#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৪৪
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“তুমি কি নিশ্চিত সোহাগ ভাই? ”
“হ্যাঁ, শতভাগ নিশ্চিত। আমি তোকে ভালোবাসি রিজা।”
রিজা মুচকি হাসে। সোহাগের দিকে একবারও চোখ তুলে তাকায় না।কফির কাপের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি যেন কি খুঁজে সেখানে।
“তুমি তাহলে আমাকে বিয়ে করতে চাও?”
“হ্যাঁ, মায়ার বিয়েটা হয়ে গেলেই তোকে আমার ঘরের বউ করে নিয়ে যাবো।”
রিজা এবার সরাসরি সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলে,”কিন্তু আমি যে আর গ্রামে ফিরে যাবো না। ওখানে আমি আর থাকতে পারবো না। আসলে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তো।”
“তুই চাপ নিচ্ছিস কেন? আমি তো তোকে গ্রামে নিয়ে যাবো না। আমি ফ্ল্যাট ভাড়া করবো। তোকে নিয়ে সেখানে থাকবো। বাবা-মাও আসবে। আর আমার বোন তো এখন হোস্টেলে থাকে। তখন তাকেও নিয়ে আসবো। সবাই একসাথে থাকবো।”
“সত্যি?”
“হুমম, সত্যি।”
“তাহলে তুমি নিশ্চিতভাবে বলছো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো আর আমাকে বিয়ে করতে চাও?”
“হ্যাঁরে বাবা। ভালোবাসি, ভালোবাসি।”
“তুমি কোথায় ফ্ল্যাট নিবে?আমি কিন্তু আমার মাকেও আমাদের সাথে রাখবো।”
“সমস্যা নেই। ফুপিও আমাদের সাথেই থাকবে।”
“আমি কিন্তু মামা-মামীদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবো।”
“হ্যাঁ, সেদিকেই নিবো। শোন, আমার অফিস মায়ার শ্বশুরবাড়ির ঐদিকেই। আমি চেষ্টা করবো ঐদিকে বাসা ভাড়া নিতে।”
রিজা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বেশ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,” বাসা ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করবে নাকি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়ে গেছে?”
সোহাগ বেশ থতমত খেয়ে বলে,”কি সব আবোলতাবোল বলছিস? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ”
রিজা সোহাগের দিকে তাকিয়ে বেশ শক্তভাবেই বলে,”ভুল কিছু বললাম? নাকি মিথ্যে বললাম? অবশ্য মিথ্যে বললেই কি? আমি না হয় একটা ভুল কিংবা মিথ্যে কথা বললাম। কিন্তু তুমি তো আমার সামনে বসে অনর্গল মিথ্যে বলেই চলেছো। তার বেলায়?তোমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?”
সোহাগ শেষ একবার নিজেকে শান্ত করে বলে,”আবোল তাবোল কি সব বলিস না তুই। নে, আরো কিছু খাবি নাকি অর্ডার কর।”
রিজা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “আমি কিন্তু জানি তুমি কেন আমাকে বিয়ে করতে চাইছো। বলি আমি?”
রিজার গলার স্বরের কাঠিন্য দেখে সোহাগ বেশ ভড়কে গিয়ে বলে,”তোকে ভালোবাসি তাই।”
রিজা আবার হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,”আমার গ্রামে কেন সোহাগ ভাই, বস্তিতেও তোমার সাথে সংসার পাততে সমস্যা হতো না। কারণ আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি। আমি দুই কাপড়ে বছর পার করে দিতে পারতাম যদি তুমি আমাকে ভালোবাসতে।”
“আমি তো তোকে ভালোবাসিই, রিজা।”
“নাহ, তুমি আমাকে ভালোবাসো না।তুমি নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য আমাকে বিয়ে করতে চাইছো। আমি কি বলবো, কেন তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইছো? কিংবা মায়ার শ্বশুরবাড়ির কাছেই আমাদের সংসার পাততে চাইছো?”
সোহাগ মাথা নিচু করে থাকে। সে বুঝে গেছে সে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করতে পারেনা। রিজা বেশ কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও কারণ তুমি মায়া আপুকে ভালোবাসো। তার সাথে কিছুটা সম্পর্ক বজায় রাখতেই তুমি আমাকে বিয়ে করে তার আশেপাশেই থাকতে চাও। মিস্টার সোহাগ, আমি কি ভুল বললাম?”
সোহাগ তবুও মাথা নিচু করে থাকে। কোনো জবাব দেয়না।
রিজা বলে,”আমার তো তোমার উপর কোনো অভিযোগ ছিল না সোহাগ ভাই।আমি যদি আগের রিজা হতাম,তাহলে আমি সহজেই তোমাকে বিয়ে করতে চাইতাম। তুমি মায়া আপুকে ভালোবাসো এটা জেনেও বিয়ে করতাম।কারণ আমার কোনো আত্মমর্যাদা ছিল না আগে। তুমি যখন মায়াপুকে পড়াতে এসে আমাকে ইন্ডিরেক্টলি অপমান করতে,আমি বুঝতাম না।মায়াপু আমাকে বোঝাতো তোমার কাছে না যেতে।তার তোমার এই আচরণ ভাল লাগতো না৷সে আমার বোন।আমার অপমান সে মেনে নিতে পারতোনা। আমার রাগ হতো কেন তুমি আমাকে ভালোবাসতে না।তোমাকে খুশি করতে আমি কত কিছুই না করতাম। তবুও আমার দিকে ফিরেও তাকাতে না। তখন তোমার প্রতি অভিযোগ থাকলেও এখন আমার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ আমি এখন জানি ভালোবাসা জোর করে হয়না।না হলে তোমার মতো ছেলেকে মায়াপু কেন রিজেক্ট করবে?ভালোবাসা রুপ দেখে হয়না।না হলে তো তুমি আমার সাজগোজ করা চেহারা দেখেই ভালোবাসতে।আমার পাগলামো দেখে ভালোবাসতে।তুমি তো বুঝতে আমার অনুভূতি।তুমি তো আর আমার মতো অবুঝ না। তাইনা?”
