আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৪০

0
1384

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৪০] প্রথমাংশ

দুইতলার বিশাল লম্বা বারান্দা দিয়ে হাঁটছে দীবা। উদ্দেশ্যে আবরারের রুমে যাওয়া। তবে দীবা মোটেও ভয়ার্ত কিংবা চিন্তিত না। বরঞ্চ ফুরফুরে মনে হেলেদুলে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আবরারের রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

তোমার ইচ্ছে গুলো, ইচ্ছে গুলো
তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো।

তুমি হাতটা শুধু ধরো,
আমি হবো না আর কারো।
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়।

হঠাৎ-ই কেউ একজন দীবার হাত টেনে অন্ধকার একটা রুমে নিয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় ভড়কে গেলো দীবা। প্রকাণ্ড রকমের ভয়ের কারণে চিৎকার করে উঠতে নিলেই জানালার ঝাপসা আলোতে আবরারের মুখশ্রী দেখে ভয়ার্ত মন শান্ত হলো কিছুটা। জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। চোখ তুলে আবরারের দিকে তাকাতেই দেখলো আবরার নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আবরার দীবার দিকে একটু এগিয়ে নিবিড় হলো। দুজনের দূরত্ব ঘুচিয়ে দীবার ঘাড়ে মুখ ডুবালো। ঘাড়ে গভীর একটা চুমু দিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,

‘আমার অনেক ইচ্ছে রয়েছে দীবা। আমার ইচ্ছে তোমাকে কাছে পাবার। তোমার পাশে বসে সূর্যাস্ত দেখার। তোমার হাত ধরে সারাজীবন পথ পাড়ি দেবার। সমুদ্রজলে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটার। আমার আরো অনেক ইচ্ছে আছে দীবা। সব ইচ্ছে আমি তোমাকে দিলাম। এবার পূরণ করার দায়িত্ব তোমার।’

আবেশে চোখ বন্ধ করেছিলো দীবা। আবরারের শার্ট খামচে ধরে আলতোভাবে শুধাল, ‘নিলাম দায়িত্ব। কিন্তু গাড়ি ভাড়াটা আপনার।’

দীবার উন্মুক্ত ফরশা ঘাড়ে ঠোঁট বুলাচ্ছিলো আবরার। এমন প্রত্যুত্তর শুনে মৃদু শব্দ করে হেসে ফেললো। মাথা উঠিয়ে দীবার চোখের দিকে তাকাতেই দীবাও চোখ খোলে আবরারের দিকে তাকালো। দুইজন দুজনের চোখের মায়ায় অনন্ত কালের জন্য আটকে পরলো। অদ্ভুত মায়া, আসক্তি কাজ করলো দুজনের মনে। আবরার দীবার চোখের দিকে তাকিয়ে নেশাক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘আই লাভ ইউ দীবা!’

দীবা চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিরক্তিকর নিশ্বাস ফেললো। তারপর চোখমুখ শক্ত করে আবরারের বুকে ধা:ক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। হঠাৎ এমন করায় হতভম্ব হয়ে গেলো আবরার। বিস্ময়কর চোখে দীবার দিকে তাকাতেই দীবা রেগে বলে উঠলো, ‘এতো কিপটা কেন আপনি?’

এবার যেন হতবুদ্ধি হলো আবরার। ফ্যালফ্যাল করে চোখে তাকিয়ে অমৃসণ কন্ঠে বললো, ‘কিপটামির কি করলাম?’

‘ক্যান্ডেল, ফুল, বেলুন, চকলেট আরো কতো কিছু দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে কত রোমান্টিক ভাবে মানুষ প্রপোজ করে। আর আপনি? একটা ফুল তো দূর ভাঙ্গা একটা ঘরে অন্ধকারে প্রপোজ করলেন। এটা কিপটামি না?’

হতভম্ব আবরার কোনো রকমে বললো, ‘এটা ভাঙ্গা ঘর না। আমার রুমটা।’

দীবা দ্বিগুণ রাগে ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘একই তো কথা। বিয়েতেও কোনো অকেশন হলো না। প্রপোজালও সুন্দর ভাবে সারপ্রাইজ দিলেন না। এতো বড় নামকরা নায়ক হয়েও কতো বড় কিপটা।’

‘তুমি তো আমার বউ-ই।’

‘বউ তো কি হয়েছে? তাই বলে একটু সারপ্রাইজ ডিজার্ভ করি না? কিপটার দল।’

রাগে, দুঃখে, মহাকষ্টে কথা গুলো বলে হনহনিয়ে রুমের বাহিরে চলে আসলো দীবা। মনে মনে ভাবলো তার কপাল টাই খারাপ। অত্যন্ত দুঃখময় চেহারায় ঠোঁট উলটে বারান্দা দিয়ে হেঁটে নিচে যাবার জন্য পা বাড়াতে লাগলো। তখুনি আকাশে মেঘেদের ডাক কানে আসলো তার। বিস্মিত হয়ে চটজলদি বারান্দার রেলিং ধরে আকাশের বুকে উঁকি দিলো। ঘন কালো মেঘদের আনাগোনা নজরে এলো তার। শীতলতর বাতাস চারপাশে সু-সু শব্দ তুললো। কিছুক্ষণ আগেও আকাশটা স্বচ্ছ ছিলো একদম। কিন্তু এখন হঠাৎ-ই এমন মেঘাচ্ছন্ন হলো কেন? আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো সবাই দৌড়ে আসছে। তাদের আসতে দেখে দীবা মিষ্টি করে হেসে তাকিয়ে রইলো।

আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস দুটোই এমন। এখুনি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, এখুনি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন আবার ধরনি কাপিয়ে ভারি বর্ষণ। হুটহাট আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে। গত দুইদিন বৃষ্টি না হলেও আজ আগাম বার্তা ছাড়া বৃষ্টির আগমন ঘটলো। আকাশের বুক চিঁড়ে একটা দুইটা বৃষ্টির ফোটা পরতে শুরু করলো। দৌড়ে এসেও নিজেদের বাঁচাতে পারলো না কেউ। বাড়ির ভিতরে ঢোকার আগেই বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে গেলো। অল্পসল্প ভিজিয়ে দিলো সবাইকে। দৌড়ে এসে সবাই বাড়ির ভিতরে ঢুকলেও বৃষ্টির মধ্যে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো রাইমা। তাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলো সবাই। দীবার ঠোঁটে আমোদিত মিষ্টি হাসি ফুটে এলো। কারণটা বুঝতে পেরে মহা আনন্দে লাফিয়ে নিচে নামার জন্য দৌড় লাগালো। রাইমাকে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাবিত ডাকলো, ‘বেকুব, ওখানে দাঁড়িয়ে ভিজছিস কেন? ভিতরে আয়।’

রাইমা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুচকি হেসে মাথা দুই পাশে দুলালো। অর্থাৎ ভিতরে যাবে না সে। বড় ভাইয়ের কথা উপেক্ষা করে ডেকে উঠলো, ‘নুরা, রিমি ভিজবি তোরা?’

রিমি ও নুরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে একে অপরের হাত ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। এক দৌড়ে রাইমার কাছে গিয়ে বৃষ্টি ভিজতে লাগলো। সাবিত রেগে ধমকে উঠলো তিনজনকে, ‘তোরা ভিতরে আসবি?’

বোনদের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা দেখে মৃদু হাসলো রাজ। হালকা ভিজে যাওয়া চুল গুলো এক হাতে ঝাড়তে ঝাড়তে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। তখুনি সিঁড়ি বেয়ে হাসতে হাসতে নিচে নামতে লাগলো দীবা। চোখাচোখি হলো দুজনের। রাজ মুগ্ধকর চোখে দীবার দিকে তাকিয়ে উপরে উঠতে লাগলো। দীবা স্বাভাবিক ভাবে নিচে নেমে সবার কাছে আসলো। বৃষ্টিতে ভিজতে বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই আরিয়ান দীবার বাহু ধরে আটকে ধরে বাধা দিলো। দীবা আকুতি মিনুতি করতে লাগলো। আরিয়ান দীবার এই করুণ চেহারা দেখে আর মানা করতে পারলো না। তাই হাত ছেড়ে দিলো। দীবা খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাহিরে গিয়ে তিনজনের সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃষ্টি ভিজতে লাগলো। রাইমার ছেলেমানুষির কারণে আনমনে মৃদু হেসে ফেললো রাজিব।

মেয়েদের হাসির শব্দ কানে আসতেই আবরার রুম থেকে বেরুলো। দুতলার বারান্দার রেলিং ধরে রাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো আবরার। রাজের ঠোঁটের মৃদু হাসি দেখে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো। রাজের থেকে চোখ ফিরিয়ে বাড়ির নিচে তাকালো। চারজন একত্রে হেলেদুলে বৃষ্টি ভিজতে দেখলো। আবরার আরেকটু খেয়াল করে দেখলো রাজ দীবার দিকে তাকিয়েই হাসছে। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। তবুও নিজেকে সংযত রেখে রাজের দিকে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো। দুই হাতে নিজের এলোমেলো চুল গুলো গুছাতে গুছাতে প্রশ্ন করলো, ‘সুন্দর লাগছে তাই না?’

রাজ এখনো মুগ্ধ হয়ে দীবাকে দেখছে। যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে সে। তাই আবরারের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে আনমনে বলে উঠলো, ‘ভীষণ!’

রাগ বাড়লেও প্রকাশ করলো না আবরার। বাঁকা হাসি দিলো একটা। নিজেও রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। সামনে তাকিয়েই আবারো প্রশ্ন করলো, ‘দীবাকে কবে থেকে চিনেন?’

রাজ এবারো দীবার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আনমনে বলে ফেললো, ‘প্রায় ছয় বছর হবে।’

কথাটা বলার পরপরই মস্তিষ্ক সজাগ হলো রাজের। চকচকিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। হুট করে কি থেকে কি বলে ফেললো সে? এতো বড় বোকামো তাকে দিয়ে কিভাবে সম্ভব? নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলো রাজ। আবরার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে অল্প শব্দে হাসলো। তারপর উষ্ঠধয়ে জিভ বুলিয়ে রাজের দিকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক থেকে তীক্ষ্ণ করলো। শান্ত কন্ঠে কাটকাট ভাবে বললো, ‘দীবার থেকে দূরে থাকবেন। আপনার জন্য এটাই ভালো। নাহলে..!’

