#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_২০
সময় বহমান। দেখতে দেখতে একমাস কেটে গিয়েছে। বৈশাখ মাসের অন্তিম দিন আজ। আকাশে কালো মেঘের ছড়াছড়ি। মেঘেরা আনাগোনা করছে আকাশজুড়ে। বয়ে যাচ্ছে শীতল হাওয়া। শহর তলীর মানুষ ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে।চিত্রা সকাল সকাল উঠে ছাদে চলে আসলো। মৃদু হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে।মিষ্টি সকাল উপভোগ করছে চিত্রা। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে নিচে আসলো। আজ বৃহস্পতিবার সে ভার্সিটিতে যাবে দুপুরের পর। ফ্রেশ হয়ে বসার রুমে আসতেই চোখে পরলো আরমান সাহেবকে। চিত্রা পাশে এসে বসলো।
“আজ ভার্সিটি নেই আম্মা?”
“আছে আব্বু তবে আজ সাড়ে তিনটায় ক্লাস। একটা ক্লাসই আছে। তোমাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। তুমি কি অসুস্থ আব্বু?”
আরমান সাহেব নিজ অসুস্থতা লুকিয়ে বললেন,,“না না আম্মা আমি একদম ঠিক আছি। রাতে ঘুম হয়নি তাই হয়তো এমন হয়েছে”
“আচ্ছা মানলাম। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো। আর সাবধানে স্কুলে যেও। ওই বাঁদরটা কোথায়?”
“আমি এখানে আপু”
প্রহর ধপাস করে সামনের সোফায় বসে পরে। চিত্রা রাগি চোখে তাকায়।প্রহর বোকার মতো হাসে। মরিয়ম সুলতানা খাবার খাওয়ার জন্য ডাক দেন। সবাই এক সাথে নাস্তা করে। আরমান সাহেব এবং প্রহর বেরিয়ে পরেন স্কুলের উদ্দেশ্যে।চিত্রা নিজের রুমে আসে। পড়ার টেবিলের পাশের জানালাটা খুলে দেয়। মৃদু বাতাসে পর্দা উড়ছে। চিত্রা একটা চেয়ার এনে সেখানে রাখে। অতঃপর একটা উপন্যাসের বই নিয়ে পড়া শুরু করে।বেশ কিছুক্ষণ পড়ার পরে সে অরিহাকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়।আষাঢ়ের সাথে সে টুকটাক কথা বলেছে। আষাঢ় সম্পর্কে বেশ কিছু জেনেছে সে।
কলিংবেল বাজাতেই অরিহা এসে দরজা খুলে। চিত্রাকে দেখে মিষ্টি হাসি উপহার দেয় সে।চিত্রা ও মৃদু হেসে প্রবেশ করে রুমে।অরিহাকে জিজ্ঞেস করে,,,
“আজ স্কুলে কেনো যাওনি অরিহা?”
“একটু ঠান্ডা লেগেছে তাই যায়নি।চিত্রা আপু আজ না আমি সব পড়া করতে পারিনি। তুমি আমায় বকা দিও না হ্যাঁ”
চিত্রা মুচকি হেসে বলে,, “ঠিক আছে আজ কিছু বলবো না। কিছু গনিত করিয়ে ছুটি। খুশি তুমি”
অরিহা কিছু বলবে তার আগেই বেলী বেগম রান্না ঘর থেকে আসেন। চিত্রা দেখে হেসে বলেন,,,
“চলে এসেছে চিত্রা। চা দেই তোমাকে”
“না না আন্টি দরকার নেই”
“তুমি বসে পড়াও ওকে। কোনো কথা না। আমি আসছি কিছুক্ষণ পর।”
বেলী বেগম চলে যান।চিত্রা অরিহার রুমে এসে ওকে পড়াতে শুরু করে।পড়ানোর মাঝে বেলী বেগম চায়ের হালকা পাতলা নাস্তা ও নিয়ে এসেছেন। চিত্রা মানা করলেও বেলী বেগম শুনেনি। সে চিত্রাকে সেগুলো সব খাইয়ে ছেড়েছে। অরিহা তা দেখে ভীষণ হেসেছে।পড়ানো শেষে বাড়িতে চলে আসলো সে। সাজিয়াকে কল করলো। অপর পাশ থেকে রিসিভ করলো সাজিয়া।
“আজ ভার্সিটি যাবি না?”
