় প্রেমের কথা না বললেই কি নয়? আবার আছে এই কবিতা। মহা ধুরন্ধর। গাড়িতে উঠেই আগে তাকে নিজের বাড়িতে যেতেই হবে। অগত্যা তাকে নামিয়ে দিয়েই মায়াকে নিয়ে আবার উল্টো ঘুরতে হবে কাব্যকে।
“মায়া। এই মায়া। ধরো।”
“হুমম। ” মায়া পাশ ফিরে দেখে কাব্য দুটো হাওয়াই মিঠাই নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। কখন এসেছে বুঝতে পারেনি সে।
“নাও। কোনটা নিবে? সাদা নাকি গোলাপি?”
মায়া ইতস্তত করে বলে,”সাদা।”
কাব্য ওর হাতে একটা তুলে দিয়ে বলে,”সাদা? মেয়েরা তো বরাবর গোলাপি পছন্দ করে।”
“সবাই তো এক হয়না। স্যার। আর তাছাড়া আমি তো জানিনা যে আপনি কোন ধরনের মেয়েদের দেখেছেন।”
কাব্য বুঝলো এক লাইন বেশি বলে ফেলেছে সে। নিজের মাথায় চাটি মারতে ইচ্ছে করছে তার। কবিতা আসলেই ঠিকই বলে। সে আসলেই গরু।পরিস্থিতি সামলাতে বলে,”সাইকোলজি তো বেশিরভাগ সময় এটাই বলে। তাই বললাম আর কি।”
“এই জ্যাম আর ভালো লাগছেনা। কখন যে গাড়ি চলবে।”
“সময় লাগবে না বেশি। অপেক্ষা করো।”
“হুমম। ”
কাব্যর গাড়ি যখন মায়ার বাসার সামনে আসলো, তখন মায়া কাব্যকে বলে,”আজ বাসায় যেতেই হবে স্যার। না গেলে আমি ছাড়ছিনা আপনাকে। চলুন আমার সাথে।”
কাব্য বিড়বিড় করে বলে,” ধরলে কই যে ছাড়বে?”
“কিছু বললেন স্যার?”
“নাহ। কিছুই না। আচ্ছা, চলো। তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”
মায়ার পিছুপিছু কাব্যও গিয়ে লিফটে উঠে। কিন্তু কাব্য কিংবা মায়া কেউ খেয়াল করে না পার্কিং এরিয়া থেকে একটু দূরেই একজন যুবক নিজের প্রেয়সীর চলে যাওয়া দেখছে শান্ত চোখে। তার চোখে কোনো ক্ষোভ না থাকলেও ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যে খাক হয়ে যাচ্ছে।
★★★
” তুমি মিস্টার কবিরের ছেলে না? তোমাকে তো দেখেছিলাম কোনো এক পার্টিতে। তোমার বাবার সাথে।”
মায়ার বাবার এমন প্রশ্ন শুনে কাব্য প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলে,”জ্বি, জ্বি আংকেল।”
“তোমার বাবার সাথে তো আমাদের কোম্পানির বেশ ভালো সম্পর্ক আছে। তোমার বাবা প্রায়ই আমাদের প্রজেক্টে ইনভেস্ট করেন।”
“অহ, আচ্ছা।আমি আসলে বাবার ব্যবসার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানিনা, আংকেল। আমি শিক্ষকতাকেই নিজের পেশা হিসেবে নিয়েছি।”
“বেশ ভালো তো। নিজের জীবন নিজে গড়ছো। বাবার উপর নির্ভরশীল না।”
সাবিহা আড়িপেতে এটুকু শুনেই ছুটে গিয়ে মায়াকে বলে,” আপু, আপু, কাব্য ভাইয়া তো পুরাই নায়কের মতো। কাব্য ভাইয়াকে বাবা চিনে, ভাইয়ার বাবাকেও বাবা চিনে। আমার তো মনে হচ্ছে এইবার কিছু একটা হয়েই যাবে।”
মায়া ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। কি বলবে সে? কি হবে? হওয়াটা কি ঠিক হবে? তাছাড়া নিজেরই এখন ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। কেমন লাগামছাড়া কথা বলেছে আজ সে কাব্যর সাথে। ভাবতেই লজ্জায় মুষড়ে পড়ছে মেয়েটা।
চলবে…..
