#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_২৫
“আমার মেয়েটাকে টানা একটা বছর কষ্ট করার পর সুস্থ করতে পেরেছিলাম। তবে সেই চঞ্চল চিত্রাকে হারিয়ে ফেলেছি আমরা। সেই আগের মতো আর খুব বেশি কথা বলে না, সব সময় পড়ার ভেতর ডুবে থাকা যেনো তার অভ্যাসে পরিনত হলো।”
আরমান রহমান কাঁদছেন। পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। অতি দুঃখ না হলে কখনোই কাঁদে না তারা। আরমান সাহেব আর মরিয়ম সুলতানার বিয়ের ৪ বছরেও সন্তান হচ্ছিলো না। এরপর অনেক সাধনার পরে চিত্রার জন্ম হয়। খুব বেশিই ভালোবাসেন কি না মেয়েকে। আষাঢ়ের চোখেও পানি। প্রিয় মানুষটির অতীত এতো বাজে সে জানতো না। তার ভাবনার মাঝেই আরমান সাহেব আবার বলে উঠলেন,,,
“ও আস্তেধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিলো তখন আবারও আরেক ধাক্কা খায় নিশি আত্নহত্যা করেছে। ওর প্রেমিক নাকি ধোঁকা দিয়েছিলো ওকে। সেই ঘটনাও বাজে ভাবে প্রভাব ফেলেছিলো চিত্রার উপর। নিশিকে একটু বেশিই ভালোবাসতো কি না চিত্রা”
“নিশি কি মারা গিয়েছে আঙ্কেল?”
“নাহ ওহ বেঁচে আছে। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিলো সে। এরপর থেকে চিত্রা কখনোই আর নিশির সাথে কথা বলেনি। নিশি অনেক বার এসেছিলো তবে চিত্রা বারবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে”
“এতো টুকুই কি চিত্রার পুরুষদের প্রতি অনীহার কারণ?”
“নাহ আরো অনেক কারণ আছে। তবে আমি ব্যতিত অন্য পুরুষদের বিশ্বাস করা ছেড়ে দিয়েছিলো সেদিন যেদিন নাহিয়ান চিত্রাকে ধোঁকা দিয়েছিলো। ওর চাচাতো বোনের বিয়ে হয়েছিলো ছেলে অত্যাচার করতো এমন আরো অনেক ঘটনা আছে। বাস্তবতা বুঝতে শুরু করলো চিত্রা। নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করলো। আমি ওর নিরাপত্তার জন্য ওকে ফাইট ও শিখিয়েছি।”
“এখন আমার কি করা উচিত আঙ্কেল। আমি কিভাবে মানাবো চিত্রাকে?”
“আমার মনে হয় আষাঢ় চিত্রা তোমাকে একটু হলেও পছন্দ করে। তুমি এক কাজ করো তাকে আজকে বিকালে হাঁটতে নিয়ে যাও। সেখানে গিয়ে তাকে বলবে তুমি তার আপাতত বন্ধু হয়েই থাকতে চাও। যদি কখনো চিত্রা তোমাকে ভালোবাসে তখন না হয় তোমাকে বলবে। বুঝেছো?”
“জি আঙ্কেল। আপনাকে ধন্যবাদ এসব জানানোর জন্য। আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো তাকে মানানোর। আমাকে দোয়া করবেন”
“তোমায় ভরসা করে আমার মেয়ের দায়িত্ব দিচ্ছি আষাঢ়। আশা করি তুমি তা সঠিক ভাবে পালন করবে। আমার মেয়েটাকে ভালোবেসে আগলে রেখো। ও বড্ড ভালোবাসার পাগল। এই বাস্তবতার দেওয়ালে আটকা পড়ে আছে। পারলে ভালোবেসে সেখান থেকে বের করার চেষ্টা করো”
আষাঢ় মাথা নাড়ায়। দু’জন নিচে নামে। আরমান সাহেব নাস্তা করতে বললেও আষাঢ় মানা করে দেয়। সে নিজ বাড়িতে আসে। চিত্রা তখনও দু’জনকে পড়াচ্ছে। অরিহা পড়া দিচ্ছে। প্রহর পড়ছিলো। আষাঢ় ওদের সামনে এসে বলে,,,
“অনেক পড়িয়েছেন চিত্রা ওদের। আর দরকার নেই। চলুন ক্রাম খেলি। প্রহর পারো তো নাকি?”
