আমি মায়াবতী পর্ব-৪০+৪১

0
432

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৪০
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

দরজা আঁটকে পুরো ঘর অন্ধকার করে ফ্লোরে বসে আছে মায়া। মাথা নিচু করে কান্না করছে। বাইরে থেকে সাবিহা, আম্মা, রিজা সবাই ডাকাডাকি করছে। সাব্বির কিছুক্ষন পরপর কান্না করছে ভয়ে। তবুও মায়া দরজা খুলছেনা। আজকে তার মন ভেঙে গেছে। নিজেকে কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছেনা। আজকে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। মায়া চান্স পায়নি। সেই কষ্টে কান্না করছে। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যাও পার হয়ে গেলো। কিন্তু মায়া এখনও দরজা খুলেনি। তাই সাগরিকা বাধ্য হয়ে রিজভীকে কল করে সবকিছু জানায়। রিজভী ঘন্টাখানেকের মধ্যে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মায়াকে ধীরে ধীরে কয়েকটা ডাক দিতেই মায়া কান্নাভেজা চোখমুখ নিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রিজভী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে।মায়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বলে,” আমি অনেক চেষ্টা করেছি বাবা। কিন্তু পারলাম না।”
রিজভী বুঝতে পারে মায়ার মনের অবস্থা। তাই হেসে বলে,” সরকারি মেডিকেলেই পড়তে হবে এর কোনো মানে আছে মায়া? তোমার বাবার কি কম আছে নাকি কিছু ? সে তোমাকে প্রাইভেট মেডিকেলেও পড়াতে পারবে। তুমি টেনশন কেন করছো?”
“আমি প্রাইভেটে পড়বোনা।”
“কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রিজভী।
“টাকার জোরে পড়তে চাইনা, বাবা।”
রিজভী হতভম্ব হয়ে গেল মায়ার কথা শুনে। তারপর বেশ ধীরে ধীরে বললো,”বেশ, ভালো কথা। তুমি যা বলবে তাই হবে। তাহলে এখন কি করবে?” ভার্সিটি ট্রাই করবে? নাকি সামনের বছর আবার পরীক্ষা দিবে?”
“দুটোই করবো বাবা।”
“অনেক খাটতে হবে কিন্তু মায়া।”
“জানি আমি।”
“বেশ, ভালো। তুমি যা বলবে, তাই হবে। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে এখন।”
“কি?”
“মন খারাপ করে কান্নাকাটি করা যাবে না মোটেও। তোমার আম্মা আর ভাই-বোনদের অবস্থা দেখেছো? সাব্বির তো কেঁদে অস্থির হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার এমন করা মোটেও উচিত হয়নি মায়া।”
“হুমম, বুঝেছি আমি।”
“এখন রুম থেকে বের হয়ে ওদের সাথে গিয়ে কথা বলো।”
মায়া মাথা নেড়ে বললো,”ঠিক আছে। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও ফ্রেশ হয়ে বের হচ্ছি।”
★★★
গুনগুন করে কান্না করছে সাব্বির আর বারবার বলছে,”আমি ভেবেছিলাম তুমি মরে যাবে মায়াপু।”
মায়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,”কেন তোমার এমন মনে হচ্ছিল?”
“তুমি দরজা আটকে দিয়েছিলে।সাবিহা আর রিজা আপু দরজা ধাক্কাছিল।মা কান্না করছিল। তাই ভেবেছিলাম তুমি মরে যাচ্ছো।”
“আমি কেন মরবো সাব্বির? আমার তো একটা সাহসী ভাই আছে। তাকে ছেড়ে আমি কেন মরবো?”
“তাহলে আর কখনোই দরজা আঁটকাবে না বলো। প্রমিস করো।”
“ওকে। যাও, প্রমিস।”
“সত্যিই?”
“তিন সত্যি।”
“আমিও অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মায়াপু। ভেবেছিলাম তুমি উল্টোপালটা কিছু একটা করে বসবে। আমি তো চিৎকার করাই বাকি রেখেছিলাম শুধু।” গালে হাত দিয়ে বলে সাবিহা।
রিজা মুখ ভেঙচি কেটে বলে,” তুই তো চিল্লাবিই৷ তুই আসলে হয়েছিস আমার মায়ের মতো। শোকর কর যে আমার মা আজ বাসায় নেই তা না হলে চিৎকার আর কান্নাকাটি করে পুরো বিল্ডিংয়ের মানুষ জড়ো করতো।”
রিজার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠে।
★★★
” সরকারি মেডিকেল কলেজ কি তোমার বর যে তাকে না পেয়ে তুমি এইভাবে কান্নাকাটি করছো? আমাকে না পেলেও তো মনে হয় এইভাবে কাঁদতে না। তাইনা?”