“আমি তোকে কখনোই ভালোবাসিনি,রিজা।”
রিজার চোখে পানি এসে পড়ে।সে জানে সোহাগ তাকে ভালোবাসে না।তবুও তার মুখ থেকে ভালোবাসিনা শব্দটা তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছে।সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”তুমি কাজগুলো ভালো করলে না সোহাগ ভাই।মায়াপুর বিয়ে ভাঙতে চাইলে আবার মায়াপুর আশেপাশে থাকার জন্য আমার অনুভূতিগুলো আবার জাগিয়ে তুমি মোটেও ভালো কাজ করলে না।”
সোহাগ আঁতকে উঠে। সহসাই তাকায় রিজার দিকে।রিজা কিভাবে জানে যে সে মায়ার বিয়ে ভাঙতে চেয়েছিল। অস্ফুট স্বরে রিজাকে জিজ্ঞেস করে,”তুই কিভাবে জানলি?”
“উফফ, থ্যাংকস সোহাগ ভাই। তুমি স্বীকার করে নিলে।অন্ততপক্ষে আবার তো বলোনি যে রিজা,তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
“তুই কিভাবে জানলি?”
“সেদিন তুমি কাব্য ভাইয়ের বড় ফুপির সাথে শপিংমলে কথা বলেছো। তোমাকে আমি দেখেছিলাম।তুমি মাস্ক পড়ে ছিলে বলে যে তোমাকে আমি চিনবো না,তুমি ভাবলে কিভাবে?তুমি না মায়াপুকে ভালোবাসো?তাকে ভালোবাসলে তার ক্ষতি কিভাবে চাইতে পারলে?তার সবচেয়ে বড় দূর্বলতাকে কেন সবার সামনে তুলে ধরলে?তুমি আসলে মায়াপুকে ভালোই বাসোনি কোনোদিন। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।কিন্তু আমি চাই তুমি যেখানেই থাকো,যার সাথে থাকো,তুমি যাতে ভালো থাকো।”
“আমি মায়াকে ভালোবাসি।ভালোবাসলে তাকে পেতে চাওয়া অন্যায় না।”
“তাতে কি লাভ হলো? বিয়েটা তো হচ্ছেই।কোনোভাবেই আটকাতে পারলে না।জীবনটা মায়াপু আর কাব্য ভাইয়ার।ওরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ের।ওদের সমর্থন করেছে ওদের বাবা-মা।কে ওদের বিয়েতে আসলো আর কে আসলো না,সেটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই।ওদের দাওয়াত দেওয়ার দরকার,ওরা দাওয়াত দিয়েছে।আর জানো তো, আমে দুধে মিলে যায় আর আঁটি কিন্তু অবহেলায় ডাস্টবিনে পড়ে থাকে। ওদের ফুপি ওদের ঠিকই মেনে নিবে।ভাইপোর বিয়েতে এসে অনেক আনন্দও করবে। কিন্তু আমি আশা করবো তুমি যাতে না আসো।আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি।বুঝতে শিখেছি সবকিছুই।সামনে কলেজে ভর্তি হবো।আমাকে ভুলভাল বোঝাতে এসো না ভুলেও।”
“তুই চাস না আমি মায়ার বিয়েতে যাই?”
রিজা বেশ কঠিনভাবে জবাব দেয়,”নাহ, আমি চাইনা।”
“হুমম। ”
“আমাকে যেতে হবে সোহাগ ভাই। মায়াপুকে পার্লারে বসিয়ে রেখে এসেছি।সবাই আমাকে কল করছে।আজ মায়াপুর গায়ে হলুদ। আমাকে সাজতে হবে।বুঝোই তো,বউয়ের একমাত্র ফুপাতো বোন আমি। আমি না সাজলে কি হয়?তবে ভেবোনা,আমি উল্টাপাল্টা সাজবোনা আর। আর না তোমার জন্য সাজবো।”
“হুমম। ”
“কফির জন্য ধন্যবাদ সোহাগ ভাই।”
কথাটা বলেই রিজা উঠে চলে যায় রেস্টুরেন্ট থেকে।সোহাগ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর চলে যাওয়ার দিকে।এই কি সেই রিজা,যে সোহাগ আসার কথা শুনলে পাশের গ্রাম থেকে হেঁটে আসতো নিজের নানাবাড়ি।যেখানে তাকে কেউ মূল্যায়নও করতো না।শত অপমান সহ্য করে যে শুধুমাত্র সোহাগকে দেখার জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকতো। আর আজ তার এতো পরিবর্তন? ভাবা যায়?সোহাগ বুঝতে পারে না সে এখন কি করবে।সে সবই হারিয়েছে আজ।তার ভিতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না কার থেকে রিজেক্ট হয়ে তার কষ্ট হচ্ছে।তার ভালোবাসার মানুষ মায়া নাকি তাকে যে ভালোবাসে সেই রিজার থেকে?