আবরারের কথা সম্পূর্ণ হতে দিলো না রাজ। তার আগেই বলে উঠলো, ‘ভয় দেখাচ্ছেন?’

আবরার মাথা হালকা নাড়িয়ে বললো, ‘না ভয় দেখাচ্ছি না। ওয়ার্নিং করছি। এন্ড দিস ইজ মাই লাষ্ট ওয়ার্নিং।’

আবরারের কথা শুনে তাচ্ছিল্য হাসলো রাজ। ঠোঁটে হাসি রেখেই আবরারের মুখামুখি সটান হয়ে দাঁড়ালো। পকেটে দুই হাত গুঁজে বললো, ‘আমি দীবার কাছে থাকি কিংবা দূরে, তাতে আপনার কি?’

আবরার বাঁকা হেসে এক হাত উঠিয়ে রাজের কাধে রেখে বললো, ‘এতো তাড়া কিসের? সময় হলে জানতে পারবেন। আপাতত দীবার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। শেষবারের জন্য সাবধান করছি।’

রাজের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আবরার। রাজ এখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হঠাৎ দীবাকে নিয়ে আবরারের কথা গুলো তার তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ প্রগাঢ় হলো তার। তবে বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হলো। এতো বড় সেলেব্রিটি কিনা দীবার মতো সাধারন একটা মেয়েকে পছন্দ করবে? এতোটাই সহজ? ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির নিচে তাকালো রাজ। দেখলো দীবাকে বৃষ্টি ভিজতে বারণ করছে আবরার। দীবা বারণ না শুনায় আবরার দীবার বাহু টেনে ভিতরে নিয়ে গেলো। ক্রোধান্তিত হলো রাজ। চোয়াল শক্ত করে গটগট পায়ের কদম ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো।

চলমান…

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল মিহির

[পর্ব-৪০] দ্বিতীয়াংশ

বৃষ্টি বিভিন্ন রুপ অনুভব করা যায় শ্রাবণমাসে। কখনো ঝমঝম, কখনো ইলশেগুঁড়ি, কখনো ঝড়কে সাথে করে মুষলধারের বৃষ্টি শ্রাবণকে ভরিয়ে দেয়। কখনো টিপটিপ বৃষ্টিতে নুপুরের নিক্কণ তুলে শ্রাবণ-ধারা। শ্রাবণের বৃষ্টিতে প্রকৃতির বহুমাত্রিক রূপও উদ্ভাসিত হয়। বৃষ্টি হওয়ার পূর্বের প্রকৃতির একটি রূপ থমথমে-গম্ভীর-এই বুঝি কিছু হবে। আবার ঘন কালো হয়ে আকাশ ছেয়ে বিদ্যুৎ-বজ্র সাথে পৃথক এক রূপ ধারণ করে প্রকৃতি। আবার বৃষ্টি-পরবর্তী প্রকৃতির বৃষ্টিস্নাত রূপ মনকে উতলা করে তোলে। রৌদ্রকে সাথে নিয়ে খেলায় মাতে মেঘের ভেলা। মেঘে, বৃষ্টিতে রৌদ্রছায়ায় শ্রাবণ পুরো আকাশে বিছিয়ে দেয় রঙের মহোৎসব।

প্রাতঃকালে দিবাকরের কোমল রোদ থাকলেও দুপুরের শেষভাবে মুষলধারে বৃষ্টি হলো। দুইদিনের অনাবৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাট, চারপাশের ঝোপঝাড়, গাছপালা ও মাটি শুকিয়ে খড়খড়ে হয়েছিলো। এই শুকিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিস্মিত করে আবারো বর্ষণ হলো। বৃষ্টির পানির তাপমান শীতল হওয়ায় গায়ের পশম কাটা দিয়ে উঠার উপক্রম। ভেজা মাটির ভ্যাঁপসা ঘ্রাণ, বর্ষাকালের অন্যতম কদমফুলের কারণে সৌরভময়ী পরিবেশ। বাহিরে ভারি বর্ষণের ঝমঝম শব্দ কান অব্দি স্পষ্ট ভেসে আসছে। জানালার পাশে বসে বাহিরের বৃষ্টিস্নাত রাত্রী দেখতে দেখতে মিষ্টি কন্ঠে সম্পূর্ণ গানটা শেষ করলো রাইমা।

তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া
টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি,
আমি ডুবতে রাজি আছি
তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া।

সকাল আমার গেল মিছে
বিকেল যে যায় তারি পিছে গো (x2)
রেখো না আর, বেঁধো না আর
কূলের কাছাকাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি,
আমি ডুবতে রাজি আছি
তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে
তোমার খোলা হাওয়া।

রাইমার সুমধুর কন্ঠে গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে বিমুখিত হয়ে সবাই করতালি দিলো। তালির শব্দ কানে আসতেই চোখ মেলে তাকালো রাইমা। সবার এমন রিয়েকশন দেখে কিছুটা লজ্জাভূতি হলো সে। চোখ ঘুরিয়ে রাজিবের দিকে তাকাতেই দেখলো রাজিব গালে দিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভীষণ রকমের লজ্জা পেলো রাইমা। গাল দুটো গাল হয়ে এলো। রাজিবের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুচকি হাসলো। রাইমার পাশেই দীবা বসে ছিলো। সে রাইমাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বললো, ‘কি মিষ্টি গান গাইতে পারো তুমি আপু।’

প্রত্যুত্তরে রাইমা মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো। একটু দূর থেকে রাজ বলে উঠলো, ‘আপনি কি কোথাও গান শিখেছিলেন নাকি?’

