#আসক্তি২
পর্বঃ৩২
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
দোতলা বিশিষ্ট সুন্দর ছিমছাম নীল রঙ্গের একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাখি।বাম হাতে ইনায়াহ্’র হাত শক্ত করে ধরে রাখা।অগণিত প্রশ্নের উত্তর জানার কৌতূহল,কিছুটা নতুন অভিজ্ঞতার পূর্বাভাস কিংবা বড় কোন লুকানো রহস্য জানার আগ্রহ, নানা ধরনের অনুভূতির সংমিশ্রনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে পাখি।রাফিকে বিদায় জানিয়েছে দশ মিনিট আগে।ভিতরে এক পা রাখার সাহস যোগাতে দুই পা পিছিয়ে আসতে হচ্ছে।রাফি পইপই করে বলে গেছে এতোবড় কাজটা না করতে। কিন্তু শোনে নি পাখি।শুনবেই বা কী করে, ভালোবাসার মানুষের কষ্ট কেউই সহ্য করতে পারে না আর সেখানে এতো বড় যন্ত্রনা।
“মুন সাইন”,হাত ধরে নিজের দিকে টানে ইনায়াহ্।সম্বিৎ ফিরে পাখি চেয়ে থাকে ইনায়াহ্’র দিকে।একটু ঝাঁকিয়ে বলে,”তুমি ভিতরে কেন যাচ্ছো না,চলো না!এটাতো দিদার বাড়ি।তুমি জানো আমার দিদা, বেষ্ট দিদা!আমায় কত্তো আদোর করে।আর দাদু তো সারাদিন আমায় কত্তো ভালোবাসে।”
ইনায়াহ্’র কথায় ভাবনায় পরে যায় পাখি,”ডাক্তার সাহেবের কাছে এতোটা খারাপ তিনি, অথচ বাকি সবাই বলে তার গুনের শেষ নেই।এর কারণ তো কিছু একটা আছেই।আমায় জানতেই হবে।আমার ডাক্তারকে আমি আর কষ্ট পেতে দেবো না”
ভেবেই ইনায়াহ্’র হাত ধরে বুকে সাহস সঞ্চার করে বাড়ির ভিতরের দিকে পা রাখে পাখি।
সকাল বেলা পাখির প্রশ্নের কাটকাট জবাব দিয়েছে রাহেলা,”আমাদের শানবাবা তোমায় যা বলেছে সব ভুল বলেছে।ম্যাডামের মতো মানুষ এ জগতে দ্বিতীয় জন আছে বলে মনে হয় না।এর থেকে বেশি কিছু তোমায় বলতে পারব না।বাকিটা জেনে নেয়ার দায়িত্ব তোমার। আর শানবাবাকে এই ভুল থেকে বের করে আনার দায়িত্বও তোমার মা”
“চাচি, আমায় সবটা জানতে হবে।দয়া করে বলুন প্লিজ”,অনুনয়ের স্বরে বলে পাখি।
রাহেলা সবজি কাটতে কাটতে বলে,”মাগো,সবার কিছু না কিছু দায়িত্ব থাকে। যেটা নিজেকেই সঠিকভাবে পালন করতে হয়।আমার দায়িত্ব এটুকুই যে তোমাকে তোমার প্রশ্নের উত্তরের রাস্তা অবধি দেখানো। বাকিটা যে তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে।এর অবশ্যই কারণ আছে।আমি সবটা উত্তর জানালে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না।শুধু এটুকু বলি, রাফি তোমায় ঐ বাড়ি অবধি পোঁছে দেবে”
পাখি আর মোটেও কালক্ষেপণ করতে চায় নি।তাই তো স্কুল ছুটি হওয়ার সাথে সাথেই চলে আসে শর্মিলা বেগমের বাড়ি।এ পথ যে অনেকটা কন্টকময় তা আর পাখির অজানা নয়।
🌸🌸
“দাদুভাই”,উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ডাকে ইনায়াহ্।
ভর দুপুরের ভ্যাপসা গরমে কোথাও বের হওয়ার জো নেই। তাই ঘরে বসে বসেই এসির ঠান্ডা হাওয়াকে প্রাধান্য দেন খান সাহেব।সামনে তার চল্লিশ ইঞ্চির বোকাবাক্সটা অনর্গল বকবক করেই চলছে।ষাটোর্ধ খান সাহেব একসময় নিযুক্ত ছিলেন আর্মির অফিসার পদে।রিটায়ার্ড হওয়ার পর এখন ঘর বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে।তবুও কোথাও বয়সের বিন্দুমাত্র রেশ তার শরীরকে ছুঁতে পারে নি।এখনো আর পাঁচটা নওজোয়ান তার কাছে ডাল-ভাত।
ইনায়াহ্’র কন্ঠে চমকিত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে নেন খান সাহেব। মরুর আকাশে এক পশলা বৃষ্টির মতো হাসি ফুটে ওঠে তার চোখে মুখে।নিমিশেই সব বিরক্তি ছুটে যায়।ঠোঁট প্রশস্ত করে দু হাত বাড়িয়ে দেয়।ইনায়াহ্ পাখির থেকে দৌঁড়ে ছুটে যায়।
এদিকে দুপুরের রান্নার কাজে ব্যস্ত শর্মিলার কানে যেন ইনায়াহ্’র গলার স্বর এক আকাশ পরিমান খুশি বয়ে আনে।খুন্তি হাতেই হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসেন।পিছন পিছন চলে আসে রানু;আব্দুল্লাহ্ আর রাহেলার মেয়ে।খান সাহেব যখন কর্মরত ছিলেন তখন শর্মিলা নিজের একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে সন্তানের দূঃখ ভুলতে রানুকে নিজের কাছে রাখেন।
ইনায়াহ্’র দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সদর দরজার কাছে চোখ রাখেন শর্মিলা।এক জোরা উৎসুক চোখ চেয়ে দেখছে তাদের মিলন মেলা।এগিয়ে আসে পাখির দিকে।শর্মিলা বেগম বুঝতে পারেন না এই মূহূর্তে তার কী অভিব্যক্তি প্রকাশ করা উচিত।আগা-গোড়া পরোখ করে তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন।
“আস্সালামু আলাইকুম মা”
শান্ত কিন্তু ধারালো একটা কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসে শর্মিলার।শেষের সম্বোধনটা যেন বুকের বাঁ পাশে কোথাও নতুন করে চিনচিনে ব্যথার পাল তুলে দেয়।কয়েক মূহূর্ত তিনি চোখের পাতা দুটোকে বিশ্রাম দেন।খুব ধীরে চোখ খুলে স্পষ্ট স্বরে বলে ওঠেন,”মা!কতো পরিচিত অথচ কতোখানি আকুল তোমার ডাক।কি কপাল আমার, ছেলের কন্ঠে মা ডাক শোনার জন্যে হাহাকার করে বুক, অথচ ছেলের বউ এসে…… ”
“বড় মা, ভাবিকে এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখবা?”,রানুর কথায় কন্ঠে ভাঁটা পরে শর্মিলার।খুন্তিটা রানুর হাতে দিয়ে চোখের কোণাদুটো সাবধানে মুছে নেন। স্থীর দৃষ্টিতে চেয়ে বলেন, “ভিতরে আসো”
ভিতরে প্রবেশ করেই খান সাহেবকে সালাম জানায় পাখি।জবাব জানিয়ে ভ্রুদ্বয়ে সামান্য ভাঁজ ফেলে শর্মিলার দিকে তাকায় তিনি।শর্মিলা চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে বলেন,”বউ মা”
চকিতে তাকিয়ে থাকে পাখি।যেন ডাকটা তার মুখের জন্যেই আল্লাহ্ তৈরী করেছেন।পাখিকে অবাক বিষ্ময়ে কিছুক্ষন আগা-গোড়া দেখে খান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে বলেন,”আসো মা আসো, বসো বসো”
“এই রানু বউ মা প্রথমবার আসলো আমাদের বাড়ি।দাঁড়িয়ে দেখছিস কি। যা মিষ্টি নিয়ে আয় দৌঁড়া”
“এখুনি আনছি বাবা”
নিজের জন্যে এতো উৎকন্ঠা দেখে বেশ অবাক হয় পাখি। পুলকিত হয়ে বাড়োন করে, “আমায় নিয়ে এতোটা ব্যস্ত হবেন না।আমার খুব অস্বস্তি লাগছে”
বেশ বিব্রতকর অবস্থা পাখির চোখেমুখে।যা নজড় এড়ায় না শর্মিলা।
“বাসায় বলে এসেছো?”