★★★
“আজকে আমাকেই সবচেয়ে সুন্দরী লাগতেই হবে মায়াপু। তোমার ঐ দেবরটা জোস। আমি তো জাস্ট ফিদা হয়ে গেছি। আপু, আপনি আমাকে গোলাপি ব্লাশ করে দিন তো মুখে। দেখেছি আমি ছেলেটা গোলাপি পাঞ্জাবি পড়েছে।”
সাবিহার কথায় বিরুক্ত হয়ে রিজা বলে,”আর একটা কথা বললে আমি তোর মুখ সেলাই করে দিব ইডিয়ট। তুই প্রেমে পড়েছিস ভালো কথা। তাই বলে সারা দুনিয়া জানাতে হবে?আর এতো নড়নচড়ন করছিস যে তোর মেকআপ ভালোভাবে বসছেই না। চুপচাপ থাক। ”
“থামবি তোরা?আমার এমনিতেই ভয় লাগছে এর মধ্যে আবার বকবক করছিস। তোদের নিয়ে আর পারি না আমি। তোদের….”
মায়া কথা শেষ করতে পারেনা। তার আগেই তার ফোন বেজে উঠে। রিজা উঠে স্ক্রিনে দেখে ◑কাব্য স্যার◑ নামে সেইভ করা নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিজা মুখে কৌতুক এনে বলে,”নাম বদলে দিই?কাব্য বর দিয়ে? নাও তোমার বর কল করেছে।তোমাকে দেখতে চায় হয়তো। ” বলেই চোখ টিপে হাসে।
মায়া লজ্জিত মুখে ফোনটা হাতে নেয়। নিজের মনেই বলে, এই লোকটার মোটেও ধৈর্য নেই। দু ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে কখন সাজ শেষ হবে আর কখন সে দেখবে। তার বউকে নাকি সবার আগে তাকেই দেখতে হবে।ইশশ!কি লজ্জা। এতো লজ্জা রাখবে কোথায় সে?
চলবে…
#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৪৫
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
মায়ার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরিকা।তার মনে পড়ে সেদিনের কথা। যেদিন এই মেয়েটা তার সংসারে প্রথম আসে। রিজভীর পিছনে ভীতু ভীতু চোখে তাকিয়ে ছিল। দেখতে তখন একটু রোগা ছিল। কিন্তু চোখদুটো ছিল মায়ায় ভরা। সেদিন কি রকম ব্যবহারই না করেছিল সাগরিকা তার সাথে। কোনো কথাই বলেনি সারাদিন। খেতেও দেয়নি কিছুই।তার নিজের মনের অবস্থাই তো ঠিক ছিল না। সেখানে মায়ার যত্ন কিভাবে করতো সে?আজ কেন যেন তার সেদিনের আচরণের জন্য খারাপ লাগছে। অনুশোচনা হচ্ছে। কেন সে তাকে কিছু খেতে দেয়নি?কেন কিছু জিজ্ঞেসও করেনি?আজ মায়া তাকে আম্মা ডাকে। সে মায়াকে তুই করে ডাকে।রিজভীকে মায়ার বাবা। সবকিছু কিভাবে যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে।সাগরিকা জানে, এতো সহজে এইসব হয়নি। প্রথমে মায়াকে একটা ধমক দিতেও তার ভয় হতো। যদি মায়া কিংবা রিজভী কষ্ট পায়। যদি মায়া কান্না করে কিংবা তার সাথে সৎ মায়ের মতো ব্যবহার করছে এটা ভাবে? সবকিছু কিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে সাবিহা মায়াকে দু -চোখের বিষ মনে করতো, সেই সাবিহার জীবনের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ এখন মায়ার কাছে। ধীরে ধীরে ভাই-বোনদের চলার সাথী হয়ে উঠেছে৷রিজভীর লক্ষী মেয়ে হয়ে উঠেছে।আর সাগরিকার?তার কিছু হয়নি? সাগরিকার নিজের মেয়ে হয়ে উঠেছে।এখন সাগরিকা মায়া অন্যায় করলে একটা থাপ্পড়ও মারতে পারে,বকতে পারে। কারণ সে জানে মায়া কিছুই মনে করবে না।কারণ মায়াও তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসে।দিনগুলো কত দ্রুত চলে গেছে।আজ মায়ার গায়ে হলুদ। হলুদ শাড়ি পড়ে স্টেজে সবার মধ্যমনি হয়ে বসে আছে। কাল মেয়েটা চলে যাবে স্বামীর ঘরে।তার সংসারে আর ফিরবে না কারণ ছাড়া।সাগরিকা চাইলেও আর তার সংসারে অকারণে আসবে না।কারণ মেয়েদের বিয়ের পর স্বামীর ঘরই হয় সবকিছু। চাইলেও সেখান থেকে হুটহাট আসা যায় না। আজ সাগরিকার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেন সে মায়াকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে? আর কটা দিন পরে বিয়ে দিলে কি খুব খারাপ হতো?আর কটা দিন তার সংসারে থাকলে কি ই বা এমন ক্ষতি হতো?অথচ মায়ার প্রথম তার সংসারে আগমন তার জন্য কতটা ভয়াবহই না ছিল।
“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন মা?স্টেজে চলো। মায়াপু ডাকছে তোমাকে। সবার আগে তোমাকেই তো হলুদ দিতে হবে।”
সাবিহার কথায় হুশ ফিরে সাগরিকার।সামনে তাকিয়ে দেখে মায়া তার দিকে হাত নেড়ে তাকে ডাকছে।তার চোখে পানি চলে আসছে।সবাই কত আনন্দ করছে অথচ সে করতে পারছেনা।সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে কান্না আঁটকানোর।তার মনে হচ্ছে মায়া অনেক কষ্ট পেয়ে এই সংসার ছেড়ে যাচ্ছে।সাগরিকা কি কখনো ভুল করেও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে?নাহ,মনে পড়েনা তার।কিন্তু তবুও সেদিনের ব্যবহারের জন্য আজ মন যেন কেমন করছে। কেন সেদিন সে মায়াকে কিছুই খেতে দেয়নি?
