#আরেকবার_আবর্তন ( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
সালটা ২০১৪ | আজ দূর্গা পুজোর অষ্টমী | কিন্তু শরৎ অঞ্জলি দেয়ার জন্য স্নান করে এলেও টাওয়াল গায়ে এদিক ওদিক হাতড়াচ্ছে ঘরের | নতুন জামা বলতে পাঞ্জাবীটাই ছিল ! বাকি দুটো শার্টই ষষ্ঠী সপ্তমীতে পড়া হয়ে গেছে | ভেবেছিলো আজ এই নতুন লাল পাঞ্জাবিটা পড়েই অঞ্জলি দেবে | কিন্তু পড়ার সময় পাঞ্জাবির বোতাম ছেঁড়া চোখের সামনে | আশ্চর্য ! নতুন জামা , আগে একবার জাস্ট ট্রায়াল রুমে পড়েছে , তাতেই এই হাল ! অথচ হাজার টাকা দাম নিয়ে নিলো ! ভেবেই রাগে গজগজ করছিলো শরৎ মনে মনে | ওদিকে বাবা ড্রইং রুম থেকে ক্লাসিক্যাল সংগীতের মতন চেঁচিয়েই যাচ্ছে , ” অঞ্জলীর সময় হয়ে গেলো , আয় রে | এটা থার্ড রাউন্ড চলছে | এরপর না গেলে মিস করে যাবি |” … এর উত্তরে কি বলবে শরৎ ! সত্যিই তো , ঘড়ির কাঁটা তো ঝড়ের বেগে এগোচ্ছে আজকের সকালে ! এই সুঁচে সুতো ভরতে ভরতে তো অঞ্জলীর লাস্ট রাউন্ডও শেষ হয়ে যাবে , ভেবেই কেমন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে ! এই পরিস্থিতিতেই হঠাৎ দরজায় টোকা , শিউলি অল্প একটু হাঁফাতে হাঁফাতে ওর দরজায় দাঁড়িয়ে বললো , ——– ” তুমি রেডি হওনি ? এবার তো সত্যি অঞ্জলি শেষ হয়ে যাবে ! আর সুঁচ সুতো নিয়ে কি করছো এখন ?”
শরতের এবার মাথাটা গরম হয়ে গেলো প্রশ্নটা শুনে হালকা , একটু বিরক্ত হয়েই বললো , ——- ” সুঁচ সুতো নিয়ে মানুষ কি করে ! দেখতে পাচ্ছিস না , পাঞ্জাবির বোতাম স্টিচ করছি | এই সময়েই এই ব্লান্ডারটা হতে হলো ! এতো নামি দোকান ! কিন্তু কি কোয়ালিটির জামা কাপড় বানায় ! ”
লাস্ট তিনটে লাইন শরৎ নিজেই নিজেকে বললো দুঃখে | তবে শিউলি এবার আর দরজায় দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা শরতের সামনে | তারপর ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো , ——– ” তুমি চুলটা আঁচড়াও | আর এই বোতামের দায়িত্বটা আমাকে দাও | আমি সেলাই করে দিচ্ছি |” …… কথাটা শেষ করেই শরতের উত্তরের অপেক্ষা না করে শিউলি পাঞ্জাবিটা কেড়ে নিলো ওর হাত থেকে | তারপর বোতামের ওপর সুঁচটা চালাতে থাকলো নিজে থেকে | না , শরৎ এবার একটা ছোট্ট ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ না দিয়ে পারলো না ! পাশের বাড়ির এই মেয়েটা বয়সে ওর থেকে পাঁচ বছরের ছোট | তবে একমাত্র এই মেয়েটাই ওর রাশভারী স্বভাবের আড়ালে থাকা আসল ছেলেটাকে অল্প অল্প চেনে | ওর পারমিশন না নিয়ে ঘরে ঢোকে , এলোমেলো বইগুলোকে মাঝে মাঝেই সাজিয়ে দেয় | ছড়ানো ছেটানো আলমারিটা আলতো করে গুছিয়ে দেয় | টুকটাক রান্না করে চমকে দেয় ! আর এই রকম পাঞ্জাবিবিভ্রাট থেকেও বিনা নোটিশে উদ্ধার করে | আসলে ছোটবেলায় মা মারা গিয়েছিলো বলেই খালি বাড়িতে একা থাকতে থাকতে শরৎ এরকম ইন্ট্রোভার্ট , গম্ভীর স্বভাবের হয়ে গেছে | খুব একটা বন্ধুবান্ধব , গার্লফ্রেন্ড কিছুই নেই জীবনে ! আরো ডাক্তারি পড়তে পড়তে ওই ওষুধ , রোগ , পেশেন্ট , এদেরকেই নিজের সার্কেল বানিয়ে নিয়েছে ছেলেটা | তবে , এইসবের বাইরে ওর বিশেষ কিছু নিয়ে খুব একটা ভাবার দরকার আছে বলেও মনে করে না ঠিক ! ফেলোশিপটা পেয়ে গেছে এই বছর | আর মাত্র এক মাস | এরপরই নিউইয়র্ক চলে যাবে তিন বছরের জন্য | কেরিয়ার গুছিয়ে নেয়ার এই তো সময় ! এখন কাজের কথা ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে ইনভল্ভ হয়ে মাইন্ড ডাইভার্ট করবে না শরৎ | যাই হোক , তবে সেদিন এই একাগ্রচিত্ত মনও হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছিলো শিউলিকে আড়চোখে চুল আঁচড়ানোর সময় দেখতে দেখতে ! আশমানি রঙের শাড়িতে তো বেশ অন্য রকম লাগছে রোজের থেকে ! কথাটা মনে এসেই মিলিয়ে গিয়েছিলো সেইদিন | যাইহোক , তবে এতকিছুর পর অঞ্জলিটা মিস হয়নি এই যা | কিন্তু ওই ভিড়ে , অঞ্জলীর শেষ ব্যাচে যখন শিউলি হঠাৎ ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ফুল নেয়ার জন্য , তখন শরৎ অবাক ! কিছুতেই আর প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলো না ঠিক |
” তুই অঞ্জলি দিসনি ? তুই তো সকাল থেকে মণ্ডপেই ছিলিস , পুজোর সব কাজ করেছিস শুনলাম | তাহলে অঞ্জলি দিসনি কেন ?”
কথাগুলো শুনে শিউলির আলতো হেসে এক কথায় উত্তর দিলো , ——— ” কখনো অঞ্জলি দিয়েছি তোমাকে ছাড়া ?”
কথাটার মানে বুঝেও শরৎ না বোঝার মতন মুখ করে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলো সেই মুহূর্তে | আসলে এই কথা বেশি এগোলে হয়তো ওর জানা অন্য কথাগুলোও বলে ফেলবে শিউলি | এই মেয়েটার মনে যে ও সব সময়েই আলাদা , স্পেশ্যাল , এটা শরৎ অনেকদিন আগে থেকেই জানে | তবে শুধু না বোঝার ভান করে থাকে ওর সামনে | আসলে ওর মনে হয় শিউলি যদি হিসাবের বাইরের কথাগুলো বলে দেয় ওর কাছে , তাহলে হয়তো মুখের ওপর ‘না’ বলতে খারাপ লাগবে খুব শরতের | মেয়েটা এমনিতে তো সত্যি খুব ভালো | তবে , শিউলির ব্যাপারে আজ অব্দি এইটুকুই ভেবেছে ও মনে মনে | এই ‘ভালো’ মেয়েটাকে আলাদা করে আর কখনো ভালো লাগেনি ওর | এটাই সত্যি | তাই তো শিউলিকে একটা লিমিটের পর কোনোদিনও নিজের কাছে আসতে দেয়নি শরৎ | কখনো ওর নাম্বারটা নিজে থেকে ডায়েল করেনি আজ অব্দি | পাশের ফ্ল্যাটে থাকা সত্ত্বেও একদিনও ওর ঘরে যায়নি কথা বলতে | আবার যখন শিউলি ওর ঘরে বিনা নোটিশে এসে অনেক বকবক শুরু করেছে হঠাৎ , শরৎ তাতে ‘হ্যাঁ’ , হুম ছাড়া আর কোনো উত্তর করেনি | চেষ্টা করেনি একবারও নিজে থেকে কথা বাড়ানোর | তবে এর বেশি হিসাবিও হতে পারেনি এই মেয়েটার কাছে এতো বছরে ! যেমন ও রান্না করে আনলে শরৎ খেয়েছে , আর প্রশংসাও করেছে মন থেকে | ও ঘর গুছিয়ে দিলে শরৎ সেটাকে এলোমেলো করেনি কখনো | ও নিজে থেকে ঘরে আসলে শরৎ ‘কাজ আছে’ বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়নি আজ অব্দি | আসলে এই মেয়েটাকে কোনোভাবে হার্ট করবে এটা যেন ভাবতেই পারে না ঠিক | আবার ভালোবাসাও যে সম্ভব না | আসলে ফিলিংস ব্যাপারটা এরকমই | খুব অদ্ভুত ! কেউ খুব কাছে থাকলেও তার জন্য হয়তো মন কেমন করে না | আবার কেউ মাইলের পর মাইল দূরে রয়ে গেলেও শুধু মন তাকেই চায় ! এই মন কখন কার কথা ভাববে , আর কাকে দূরে সরিয়ে রাখবে , তার খোঁজ আর হিসেব ও নিজেও ঠিক জানে না |