কাব্যর নাম্বার থেকে এইরকম একটা মেসেজ দেখে মেজাজটা বিগড়ে গেল মায়ার। শুধু শুধু তাকে না কষ্ট দিলেই কি নয়? মায়া কিছু লিখতেই যাবে তার আগেই কাব্য আবার মেসেজ করে,” কালকে দেখা হবে মায়া। আজকের মতো ঘুমিয়ে পড়ো। আর হ্যাঁ, ভুলেও কাঁদতে পারবে না। তোমার চোখে যেন পানি না থাকে।”
এই মানুষটাকে এখনও বুঝে উঠতে পারে না মায়া। কখন কি বলে মায়া নিজেই বুঝতে পারে না। কিন্তু কাব্যর কথাটা তার ঠিক মনে হয়। এখন তার ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু ঘুমুতে পারছেনা। তার মায়ের যে খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ে তার মেডিকেলে পড়বে। সে ইচ্ছেকে বাস্তবে রুপ দিতে পারলো না সে৷ কিন্তু সে তো চেষ্টা কম করেনি৷ মা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তো৷ কিন্তু মা তো আর নেই৷ তাকে জড়িয়ে আদর করে ঘুম পাড়ানোরও কেউ নেই।
পাশে শুয়ে থাকা সাবিহাকে মায়া বলে,” তুই কাব্য কে কল করে সব জানিয়েছিস?”
সাবিহা কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে থাকে।মায়া রেগে গিয়ে বলে,” ঘুমের ভান ধরবিনা সাবিহা। গুতা মারবো কিন্তু। সত্যি কথা বল।”
সাবিহা তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে বলে,”হ্যাঁ, বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে ছিল ভাইয়া।”
“কিহ?”
“হুমম। ”
“তুই বলছোস কোন দুঃখে?”
” আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই।”
মায়া চাইলেও আর কিছু বলতে পারেনা। সে তাই লাইট বন্ধ করে ঘুমুনোর প্রস্তুতি নেয়। ঠিক সেই সময় দরজা ঠেলে একটা বালিশ হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকে সাগরিকা। তাকে দেখে মায়া বলে,” এখানে কি করছো আম্মা?”
সাবিহাও চোখ দুটো বড় বড় করে বলে,”বাবাকে রেখে এখানে কি করছো মা?”
সাগরিকা দুই মেয়ের বালিশের মাঝখানে বালিশ রেখে শুতে শুতে বলে,” তোদের বাবার নাকে সমস্যা হয়েছে।সারারাত নাক ডাকে। আমি ঘুমুতে পারিনা। তাই এখানে এসেছি। কেন তোদের সমস্যা হবে?”
“নাহ। কোনো সমস্যা নেই। তুমি ঘুমুও মা।”
“মায়া, তোর কোনো সমস্যা?”
“নাহ, তুমি এখানেই থাকো আম্মা।”
“ভালো। এখন যা লাইট অফ করে দিয়ে আয়। চোখে বেশি আলো লাগে।”
মায়া লাইট বন্ধ করে দিয়ে এসে সাগরিকার পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। সাগরিকা মুখে এককথা বললেও মায়া আর সাবিহা ভালোমতোই জানে, সে মায়ার জন্য এখানে এসেছে। সন্তানের সফলতা আর ব্যর্থতা সবকিছই মায়েদের মেনে নিতে হয়। মায়েদের উপরের খোলসটা শক্ত হলেও ভেতরটা যে নরম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাগরিকা বুঝতে পারে সাবিহা আর মায়া দুজনেই ঘুমিয়ে গেছে। সাগরিকা মায়ার পাশে ফিরে ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তারও প্রায় কিছুটা চোখ লেগে আসে। ঠিক এমন সময় মায়া বলে,” আম্মা।”
সাগরিকা হুট করেই মাথা থেকে তার হাত সরিয়ে নেয়। কিছুটা সময় নিয়ে বলে,” কি মায়া?”
“তুমি কি একটা কথা জানো?”
“কি?”