“ও মা,এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছো?চলো,তাড়াতাড়ি চলো।”
সাগরিকার ইচ্ছে করছে কান্না করতে।কিন্তু সেটা সে করতে পারছেনা।গলার কাছে কি যেন একটা জমে আছে।কোনো আওয়াজও বের করতে পারছে না মুখ থেকে।কোনোরকমে সাবিহার দিকে তাকিয়ে বলে,”এতো সেজেছিস কেন?মুখে এতো রঙ মেখেছিস কেন?এইরকম গোলাপি রঙ মেখে কি নিজেকে বেশি সুন্দরী ভাবছিস?ভুতের মতো লাগছে তোকে দেখতে। ”
“বাজে কথা বলো না তো মা।এখন এইসবই চলে। বুঝলে?বাবা কোথায়?বাবাকেও তো যেতে বলেছে মায়াপু। তুমি আগে আপুর কাছে যাও তো।”
সাবিহা চলে গেলে সাগরিকা ধীরে ধীরে হাসিমুখে মায়ার দিকে যায়। কাছে যেতেই সাগরিকা তার হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে বলে,”ঐখানে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন তুমি আম্মা?তোমাকে কখন থেকে ডাকছি আমি।শুনোনি তুমি?সবার আগে কিন্তু তুমি আমাকে হলুদ দিবে।”
“তা কেন হবে মায়া?প্রথমে তো ছেলের বাড়ি থেকে মানুষ এসে হলুদ দিবে। তারপর না আমরা দিবো তোমাকে।” মায়ার খালামনি মায়াকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে।
“এটা কি কোনো নিয়ম খালামনি?”
“হ্যাঁ, সবসময় তো এইটাই হয়ে আসছে।”
“সে হোক।আমাকে আম্মাই আগে দিবে।তারপর বাবা।তারপর বাকি সবাই।হলুদের বাটি কই খালামনি?”
“সাবিহা আনতে গেছে।”
রিজা পাশ থেকে টিপ্পনী কেটে বলে,”তাহলেই হয়েছে। এখন ওকে আনতে কাকে যেতে হয় দেখা যাক।”
মায়া রিজার দিকে তাকিয়ে বলে,”বকবক না করে তুই যা না।ওকে খুঁজে নিয়ে আয়।”
রিজা উঠে যাওয়ার সময় মায়ার নানী পেছন থেকে বলে,”দেখো আমার না হওয়া জোয়ান সতীন, তোমাকে খুঁজতে যেন আবার আমার বুড়ো বরকে যেতে না হয়।”
মায়ার নানীর কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠে।মায়ার কিছু বান্ধবী এসেছে সেখানে। তারা মায়ার নানীকে বলে,”আপনার বর টা এখনো মাশাল্লাহ। এক্কেবারে শাহরুখ খান।একটা সুযোগ তো আমরাও পেতে পারি।”
মায়ার নানীও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন।মেয়েদের সাথে সমান তালে বলে উঠে,”একটু পর যে ও বাড়ি থেকে ডজন ডজন ছেলেরা আসবে,তখন কি তাদের সাথে আমি গিয়ে ভাব জমাবো?তোমরা যদি আমার বুড়ো বরকে নিয়ে পড়ে থাকো,তাহলে তো আমারই যাওয়া লাগবে মনে হচ্ছে। ”
হঠাৎ সাবিহা সেখানে এসে বলে,”শোনো নানী, সেখানে গোলাপি পাঞ্জাবি পড়া একটা ছেলে আসবে।তাকে ছাড়া তুমি যে কারো সাথে ভাব জমাতে পারো।ভুলেও তার দিকে নজর দিবে না।”
“দেখেছিস,তোর মা কিন্তু সামনে বসে আছে।”
সাবিহা মায়ের দিকে তাকিয়ে অনেকটা ভড়কে গিয়ে বলে,”আমি বাবাকে খুঁজে আনছি।”
আবারো একটা হাসির রোল পড়ে যায়।
মায়ার কথামতো প্রথমে সাগরিকা আর তারপর রিজভী মায়াকে হলুদ ছোঁয়ায়।রিজভী মায়াকে বলে,”তোমার জন্য একটা গিফট আছে মায়া।রাতে পাবে। খুব স্পেশাল।সে আসতে দেরি করছে না হলে এখনই পেয়ে যেতে।”
“কে আসছে বাবা?”
“তোমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। ”
“বলোনা বাবা,কে আসছে।”
সাগরিকা হেসে বলে,”উপহার উপহারই হয় মায়া।আগে বলে দিলে কি আর উপহার হলো?বাসায় গিয়ে রাতেই দেখো।”
“ওকে।কি আর করার।”
সবাই নিজেদের মাঝে আনন্দ করছিল।এই সময় কেউ একজন এসে বলে ছেলেপক্ষ চলে এসেছে। সবাই মায়াকে ফেলে আগে নিজেদের চেহারা দেখে নেয় আগে।তারপর ছুটে যায় গেইটের দিকে। সাবিহা ছুটে গিয়েও আবার মায়ার কাছে ফিরে এসে বলে,”মায়াপু,আমার মেকআপ ঠিক আছে তো?আমাকে ভালো দেখতে লাগছে তো?”