<২>
” আচ্ছা শিউলি , আর কতদিন এইভাবে চালাবি বল তো ? সব কিছুর তো একটা লিমিট আছে না কি ! গোপন প্রেম তো রবীন্দ্রনাথের যুগে হতো | তখন মানুষ মনের কথা বুঝেও যেত | তবে এই যুগে এইসব ইম্পসিবল | তোকে নিজেকেই একটু একটিভ হতে হবে | ওই সিরিয়াস স্টুডিয়াস পাবলিককে দিয়ে কিছু হবে না | যা বলার তোকেই বলতে হবে বুঝলি | ”
চাটনি ফুচকা খেতে খেতে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো অনু | শিউলির ছোটবেলার বন্ধু | তবে শিউলি এইসব শুনে চুপ | আসলে যুগ যতই এগিয়ে যাক ! একটা মেয়ে হয়ে নিজে থেকে প্রপোজ করবে এটা যেন এখনো ঠিক মন থেকে মেনে নেয়া যায় না ! আর শরৎ তো ওকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখছে | ও কি কিছু বোঝে না ! শিউলির এতদিনের জমানো ফিলিংসগুলো তো কোনো অন্ধও এতদিনে নোটিশ করে ফেলবে ! শরতের তো তা ও সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিক | তাহলে ওকেই শব্দ খরচ করে বলতে হবে কেন নিজের মনের কথা ! এইসবই ভাবছিলো , তখন অনু আবার বলে উঠলো ,
—— ” কি ভাবছিস ? মেয়ে হয়ে নিজে থেকে প্রপোজ করবি কি না ! মানছি এটাতে তোর খারাপ লাগবে | কিন্তু এখন যদি এই স্টেপটা না নিস্ , তাহলে দুদিন বাদে নিউইয়র্ক চলে গিয়ে একটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে আনলে তখন তো আরো খারাপ লাগবে ! তিন বছর কিছু না বলে অপেক্ষা করে সেই দৃশ্যটা দেখতে পারবি তো ? তাই বলছি এতো না ভেবে যা বলার সেটা বলে ফেল এর মধ্যেই | আর এই পাড়ায় সবাই জানে , শরৎদার না কোনো বিশেষ বন্ধুবান্ধব আছে , না কারোর সাথে বেশি কথা বলে ! একমাত্র তোকেই ও বেশ পাত্তা দেয় | ওর ঘরে যখন তখন যাস , দরকারি জিনিস পত্র গুছিয়ে দিস , রান্না করে দিস , এইসবে তো ছেলেটা কখনো না বলে না ! আমার মনে হয় শরৎদার মনেও তোর জন্য কিছু আছে | কিন্তু ইন্ট্রোভার্টদের ওই একটাই প্রব্লেম | মনে যা ই থাক , মুখে আনতে পারে না | তাই তোকেই এই ফার্স্ট স্টেপটা নিতে হবে |”
শিউলি কথাগুলো মন দিয়ে শুনে এইবারও চুপ থাকলো | তবে মনে মনে এতো যুক্তি অস্বীকার করতে পারলো না কিছুতেই ! বরং হঠাৎ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা দৃশ্য | তিন বছর বাদের একটা দৃশ্য | শরৎ অন্য একটা মেয়ের হাত ধরে এই দূর্গা পুজোর মণ্ডপে দাঁড়িয়ে | মেয়েটার মুখটা আবছা ! কিন্তু শরতের হাসি মুখটা একদম স্পষ্ট | কল্পনার এই ছবিটা দেখে শিউলি কয়েক সেকেন্ডেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো নিজের মধ্যে | তাহলে এই দৃশ্য যদি বাস্তবে দেখতে হয় তাহলে শিউলির কি অবস্থা হবে ! কথাটা ভেবেই ও আর চুপ থাকলো না | অনেক্ষনের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে বেশ দৃঢ় গলায় অনুকে বলে উঠলো এখন , ——– ” আজ অষ্টমীর দিনই আমি শরৎকে যা বলার বলে দেব | তুই ঠিকই বলেছিস | এখন না বললে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে !”