“তুমি কি জানো তুমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা আর সবচেয়ে ভালো মানুষ? ”
সাগরিকা বরফের মতো জমে যায়। মায়ার সাহস বেরে যায়। সে বালিশ ছেড়ে সাগরিকার বুকের কাছে গিয়ে তার মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। সাগরিকাও তাকে পরম মমতায় নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। এই প্রথমবার তারা দুজনেই অনুভব করে তারা এখন থেকে নিজেদেরকে মা-মেয়ে হিসেবে মেনে নিয়েছে। সাগরিকা ভাবে তার অনেক আগেই উচিত ছিল মায়াকে এইভাবে ভালোবাসা। হয়তো সে চিরাচরিত সৎ মায়েদের মতো তাকে অবহেলা করেনি। কিন্তু মাতৃস্নেহে তো নিজের সন্তানের মতো কাছেও টেনে নেয়নি। নিজের কাছেই নিজেকে বেশ ছোট লাগে তার। সে অনুভব করে মায়া কাঁদছে। তার চোখের পানির স্পর্শ সে অনুভব করতে পারছে। কিন্তু তার ইচ্ছে করছেনা তার চোখের পানি মুছে দিতে। লাভ কি হবে তাতে? বরং সব দুঃখ-কষ্ট গুলো ধুয়ে মুছে যাক না হয়। এই মেয়েটি তার স্বামীর বায়োলজিকাল মেয়ে। কিন্তু তার না। তবে এই মেয়েটিকে একটা সময় ব্লাড দিয়েছিল সাগরিকা। তার নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে তাকে বাঁচিয়েছিল সে। তার অবদানই বা কম কিসে? মায়া তারও মেয়ে। একসময় মায়া কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। তবে সাগরিকাকে ছাড়ে না। হয়তো ঘুমের ঘোরে নিজের মা ভেবেই এখনও ধরে আছে। সাগরিকা নিজেকে প্রবোধ দেয়। নিজের মা ভেবে কেন ধরবে ? মায়া তো তারই মেয়ে। তাকে ভেবেই ধরেছে।

চলবে…..

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৪১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“তুমি তাহলে আবার সামনের বছর পরীক্ষা দিবেই? আবার এই বছর ভার্সিটি পরীক্ষাও দিবে?” চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে মায়াকে জিজ্ঞেস করে কাব্য।
মায়া মাথা নাড়িয়ে বলে,”হ্যাঁ।”
“হুমম। বুঝলাম। ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু তোমাকে অনেক খাটতে হবে।”
“জানি আমি।”
“তুমি প্রস্তুত? ”
“মেইবি এখন না।”
“হুমম। কিছুদিন রেস্ট নাও। তারপর পড়াশোনা শুরু করো আবার।”
“হুমম। ”
“তাহলে তো আমাদের বিয়ে আবারো পিছিয়ে যাবে।”
“মানে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মায়া।
“মানে হচ্ছে তুমি আবার ভার্সিটির জন্য প্রিপারেশন নিলে কি আর আমাকে এখনই বিয়ে করবে? তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে না?”
মায়া মাথা চুলকে বলে,”আমি আসলে এইভাবে ভেবে দেখিনি।”
“কিন্তু ভাবতে তো হবে মায়া। আমি আসলে এইভাবে তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি কিন্তু। ”
“কিন্তু কি?”
“প্রবলেম হচ্ছে সোহাগ।”
“মানে?”
“ও যদি তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রোপোজাল নিয়ে যায় আগে? ওর বাবাও তো তোমার বাবার বন্ধু। যদি ওদের কথা ফেলতে না পারে, তবে কি হবে?”
মায়া মাথা নিচু করে বলে,”আমি আসলে বুঝতে পারছিনা যে আমি কি করবো। আপনার কথাও ঠিক। কিন্তু এই বছরে আমাকে অনেক পড়াশোনা করতে হবে।এই অবস্থায় বিয়ে হলে কিভাবে হবে।”
“হুমম,বুঝেছি।”
“এখন কি করবো? আমাকে বলুন।”
“তোমাকে কিছুই করতে হবে না। যা করার আমিই করবো। তুমি শুধু বলো, তুমি কি তোমার বাবাকে বলতে পারবে যে তুমি আমাকে পছন্দ করো?”
