আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৩৭

0
1552

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৩৭]

রাতের ঘড়ির কাটা সাড়ে নয় টার ঘরে। এই অল্প সময়েও চারপাশ একদম নিরব নিস্তর। রাত্রীর ঘন কালো ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারপাশ আচ্ছন্ন। বাড়ির পাশের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের অমৃসণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কানে। বিছানার হেড সাইডে হেলান দিয়ে বসে আছে রিমি, নুরা ও দীবা। সামনে ল্যাপটপে “Choose or die” সাসপেন্স থ্রিলার মুভি চলছে। তিনজনই পাশাপাশি বসে অধিক আগ্রহ নিয়ে দেখছে। একের পর এক টুইস্ট দেখে নুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাইমা এক্সাইটেড নেক্সট কি হবে ভেবে। আর এতো এতো টুইস্ট দীবার মাথায় তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। তবুও আগ্রহ প্রবল তার। তখুনি দরজায় ধাক্কা পরার শব্দ কানে আসলো তিনজনের। রিমি দীবাকে চোখের ইশারা দিলো দরজা খোলার জন্য। দীবা কিছু দেখেনি কিছু শুনেনি একটা ভাব নিয়ে বিছানার পাশে থাকা ছোট কেবিনেটের উপর থেকে বোতল হাতে নিলো পানি খাওয়ার জন্য। তার ভাবলেশহীন ভাব দেখে বিরক্ত হলো রিমি। নুরার দিকে তাকাতেই দেখলো নুরা মোবাইল নিয়ে মহা ব্যস্ত। অবশেষে দুইজনের উপর চরম বিরক্ত হয়ে কোল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে বিছানায় রাখলো। গটগট পায়ের কদম ফেলে দরজার কাছে যেতে যেতে প্রশ্ন করলো, ‘কে রে ভাই? এতো রাতে এখানে কি?’

বাহির থেকে আবরারের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘আমি।’

চিনতে পারার পরেও দীবা না চেনার ভান করে গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে উঠলো, ‘আমি টা কে? নাম টাম নাই নাকি?’

দীবার কন্ঠ শুনে আলতোভাবে হাসলো আবরার। বাঁকা হেসে প্রত্যুত্তর করলো, ‘দীবার জামাই আবরার জুহায়ের।’

মাত্রই বোতল থেকে পানি খাওয়ার জন্য মুখে ঢেলেছিল দীবা। আবরারের প্রত্যুত্তর শুনে বিষম খেলো দীবা। খুকখুক করে কেশে উঠলো। রিমি ও নুরা ঠোঁট চেপে হাসলো। রিমি দরজা খুলে দেবার পর আবরার ভিতরে এসে দেখলো দীবার চোখমুখ লাল করে হয়ে আছে। হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে অস্থির হলো আবরার। দ্রুত দীবার কাছে এগিয়ে এসে ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠলো, ‘কি হয়েছে তোমার? চোখমুখ এমন লাল হলো কিভাবে?’

বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করলো দীবা। তবুও অতিরিক্ত কাশির জন্য হাঁপিয়ে উঠেছে সে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে অপ্রসন্ন চোখে আবরারের দিকে তাকালো দীবা। কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘অসভ্য লোক।’

আবরার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো, ‘অসভ্যের মতো আবার কি করলাম?’

দৃষ্টি সরিয়ে অন্যত্র তাকালো দীবা। পানির বোতলটা কেবিনেটের উপরে রেখে দিলো। বাহিরের আকাশে কালো মেঘের ছায়া স্পষ্ট। রাত্রী হওয়ায় পরিবেশ শীতল। হালকা শীত শীত আমেজ চারপাশে। শুয়ে পরার জন্য বিছানায় হেলান দিতেই তার হাত টেনে ধরলো আবরার। বাধা দিয়ে বলে উঠলো, ‘এখানে না উঠো!’

বিস্মিত হলো দীবা, ‘এখানে না মানে? ঘুমাবো কোথায় আমি? আশ্চর্য!’

আবরার দীবার হাত ধরে রুমের বাহিরে যেতে যেতে প্রত্যুত্তর করলো, ‘আমার রুমে ঘুমাবে।’

হতবাক হয়ে গেলো দীবা। বলে কি এই অ’সভ্য লোক? ঘুরতে এসেও এক সাথে? আবরারের রুমে যাবার ইচ্ছে নেই তার। তাই নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত মুচড়াতে লাগলো দীবা। আবরার আরো শক্ত করে ধরলো তার হাত। পুরো রাতের পরিকল্পনা ভেস্তে দিলো আবরার। রিমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আবরারের দিকে। দীবাকে নিয়ে যেতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো নুরা, ‘আরব ভাই দীবা থাক না এখানে। ওকে নিতে হবে কেন?’

