#আসক্তি২
পর্বঃ৪০
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
বিকেল বেলা রাহেলা সহ চায়ের আড্ডায় মগ্ন পাখি।ইনায়াহ্ পাশে বসে কিছু একটা আঁকছে।গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিতেই শান হুরমুর করে বাড়িতে ঢোকে।চমকে যায় সবাই।পাখি দ্রুত কাপটা টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে দাঁড়ায় শানের সামনে।
“কি হয়েছে আপনার?এমন দেখাচ্ছে কেন?”
শান কোন কথার জবাব না দিয়ে ঠোঁটে স্মিত হাসি বজায় রেখে পাখির দিকে চেয় থাকে।পাখি দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,”আরে বলুন না!এমন করে আছেন কেন?”
চট করে শান পাখির কোমড় জড়িয়ে কোলে তুলে নেয়।হাসতে হাসতে বলে, “পাখি আমার জন্যে আজ অনেক খুশির দিন।আমি আজ অনেক অনেক খুশি”
পাখি হকচকিয়ে ওঠে।আড়চোখে পাশে থাকা রাহেলা আর ইনায়াহ্’কে দেখে নিয়ে চাপাস্বরে শানকে কপোট রাগ দেখায়।
“কি করছেন টা কি? ছাড়ুন…. ”
পাখির কথা শেষ হতে না হতেই শান রাহেলার দিকে তাকিয়ে দেখে হা হয়ে তাকিয়ে আছে।রাহেলা মিটমিটিয়ে হেসে নজর সরিয়ে নেয়।উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে,”তা কি এমন খুশি শানবাবা।আমাদের বুঝি বলা যায় না!”
শান বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে চোখ মুখ কুচকে ফেলে।পাখিকে নামিয়ে দিয়ে থতমত খেয়ে বলে,”এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো ”
বলেই ইনায়াহ্’র পাশে গিয়ে বসে।
রাহেলা একটু ঝুঁকে স্বাভাবিকভাবেই বলে,”কি হয়েছে বাবা?এতো খুশি কেন আজ?”
পাখিকে পানির গ্লাস আনতে দেখে শান হাতার বোতাম গুলো খুলতে খুলতে বলে,”আমাদের হসপিটালের যিনি ওনার তিনি আগামি মাসে শিকাগো চলে যাচ্ছেন।মূলত তার ফুল ফ্যামিলি ওখানে চলে যাচ্ছে।আর এখানে যেহেতু কয়েকটা ব্যবসা তার। তার মাঝে হসপিটালটা অন্যতম, সেটার এম ডি হিসেবে আমায় সিলেক্ট করেছেন।”
“সত্যি বলছো!”,
শানের কথায় খুশিতে চকচক করে ওঠে রাহেলার চোখ মুখ।
পাখি ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি এলিয়ে শানের দিকে তাকায়।
“একদম সত্যি চাচি।তবে দায়িত্ব পাইলেই তো আর হয় না।সেটা সুষ্ঠুভাবে পালনও করতে হয়।পদের পাশাপাশি দায়িত্বটাও অনেক বেড়ে গেলো এবার”,বলতে বলতে পিছনে সোফায় গা এলিয়ে দেয় শান।
পাখি উঠে গিয়ে পিছনে দাঁড়ায়। দুই হাতে খুব আলতো করে মাথাটা টিপে দেয়।এতে শানের কোন প্রতিক্রিয়া না থাকায় পাখি নিজের কাজ ভালো ভাবে চালিয়ে যায়।
“চা করে দিবো;আদা দিয়ে?”,প্রশ্ন করে পাখি।
শান দুই চোখের কোণা দুটো দু আঙ্গুলে চেপে বলে, “না থাক, এখন না।পরে..”
রাহেলা ওদের দুজনকে একবার দেখে নিয়ে বলে, “দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার মতো মানুষ আছে তো বাবা”
শান কিছু না বলে মুচকি হেসে রাহেলার দিকে তাকায়।
“চলো আজ ঘুড়তে যাবো।আজ আর হসপিটালে যাচ্ছি না”,বলেই পাখির দিকে তাকায়।
ইনায়াহ্ খুশি হয়ে বলে ওঠে,”জানো মুন সাইন আগে আমরা কতো ঘুড়তে যেতাম।এখন আর সান সাইন নিয়ে যায় না আমাদের”
বলেই মুখে স্পষ্ট অভিমানের ছাপ ফুটিয়ে তোলে।শান একগাল হেসে ইনায়াহ্’কে জড়িয়ে নিয়ে দুই গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলে,”আজ যাবো মাম্মাম।”
পাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার মুন সাইনকে ঘুড়ানো হয় নি ”
পাখি ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি রেখে বলে,”চাচি তুমিও চলো না!সবাই যাই মজা হবে অনেক”
“না মা, তোমরা যাও। আমি বরং বাড়ির কাজগুলো এগিয়ে নেই”,ঠোঁট প্রসস্ত করে হেসে জবাব দেয় রাহেলা।
শান সাথে সাথে বাঁধা দিয়ে বলে,”আজ কিছু রেঁধো না চাচি।আমরা বাহিরে থেকে খাবার নিয়ে আসবো ”
আবার শান প্রশ্ন করে, “চাচি রনি কোথায়?”