রাইমা রাজের দিকে তাকালো। বয়সে রাজের অনেক ছোট সে। কিন্তু সম্পর্কে বড় ভাবি। তাই সম্মান করে আপনি সম্মোধন করেছে রাজ। ব্যাপার টা ভালো লাগলো রাইমার। আর সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো, ‘না। এমনি শখের বসে গাই।’

রাজ বিনিময়ে আলতো হেসে শুধাল, ‘মাশাআল্লাহ! খুব ভালো গাইতে পারেন।’

রাজিব এক হাতে মাথা চুলকে বলে উঠলো, ‘বউটা কার দেখতে হবে না?’

তার এমন কথা শুনে হেসে উঠলো সবাই। রাজিবের লাগাম ছাড়া বেফাঁস কথায় লজ্জায় নত হয়ে গেলো রাইমা। এমনিতেই রাজিবের সামনে আসতে লজ্জা লাগে ভীষণ, তার উপর আবার এসব কথাবার্তায় তাকে আরো লজ্জিত করে। লোকটা ভারি অ’সভ্য! মনে মনে এই গালিটা দিয়ে নিজেই আহাম্মক হয়ে গেলো রাইমা। আবার নিজের এমন চিন্তায় নিজেই হেসে উঠলো।

আরিয়ান কিছুটা রশিকতার ছলে রাইমাকে কূটস্থ করে বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ ভাই আপনার বউ বহু গুণে গুণান্বিত। আপনাকে কয়েকটা এডভাইজ দিয়ে রাখি। নাম্বার ওয়ান, ইমারজেন্সি ফাস্ট এন্ড এইড বক্স রাখবেন হাতের নাগালে। নাম্বার টু, এম্বুলেন্স কিনে রাখবেন। যেকোনো মুহূর্তে কাজে লাগতে পারে। নাম্বার থ্রি, মোস্ট ইম্পরট্যান্ট থিংক পাবনা ম্যান্টাল হস্পিটালের নাম্বার রাখবেন। কবে যে এই মেয়ে আপনার মাথা খেয়ে ফেলে আল্লাহ ভালো জানে। আপনাকে আমি বড় ভাই মানি। তাই আগে আগে সাবধান ও সমাধান জানিয়ে দিচ্ছি। পরে দেখবেন কোনো এক সময় এই ছোট ভাইটার কথা গুলোই মনে পরবে।’

নিজের বোনের সম্পর্কে এমন বানী শুনে হাসতে হাসতে লুটিপুটি খাওয়ার অবস্থা নুরার। হাহাহা করে শব্দ তুলে হেসে রিমির গায়ের উপর হেলান দিয়ে পরলো। আবরারও অল্প শব্দ তুলে হেসে ফেললো। অন্যরা মুখ টিপে হাসলো। এমন কি রাজিবও। রাগান্বিত হলো রাইমা। নিজের কোলে থাকা কুশন টা হাতে নিয়ে আরিয়ানের দিকে দাঁতে দাঁত পিষে ছুঁড়ে মা:র:লো। আরিয়ান কুশনটা ধরে ত্যাঁছড়া ভাবে হাসলো। রাইমা রাগে কিড়মিড় করে বললো, ‘তোমার কপালে রাক্ষস বউ জুটবে বলে দিলাম।’

আরিয়ান ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো, ‘সমস্যা নেই। রান্নাবান্না সব পারি। ভালো হোক কিংবা খারাপ দুইটাই বউয়ের উপরে চালিয়ে দিতে পারবো। অপচয় হবে না।’

রাইমা প্রত্যুত্তর করলো না। মুখ গুমরো করে বুকে দুই হাত গুঁজে বসে রইলো। সবাই আনন্দ করলো এক সাথে। অবশেষে আবরারকে গান গাওয়ার জন্য ধরা হলো। আবরার প্রথমে নাকচ করলেও পরে গান গাইবে বলে মনস্থির করলো। আরিয়ানের কাছ থেকে গিটারটা নিজের কাছে এনে আঙুর চালালো। টুংটাং শব্দ তুলে গাইতে লাগলো….