মায়া হেসে বলে, “অসাধারণ লাগছে। এখন তুই যা।”
সাবিহা হ্যাঁ হ্যাঁ বলতে বলতে ছুটে যায় সবার মাঝে। আর মায়া আর তার নানী হাহা করে হাসে ওর কান্ডকারখানা দেখে।
★★★
“মায়া ভাবী,আপনাকে অসাধারণ লাগছে। এক কথায় নায়িকা।”
“পাম্প দিবি না কবিতা।”
“সত্যি বলছি আমি।বিশ্বাস কর। শোন তোকে একটা কথা বলি।”
“কি?”
“ভাইয়া বাইরে আছে।একবার বাইরে গিয়ে দেখা করতে হবে তোকে।”
কবিতার কথায় আঁতকে উঠে মায়া। ফিসফিস করে বলে,”কি বলিস?পাগল হয়েছিস?এইখানে কত মানুষ। আমি যাবো কিভাবে?”
“তোকে সেটা দেখতে হবেনা।আমার উপর ছেড়ে দে।”
ভয়ে আর লজ্জায় মায়ার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। সবাই এইখানে মায়ার সাথে ছবি তুলছে। আর এখন নাকি ওকে নিয়ে যাবে।
“তুই উঠলে আমরাও একটা ছবি তুলতাম কবিতা। আমাদের নতুন ভাবির সাথে।”
মায়া সামনে তাকিয়ে দেখে তার সামনে দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চিনে মায়া। একজন কাব্যর ফুপাতো বোন আরেকজন কাব্যর বন্ধু।যদিও তার আরো একটা পরিচয় আছে।
কবিতা উঠে গেলে মেয়েদুটো মায়ার পাশে বসে ছবি তুলতে থাকে। কাব্যর বন্ধু বলে,”তুমি কি জানো,আমি কে?”
মায়া তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,”জানি। উনার বন্ধু।”
“অহ,তাহলে কাব্য তোমার উনি।” শ্লেষের সাথে হেসে মেয়েটা বলে।
মায়া কিছু বলে না। মেয়েটা নিজের মোবাইলটা বের করে প্রথমে মায়ার সাথে কিছু ছবি তুলে। তারপর নিজের গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে মায়ার সামনে তুলে ধরে। মায়া ভালোমতো তাকিয়ে দেখে ছবিটি কাব্য আর এই মেয়েটির।না চাইতেই মায়ার মুখের হাসি উবে গিয়ে সেখানে বিষাদ নেমে আসে।মেয়েটি পরপর আরো কিছু ছবি তাকে দেখায়।মায়া চুপ করে থাকে। মেয়েটি এবার বলে,”তুমি কি বুঝতে পারছো,কাব্য আমার কে হয়?আমরা কতোটা কাছের বন্ধু?”
কাব্যর ফুপাতো বোন বলে,”কাব্য আর আমরা ক্লাসমেট।ছোটবেলা থেকেই একসাথে থাকতাম।কাব্য ওকে অনেক ভালোবাসে।কিছু ৫ বছর আগে একটা কারণে ওদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হয়ে ওদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।কিন্তু আমার এখনো মনে হয়,কাব্য আর ও দুজনেই এখনো দুজনকে ভালোবাসে।তোমাকে শুধু নিজের প্রয়োজনে বিয়ে করছে। হাজার হোক,পুরুষ মানুষ। বিয়ে তো করতেই হবে।”
কথাগুলো শুনে মায়া হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,”আর আপনার বান্ধবী বুঝি বিয়ে করেনি?আমি তো শুনেছিলাম ওনার বিয়ের জন্যই বিচ্ছেদ হয়েছিল।উনি স্বামীর সাথে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু নিয়তির দোষে সংসার করতে পারেনি। এখন নিজের সংসারে পরাজিত হয়ে আবার উনার পিছনে পড়েছে।”
মেয়েটি মায়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,”তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো।এটা ঠিক না।”
মায়া হাসি হাসি মুখ করে বলে,”ও তাই?তাহলে আপনি যে আমার না হওয়া সংসারটাকেই নষ্ট করতে চাইছেন।তার বেলায়?”
“শোনো মেয়ে,বোকার মতো কথা বলোনা।কাব্য তোমাকে কখনোই ভালোবাসেনি।ভালোবাসেও না।ভালোবাসবেও না।বোকার মতো ওর সাথে নিজের জীবন জড়িয়ে নিও না।তুমি ওর সাথে খুশী থাকবে না।”
মায়া আবারো হেসে বলে,”বোকা আমি না তুমি সেটা বিয়ের ফটোতেই ভালোভাবে বোঝা যাবে।”
কাব্যর ফুপাতো বোন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি পাগলের মতো কথা বলছো তুমি?”
“হ্যাঁ, দেখতে পাবেন।আশেপাশে সবাই ছবি তুলছে। আমার সব ছবিই হাসি মুখে হবে।আর উনার আর আপনার ছবি থাকবে রাগান্বিত অবস্থায়।সবাই কি ভাববে বলুন তো?”