“ভাইয়া তো রাখির সাথে ঘুরতে গেছে”,বলেই হেসে দেয় পাখি
“এতো ঘোরাঘুরির কি আছে বুঝি না, কদিন বাদেই তো বিয়ে”
“ওরা রোম্যান্টিক। আপনার মতো না”,কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে পাখি।
শান সরুচোখে সেদিকে তাকাতেই পাখি ফট করে উঠে দাঁড়ায়।ইনায়াহ্’কে তাগাদা দিয়ে বলে,”মা চলো আমরা রেডি হই”
🌸🌸
পার্কে এসে দেখা মেলে ইনায়াহ্’র কয়েকজন বন্ধুর।সাথে তাদের ফ্যামিলি।আর সে এসেই তাদের সাথে মিশে গেছে একদম।শান পাখির হাত টেনে পাশের নির্জন একটা বেঞ্চে বসে। পাখির হাতদুটো হাতের মুঠোয় ভরে গভীর চুমু দেয়।পাখি পরম ভরসায় মাথা এলিয়ে দেয় শানের কাঁধে।
শান সামনের পুকুরের পরিষ্কার পানিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শান্ত স্বরে বলে,”তুমি আমার জন্যে অনেক লাকি”
“কী রকম!”
শান একহাতে পাখিকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,”এই যে আম্মাকে পেলাম।আমার বাবার পাপের শহর গুড়িয়ে দিতে পারলাম।হসপিটালের এমডি’র পদ পেলাম।এসব কি চাখটিখানি কথা!”
পাখি সামান্য হেসে বলে,”এসবই আপনার প্রাপ্য”
“উুহু,তোমার মাঝে কিছু তো একটা আছে।যা সকল মন্দকে পরাস্ত করতে পারে”
“তাহলে আমার সাথে হওয়া মন্দ গুলো কেন পরাস্ত করতে পারি নি ডাক্তার সাহেব”,কাঁধ থেকে মাথাটা উঠিয়ে হতাশ কন্ঠে বলে পাখি।
শান ভ্রু কুচকে পাখির দিকে ফেরে।ভীত সন্ত্রস্ত কন্ঠে বলে,”তোমার কি মন খারাপ? ”
“নাহ,সেরকম নয়।তবে এটা প্রশ্ন আমার।আমার সাথে হওয়া মন্দগুলো কেন ঠেকাতে পারলাম না।সামনে যদি আরো কোন মন্দ থাকে সেগুলোই বা ঠেকাব কিভাব! “,শানের চোখে চোখ রেখে গড়গড় করে কথাগুলো বলে পাখি।
শান পাখির দুই গালে হাত রেখে মুখটা আঁজলা ভরে ধরে বলে,”তুমি সব মন্দকে হারিয়ে এতোদূর এসেছো।যদি তাই না হতো তাহলে তোমার বড় বাবার পরিবারের মতো ডেঞ্জারাস পরিবারে এতোগুলো বছর টিকতে পারতে না পাখি।”
“আব্বু, আম্মুর সাথে হওয়া মন্দ টা তো আটকাতে পারি নি “,
পাখি জানে এই কথাটা পুরোটাই তার নিছক আবেগ মাত্র।কারণ কেউ কখনোই কারো মৃত্যুকে আটকাতে পারে না।
শান চশমার গ্লাস ভেদ করে পাখিকে দেখে নিয়ে বলে,”তাহলে তোমায় পাইতাম কি করে!”
পাখি আর কিছু বলতে পারে না।প্রশান্তির হাসি ঠোঁটে এলিয়ে শানের বাম হাতটা জড়িয়ে কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়।
আদুরে স্বরে বলে,”যতোক্ষণ আপনি থাকেন আমার কোন ভয় থাকে না।আপনি না থাকলে কেমন যেন খালি খালি লাগে।এখন তো আরো ব্যস্ত হয়ে পরবেন”
শান অভয় দিয়ে বলে,”আমি যদি কখনো পাশে নাও থাকি আমার ভালোবাসা সবসময় তোমার সাথে থাকবে পাখি।পরিস্থিতি যাইই আসুক আমি তো তোমায় ছাড়ছি না”
শেষ কথাটা বেশ জোড় দিয়ে বলে শান।
“আচ্ছা যদি কোনদিন আমার সাথে খুব খুব খুব মন্দ কিছু হয় তখনো কি আমায় এভাবেই ভালোবাসবেন?”,জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে শানের দিকে চেয়ে বলে পাখি।
শান ধমকে বলে,”এসব কি ধরনের কথা বার্তা পাখি? কি মন্দ কিছু হবে।আজগুবি এসব চিন্তা করে করেই শরীরের বারোটা বাজাইছো, না?”
