#আরেকবার_আবর্তন ( তৃতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৫>
দিন , মাস , বছরের হিসেব যেন চোখের পলকেই কেটে যায় | আজ দমদম এয়ারপোর্টে নেমে শরতের ঠিক এই কথাটাই প্রথম মনে হলো | তিন বছর আগে এরকমই সন্ধ্যেবেলা ফ্লাইট ছিল ওর | আর আজ এতগুলো দিন বাদে একই রকম একটা সন্ধ্যেবেলা কলকাতায় ফিরলো ও | তবে বাবাকে সেদিন দূর থেকে দেখে হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছিলো যেন | এই মানুষটা জীবনে কতটা জুড়ে আছে , সেটা মনে হয় এই ‘তিন বছর’ জীবনে না এলে কখনো বোঝাই হতো না ! কিন্তু বাবা কি আগের থেকে একটু রোগা হয়ে গেছে ! প্রশ্নটা আচমকা মনে এসে ভিড় করলো শরতের | আর তখনই বাবা খুব কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে |
সেদিন এইসবের পর লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের জ্যাম কাটিয়ে যখন শহরের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো ট্যাক্সীটা তখন ঘড়ির কাঁটা আরো এক ঘন্টা এগিয়ে গেছে | তবে শরতের মুখের হাসিটা এখনো কনস্ট্যান্ট | এতদিন বাদে সেই পুরোনো রাতের চেনা কলকাতাকে দেখে অদ্ভুত একটা শান্তি হচ্ছিলো মনে | নিজের জায়গায় ফেরার শান্তি | এতটা পথ , এতটা সময় পেরিয়ে আবার পুরোনোতে ফেরার শান্তি | সত্যি , এই শহর , এখানকার মানুষগুলোর কাছ থেকে দূরে না গেলে হয়তো সত্যি বোঝা হতো না ওর , যে এরা ঠিক কতটা মন জুড়ে আছে | তবে সেই সময় ওই চলন্ত রাস্তাগুলোর ভিড়ে আর একটা মুখ বার বার চোখের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছিল যেন শরতের | যেই মুখটা এতদিনে অনেক দূরে সরে গেছে ! সেই মেয়েটাকে আর একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো আজ | শরৎ এই তিন বছরে একটা জিনিস মন থেকে বুঝেছে , যে ওই শেষের এক মাস যা করেছিল সেটা ঠিক ছিল না | হয়তো নিজের অজান্তেই একজন খুব কাছের মানুষকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলো ও | তা ও আবার এমন একজনকে , যার কাছে ও ভীষণ দামি ছিল | জানে না সেই ভুলটাকে ঠিক করবে কি করে ! এতদিন বাদে কিছু ঠিক করা যায়ও কি না সেটাও জানা নেই | তবে চেষ্টা করবে | যাই হোক , এইসব ভাবনার ভিড়েই রাস্তাটা কেটে গেছিলো সেইদিন | এতদিন বাদে ফ্ল্যাটে ফিরে তো তারপর অবাক হয়ে গেছিলো | সব পুরোনো বন্ধুরা , এপার্টমেন্টের চেনা কাকু , জেঠু , কাকিমা , পিসিমা প্রায় সবাই একের পর এক আসছিলো দেখা করতে ওর সঙ্গে | নিউ ইয়র্কের ওয়েদার কেমন , ওদের গভর্নমেন্ট কেমন , ওখানকার লোকজন কেমন , ওখানকার রাস্তা ঘাট , লাইফস্টাইল কেমন , এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে নিজেকে মাঝে মাঝে কেমন