“না মানে,মানে…..আমি স্কুল থেকে আরকি….”,রিনরিনে স্বরে অর্ধ্বকথায় থেমে যায় পাখি।
“স্বামীর বিনা অনুমতিতে এভাবে আসা ঠিক হয় নি। এ বাড়ির কথা শুনলে তোমার সাথে অনেক ঝামেলা হতে পারে”,স্থীর দৃষ্টিতে চোখ মেলে কথাগুলো বলেন শর্মিলা।
কাচুমাচু করে পাখি জবাব দেয়,”আমার কিছু কথা ছিলো মা।যেগুলো জানা আমার খুব জরুরী।”
“তুমি রেস্ট করো।এসেছো,দুপুরে খেয়ে যেও।”
“মা প্লিজ”,অনুনয়ের স্বরে বলে পাখি।
থমকে যায় শর্মিলা।খান সাহেবের দিকে তাকাতেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইনায়াহ্’র হাত ধরে উপরে চলে যায়।রানুও চলে যায় রান্নাঘরে।
পাখি চট করে শর্মিলার দুই হাত ধরে বলে,”আপনার ছেলে আপনাকে অনেক ভালোবাসে মা।কিন্তু কোন একটা কারণে তিনি আপনাকে মানতে পারছে না।কী সে কারণ মা। আমায় বলুন ।তার এই চাপা কষ্ট আমার সহ্য হয় না”
ছেলের মনের কথা তিনি বোঝেন।তবুও আজ পাখির মুখে শুনে মনের মাঝে হাহাকার টা বেড়ে যায় দ্বিগুন।
“শান তো তোমায় সবটা বলেই দিয়েছে মা, তাহলে?”
“আমার মনে হয় উনার কোথাও ভুল হয়েছে মা;উনার জানার মাঝে ভুল আছে।আমি সঠিক টা জানাতে চাই উনাকে”
মুচকি হেসে ওঠে শর্মিলা।মূহূর্তেই সে হাসি মিলিয়ে যায় ঠোঁটের কোণে।তাকাতেই চোখ আটকে যায় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা শানের দিকে।শান এক দৃষ্টে আগুন চোখে তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে।পাখি শর্মিলার দৃষ্টি অনুসরন করে দরজার দিকে তাকাতেই বুকে “ধ্বক” করে ওঠে। দুটো শুকনো ঢোক গিলে সন্তোর্পনে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় শানের দিকে।কটমটে দৃষ্টিতে শান নজড় ফেলে শর্মিলার দিকে।
এই প্রথম এ বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছে শান।চোখ ভরা জল নিয়ে শর্মিলা চেয়ে থাকে ছেলের দিকে। দৃষ্টি উপেক্ষা করে পাখির হাত চেপে ধরে শান।টেনে নিয়ে আসে দরজার দিকে।কি ভেবে থেমে যায় সে।
“ইনায়াহ্”,জোড়ে চিৎকার করে ইনায়াহ্’কে ডাকে।কেঁপে ওঠে পুরো বাড়ি।অন্তরাত্মা সমেত কেঁপে ওঠে পাখি।
“ইনায়াহ্ এখানে থাকুক না আজ “,শ্বান্তকন্ঠের অনুরোধ শর্মিলার।
বজ্রকন্ঠে জবাব দেয়,”ইনায়াহ্’কে দেখে রাখার মতো ক্ষমতা আছে আমার”
শানের কর্কশ গলার স্বরে উপর থেকে খান সাহেবের হাত ধরে নেমে আসে ইনায়াহ্। ড্রেস ছাড়িয়ে নরমাল ড্রেসে সে।ফ্রেশও হয়ে গেছে কিছুক্ষন আগেই।তা ইনায়াহ্’র চোখ মুখে পানির ফোটা দেখেই বোঝা যায়।শান একবার খান সাহেবের দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ডাকে ইনায়াহ্’কে।
“ইনায়াহ্ চলে আসো,রাইট নাউ”
“আমি দিদার কাছে থাকব আজ”,সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে নামতে নামতে বলে ইনায়াহ্।
শান অবাক হয়ে যায় ইনায়াহ্’র এমন আচরনে।শর্মিলাকে জড়িয়ে পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ও মুন সাইন, আমি আজ এখানে থাকি না প্লিজ”
ইনায়াহ্’র কথায় পাখি জিহ্বায় শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই শান ওকে টেনে নিয়ে আসে বাড়ির বাহিরে।গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে বসতে বলে।অপর পাশে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে শান। ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে দেয় কোন কথা ছাড়াই।অবাক চোখে ভয়ে ভয়ে তাকায় পাখি।শানের রাগের কাছে কিছু বলার মতো সাহস তার হচ্ছে না।দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে আসে বাড়িতে।আবারও পাখিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা খুলে বের করে আনে ওকে।হাত চেপে ধরে উঠে যায় সোজা উপরে।রাহেলার বোঝার বাকি নেই পানি অনেকদূর গড়িয়ে গেছে।আহত স্বরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে যান তিনি।
🌸🌸
“কার সাহসে ও বাড়ি গেছো?”,শান্তস্বরে প্রশ্ন করে শান।
একবার শানের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে নেয় পাখি।নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, “আমি, মানে….”