“বলুন না প্লিইইজ”,নাকে কান্নার স্বরে পাখি জানতে চায়।
শান বুঝতে পারে এ প্রশ্নের পাখি নিয়ে তবেই খান্ত হবে।
“তোমার শেষ শ্বাসের শেষ বিন্দু পর্যন্ত তোমার সাথে থাকব আমি।কারণ তুমি আমার প্রেম না ভালোবাসাও না তুমি আমার আসক্তি।যাকে এক মূহূর্তও ছেড়ে থাকা যায় না, উহু কিছুতেই না”
পাখি চুপচাপ বসে থাকে।দুজনের দৃষ্টি এখন পুকুরের লাল শাপলা গুলোর দিকে।
হঠাৎ বাম দিক থেকে আসা বাচ্চার কান্নার আওয়াজে দুজনেই সেদিকে তাকায়।ফুটফুটে একটা সদ্য হাঁটতে পারা বাচ্চা নজরে আসে।কান্না করে চোখ ফুলিয়েছে যে।পাখি একবার শানকে দেখে বাচ্চাটার দিকে তাকায়।আশপাশ চোখ বুলিয়ে দেখে কেউ নেই।পাখি দ্রুত উঠে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়।কোলে নিয়ে কিছুক্ষন দোলাতেই একদম চুপ হয়ে যায় বাচ্চাটা।ঠোঁট উল্টিয়ে পাখির দিকে তাকায়।
“তোমার মা কই”,বেশ আদুরে কন্ঠে বলে পাখি।
বাচ্চাটার বয়স খুব বেশি হলে তিন বছর হবে।বয়স বুঝতে পেরেই পাখি এটা সেটা জানতে চাইছে।এদিক সেদিক ঘুরে বাচ্চাটা তার মাকে খোঁজার চেষ্টা করছে।ইতোমধ্যে শান চলে আসে।বাচ্চার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গালে আলতো ছুঁতেই রাগের বলিরেখা স্পষ্ট ফুটে ওঠে বাচ্চাটার চোখে মুখে।শান পাখি দুজনেই অবাক হয়ে যায় তার প্রতিক্রিয়া দেখে।পাখির কোল থেকে হাত বাড়িয়ে শানকে মার দিতে চায় বাচ্চাটা।পাখি এগিয়ে যেতেই শান দূরে সরে যায়।এভাবে দুই একবার করতেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে বাচ্চাটা।ওদের দুজনের খুঁনসুটি বেশ উপভোগ করছে সে।
“ওর মা কই?”,আশপাশ তাকিয়ে বিড়বিড় করে শান।
পাখি বাচ্চাটার গালে আদোর করে বলে,”বুঝতে পারছি না।কিন্তু খুব কিউট না?”
“হুমমম”,মুচকি হেসে বলে শান।
একজন ভদ্র মহিলা সাথে একটি বাচ্চা সমেত এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।তার পিছনে একজন ভদ্র লোককে দেখতে পায় শান।
ওদিকে ইশারা করে বলে,”এরাই নাকি?”
পাখি শানের নিশানা অনুসরন করে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,”ঠিক বলতে পারছি না।আসুক দেখি কি বলে!”,
এর মাঝেই ঐ ভদ্র মহিলা এদিকে দৌঁড়ে ছুটে আসে।পাখির কোল থেকে বাচ্চাটাকে দ্রুত নিয়ে আদোর করে দেয়।বাচ্চাও যেন মায়ের বুকে ফিরে শান্তি খুঁজতেই ঘাড়ে মাথা এলিয়ে দেয়।দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় ইনিই মা।মায়েরা তো এমনিই হয়।
সারা মুখে চুমু খেয়ে ভদ্র মহিলা শান পাখির দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকায়।মুখটা মলিন করে পাখি শানের দিকে তাকাতেই শান ভদ্র মহিলাকে আশ্বস্ত করে বলে,”ভয় পাবেন না।বাচ্চাটা আমাদের পাশে এসে কান্না করছিলো……”
“ঠিকাছে “,শানের কথায় তড়িঘড়ি করে জবাব দেয় ভদ্র মহিলা।তার ভাব দেখে বুঝাই যাচ্ছে তিনি এখনো শান পাখিকে বিশ্বাস করতে পারেন নাই।
পিছনে আরেকটি বাচ্চা সমেত ভদ্রলোক এগিয়ে এসে শানের সাথে হাস্যোজ্বল মুখে মুসাফায়ের উদ্দেশ্যে হাত এগিয়ে দেয়।
“হ্যালো ডক্টর শান”
“হ্যালো,মিস্টার রাজীব “,ঠোঁটে সৌজন্যতার হাসি ফুটিয়ে বলে শান।
“আমার মিসেস।আর বাচ্চাও আমার”,বাচ্চা সহ মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে রাজীব।
শান একগাল হেসে রাজীবের মিসেসের দিকে তাকায়।
“আসলে সদ্য হাঁটা শিখেছে তো বুঝতেই পারি নি কখন এদিকটায় এসেছে।বড্ডো ভয় পেয়ে গেছিলাম”,ভীত কন্ঠে বলে রাজীব।
“মিসেস রাজীব,নেক্সট টাইম একটু দেখে রাখবেন যাতে নিজের দায়িত্বহীনতার দায়ভার অন্যের উপর বর্তাতে না হয়, কেমন!,”
ভদ্র মহিলা চুপসে গিয়ে বাচ্চাকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়।পাখির দিকে একবার তাকিয়ে অন্যত্র চলে যায়।
রাজীব কিছু বলতে উদ্যত হতেই শান পাখির হাত টেনে নিয়ে চলে যায়।
এরপর আরো কিছুক্ষন ইনায়াহ্’কে নিয়ে খেলাধুলা করে শান বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে।পথে সকলের জন্যে রাতের খাবার কিনতে ভুল হয় না।
কিছুক্ষন পর বাড়িতে পৌঁছে যায় তারা।বেশ ফুরফুরে লাগছে আজ পাখির।কেমন যেন ডানা ঝাপটানো পাখির মতো লাগছে।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখে শান ফোনে কিছু একটা করছে।পাখি তোয়ালেতে মুখটা মুছে ভেজা তোয়ালে শানের ফোনের উপর ছুড়ে মারে।
“কি হলো এইটা?”,অবাক হয়ে প্রশ্ন করে শান।
পাখি ড্রেসিং টেবিলের টুলটা টেনে বসতে বসতে বলে,”কি আর হবে!দৈনিক যা হয় তার একটু উল্টো আর কি!”