ট্রাভেল গাইডের মতন মনে হচ্ছিলো যেন শরতের | তবে আগে হলে এতো কথা বলতে বিরক্ত লাগতো যদিও , কিন্তু এই তিন বছর বাদে এতো কথার ভিড় সত্যি ভালো লাগছে খুব | আর সব থেকে বেশি ভালো লাগছে চারিদিকে এতো বাংলা শুনে | মনে হচ্ছে কানটা এতদিনে যেন একটু শান্তি পেলো ! তবে এতো কিছুর মধ্যে একটা জিনিস ও প্রথম থেকেই খেয়াল করেছে , এতো লোকের ভিড়ে শিউলি কোথাও নেই | ওর মা তবে এসেছিলো একবার দেখা করতে | কিন্তু সেই মেয়েটা আসেনি একবারও | সেই রাতে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেন শিউলির সেই শেষদিনের কথাটা মনে পরে গেলো শরতের | ” এরপর আর কোনোদিন আসবো না |” —— কথাটা যে মেয়েটা একদম ভেতর থেকে বলেছিলো এটা আজ তিন বছর বাদে আরো বেশি করে বুঝলো যেন শরৎ | তবে শিউলি না আসুক , শরৎ তো যাবে | এতদিন পরে মুখোমুখি তো ওকে হতেই হবে | সেইদিন রাত্রে কথাগুলো ভেবেই ঘুমের দেশে গেছিলো ও |
পরের দিনের সূর্য চোখে এসে লাগতেই এরপর ঘুমটা ভেঙে গেছিলো শরতের | মনে হচ্ছিলো যেন কতযুগ বাদে নিজের ঘরে একটা সকাল দেখলো ও ! যাইহোক , সেদিন ব্রেকফাস্ট করেই ও আর সময় নষ্ট করেনি | সোজা হাজির হয়েছিল শিউলিদের ফ্ল্যাটে | তবে ড্রইং রুমে হুইল চেয়ারে বসে থাকা রোগা , ক্লান্ত মানুষটাকে দেখে সত্যি কষ্ট হয়েছিল ভীষণ | শিউলির বাবা তবে সেদিনও এক গাল হেসেছিলো শরৎকে দেখে | আর অবাকও হয়েছিল একটু | শরৎ আসলে ওনাদের ফ্ল্যাটে খুব কম এসেছে নিজে থেকে ! তবে আরো অবাক হয়েছিল যখন শরৎ একটা লেগ ম্যাসাজার হঠাৎ ওনার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো | নিউ ইয়র্ক থেকে এটা এনেছে ওনার জন্য | শিউলির বাবা তো এইসব দেখে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিলো না ! তখন শরৎই বলে উঠলো , ———— ” এটা ইউজ করো কাকু | পায়ের মাসলগুলো মুভ করতে হেল্প করবে এটা | ”
কথাটা শুনে শিউলির বাবা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে একটু কিন্তু কিন্তু করেই বলে ফেলেছিলো , ———-
” না মানে বাবা এতো দামি একটা জিনিস ! আমি কি করে নিই !”
শরৎ তখন গলায় একটু জোর দিয়ে উত্তর দিয়েছিলো , ——— ” নিই মানে ! আমি কি তোমায় জিজ্ঞেস করছি না কি ! এস এ ডক্টর এটা আমি তোমায় রেকমেন্ড করছি | তোমাকে ইউজ করতেই হবে , বুঝলে |”
না , এসবের পর শিউলির বাবা সত্যি আর কিছু বলতে পারেনি | এরপর না নিলে ছেলেটাকে অপমান করা হয় ! তবে এইসব কথার মধ্যে শরৎ খেয়াল করেছিল সেই মেয়েটা এখনো ওর দৃষ্টির বাইরে | সে তো ঘর থেকে বেরোয়ই না ! তাই শরৎ আর অপেক্ষা না করে শিউলির মাকে সোজাসুজি প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলো সেই মুহূর্তে , ———- ” কাকিমা , শিউলি কোথায় ? ওকে তো এসে থেকে একবারও দেখছি না |”