“বলো”,আবার প্রশ্ন করে শান।এতো শান্ত সে স্বর অথচ খুব ভয়ানক। ঝড়ের পূর্বাভাস যাকে বলে।
“স্কুল শেষে, গেছিলাম”, আমতাআমতা করে বলে পাখি।
“ও বাড়ি যাওয়ার আগে একটি বারও আমার কথা মনে হলো না তোমার?”,দাঁতে দাঁত পিষে রাগ দেখিয়ে বলে শান।
পাখি এগিয়ে শানকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে,”আপনি প্লিজ শান্ত হোন।আমরা তো ভালোভাবে বসে কথাগুলো বলতে…..”
“ভালোভাবে বসে!”,চোখ মুখ কুচকে বলে শান।স্বগতোক্তি করে বলে, “পাখি সামনে থেকে সরো।রাগের মাথায় কি করে বসব নিজেও জানি না।সরো”
মুখটা থমথমে করে পাখি জবাব দেয়,”মারবেন?”
থেমে যায় শান।মুখ থেকে যেন রাগের কালো মেঘটা সরে যায় পাখির এই একটি মাত্র কথাতে।একহাত টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে শান বলে,”আমি অনেক কিছু হারিয়েছি এ জীবনে।আর কিছু হারাতে পারব না।তোমাকে হারাবার কথা ভাবতেও পারি না।এক মূহূর্তের জন্যেও তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারি না আমি।তুমি আমার সেই আসক্তি যার নেশায় আমি আসক্ত।আমি চাই না তুমি ঐ মহিলার সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাত করো”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে পাখিকে পাশে সরিয়ে রেখে চলে যায় শান।হতভম্ব হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে পাখি।
🌸🌸
বিকেল গড়িয়ে যায় তবু শানের দেখা মেলে না।কয়েকবার ফোন করলে কেটে দিয়েছে শান।বুঝতে পারে পাখি, শান ভীষণ রেগে আছে।রাগ ভাঙ্গানোর জন্যে কি করা উচিত ভাবতে থাকে।
সন্ধ্যেবেলা রান্নাঘরে রাহেলাকে এ টু জেট সব কথা বলেছে পাখি।এরপর থেকে ভীষণ চিন্তিত রাহেলা সাথে একরাশ হতাশা।
“শানবাবা কি কোনদিনও সত্যিগুলো জানতে পারবে না?”
শানের কাছে আবার ফোন করে পাখি।সোজাসুজি উত্তর দেয় , “দেরি হবে”
মুখ গোমড়া করে বসে থাকে পাখি।আচমকাই একটা অদ্ভুত বুদ্ধি মাথায় আসে।মূহূর্তেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। পরোক্ষনে ভাবতে থাকে, “আমারই তো”
কাবার্ড থেকে পাতলা ফিনফিনে জর্জেটের লাল শাড়িটা বের করে পাখি।বিয়েতে রাখি এটা সিক্রেইট গিফট হিসেবে দিয়েছিলো।ভাবতেই লজ্জার লাল আভা গালে ফুটে ওঠে।বেশ পরিপাটি করে সেট করে নেয় শরীরের সাথে।আয়নার সামনের টুলটা টেনে নিয়ে গাঢ় করে কাজল দেয় চোখে।লাল টকটকে রং টা ঠোঁটে রাঙ্গিয়ে নেয় গাঢ় করে।পাউট করে হেসে ফেলে মূহূর্তেই।লম্বা মসৃন চুল গুলো ছেড়ে দেয় পিঠের উপর।দাঁড়িয়ে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নেয়।শব্দ করে হেসে ফেলে পাখি।
ঘরে কয়েক রঙ্গের মোম জ্বালিয়ে দেয় পাখি।এরপর লাইটটা অফ করে ঘড়ির দিকে তাকায়।
“এগারটা!এতোক্ষনে তো আসা কথা!”,ভাবতে ভাবতে জানলার কাছে এগিয়ে যায় পাখি।তখনি বাড়ির ভিতরে ঢোকে শানের গাড়ি।বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।তড়িঘড়ি করে নিজেকে আরেকবার দেখে নেয়.
মিনিট পাঁচেকের মাঝেই শান ঘরে ঢোকে।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে থ হয়ে যায়।নাকি আসে কড়া লেডিস পারফিউমের সুঘ্রাণ।চারিদিকে লাল নীল মোমের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।একবার চোখ বুলিয়ে হাতের ফোন, গাড়ির চাবি, ওয়ালেট সবটা দরজা পাশের ওয়ারড্রবের উপরে রাখে।বিছানায় বসে মোজা জোড়া খুলতে খুলতে চারিদিকে আবার চোখ বুলিয়ে নেয়।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে ড্রেস নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।
পাখি বেলকোনি থেকে আড়চোখে সেসব দেখছে।কিছুক্ষন পর গোসল সেড়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয় শান।তড়িৎগতিতে পাখি সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।হাত থেকে তোয়ালে টা কেড়ে নিয়ে মাথা মুছে দেয়।শান চোখ মেলে তাকায় ওর দিকে।মাথা থেকে পা অবধি দেখে নজড় গিয়ে আটকে লাল রঙ্গের পুরু আস্তরনে আচ্ছাদিত ঠোঁটের উপর।পাখি সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে শানের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে।
শানের দৃষ্টি এবার থামে কোমড়ের কাছের উন্মুক্ত জায়গায়।ফট করে চোখ সরিয়ে চলে আসে শান।
ব্যপার টা মোটেও ভালো লাগল না পাখির।ঠোঁট উল্টিয়ে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।শান চুল গুলো ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুলে ব্রাশ করতে করতে বলে,”ঠোঁটের ঐ রং সরাও।কি বিশ্রী দেখাচ্ছে!আর এতো সিডিউস করার দরকার নাই”
পাখি চমকে তাকায় শানের দিকে।নজর এদিক সেদিক করে পাখি অন্যত্র চলে যেতেই হাত টেনে ধরে শান।
খুব ধীরে টেনে আনে নিজের কাছে।একহাতে কোমড় জড়িয়ে ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে ঘষে ঠোঁটের রং টা উঠিয়ে দিতে দিতে বলে,”তুমি এমনিই অনেক সুন্দর।”
বৃদ্ধাঙ্গুলে মাখানো রং টা কোমড়ের খোলা জায়গায় মুছে বলে,”এসবের কোন দরকার নাই”
“আপনি যে রেগে আছেন আমার উপর।তাই ভাবলাম……”,মিনমিন করে বলে পাখি।
বেশ সাবলীল ভাবে জবাব দেয় শান,”আমার রাগ ভাঙ্গানোর জন্যে তোমার এই খোলা চুল আর শাড়িটাই এনাফ।এসব রঙ চঙ্গের দরকার নাই পাখি।আর সবথেকে বড় কথা আমি রেগে নেই”
শান্ত চাহনীতে তাকায় পাখি। দুপাশের চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে কপালে ঠোঁট ঠেকিয়ে শান বলে,”খুব ভালোবাসি”
চোখ বন্ধ রেখে মুচকি হেসে ওঠে পাখি।কতো সাধারন একটা বাক্য অথচ শানের কন্ঠে কতোই না শ্রুতিমধুর শোনায় তার কাছে।আবেশে গালের উপর রাখা শানের ডান হাতটায় ঠোঁট ছুঁয়ে পাখি জবাব দেয়,”আমার কিছু চাই ডাক্তার সাহেব”
“কী? ”
“কথা দিন”
“দিলাম”
“আমি চাই আপনি মায়ের সাথে একটি বার কথা বলুন।তার থেকে সবটা শুনুন”
পাখির কথায় সরে যায় শান।পিছু ফিরে চিরুনি টা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।মাথায় চিরুনি চালিয়ে বলে,”এটা তোমার কেমন আবদার পাখি।অন্য কিছু চাও।আমি মা নামোক মানুষটাকে মুছে ফেলেছি ষোল বছর আগে।”
“যদি বলি আমার ভালোবাসার আবদার!”