“মেইবি পারবো।”
“মেইবি বললে হবে না। হ্যাঁ বা না বলো।”
“ওকে। বলবো। আর আমি না বললেও সাবিহা বলে দিবে।”
“হুমম। ছোটবোনের থেকে কিছু শিখো মায়া।”
“জ্বালায়েন না আমারে।”
“ওকে। চলো আজকে কোথাও থেকে ঘুরে আসি আমরা।”
“কবিতা কই? ওর ও তো চান্স হলো না। কান্না করেছে নাকি?”
“ও বিন্দাস আছে। ওর মিশন ভার্সিটি। তবে তোমার কথা শুনে মন খারাপ করেছে। ”
“হুমম। ”
“কোথায় যাবে বলো?”
“আপনাদের বাড়িতে যাবো। কবিতার সাথে দেখা করতে হবে।কথা আছে ওর সাথে।”
“সেখানে গেলে তো আর আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। বান্ধবী নিয়েই পড়ে থাকবে।”
“আপনার সাথেও গল্প করবো।”
“ওকে। চলো। গাড়িতে উঠো।”
“অতো পাগল হইনি মাষ্টারমশাই। আপনার গাড়ি চড়ে আপনার বাড়িতে যাবো কেন? আপনার এলাকার কেউ দেখলে?তাছাড়া আপনার মা-বাবা যদি দেখে আমি আপনার গাড়ি থেকে নামছি। তাহলে কি ভাববে?”
কাব্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “তোমার কি মনে হয়, আমার বাসায় কেউ জানে না?”
“মানে?”
“সবাই জানে আমাদের কথা।”
মায়া হুট করে বসা থেকে উঠে বলে,”আমি যাবোনা আপনার বাসায়। ছিহ!কি ভাববে সবাই আমাকে?”
“ঢং করোনা মায়া। চলো।”
“নাহ। আমি যাবো না। ”
“কেন?”
“এমনি।”
“বিয়ের পর তো ঐখানেই থাকতে হবে। তাইনা? তাহলে যাবে না কেন?”
“বিয়ের আগে আর যাবোনা। একেবারে বিয়ের পরেই যাবো।”
“কি মুশকিল! তোমাকে বলাই তো ভুল হলো।”
“হুমম। কিন্তু আমি যাবোনা।”
“তোমাদের মেয়েদের মন বুঝা দায়। এই ভালো তো এই খারাপ। তোমাদের এই ঘন ঘন মুড সুইং যে আল্লাহ কেন দিয়েছে সেটা আল্লাহই ভালো জানে।”
মায়া কপট রাগ দেখিয়ে বলে,”মেয়েদের নিয়ে বাজে কথা বলবেন না একদম।”
“ওকে, যথাআজ্ঞা মহারাণী।”
মায়া খিলখিল করে হেসে উঠে তার প্রেমিক পুরুষের কথায়। আর তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে বিপরীত পাশে থাকা মানুষটি।
★★★
“তোর মতো মেয়ে ঘরে থাকলে, তোর বাপের ফকির হইতে আর বেশিদিন বাকি থাকবোনা সাবিহা। সর তো সর। আসছে কেক বানাইতে।ভাত রান্না করতে পারেনা উনি আবার বোনের জন্য কেক বানাবেন বোনের মন ভালো করার জন্য। ” সাবিহাকে রান্নাঘর থেকে ঠেলে বের করে ব্যঙ্গ করে কথাগুলো বলে রিজা।
সাবিহা গাল ফুলিয়ে চেয়ারে বসে থাকে। কিছু সময় মন খারাপ করে গাল ফুলিয়ে থেকে বুঝতে পারে কেউ এসে এখন তাকে স্বান্তনা দিবে না। কারণ সে আর রিজা ছাড়া যে কেউই বাসায় নেই। মায়া গেছে কাব্য ভাইয়ার সাথে দেখা করতে। মা গিয়েছে সাব্বিরের সাথে। বাবা অফিসে আর ফুপি দোকানে। সে চেয়েছিল নিজে হাতে একটা কেক বানিয়ে মায়াপুকে চমকে দিতে। কিন্তু বরাবরের মতো এইবারও সে কেক বানাতে ব্যর্থ। কেকটা চুপসে গেছে পুরোপুরি। দেখতে অনেকটা টুপির মতো। কিংবা ডোরেমনের ডোরাকেকের এক পাশের মতো। প্রথমবার যখন কেক বানাতে গিয়ে এই অবস্থা হয়েছিল তখন সে নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিতে কেকের মাঝখানে চকলেট ঢেলে খেতে গিয়েছিল। কিন্তু তার স্বাদ ছিল জঘন্য। কিন্তু সে দমে যায়নি। একের পর এক কেক বানিয়েই গেছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। কেক তো হয়ইনি তার উপর আবার পুরো রান্নাঘর নোংরা করে ফেলেছে। সাগরিকা থাকা অবস্থায় আর সে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়নি কিন্তু সে না থাকলেই ঢুকে গিয়ে এই কাজটা করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। কেউ তাকে স্বান্তনা না দেওয়া পর্যন্ত তার গাল আর স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনা। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। বাসায় রিজা ছাড়া আর কেউ নেই। রিজা রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘর পরিষ্কার করছে তাই তার থেকে সহানুভূতি আশা করাটা ঠিক হবে না। সাবিহা প্রায় আশা হারিয়েই ফেলেছিল কিন্তু হঠাৎ করেই বাসার কলিংবেল বেজে উঠলে সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে চুপচাপ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার অপরপাশে থেকে মায়া বলে,” এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সামনে থেকে সর। আমি তো ভিতরে ঢুকবো।”
সাবিহা কোনো কথা না বলে চুপচাপ সরে দাঁড়ায়। মায়া নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়েও ফিরে এসে সাবিহাকে বলে,”এই কি হয়েছে? এইভাবে সংয়ের মতো গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
সাবিহা কোনো জবাব দেয় না। রান্নাঘর থেকে রিজা উত্তর দেয়,” কি আর হবে?গাল ফুলানোর কেক বানাইছে। কেক তো ফুলে নাই। তাই গাল ফুলায় রাখছে।”
মায়া বুঝতে পারে রিজা কি বলতে চাইছে। নিজে টেবিলে রাখা কেকটার দিকে তাকিয়ে দেখে ঠিক আগের মতোই হয়েছে এইটাও।ততক্ষণে রিজাও রান্নাঘর পরিষ্কার করে চেয়ারে এসে বসতে বসতে বলে,”কোমড়টা গেছে আমার। পুরো ঘর আটা-ময়দা দিয়ে মাখিয়ে রাখছিল। সেইসব পরিষ্কার করা কি চাট্টিখানি কথা?”
“আজকে আবার কেক কেন বানিয়েছিস সাবিহা?”
সাবিহা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। রিজাই বলে,” তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু নিজেই চমকাইয়া গেছে। “বলেই হিহি করে হাসতে থাকে রিজা।
মায়া দাঁড়িয়ে থাকা সাবিহার কাছে গিয়ে ওকে এনে বসিয়ে বলে,” কেক যেমনই হোক না কেন, আমার জন্য যেহেতু বানিয়েছিস, আমি তো খাবোই।”
সাবিহার চোখ চকচক করে উঠে। উল্লোসিত গলায় বলে,”তুমি খাবে? সত্যি?”
“হুমম। ”
“কিন্তু এইভাবে কিভাবে খাবে?”
“তুই যা। রান্নাঘর থেকে মধু নিয়ে আয়। তাহলেই হবে।”
সাবিহা ছুটে গিয়ে মধুর বৈয়াম নিয়ে আসে। মায়া খানিকটা মধু বাটিতে ঢেলে কেক ছিড়ে ছিড়ে সেটা দিয়ে মিশিয়ে খেতে থাকে। কেকটা এতোটাই শক্ত হয়ে গেছে যে সে সেটাকে একটা সময় পর মধুর মধ্যে চুবিয়ে রাখে। তার দেখাদেখি প্রথমে রিজা আর তারপর সাবিহাও নিজেদের মুখে তুলে নেয় কিছুটা।রিজা খেয়ে বলে,”মন্দ হয়নি খুব একটা। তবে, মধুটা বাড়তি লাগলো।”
সাবিহা খেতে খেতে বলে,”আমার তো ভালোই লাগছে। মিষ্টি মিষ্টিও আছে।”
রিজা বিড়বিড় করে বলে,” তা মিষ্টি হবে না? মশলাপাতি তো আর কম কিছু দাওনি এর মধ্যে। ”
সাবিহা রিজাকে বলে, “কিছু বলছো রিজাপু?”