রোজ সকালে তোর মায়াবি ছবি
চোখে ভাসে তোর মিষ্টি হাসি
বেলী গাঁথা তোর চুলের বেণী
মায়াপূর্ন তোর চোখের চাহনি।

রোজ সকালে তোর মায়াবি ছবি
চোখে ভাসে তোর মিষ্টি হাসি
বেলী গাঁথা তোর চুলের বেণী
মায়াপূর্ন তোর চোখের চাহনি।

ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী
ভালোবাসি শুধু তোকেই।

ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী
ভালোবাসি শুধু তোকেই।
ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী।

দীবার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকালো আবরার। দীবার বেনী করা চুলের ভাজে একটা গাজরা আটকানো। কপালে ছোট একটা কালো টিপ। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। মৃদু মুচকি হাসিতে মারাক্তক সুন্দর লাগছে তাকে। তার এই সৌন্দর্যের প্রেমে আবারো পরলো আবরার। মুগ্ধ হয়ে গানের বাকি লাইন গুলো গাইতে লাগলো…

তোর জন্য এই ভালোবাসা অসীম
অসীম আমার এই লেখা গান
প্রতিটি ছন্দে তোর রূপের আলোড়ন। (২)

তাতেই হারিয়েছি,
আমার এই প্রান।
তাতেই হারিয়েছি,
আমার এই প্রান।….

“তাতেই হারিয়েছি আমার এই প্রান!” লাইনটা শুনতেই স্মিতি হাসলো রাজ। তখনকার সময়ে নিজের পাগলামি টা আবেগ মনে হলেও এখন সেই অনুভূতি টা প্রগাঢ়। বয়সের সময়সীমা অনুযায়ী দীবা তার থেকে অনেক ছোট তবুও যেন এই পিচ্চি মেয়েটার প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই তার। গোলগাল চেহারার মিষ্টি হাসিটার প্রেমে বারংবার তাকে ঘায়েল করে। সবার থেকে একটু পিছিয়ে বসায় অনায়াসে দীবাকে প্রথম থেকে এখন অব্দি দেখে যাচ্ছে। দীবার খিলখিলিয়ে হাসির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও হেসে উঠছে আনমনে।

সম্পূর্ণ গানটা দীবার দিকে তাকিয়েই শেষ করলো আবরার। গান শেষে গিটারটা সরিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিলো। সবাই প্রতিবারের মতো আজও তার গানের গলার প্রশংসা করলো। যদিও এই প্রশংসা শুনতে ইচ্ছুক ছিলো না আবরার। কিন্তু পরিবারের লোক তাই চুপচাপ শুনতে হয়েছে।

সাবিত হাত ঘড়িতে সময় দেখলো অনেক রাত। তাই সবাইকে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিলো। অবশেষে আড্ডার আসর ভেঙ্গে এক এক করে সবাই যার যার রুমে চলে গেলো। শুরু রইলো রাজ আর আবরার। রাজ মোবাইলে কিছু একটা চেক করছিলো তাই আগের মতোই বসে আছে। আবরার ইচ্ছে করেই একটু দেরি করলো। সবাই যেতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গিটারটা দেখতে দেখতে অদ্ভুত ভাবে রাজকে বলে উঠলো, ‘অন্যের সম্পদের দিকে নজর দেওয়া অভদ্রতার তালিকায় পরে।’

আবরারের কথা কর্ণপাত হতেই মোবাইলে আঙ্গুল চালানো বন্ধ করলো রাজ। কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা ক্ষুব্ধা হয়ে চোখ তুলে সামনে তাকালো। চুপচাপ মোবাইলটা পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ালো। আবরার গিটার টা এক হাতে নিয়ে রাজের সামনে দাঁড়িয়ে কাটকাট গলায় বললো, ‘নতুন আত্মীয় হওয়ায় এখনো সম্মান দিয়ে বলছি। দীবার থেকে দূরে থাকেন। ভুলেও দীবার দিকে চোখ তুলে তাকাবেন না।’

রাজ নিশ্চুপ রইলো। তীক্ষ্ণ চোখে আবরারের চোখে চোখ রাখলো। রাগান্বিত হলেও উপরে শান্ত গলায় স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘এতো গুলো বছর যাকে দূর থেকে ভালোবাসলাম, আগলে রাখলাম। আর আজ শুনতে হচ্ছে তার থেকে দূরে থাকতে। আপনার কি মনে হয় এতো বছরের অনুভূতি হুট করে বদলে ফেলবো? আমাকে ভীতু লাগে আপনার?’

‘তুমি ভীতু হও কিংবা সাহসী তাতে কিছু যায় আসে না আমার। শুধুমাত্র একটা কথাই আমি বারবার রিপিট করছি আমার দীবার থেকে দূরে থাকো।’

রাজ পকেটে দুই হাত গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপনি বলার কে?’

আবরার কণ্ঠস্বর শক্ত করে কাটকাট গলায় বললো, ‘আমি দীবার হাসবেন্ড।’

শব্দ তুলে হেসে ফেললো রাজ। হাসিটা ছিলো তাচ্ছিল্যের হাসি। জিভ দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয় ভিজিয়ে নিলো রাজ। আবরারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো, ‘তিনমাস পর হাসবেন্ড দাবী করছেন। লিখিত কোনো প্রমাণ আছে?’