থেমে যায় শান।হাত যেন অচল হয়ে উঠছে।কিছুক্ষণ আয়নায় তাকিয়ে দেখে পিছনে দাঁড়ানো পাখির প্রতিবিম্বের দিকে।চিরুনি টা টেবিলে রেখে পিছু ফিরে বলে, “ওকে।শুধুমাত্র তোমার জন্যে আমি তার সাথে দেখা করব।তবে মনে রেখো, তার জন্যে জমানো ঘৃনা একরত্তিও কমবে না”
খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে পাখি।কাল বিলম্ব না করেই শানের বুকে ঝাপিয়ে পরে ।শান টাল সামলাতে পিছনে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে পা ঠেস দেয়।
“আরে আস্তে পরে যাবা “,পাখির চুলে হাত বুলিয়ে বলে শান।
পাখি আরো শক্ত করে চেপে ধরে শানকে।অস্ফুটস্বরে বলে,”আপনি আছেন না, এমন করেই ধরে ফেলবেন”
পাখির চুলের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে বলে,”আছি তো”
চলবে……
#আসক্তি২
পর্বঃ৩৩
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
শরৎের একটা মিষ্টি সকাল।রোদ টা যেন কাঁচের জানলাটার ছোট্ট ঐ ফোঁকর টা দিয়ে হুরমুরিয়ে ঢুকতে চাইছে ঘরে।রাস্তায় সবে মাত্র লোকেদের আনাগোনা।সকালের সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো তাদেরও জীবন যুদ্ধ।প্রতিটা সকালই কোন না কোন নতুনত্বের আহ্বান জানায়।জানায় নতুন করে জীবনকে সাজানোর উপায়।জীবনের মানে বোঝায় সুক্ষ ভাবে।রাতের পর সকাল হয়ে প্রমান করে জীবনে ঘনকালো অমানিশার পর অবশ্যই সুখের মশাল হাতে সকাল হাজির হয়।
পিটপিটিয়ে চোখ খোলে পাখি।সিথি বরাবর আছড়ে পরছে পরম ভালোবাসার মানুষ,প্রাণপ্রিয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস।জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে আসা আলোটা মন্দ লাগছে না। অনুভূতিরা জানান দেয়, পিঠে কারো পুরুষালী বাঁ হাতের শক্ত বাঁধন।সদ্য জাগ্রত ভোঁতা অনুভূতিগুলো গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।উষ্ণ আবেশে বুকে মিইয়ে যায় ।পার হয় কিছুটা সুখের মূহূর্ত।মাথা তুলে তাকায়।
বক্ষের মালিকের দুঠোঁটের মাঝে পৌনে ইঞ্চির দূরত্ব। মুচকি হেসে আনমনে বলে,”তাই তো বলি আজ নিঃশ্বাসের ঘনত্ব এতো বেশি কেন!”
ভেবেই ঠোঁটের দূরত্বটা দু আঙ্গুলে ঘুচিয়ে দেয়।কিন্তু বিঁধিবাম, এ দূরত্ব যেন বাঁধা মানছে না।বার দুয়েক এমন করতেই নড়েচড়ে ওঠে শান।এবার দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে বুকের উপর থাকা তার অর্ধাঙ্গিনীকে।পাখি আবারও উদ্যত হতেই কোথা থেকে একটা সাদা কিছু এসে দখল করে নেয় শানের নাকের ডগা।ভ্রুকুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে বুঝতে পারে, কাশফুলের গুচ্ছ থেকে বিতারিত হওয়া কোন একটা উড়ন্ত ফুল।খুব সন্তোর্পনে আঙ্গুলে উঠিয়ে নেয় পাখি।হঠাৎ মনে পড়ে, “শরৎ এসে গেছ!”
মোহনীয় হাসিতে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয় অজানার উদ্দেশ্যে।
“খেলা শেষ হয়ে গেলে এবার ওঠো, আমার বুকটা ব্যথা হয়ে গেলো”
“আপনি জেগে আছেন!”,অবাক হয়ে বলে পাখি।
চট করে শান চোখ খুলে ছাদের দিকে চেয়ে বলে, “হুম জেগে আছি।এবার যদি বাঁচাতে চাও তো ওঠো আমি উঠব”
রেগে কটমটে দৃষ্টিতে তাকায় পাখি।
“কী?”
“খুব ভার লাগছে না?”
“তো লাগবে না! এতো বড় একটা মানুষ যদি এভাবে থাকে কার ভার লাগবে না?”
শানের কথায় আরো রেগে যায় পাখি।কপোট রাগ দেখিয়ে উঠে বসে পাশে।শান বুকটা চেপে ধরে উঠতে উঠতে বলে,”তাও আবার মেয়ে মানুষ”
পাখি কোন কথা না বলে উঠে চলে যেতেই শাড়ির আঁচলে টান পড়ে।আঁচলের শেষ মাথা দেখে বুঝতে পারে সেটা শানের হাতের মুঠোয়।
“ছাড়ুন বলছি”
পূর্বের ন্যায় বসে থাকে শান।
“কি হলো ছাড়তে বলছি না?”,চোখ রাঙ্গিয়ে বলে পাখি।
এবার আঁচল ধরে এক টানে কাছে নেয় পাখিকে।হকচকিয়ে ওঠে পাখি।শানের উপর গিয়ে পরে।
মাথাটা হালকা ঝুঁকে শান বলে,”মজা করলাম তো”
চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন হয় পাখির।মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকায়।কপালে গাঢ় চুমু এঁকে শান বলে,”বলছি তো মজা করেছি”
“হুমমম বুঝলাম”,উঠে শাড়িটা আবার সেট করতে করতে বলে পাখি।শান মাথা চুলকে সেদিকে চেয়ে মুচকি হেসে ওঠে।হঠাৎ কি হলো,পাখি চট করে বললো,”কাল রাতের কথা মনে আছে তো?”