কথাটা শুনে শিউলির মা আলতো হেসে উত্তর দিয়েছিলো , ——- ” ও নিজের ঘরেই আছে | যাও না তুমি | দেখা করে এস | আমি তোমার জন্য শরবত পাঠিয়ে দিচ্ছি |”
না , কথাটা শুনে শরৎ আর বেশিক্ষন ওয়েট করেনি ড্রইং রুমে | তিন বছর সময় পার করে ও শিউলির ঘরে গিয়ে হাজির হয়েছিল | তবে মেয়েটা যদিও ওকে তখনও ঠিক খেয়াল করেনি | এক মনে নিজের গল্পের বইয়ের তাকটা গুছিয়ে যাচ্ছিলো | কিন্তু সেই চেনা গলার আওয়াজে হঠাৎ সম্ভিত ফিরলো , আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন থমকে গেলো ও | তিন বছর বাদেও গলার আওয়াজটা চিনতে ভুল হয়নি ! ——- ” কেমন আছিস তুই ?” প্রশ্নটা যেন আচমকা কানে এসে লেগেছিলো সেইদিন | আর চোখ ফিরিয়েই দেখেছিলো দরজায় শরৎ দাঁড়িয়ে | এতদিন বাদেও যেন একই দেখতে আছে ছেলেটাকে | শুধু গালে হালকা দাঁড়ি রেখেছে এই যা | তবে শিউলির মুখটা যে আগের থেকে অনেক বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে , সেটা শরৎ এক দেখাতেই বুঝেছিলো | চোখে আবার একটা রিমলেস চশমা | সময় যেন শিউলিকে একটু বেশিই এসে ছুঁয়ে গেছে |
শরৎ কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই শিউলি এক কথায় উত্তর দিলো এবার ,——- ” তুমি ! হ্যাঁ, ভালো আছি |”
আসলে শরৎ এর আগে কোনোদিনও এইভাবে শিউলির ঘরে আসেনি একবারও | তাই শিউলি একটু অবাক না হয়ে পারেনি ! এইসবের মধ্যেই শরৎ একটু হেসে বললো , ——— ” হ্যাঁ , আমি | কাল রাতে ফিরেছি | ভাবলাম তোর সঙ্গে , কাকু কাকিমার সঙ্গে দেখা করে আসি |”
শিউলি কথাটা শুনে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না ! তা ও দু সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো , ——- ” ওহ , আচ্ছা |”
শরৎ এবার একটু ভেবে বললো , ——– ” আমাকে জিজ্ঞেস করবি না কেমন আছি ?”
শিউলি এই প্রশ্নটা শুনে আবার এক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো , —- ” হ্যাঁ , কেমন আছো তুমি ?”
শরৎ এবারও আলতো হেসে উত্তর দিলো , ——– ” ঠিক আছি | তোর সাথে অনেকদিন বাদে কথা হলো | আমি নিউইয়র্ক থেকে যতবার কল করেছি কাকুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার জন্য , তখন দু তিন মিনিটের বেশি তো কথা হয়নি কখনো | ”
এর আর কোনো উত্তর দিলো না শিউলি | এর বেশি তো কথা হওয়ার কথা ছিল না ওদের ! চিন্তাটা মনে এসেই মিলিয়ে গেলো | শরৎ তখন আবার বলে উঠলো , ———- ” বাবার কাছে শুনলাম তুই না কি এখন একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াস ?”
