#আরেকবার_আবর্তন ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৫>
এইসবের পর কয়েকটা দিন কেটে গেছে | আজ দূর্গা পুজোর ষষ্ঠী | এর মধ্যে যতবার শিউলির সঙ্গে শরতের দেখা হয়েছে , কেউই ঠিক কথা বলে উঠতে পারেনি যেন | শিউলি তো ওকে দেখে অল্প হেসেই অন্যদিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে সব সময় | কিছু মানুষের সাথে দূরত্বটাই হয়তো নিয়তি | আর শিউলি কখনোই চেষ্টা করবে না নিয়তিকে বদলানোর | সেইদিন ষষ্ঠীর পুজো দেখতে দেখতেও এইসবই ভাবছিলো সন্ধ্যেবেলা | ও এখন মণ্ডপে আছে কারণ শরৎ এখানে নেই | কিন্তু ছেলেটা যদি আসে , তাহলে ও ফ্ল্যাটে চলে যাবে আবার | এইসব চিন্তার মধ্যেই ঢাকের তালে , পুজোর মন্ত্রে সন্ধ্যেটা কেটে যাচ্ছিলো বেশ | কিন্তু হঠাৎ সব কিছু থমকে গেলো যখন আনমনে শরতের দিকে চোখটা চলে গেলো শিউলির | পুজোর মণ্ডপে এই মুহূর্তে শরৎ ঢুকছে | তবে আজ একা নয় | সঙ্গে সেই রেস্টুরেন্টে বসে থাকা মেয়েটা | বেশ হাসি হাসি মুখেই কথা বলতে বলতে আসছে দুজন | দৃশ্যটা দেখেই শিউলির ভেতরটা আবার সেই আগের দিনের মতন আর একবার ভাঙলো | মুখটা না চাইতেও অন্ধকার হয়ে এলো | তাও নিজের মনকে ও জোর করেই আবার বলে উঠলো , যে না , যা দেখছে তাতে ওর সত্যি কিছু আসে যায় না | শরৎ অন্য যে কাউকেই ভালোবাসতে পারে | আর তাতে শিউলির কিছু না | এইসব ভাবনার ভিড়েই শরৎ আর ওই মেয়েটা কখন যে ওর একদম সামনে চলে এসেছে , শিউলি ঠিক খেয়ালই করেনি | সম্ভিত ফিরলো শরতের গলার আওয়াজ শুনে , ————- ” কিরে কি ভাবছিস ? তোর সাথে সেদিন আলাপ করাতে পারেনি | ও নিশা , ওই রেস্টুরেন্টে যার সাথে কথা বলছিলাম |”
শিউলি হঠাৎ এইসবের কি উত্তর দেবে ঠিক ভেবে পেলো না | তা ও অল্প হেসে নিশার দিকে তাকিয়ে বললো , ——– ” ওহ , আচ্ছা | আমি শিউলি , শরতদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি |”
নিশা কথাটা শুনে এক গাল হেসে এবার বলে উঠলো , ——— ” জানি তো | শরৎ তোমার কথা অনেক বলেছে আমাকে | শুধু দেখা হওয়াটা বাকি ছিল | ”
শিউলি এর উত্তরে একটু ভেবে বললো , ——- ” ওহ , হ্যাঁ, আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো | যাইহোক , তোমরা বসো মণ্ডপে | পুজো দেখো | আমি আসছি | একটু কাজ আছে |”
কথাটা শেষ করেই শিউলি সেদিনও যেতে যাচ্ছিলো , তবে শরতের কথায় আর সেটা করতে পারলো না | ওর কথাটা শেষ হতেই শরৎ আচমকা একটু কঠিন গলায় বলে উঠলো হঠাৎ , ——–
” কেন ? এতোই যখন আলাপ হয়ে ভালো লাগছে তাহলে চলে যাচ্ছিস কেন ? বসে কথা বল কিছুক্ষন আমাদের সঙ্গে | আর কি এমন কাজ আছে যে এখনই চলে যেতে হবে ?”