কাব্যর ফুপাতো বোনকে মেয়েটি প্রায় তুলে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। ওরা যেতেই কবিতা আবার ওর পাশে বসে বলে,”কি বললো ডাইনি দুটো? ”
“কি আবার বলবে?তোর ভাইয়ের তার প্রতি কত ভালোবাসা ছিল,সেটাই বলে গেল।আর আমি তার সাথে কতটা কষ্টে থাকবো,সেটা বলে গেলো।”
“বাদ দে তো ওদের কথা।ওদের দেখলেই আমার মেজাজ টা গরম লাগে।নেহাৎ এখানে মানুষ আছে,না হলে ওদের দেখে নিতাম।”
“জানি আমি।”
“তোর বোন তো আমার কাকাতো ভাইয়ের পিছনে পড়েছে।আমার ভাই তো পড়েছে মহা বিপদে।”
“কেন?বিপদে কেন পড়বে?”
“আমার কাকি কে তো চিনিস না।সারাক্ষণ ভাইয়ার পিছনে পড়ে থাকে।পড়াশোনা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই কাকি ওকে পাহারা দিয়ে রাখে।বেচারার বন্ধুরাও তাকে নিয়ে মজা করে।তোর বোনকে অনেক পছন্দ করেছে।কিন্তু মায়ের জন্য কিছুই বলতে পারছেনা।”
“অহ,মাম্মাস বয়।”
“নাহ,তেমন না।কিন্তু কাকির একটাই ছেলে।বাকি বাচ্চাগুলো জন্মের সময়ই মারা গেছে।তাই ভাইয়াকে অনেক কড়া শাসন আর আদরের মধ্যে রাখে।”
“বুঝেছি।”
“তারপর বল,কালকের জন্য কি প্ল্যান আছে?কিছুই কি ভাবিসনি?”
মায়া লজ্জা পেয়ে বলে,”বাজে কথা বলিস না।এখানে সবাই আছে।”
অজান্তেই মায়ার চোখমুখ লাল হয়ে উঠে।সব কল্পনা জল্পনার অবসান ঘটবে কাল।মেয়ে হয়ে জন্মেছে সে।বিয়ের স্বপ্ন তো সারা জীবন ধরেই দেখে সব মেয়েরাই।আর সেটা যদি হয় ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে,তবে সেটা যে কতোটা আনন্দের, সেটা মায়া বুঝতে পারছে।কিন্তু নিজের পরিবারের কথা মনে পড়লে,কিংবা ওদের কারো দিকে নজর গেলেই বুকটা হুহু করে কেঁদে উঠছে।বিশেষ করে সাব্বির,ও তো মায়াকে ছাড়া থাকতে পারেনা। না জানি কি হবে তার সাথে।মায়া সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকায়।সবাই আনন্দে আছে।কিন্তু আগামীকাল এই সময়ে হয়তো কান্না করবে।কি আজব এই নিয়ম।
★★★
“আজকে কি দেখা না করলেই হতো না?সবাই ঐদিকে আপনাদের বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।আর আমি এখানে।কালকেই তো আপনার বাসায় যাবো।আজ এইভাবে দেখা করার কি আছে?”
মায়া ভ্রু কুঁচকে বলে,”আমার বউ,আর আমি দেখবোনা, আমার বন্ধুরা, পরিবার দেখলেই হবে?আমি দেখবোনা?”
“ওকে।বুঝেছি। এখন আমি যাই? সবাই কি ভাববে?”
“যা ইচ্ছে ভাবুক।তাতে আমার কি?”
“হুমম। ”
“ওরা তোমাকে বাজে কথা বলেছে?”
“কে?আপনার প্রাক্তন? যাই বলুন না কেন,আপনার প্রাক্তন কিন্তু সেই রকম সুন্দরী। সত্য এটাই।”
“আমার হবু বউয়ের চাইতে তো অবশ্যই না।আমার চোখে সে সবচেয়ে সুন্দরী।”
মায়া লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।কাব্য ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”মায়া।”
“বলুন।”
“তাকাও আমার দিকে।চোখের দিকে।”
“উহু।”
“মায়া,কালকে আমাদের বিয়ে।আর আজও তোমাকে কিছু একটা বললেই আমার দিকে তাকাতেও পারো না।মনে আছে তো,কালকেই আমাদের বিয়ে।তারপর কিন্তু আর আমাকে আপনি বলে ডাকবে না।তুমি করে বলবে।”
মায়া আবারও মাথা নিচু করে বলে,”দেখা যাক।”
“দেখা যাক টাক না,তুমিই বলবে।”
“ঠিক আছে।”
কাব্য আরো কিছু বলার আগেই পিছন থেকে কবিতা বলে উঠে,”এইইই তোদের প্রেম করা শেষ হলে, চলে আয়।সবাই খুঁজছে মায়াকে।পরে সবাই বলাবলি করবে যে বিয়ের আগের রাতে বউ পালিয়েছে।বদনাম হয়ে যাবে রে। চলে আয়।কালকে প্রেম করিস।সারারাত পরে থাকবে।এখন চল।”
কাব্য আর কিছুই বলে না।বাস্তবতা বুঝে সে।মায়া এখন না গেলে অনেকে অনেক কথা বলবে।তাই মায়াকে বলে,”চলে যাও আমার প্রিয়তমা,কালকে দেখা হবে।কিন্তু প্রেমিকা হিসেবে না,স্ত্রী হিসেবে।”
মায়া আসি বলে ধীর পায়ে চলে যায় ভিতরের দিকে।আর কাব্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে তাকে।সেই প্রথম দিনের মতো।যেদিন মায়ার কোচিং ক্লাসে মায়া দেরি করে এসে বকা খেয়েছিল তার কাছে।পড়া না পারার জন্য বকা খেয়েছিল।আর বকা খেয়ে যখন কান্নারত মুখে তাকে দেখেছিল,সেই মায়াময় মুখটা দেখেই মুহুর্তেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল।তারপর মায়ার মায়ায় ধীরে ধীরে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল।তার ভাবতেই অবাক লাগছে সেদিনের সেই কাঁদুনি মেয়েটা কাল তার বউ হতে চলেছে।তারা সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে মায়াকে এই কাঁদুনি নামে ডেকে অনেক ক্ষ্যাপাতো।কাব্য ঠিক করে নেয়,জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মায়াকে সে এই নামেই ডাকবে।
★★★
“আমাকে ডেকেছিলে আম্মা?”
