আলগোছে আছো হৃদমাঝারে পর্ব-০১

0
92

#আলগোছে_আছো_হৃদমাঝারে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#সূচনা_পর্ব

“টাকার বিনিময়ে তোমাকে নিজের গর্ভ ভাড়া দিতে হবে, জায়রা।”
হবু বরের মুখ থেকে বিস্ফোরিত বাক্য শুনে থমকে যায় জায়রা। আচম্বিত এহেন শব্দ সহ্য করতে পারল না। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিয়েও দেয়াল আঁকড়ে নিজেকে সামলে নেয়। চোখের কোনে অশ্রুকণা জমাট বাঁধতে শুরু করল। অসহনীয়, করুন চোখে তাকাল রিজভানের দিকে। অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করল,
“কি বললে?”
রিজভান পুনরায় শান্ত বাক্যে বলল,
“তোমার গর্ভে আমার ভাইয়ের বাচ্চা ধারণ করতে হবে, যার বিনিময়ে তোমাকে নগদ ৪০ লাখ টাকা দেওয়া হবে।”
জায়রা কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। মুখ দুইহাতে চেপে ধরল। নিজের শ্রবণ অঙ্গকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভুল শুনল নাকি? কিন্তু দুইবার কি ভুল শোনা যায়? হয়তো যায়! আরেকবার প্রশ্ন করে দেখব? জায়রা পুনরায় থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল,
“আমি টাকার জন্য নিজের গর্ভ ভাড়া দিব?”
রিজভান এবার একটু কঠিন বাক্যেই বলল,
“বার বার এক প্রশ্ন করছো কেন? বললাম তো, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তোমার গর্ভে আমার ভাইয়ের বাচ্চা ধারণ করতে হবে।”
জায়রা এবার চিৎকার করে উঠল। সপাটে থা’প্পড় বসিয়ে দিলো রিজভানের গালে। পর পর দুটো থা’প্পড় দিয়েও ক্ষান্তি হলো না। দুইহাতে খাবলে ধরল রিজভানের কলার। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
“কু*ত্তার বাচ্চা তুই এই কথা উচ্চারণ করলি কিভাবে? এই তোর কি আমাকে রাস্তার মেয়ে মনে হয়? আমার বাবার কি টাকার অভাব পড়েছে যে আমি টাকা রোজগারের জন্য নিজের গর্ভ ভাড়া দিব? তাও আবার তোর ভাইয়ের জন্য? তোকে আমার এক্ষুনি খু*ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে?”
একটু দম নিয়ে পুনরায় বলল,
“এই তুই না আমাকে ভালোবাসতি? তবে কি আমাদের দুই বছরের ভালোবাসার অনুভূতি মিথ্যা ছিল? আমাদের এত এত সুন্দর মুহূর্ত, স্মৃতি সব মিথ্যা ছিল?”
রিজভান বোবার মতো চেয়ে আছে জায়রার দিকে। রাগে, ক্ষোভে জায়রা কাঁপছে। চোখ থেকে অঝরে পানি পড়ছে। আঁখিদুটি অগ্নীশ্বর রুপ ধারণ করেছে। ঠোঁট দুটোও তিরতির করে কাঁপছে। ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে উঠেছে৷ জায়রার এমন রুপ এই প্রথম দেখছে। জায়রা তো সবসময় শান্তশিষ্ট স্বভাবের ছিল। আজ যেই নিজের সম্মানের আঘাত লাগলো তেমনি বাঘিনী রুপ ধারণ করল। রিজভান উত্তর দিতে ভুলে গেল। রাগে শরীর রি রি করে উঠল। তবুও নিজেকে সংযত রাখল। শান্ত বাক্যে জায়রার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে উঠল,
“শান্ত হও, জায়রা। তুমি আমার হবু বউ। আমার ভালোবাসার মানুষ। তোমাকে এই কথাটা কেন বলেছি সেই কারণ জানতে চেয়েছো?”
জায়রা রক্তিম চোখে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল,
“কি কারণ শুনি? বলো?”
রিজভান জায়রার কাঁধে হাত রাখতেই জায়রা হাত ছিটকে সরিয়ে দিল। রিজভান এবার কিছুটা অসহায় বাক্যে বলা শুরু করল,
“আজ ভাবি সুই-সাইড করার চেষ্টা করছিল।”
জায়রা কিছুটা অবাক চোখে তাকালো রিজভানের দিকে। প্রশ্ন করল,
“কেন?”
রিজভান সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“একটা বাচ্চার জন্য আমার পরিবারে কি পরিমান অশান্তি তুমি জানো না, জায়রা৷ আমার ভাইয়ের সংসার নষ্ট হওয়ার পথে। ভাবি প্রতিনিয়ত ডিপ্রেশনে ভুগছে। ভাইয়া, ভাবির দুঃখে আমার বাবা মাও দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ শুধুমাত্র একটা বাচ্চার জন্য আমাদের পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, জায়রা।”
কথাগুলো বলে রিজভান কান্না করে দিল। জায়রা কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু তবুও রিজভানের প্রস্তাবটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কোনো মেয়ের পক্ষে কি মেনে নেওয়া সম্ভব? জায়রা কাঠকাঠ স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কিন্তু তুমি আমাকে কেন এই প্রস্তাব দিলে?”