শিউলি এতগুলো প্রশ্ন একসাথে শুনে একটু অবাক হয়েছিল আজ | তবে না , ভাঙলে চলবে না কিছুতেই | যতই খারাপ লাগুক , কিন্তু সেটা শরৎকে ও কিছুতেই বুঝতে দেবে না | তাই কয়েক সেকেন্ড ভেবে গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে উত্তর দিলো , ———- ” না আসলে বাবাকে একটা ওষুধ খাওয়াতে হবে | মায়ের তো বয়স হয়েছে | মনে থাকে না সব সময় | তাই |”
শরৎ এরপরও সেই কঠিন গলায়ই বললো , ———- ” আমি তো ডাক্তার | একটা ওষুধ দশ মিনিট বাদে খাওয়ালে কিছু এমন ক্ষতি হবে না | তাই তুই এই মুহূর্তে এখানে বসতে পারিস | আমাদের সাথে একটু গল্প তো করাই যায় |”
না , এই কথাটার পর সত্যি শিউলির আর কিছু বলার ছিল না | মণ্ডপের চেয়ারগুলোতে গিয়ে বসতেই হলো সেই ওদের সঙ্গে | কিন্তু কিছুতেই যেন মুখটাকে ও জোর করেও হাসি হাসি করে রাখতে পারলো না আর ! কেমন একটা অন্ধকার নেমে এলো সেখানে | শরৎ যে এরকম কেন করছে ঠিক বুঝতে পারছে না ও ! শিউলি তো ওদের মাঝে আসতে চায় না | ও তো পুরোনো কিছুই আর মনে রাখতে চায় না | তাহলে শরৎ কেন ওকে দূরে থাকতে দিচ্ছে না ওদের লাইফ থেকে ! কেন এইভাবে জোর করে কথা বাড়াচ্ছে ও ! প্রশ্নগুলো না চাইতেও মনে এসে ভিড় করলো শিউলির | তখন শরৎ আরেকটা প্রশ্ন করে উঠলো হঠাৎ , ————- ” কি হলো শিউলি ? চুপ কেন ? তুই তো জানতে চাইলি না যে আমার আর নিশার কি করে আলাপ হলো ? কিভাবে শুরু হলো সব কিছুর ? মানে তোর তো আমাদের একসঙ্গে দেখে খুব ভালো লাগছে তাই না ! তাই বলছিলাম আর কি | কিছু জানতে চাইলি না তো ?”
কথাগুলো শুনে শিউলি আবার সেই পুরোনো জোরের হাসিটা হেসে বললো , ———- ” হ্যাঁ , ভালো তো লাগছেই খুব | কিন্তু কিভাবে তোমাদের আলাপ হলো , সব কিছুর শুরু হলো , সেইসব তো তোমাদের পার্সোনাল ব্যাপার না ! আমি কি করে জিজ্ঞেস করি !”
ওর কথাটা শেষ হতেই এবার নিশা নিজে থেকে বলে উঠলো , ———– ” আরে এ আর এমন কি পার্সোনাল কথা ! ওর সাথে আমার আলাপ আমাদের হসপিটালে | আমাদের একই দিনে জয়েনিং ডেট ছিল | আমি তো শুরুতে একটু টেনশনে ছিলাম | ওই ফার্স্ট ডে হলে যা হয় | তখন শরৎ আমাকে এক কাপ কফি খাইয়েছিল | কথা বলে একটু টেনশনটা কমানোর চেষ্টা করেছিল | ব্যাস , ওই থেকেই বন্ধুত্বের শুরু |”
কথাটা শুনে শিউলি থমথমে মুখে একটা লাইনেই উত্তর দিয়েছিলো , ———– ” ওহ , আচ্ছা | খুব ভালো |”
শরৎ এবার আর কোনো প্রশ্ন না করে নিজে থেকেই বলতে শুরু করেছিল , ———- ” আসলে কি বল তো শিউলি , নিশা একচুয়ালি একজন খুব ভালো ডাক্তার | যত দিন গেছে , এটা আমি ওর মধ্যে নোটিশ করেছি | তাই ইমপ্রেস না হয়ে আর কোনো উপায়ই ছিল না | ”
না , শিউলি এইসবের পর আর কিছুতেই চুপচাপ চেয়ারটায় বসে থাকতে পারলো না | এবার ওর মনটা সত্যি ভেতর থেকে ভাঙছে | আর কিছুক্ষন এখানে দাঁড়ালে সেই ভাঙ্গনটা শরৎ খুব পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবে | তাই শিউলি চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো | তারপর একটু দৃঢ় গলায় বললো , ——— ” আমি আসছি শরৎ | বাবা হয়তো অপেক্ষা করছে আমার | তোমরা গল্প করো |”
কথাটা শেষ করেই ও আর কোনো প্রত্তুতরের অপেক্ষা করলো না সেইদিন | ওই ষষ্ঠীর সন্ধ্যে , ঢাকের আওয়াজ , পুজোর মন্ত্র , আর চেনা সেই পুরোনো মুখটা ছেড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে | দম বন্ধ করা একটা সন্ধ্যে ছেড়ে যেন শ্বাস নিতে বেরিয়ে এলো খোলা আকাশের নিচে |
কেন আমাদের জীবনে এরকমটা হয় ! কেন চাওয়া পাওয়ার হিসেবের ভিড়ে বার বার আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলি ! কেন হাজার চাইলেও সেই পুরোনো একজনকে কিছুতেই ভুলতে পারি না ঠিক ! হাজার চেষ্টা করেও আটকে থাকি সেই এক জায়গায় ! দিনের পর দিন , বছরের পর বছর | কথাগুলো এই খোলা আকাশের নিচে এসে মনে ভিড় করলো আবার | কিন্তু আজও শিউলি এর কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না | ঢাকের আওয়াজের মাঝে নিঃস্তব্ধ নিজেকে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো তাই একা একা , একটু নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য |