শান দ্রুত পায়ে বিছানা ছাড়তেই পাখি ফট করে উঠে দাঁড়ায়।চিরুনীটা সামনে তরবারির ন্যায় ধরে বলে,”একদম না বলছি। একদম না।কেমন লাগে হুমমম?যখন প্রতিদিন আমার দিকে ছোড়া হয়!”
শান মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,”দাঁড়াও তোমার কেমন লাগাচ্ছি”
“একটা মার আজ গায়ে পড়লে কিন্তু আমিও আজ মারব”,
“কি বললে, স্বামীর গায়ে হাত তুলবা “,বলতে বলতে এগিয়ে আসে শান।
দুইহাত মুঠোয় ভরে পিছনে মুছড়ে ধরে। সামান্য ব্যথায় চোখ মুখ কুচকে ফেলে পাখি।
“আর বলব না, প্রমিজ প্রমিজ”
শান মিটমিট করে হাসে আর পাখির দিকে চেয়ে থাকে।পাখি আবারও বলে,”আর দুষ্টুমি করব না সত্যি”
শান একগাল হেসে হাত ছেড়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।
“খুব ব্যথা পাইছো?”
“হুমমম, একটু ”
“আচ্ছা সরি”
শানের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে পাখি বলে, “তখনকার বাচ্চাটার কথা মনে আছে আপনার?”
“হুমমম আছে তো”
“কি কিউট না, গোলুমোলু টাইপ”
শান শব্দহীন হেসে দেয় কিছু বলে না।
পাখি মাথাটা তুলে শানের থুতনিতে কপাল ঠেকিয়ে বলে,”ইশ!আমাদের যে কবে হবে, ওমন গোলুমোলু টাইপ একটা।ওহ না না, দুইটা;টুইন হবে।ডাক্তার সাহেব আমার না টুইন বেবি খুব পছন্দ।আপনার মতো দুইটা চাই আমার।”
গড়গড় করে বলে চলেছে পাখি।বলার পরেও শানের কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে পায়ের পাতায় ভর করে একটু উচু হয়ে বলে,”কি হয়েছে কথা বলছেন না যে!”
শান থমথমে মুখে পাখির দিকে চেয়ে থাকে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাখিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে চলে যেতেই সবটা খেয়াল হয় পাখির। কোন কথা ছাড়াই শক্ত করে জড়িয়ে রাখে শানকে।কারো মুখে কোন কথা নেই কিছুক্ষণ।নীরবতা ভেঙ্গে পাখি ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, “আমি ভুলে গেয়েছিলাম ”
“প্রত্যেকটা মেয়েই মা নামোক ছোট্ট শব্দের গভীর অনুভূতি নিয়ে জন্ম নেয়।তোমারও তার ব্যতিক্রম নয়।আমি জানি তুমিও মা হতে চাও। কিন্তু আমি অপারগ।এইসব কারণেই কিন্তু তোমার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি।তোমার এই একটা জিনিসের অভাব আমি কোনদিনও পূরণ করতে পারব না পাখি।সরি “,এক দমে কথা গুলো বলে শান পাখিকে সরিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে।
পাখির ভিতর ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করে। কিন্তু সে ইচ্ছে করে চায় নি ওভাবে বলতে।শানের যে এমন একটা দূর্বলতা আছে তা পাখির মাথাতেই ছিলো না।মনের ভুলে কথা গুলো বলেছে।
“আমি সত্যিই ইচ্ছে করে বলিনি ডাক্তার সাহেব।আমার মনেই ছিলো না সবকিছু”,বলতে বলতে শানের পাশে গিয়ে বসে।বিছানায় রাখা শানের হাতটা নিজের গালে ঠিকিয়ে নেয়।শান শান্ত চাহনীতে পাখির দিকে তাকায়।খুব অসহায় চোখে পাখি ক্ষমা চেয়ে বলে,”বিশ্বাস করুন”
ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি রেখে শান বলে,”আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে বলো নি।তোমার মনেও মা হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আছে।আর সেই আকাঙ্খা থেকেই কথাটা বলেছো…..”