শিউলি এবারও দু কথায় বললো , ——– ” হ্যাঁ. ওই আর কি |” …….তবে এরপর শরতের সাথে যাতে আর কথা না বাড়ে তার জন্য নিজেই কথা থামিয়ে দিলো | টেবিলে রাখা ভ্যানটি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো , ——– ” যাইহোক , আমাকে এখন একটু বেড়োতে হবে | কাজ আছে কিছু | আসছি |”
কথাটা শেষ করেই ও আর দাঁড়ালো না ছেলেটার সামনে | আসলে কিছু মানুষের মুখোমুখি আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না ! দূরত্বটাই অভ্যেস হয়ে যায় | তবে শরৎ আজ খুব তাড়াতাড়ি শিউলির ঘর থেকে বেড়োতে পারলো না | কিছু পুরোনো ব্যবহার মনে হলো যেন ফেরত পেলো হঠাৎ | তবে অবাক হলো না ! শিউলির জায়গায় ও নিজে থাকলেও খুব সহজ হয়ে কথা বলতে পারতো না হয়তো | এইসবই ভাবছিলো , তখনই আনমনে টেবিলে রাখা একটা বিয়ের কার্ডের দিকে চোখ চলে গেলো | শরৎ যেন কয়েক মুহূর্ত থমকে গেলো কার্ডের ওপরে লেখা নাম দুটো পড়ে | শিউলি ওয়েডস পার্থ ! ও ঠিক পড়ছে তো ! কথাটা মনে হতেই ও কার্ডটা হাতে তুলে নিলো | তারপর মন দিয়ে কার্ডের প্রত্যেকটা লেখা পড়লো | পরের মাসে বিয়ের তারিখ লেখা ! হঠাৎ যেন কিছুই মেলাতে পারলো না শরৎ ! শিউলি বিয়ে করছে ! তিন বছরে ও সত্যি এতটা দূরে চলে গেলো ! কথাটা ভেবেই ভেতরে অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা এসে ভিড় করলো | আর এতো বড়ো একটা খবর শিউলি নিজে ওকে বললো না ! কথাটা ভেবে যেন আরো বেশি মনে লাগলো | তার মানে কি তিন বছর আগে শরৎ শিউলির সঙ্গে এতটাই কঠিন ছিল যে শিউলি সত্যি ওকে পুরোপুরি ভুলে গেছে ! ওর থাকা না থাকাটা শিউলির জীবনে আর বিশেষ ম্যাটারই করে না | তাই হয়তো এতদিন বাদে দেখা হওয়ার পরও ওকে এইভাবে এভোয়েড করতে পারলো | বিয়ের মতন এতো বড়ো একটা খবর ওকে জানালো না | আর এই পার্থটাই বা কে ! যে শিউলির মনে এতটা গভীরভাবে জায়গা করে নিয়েছে যে একেবারে বিয়ে করার ডিসিশনই নিয়ে নিতে হলো ! কথাগুলো একসঙ্গে এসে ভিড় করলো মনে , আর শরতের ভেতরটা হঠাৎ কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো আজ | সময়ের দাম ঠিক সময়ে না দিলে মনে হয় এইভাবেই একা হয়ে যেতে হয় ! বিয়ের কার্ডটা হাতে নিয়ে শরতের ঠিক এই কথাটাই মনে হলো এখন !
<৬>
সেইদিন বাড়িতে এসে সবার প্রথমে বাবার সামনে গেছিলো শরৎ | বাবা ডাইনিং টেবিলে এক মন দিয়ে পেপার পড়ছিলো | হঠাৎ ছেলেকে এরকম থমথমে মুখে আসতে দেখে একটু অবাক হলেন উনি ! কি হলো হঠাৎ ! প্রশ্নটা মনে আসতেই শরৎ ওনাকে আরেকটা প্রশ্ন করে উঠলো ,
——— ” শিউলির বিয়ে ? তুমি কিছু জানো এই ব্যাপারে বাবা ?”
আচমকা এরকম একটা প্রশ্নের কোনো মানে খুঁজে পেলেন না উনি ! শরৎ হঠাৎ শিউলির বিয়ে নিয়ে পড়লো কেন বুঝতে পারছে না | তখন শরৎ একটু অধৈর্য হয়েই বলে উঠলো , ———- ” কি হলো ? বলবে কিছু ! জানো ওর বিয়ের ব্যাপারে তুমি ?”