<১৬>
যাইহোক , সপ্তমীর সকাল আজ | ষষ্ঠীর রাত পেরিয়ে নতুন একটা দিন এসে ভিড় করেছে বাঙালির দরজায় | সকাল থেকেই তাই মণ্ডপের মাইকে বাজছিলো সপ্তমী পুজোর মন্ত্র | কলাবৌ স্রান হয়ে গেছে মনে হয় কিছুক্ষন আগে | শিউলি ব্যালকনির গাছে জল দিতে দিতে এইসবই ভাবছিলো | না , আজ আর মণ্ডপে যায়নি ও | কালকের ঘটনাটার পর নিজেকে আরো বেশি করে গুছিয়ে নেয়ার জন্য কিছুটা সময় চাই এখন | এই সময়ে শরতের মুখোমুখি হলে চলবে না | তাই ইচ্ছে করেই মণ্ডপে গিয়ে দাঁড়ায়নি | সেইদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠলো ওদের ফ্ল্যাটের | এখন আবার কে এলো ! কথাটা ভাবতেই ও ড্রইং রুমে বেরিয়ে এলো , কিন্তু পা-টা আটকে গেলো হঠাৎ | ঈশ্বর কি ওকে একটু শান্তি দেবে না ! না কি এই ছেলেটা ওকে শান্তিতে থাকতে দেবে না ! কি চাই আর শরতের | করছে তো প্রেম অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে | শিউলি তো আর একবারও ওর সাথে এই নিয়ে কথা বলতে যায়নি | এমন কি শরতের ফেরার পর থেকে যতটা সম্ভব নিজে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে | শরৎ তিন বছর আগে যেই দূরত্বটা যত্ন করে তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিলো , শিউলি আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সেটাকে মেনে চলার | তাহলে ওর সামনে এইভাবে বার বার কেন আসছে ছেলেটা ! কথাগুলো না চাইতেও মনে মনে ভেবে ফেললো ও এখন | কিন্তু মুখে সেই মিথ্যে হাসিটা ধরেই রাখলো | কেউ নিজে থেকে বাড়িতে এলে তো আর অভদ্রতা করা যায় না | এই ভেবেই দাঁড়িইয়ে রইলো কিছুক্ষন ড্রইং রুমে | তবে শরতের ততক্ষনে ওর বাবা মা কে নমস্কার পর্ব সাড়া হয়ে গেছে | এরপর হঠাৎ ও শিউলির দিকে তাকিয়ে বললো , ————- ” কি ব্যাপার ? সপ্তমীর সকাল ! তুই রেডি হোসনি এখনো ? বেরোবি না ঠাকুর দেখতে ?”
শিউলি এর উত্তরে একটা সাজানো কথা বলতে যাবে , তখনি ওর বাবা সব কিছুতে জল ঢেলে আসল কথাটা বলে ফেললো , ———— ” আরে , দেখো না শরৎ | সেই তিন বছর ধরে মেয়েটা কোনোবার পুজোতে কোথাও বেরোয় না | বলে আমি যেহেতু বাড়িতে বসে থাকি সারাক্ষন , তাই ওর আমাকে ছাড়া না কি কোনো ঠাকুর দেখতে মন চায় না | এটা কোনো কথা ! আমার জন্য পুজোর এই চারটে দিনও বাড়িতে বসে থাকতে হবে ! কতবার বলেছি ও আনন্দ করলে আমার নিজের খুব ভালো লাগে | কিন্তু কে শোনে কার কথা !”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো শিউলির বাবা | আর শিউলি নির্বাক হয়েই রয়ে গেলো শরতের সামনে | ধুর , বাবাকে এতো কথা বলতে কে বলেছিলো ! এটাই ভাবছিলো , তখনি শরৎ বলে উঠলো , ———— ” তিন বছর যা হয়েছে হয়েছে | কিন্তু এই বছর তো তোকে বেড়োতেই হবে ঠাকুর দেখতে | আমি আর নিশা মিট করবো কিছুক্ষন বাদে ওই দেশপ্রিয়পার্কে | তুইও চল | নিশা কালকের পর থেকে তোর কথা খুব বলছে | ও ই বলেছে তোকে নিয়ে আসতে |”
কি অদ্ভুত তো ! নিশা মেয়েটার কি মাথার ঠিক আছে ! দেখেছে তো ওকে ওই একদিন দশ মিনিটের জন্য | তার মধ্যে কারোর কাউকে কি করে এতো ভালো লেগে যেতে পারে ! আর নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে লোকজন তো পার্সোনাল টাইম স্পেন্ড করতেই বেশি পছন্দ করে | এই প্রথম দেখছে কাউকে যে বাইরের লোকজনকে ডেকে ডেকে ইনভাইট করছে নিজেদের সাথে ঘোরার জন্য |কথাগুলো মনে আসতেই ও এবার একটু দৃঢ় গলায় বললো , ——— ” না শরৎ | আমি যাবো না কোথাও | আমার ভালো লাগে না ঘুরতে পুজোতে আর |”
কথাটা শুনে শরৎ দু সেকেন্ড সময় নিয়ে এবার হঠাৎ নতুন প্রশ্ন করে উঠলো সবার সামনে শিউলিকে , ————– ” তাই ! তা তোর ভালো না লাগার কারণটা কি শুধু কাকুই না অন্য কিছুও ? মানে কাকু তো খুশিই হবে মন থেকে, যদি তুই বেড়োস | তাহলে কি অন্য কোনো ব্যাপারে তোর খারাপ লাগছে ? তাই তুই আমাদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়াটাকে এভয়েড করছিস ?”