আবরার ভাবলেশহীন ভাবে শুধালো, ‘কারণ বউ ছাড়া আমার ঘুম আসে না।’

দুইজনের উষ্ঠধয়ে কিঞ্চিৎ দূরত্ব তৈরি হলো আপনাআপনি। ফ্যালফ্যাল চোখে আবরারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর দুইজনে একইসঙ্গে শব্দ করে হেসে উঠলো।
_____________________

আবরারের রুমের সামনে যাবার পর দীবা তার হাত ঝামটা মে:রে ছাড়িয়ে নিলো। আবরারের দিকে রাগী রাগী লুক দিয়ে কটমট করে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি আপনার?’
স্মিতি হাসলো আবরার। শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে জবাব দিলো, ‘তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না। এটাই তো একমাত্র সমস্যা। সমাধান দিবে?’

শেষের কথাটা দীবার দিকে ঝুকে এসে বললো আবরার। দীবা চোখ তীক্ষ্ণ করে তাকিয়ে আবরারের বুকে মৃদু ধা:ক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর গটগট পায়ের কদম ফেলে আবরারের রুমে চলে গেলো। দীবার রাগী চেহারা দেখে হেসে উঠলো আবরার। এক হাতে এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। রুমের পাশে থাকা বড় জানালার কাছে থাকা বেতের মোড়ার উপর বসলো দীবা। রাগের কারণে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। চুপচাপ নাক ফুলিয়ে ফুঁশছে সে। আবরার তার এই অবস্থা দেখে ঠোঁট গোল করে শিশ বাজাতে বাজাতে বিছানায় বসলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে আপন মনে ফেসবুক স্ক্রোল করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আবরারের সাড়াশব্দ না পেয়ে অধৈর্য হয়ে উঠলো দীবা। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোমড়ে দুই হাত রেখে ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে মোবাইল টিপছেন আপনি? আমি কি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো?’

মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে দীবার দিকে তাকালো আবরার। মোবাইলটা বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালো। গায়ের শার্টটের কলার ঠিক করতে করতে বললো, ‘তাহলে আসো টাইম ওয়েস্ট না করে বাসর টা সেরে ফেলি।’

চোখ দুটো ছানাবড়া করে তাকালো দীবা। হকচকিয়ে যাওয়া কন্ঠে শুধাল, ‘আপনার মুখে এই শব্দটা ছাড়া আর কিছুই নেই।’

অল্প শব্দে হাসলো আবরার। দীবা চোখমুখ কালো করে অন্যদিকে তাকালো। আবরার এগিয়ে এসে দীবাকে পিছন দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ লুকালো। মৃদু কন্ঠে বললো, ‘আগে কেন আমার জীবনে আসো নি তুমি?’

আলতোভাবে লাজুক হাসলো দীবা।আবেশে চোখ বন্ধ করে বললো, ‘আগে আসলে কি হতো?’

দীবাকে নিজের দিকে ঘুরালো আবরার। মুখের সামনে পরে থাকা চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে আদুরে গলায় বললো, ‘আরো বেশি ভালোবাসতে পারতাম।’
_____________________