আবরার এমন কথা শুনে রাগে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। কপালের রগ ফোলে নীল বর্ণ ধারণ করলো। তবুও নিজেকে সংযত রাখলো সে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় না। তাই নিশ্চুপ রইলো। তীক্ষ্ণ চোখে রাজের দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল। তাচ্ছিল্যকর হাসি থামালো রাজ। চোখমুখ শক্ত করে আবরারের দিকে একটু এগিয়ে বললো,

‘এই এক মাসে আপনি দীবার সৌন্দর্যের প্রেমে পরেছেন। যদি দীবা সুন্দর না হতো, স্টাইলিশ না হতো তাহলে বিয়ের দিন রাতে যেভাবে ফেলে রেখে গেছেন ঠিক সেভাবেই রেখে যেতেন। দীবা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন থেকেই আমি তাকে ভালোবাসি। ক্লাস এইটে পড়ুয়া দীবা আর বর্তমানের দীবার মাঝে অনেক তফাৎ। তখন দীবা এতো স্টাইলিশ ছিলো না। একদম সাদামাটা ছিলো। আমি সেই পিচ্চি দীবার ভালোবাসায় এখনো মেতে আছি। আপনার মতো আমি সৌন্দর্যের প্রেমে পরিনি। আমার ভালোবাসা কিভাবে আমার করতে হয় সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। মাঝখান থেকে কাঁটা হয়ে আসবেন না।’

আবরারের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দুতলায় উঠার বিপরীত পাশের সিঁড়ি দিয়ে চলে গেলো রাজ। রাগে শরির মৃদু কাঁপছে আবরারের। দাঁতে দাঁত লেগে আসছে। দাঁড়িয়ে না থেকে গটগট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।

আবরারকে উপরে উঠে আসতে দেখে দ্রুত সরে গেলো নুরা। নিজেকে আড়াল করে দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে পরলো। এতো এতো সত্য কথা নিজের কানে শুনে পর থেকে স্তব্ধ নুরা। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। দীবা ক্লাস এইটে থাকাকালীন সময় থেকেই রাজ ভালোবাসে? এতো আগে থেকে? নুরা কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। সিঁড়ি বেয়ে আবরার নিজের রুমে চলে যাবার পর দেয়ালের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসলো নুরা। দ্রুত পা চালিয়ে নিজেদের রুমের দিকে গেলো। দরজার সামনে এসেই অস্থির হয়ে কয়েকবার টোকা দিলো। বেশ কিছুসময় পর দীবা রুমের দরজা খুললো। আড়ষ্ট চোখে দীবার দিকে তাকালো নুরা। রাজ দীবাকে ভালোবাসে। রাজের কথা গুলো পূর্ণরায় কানে বাজতেই দীবার গালে ঠাস করে একটা চ’ড় মা’র’লো নুরা।

চলমান…

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৪০] তৃতীয়াংশ

আকস্মিক ঘটনায় বিস্মিত হলো দীবা। হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রিমি। দীবা এক হাতে গাল ধরে আশ্চর্যান্বিত হয়ে নুরার দিকে তাকালো। থা’প্প’ড়ে মাত্রা এতোটাই গভীর ছিলো যে দীবার ফরশা গাল লাল হয়ে গেছে। জ্বলছে প্রচুর। দীবা গালে হাত বুলাতে বুলাতে কাদুকাদু গলায় বললো, ‘মা’র’লি কেন?’

রাগে শরির কাঁপছে নুরার। দীবার দিকে ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘আমার প্রিয় জিনিস গুলোই কেন অন্যের হয়? কেন বলবি আমায়?’

নুরার প্রত্যুত্তর শুনে রিমি হকচকিয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে তাকালো নুরার দিকে। এতো তাড়াতাড়ি ধরা খাবে কল্পনাও করে নি সে। নুরাকে এভাবে রেগে থাকতে দেখে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। মনে মনে ভাবতে লাগলো দীবা যেন স্বীকার না করে। কিন্তু তা আর হলো না। দীবা গালে হাত রেখেই নুরার ভয়ে অস্থির হয়ে বলে উঠলো, ‘বিশ্বাস কর তোর ব্রেসলেট আমি না রিমি নিয়েছে। আমি কিছু জানি না। আমাকে মারবি না। আমি বারণ করেছিলাম। যা বলার রিমিকে বল।

দীবার সহজসরল স্বীকারুক্তি শুনে আশ্চর্যরকম ভাবে তাকালো নুরা। প্রথমের রাগি চেহারা পালটে দিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে দীবার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্তম্ভিত হয়ে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আমার ব্রেসলেট চুরি করেছিস?’

ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে বললো রিমি, ‘তুই টের পাসনি?’

নুরা চোখেমুখে চকম রেখে বললো, ‘না। কোনটা নিয়েছিস? আর কবে?’

দাঁতে দাঁত পিষলো রিমি। চটজলদি পা চালিয়ে এসেই দীবার মাথায় ঠাস করে একটা থা’প্প’ড় মা:র:লো। পরপর দুই বার মা/র খাওয়ায় দীবার অবস্থা নাজেহাল। কাদুকাদু চেহারা এবার কান্না করার উপক্রম। রিমি কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘আগে আগে এতো কথা বলিস কেন?’

দীবা রাগে, দুঃখে, ব্যাথায়, অপমানে মৃদু আর্ত’নাদ করে উঠলো, ‘তোরা শুধু আমাকে মা’ড়’ছি’স কেন?”

মা’রার কথা মনে পরতেই নুরার দিকে তাকালো রিমি। অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে নুরাকে বললো, ‘তুই দীবাকে মা’র’লি কেন? কি হয়েছে?’