সেই সকালে কথাটা অনুকে যত সহজে বলে দিয়েছিলো শিউলি , ততো সহজে কাজটা করতে পারেনি যদিও ! এতদিনের এতো জমা কথা , এতো ফিলিংস , এইসব সাজিয়ে গুছিয়ে বলা কেমন একটা ভাইভা পরীক্ষা দেয়ার মতন ব্যাপার | কিভাবে বলবে , কিভাবে এক্সপ্রেস করবে ঠিক বুঝতেই পারছে না যেন | আসলে এই ভালো লাগাটার শুরু যে ঠিক কবে থেকে হয়েছিল সেটা তো ও নিজেও জানে না ঠিক ভাবে ! ওই ক্লাস টেনে যখন ও অঙ্ক করতে মাঝে মাঝে শরতের কাছে যেত তখন ! ওই গম্ভীর মুখটা , মাঝে মাঝে অল্প হাসি , আস্তে গলায় কথা , শান্ত দুটো চোখ তখনই কি খেয়াল করেছিল শিউলি আনমনে ! না কি সেইবার কলেজ থেকে ফেরার সময় যেদিন খুব জোর বৃষ্টি নেমেছিল হঠাৎ | পাড়ার মোড়ের কিছুটা আগে বাস থেকে নেমে শিউলি দেখেছিলো শরৎকে | আধো ভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা বাস স্টপের শেডের নিচে | তাহলে কি ওর কাছে ছাতা নেই ! তাই অপেক্ষা করছে বৃষ্টি থামার ! কথাটা মনে আসতেই শিউলি শরতের সামনে গিয়ে বলেছিলো , ———- ” তুমি এইভাবে ভিজে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? শরীর খারাপ হবে তো ! আমার ছাতা আছে | চলে এস |”
কথাটা শুনে শরৎ দু সেকেন্ড সময় নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো শিউলির কাছে | আর হঠাৎ ভিজে মাটির গন্ধর সাথে শরতের পারফিউমের হালকা গন্ধটা মিলে গিয়েছিলো ওর চারিদিকে | তখনই কি শিউলি খুব মন দিয়ে খেয়াল করেছিল ছেলেটাকে ! সেই বৃষ্টি ভেজা রাস্তার শেষে নতুন কিছু শুরু হয়েছিল ওর মনে ! না কি ওই ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের জন্য ! তখন ওর থার্ড ইয়ার | পুজোর সময় পাড়াতে শরৎ নিজেই চেষ্টা করে এরেঞ্জ করেছিল একটা ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প | আসলে সেইবার পাড়ার পুজোর পঁচিশ বছর ছিল | থিমের পুজো নিয়ে পাড়ার কিছু কাকুরা প্রথম থেকেই মাতামাতি করছিলো | সেইবার পুজোর মিটিংয়ে শরৎ গিয়েছিলো প্রথমবার , ওর বাবার শরীরটা খারাপ থাকার জন্য | তখন সবাইকে চুপ করিয়ে ও হঠাৎ বলে উঠেছিল এই ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের ব্যাপারে | মায়ের পুজোতে প্যান্ডেলের ওপর টাকা খরচ থেকে যদি কিছু বাঁচিয়ে কটা লোকের কাজে লাগার মতন কাজ করা যায় , তাহলেই হবে সেটা আসল পুজো | পাড়ার প্রায় সবাই শরতের এই কথাটা শুনে দু সেকেন্ড চুপ হয়ে গিয়েছিলো | কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও ভাবতে বাধ্য হয়েছিল যে ‘মা’ কি চায় ! অনেক আড়ম্বরের টাকায় মোড়া প্যান্ডেল , না কি কিছু লোকের হাসি মুখ ! তাই আর কেউ না বলতে পারেনি শরতের মুখের ওপর | আর এই গোটা দৃশ্যটাই শিউলি দেখেছিলো অপলক দৃষ্টিতে | তারপর ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের দিন একার দায়িত্বে অতোজন ডোনার জোগাড় করে আনা , তাদের ব্লাড নেয়ার ব্যবস্থা , খাবার ব্যবস্থা , সব করেছিল শরৎ | সেইদিনই ভিড়ের মধ্যে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো এই ছেলেটা শিউলির কাছে ! হয়তো তাই | আসলে এতো এতো মুহূর্তের ভিড়ে কোন মুহূর্তটায় শরৎ এসেছিলো ওর মনে , সেটা ও আজও ঠিক বুঝতে পারে না ! সারাদিনটা আজ এইসব ভাবনার ভিড়েই কেটে গিয়েছিলো শিউলির | তবে সন্ধ্যের সময় পুরোনো দিনগুলো থেকে বেড়িয়ে অনেক সাহস সঙ্গে নিয়ে ও এসে হাজির হয়েছিল ওদের ফ্ল্যাটের ছাদে | শরৎ সেখানে মনে হয় একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো | শিউলিকে দেখে একটু অবাক হয়ে ও প্রশ্ন করেছিল সেইদিন ,
” কি রে , কি ব্যাপার ? হঠাৎ এখানে ডেকে পাঠালি ? আর অষ্টমীর দিন সন্ধ্যের সময় ঠাকুর দেখতে বেরোসনি কেন ?”
এর কি উত্তর দেবে শিউলি ! আর ঠাকুর ! এখন তো ওর পুরো পৃথিবীটাই ওলোট পালট হয়ে যাচ্ছে টেনশনে | ‘ভালোবাসি’ বলার চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জড়ো হচ্ছে আস্তে আস্তে | এখন কি আর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরার কথা মাথায় আসবে ! কথাগুলো মনে মনে ভাবতে ভাবতেই শরৎ আবার জিজ্ঞেস করে উঠলো , ——– ” আরে কি হলো ? অদ্ভুত তো ! কিছু বলছিস না কেন ?”
না , শিউলি এবার আর চুপ থাকলো না | এই সময়ে চুপ থাকলে সত্যি আর চলবে না | তাই এতদিনের জমানো কথাগুলো সাজিয়ে ও আস্তে গলায় বলে উঠলো , ———— ” আসলে আমার তোমাকে কিছু বলার আছে | আমি অনেকদিন ধরেই বোঝানোর চেষ্টা করেছি ! মানে , তুমি আমার কাছে খুব আলাদা | সবার থেকে আলাদা ! আমি জানি না আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি কি না ! কিন্তু এই কথাটা এখন না বললে হয়তো কখনো বলেই উঠতে পারতাম না | তোমার জন্য চিন্তা , তোমার জন্য ফিলিংস , এইসব অনেক বছর ধরেই ছিল আমার মনে | কিন্তু আমি সাহস করে বলতে পারিনি কখনো | তবে আজ মনে হলো এটাই ঠিক সময় ! তাই ! তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথাগুলো ? আমি কি বলতে এসেছি আজ ?”