“আমি….”
“আমায় বলতে দাও।আমি কিছু মনে করি নি পাখি।বার বার সরি বলতে হবে না। হুমমম!”
পাখি আরেকটু এগিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে শানের।মাথায় হাত বুলিয়ে শান বলে,”আমরা কোনদিনও বাবা মা হতে পারব না জান।এই সত্যিটা মেনে নাও”
“এই জিনিসটা আর কখনো পূনরাবৃত্তি হবে না। কথা দিলাম”
চলবে…..
#আসক্তি২
পর্বঃ৪১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
দিন চলে যায় নিজস্ব গতিতে।কারো দূঃখ-সুখে তার স্থায়িত্বের হেরফের হয় না।মানুষ বরাবরই মনে করে সুখের সময় গুলো তাড়াতাড়ি কাটে ;আদৌ কি তাই!
সে তো আপন গতিতে অগ্রসর হয়েই চলেছে।
শীতের চাদরে ঢেকে উঁকি দেয় একটা মিষ্টি সকাল।গ্রামে শীতের পরিবেশ টা অনেক সুন্দর হয় শহুরে জীবনের তুলনায়।ঘাসের উপর শিশির বিন্দুর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠা নজর কারে প্রতিটা প্রকৃতিপ্রেমীর।গ্রামে থাকাকালীন এই সময়টা বেশ উপভোগ করতো পাখি।সকাল সকাল বাড়ির পাশের খোলা মাঠটায় কিছুক্ষন খালি পায়ে না হাঁটলে তার দিনই শুরু হতো না।শহরের যান্ত্রিক জীবনে সেসব না থাকলে কি হবে শখ তো ঠিকই আছে।তাই শখ পূরনে পাখি সকালে উঠেই আজ ছাদে এসেছে।এতো সকালে ইদানিং শানও আর ঘুম থেকে ওঠে না।
ছাদে কয়েক প্রজাতির গাছ লাগিয়েছে পাখি।শানও খুশি খুশি সেসব এনে দিয়েছে।একটু হেঁটে এগিয়ে যায় গাছ গুলোর কাছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই পাতায় জমে থাকা পানিগুলো ভালোবেসে ভিজিয়ে দেয় পাখির হাত।বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি জেগে ওঠে।একটু এগিয়ে রেলিং এর কাছে যেতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে,চোখের দুই কোণ কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়।মাথাটা চেপে ধরে সোজা বসে পরে পাখি।এই সমস্যা আজ কয়েকটা দিন ধরেই হচ্ছে তার। শানকে যদিও বুঝতে দেয় নি তবুও দিনে কয়েকবার করে জানতে চেয়েছে শরীর খারাপ কিনা।
আর পাখি বরাবরই ব্যপারটাকে এড়িয়ে যায়।
ইদানিং খাবার দেখলে কেমন যেন বমি বমি পায় পাখির।বেশি কোলাহল পছন্দ হচ্ছে না।খাবারে রুচি নষ্ট হওয়াতে শরীরেও তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।দিনকে দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে।কারো সঙ্গ ভালো লাগছে না।যদিও ব্যপারগুলোর সাথে পাখির পূর্বপরিচয় ছিলো না তবুও এ ছোটখাটো ব্যপার শানকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করে নি।কারণ জানালেই একগাদা ঔষধ এনে ঘরে রাখবে।
🌸🌸
আজ রনি-রাখির বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হবে।আবারও বৈঠকে বসেছে সকলে।পাখি, রাখির পাশে বসে বসে সবার কথা শুনছে।কেমন যেন সবকিছুই বিরক্ত লাগছে পাখির।বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ মুখেও দেখা যাচ্ছে।শান সেদিকে আড়চোখে চেয়ে ভ্রুকুটি করে নেয়ে।তবে কিছু বলে না।
অনেক আলোচনার পর আগামী মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার অর্থাৎ ১৪ তারিখে বিয়ের দিন নির্ধারন করা হয়।
শানের ফোনে কারো কল আসায় শান উঠে চলে যায়।হঠাৎ বমির উপক্রম হয় পাখির।মুখ চেপে ধরে সংবরনের চেষ্টা করে। সবাই আতঙ্কিত চোখে তাকায় পাখির দিকে।সকলের দিকে একবার তাকিয়ে পাখি ওয়াশরুমের দিকে ছোটে।শর্মিলা, রাহেলা, রাখি সবাই পাখির পিছনে ছুটে আসে।
কিছুক্ষণ পর পাখি বেরিয়ে আসলে শর্মিলা কপালে, গালে হাত দিয়ে ভয়ার্ত মুখে প্রশ্ন করে,”বউ মা তোমার কি শরীর খারাপ?”
