আলগোছে আছো হৃদমাঝারে পর্ব-০৫

0
70

#আলগোছে_আছো_হৃদমাঝারে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পাঁচ

“আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন কোন সাহসে, মিস্টার জাইহান?”
জাইহান থতমত খেয়ে গেল। জায়রার যে জ্ঞান ফিরেছিল সেটা বুঝতে পারে নি৷ জায়রা বালিশ থেকে পড়ে গিয়েছিল তাই যত্ন করে বুকে আগলে ঠিক করে শুইয়ে দিয়েছিল। তৎক্ষনাৎ জায়রা চোখ খুলে উপরোক্ত প্রশ্নটি করে। জাইহান লজ্জা পেল খানিকটা। জায়রা কেমন পুলিশের চোখে তাকিয়ে আছে। যেন মনে হচ্ছে জাইহান কোনো কিছু চুরি করেছে, জায়রা পুলিশ হয়ে প্রশ্নোত্তর চোখে তাকিয়ে আছে। কী আশ্চর্য! জাইহান মনে মনে একবার বলে উঠল,
“কী আশ্চর্য! আমি কি চোর নাকি? এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে?”
তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্ক উত্তর দিল,
“মিস্টার জাইহান, আপনি পুরো দুনিয়ার চোখে পুলিশ হলেও, ভালোবাসার মানুষটার কাছে চোর। মিস জায়রার, মন চুরি করার অপরাধে আপনার যাবজ্জীবন জেল হতে পারে।”
“এখন চোরের মতো চুপ করে আছেন কেন?”
এটা আবার কে বলল? জাইহান হকচকিয়ে তাকাল। জায়রা বলেছে! মানে কী? একদম সোজা চোর বানিয়ে দিল? নাহ! এই অপমান সহ্য করা যাচ্ছে না। কিন্তু কি আর করার? এখন যেহেতু অন্যায় করেছে, সেহেতু বড় গলা করা যাবে না। তাহলে প্রেমের আগেই প্রেমিকা মে”রে তক্তা বানিয়ে দিবে। তখন কী জাইহানের সম্মান থাকবে? আকাশ কুসম ভেবে অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে উত্তর দিল,
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, মিসেস জায়রা। আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরিনি।”
জায়রা রেগে তাকাল। কটমট দৃষ্টিতে জাইহানের চোখে চোখ রেখে বলল,
“আপনার কি আমাকে অন্ধ মনে হয়, মিস্টার জাইহান?”
জাইহান এবার কেন যেন একটু সাহস পেল। মনে জোর বাড়ল। শান্ত বাক্যে বলে উঠল,
“একদম না, মিসেস জায়রা।”
জায়রা থমকাল। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ওয়েট! মিসেস জায়রা মানে? আমাকে দেখে কি বিবাহিত মনে হয়?”
জাইহান কিছু না জানার ভান করে বলল,
“কাল সন্ধ্যায় রাস্তায় আপনার স্বামী আমাকে থ্রেট করেছিল। যদি আপনি বিবাহিত না হন তাহলে সে আমাকে থ্রেট করল কিভাবে? ওহ হ্যাঁ, আজ সকালে আবার দেখতেও এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করছিল দেখলাম। খুব ভালোবাসে বোধহয়।”
জায়রা আঁতকে উঠল। রাগে শরীর রি রি করতে শুরু করল। গর্জে উঠে বলল,
“আমি অবিবাহিত, মিস্টার জাইহান। কান খুলে শুনে রাখেন, আমার কোনো স্বামী নেই। আমার কেউ নেই। আমি ঘৃণা করি ওই লোকটাকে৷ প্রচন্ড ঘৃণা করি। ঘৃণা ক…।”
আর বলতে পারল না। হাঁপাতে শুরু করল। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়া শুরু করল। জায়রা মাথা এক হাতে চেপে ধরল। অন্য হাতে জাইহানের বাহু খাবলে ধরল। মাথা ঘুরানো শুরু হয়ে গেল। জায়রার অবস্থা দেখে জাইহান ভয় পেয়ে গেল। জায়রাকে আঁকড়ে ধরতে গিয়েও থেমে গেল। চিন্তিত বাক্যে বলতে লাগল,
“মিস, জায়রা! কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আমাকে বলুন। ডাক্তার ডাকব? জায়রা! এই জায়রা!”
জায়রার মনে হচ্ছে ‘ও’ এক্ষুনি জ্ঞান হারাবে। তবুও জাইহানের দিকে নিভু নিভু চোখে তাকাল। মানুষটার চোখে, মুখে ভয়৷ হাসিখুশি মুখটা শুকিয়ে গেছে মুহূর্তেই৷ শেষ বারের দুটো ডাক জায়রার বুকে তীরের মতো বিঁধল। কী মায়া! কই আগে তো কেউ এত মায়া নিয়ে ডাকেনি? এই মানুষটা কেন এত মায়াবী স্বরে ডাকল? কেন? মানুষটা কি জায়রাকে আগের থেকে চিনত? একদিনের পরিচয়ে কেউ এত মায়া করে ডাকতে পারে? জায়রা কিছু বলতে গিয়েও পারল না। ঢুলে পড়ল জাইহানের বুকে। জ্ঞান হারানোর আগে বুঝতে পারল জাইহান খুব যত্নে নিজের বুকে জায়রাকে আগলে নিচ্ছে৷ জায়রা জ্ঞান হারাতেই জাইহানের বুকটা ধক করে উঠল। জাইহান এবার চেঁচিয়ে ডাকল,
“জায়রা! এই জায়রা! চোখ খুলুন। শুনতে পারছেন? চোখ খুলুন না জায়রা। ভয় হচ্ছে আমার। খুব ভয় হচ্ছে। আপনাকে হারানোর ভয় পাচ্ছি আমি। জায়রা, শুনছেন?”
নাহ! আর ডাকতে পারল না। জাইহানের গলার স্বর রোধ পাচ্ছে। হাত কাঁপছে। বুক কাঁপছে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। ভয়ানক যন্ত্রণা! ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট পেতে দেখার যন্ত্রণা। জাইহান চেঁচিয়ে ওর মাকে ডাকতে লাগল। নার্সদের ডাকতে লাগল। জাইহানের কণ্ঠস্বর শুনে মনিকা বেগম দৌড়ে আসলেন। তিনি পাশের কেবিনে রুগী দেখছিলেন। হঠাৎ ছেলের এমন চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে, বাবা?”
চোখ গেল জায়রার দিকে। জায়রাকে জাইহানের বুকে দেখে অবাক পানে বললেন,
“জায়রার কি হয়েছে? এভাবে ধরে রেখেছো কেন?”
জাইহান অসহায় চোখে তাকাল। চোখের ভাষায় বুঝানোর চেষ্টা করল কিছু। মনিকা বেগম এখনো প্রশ্নোত্তর চোখে তাকিয়ে আছেন। জাইহান এবার অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
“জায়রা, আবার জ্ঞান হারিয়েছে, মা।”
মনিকা বেগম নার্স ডাকলেন। কিছু ব্যবহৃত জিনিসপত্র আনার জন্য হুকুম করলেন। জাইহানের উদ্দেশ্যে বললেন,
“জায়রাকে সাবধানে শুইয়ে দাও, জাইহান।”
জাইহান জায়রাকে শুইয়ে দিতেই মনিকা বেগম পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“কি হয়েছিল? আমি তো কিছুক্ষণ আগে চেকাপ করে গেলাম। জ্ঞান ফিরেছিল মেয়েটার। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। তাহলে আবার জ্ঞান হারাল কেন?”
জাইহান চুপ করে রইল। কী উত্তর দিবে? জায়রার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হতে লাগল। কী দরকার ছিল জায়রাকে মিথ্যা বলার? কী দরকার ছিল ওইসব কথা বলার? কিন্তু যে মেয়ে ওই ছেলেটাকে এত ভালোবাসে, সে হঠাৎ ভালোবাসার মানুষটার নাম শুনে এভাবে রেগে যাবে কেন? এত হাইপার কেন হবে? কি কারণ? জানতেই হবে।