প্রত্যুত্তর করলো না নুরা। চুপচাপ রুমের ভিতরে ঢুকে বিছানায় বসলো। চোখ দুটো তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে। চোখে জমে এসেছে বিন্দু বিন্দু জলের কণা। নুরার এমন অবস্থা দেখে রিমি ও দীবা দুইজন হতবাক হয়ে গেলো। মামলা একটু বেশি সিরিয়াস তাই দুইজনে সিরিয়াস ভঙ্গিতে আসলো। অস্থির হয়ে নুরার কাছে এসে জানতে চাইলো সে কাঁদছে কেন? নুরা এতোক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও এখন কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। রিমিকে ঝাপটে ধরে অঝোরে কেঁদে ফেললো। হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা ও রিমি। বিস্মিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। নুরা কান্নায় ভেঙ্গে বলে উঠলো, ‘আমার সাথেই কেন এমন হলো? আমি যেটাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি সেটাই কেন হারিয়ে গেলো? আমার কি দোষ বল? আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে রিমি। এতো কষ্ট আগে কখনো পাই নি।’

রিমি নুরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মলিন কন্ঠে বললো, ‘নুরা? বোন আমার কি হয়েছে? আমাকে বল।’

নুরা কাঁদছেই। থামছে না একদম। অতিরিক্ত কান্নার কারণে কথা বলতে পারছে না সে। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে দীবার চোখেও পানি এসে পরেছে। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে এমন কিছুই করে নি যে নুরা কষ্ট পেয়ে এভাবে কাঁদবে। রিমিও কিছু বুঝছে না। তার মাথায় একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। নুরার এমন প্রিয় কোন জিনিস হারালো যার জন্য দীবা দায়ী? চিন্তিত চোখে দীবার দিকে রাকালো রিমি। তারপর নুরাকে শান্ত করে আবারো বললো, ‘বোইন আমার কাঁদিস না প্লিজ। কি হয়েছে?’

কান্নার কারণে খিচঁকি উঠছে নুরার। চোখমুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস করলো নুরা। কোনো রকমে কান্না থামিয়ে চোখের পানি মুছলো। উঠে দাঁড়িয়ে দীবা ও রিমির হাত ধরে রুম থেকে বের করে দিলো। নুরার কান্ডে অবাকের পর অবাক হচ্ছে দুইজন। নুরা দুইজন কে রুমের বাহিরে রেখেই দরজা লাগিয়ে দিলো। হতবুদ্ধি হয়ে গেলো রিমি। বিস্মিত চোখে দীবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দরজা দিল কেন?’

দীবা অবুঝের মতো মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে জানে না। রিমি ডাকলো, ‘দরজা লাগালি কেন?’

ভিতর থেকে নুরার কাটকাট রাগান্বিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘বিরক্ত করবি না। যা এখান থেকে।’

দীবা দরজায় ধা’ক্কা দিয়ে বললো, ‘এতো রাতে কোথায় যাবো?’

‘জাহান্নামে যা।’

নুরার এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণে আশ্চর্যান্বিত হলো দুইজন। হঠাৎ হলোটা কি এই মেয়ের? ভাবান্তর আসলো দুজনের মাঝে। দীবা আবারো দরজা ধা’ক্কা দিতে গেলে রিমি বাধা দিলো। ভাবলো নুরার মন ভালো থাকার জন্য এবার একটু একা ছাড়া যাক। তাই বিরক্ত করলো না দুইজন। কিন্তু এখন তারা থাকবে কোথায়? কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আশাহত হলো। না! নুরা এই জন্মে আজ রাতে আর দরজা খুলবে না। অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করতে হবে দুজনকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো রিমি থাকব্ব রাইমার রুমে আর দীবা যাবে আবরারের রুমে। যেই ভাবা সেই কাজ। দুইজন কথানুযায়ী দুই রুমে গেলো।
_____________________

রুমের এক পাশে থাকা কর্ণার টেবিলের উপর থেকে ফুলের টব হাতে নিয়েই মেঝেতে আ’ছা’ড় দিলো রাজ। কাচের টব টা ভেঙ্গে গুরুগুরু হয়ে মেঝের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো। তবুও শরিরের রাগ কমলো না রাজের। অতিরিক্ত রাগের কারণে শরির মৃদু কাঁপছে তার। কপালের রগ নীল বর্ন ধারণ করেছে। এই মুহূর্তে তার মা/র্ডা/র করতে ইচ্ছে করছে। শুধুমাত্র আবরারকে মে’রে গুম করতে ইচ্ছে করছে। দীবার পাশে কিছুতেই আবরারকে মানতে পারছে না সে। দীবা ও আবরারের বিয়ের কথাটা জানার পর থেকেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে তার। কথাটা জেনে রাতে খাবারের টেবিলে। যেদিন রাইমার বিয়ের গয়না অর্ডার দিতে গিয়েছিলো সেদিন-ই। মার্কেট থেকে রাজ ও তার মা বাড়ি ফেরার পরেই ডিনার করতে সবাই এক সাথে বসেছিল। তখন রাজের মা তার বাবা আফজালের উদ্দেশ্যে বলেছিল,

‘জানো আজ দীবাও এসেছিলো। মেয়েটা অনেক মিশুক। হাসিটাও সুন্দর। আমার কিন্তু ভীষণ পছন্দ হয়েছে দীবাকে। যদি না ছোট হতো রাজিবের সাথেই দুজনের বিয়ের কথা ফাইনাল করে ফেলতাম। ভালো হতো না? দুই ছেলের এক সাথে বিয়ে হতো।’

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বিস্মিত চোখে একবার মায়ের দিকে তাকালো রাজ। তাকাতেই তার মা প্রশ্ন করে উঠলো, ‘দীবাকে চিনো তুমি?’