“না মা,সেরকম টা নয়”, কন্ঠের স্বর খাঁদে ফেলে জবাব দেয় পাখি।
রাহেলা শর্মিলাকে কি যেন ইশারা করে।শর্মিলা চট করে বলে, ” মা পিরিয়ড হয়েছে লাস্ট কবে?”
পাখি লজ্জায় এদিক সেদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয়।রাখি এসে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,”আন্টি আমি দেখছি”
রেহানা হক বেশ বিচক্ষণ মানুষ।তিনি একদৃষ্টে পাখির আগা-গোড়া দেখে চট করে বলেন, “না, আমি কথা বলছি পাখির সাথে”
বলেই হাত টেনে নিয়ে যায়।পাখি হকচকিয়ে পিছন ফিরে সবার দিকে দেখে নেয়।ঠোঁট উল্টিয়ে রাখির দিকে তাকায়।
“পাখি বমি কি আজই প্রথম হলো?”, পাখির দিকে ঝুঁকে এসে বলে রেহানা।
চকিতে মাথা তুলে কম্পিত দৃষ্টিতে চেয়ে পাখি বলে,” না, আজ কয়েকদিন ধরেই এমন হচ্ছে”
“আরো কোন সমস্যা? ”
“সমস্যা বলতে, খাবার দেখলেই কেমন যেন উল্টি আসে,বমি বমি লাগে,গা গুলিয়ে আসে।”
“আর?”, আগ্রহ ভরা চোখে প্রশ্ন করে রেহানা।
পাখি একবার তাকিয়ে রেহানাকে দেখে নিয়ে বলে,” মাথাটাও চক্কর দিচ্ছে ক’দিন ধরে”
“গত মাসে কি মিস গেছিলো মা?”
পূনরায় লজ্জায় পরে যায় পাখি।রেহানা ওর হাত দুটো ধরে আশস্ত করে বলে,”তুমি তো আমার মেয়ের মতো।আর মাকে সব কথাই বলা যায়”
“না, মিস যায় নি।হয়েছিল তবে বরাবরের মতো না”
রেহানা হেসে ওঠে।পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”নতুন কিছুর জন্যে তৈরী হও মা”
পাখি বুঝতে পারে না রেহানা ঠিক কি বোঝাতে চাইছে।অবুঝের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
রেহানা সেখানে আর এক মূহূর্ত দেরি না করে সবার মাঝে চলে আসে।
“আপা মিষ্টি নিয়ে আসেন”, শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে রেহানা।
শর্মিলার চোখমুখ খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে।রনি আর খান সাহেব একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।কারণ তারা কিছুই বুঝতে পারছে না।ইনায়াহ্ রনির কোলে বসে সবার দিকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে সবটা।
একটু পরে পাখি চলে আসলে রাখি গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,” কংগ্রাচুলেশনস ডার্লিং ”
পাখি মুচকি হাসি দিয়ে রাখির দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
শর্মিলা উঠে এসে পাখিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।ছলছলে চোখে বলে,”আমিও ধারনা করেছিলাম আমি দাদি হতে চলেছি”
বুক কেঁপে ওঠে পাখির।সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় মূহূর্তে।এইখানে উপস্থিত কেউ না জানুক সে তো জানে এটা আদৌ সম্ভব নয়।চোখে মুখে বিষাদের তিক্ত বলিরেখা স্পষ্ট হয় পাখির।আনমনে বিড়বিড় করে,”এটা কি করে সম্ভব?কোথাও কোন ভুল নিশ্চই হচ্ছে।আমি কোনদিনও মা হতে পারব না”
“আমরা তো অভিজ্ঞতা থেকে বললাম। তবে তুমি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে টেষ্ট করিয়ে নিও পাখি”,রেহানার কথায় পাখি সম্বিৎ ফিরে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়।রাহেলা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বলে,” অনেক সুখী হও মা”
শর্মিলা একটু এগিয়ে এসে সোফায় বসা রনি আর খান সাহেবকে খবরটা দিতেই খুশিতে লাফিয়ে ওঠে রনি।ইনায়াহ্’র কাছে গিয়ে শর্মিলা বলে,”দাদুভাই তোমার একটা ছোট্ট বোন আসতে চলেছে”
ইনায়াহ্ দৌঁড়ে গিয়ে পাখির কোমড় জড়িয়ে ধরে।খুশি হয়ে বলে,”আমার ফ্রেন্ডদের সবার ছোট বনু, ভাই আছে।আমারই ছিলো না মুন সাইন।এখন আমারও হয়ে গেছে…..ইয়েএএএ”
এতোসবের কোন প্রভাবই পাখির উপর পরছে না।সে জানে সে কখনোই মা হতে পারবে না।তাহলে তার শরীর খারাপের কারণ কি?
“মা আমি একটু ঘরে যাই।শরীর খারাপ লাগছে”, দূর্বল চিত্তে জানিয়ে পাখি উপরে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হয়।
খান সাহেব বলে ওঠেন,” হ্যা মা তুমি উপরে যাও।আর বেশি উঠা নামা করো না।রেষ্ট করো তুমি”
পাখি স্মিত হেসে মাথাটা হালকা বামে হেলিয়ে উপরে চলে যায়।
🌸🌸
“আমার একটা হেল্প করতে পারবি?”