ভাবুকের মতো শান পাল্টা প্রশ্ন করে,”কোন কথা?”
“মনে নাই।মায়ের সাথে দেখা করা….ঐ যে… যেভাবে আমি চাই সেভাবে কিন্তু”,কথায় কিছুটা মায়াবি কম্পন তুলে বলে পাখি।যাতে শানের মনের কথা জানতে পারে।
“ওকে, তবে আবারও বলছি আমার থেকে কোন ভালো ব্যবহার এক্সপেক্ট করো না।তখন কিন্তু তোমারও কোন রাখতে পারব না।মাথায় রেখো”,বলতে বলতে বিছানা থেকে নেমে স্লিপার জোড়া পায়ে দেয় শান।ফোনে দুইবার ট্যাপ করে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। পাখি গলা উচিয়ে জোড়ে বলে,”সেটাই যথেষ্ট”
🌸🌸
মুখোমুখি বসে আছে আজ ষোল বছরের পুরোনো দুটি সত্ত্বা।কারো অন্তরে দাউদাউ করছে ঘৃনার আগুন, কারো অন্তরে সন্তানের জন্যে উতলে পড়া হাহাকার।ছেলের দিকে চেয়ে আছে শর্মিলা।চোখ দুটো আজ যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।বহুবছরের তৃষ্ণার্ত চোখ আজ শান্ত ;ছেলেকে এতোটা কাছ থেকে দেখতে পেয়ে। চোখের পলক ফেলতেও ভয় হচ্ছে তার, এই বুঝি সবটা স্বপ্নের মতো মিলিয়ে যায়!
শান শান্ত চাহনীতে নজর ফেলে পাখির দিকে।পাখি শুকনো ঢোক গিলে রাহেলার দিকে একবার তাকায়।চোখে মুখে অসহায়ত্ব বিরাজমান।চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে রাহেলা।তবুও কোথাও অন্তরের অন্তস্থল জানান দিচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটতে চলেছে।খুব কি কঠিন কিছু?
গলায় খাঁকারি দিয়ে পাখি বলে ওঠে,”মা”
সচকিতে চোখ সরিয়ে নেয় শর্মিলা।চশমা টা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে জবাব দেয়,”হ্যা বউ মা, বলো”
চোখে চশমা লাগিয়ে পাখির দিকে ফিরে বসেন তিনি।পাখি বুঝতে পারে না সবটা কীভাবে শুরু করবে সে।
হাত কচলাতে কচলাতে সবার দিকে একবার তাকায়।
উঠে দাঁড়ায় শান।পাখিও উঠে দাঁড়ায় সাথে সাথে।সামনে গিয়ে বলে,”কোথায় যান।আজ না এখানে থাকার কথা…”
“দেখা করতে বলেছো করেছি।এভাবে বসে থেকে থেকে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।শুক্রবারের দিন।নিজের বিকেল ঘুম নষ্ট করে বসে থাকতে পারব না আমি”,গড়গড় করে কথাগুলো বলে পা বাড়ায় শান।পাখি আবারও পথ আগলে দাঁড়ায়।
চাপাস্বরে বলে,”এমন কেন করছেন!একটু বসুন না প্লিজ”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান বলে,”তাড়াতাড়ি”
পাখি আবার হাত টেনে বসিয়ে দেয় শানকে।
“আজ এতোগুলো বছর পর এসবের দরকার ছিলো না বউমা।আমাদের যে সময়গুলো চলে গেছে তা আর ফিরে আসার নয়।আমার নাড়িছেঁড়া ধনের কাছে এ বয়সে এসে নতুন করে অধিকার ফলাতে চাই না”
“এমন কেন বলছেন মা।আপনি তার মা।এখানে নতুন করে আরো কি কোন অধিকারবোধের প্রশ্ন থাকতে পারে”,শর্মিলার পাশে গিয়ে বসে বলে পাখি।
কথার মাঝেই ছ্যাঁত করে ওঠে শান, “আমি মানি না”
মূহূর্তেই চোখ বন্ধ করে ফেলে শর্মিলা।পাশে বসা রাহেলা হাত চেপে ধরে।চোখ খুলতেই দুফোটা জল গড়িয়ে পরে কোলের উপর।পাখি উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে শানের দিকে।
“বাদ দাও এসব মা।তোমায় বলেছিলাম এসবের কোন দরকার নাই।কোন কথাই শুনলে না আমার “,জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলে শর্মিলা।
থমথমে মুখে অসহায় চাহনীতে চেয়ে থাকে পাখি।
“তো আপনি কি ভেবেছিলেন?আমার সামনে এসে বসবেন?কুমিরের কান্না কাঁদবেন আর আমি গলে জল হয়ে যাবো!নো ওয়ে”,রাগ রি রি করে ওঠে শানের শরীর।
পাখি দ্রুত উঠে গিয়ে শানের পাশে কাঁধে হাত রাখে।স্বাভাবিকভাবে বলে,”এভাবে মায়ের সাথে কথা বলতে নেই ডাক্তার সাহেব”
“মা!”,কটাক্ষ করে বলে শান।স্বপক্ষে আবার বলে,”কিসের মা?কার মা?আমার তো কোন মা নেই!সে তো ষোল বছর আগেই চলে গেছে নিজের খায়েশ পূরণ করতে! আর আমায় দিয়ে গেছে বেঁচে থেকেও নরক যন্ত্রনা”
শেষের কথাটায় বেশ শক্ত হয়ে আসে শানের চোখ মুখ।
শর্মিলা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,” আসি মা”
“মা যাবেন না “,অনুনয়ের স্বরে বলে পাখি শর্মিলার সামনে দাঁড়ায়।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,”ছোটবেলায় বাবা মা দুজনকেই হারাই।লাখ লাখ টাকার সম্পদ থাকা স্বত্বেও বড় বাবার সংসারে কাজের মেয়ের মতো কাজ করেছি।বড় মায়ের কতো ঝাঁটার বাড়ি,খুন্তির আঁচ সহ্য করেছি।আপনাকে দেখার পর আমার মা মা অনুভূতিটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সবটা এভাবে শেষ হতে দেবেন না ”
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে পাঁখি।প্রতিটা ফোটা অশ্রু যেন তীরের মতো বিঁধছে শানের কলিজায়।উঠে এসে পাখিকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। শর্মিলার দিকে চোখ রেখে বলে,”ওকে ফাইন।আমি সবকিছু শুনতে রাজি আছি।তুমি আর পাঁচটা রমনীর মতো ছলনাময়ী নও,তাই নিজের এই মূল্যবান চোখের পানি বা অনুভূতি কোন ছলনাময়ীর সামনে খরচ করো না”
শানের কথা শেষ হতে না হতেই শর্মিলা একটা বিষ্ময়কর কাজ বসে।যেটার জন্য উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।কেউ ভাবতেও পারে নি এমন একটা কাজ সে করবে।
“আমি ছলনাময়ী তাই না? “,বুকের আঁচল উন্মুক্ত করে চিল্লিয়ে বলে শর্মিলা।
“এসব আমার ছলনার চিহ্ন বাবা,তাই না?”