কথাটা শুনে শরতের বাবা এবার একটু গুছিয়ে বললো , ——– ” না জানার কি আছে ! পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে | বিয়ের কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করে গেছে কিছুদিন আগে |”
কথাটা শুনে শরৎ যেন আকাশ থেকে পড়লো ! ———– ” কি ! বিয়ের কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করে গেছে ! আর তুমি আমাকে এই ব্যাপারে কিছুই বলোনি ? ”
শরতের বাবার এবার সত্যি কিছু মাথায় আসছে না | শিউলির বিয়ে তো ভালো ব্যাপার | এতে ওনার ছেলে যে কেন এরকম উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না | তা ও কিছু কথা সাজিয়ে বললো , ———-
” তুই তো এই কাল এলি ! আর শিউলিকে নিয়ে তোর কবে থেকে এতো চিন্তা হতে শুরু করলো ! আমি ভেবেছিলাম সাধারণ একটা ঘটনা | তুই এলে তো জানতেই পারবি | আলাদা করে বলার মতন তো কিছু নেই |আর ছেলেটা ওর বাবার বন্ধুর ছেলে | শুনেছি ওর বাবার শরীর খারাপের টাইমে হেল্প করেছে খুব | সেই সময় থেকেই হয়তো কথাবার্তা শুরু হয়েছে | এবার নেক্সট মন্থে বিয়ে |”
কথাগুলো শুনে শরৎ একটা শব্দেই উত্তর দিলো এবার , ——— ” বুঝলাম |”
তবে মনে মনে একবার অন্তত এই ছেলেটার মুখোমুখি হতে ইচ্ছে হয়েছিল সেইদিন | ছেলেটা কি ভীষণ ভালো ! প্রশ্নটা অজান্তেই মনে এসে ভিড় করেছিল | তবে উত্তর পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি | দুদিন বাদে ব্যাংকের একটা কাজে বেড়োনোর সময় হঠাৎ ফ্ল্যাটের বেসমেন্টে এসে চোখটা আটকে গেলো | উল্টো দিক থেকে শিউলি আচমকাই একটু এলোমেলো ভাবে এগিয়ে আসছিলো নিজের মনে , গায়ের ওড়নাটা ঠিক করতে করতে | চুলটাও যেন উস্কো খুস্ক | হয়তো নিজের খেয়ালে ছিল না | তাই শরতের সাথে হঠাৎ মুখমুখি হতেই কেমন ঘাবড়ে গেছিলো ও ! শরৎ খেয়াল করেছিল শিউলি একটু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে এখন | চোখটাও কেমন ছলছলে | কোনো একটা ঝামেলার মধ্যে থেকে বেড়িয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছিলো দেখে | শরৎ বুঝতে পারলো না ওকে এরকম দেখতে লাগছে কেন ! সব ঠিক আছে তো ! কথাটা মনে আসতেই দেখলো পেছন থেকে একটা ছেলে যেন দৌড়েই ওদের সামনে এসে হাজির হলো | শিউলির ছেলেটাকে দেখে মুখটা আরো অন্ধকার হয়ে গেলো এই সময়ে | তবে ছেলেটাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে এই মুহূর্তে শরৎকে দেখে | আসলে এই দুপুরের টাইমে বেসমেন্ট পুরো ফাঁকাই থাকে | হয়তো দুজনের কেউই শরৎকে এখানে ঠিক এক্সপেক্ট করেনি ! তবে শিউলির এরকম উস্কো খুস্ক এলোমেলো চেহারা দেখে শরৎ জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলো না , ———- ” কি হয়েছে তোর ? এইরকম লাগছে কেন দেখতে ? আর এই ছেলেটা কে ? ঠিক আছে সব ?”
প্রশ্নগুলো একসঙ্গে শুনে শিউলির সম্ভিত ফিরলো হঠাৎ | একটু কাঁপা কাঁপা গলাতেই নিজেকে সামলে নিয়ে কথা ঘোরানোর জন্য বললো , ——— ” ঠিক আছি আমি | আলাপ করিয়ে দিই | ও পার্থ | ওর সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে |”
কথাটা শুনে শরৎ এক মুহূর্ত থমকে গেলো | তবে খেয়াল করলো পার্থ হঠাৎ নিজের হাতটা শিউলির কাঁধে রেখে বেশ এটিটিউড নিয়েই ওকে বললো , ———- ” আপনি কে ? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না !”
তবে এই সময়ে শিউলির মুখটা যেন আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে | পার্থর হাতটা যে ও নিজের কাঁধ থেকে সরাতে চাইছে সেটা ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে শরৎ | শিউলিকে ভীষণ আনকমফোর্টেবেল লাগছে এই ছেলেটার সঙ্গে | কিন্তু ও মনে মনে যা বুঝছে সেটা তো আর মুখে সোজাসুজি বলা সম্ভব না | তাই একটু ভেবে বললো , ——- ” আমি শরৎ | শিউলিদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি | আপনার ব্যাপারে শুনেছি কদিন আগে বাবার মুখে | নাইস টু মিট ইউ .. ” ….