রাত যতো গভীর হলো চারপাশে পিনপতন নিরবতা বাড়তে লাগলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গা ছমছম করার মতো ভয়ংকর অনুভূতি হয়। জানালা দিয়ে সু-সু শব্দ তুলে শীতল বাতাস ভেসে আসছে। শরিরের পশম কাটা দিয়ে উঠলো নুরার। কাঁপুনি দিয়ে উঠলো শরির। পরনে শুধুমাত্র সাদা টপ শার্ট। তাই শীতল বাতাসের ঠান্ডা অনুভব হতেই শীত লাগলো তার। তবুও টেবিল চেয়ার থেকে উঠলো না নুরা। চিরকুট টা লিখা শেষ হয়নি। তাই এক বসাতেই লিখে শেষ করে কলমটা পাশে রাখলো। হলুদ রঙের চিরকুট টা হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ লিখাটা নতুন করে পড়লো। নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই হলুদ রঙের চিরকুট টা দেখে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। তখুনি আকাশে বৃহৎ শব্দ তুলে মেঘগর্জন দিয়ে উঠলো। ইষৎ কেঁপে উঠলো নুরা। তুফানের মতো বাতাস তুমুল বেগে ছুটছে। জানালা খোলা থাকায় শীতল বাতাস রুমে প্রবেশ করছে। নুরা জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে বিছানায় তাকালো। দেখলো রিমি গুটিসুটি হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। চিরকুট টা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো নুরা। জানালা কাছে এসে পর্দা টেনে ধরলো। ভুলবশত হাত থেকে ছোট চিরকুট টা বাতাসে উড়ে বাড়ির নিচে পরে গেছে । হতবাক হয়ে গেলো নুরা। জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখলো চিরকুট টা ঘাসের উপর পরে আছে। বাতাসের বেগ অতিরিক্ত। যেকোনো মুহূর্তে কাগজ টা উড়িয়ে নিতে পারে। কিন্তু নুরা এটা হারাতে চায় না। তাই বিলম্ব না করে দ্রুত পা চালিয়ে দৌড়ে বাড়ির নিচে আসলো। চারপাশ নিঝুম অন্ধকার। বাড়ির ভিতরের আলোতে বাড়ির সামনের আঙ্গিনা আলোকিত। আঙ্গিনায় মাটির ছোঁয়া নেই। কারণ পুরো খালি জায়গা জুড়ে রয়েছে কেবল ঘাস। আবছায়া অন্ধকারে চিরকুট টা খুঁজবে কিভাবে? আসার আগে লাইট টাও আনতে ভুলে গেছে। বাতাসে উড়ে কোথায় পরেছে কে জানে। চিন্তিত হলো নুরা। ঠোঁট কামড়ে খুঁজতে লাগলো আশেপাশে।

বাতাসের শব্দ, অন্ধকার পরিবেশ। ভয়ে নুরার বুক ধড়ফড় করছে। তবুও চিরকুট ফেলে রেখে মন চাইছে না তার। ভয়ার্ত চোখেমুখে চিরকুট খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। হঠাৎ-ই থমকে গেলো নুরা। নিজের পিছনে কারোর অস্তিত্ব টের পেয়ে অসাড় হয়ে এলো তার শরির। নিশ্বাস ভারি হয়ে গেলো তার। ধীরে ধীরে পিছু ফিরে তাকাতেই ভড়কে গেলো। রাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকে এক হাত রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো নুরা।

রাজ তীক্ষ্ণ চোখে নুরার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর গম্ভীর মুখখানি কাটকাট কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলো, ‘এতো রাতে এখানে কি করছো?’

রাজের গম্ভীর চেহারা ও কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ার্ত হলো নুরা। কোনো মতে ঠোঁট নাড়িয়ে মিনমিনে গলায় উত্তর দিলো, ‘এমনি এসেছি।’

উত্তর টা নিজের পছন্দ মোতাবেক না হওয়ায় সন্তুষ্ট হলো না রাজ। তাই আরো গম্ভীর হলো মুখ। রাগটাও বাড়লো বেশ। তবুও নিজেকে শান্ত রাখলো। রাগ যথেষ্ট সংযত রেখে বললো, ‘রুমে যাও।’

নুরা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা একপাশ কাত করে সম্মতি দিলো। পিছু ফিরে আবারো চারপাশে একবার চোখ বুলালো। চিরকুট টা না পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো। ক্ষুন্ন মনে চুপচাপ বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। নুরা চলে যাবার পর রাজ নিজেও চলে যেতে পা বাড়াতেই দাঁড়িয়ে পরলো। দেয়ালের একদম চিপায় একটা হলুদ রঙের কাগজ দেখে সেটা হাতে নিলো। চিরকুট টা পড়ে ভ্রুঁ জোড়া কুচকালো তাৎক্ষনাৎ। হাতের লিখাটা দেখে অনায়াসে বুঝে গেলো এটা নুরার হাতের লিখা। এটাই নুরা খুঁজছিলো এতোক্ষণ? কিন্তু লিখাটা? আবারো পড়লো চিরকুট টা। বিস্মিত হলো বেশ। নুরা কাউকে ভালোবাসে? অপ্রকাশিত ভালোবাসা? তারই মতো। স্মিতি হাসলো কেবল।

Dear Astrology,

You are as beautiful as the night sky. Sight is as perfect as the stars. I will always watch you from afar. You will never know how much I love you. If the time comes, I will reveal my hidden love. But I’m afraid. Will you really accept my love? Or neglect? I don’t know if I’ll get you. But I want you. I really want you from my heart.

The end
Someone.

চলমান…