“হ্যাঁ, ভিতরে এসো।আমার পাশে এসে বসো।”
মায়া সাগরিকার পাশে এসে বসে।তার কেমন যেন একটু লজ্জা লজ্জা লাগছে।কথা বলতেও কেমন একটা লাগছে।কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,”বাবা কোথায় আম্মা?”
সাগরিকা হেসে বলে,”মেয়ের বাবা-মার অনেক দায়িত্বরে মা।মেয়ের মা হলে জ্বালা বুঝবি।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“কিছু বলবে আমাকে?কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু? ”
“হ্যাঁ।যদিও আমি বলা বা না বলায় কিছুই যায় বা আসে না।তোমার ভাগ্যে যা লেখা আছে, তাই হবে।শোনো মায়া,মেয়েদের জীবন কয়েকটা পর্যায়ে বিভক্ত।কারো মেয়ে,কারো বোন,কারো বউ,কারো মা,কারো শাশুড়ী আবার কারো নানী-দাদী। মেয়েরা অন্যের পরিচয়েই আমাদের সমাজে থাকে।আগেকার দিনের মেয়েরা সংসার সামলাতে সামলাতে নিজের নামটাই শেষে ভুলে যেতো।কারো মা হয়ে,কারো বউ হয়ে,কারো দাদী-নানী হয়ে।”
মায়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।কি বুঝাতে চাইছে আম্মা,কিছুই বুঝতে পারছে না।সাগরিকা আবার বলে,”যার পরিচয়েই বেঁচে থাকুক না কেন,সে যেন সম্মানের সাথে বেঁচে থাকে।কালকে থেকে তোমার জীবনের আরেকটা পর্যায় শুরু হবে। তখন শুধু তুমি আমার বা তোমার বাবার মেয়ে থাকবে না,কিংবা সাবিহা সাব্বিরের বোন থাকবে না,তোমার আরো অনেক পরিচয় থাকবে।সংসার জীবনটা এতো সহজ না রে মা।আমি একা তোর বাবার সাথে সংসার করেছি।তাই আমি শুধু তোর বাবার বউ হয়েই ছিলাম।কিন্তু তুই একটা পরিপূর্ণ পরিবারে যাচ্ছিস।তোর দায়িত্ব অনেক।তুই কখনো সেখানে নিজেকে ছোট ভাববি না।সবাই তোকে পায়ের নিচে রাখবে।আবার এতো বড়ও ভাববি না,যাতে তোকে পিছনে গালি দিয়ে সামনে তোকে মাথায় করে রাখে।ভালোবাসা পেতে গেলে ভালোবাসা দিতে জানতে হয়।সবাইকে ভালোবাসবি।আর নিজের অধিকার থেকে রাগ করে নিজেকে বঞ্চিত করবি না।খাবারের উপর রাগ করে থাকবি না।খাবার খেলে খাবারও তোর জন্য দোয়া করবে।আমরা বয়ামে বিস্কুট বা অন্যকিছু ভরার সময় ভরে গেলেও কিছুটা ঝাকিয়ে নিই যাতে আরো কিছুটা রাখতে পারি।সেইভাবে সব জায়গায়ই ঠেলেঠুলে নিজের জায়গা করে নিবি।তবে,সেটা সম্মানের সাথে।যেখানে কেউ তোকে সম্মান দিবে না,সেখানে কখনো ভুল করেও যাবি না।তবে তারা তোকে দূর্বল ভাববে।আর বাকি রইলো কাব্যর কথা,ভুলক্রমেও কখনো ওর থেকে দূরে যাবিনা।স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া ঝামেলা হবেই।কিন্তু কখনো আলাদা থাকবি না।তাহলে সেই সুযোগে শয়তান তোদের মাঝে ঢুকে পড়বে।যতোটা পারবি,তাকে নিজের করে রাখবি।তাকে সম্মান করবি।শ্বশুর শাশুড়ীকে বাবা-মায়ের মর্যাদা দিবি।তবেই তারা তোকে ভালোবাসবে মেয়ের মতো করে।কিছু বোঝাতে পারলাম আমি?”
মায়া মাথা নাড়ে। সাগরিকা আবার বলে,”মায়া।”
“কি আম্মা?”
“আমার উপর কি তোর কোনো অভিযোগ আছে?”
মায়া বাচ্চাদের মতো হেসে ফেলে।হাসতে হাসতে বলে,”আমার উপর কি তোমার অভিযোগ আছে?”
“নাহ।”
“মেয়ের উপর মায়ের নেই।তাহলে মায়ের উপর মায়ের কিভাবে অভিযোগ থাকবে?”