“হ্যাঁ যাবো তো। আমি তোকে তিনটায় এ ডাকতে আসবানি। তুই তৈরি থাকিস”
টুকটাক কথা বলে ফোন রাখলো চিত্রা।এরপর কিছুক্ষণ পড়ে গোসলে ঢুকলো। গোসল সেরে তৈরি হতে হতে সময় হয়ে গেলো। এর ভেতর সাজিয়াও চলে এসেছে। দু’জন রওনা হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।ক্লাস করলো মনোযোগ দিয়ে। ভার্সিটি থেকে বের হতেই দেখা হলো রোহানের সাথে। চিত্রা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো তবে ছেলেটি বলল,,,
“চিত্রা কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে”
“আমার সময় নেই। আমি কোনো অভদ্র ছেলেদের সাথে কথা বলি নাহ। আপনাকে বলেছিলাম আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন না হয় এরপর কিন্তু ভালো হবে না।”
চিত্রা সাজিয়াকে নিয়ে রাস্তার অপর পাশে আসলো।আষাঢ় এসে পেছন থেকে চিত্রা বলে ডেকে উঠলো। চিত্রা পেছনে ঘুরে আষাঢ়কে দেখলো তবে মুখ ভঙ্গি আগের ন্যায়। সাজিয়া আষাঢ়কে দেখে বেশ অবাক হলো। আষাঢ় এগিয়ে এসে বলল,,,
“কেমন আছেন সাজিয়া?”
“ ভালো ভাইয়া আপনি?”
“জি ভালো। চিত্রা আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমরা কি কোথাও বসতে পারি”
চিত্রা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,,,“ হ্যাঁ সমস্যা নেই। একটু অপেক্ষা করুন আমি সাজিয়াকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আসি”
আষাঢ় সম্মতি দিলো। চিত্রা রিকশা ডেকে সাজিয়াকে উঠিয়ে দিলো। সাজিয়াকে সাবধানে যেতে বলে আষাঢ়ের কাছে আসলো। আষাঢ় সাজিয়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায়নি কারণ সেখানে অনেক মানুষ। আষাঢ় নিরিবিলি একটা পার্কে নিয়ে এসেছে। দু’জন বসে আছে একটা বেঞ্চে। আষাঢ় দূরত্ব বজায় রেখেই বসে আছে।
“আপনি কি বলতে এখানে এনেছেন আমাকে আষাঢ় সাহেব”
“আমি আপনাকে অনেকদিন ধরে কথাগুলো বলবো ভাবছিলাম। আজ নিজের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে কথাগুলো বলতে এসেছি। কথাগুলো না বলতে পেরে আমার অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। এগুলো না বললে আমি শান্তি পাচ্ছি না।”
চিত্রা আষাঢ়ের কথার ধরণে বুঝে ফেলেছে আষাঢ় কি বলতে চায়।আষাঢ়ের উষ্কখুষ্ক চুল,চোখ মুখের অবস্থা দেখে চিত্রা আন্দাজ করলো লোকটি তাকে সত্যিই হয়তো ভালোবাসে। আষাঢ় আবারও নিচু স্বরে বলে উঠলো,,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি চিত্রা। আপনার জন্য আমি রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারছি না। এতোদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি তবে হেরেছি আমি। তাই বলেই দিচ্ছি আমি ভালোবাসি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি”
চিত্রা স্বাভাবিক। তার মুখ ভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না।চিত্রা নির্বাক কন্ঠে শুধালো,,“আমাকে ভালোবাসার কারণ কি?”
“আমি আপনায় কোনো কারণ ছাড়াই ভালোবাসি।কারণে ভালোবাসলে সেই কারণ যদি কখনো মন থেকে উঠে যায়।তাই আমি আপনায় কোনো কারণ ছাড়াই ভালোবাসি,আমার আপনাকে ভালোবাসতে কোনো কারণের প্রয়োজন নেই।ভালোবাসি চিত্রা!”
চিত্রা অন্যমনষ্ক হলো।আনমনে বললো,,“আপনি জানেন সব কিছু!আমার অতীত আছে। বাজে অতীত যা আমায় এখনো তাড়া করে বেড়ায়”
“আপনার অতীত নিয়ে আমার কখনোই কোনো সমস্যা ছিলো না চিত্রা। আমি প্রথমত আপনাকেই চেয়েছি,দ্বিতীয়ত আমি আপনাকেই চাই,তৃতীয়ত আমি আমার গোটা জীবনে শুধু আপনাকেই চাইবো!”