#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৩৫
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
প্রিয় স্বামী আমার,
আমি জানিনা আপনি কখনো এই চিঠিটি পড়বে কি না। আমার প্রতি আপনার যে বিতৃষ্ণা, আমার চিঠির প্রতিও হয়তো তাই। হয়তো পড়বেন কিংবা পড়বেন না।পড়লেও কবে পড়বেন, খোদা জানে। তবুও আমি লিখছি। আমি যখন চিঠিটি লিখছি, এই মুহুর্তে আপনি আমার স্বামী। কিন্তু যখন চিঠিটি আপনার হাতে যাবে, না আপনি আমার স্বামীরুপে থাকবেন আর না আমি এই দুনিয়াতে থাকবো। আমার সবকিছুর প্রতিই তো আপনার বিরক্তি । শুধু মায়া ছাড়া। আপনি মুখে যতোই বলেন না কেন, আমি জানি আপনি মায়াকে ভালোবাসেন। ভীষণ ভালোবাসেন। কারণ আপনি তার বাবা। আমি যেমন আমার বাবা মায়ের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে, একটা মেয়ের সংসার ভাঙার চেষ্টা করেও আমার বাবার কাছে তার রাজকন্যা হয়েই আছি, সেখানে মায়ার তো কোনো দোষই নেই। ও তো আর কোনো দোষ করেনি। যদিও আমি ছিলাম আমার বাবার বহু প্রত্যাশিত কেউ। আর মায়াকে তো আপনি চানও নি। সে তো আপনার জীবনের একটা উটকো ঝামেলা মাত্র৷ যদিও এতে আপনার কোনো দোষ নেই।
আমি মোহিনী। আপনার সন্তানের মা। আমার পরিচয় আপাতত এইটুকুই। যখন চিঠিটি পড়বেন, তখন আর আমি আপনার স্ত্রী থাকবো না। কারণ আপনি আমাকে ডিভোর্স দিবেন। শুধুমাত্র মায়াকে আপনার কাছে রাখার শর্ত হিসেবে আপনি আমাকে ডিভোর্স দিবেন। আপনার কি মনে হয় নি কখনো, আমার প্রতি আপনি অন্যায় অবিচার করেছেন? আমারও তো চাহিদা ছিল। আপনাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে ছিল। একটা সংসার করার ইচ্ছে ছিল। আমার একটা ভুল কি মাফ করা যেতো না? আমি জানি আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি, আপনার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছি। আপনার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে মিথ্যে অপবাদ দিতে চেয়েছি। সেইজন্য আপনি আপনার মেয়েটিকে দেখতেও আসেন নি। আমি জানি আমি অবিবেচক এর মতো কথা বলছি। কিন্তু আমি তো আপনার স্ত্রী ছিলাম। আমাকে কেন একটু ভালোবাসেন নি। আমি জানি আমি আপনার জীবনটাকে বিষিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু একটা কথা জানেন তো? সবকিছুর উপরে আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। নিজের জীবন দিয়ে ভালোবেসেছি। এতোটাই ভালোবেসেছিলাম যে নিজের সবটুকু আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
আমি জানি এইটা অন্যায় ছিল, ভুল ছিল। কিন্তু নিজের মনকে কিভাবে মানাতাম আমি? আপনার কি মনে আছে, আমি রান্না করলে আপনি সবটুকু খেয়ে নিতেন। কিন্তু আমি ঐ খাবার খেতে পারতাম না। আমি ভাবতাম আমি রান্না করেছি বলে হয়তো আপনি এইভাবে খেতেন। কিন্তু আমি পরে জেনেছিলাম আপনি ক্ষুধার জ্বালায় খেতেন। আপনি সেই অখাদ্য গলাঃধকরন করতেন যাতে আপনার প্রিয় স্ত্রীকে একটু বেশি খাবার খাওয়াতে পারতেন।সেদিন রাতেও কিন্তু আপনি আমার বাসায় খাবারের জন্যই এসেছিলেন। কি অদ্ভুত প্রেম ছিল আপনার। আর আমি আপনাদের মাঝে ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ শয়তান।