প্রহর সাথে সাথে বই বন্ধ করে নেয়। এর লাফিয়ে উঠে বলে,, “হুম পারি তো আষাঢ় ভাই। ক্রাম খেলতে আমার অনেক বেশি ভালো লাগে। চলো চলো খেলি”
“অরিহা প্রহরকে নিয়ে যা বোর্ড নামিয়ে নিয়ে আয়।চিত্রা আপনি খেলতে পারেন তো?”
প্রহর অরিহা ক্রামবোর্ড আনতে যায়। আষাঢ়ের কথার পিঠে বলে,,, “পারি তবে আপনি কিন্তু কাজটা মোটেও ভালো করেননি। কি দরকার ছিলো ওদের পড়ার মাঝে খেলার কথা তোলার। দু’টোই তো পড়া শোনা করে না। আবার আপনি উড়ে এসে জুড়ে বসলেন”
আষাঢ় মৃদু হেসে বলে,,,“একদিন না পড়লে কিছুই হবে না। চলুন তার থেকে শৈশবে ফিরে যাওয়া যাক। যখন আমরা মুক্ত পাখির ন্যায় উড়তাম”
আষাঢ়ের জোড়াজুড়িতে রাজি হয় চিত্রা। বসার ঘরে খেলতে বসে চারজন। যদিও এর মাঝে প্রহর অরিহার ঝগড়া হয়েছে বেশ কয়েকবার। যে কোনো কথা নিয়েই দু’জন ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। গেমে খেলছে চারজন। চিত্রা আর অরিহা,প্রহর এবং আষাঢ়। চারজনের খেলার মাঝে বেলী বেগম উপস্থিত হন সেখানে। চিত্রা সবার সাথে কথা বলছিলো আর হাসছিলো। চিত্রাকে মনে হয় সে এই প্রথম প্রাণ খুলে হাসতে দেখছেন বেলী বেগম। তিনি এসে বলেন,,
“সবাই আমাকে ভুলে গিয়েছো?”
চিত্রা মৃদু হেসে বলে,, “না না আন্টি ভুলবো কেনো?আপনিও আসুন দরকার হলে আমি উঠে যাচ্ছি আপনি বসুন”
অরিহা তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,,,“জানো চিত্রা আপু আম্মু ও অনেক ভালো ক্রাম খেলে। আমি উঠছি তুমি বরং আম্মুর সাথে খেলো। আমি তো খেলাম তবুও হারতে হলো আমার জন্য তোমার। এবার আম্মুর সাথে খেলো তুমি”
সবার জোড়াজুড়িতে বেলী বেগম ও যোগ দিলেন তাদের সাথে। শুরু হলো খেলা। প্রহর এবং আষাঢ় অনেক ভালো খেলছে তবে বেলী বেগম আর চিত্রা একসাথে তাদের থেকেও ভালো খেলছে। দু’জন কিছুক্ষণের মাঝে জিতে গেলো। চিত্রা খুশিতে জড়িয়ে ধরলো বেলী বেগমকে। আষাঢ় প্রহর অরিহা সবাই বিষ্মিত চাহুনিতে দেখছে চিত্রা নামক রমনীকে। প্রহর এতো বছরে এই প্রথম চিত্রাকে এমন প্রাণখোলা হাসিতে দেখলো। ও বুঝে নিলো তার বোন এই পরিবারের খুশি থাকবে, ভীষণ খুশি।
–
“চিত্রা শুনুন”
আষাঢ়ের ডাকে পিছু ফিরে তাকালো চিত্রা। আষাঢ় তার কাছে এগিয়ে এসে বলে,,“আপনি কি বিকালে ফ্রি আছেন চিত্রা। আসলে বিকালে আপনায় নিয়ে আমার এক প্রিয় জায়গায় যাবো। যাবেন?”