চিত্রা নির্লিপ্ত কন্ঠে প্রতিউত্তর করলো,,“পরে আফসোস হবে!আমি সহজে আপনাকে মেনে নিতে পারবো না”
আষাঢ় মৃদু হেসে শুধালো,,“আমার শুধু আপনাকে লাগবে চিত্রা,বরং আপনায় না পেলে আমার গোটা জীবন আফসোস করতে করতে কাটাতে হবে।নিজের সুখে থাকার কারণটাকে হারাতে দেই কিভাবে বলুন তো!”
“তাহলে,অপেক্ষা করতে হবে!আমার দ্বারা বিয়ে সম্ভব নয় এই মুহুর্তে। আমি সহজেই কাউকে ভালোবাসতে পারবো না ”
আষাঢ় দৃষ্টি মেলালো চিত্রার সাথে।চিত্রা তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নোয়ালো।তা দেখে হালকা হেসে আষাঢ় শুধালো,,, “বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন।বিয়ে-প্রেম সুন্দর চিত্রা!তবে আপনি কি জানেন অপেক্ষা তার চেয়েও সুন্দর, ভয়ংকর রকম সুন্দর। আমি না হয় অপেক্ষাটাকেই নিজের করে নিলাম।আপনার জন্য আমি না হয় শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অপেক্ষা করে গেলাম”
“ভেবে বলছেন তো আষাঢ় সাহেব!আপনার পরিবার কি মানবে আমাকে”
“কিছু মূল্যবান জিনিস পেতে হলে অপেক্ষার প্রয়োজন।আপনাকে পেতে হলে অপেক্ষায় শ্রেয়।আমি সাদরে গ্রহন করলাম।তবে আপনি হবেন তো আমার?আমায় অপেক্ষায় আছি আপনার। আর পরিবার! আম্মা আপনাকে আগে থেকেই অনেক ভালোবাসেন এবং পছন্দ করেন”
চিত্রা নির্লিপ্ত চোখে তাকালো আষাঢ়ের দিকে। অতঃপর বলল,,, “আপনিও যদি মাঝ পথে আমায় ছেড়ে চলে যান। তাহলে! পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করা বড্ড কঠিন”
“আমি জানি বর্তমান যুগে বিচ্ছেদের গল্পই বেশি। বিশ্বাস করা বড্ড কঠিন, তবে আপনি আমায় বিশ্বাস করে একবার আমার হাতটা ধরুন আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো। আপনি ব্যতীত অন্য কোনো নারী আমার জীবনে কখনোই আসবে না”
“আমার বড্ড ভয় হয় আষাঢ় সাহেব মানুষকে বিশ্বাস করতে”
“চিত্রা ভয় পাবেন না। আমি হারাম কোনো সম্পর্কে কখনোই জড়াবো না। আপনাকে আমি বৈধ ভাবে নিজের করতে চাই। ভালোবাসি আপনাকে, কখনোই অসম্মান হতে দিবো না। ভরসা করতে পারেন”
“আমি বাড়ি যাবো।”
আষাঢ় বুঝলো চিত্রা কথা বাড়াতে চাইছে না। আষাঢ় উঠে বলল,,, “চলুন”
চিত্রা এক পলক তাকালো তার দিকে। দেখলো আষাঢ়ের মলিন মুখ খানি। সেও আষাঢ়ের সাথে পা মিলিয়ে নিজেদের গন্তব্যের দিকে রওনা হলো। আষাঢ় একটা রিকশায় তাকে উঠিয়ে দিয়েছে। আর সে অন্য একটা রিকশায় উঠেছে। আষাঢ়ের মনটা ভীষণ খারাপ। সে জানতো চিত্রা তাকে গ্রহন করবে না। তবুও হৃদয়ের গহীনে কষ্ট হচ্ছে। তাকে ভালোবাসা যে বড্ড পুড়াচ্ছে। পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছে। এখান থেকে একমাত্র চিত্রা নামক রমনীই তাকে উদ্ধার করতে পারে। চিত্রা ছাড়া সম্ভব না এক মুহুর্তও চলা। এ কোন মায়ায় সে আটকে গিয়েছে। ভালোবাসার যন্ত্রণা বুঝি এতো গভীর। আষাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,,
“ভালোবাসি আপনায় চিত্রা। অপেক্ষায় শ্রেয়। মূল্যবান জিনিস সহজে পেয়ে গেলে তার মূল্য কোথায় থাকে। আমি না হয় কষ্ট করেই আপনাকে অর্জন করলাম।”
#চলবে~