“কি হেল্প, বল না”
“আজ আসার সময় একটা প্রেগন্যান্সি স্ট্রীপ নিয়ে আসতে পারবি?”
“সেটা তো তোর ডাক্তার সাহেবও এনে….. ”
“আমি তোকে বলেছি না, তুই নিয়ে আসবি”
“ওকে ”
বলেই কল কেটে দেয় রাখি।
পাখি সমানে ঘরের মেঝেতে পায়চারী করছে।
এমডি’র পদে প্রোমোশন হওয়ার পর শানের ব্যস্ততা বহুগুনে বেড়ে গেছে।খুব একটা সময় এখন আর বাসায় দিতে পারে না সে।গত রাতে শানকে সবটা বলতে চেয়েছিলো পাখি কিন্তু শান রাতে বড্ডো ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে।পরে আর কিছু বলা হয় নি।আর আজ সকালেও বেশ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় ।
সকাল ১১ টার দিকে রাখি চলে আসে।পাখি হন্তদন্ত হয়ে রাখির থেকে কীটটা নিয়ে নেয়।অবাক চোখে চেয়ে পাখির কান্ড দেখে রাখি।
কিছুক্ষন পর ওয়াশরুম থেকে থমথমে মুখে বের হয় পাখি।
“কিরে…..না?”
পাখি কিছু না বলে কীটটা এগিয়ে দেয় রাখির দিকে।খুশিতে ঝলমল করে ওঠে রাখির চোখ মুখ।পাখি বিরসবদনে সিঙ্গেল সোফাটায় গিয়ে বসে।হাতে কপালে ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
“আমি কালও দেখেছি তোর মন খারাপ ছিলো,আজও দেখছি মন খারাপ।ব্যপার কি বলতো?তুই কি এখনি বাচ্চা নিতে চাস না?”, পাখির পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে রাখি।
পাখি মাথা তুলে তাকিয়ে রাখির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলে,” এটা কোনভাবেই সম্ভব না রে রাখি।আমি কোনদিনও মা হতে পারব না।কারণ ডাক্তার সাহেব কোনদিনও বাবা হতে পারবেন না”
রাখির মাথায় বাজ পরে যায়।পায়ের তলার মেঝেটা নড়বড়ে মনে হচ্ছে।হাঁটু গেড়ে বসে বলে,”এসব কি বলছিস তুই?”
“হুমম, ঠিকই বলছি।এক্সিডেন্টে উনি বাবা হওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে”
“আগে জানতি?”
“হ্যা সবটা জেনেই বিয়ে করেছি আমরা”
অবাক হয় রাখি।সবটা জেনে কি করে কোন মেয়ে বিয়েতে জড়াতে পারে এটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর পাখি ছলছলে চোখে বলে,”এটা কি হলো রে রাখি।উনি কি আমায় ভুল বুঝতে চলেছেন?”
রাখি বুঝতে পারে না এই সময় পাখিকে কি বলে শান্তনা দেয়া উচিত।রাখিকে নিরুত্তর দেখে পাখি আবারও বলে,”আমার তো নিয়মিত…..”
“শোন, মা বলেছে অনেকের নাকি নিয়মিত পিরিয়ডের পরেও প্রেগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।তবে প্রেগন্যান্সির তিন চার মাসে এসে সেটা টোট্যালি বন্ধ হয়ে যায়।”
পাখি মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে।
“বিশ্বাস কর রাখি, ডাক্তার সাহেব ছাড়া আমি কোন পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই নি”, কেঁদে কেঁদে বলে পাখি।
কপোট রাগ দেখিয়ে রাখি বলে,” এসব কেউ তোকে বলেছে?এতো নোংড়া চিন্তা তোর ব্যপারে কেউই মাথায় আনবে না”
“আমি কি করব রে?”, অসহায় চাহনীতে তাকায় রাখির দিকে।
রাখির মনে এখন আরেকটা দূঃচিন্তা ছেঁয়ে যায়,” পাখি যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে গর্ভে কি?অন্য কোন রোগ বাসা বেঁধে নেই তো?”
“কিছু বলছিস না কেন!কি করব আমি?”
পাখির ডাকে ভাবনায় ছেঁদ পরে রাখির।হকচকিয়ে নজর ঘুরিয়ে বলে,”আচ্ছা ভাইয়ার যে এই প্রবলেম সেটা কিভাবে জানলো?”
“এক্সিডেন্টের পর তার বাবা নাকি বলেছে।”
“রিপোর্ট গুলো কোথায়?দেখাতে পারবি?”