“নাহ। কিছুই তো বলিনি আমি।নে খা খা। খুব মজা হয়েছে। দোকানের কেক ফেইল।”
তারা তিনজনেই জানে কেমন হয়েছে। তাই রিজার কথা শুনে রিজাসহ তিনবোনই হাহাহা করে হেসে উঠে।
★★★
“ফোন কেন ধরছিলে না মায়া? আমি তো তোমার স্যার হই। তাইনা? মিনিমাম রেসপেক্ট তো আমি পাই তোমার থেকে।”
মায়া ছোট্ট করে বলে,” ওয়াশরুমে ছিলাম সোহাগ ভাই। তাই ধরতে পারিনি।”
সোহাগ ফোনের অপরপাশে থেকে বলে,”তোমার রেজাল্ট দেখলাম কালকে। খারাপ লাগলো৷ তবে ভেঙে পড়োনা। সামনে আরো সুযোগ আছে। সেইসবের জন্য প্রস্তুতি নাও।”
“হ্যাঁ, ভাইয়া।দোয়া রাখবেন আমার জন্য। ”
“সবসময়ই তোমার জন্য দোয়া করি মায়া।তাই দোয়া চেয়ে আর লজ্জা দিও না আমাকে।”
মায়া কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা। তাই শুধু বলে,”জ্বি, ভাইয়া।”
“শোনো, মায়া। একটা কথা বলার জন্য তোমাকে কল করেছিলাম।”
“জ্বি, বলুন।”
“তোমাকে তো অনেকদিন পড়ালাম। একটা ট্রিট তো পাওনা আছে তোমার। কবে ফ্রি আছো বলো? কবিতাকেও আসতে বলো।”
মায়া বেশ শান্তস্বরেই বলে,”এখন পারবো কিনা জানিনা। তবে আপনাকে জানাবো।”
“ওকে। বাট বেশি দেরি করোনা। আমি আসলে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছি। লিখিত পরীক্ষায় টিকেছি। ভাইবাও মোটামুটি ভালোই হয়েছে। চাকরীটা হয়ে গেলে কোথায় পোস্টিং দেয় বলা যাহ না। তাই একটু তাড়াতাড়ি করো।”
“আচ্ছা, ভাইয়া।”
“আমার জন্য দোয়া করবে না?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। দোয়া করি যেন আপনার চাকরিটা হয়ে যায়।”
“ধন্যবাদ,মায়া।”
“ভাইয়া, আমি একটু বাইরে যাবো৷ পরে কোনো এক সময় কথা হবে।ভালো থাকবেন।”
“ওকে মায়া। তুমিও ভালো থেকো।”
সোহাগের থেকে এতোটুকু শুনেই মায়া কল কেটে দেয় তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। বিরক্ত লাগে তার এই লোকটাকে। কিন্তু কোনোভাবে একে পাশ কেটে জীবনে চলা যায়না।
★★★
৩ মাস পর….
এক সন্ধ্যায় সাবিহা আর রিজা নিজেদের রুমে পড়তে বসেছে। মায়া সাব্বিরকে পড়াতে বসিয়েছে। সাগরিকা তাদের সবাইকে যার যার রুমে চা দিয়ে মায়াকে বলে,”তোর বাবা ডাকছে মায়া। ড্রয়িংরুমে যা। ”
মায়া স্বাভাবিকভাবেই সাব্বিরকে পড়া দিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে সেখানে বাবা, আম্মা আর ফুপি বেশ গম্ভীরমুখে বসে আছে। মায়া তাদের দেখেই বুঝতে পারে এইখানে কোনো সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে। রিজভী চোখের ইশারায় মায়াকে এক সিটের সোফায় বসতে বলে। মায়া ধীরে ধীরে সেখানে বসে তাদের দিকে তাকায়। তার মনে হচ্ছে সে যেন কোনো ইন্টারভিউ দিতে বসেছে। কিংবা তাকে জেরা করা হচ্ছে। মায়া বাবাকে জিজ্ঞেস করে,”কিছু কি হয়েছে বাবা?কিছু বলবে আমাকে?”
রিজভী কিছু সময় চুপ করে থাকে। তারপর সরাসরি মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,” তুমি এখন বেশ বড় হয়েছো মায়া। তুমি কলেজে উঠার পর থেকেই তোমার বিয়ের প্রোপোজাল আসা শুরু করেছে। কিন্তু আমরা পাত্তা দেইনি। কারণ তুমি তখনও ছোট ছিলে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। তুমি এখন বোঝো অনেক কিছু। তাইনা?”