কথাটা শুনে পার্থ এবার উদাসীন ভাবেই বললো , —— ” আচ্ছা | সেম হিয়ার ..” তবে তখনও পার্থ নিজের হাতটা শিউলির কাঁধ থেকে সরায়নি | আর শিউলির যে এই জিনিসটা খুব অস্বস্তিকর লাগছে সেটা ওর ফ্যাকাসে মুখটা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে শরৎ | সত্যি কি অদ্ভুত ছেলেরে বাবা ! একটা মেয়ে যখন আনকম্ফোর্টেবল , তখন এইভাবে টাচ করার দরকার কি ! শরৎ যেটা বাইরে থেকে দেখে বুঝছে , এই পার্থ ছেলেটা সেটা বুঝতে পারছে না ! এ করবে বিয়ে দুদিন বাদে ! কথাগুলো ভেবেই শরৎ এবার ইচ্ছে করেই শিউলিকে এই সিচুয়েশন থেকে বার করার জন্য একটা বানানো কথা বললো , ———– ” এই শিউলি তোকে কাকিমা খুঁজছে জানিস | আমি যখন বেড়োচ্ছিলাম দরজায় দেখা হলো | তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলো | তুই এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে যা তাড়াতাড়ি | মনে হয় কোনো দরকার আছে | বুঝলি |”
কথাটা শুনে শিউলি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো | এক ঝটকায় নিজের কাঁধ থেকে পার্থর হাতটা সরিয়ে দিয়ে ওকে বললো , ——— ” মা ডাকছে | আমি আসি | আর পার্থ , তুমি এখন বাড়ি যাও | আমরা পরে কথা বলবো |”
কথাটা শেষ করেই ও আর পার্থর কোনো প্রত্তুত্যরের অপেক্ষা না করে ওই এলোমেলো চেহারায় চলে গেলো সেই
মুহূর্তে | তবে পার্থ বিরক্ত মুখেই দাঁড়িয়ে রইলো এই চলে যাওয়াটা দেখে | কিন্তু শরতের এই পুরো দৃশ্যটা চোখের সামনে দেখে খুবই অদ্ভুত লাগলো এখন | এই পার্থ ছেলেটার মুখের ভাব , ওর চাল চলন দেখে এক দেখাতেই কেমন ম্যানারলেস , ইনসেনসিবেল বলে মনে হচ্ছে শরতের | আর শিউলি যার সাথে এতটা আনকমফোর্টেবল ফিল করে তাকে হঠাৎ বিয়ে করতে যাচ্ছে কেন এটাও বুঝতে পারলো না ও !
কিন্তু এইসবের সাতদিন বাদে আরেকটা ঘটনা ঘটলো | শরৎ বিকেলের দিকে হেডফোনটা নিয়ে ছাদে গিয়েছিলো | কিন্তু দরজার সামনেই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো শিউলির গলা শুনে ! ছাদে এখন শিউলি আর ওই পার্থ বলে ছেলেটা | পার্থ আজ কেমন হিংস্র , রাগে লাল | ও শিউলির হাতটা মনে হয় নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে ! তারপর বেশ তেজ দেখিয়ে বলছে , ———- ” কিসের এতো নেকামি তোমার ? আমাদের বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে | এখনও তোমাকে একটা কিস করতে গেলেও এতো যুদ্ধ করতে হয় ! নিজেকে ঠিক কি মনে করো !”