শরতের এই প্রশ্নগুলোর মানে সেই মুহূর্তে শিউলির মা বাবা বুঝতে না পারলেও শিউলি খুব ভালো করে বুঝেছিলো | শরৎ ওকে ঠিক কি মিন করতে চাইছে এটা খুব স্পষ্ট এখন ওর কাছে | তাই নিজের মনটাকে শক্ত করেই বলে উঠলো এবার , ———- ” কে বললো অন্য কোনো ব্যাপার আছে ! আর তোমাদের এভয়েডই বা করবো কেন ! কোনো ব্যাপারে কোনো খারাপ লাগা নেই আমার মনে | ঠিক আছে | আমি রেডি হয়ে আসছি | ওয়েট করো | বেরোবো তোমাদের সাথে ঠাকুর দেখতে |”
কথাটা শেষ করেই ও খেয়াল করলো শরতের মুখে একটা আলতো হাসি | তবে না , শিউলি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চলে এলো নিজের ঘরে রেডি হতে | পুরোনো কোনো কিছুর রেশ যে আর ওর মনে নেই সেটা আজ জোর করে হলেও প্রমান করবে ও শরতের সামনে | কি ভাবে কি ছেলেটা ওকে ! গল্পের শেষ শুধু ও ই করতে পারে ! শিউলি নয় ! ও এতো ইমোশনাল যে পুরোনো একটা রিজেকশনকে আঁকড়ে ধরে সাড়া জীবন বসে থাকবে ! এগিয়ে যেতে পারবে না জীবনে ! না , এটা যদি কেউ ওর ব্যাপারে ভেবে থাকে সেটা ভুল | আজ তাই শিউলি দেখিয়ে দেবে , শরৎকে অন্য যে কারোর সাথে দেখে ও খুশি হতে পারে | ও যেমন শরতের রিজেকশনটাকে একসেপ্ট করে নিয়েছিল , সেইরকম শরৎকে অন্য একজনের সঙ্গেও খুব সহজেই একসেপ্ট করে নিতে পারে | এইসবই ভাবছিলো সেইদিন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরতে ঘুরতে | তবে অদ্ভুত লাগছিলো একটা ব্যাপার দেখে | দেশপ্রিয়পার্ক এর সামনে এসে ওরা প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইলো লাইনে, কিন্তু ওই নিশা বলে মেয়েটার তো কোনো পাত্তাই নেই ! শরৎকে প্রশ্নটা করাতেই ও বলে উঠলো দু সেকেন্ড ভেবে , ———– ” নিশার কিছু আর্জেন্ট কাজ চলে এসেছে বুঝলি | ও আমাদের সাথে রাসবিহারীর কাছে মিট করবে , দ্যা গ্রিন ভিউ ক্লাব বলে একটা রেস্টুরেন্টে |”
কথাটা শুনে শিউলি একটু অবাক হয়ে গেলো এবার | এর মানে কি এখন শরতের সাথে রেস্টুরেন্ট অব্দি যেতে হবে ! ভেবেছিলো দেশপ্রিয় পার্কে ওই নিশা এলে, কয়েক মিনিট কথা বলে ও চলে আসবে কিছু একটা কাজের দোহাই দিয়ে | কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে এই ছেলেটার সাথেই না পুরো দিনটা কাটাতে হয় ! সত্যি , জীবনে কি একটা ভাবনাও মিলবে না ওর | এইসব ভাবনাগুলোর মধ্যেই শরতের টুকটাক কথা শুনতে শুনতে ওরা অবশেষে হাজির হয়েছিল সেই রেস্টুরেন্টে | কিন্তু এ কি , এখানেও তো নিশা নেই ! হচ্ছেটা কি সকাল থেকে আজ ! এখন কি শরতের সঙ্গে এই রেস্টুরেন্টে একা একা বসে ওকে লাঞ্চ করতে হবে ! কথাটা ভেবেই ও জিজ্ঞেস করে উঠলো , ———— ” আচ্ছা , তোমার নিশার কি এখনো টাইম হলো না আসার ? সকাল থেকে ঘুরে যাচ্ছি আমরা দুজন | এখন রেস্টুরেন্ট অব্দি পৌঁছে গেলাম | কিন্তু সেই মেয়ের তো কোনো খবরই নেই ! ”
কথাটা শুনে শরৎ আস্তে গলায় বললো অল্প হেসে , ——— ” আরে , তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন ? মানছি , আমার সাথে নিশাকে একসঙ্গে দেখে তোর খুব ভালো লাগে | তাই বলে একটু ওয়েট করতে পারবি না ! এই তো আমাকে ম্যাসেজ করেছে ফোনে নিশা , চলে আসবে আর কিছুক্ষন বাদে | আমরা এর মধ্যে খাবারটা অর্ডার করে দিই বুঝলি | বল তুই কি খাবি ?”