শর্মিলার দিকে তাকিয়ে আতকে ওঠে পাখি।দুহাতে মুখ চেপে ধরে। রাহেলা কপালে হাত ঠেকিয়ে সোফায় বসে মেঝেতে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।শান একবার সেদিকে তাকিয়েই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।নজর সরিয়ে ধীরেধীরে বসে পরে পিছনে থাকা সোফায়।
“সময়টা ঠিক এমনিই এক শুক্রবার;বিকেল বেলা।তোমায় দুনিয়া দেখানোর জন্যে জীবন বাজি রেখে প্রসব ব্যথা সহ্য করছি।জীবন যখন ওষ্ঠাগত আমার তখন তোমার কান্নার করুন স্বর কানে ভেসে আসলো।চোখদুটো আর খোলা রাখা সম্ভব হচ্ছিলো না।বুঝতে পারলাম আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসলো।কতোক্ষন কেটে গেছে জানা নেই।যখন জ্ঞান ফিরলো কানে শুধু একটাই কথা ভেসে আসল,’এ সন্তান আমার না।এ সন্তান আমজাদ খানের।’
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।কান্না করার মতো অবশিষ্ট শক্তিটুকুও আমার শরীর ছিলো না।তোমায় বুকে জড়িয়ে নীরব অশ্রু ঝড়িয়েছি।তোমার বাবার অভিযোগের পিছনের কারণ ছিলো তোমার সৌন্দর্য।তার ভাষ্যমতে ‘আমি কালো, আমার সন্তানও হবে কালো।সে কেন এতো সুন্দর হলো!”
হাজার বার তোমার বাবাকে বুঝিয়েছি তুমি আমাদেরি সন্তান। তবুও তিনি আমার সারা গায়ে কলঙ্ক লেপতে কুন্ঠিত হোন নি।তোমার বাবার সাথে বিবাহের পূর্বে আমজাদ খানের সাথে আমার পরিচয় ছিলো।খুব ভালোবাসতাম একে অপরকে।কিন্তু আমার বাবার কাছে হেরে যায় আমার মনের লুকানো অনুভূতি।বউ হয়ে আসি তোমার বাবার সংসারে।বিয়ের পর আমজাদের সাথে কোনরকম কোন সম্পর্ক আমার অবশিষ্ট ছিলো না।তবুও তোমার বাবা তার নাম নিয়ে সবসময় আমায় জড়াতেন।শেষ পর্যন্ত তোমায় অস্বীকার করে মিথ্যে বদনামকে বাস্তবে রূপদানের চেষ্টা করেন।
শুরু হয় আমার উপর অমানবিক নির্যাতন।রাত নেই দিন নেই সবসময় আমায় মারধোর করত।আমার সংসারের শান্তিটাই বিলীন হয়ে গেলো ধীরেধীরে।তবে সময়ের সাথে তোমার বেড়ে ওঠা হয়ে উঠল তোমার বাবার একাকিত্বের সঙ্গী।তোমাকে মেনে নিলেন তিনি।আমিও অতীতের সবকথা ভোলার চেষ্টা করলাম।হারানো সুখ টা ফিরে পেলাম নতুন করে।
কিন্তু কোথাও না কোথাও মনে একটা চাপা কষ্ট থেকে যেতো তোমায় নিয়ে।
নতুন ব্যবসা শুরু করলেন তোমার বাবা।কি ব্যবসা জানতে চাইলে সবসময় এড়িয়ে চলতেন।ব্যবসার সুবাদে মাঝে মাঝে কিছু লোকজন বাড়িতে আসত।
যাদের চাল চলন মোটেও পছন্দ হতো না আমার।এভাবে কিছু মেয়েরাও আসত।বেশভূষায় ভালোভাবেই বুঝে গেলাম এরা কোন ভালো মেয়ে নয়।প্রতিবাদ করলে তোমার বাবার অকথ্য গালাগাল শুনেছি।মার খেয়েছি।বার বার বলেছিলাম,’কি এমন ব্যবসা তোমার যে এরকম মেয়ে ছেলেরা বাসায় আসে?’
উত্তরে বলেছিলো, ‘আমার অনেক অনেক টাকা চাই শর্মিলা’
আস্তে আস্তে জানতে পারলাম তোমার বাবা নারী ব্যসায়ের সাথে জড়িত। নারী দেহ ছিলো তার একমাত্র নেশা,আর সেই নারীদের দিয়ে টাকা কামানোই ছিলো তার পেশা।
এসব শোনার পর তোমার বাবাকে প্রশ্ন করি, ‘এসব কি সত্যি’
তোমার বাবা সেদিন বলেছিলো,’সবই সত্যি, পোষালে থাকো নয়ত চলে যাও’
তোমার হাত ধরে চলে আসার উদ্যত হতেই বুঝতে পারলাম আমি দ্বিতীয় বারের মতো মা হতে চলেছি।বেরি পরে গেলো পায়ে।দুই দুইজন সন্তান নিয়ে ভাইয়ের কাঁধে কী করে বোঝা হবো?বাবা তো বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে পরোপারের টিকেট কেটেছেন। আর আমায় দিয়ে গেছেন বেঁচে থেকেও নরক যন্ত্রনার মতো কষ্ট।
ততোদিনে আমার কিছুই করার ছিলো না। সবটা মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া টু শব্দ করতে পারছিলাম না।তোমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তোমার বাবা আরো বেশি নোংড়া আর হিংস্র হয়ে উঠল।নিজের ছেলেকে জিম্মি করে আমায় ভয় দেখাতেন।চোখের সামনে নিজের স্বামীর এমন নোংড়া লীলা দেখা সম্ভব ছিলো না আমার।এমনও দিন গেছে আমায় পাশের ঘরে তালাবদ্ধ রেখে তোমার বাবা আরেক ঘরে অন্য মেয়ের সাথে সময় কাটিয়েছে।এসব কিছু থেকে তোমাকে যতোটা পেরেছি দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। আমি কখনোই চাইনি তোমরা তোমাদের বাবার আসল রূপ দেখতে পাও।কারণ সেটা ছিলো খুব নোংড়া আর হিংস্র।সমাজের চোখে ততোদিনে তোমার বাবা খুব মহামানবে পরিনত হলেন।আর আমার কষ্টের একমাত্র সঙ্গী ছিলো তোমার রাহেলা চাচি
আস্তে আস্তে টিনা চলে আসলো পৃথিবীতে।তোমার বাবার লোভ আরো তড়তড় করে বেড়ে চলছিলো।তিনি সবসময় শুধু বলতেন তার অনেক টাকা লাগবে।আমি কিছুই বলতে পারতাম না;অসহায় বলে।তোমার বাবা আমার সেই অসহায়ত্বের সুযোগে দিনে দিনে লোকচোক্ষুর আড়ালে নোংড়া ব্যবসাকে আরো বড় করে তুললেন।গোপনেই প্রসার ঘটালেন ব্যবসার।সময়ের সাথে সাথে তার ব্যবহার আরো বেশি পশুর মতো হতে লাগলো।রাতে নেশা করে বাড়ি ফেরা।নেশাগ্রস্থ হয়ে আমার উপর শারীরিক অত্যাচার করা, সিগারেটের আগুনে গা পুরিয়ে দেয়া এসবে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন।অথচ তোমাদের দুই ভাইবোনের সামনে ফেরেসতা সেজে থাকতেন।আর আমিও চাইনি তোমরা সবটা জানো।তাই ভোর হওয়ার সাথে সাথে সব ভুলে তোমাদের যত্নে মন দিতাম।