প্রশ্নটা করেই আচমকা শিউলি থেমে গেলো | শরতের থমকে যাওয়া মুখটাকে দেখে | মনে হচ্ছে এমন কিছু বলে ফেলেছে ও যেটা হয়তো শরতের শোনার ইচ্ছে ছিল না ! শিউলি তাই নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে | মনে হচ্ছিলো এই উৎসবের সন্ধ্যের সময়টা কেমন যেন নিঃস্তব্ধতা ডেকে এনেছে ওর কাছে ! তাহলে কি শরৎ ওকে ভালোবাসে না ! কথাটা মনে আসতেই নিস্তব্ধতা ভেঙে শরৎ বলে উঠলো , ———– ” আমি জানি তুই কি বলতে চাইছিস | অনেকদিন ধরেই জানি | তোর মাঝে মাঝেই আমার ঘরে আসার , আমার টুকটাক কাজ করে দেয়া , রান্না করে আনা , সবই আমি নোটিশ করেছি | কিন্তু তার সঙ্গে এটাও চেষ্টা করেছি যে তুই নোটিশ করিস , আমার এইসবে কিছুই আলাদা করে যায় আসে না ! আমি আসলে তোকে কখনো হার্ট করতে চাইনি | তাই মুখের ওপর কিছু বলিনি | কিন্তু আজকে যখন তুই ডিরেক্টলি এসে জিজ্ঞেস করলি , তখন বলতে বাধ্য হচ্ছি , প্লিজ তুই হার্ট হোস না , কিন্তু আমি তোর জন্য কিছু ফিল করি না | তুই আমার কাছে ওই পাশের ফ্ল্যাটের চেনা একটা মুখ ছাড়া আর কিছুই নোস্ | আর কখনো হবিও না | এটাই সত্যি |”
কথাটা বলে শরৎ এবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামলো | তবে সেই মুহূর্তে ও খেয়াল করলো শিউলির ভিজে দুটো চোখ, থমকে যাওয়া হাসি মুখটা ! কেমন যেন চুপ করে এই অন্ধকার সন্ধ্যেটায় দাঁড়িয়ে ও ! একটা মন ভাঙা অষ্টমীর দিনে | শরতের হঠাৎ ভেতর থেকে খুব খারাপ লাগলো | কিন্তু তা ও নিজেকে কঠিন করার চেষ্টা করে বললো , ——— ” আমার মনে হয় আজ যা হলো, এরপর আমাদের আর কথা না হওয়াই ভালো | আমার জন্য কিছু বলছি না | কিন্তু তোর জন্য এটাই ঠিক | আমার সাথে কথা বলা মানেই নিজের ফিলিংসগুলোর সাথে আরো বেশি করে জড়িয়ে যাওয়া ! একতরফা কষ্ট | যেটার কোনো দরকার নেই তোর লাইফে | তাই তোকে আমার থেকে , এই ফিলিংসটার থেকে বেড়োতে হবে , মুভ অন করতে হবে | প্র্যাকটিকাল হতে হবে | আর আমি জানি তুই নিশ্চই লাইফে এমন কাউকে খুঁজে পাবি , যে শুধু তোর | তোকে খুব ভালোবাসবে | যাইহোক , এরপর আর তুই কখনো আমার ঘরে আসবি না | আমি জানি কথাটা শুনতে খুব রুড লাগছে | কিন্তু এটাই ঠিক | ”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে শরৎ ছাদটা খালি করে দিয়ে চলে গেলো সেইদিন শিউলির সামনে থেকে | আসলে কিছু কিছু সময় কঠিন হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয় | আর কোনো রাস্তা থাকে না | ও জানে ও এই মেয়েটাকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না | যেই ফিলিংস , যেই টান শিউলি ওর কাছ থেকে চায় , সেইসব কখনোই দিতে পারবে না | তাহলে মিথ্যে পাশে থাকার ভান করেও কোনো লাভ নেই | বরং শিউলির কাছ থেকে সরে গিয়েই বাস্তবটা বোঝানো উচিত |
তবে সেইদিন শিউলি এক পা ও এগোতে পারেনি অনেকক্ষন | হঠাৎ এতো বছরের জল এসে একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল ওর মনে | চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ , মাইকের গান , পুজোর মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ , সব কিছুর মাঝে শিউলি একেবারে নিঃস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ | আচ্ছা , ভালোবাসাটা কেন একটু বুঝে শুনে হয় না ! যে একটু ভালোবাসতে পারবে , ভালোবাসাকে ফেরত দিতে পারবে , তাকে মন খুঁজে পায় না ! কেন সব সময় মনভাঙার লোককেই আমরা মন দিয়ে ফেলি ! কষ্ট পাওয়ার জন্যই ভালোবাসি ! এই বাস্তব প্রশ্নগুলো আজ বার বার মনে এসে জমা হচ্ছিলো ওর , আর সব রূপকথা কল্পনা ভেঙে ওই শান্ত মুখের সবার থেকে আলাদা ছেলেটা আজ কেমন কঠিন , ইমোশনলেস একটা মানুষ হয়ে ধরা দিচ্ছিলো শিউলির সামনে | হঠাৎ খুব অচেনা লাগছিলো যেন ওই পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটাকে ওর | এমন একজন , যে খুব দূরের |
চলবে।