আশ্চর্য তো ! ও কি এখানে খেতে এসেছে ! আর নিজের গার্লফ্রেন্ড কে জিজ্ঞেস করুক সে কি খেতে চায় ! ওকে নিয়ে এতো কনসার্ন দেখানোর কি আছে ! কথাগুলো মনে মনে ভাবতেই অদ্ভুত একটা রাগ এসে ভিড় করলো মনে | তাই গম্ভীর মুখেই উত্তর দিলো , ———— ” আমার যা হোক কিছু হলেই চলবে | তুমি বরং তোমার নিশাকে ম্যাসেজ করে জিজ্ঞেস করো , ও কি খেতে চায় |”
কথাটা শেষ হতেই শরৎ এবার হেসে এক কথায় বলে উঠলো , ———– ” নিশাকে আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে ! ওর তো চাইনিজ পছন্দ .. চিকেন মাঞ্চুরিয়ান , আর ফ্রাইড রাইস ওর অল টাইম ফেভারিট | আসলে ওকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি আর বুঝি |”
কথাগুলো শুনে সত্যি এবার ভেতর থেকে জ্বলে গেলো কিছু একটা শিউলির | এতো ডিটেলসে নিশার ব্যাপারে জানে শরৎ ! কোই , তিন বছর আগেও তো এই ছেলেটা লেভেলের শাই ছিল | কম দিন তো চিনতো না ওকে ! সেই ছোটবেলা থেকে | শিউলি ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে তো চোখ তুলে কথা অব্দি বলতে পারতো না ! আর আজ একেবারে ফ্রাইড রাইস , আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ানে পৌঁছে গেলো ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও সেই গম্ভীর মুখটা নিয়েই উত্তর দিলো , ———- ” বুঝলাম | তোমার তো দেখছি বেশ ভালোই উন্নতি হয়েছে নিউ ইয়র্কে গিয়ে | ভালো লাগলো জেনে | ”
শরৎ কথাটার কোনো মানে খুঁজে না পেয়ে একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন মুখে নিয়ে বলে উঠলো এবার , ———– ” উন্নতি মানে ? বুঝলাম না ঠিক |”
শিউলি তখন ভদ্রতার হাসি হেসে এক কথায়ই উত্তর দিলো , ———– ” না , এই যে একটা মেয়ের পছন্দ অপছন্দ এতো ভালোভাবে জেনে বুঝে গেছো | আগে হলে তো ঠিকভাবে কথাও বলতে পারতে না | তাই বললাম আর কি |”
শরৎ কথাটা শুনে এই মুহূর্তে হেসে ফেললো হঠাৎ | তারপর একটু ভেবে বললো , ———– ” কেন , তোর ভালো লাগছে না ? তোর তো খুশি হওয়ার কথা | আমি আমার লাইফে কাউকে নিয়ে এতো ভাবছি | রিলেশনে এসেছি একটা মেয়ের সঙ্গে | তোর সেদিনের কথা অনুযায়ী তো এইসব জেনে তোর ভীষণ আনন্দ পাওয়ার কথা !”
ওর কথাগুলো শেষ হতেই এবার শিউলির পারদ আপনাআপনিই চড়ে গেছে ! না , আর রাগটাকে মনে রাখা সম্ভব না | তাই বেশ জোর দিয়েই একটু গলার ভলিউম বাড়িয়ে বললো , ——— ” কে বললো আমার ভালো লাগছে না ! আমার ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালো লাগছে তোমাদের জন্য | সেদিন ওই রেস্টুরেন্টে তোমাদের একসাথে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিলো | তোমাদের জুটি দেখলে আমার শাহজাহান মমতাজ , উত্তম সুচিত্রার কথা মনে পরে যায় | এতো ভালো লাগে তোমাদের একসাথে দেখলে | হয়েছে এবার বিশ্বাস আমার কথায় ? না কি আরোও কিছু লাইন বানিয়ে বলতে হবে ?”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করে শিউলি এবার থামলো | রাগটাকে এতক্ষনে শরতের সামনে দেখিয়ে এবার যেন একটু শান্তি হচ্ছে মনে | কিন্তু শরত এইসবের কোনোই উত্তর দিতে পারলো না এই মুহূর্তে কারণ নিশা এসে হাজির হয়েছে এর মধ্যেই | শিউলি রাগে কথাগুলো বলতে বলতে আসলে খেয়াল করেনি ব্যাপারটা | নিশা ওর পেছন থেকে হঠাৎ উঁকি দেয়ায় সম্ভিত ফিরলো | তবে ওর কিছু বলার আগেই নিশা এবার বলে উঠলো নিজে থেকে , ———— ” কি হলো শিউলি ? আমি রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে দেখছিলাম | তুমি কি সব শাহাজান মমতাজ , উত্তম সুচিত্রার কথা নিয়ে কিছু একটা বলছিলে না শরৎকে ?”