আমার যে মাঝেমাঝে আফসোস হয় না, তেমনটা কিন্তু নয়। আমার ভীষণ আফসোস হয়। হয়তো আপনি আমার জীবনে না আসলে আমার জীবনটা অন্যরকম হতো। তবে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যেতো যখন আমি মায়ার দিকে তাকাই। ওর মুখে আপনার চেহারার ছাপ স্পষ্ট। আমি চেয়েছিলাম সংসার করতে। একটা সুখী পরিবার হতে। কিন্তু আমি আমার সংসার গুছাতে গিয়ে যে আরেকটা সংসার ভাঙতে চেয়েছিলাম, সেটা মনে হয়নি।
আমি জানি আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। আমার নিজের জীবন নিয়ে আমার কোনো আশা নেই আর। কিন্তু আমার ভীষণ ভয় হয় আমার মায়াকে নিয়ে। ওর মায়াভরা মুখটার দিকে তাকালে আমার মনে হয় না জানি আমার পাপের ফল আমার বাচ্চা মেয়েটাকে না ভোগ করতে হয়।
এক জীবনে সবকিছু পেতে হবে, তার কোনো মানে নেই। তবে, আমি আমার জীবনে মায়াকে ছাড়া আর কোনো কিছুই অর্জন করতে পারলাম না। ভেবেছিলাম এই জীবনে আপনাকে না পাই, পরকালে তো আপনাকে পাবো। কিন্তু আপনি আমার সেই আশাটুকুও শেষ করে দিলেন। আপনি মায়াকে আপনার কাছে রাখার বিনিময়ে পরকালেও আমার থেকে নিজেকে আলাদা করে দিলেন। আমার দোষটা কি এতোটাই বেশি ছিল? আমি তো আর আপনার সংসারে কখনোই কোনো ঝামেলার সৃষ্টি করিনি। আমাকে শেষ জীবনে কাছে রাখলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো? আপনি আমাকে কি বললেন? আপনার স্ত্রীর হক নাকি আপনি নষ্ট করতে চাননি। সে যে আপনার জন্য সব ছেড়েছুড়ে এসেছে।
আপনার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। কোনো অভিমানও নেই। কারণ, আমার যে সেই অধিকারটুকুও নেই। আমি সেই অধিকার অর্জন করতে পারিনি। আমি শুধু চাইবো আমার মেয়েটাকে আপনি দেখে রাখেন। সাগরিকা যে মায়াকে প্রথমে মেনে নিতে পারবে না, সেটা আমি জানি। তবে আমার মায়ার মায়ায় পড়ে তাকে যে ভালোবাসতেই হবে। আপনি আমার উপরের কোনো রাগ আমার মায়ার উপরে দেখাবেন না। দোহাই লাগি আপনার। আপনারা ছাড়া আমার মায়ার যে আর কেউই নেই এই দুনিয়ায়। আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবো যাতে আমাদের ডিভোর্স না হয়। সংসার হয়তো নেই আমাদের কিন্তু আমার তো আছে। একটা বাচ্চা, মাসে দু একবার স্বামীর দর্শন, এই তো অনেক। আর কি চাই জীবনে? আমি আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ রাখবো না। কারণ, আমার যে অভিযোগ করার অধিকারও নেই।
ইতি
আপনার বিষাক্ত সাপ
চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো রিজভী। নিজের অতীতের সাথে যে আরো একবার সাক্ষাৎ হবে, সেটা আশা করেনি সে। সবতো ঠিকই ছিল। কেন হঠাৎ করেই চিঠিটা সামনে এলো? না এলেই কি ভালো হতো না? সেই কবে সাগরিকার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে কোনো এক পুরোনো ফাইলের মাঝে রেখে দিয়েছিল সে। আজ সেইসব ঘাটাঘাটি করতে গিয়েই সামনে পেয়ে গেছে সে। মোহিনীর জন্য মাঝে মাঝে করুনা হয় তার। মেয়েটি একটা মোহে পড়ে সবই হারিয়েছে। সাথে করে তার নিজের জীবনটাকেও