মায়া মাথা নিচু করে মাথা নাড়ে।
রিজভী আবার বলে,”সাতদিন আগে একজন আমাকে তোমাকে তার ছেলের বউ করে নিতে চেয়েছে। সে যথেষ্ট ভালো মানুষ। আমার পরিচিত। আমি তাকে এড়িয়ে যাইনি। তার ছেলেকে তুমি চেনো। সেও যথেষ্ট ভালো মানুষ। তোমার আম্মা, ফুপিরও একই ধারণা। তারাও তাকে পছন্দ করেছে।”
মায়ার হৃদয় লাফিয়ে উঠে। তবে কি সোহাগ ভাইয়ের বাবাই সবকিছু বলেছে। সে ঘামতে থাকে ক্রমাগত। ভীষণ পানি পিপাসা পাচ্ছে তার। কিন্তু এইখান থেকে উঠার শক্তি তার নেই।তাই মাথা নিচু করে সবকিছু শোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।
রিজভী আবার বলে,”আমার ধারণা, তুমি তাকে পছন্দ করো। হয়তো সেও তোমাকে পছন্দ করে। ছেলেটা ভালোই। খারাপ না।”
ভাইকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে রিতু বলে,”হ্যাঁ, মিয়াভাই। ঠিকই কইছো। কাব্য ছেলেডা ভালোই। খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলে।”
মায়া হকচকিয়ে উঠে ফুপির দিকে তাকালো। কার কথা বললো?কাব্যর কথা? তবে কি কাব্যর বাবা বিয়ের প্রোপোজাল দিয়েছে। রিজভী আবারও কিছু বলতেই যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বাসার কলিংবেলটা বেজে উঠে। রিতু গিয়ে দরজা খুলে দিলে সবাই দেখে সোহাগ আর তার বাবা এসেছে। আজগর আলী কে দেখেই রিজভী উঠে গিয়ে তাকে বলে,”তুই? এইসময়? আসবি বলে আসবি না?আর তোর হাতে এটা কি? মিষ্টির প্যাকেট? হঠাৎ মিষ্টি আনলি কেন?”
আজগর আআলী জবাব দেওয়ার আগেই রিতু বলে,”মিষ্টি আনছেন, ভালোই করছেন ভাইজান। আমাদের মায়ার বিয়া ঠিক হইলো আজ। শুভসময়েই আইছেন মিষ্টি নিয়া। আপনাগো মিষ্টি দিয়াই না হয় মিষ্টিমুখ করলাম। আসেন আসেন।”
আজগর আলী আর সোহাগ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সোহাগ সহসাই তাকায় মায়ার দিকে। আর আজগর আলী সোহাগের দিকে। তারপর সোহাগের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। বাবার হাতের মুঠোর স্পর্শে সোহাগ বুঝে যায় তারা এখানে যে উদ্দেশ্যে এসেছে,সেটা যেন ভুলেও এখন এখানে উচ্চারণ না করে। আজগর আলী বলে,”ভালোই তো। এক কাজে দুই কাজ হয়ে গেল। আমি মিষ্টি আনছিলাম আমার পোলা চাকরি পাইছে হের লাইগা। আইসা শুনি আমাগো মাইয়ারও বিয়া ঠিক।ভালোই তো।”
রিজভী বলে,”চাকরি তো পাইছে দুই মাস আগে। ও তো এসে মিষ্টি খাইয়ে গেছে আমাদের৷ তুই আবার শুধু শুধু কেন এতো কষ্ট করতে গেলি? আয় আয় ভিতরে এসে বোস তো আগে।”
মায়া নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।সোহাগ আর তার বাবা শুকনো মুখে বসে। আজগর আলী এটা সেটা কথা বলছে রিজভীর সাথে। কিন্তু সোহাগ মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। তার ইচ্ছে করছে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কান্না করতে। ইচ্ছে করছে মায়াকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যেতে। ইচ্ছে করছে মায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতে,” আমার মাঝে কি এমন কমতি ছিল যার কারণে তুমি আমাকে ভালোবাসলে না?”
মাথাব্যথায় সোহাগের মাথা যেন ছিড়ে পড়ছে। বিরবির করে সে বলতে থাকে,”হে আল্লাহ, এক তরফা ভালোবাসাগুলো এতো কষ্টদায়ক কেন? যখন তাকে আমার জন্য সৃষ্টিই করোনি, তবে কেন তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে? কেন তার মায়ায় আমাকে জড়িয়েছিলে?কি দোষ ছিল আমার যে সারাজীবন আমাকে এই একপাক্ষিক প্রেমের দহন সইতে হবে?”
চলবে…..