কথাটা শুনে শিউলি এবার ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না আর ! রাগের মাথায় কি বলেছে তার খেয়াল ওর আছে না কি ! তখন শরৎই অল্প হেসে শিউলির হয়ে উত্তরটা দিয়ে দিলো এখন | একটুও সময় না নিয়ে ও বলে উঠলো নিশাকে , ———- ” আসলে শিউলি আমাদের একসঙ্গে দেখে ঠিক কতটা খুশি , সেটাই ও এতক্ষন ধরে বোঝাচ্ছিলো আমাকে | কি তাই না ?”
শেষ কথাটা ও শিউলির দিকে তাকিয়েই বললো | তবে শিউলি মুখটাকে লাল করে চুপই রইলো | রাগ আর কষ্ট আসলে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে এখন | তাই এই সময় কোনো কথা , কোনো শব্দ আসছে না আর ওর | যাইহোক , সেইদিন এরপর পুরো লাঞ্চের সময়টা শিউলি ‘হ্যাঁ’ , ‘আচ্ছা’ , ‘ওহ’ , ‘ভালো’ এই রকম টুকটাক শব্দ খরচ করে কাটিয়ে দিলো কোনো মতে | তারপর অন্ধকার মুখে ফিরে এলো বাড়ি | ও কি আজ সত্যি পারলো শরৎকে বোঝাতে যে ওর এই রিলেশনটা নিয়ে কিছুই যায় আসে না ! যেই মিথ্যেটা ও রোজ নিজেকে বলে , সেটা কি দেখাতে পারলো ওই ছেলেটাকেও ! আর কেন যে তিন বছর বাদেও কারোর জন্য এতো কষ্ট হয় ! কেন মন এতো বেহিসাবভাবে ভেবে ফেলে বার বার ! কেন একই ভুল একজনের জন্য কেউ বার বার করে ! প্রশ্নগুলো একসঙ্গে মনে এসে জমা হলো আজও , আর সপ্তমীর বিকেলটাকে একেবারে ভিজিয়ে দিলো শিউলির জলে |
<১৭>
আজ অষ্টমী | সকাল সকাল অঞ্জলি দেবার লাইন মণ্ডপে | শিউলি একদম ঠিকঠাক টাইমেই শাড়ি পরে এখন মণ্ডপের সামনে এসে হাজির হয়েছে | লাল রঙের শাড়িতে সেজেছে আজ ও | ওর মা জোর করে সাজিয়ে দিয়েছে ওকে সকাল সকাল | যাইহোক , স্রান করে শাড়ি পরে যে ঠিক সময়ে মণ্ডপে আসতে পেরেছে এই অনেক ! আজকে সেকেন্ড রাউন্ডেই অঞ্জলি দিয়ে দেবে ও | এইসবই ভাবছিলো , তখনই সবার ভিড়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শরতের দিকে চোখ চলে গেলো হঠাৎ | লাল রঙের পাঞ্জবী পড়েছে আজ | কিন্তু শরৎ তো এক দৃষ্টিতে স্থিরভাবে এখন ওরই দিকে তাকিয়ে ! অদ্ভুত তো ! ওর দিকে এইভাবে দেখছে কেন ! না , কি সব ভাবছে শিউলি ! এই ভিড় মণ্ডপে যে কারোর যে কারোর দিকে চোখ পরে যেতে পারে | এর আর অন্য কোনো মানে নেই | কথাটা ভেবেই ও শরতের দিক থেকে চোখটা ঘুরিয়ে অঞ্জলীর লাইনে এসে দাঁড়ালো | তারপর ফুল নেয়ার ব্যস্ততায় হঠাৎ খেয়াল করলো সেই লাল পাঞ্জাবি পড়া ছেলেটা এই মুহূর্তে ভিড় কাটিয়ে ওরই পাশে এসে হাজির | তবে না , শিউলি আজ ওকে দেখে আর একটাও কথা বললো না | চুপচাপ চোখ বন্ধ করে অঞ্জলীর মন্ত্রোচ্চারণ এ মন দেবে ভেবে দাঁড়ালো | কিন্তু সেই মুহূর্তে হঠাৎ ওই বন্ধ চোখের আড়ালে সেই চেনা গলার স্বরটা এসে ওর কানের পাশে বলে উঠলো , ———- ” লাল রংটাই বেশ মানিয়েছে আজ | ভালো লাগছে |”.