সাগরিকাও এবার হেসে ফেলে।মায়া সাগরিকার কোলে মাথা রাখে।চোখ বন্ধ করে বলে,”সারাদিন ভারি শাড়ি গহনা পড়ে আমি ক্লান্ত।মাথায় হাত বুলিয়ে দাও আম্মা।”
সাগরিকা মায়ার চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে।আমুদে মায়ার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে।সে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল।হঠাৎ করেই কলিংবেল বেজে উঠে।মায়ার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলে ও বিরক্ত হয়ে উঠে বসে।হঠাৎ বসার ঘর থেকে সাবিহার চিৎকার শুনতে পায়।তারা দুজনে একে অপরের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে ছুটে যায় বসার ঘরের দিকে।গিয়ে দেখে সেখানে সবাই হৈ-হুল্লোড় করছে।আর সবার মাঝখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটি মরিয়ম।মায়াও মরিয়মকে দেখে প্রায় চিৎকার করেই ওকে ডেকে জড়িয়ে ধরে।মরিয়ম বলে,”বিয়ের জন্য শুভকামনা মায়া।”
“তুমি আগে কেন আসোনি?আজকে আসলে তাও আবার রাতে।দিনে আসোনি কেন?”
মরিয়ম ইতস্তত করে বলে,”অনেক কাজ ছিল বাড়িতে।বুঝোই তো,শ্বশুর বাড়িতে থাকি।তারা অনুমতি না দিলে কিভাবে আসবো।”
সাবিহা বলে,” সে যাই হোক,আজকে রাতে পার্টি হবে।সারারাত ঘুমোবো না আমরা।”
সাগরিকা ওর মাথায় চাটি মেরে বলে,”আধঘন্টার মধ্যে সবাই ঘুমুতে যাবি।এতো মানুষ জায়গা হবে না।আমি নিচে বিছানা করে দিব।আজকে সারা রাত জেগে কি কালকে সারাদিন ঘুমোবি?বিয়ে হবে কিভাবে তাহলে? আর মরিয়ম জার্ণি করে এসেছে।ওকে ঘুমুতে দিতে হবে।যত আনন্দ কালকে হবে।মরিয়ম,আমার সাথে এসো।ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিবে।”
মায়া রিজভীর দিকে এগিয়ে যায়।বেশ ক্লান্ত লাগছে তাকে।কয়েকদিন ধরে তো অনেক পরিশ্রম করছে।বাবার পাশে বসে মায়া বলে, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা।ওকে এখানে আনার জন্য।আমি ওকে অনেক পছন্দ করি।ও আমার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। ”
“আমি জানি।সেই জন্যই ওকে এনেছি।”
মায়া ফিরে আসে নিজের ঘরে।গুরুত্বপূর্ণ? মরিয়ম? হ্যাঁ, মরিয়ম আসলেই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ, সে আজ কোথায়?দূরের আকাশের তারা হয়ে তাকে দেখছে তো?আজ সে বেঁচে থাকলে কি অনেক খুশি হতো?আম্মার মতো কি সাহস দিতো?সবদিক কি সামলে নিতে পারতো?কি জানি পারতো কি না।চোখ ফেটে গলগল করে পানি গড়িয়ে পড়ে তার।সে দ্রুত মুছে নেয় সেটা।এই পানি কাউকে দেখানো যাবে না।তাহলে সবাই জিজ্ঞেস করবে কেন সে কাঁদছে।কিন্তু সেটা মায়া চায় না।সবাই আনন্দ করছে।সবার আনন্দ সে নষ্ট করতে চায় না মোটেই।
★★★
সবাই একসাথে নিচে বিছানা করে শুয়েছে।মায়াও তাদের সাথেই শুয়েছে।সাবিহা তার পাশে।সবাই ঘুমুলেও ঘুম নেই মায়ার চোখে।ভবিষ্যতের চিন্তায় সে অস্থির।কেমন হবে আগামী দিনগুলো?সব ঠিকমতো হবে তো?সবাই তাকে ভালোবাসবে তো?আম্মার কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।কোনো ভুল করবে না।মায়া যখন এইসব চিন্তা করতে ব্যস্ত, তখন সাবিহা তার কানে ফিসফিস করে বলে,”ঘুমিয়ে গেছো মায়াপু?”
“নাহ।”
কিছুক্ষণ সাবিহা নিরব থাকে।তারপর মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তোমাকে মিস করবো মায়াপু।অনেক মিস করবো।সবকিছু মিস করবো।”
মায়া দু’হাতে আগলে নেয় বোনকে।সেও কি কম মিস করবে তাকে?সাবিহা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরেই হুহু করে কেঁদে উঠে।কান্না ব্যাপারটা যেন সংক্রামক।মায়ারও কান্না পেল। দুবোন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে। কিন্তু খুব আস্তে আস্তে। যাতে তাদের কান্না আর কেউ না শুনে।তাদের কেউ বলেনি আস্তে কান্না করতে।কিন্তু তারা পরিস্থিতি বুঝে গিয়েছে।মায়ার মনে হয়,এরপর কি এই বোনটাকে আর এইভাবে ধরে শুতে পারবে কখনো? কাব্যকে ছেড়ে কি এসে থাকতে পারবে?বিয়ে নামক এ কেমন পবিত্র বন্ধন যে এক আত্মাকে ছেড়ে গিয়ে আরেক জায়গায় বাসা বাঁধতে হয়?
চলবে…..