“আজকের মধ্যে দশজন মেয়ে লাগবে আমার। কিভাবে ম্যানেজ করবে তুমি জানো। রাত ১০টায় বোট ছাড়বে। এর মধ্যে দশ জন মেয়ে এনে আমার চোখের সামনে হাজির করবে। বুঝতে পেরেছ?”
সামনের ব্যক্তিটির কথা শুনে রিজভান ক্রোধে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। রাগান্বিত স্বরে বলল,
“এক দিনের মধ্যে দশজন মেয়ে ম্যানেজ করা কি পসিবল?”
ব্যক্তিটি হাসলেন। বেশ জোরালো স্বরে বলে উঠলেন,
“অবশ্যই, পসিবল।”
রিজভান পাল্টা প্রশ্ন করে বসল,
“কিভাবে?”
ব্যক্তিটি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
“গ্রামের দিকে যাও। ঢাকার আশেপাশে অনেক গুলো গ্রাম আছে।”
“তো…?”
“আহা! সব কি তোমাকে বলে দিতে হবে।”
“জ্বি, বলে দিতে হবে। কারণ, আপনার এমন অসময়ের আবদার আমার পূরণ করা সম্ভব নয়।”
ব্যক্তিটি হাসলেন। শান্ত বাক্যে বললেন,
“গ্রামের মেয়েরা বেশিরভাগ সহজ, শরল হয়। আ…।”
লোকটির কথা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই রিজভান বাদ সাধল। বলল,
“আপনি তো আদিম যুগের তাই ভেবেছেন এখনকার গ্রামের মেয়েরাও আদিম যুগে আছে। আজকাল গ্রামের মেয়েরা শহরের মেয়েদের থেকেও স্মার্ট।”
ব্যক্তিটি হাসলেন। নিজের প্লানটা সাজিয়ে বলল রিজভানকে…