কথাটা শেষ হতেই শিউলি চোখ খুললো আনমনে | শরৎ ওকে কমপ্লিমেন্ট দিলো ! কথাটা ভেবেই পাশে ফিরে তাকালো | কিন্তু এ কি ! সেই ছেলের চোখ তো এখন বন্ধ | হাত জোর করে সে এক মনে মায়ের ভক্তিতে বিলীন | তাহলে কি ভুল শুনলো কিছু ! শিউলি কথাটা ভাবতেই ঠাকুরমশাই এবার মাইকে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলো | না , আর অন্য কোনো কথায় মন না দিয়ে শিউলি এবার অঞ্জলিতেই কনসেনট্রেট করলো | সত্যি হয়তো ভুল শুনেছিলো ও | শরৎ ওকে কেন কমপ্লিমেন্ট দিতে যাবে ! তার জন্য তো নিশা আছে | কথাগুলো ভেবেই ও আর নিজের ভাবনাগুলোকে এগোতে দিলো না আজ |
তবে অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলা একটা ঘটনা ঘটলো | শিউলি পুজো দেখবে বলে মণ্ডপে এসেছিলো একটু সেজে গুজে | কিন্তু এখানে এসেই আজও আবার শরৎ আর নিশাকে একসঙ্গে দেখে পা টা থমকে গেলো আরেকবার |তবে সকালের মতন শরৎকে দেখে চুপ করে থাকতে পারলো না এখন | কারণ শরৎ নিজে থেকেই ওর সামনে এসে বলে উঠলো একটা অন্য কথা | যেটা শোনার জন্য এই মুহূর্তে শিউলি ঠিক তৈরী ছিল না | আসলে শরৎ সেইদিন বেশ হাসি মুখে এসেই শিউলিকে খবরটা দিয়েছিলো | কিছু কথা সাজিয়ে বলেছিলো , ————– ” তোকে একটা খুব ভালো খবর জানানোর আছে আমার আর নিশার ব্যাপারে আজ | বাবার সাথে ওর আলাপটা করিয়েই দিলাম | খুব তাড়াতাড়িই হয়তো বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে | তুই তো সেই প্রথম দিন থেকেই আমাদের দেখে খুব খুশি | তাই তোকেই ফার্স্ট জানালাম এই বিয়ের ব্যাপারে |”
না , শিউলি এটা শুনে আজ আর কিছুতেই সেই জোরের হাসিটা হাসতে পারলো না শরতের সামনে | হাজার চেষ্টা করেও একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলো না মুখ দিয়ে | সত্যি শরতের এই মেয়েটার সাথে বিয়ে হয়ে যাবে ! কথাটা এসে যেন অদ্ভুত একটা ধাক্কা দিলো ওর মনে | না চাইতেও চোখটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভিজে গেলো সবার সামনে | তবে এই সময়ে আর এখানে দাঁড়িয়েও থাকা সম্ভব না | তাই ও কিছু না বলেই মণ্ডপ ছেড়ে চলে এলো আজ , ওর একাকী সেই পুরোনো ছাদে | যেখান থেকে এই মন ভাঙার গল্পটার প্রথম শুরু হয়েছিল ! আজও সেই একই সন্ধ্যে চারিদিকে | সেই পুরোনো ঢাকের আওয়াজ , মাইকের গান বাজছে পুরো শহর জুড়ে | সেই অষ্টমীর একটা সুন্দর সন্ধ্যে ছড়িয়ে আছে আসে পাশে তিন বছর আগের মতন | আর সেই শিউলি আবার কাঁদছে এই সবকিছুর আড়ালে | সেই আবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে পুরোনো সময়ের মতন | কিন্তু না , আজ আর শেষ হলে হবে না | মানতেই হবে সত্যিটা | নিজেকে শক্ত হতেই হবে | ও আর শরতের জন্য কাঁদবে না | ও আর শরতের কথা ভাববে না | এই কথাগুলোই জোর করে নিজের মুখে আওড়াচ্ছিলো সেদিন একা ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে | চোখটা ভিজে হলেও মুখে বার বার একটাই কথা বলছিলো ও , ——– ” কিছু যায় আসে না আমার কারোর জন্য |” …….. কিন্তু সেইদিন তিন বছর আগের মতন এই কান্নার ভিড়ে একা থাকতে হয়নি ওকে বেশিক্ষন | হঠাৎ নিঃস্তব্ধ ছাদে সেই চেনা গলার আওয়াজটা কানে এসেছিলো শিউলির | শরৎ বেশ দৃঢ় গলায় এসে বলেছিলো , ——- ” তোর যায় আসে শিউলি | আর এটাই সত্যি | তুই এখনো ফিল করিস | এখনো আমার কথা ভাবিস | তিন বছরে তুই এমন কিছুই এগিয়ে যাসনি পুরোনো সময়ের থেকে | তুইও আমার মতন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছিস | একই কথা ভাবছিস |”
কথাগুলো সেদিন এক নিঃশ্বাসে বলে গেছিলো শরৎ , আর শিউলি অবাক চোখে ফিরে তাকিয়েছিলো ছাদের দরজার দিকে | এই ছেলেটা কেন এসেছে ! কথাটা ভেবেই ও প্রশ্ন করেছিল ভিজে গলায় , ——— ” তুমি এখানে এখন কি করছো ?”