তুমি বড় হচ্ছিলে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছিলো তোমার বাবার লোভের পরিধি।আমি আর চুপ থাকতে পারছিলাম না।প্রতিবাদ করা শুরু করলাম।মারমুখী হওয়া হাতদুটো আটকে দিতাম,বাড়িতে নোংড়া ব্যবসার প্রশ্রয় দিতাম না।তখন তোমার বাবা তোমার স্কুলের ফিস দেয়া বন্ধ করলেন,বন্ধ করলেন তোমাদের পিছনে এক টাকা খরচ করা।টিনার বাড়তি খাবার বন্ধ করলেন।প্রশ্ন করলে বলতো সন্তাদের পিছনে তিনি টাকা খরচ করবেন না।আমার হাতে লুকানো যা ছিলো তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার সামলিয়েছি।সম্মুখে ছিলো তোমার মাধ্যমিক পরীক্ষা। ফর্ম ফিলাপের টাকা,তোমার প্রাইবেটের বেতন সবটা আমার গলায় কাঁটার মতো বিঁধে গেলো।কারণ আমার হাতের জমানো টা ততোদিনে ফুরিয়ে গেছে।কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।উপায়ান্তর না পেয়ে আবারও হেরে গিয়ে সবটা নিয়তির উপর ছেড়ে দিলাম।
দেখতে দেখতে তোমার ফর্মফিলাপের তারিখ চলে এলো।আকুতি মিনতি করে টাকা নিয়ে তোমার হাতে দিয়েছিলাম ফরফিলাপের জন্যে।আর তোমরা ভাবতে তোমাদের বাবা তোমাদের কতোই না ভালোবাসত।
সেদিন ভর দুপুরে তোমার বাবা দুইজন মেয়ে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন।আমি অনেক অনুনয় করেছিলাম, বুঝিয়েছিলাম তোমার বাবাকে কিন্তু তিনি আমার কোন কথা শুনে নি।সহ্য করতে না পেরে ঐ নোংড়া মেয়ে দুটোকে ধাক্কা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম।রাগে অপমানে তোমার বাবাকে তারা ব্যবসা থেকে বহিষ্কার করবে বলে জানায়।আর তোমার বাবা সেই রাগ আমার উপর তোলে।হাতের কাছের মোটা বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি মেরেছিলো আমায়।এরপর আমার আধমরা শরীরে, বুকে, পেটে , তলপেটে গলগল করে ঢেলে দেয় সদ্য কিনে আনা এসিড। সেদিন তোমার রাহেলা চাচিও বাড়িতে ছিলেন না।আমার টিনা খেলতে গেছিলো আর তুমি স্কুলে।”
কথাগুলো বলতেই চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছিলো শর্মিলার।পাখি এসে তাকে ধরে শান্তনা দেবার বৃথা চেষ্টা করে। শান হাতকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে মেঝের টাইলসের দিকে।
“আরো আছে বউ মা।”,নিজেকে ধাতস্ত করে শর্মিলা আবার বলতে শুরু করেন।
“দুহাতে মুখ ঢেকে কাতরিয়েছি সেদিন। আশপাশ কেউ আসে নি।আসবে কি করে দুপুরের খাবারের পর সবাই ভাতঘুমে ব্যস্ত।আর বাড়ির দরজা জানালা লাগিয়ে তিনি আমায় নির্যাতন করতেন।ঝলসে গায়ের মাংস খসে খসে পড়ে যাচ্ছিলো। গলার নিচ থেকে জ্বলে যাচ্ছিলো।কাটা মুরগীর মতো কষ্ট পাচ্ছিলাম। আর তোমার বাবা পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে সেসব উপভোগ করছিলেন।প্রাণপনে আল্লাহ্’র কাছে চাচ্ছিলাম কেউ একজন আসুক।কেউ একজন আসুক আমার সন্তানদের জন্যে হলেও আমাকে বাঁচতেই হবে।ঐ সময় কলিং বেল বেজে ওঠে।বিরক্তি নিয়ে তোমার বাবা গেইট খুলতে যান। আমি গলা ফাটিয়ে কয়েকটা চিৎকার করে থেমে যাই।এরপর আর কি হয়েছে আমার মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফেরে বুঝতে পারি আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।বুক থেকে পা পর্যন্ত ছাউনির মতো ঢেকে দেয়া আমার শরীর।চোখ খুলে দেখি আমজাদ খান আমার পাশে বসে আছেন।হয়ত আমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন।আমায় চোখ খুলতে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন তিনি।তাকে দেখে স্বভাবতই অবাক হই।এরপর সব ঘটনা খুলে বলেন তিনি
আমার বাড়িতে আমার খোঁজ নিতে,একটি বার দেখা করতে এসেছিলেন তিনি।গেইটে পা রাখতেই তোমার বাবা তাকে আটকে দেয়।আমার চিৎকারে তোমার বাবাকে এড়িয়ে ভিতরে ঢুকে তিনি আমায় ঐ অবস্থায় দেখতে পান।এরপর দ্রুত নিয়ে আসেন হাসপাতালে।