রিজভান সাথে সাথে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“অন্য কোনো মেয়ে এমন প্রস্তাব মেনে নিতো বলে তোমার মনে হয়?”
“তাহলে তুমি কি করে ভাবলে, আমি মেনে নিব?”
জায়রার পাল্টা প্রশ্নে রিজভান কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। তবুও পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠল,
“কারণ তুমি আমার বউ হতে যাচ্ছো। আমি কি আমার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য কিছু করতে পারিনা?”
“তাই বলে নিজের বউয়ের গর্ভে ভাইয়ের বাচ্চা ধারণ করতে বলবে, রিজভান?”
জায়রার সাথে সাথে পাল্টা প্রশ্নে রিজভান কিছুটা নড়চড়ে দাঁড়ালো। মনে মনে একবার নিজেই বলে উঠল,
“তুমি আমার তুরুপের তাস জান। তোমাকে কাজে লাগিয়ে টাকা গুলো হাতিয়ে নেওয়াই এখন আমার কাজ।”
রিজভানকে চুপ থাকতে দেখে জায়রা পুনরায় উচ্চ বাক্যে রিজভানকে প্রশ্নবিদ্ধ করল,
“চুপ করে থেকে আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিও না। কী চাও তুমি? তুমি কি আমাকে আদৌও ভালোবাসো?”
রিজভান সাথে সাথে কান্না মাখা মুখশ্রী নিয়ে করুন স্বরে বলল,
“দেখো জায়রা, তুমি আমার শখের নারী। আমার ভালোবাসার নারী। তোমার কি মনে হয় তোমাকে এই প্রস্তাবটা আমি শখে দিয়েছি? আমার ব্যক্তিগত নারী, আমার বউয়ের গর্ভে অন্যের সন্তান জন্মাবে এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য খুব সহজ? আমারোও কষ্ট হচ্ছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু কি করব বলো? তুমি ছাড়া আমার তো আবদার করার কোনো জায়গা নেই। এখন তুমিও যদি আমাকে ফিরিয় দাও আমি কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো?”
জায়রার কেন যেন এই প্রথম রিজভানের উপর বিরক্ত লাগছে। রাগ হচ্ছে প্রচন্ড। এই প্রথম রিজভানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। ওর চোখের পানিকে মিথ্যা মনে হচ্ছে। জায়রা রিজভানের কথায় গলে না গিয়ে স্পষ্ট বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে আমাকে কেন বললে টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দিতে হবে?”
রিজভান কথাটার জবাব আগেই তৈরি করে রেখেছিল। তাই সাথে সাথে উত্তর দিল,
“তোমার আর আমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে, জায়রা। আমার ভাইয়ের যদি ছেলে হয় তাহলে তো আমার বাবার সমস্ত সম্পত্তির সিংহভাগ সেই পাবে? তাহলে পরিবর্তিতে আমাদের সন্তানের ভবিষ্যত কি হবে? আমাদের কি নিজেদের সন্তানের কথা ভাবা উচিত না?”
জায়রা হাত দিয়ে রিজভানকে থামিয়ে দিল। চোখে চোখ রেখে কঠিন বাক্যে বলল,
“দুঃখিত, মিস্টার রিজভান সিকদার। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি আপনার সাথে সব প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। যে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সম্মান করতে জানে, তাকে অন্তত আমি স্বামী হিসেবে চাই না। স্বামী হতে হলে শুদ্ধতম পুরুষ হতে হবে। যার কাছে দুনিয়ার সবার আগে নিজের স্ত্রীর সম্মান, অধিকার থাকবে। আপনাকে আমি চিনতে ভুল করেছি তাই আজ সেই ভুল শুধরে নিলাম। আপনি ভালো প্রমিক অবশ্যই কিন্তু স্বামী হওয়ার যোগ্য নন। আসি।”
বলেই জায়রা আর সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়ালো। বড় বড় পা ফেলে রিজভানদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। চোখের কোনের জলটুকু গড়িয়ে পড়তে দিল না। জায়রা সবসময় বিশ্বাস করে ‘অশ্রু মানুষকে দূর্বল করে দেয়। হাসি মানুষকে শক্ত বানিয়ে তুলে’৷ রিজভান চেয়েও জায়রাকে আটকাতে পারেনি। জায়রা চলে যেতেই রিজভান রাগে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে ঘু’ষি মা*রল। চিৎকার করে বলে উঠল,
“তোমাকে আমি ছেড়ে দিব না, জায়রা। আমার সমস্ত প্লান তো আমি এভাবে ভেঙে যেতে দিব না৷ তোমার জীবন যদি আমি নড়ক না বানিয়েছি তাহলে আমার নামও রিজভান সিকদার নয়।”