রাজ চুপচাপ খাবার খেতে খেতে উত্তর দিলো, ‘হুম, আমার স্টুডেন্ট।’

রাজের মা প্রাণবন্তর হাসি দিলো একটা। কিন্তু আফজাল গম্ভীর মুখে রইলো। চেহারায় গাম্ভীর্য বজায় রেখে হতাশ কন্ঠে বললো, ‘তা আর হবে না। মেয়েটা বিবাহিত।’

আফজালের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো রাজ। মুখে খাবার দিতে গিয়েও থেমে গেলো। তবে প্রতিক্রিয়া দেখালো না একদম। রাজিব বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘বিবাহিত মানে? এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলো?’

আফজাল আবারো বললো, ‘রোশানের বড় ছেলে আবরারের সাথে নাকি তিন মাস আগেই বিয়ে হয়ে গেছে দীবার। আজ জানলাম রোশানের থেকে।’

রাজিব এবার আরো বিস্মিত কন্ঠে বললো, ‘আবরার তো নামকরা গায়ক। বিয়ের ব্যাপার টা লুকালো কেন তাহলে?’

রাজ নিশ্চুপ থেকে প্লেটে চামচ ঘুরাচ্ছে শুধু। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে তার। দীবা বিবাহিত তা মানতে পারছে না কিছুতেই। মনে মনে এই ভাবছে যেন এইসব তার স্বপ্ন হয়। বাস্তবে মানতে পারবে না সে।

আফজাল দীবা ও আবরারের বিয়ের সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললো। দীবা কে, আগে কোথায় থাকতো। কিভাবে গ্রামে গিয়ে বিয়েটা হলো। আবরার যে দীবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসে সব মেনে নিয়েছে। সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে রাজিব ও তার মা অবাক হলো বেশ। তবে রাজিবের মা একটু আফসোস করলো। দীবাকে তার বড্ড মনে ধরেছিল। কিন্তু কি আর করার। তবে যাইহোক, মেয়েটা যেন সুখি হয় সেই দোয়া করলো।

রাজ চুপচাপ বসে থাকলেও নিরবে নিরবে অধৈর্য হয়ে উঠেছে সে। এতো এতো ঘটনা তার অগোচরে হয়ে গেলো অথচ সে বিন্দুমাত্র টের পেলো না? যাকে দূর থেকে আগলে রেখেছে তার সম্পর্কে এতোটাই অজানা তথ্য রয়েছে। আর বসে থাকলো না। ‘আমার খাওয়া শেষ।’ এইটুকু কথা বলেই উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুমের দিকে অগ্রসর না হয়ে সোজা বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। তাকে বেরুতে দেখে তার মা পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কোথায় যাচ্ছো এতো রাতে? একটু আগেই তো বাহির থেকে আসলাম। এখন বিশ্রাম নাও। রাজ?’

কে শুনে কার কথা। রাজ বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। তবে অন্য কোথায় যায় নি। লিফট ধরে সোজা ছাদে চলে এসেছে। ছাদের রেলিংয়ের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। চুপচাপ বাবার বলা কথা গুলো ভাবতে লাগলো। প্রচন্ড রকমের রাগ হলো তার। রাগের কারণে ছাদে থাকা বেশ কয়েকটা ফুল গাছের টব ভেঙ্গে ফেললো। চুল খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। দীবা অন্য কারোর তা কিছুতেই মানতে পারছে না। এডাল্ট হয়েও আজ ছেলেমানুষি করছে সে। নিজের অজান্তেই চোখ লাল হয়ে এসেছে। শেষ কান্না সে ছোট বেলায় কেঁদেছিল সাইকেল এনে দেবার জন্য। আজ আবারো কান্না করছে তার ভালোবাসার জন্য। এতো কষ্ট তার সহ্য হয় নি।

সেদিন একের পর গাছসহ গাছের টব ভেঙ্গে ফেলেছিলো সে। আজও রুমে এসে একটা কাচের টব ভাঙ্গলো। সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে সে। রাগ কন্ট্রোল হচ্ছে না কিছুতেই। আজ আবরার যখন দীবার দিকে তাকিয়ে গান গাচ্ছিলো তখন তার রাগ হয়েছিলো। হিংসে হয়েছিল প্রচুর। সে জানে দীবা আবরারের স্ত্রী। তবুও মানতে কষ্ট হচ্ছে। দীবাকে কি সে কেড়ে নিবে? নাকি চুপচাপ মেনে নিবে সব? কিন্তু দীবাকে ছাড়া সে অসহায়। কিভাবে বেঁচে থাকবে সে? কিভাবে?

চলমান…