কথাটা শুনে শিউলি এবার কান্নাভেজা গলায়ই বললো , ——– ” আমার হাতটা ছাড়ো প্লিজ | আমার লাগছে খুব |”
শিউলির কথাটা শরতের কানে এসে লাগলো এবার ! ও আর নিজেকে আটকাতে না পেরে এগিয়ে যেতে যাবে , তখনই আরেকটা কথায় থমকে গেলো | পার্থ শিউলিকে এবার বেশ শাঁসিয়ে বললো , ———- ” বিয়েটা কিন্তু তোমায় আমার সাথেই করতে হবে | এটা মাথায় রেখো | এখন ছেড়ে দিচ্ছি | তবে সিঁদুরটা পড়ালে কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না এতো সহজে | মাথায় রেখো এটা |”
কথাটা শেষ করেই পার্থ রাগে গড়গড় করতে করতে বেড়িয়ে গেলো ছাদ থেকে | ও রাগে এতটাই অন্ধ ছিল যে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা শরৎকেও ঠিক খেয়াল করেনি ! কিন্তু শরৎ এই মুহূর্তে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না | সোজা শিউলির কাছে এগিয়ে গেলো | শিউলি হঠাৎ এই ফাঁকা ছাদে শরৎকে দেখে অবাক হয়ে গেছিলো ! শরৎ কিছু শুনতে পায়নি তো ওদের কথা ! প্রশ্নটা মনে আসতেই শরৎ ওর খুব কাছে চলে এলো | শিউলি তখনই নিজের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো | নিজের এই অবস্থাটা যেন আড়াল করতে চায় ও | শরৎ এবার চুপ না থেকে বলে উঠলো , ——– ” কি হয়েছে তোর ? আমি এখুনি কি দেখলাম এইসব ? আর তুই তাকাচ্ছিস না কেন আমার দিকে ? তাকা বলছি |”
কথাগুলো একসঙ্গে বলার পরও সেদিন শিউলি মুখটা ঘোরায়নি | কিছুতেই শরতের দিকে তাকাচ্ছিলো না ও সোজাসুজি | কিন্তু শরৎ এবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে জোর করে শিউলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো | তবে এবার শিউলিকে দেখে আরও চমকে গেলো ! ওর গালটা লাল হয়ে আছে পাঁচ আঙুলের দাগে | ঠোঁটের কাছে রক্ত জমাট বাঁধা কালো দাগ | শরৎ এই দৃশ্য দেখে থমকে গেলো কয়েক সেকেন্ড ! তারপর দৃঢ় গলায় জিজ্ঞেস করলো , ———– ” ও তোকে মেরেছে ? ”
না , শিউলি এবারও চুপ ছিল | ও একটু সময় নিচ্ছিলো নিজেকে সামলানোর | চোখের জলটাকে আরেকবার মোছার ! আসলে এই শেষ দেড় বছরে এইরকম সময় ওকে বার বার নিতে হয়েছে নিজের কাছে | নিজেকে কঠিন করার সময় | আর তারপর বেশ দৃঢ় গলায় বলেছিলো , ——- ” কিছু হয়নি আমার | আর এটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার | তুমি আগে যেমন আমাকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে না , এখনও সেরকম মাথা ঘামানোর দরকার নেই | প্লিজ আমার ব্যাপার থেকে দূরে থাকো | এটা আমার রিকুয়েস্ট |”
কথাগুলো শেষ করে শিউলি এবার আস্তে আস্তে শরতের চোখের পলকে ওর থেকে দূরে চলে গেছিলো ছাদটাকে ফাঁকা করে | কিন্তু শরৎ হঠাৎ আজ ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো এই মুহূর্তে | যেই মেয়েটাকে ও ছোট থেকে এতো হাসতে , ননস্টপ বকবক করতে , প্রাণ খুলে বাঁচতে দেখেছে , তার গালে আজ পাঁচ আঙুলের দাগ ! একটা বাইরের ছেলে সেই মেয়েটার গায়ে এইভাবে হাত তোলে ! মারে ! নোংড়ামি করে ! আর এতো কিছু পরেও শিউলি শরৎকে শব্দও বললো না ! যে ওকে ছোট থেকে নিজের সমস্ত ছোট বড়ো কথা শেয়ার করতো , সে আজ চুপ করে গেলো ওর সামনে ! তার মানে কি শিউলির সাথে আজ ওর সত্যি এতো দূরত্ব যে ওকে নিজের ব্যাপারে কোনো কথা বলা যায় না ! শরতের কথাগুলো ভেবে কেমন এলোমেলো লাগছে এখন | শিউলির কালশিটে পড়া মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে | কিন্তু বুঝতে পারছে না কিভাবে হেল্প করবে এই মেয়েটার ! যে ওকে নিজের থেকে এতটা দূরে সরিয়ে রাখতে চায় , তার খুব কাছাকাছি আবার পৌঁছবে কিভাবে !
চলবে।