চিত্রা মৃদু হেসে বলে,,,“ঠিক আছে। আপনি আমায় মেসেজ করে সময় বলে দিয়েন”
“চিত্রা আপনার নাম্বারটা?”
“আন্টির কাছে আছে তার কাছ থেকপ নিয়ে নিবেন। আসি”
চিত্রা নিজের বাড়িতে চলে আসলো। বেশ কয়েকদিন ধরে তার মনে আষাঢ়ের জন্য একটু হলেও অনুভূতি জন্ম নিয়েছে। এটা সে অস্বীকার করতে পারবে না। আষাঢ়ের সাথে মিশে সে বুঝতে পেরেছে আষাঢ় অসম্ভব ভালো ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ। চিত্রার সব থেকে বেশি ভালো লেগেছে আষাঢ়ের তাকে আপনি বলে ডাকা। তার থেকে বয়সে বড় হলেও তাকে যথেষ্ট সম্মান করে আষাঢ়। আষাঢ়ের দৃষ্টিতে সে কখনো লালসা দেখেনি দেখেছে শুধু মুগ্ধতা। সাজিয়ার কথা গুলো মাথায় রেখে আষাঢ়ের ব্যবহার দেখের চিত্রা আষাঢ়কে নিজের বন্ধু বানিয়েছে।চিত্রা বসার রুমে আসতেই আরমান সাহেবকে দেখলো। বাবার পাশে এসে বসলো চিত্রা।
“আব্বু তুমি এখানে বসে যে?অসুস্থ লাগছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছি কতো বার কেনো যেতে চাও না!”
“আমার তো কিছু হয়নি আম্মা তাহলে কেনো যাবো ডাক্তারের কাছে বলো তো। এসব বাদ দাও। তোমায় একটা সু খবর দেই। তোমার নানু আসছেন”
“সত্যি নানু আসছে। সেই কবে বলেছিলো আসবে। এখনো আসতে পারেননি তিনি। আমি রেগে আছি তার উপর”
আরমান রহমান অবাক হলেন। তার মেয়ে এমন কথা আজ কতো বছর পর বললো। আরমানের খুশিতে চোখে পানি চলে আসলো। আষাঢ় নামক পুরুষটি তার আম্মার জীবনে আসার পর থেকে তার মেয়ের জীবনে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়েছে। এতেই খুশি সে তার মেয়ে আগের মতো হচ্ছে।
“রাগ করে না আম্মা। নানু সমস্যায় ছিলো বিধায় হয়তো আসতে পারেনি। এখন আসছে তো”
“হুম আমি এমনি বলছিলাম। রুমে যাও ঘুমিয়ে পড়ো। আমিও রুমে যাবো। বিকালে আবার আষাঢ় সাহেব কোথাও নিয়ে যাবেন বলেছে”
“তুমি যাবে আম্মা?”
“হ্যাঁ আব্বু। তাকে এতোদিনে এতোটুকু বিশ্বাস আমি করতে পেরেছি”
“আচ্ছা রুমে যাও আম্মা”
চিত্রা রুমে আসলো। আযান দেয়নি এখনো। সে শুয়ে পরলো বিছানায়। সে নিজের আচরণে নিজেই অবাক। সে কি ঠিক হয়ে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখছে। বাস্তবতার বেড়াজালে মিশে, নেগেটিভ দিকগুলো সব দেখে পুরুষদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছিলো সে। আরো নাহিয়ানের ধোঁকা, নিশির সুইসাইড এসব কিছুর জন্য তো পুরুষ মানুষই দায়ি ছিলো। তবে আষাঢ় নিশীথ এদের দেখে ধারণাটা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছে।
#চলবে~