“স্যার, মেয়েটার বিষয় সমস্ত খবর পেয়ে গেছি। মেয়েটার নাম রিয়ানা আফরিন জায়রা। বয়স ২১। ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী৷ বাবার নাম মেজর জেনারেল আমির হোসেন।”
বলেই থামল নিলয়। নিলয়ের শেষ নামটা ভয়ে কাঁপা-কাঁপি শুরু হলেও সামনে থাকা ব্যক্তিটার মধ্যে কোনো ভয় নেই। সংকোচ নেই। এমন কেন এই মানুষটা? নিলয় থামতেই উপস্থিত ব্যক্তিটি থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল,
“আর কিছু?”
নিলয় কাঁপা-কাঁপি স্বরে জবাব দিল,
“স্যার, মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
কথাটা শেষ হতেই ব্যক্তিটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। নিলয় ভয়ে এক পা পিছিয়ে যেতেই, নিলয়কে শান্ত করতে ব্যক্তিটি শান্ত বাক্যে বলল,
“ভয় পাচ্ছো কেন? জীবনে সুস্থ ভাবে বাঁচতে হলে ভয় পাওয়া চলবে না। ভয় পেলে তো হেরে গেলে। ভয়কে জয় করতে হবে। তুমি ভুলে যেও না, তুমি একটি দেশের সৈনিক। দেশ প্রেম করতে হলে সবার আগে নিজের ও পরিবারের জীবনের মায়া ত্যাগ করতে হবে। নয়তো এই পেশা তোমার জন্য না।”
বলেই এক পা সামনে এগিয়ে থেমে গেল। রহস্যময় স্বরে বলল,
“জায়রা শুধু ক্যাপ্টেন জাইহান চৌধুরীর। জাইহান ব্যাতিত দ্বিতীয় পুরুষের জন্য সে কোনোদিন বউ সাজবে না।”

চলবে।

[ভুলগুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।]