বিষিয়ে দিয়ে গেছে। মুহুর্তেই আবার তেতো হয়ে উঠে রিজভীর মন মোহিনীর প্রতি। তার দুঃখ কষ্ট গুলোকে নিজের করে নিতে পারেনা সে। সে তার কেউ না। কেউ ছিলও না কখনোই। চিঠিটাকে কুটি কুটি করে ছিড়ে ফেলে সে। তার জীবনে এইসব ফালতু মেয়ের কোনো কিছুরই দরকার নেই। কিন্তু মায়াকে সে কিছুতেই ফেলতে পারবে না। সে যে তারও অংশ। সে তার নিজের মেয়েকে ভালোবাসে। পরের কথায় কেন সে ভালোবাসবে? সে এখন বেশ ভালো আছে। মায়াও ভালো আছে। সবাই ভালো আছে। সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে সবাইকে ভালো রাখতে।
★★★
“মিয়াভাই, মায়া সাগরিকা ভাবি আর তোমার মেয়ে না? ও অন্য মহিলার মেয়ে?” অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে রিতু।
আচমকাই এইরকম প্রশ্নে চমকে উঠে রিজভী। রিতু কিভাবে জানে এইসব? কেউ কি তাকে বলেছে?রিতুর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় সে। রিতু সে দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলে,”সাব্বির বলেছে।”
“সাব্বির? কি বলেছে ও?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রিজভী।
রিতু একটু ইতস্তত করে বলে,”বলেছে আমার মাও কি মরে গেছে নাকি যে আমি মায়ার মতো এখানে এসে থাকছি?”
রিজভী বিরক্তিতে মুখটা বিকৃত করে ফেলে।
“আমারে কি বলা যায়না মিয়াভাই সবকিছু? ”
“কেন বলবো না? অবশ্যই বলবো৷ কিন্তু কথা দিতে হবে তোকে,মায়াকে ভিন্ন চোখে দেখবি না মোটেও। এখন যেভাবে দেখছিস, সেইরকমই দেখবি।”
ভাইয়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না রিতু। কিন্তু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায় সে।
ভরসা পেয়ে রিজভী একে একে সবকিছু খুলে বলে তাকে। রিতুর দুচোখে পানি টলমল করে। চোখ বন্ধ করলেই যেন পানিগুলো মুক্তোর দানার মতো টপটপ করে পড়বে। রিজভী তাকে কোনো সান্ত্বনা দেয় না। কাঁদুক সে। সেও জানুক তার ভাইও ভালো ছিল না কোনো কালেই। দুঃখ যে তাদের কারো পিছুই ছাড়েনি।
গভীর রাত। আজকের সারাটাদিনই মোহিনীর স্মৃতিগুলো তাড়া করে বেড়িয়েছে রিজভীকে। বিন্দুমাত্র ঘুম আসছে না তার চোখে। পাশ ফিরে সাগরিকাকে একবার দেখে নেয় সে। এই মানুষটা সবকিছু এতো সহজভাবে নিয়েছে বলেই তার জীবনটা এতো সুন্দর আজ।কিন্তু বুকের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে তার৷সে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। প্রথমে সাব্বিরের রুমে উঁকি দেয় সে। ছেলেটার ভবিষ্যত নিয়ে সে ভীষণ চিন্তিত। তারপর সে যায় বোনের ঘরের কাছে। ভিতরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকতে পারে না সে। ঘুমুচ্ছে তারা। বোন আর বোনের মেয়ে আছে রুমে। কি এক অদ্ভুত জড়তা কাজ করছে। সে উল্টো ঘুরে আসলো মায়াদের রুমে। গিয়েই অবাক হয়ে গেল সে। খাটে শুধু সাবিহা শুয়ে আছে। বুকটা ধ্বক করে উঠে তার। মায়া কোথায়? লাইট জ্বালিয়ে দেয় সে। ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দেখে বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া। তবুও দরা খুলে দেখে নেয় সে। কেউ নেই সেখানে। রিজার কাছে গিয়েছে কি না দেখার জন্য তড়িঘড়ি করে পা বাড়াতেই বারান্দা থেকে মিহি স্বরে কান্না শব্দ শুনতে পায় সে। পা টিপে টিপে সেখানে গিয়ে দেখে মায়া একটা শাড়ি বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের মুখ নিজে চেপে ধরে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। থমকে দাঁড়ায় সে। তবে কি মায়া ভালো নেই? ধীরে ধীরে হেটে মায়ার কাছে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ে। মায়ার মাথায় হাত রাখতেই মায়া হতচকিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নিজেকে একবার সামলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও আবার বসে পড়ে সে। ছোট্ট শিশুর মতো বাবার গা ঘেঁষে বসে পড়ে। রিজভী মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”কি হয়েছে মায়া? কেউ কি বকেছে? কষ্ট দিয়েছে?”
মায়া নাক টানতে টানতে বলে,” নাহ।”
“ব্যথা পেয়েছো কোথাও? কোনো অসুখ করেছে মা?”
“নাহ।”
“কারো সাথে ঝগড়া করেছো? কোনো সমস্যা হয়েছে? স্যার রা বকেছে?”
“নাহ।”
“তাহলে কি হয়েছে?”
মায়া বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার মনে নেই বাবা?”
“কি আজকে? কিছু হয়েছিল?”
মায়াকে দেখে মনে হলো মায়া আশাভঙ্গ হলো। কিছুই বললো না সে। রিজভী তাকে চুপচাপ থাকতে দেখে আবার বলে,”বাবাকে বলা যায় না কি হয়েছে?”
মায়া বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,” আজ আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী বাবা। রাত ২ টা ১৮ মিনিটে আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে বাবা। আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেছে সে।” বলেই হুহু করে কান্না করে উঠে সে।
রিজভী আর বসে থাকতে পারে না সেখানে। মায়ার সেই হাসিমাখা মুখের চোখের চাহনির মাঝে কি একটা অভিমান লুকিয়ে রেখেছে সে।অথচ মুখে হাসি। কি ভয়ানক। মায়ার সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই তার। উঠে পড়ে সে দ্রুতই। বড় বড় পা ফেলে চলে আসে নিজের ঘরে। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে তার এখন। মনে হচ্ছে মোহিনীর ভুত তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আজ সারাদিন। মায়ার সামনে যাওয়ার সাহস তার নেই। কিন্তু সে যদি পেছনে ঘুরতো, তবে দেখতে পেতো মায়া অঝোর ধারায় কান্না করছে। মায়ার এখন তাকে ভীষণ দরকার। মায়ার যে তার বাবার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তার মা ই যে তাকে কোনো অভিযোগ করতে বারণ করে গেছে। শত হোক, মা তো। যতো খারাপ কাজই করুক না কেন, মায়ের সব কথাই সে মেনে নিয়েছে। বাবা যাই করেছে, সবই পরিস্থিতির শিকার হয়ে করেছে। নিজের স্ত্রী আর সন্তানদের কথা ভেবে করেছে। তবুও মায়াও যে আদম সন্তানদেরই একজন। তার মাঝেও যে হিংসা আছে, ক্ষোভ আছে। সেটাকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা মায়ার নেই। সাগরিকা যতোই ভালোবাসুক না কেন, মা তো মা ই হয়। সে ভালোবাসলেও মা, ভালো না বাসলেও মা।
চলবে…..