প্রশ্নটা শুনে শরৎ সেদিন শিউলির খুব কাছে এসেই উত্তরটা দিয়েছিলো , ———- ” কেন , তোর মনে নেই ? তুই ডেকেছিলিস আমাকে এখানে ! একটা অষ্টমীর সন্ধ্যেতে ! জানি , আমার আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে | তিন বছর সময় লেগে গেছে সব কিছু বুঝতে | কিন্তু তার জন্য কি পুরো লাইফ তুই আর ফিরে তাকাবি না ? আরেকবার কনসিডার করবি না ?”
না , শিউলি সত্যি কিছু বুঝতে পারছিলো না শরতের কথা গুলোর মানে | শরৎ এর নিশার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে | তারপর ওকে এইসব কথা বলতে কেন এসেছে এখানে ! কথাটা ভেবেই ও আস্তে গলায় বলে উঠলো , ———- ” তুমি এইসব কেন বলছো হঠাৎ ? আর তোমার তো বিয়ের ঠিকই হয়ে গেছে | তাহলে কেন এসেছো এখানে ?”
শরৎ এর উত্তরে আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে বললো , ———– ” তুই এতো বোকা ! সিরিয়াসলি আমি ভাবতে পারছি না ! এইসব বলার পরও তুই বুঝতে পারলি না ! নিশা আমার জাস্ট একজন কলিগ | হ্যাঁ , তোর সামনে ঐসব বানানো কথা বলেছিলাম এই কদিন ধরে ঠিকই | কিন্তু সেটা তোকে রিয়ালাইজ করানোর জন্য , যে আজও তুই আমার জন্যই ভাবিস | একচুয়ালি তোকে সেই নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমার কথাগুলো, আমার ফিলিংসগুলোর ব্যাপারে ! কিন্তু তুই তো দেখেও কিছু দেখছিলিস না | বুঝেও যেন বুঝছিলিস না | তারপর সেদিন নিশার সাথে আমাকে রেস্টুরেন্টে দেখেও মুখের ওপর বলে দিলি যে তোর কিছু যায় আসে না ! তাই তো এই গল্পটা বানালাম | তোর সামনে নিশার হেল্প নিয়ে একটু এক্টিং করলাম | আর তুই তোর রিয়াকশনটা দেখিয়ে দিলি ! নইলে হয়তো সারা জীবন আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়েই থাকতিস | জোর করে নিজের মনকে এটাই বুঝিয়ে যেতিস যে আমার জন্য তুই আর ফিল করিস না !”
কথাগুলো শুনে শিউলি সত্যি এবার ভেঙে পড়লো শরতের সামনে | ও আরেকবার সেই ভেজা গলায়ই জিজ্ঞেস করলো , —— ” মানে ? তুমি সত্যি নিশাকে বিয়ে করবে না ? সিরিয়াসলি সবটা মিথ্যে ছিল ?”
শরৎ এবার আলতো হেসে শিউলির হাতটা শক্ত করে ধরে দৃঢ় গলায় বললো , ———- ” না | আমি কোনো নিশা , এশা , মমতাজ , সুচিত্রা , কাউকে বিয়ে করবো না ! আমি যদি বিয়ে করি তাহলে একজনকেই করবো | মানে সে যদি পারমিশন দেয় তাহলেই | মেয়েটা আমাদের সামনের ফ্ল্যাটেই থাকে বুঝলি | একটু দিদিমনি দিদিমনি টাইপের | একটু গম্ভীর | কিন্তু আসলে একদম বাচ্চা | আইসক্রিম দেখলেই যে গোলে যায় | বুঝেছিস নিশ্চই মেয়েটা কে !”
না , শিউলি আর কান্নাটাকে ধরে রাখতে পারেনি সেইদিন | কথাটা শুনে আনমনে ভেজা চোখের আড়াল থেকে মিষ্টি একটা হাসি এসে ভিড় করেছিল ওর মুখে | শরতের হাতটাকে আর ছাড়িয়ে নেয়নি ও এরপর | বরং খুব শক্ত করে ধরেছিলো আবার সেই মুহূর্তে | নতুন একটা শুরুর জন্য |
আবর্তন আমাদের সবার জীবনেরই একটা নিয়ম | ঘুরে ফিরে , জেনে বুঝে , খেয়ালে বেখেয়ালে , আমরা হয়তো অনেক সময়ই সেই পুরোনো থমকে থাকা সময়ের কাছে ফিরে যাই , নতুন একটা গল্প লেখার জন্য | আরেকবার ওই ইনকমপ্লিট, খাপছাড়া , না লেখা পুরোনো গল্পটাকে কমপ্লিট করার জন্য | নতুন একটা হ্যাপি এন্ডিংয়ের জন্য |
<সমাপ্ত>