আমেনা বেগম রান্না করছিল। এর মধ্যেই সালমান এসে হাঁক ছেড়ে বলল,
“চাচি। ও চাচি, কই তুমি? বাড়িত আছোনি? এইদিকে আহো। জরুরি কতা আছে তোমার লগে।”
আমেনা বেগম সালমানের স্বর শুনে দৌড়ে আসলেন রান্নাঘর থেকে। মুখে হাসি টেনে বলে উঠলেন,
“আল্লাহ গো! কেডায় আইছে? আমার বাজান দেহি। কত্তদিন পর বাজান তুই আইলি?”
সালমান এগিয়ে এসে আমেনা বেগমকে সালাম দিয়ে হাসি মুখে বলে উঠল,
“চাচি, তোমার লেইগা একটা খুশির খবর লইয়া আইছি।”
আমেনা বেগম অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলেন,
“কি খবর, বাজান?”
সালমান আগে সাবধানতার স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“লিলি কই? বাড়ি আছেনি?”
“না ওয় ইস্কুলে।”
সালমানের মুখে হাসি ফুটল৷ উত্তেজিত বাক্যে বলতে শুরু করল,
“চাচি, তোমার এখন থাইকা আর কোনো দুঃখ থাকবো না। তোমার লিলির লেইগা আমি একটা কাজ জোগাড় কইরা আনছি।”
আমেনা বেগমের মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। বেজার মুখে বললেন,
“আমার ওই ছোট্ট মাইয়াডা কি কাম করব, বাজান?”
সালমান আগের ন্যায় দুঃখী, দুঃখী বাক্যে বলল,
“চাচি, চাচার তো বড় অসুখ। এই অসুখের চিকিৎসা করানোর লেইগা ম্যালা টাকার দরকার। তুমি একলা একলা কত দিকে করবা। তোমারোও তো বয়স হইছে। ওহন যদি টাকার অভাবে চাচায় মইরা যায় হেইডা কি ভালো হইব?”
আমেনা বেগমের মুখটা আরো চুপসে গেল। তার চোখের কোনে পানি জমেছে। জিজ্ঞেস করলেন,
“কি কাম জোগাড় করছো, বাজান?”
সালমান উৎসুক স্বরে বলে উঠল,
“ভালা কাম, ইস্কুলে পড়াইব। ছোড ছোড বাচ্চাগো ম্যাডাম হইব।”
আমেনা বেগমের মুখে হাসি ফুটল। খুশিতে চোখ মুখ চকচক করে উঠল। জিজ্ঞেস করলেন,
”সত্য কইতাছো?”
“হ চাচি। তোমারে আমি সব বুঝাইয়া কইমুনে। আগে লিলিরে তুমি রাজি করাও। তাইলে আজকা রাইতেই আমি লিলিরে নিতে আইমু।”
আমেনা বেগমের মুখটা আবার চুপসে গেল। আজকে রাতেই? মনটা মানছে না। কেমন যেন লাগছে। কোনো বিপদ হবে না তো?

#চলবে