কেটে যায় পুরো একুশটা দিন।এর মাঝে জানতে পারি তোমার বাবা আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন।রাহেলার সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারি তোমার মনে ততোদিনে আমার জন্যে ঘৃনার প্রবালদ্বীপ গড়ে ফেলেছেন তোমার বাবা।আমার কলিজার টুকরা টিনাকেও নাকি আমেরিকা নিয়ে গেছে তোমার কাকা।বেঁচে থাকার মতো কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।অন্যদিকে নিজের ঝলসানো শরীর।এমন সময় বিপদের সঙ্গী হিসেবে পাশে দাঁড়ায় আমজাদ। ওর পরিবারে আশ্রয় দেয়।সাদরে আমায় গ্রহন করে আমজাদের মা ও ছোট বোন।তোমাদের ছেড়ে থাকাটা খুব কষ্ট সাধ্য ছিলো আমার জন্যে।অনেকভাবে অনেকবার তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। প্রতিবারই তোমার বাবার কাছে ধরা পরে যাই।এরপর আমায় ডিভোর্স দেয় তোমার বাবা।আমজাদের কথামতো আইনের সহযোগীতাও নিয়েছিলাম। ততোদিনে তোমার বাবার হাত আইনের সর্বচ্চ চূড়া অবধি উঠে গেছিলো।আমার জন্যে আমজাদ তার চাকরি হারাতে বসেছিলো।আর তোমার বাবা তোমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আমায় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে বাধ্য করেছিলো বাপ।অগত্য সে পথেও আর পা বাড়াই নি।ভাগ্যকে মেনে নিয়ে ছিলাম।
আমজাদের মা বোন থাকা স্বত্বেও সমাজ আমার প্রতি আঙ্গুল তুলেছিলো।কালিমা লেপে দেয় গায়ে।উপায়ন্তর না পেয়ে সর্বজনের সম্মতিতে দ্বিতীয় বারের মতো সংসার শুরু করি আমজাদের সাথে। মানুষ টা ফেরেসতার মতো ঝলসানো এই আমিকে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছে।”
দুহাতে মুখ ঢেকে হুহুস্বরে কেঁদে ওঠেন শর্মিলা।এতোসব শুনে পাখি নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।শর্মিলাকে ধরে কেঁদে ওঠে।শান হতভম্বের মতো ঠাঁয় বসে আছে।শরীরের কোষ গুলো মৃত প্রায়।দুই কান দিয়ে গরম বাতাস যেন সাঁইসাঁই করে বের হচ্ছে।বাবার জন্যে জমানো এতোদিনের সমস্ত বিশ্বাস, ভালোবাসার দেয়ালটা যেন খসে খসে পড়ছে একে একে।নিজের চোখে মায়ের ঝলসানো বুক পেট দেখে কোন কিছুই অবিশ্বাস করার জো নেই।তারপরেও বিশ্বাসযোগ্য নয় এতো ঘৃন্য কাহিনী।
শর্মিলা মুখ মুছে বলে,”তুমি শহরে আসার পর তোমাকে একনজর দেখতে চোখ যেন মরে যাচ্ছিলো।আমজাদ বুঝতে পেরেছিলো দিনে দিনে আমি কতোটা মরে যাচ্ছি ।আমজাদের বোনের বিয়ে হয়ে যায়,মা চলে যায় এরপর আমার জন্যে ঢাকা শহরে তোমার পাশের এলাকায় বাড়ি কিনে নেয়।বাপ আমার, তোমার বাবা পৃথিবীর সবথেকে ঘৃন্য ব্যক্তি ছিলো।সে তার গন্তব্যে পৌঁছেছে।তবে আমার মনের ঘৃনার ঘা গুলো এখনো দগদগে।চাইলেও ভুলতে পারছি না তার দেয়া কষ্ট গুলো।আমার হারানো ষোল বছর!মৃত মেয়েটার মুখটাও দেখতে পারিনি তোমার বাবার জন্যে।
সে বার ইনায়াহ্’র দেখাশোনা করতে টিনাকে আমার কাছে এনেছিলাম তখন আমার শরীরের এই ঝলসানো দাগগুলো নজড় এড়ায় নি আমার মেয়ের।হাউমাউ করে কেঁদেছিলো।ভেবেছিলো নতুন সংসারে সুখী নেই আমি।আমি চাইলেই বরাবরের মতো তোমার বাবার রূপটাকে আড়াল করতে পারতাম।করিনি, কারণ তার পাপের জন্যে নির্দোষ আমজাদ কেন অপবাদ নেবে।সবটা বলেছি আমার মেয়েকে।আর ততোদিনে সবটা বোঝার মতো উপযুক্ত হয়েছিলো আমার টিনা।টিনার মাধ্যমে বার বার সবটা তোমায় জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ততোদিনে আমার জন্যে ঘৃনা ছাড়া কিচ্ছু ছিলো না তোমার মনে।
কিন্তু আমি তো মা।তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাসের খবর নিতাম তোমার রাহেলা চাচির থেকে।তোমার কলেজের প্রিন্সিপাল আমজাদের ফ্রেন্ড তার থেকে।অপেক্ষা করেছিলাম একটা নতুন ভোরের কবে এসে আগের মতো জড়িয়ে ধরবে।কিছুদিন পর জানতে পারি নীরা নামের একটা অসহায় মেয়ের প্রেমে পড়েছো তুমি।খুশি হয়েছিলাম ভীষণ।কারন আমার বিশ্বাস ছিলো কেউ একজন তোমার জীবনে আসবে যে তোমার সমস্ত কষ্ট ঘুচিয়ে দেবে।মনঃস্থির করলাম দেখা করব নীরার সাথে।তার আগেই জানতে পারি নীরাকে তোমার বাবা নিজের বশে করে নিয়েছে।ভীষণ লোভী ছিলো নীরা। সম্পদের লোভ দেখিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করে।হাজার হাজার বার বাড়োন করেছি যেন তোমার সাথে এ অন্যায় না করে। কিন্তু তোমার বাবা আমার কোন কথা শোনে নি।খুব উপদ্রব হয়েছিলো তার।আর আল্লাহ্ উপদ্রবকারীকে পছন্দ করেন না।বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই মৃত্যুর কাছে হেরে যায়।”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় শানের শরীর থেকে আত্মা যেন বেরিয়ে যাবার উপক্রম আজ।মন বলছে মায়ের সবকথা ঠিক। তবুও কোথাও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার বাবা এতো টা নোংড়া ছিলেন।
রাগটা ভেতর থেকে আসলেও মায়ের মুখটা দেখে মিলিয়ে যায় সে রাগ।ঢোক গিলে শান্তস্বরে বলে,”বাবা শহরের বাহিরে থাকত,নেশা করত।আপনার জন্যে কষ্ট পেতো।সবটা তো আপনার জন্যে ছিলো!”
“না।আমার জন্যে নয়।পাছে তার গোপন ব্যবসার খোঁজ তুমি জানতে পারো তাই তিনি শহরের বাহিরে থেকে কাজ চালাতেন।তার ব্যবসা পরবর্তীতে নারী পাচারের মতো জঘন্য ব্যবসায় রূপ নেয়।শহরের বাহিরে থেকে তিনি মেয়ে যোগার করে আনতেন আর মোটা অঙ্কে বিদেশে পাচার করতেন।বর্তমানে যে ব্যবসার একচ্ছত্র মালকিন এখন নীরা।তবুও যদি বিশ্বাস না হয় খোঁজ নিয়ে জেনে নিও।”,ঝনঝনে গলায় বলে শর্মিলা।
চলবে…….