“কেন?কি করবি সেসব দেখে”
রাখি উঠে দাঁড়িয়ে ভাবুকের মতো বলে,”শোন, যে মানুষটা গুছিয়ে এতোটা মিথ্যে বলতে পারে আর সে মিথ্যেকে ষোল টা বছর সত্যি বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারে তার কাছে এটা কোন ব্যপারই না।এমনও তো হতেই পারে নীরাকে বিয়ে করার জন্যেই তিনি তোর ডাক্তারকে মিথ্যে বলেছে”
“উুহু,উনি নিজেই রিপোর্ট দেখেছে আর আমাকেও দেখিয়েছে।সেখানে স্পষ্ট লেখা তিনি বাবা হওয়ার এবিলিটি হারিয়ে ফেলেছে।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কিভাবে কি হলো রাখি!তাকে কি জবাব দেবো আমি? “, শেষের কথাটা বেশ আতঙ্কিত ও ভয়ার্ত কন্ঠে বলে পাখি।
🌸🌸
সারাদিনের দূঃচিন্তায় শরীরের অবস্থা আরো খারাপের দিকে এগিয়েছে পাখির।বিছনা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছে না ।কেমন যেন অবসাদ অবসাদ লাগছে।রাহেলাও পাখির কাছে ইনায়াহ্’কে তেমন একটা ঘেঁষতে দেয় নি।প্রথম প্রথম সবকিছুই খারাপ লাগে ভেবে পাখিকে একা থাকতে দিয়েছে।
শান আজ সন্ধ্যেবেলা বাড়ি চলে আসে।ড্রয়িংরুমে ইনায়াহ্ পড়ছে আর রাহেলা বসে বসে সেসব দেখছে।
” পাখি কোথায় চাচি?”
সহাস্যে রাহেলা জবাব দেয়,”ঘরে শুয়ে আছে বাবা”
“এই অবেলায় শুয়ে…!”, ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে শান।
রাহেলা হয়ত বুঝতে পারলো,পরোক্ষনে জবাব দিলো,” এ সময় এরকম একটু আকটু হয়।তুমি ঘরে যাও বউ মা’র সাথে থাকো সবসময়।”
শান কিছুই বুঝতে পারলো না।
“কি হয়েছে চাচি, ওর কি শরীর খারাপ?”
“ঘরে যাও বুঝতে পারবে”, মিটমিট করে হেসে জবাব দেয় রাহেলা।
শান আর কিছু না বলে উপরে চলে যায়।ঘরের দরজায় পা ফেলে সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই বুঝতে পারছে না।ফোনের লাইট জ্বালিয়ে ঘরের সুইচ টিপতেই পাখি ফট করে শানের দিকে ফেরে।হতবাক হয়ে যায় শান।দৌঁড়ে পাখির কাছে চলে যায়।
” এই কি হইছে তোমার, পাখি….দেখি এদিকে ঘোরো দেখি ” হন্তদন্ত হয়ে বলে পাখির মুখটা ঘুরিয়ে দেয়।চোখ মুখে ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। চোখের পাতায় এখনো পানির কয়েকটা বিন্দু।
শান সেগুলো দুহাতে মুছে করূন চাহনীতে বলে ,”কি হইছে তোমার? এভাবে কেন কেঁদেছো?”
পাখি নিজেকে ধাতস্ত করে সাবধানে একটু সরে আসে শানের থেকে।শান ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে আবারও নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়।
“ক’দিন ধরে খুব ব্যস্ততার মাঝে আছি জান।তোমার দিকে খেয়াল করার সময়ই পাই নি।সরি আর কখনো এমন হবে না”,বলতে বলতে পাখিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
শানের বুকে মুখ গুঁজে হুহুস্বরে কেঁদে ওঠে পাখি।যে কান্না শানের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে তোলে।মাথা বরাবর চুমু দিয়ে বলে,” বলছি তো আর কখনো হবে না”
পাখির কান্নার বেগ দ্বিগুন বেড়ে যায়।মনে মনে বলে,”সত্যিটা জানলে আমায় ভুল বুঝবেন নাতো?এই বুক থেকে আমায় সরিয়ে দিবেন নাতো?”
ভাবতে ভাবতে শানের কলার শক্ত করে চেপে ধরে পাখি কেঁদে ওঠে।
একটু পরে শান ওকে বুক থেকে সরিয়ে সামনে বসিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।হাসির রেখা ঠোঁটে এনে বলে,”এতো সামান্য কারনে মন খারাপ করে কেউ হুমমম”
পাখি পানিতে টইটম্বুর চোখ দুটো তুলে তাকায় শানের দিকে।
“ওকে ওকে সরি, এটাই বিরররররাট কারণ মন খারাপ করার”, দুই হাতে কানে চিমটি কেটে বলে শান।
পাখি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওঠে।শান কপালে একটা চুমু দিয় বলে,” এভাবে কেঁদো না। আমার খুব কষ্ট হয়”
“একটা কথা বলব?”, কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে পাখি।
শান পাখির দুইহাত হাতের মুঠোয় ভরে বলে,” হাজার টা”
ইতস্ততভাবে পাখি নজর এদিক সেদিক করে।
“কি হলো, বলো না কি বলবা?”
“আপনি কি কখনোই বাবা হতে পারবেন না?”, চোখ মুখ খিঁচে কথাটা উগড়ে দেয় পাখি।
শান চট করে ওর হাত দুটো মুক্ত করে উঠে দাঁড়ায়।শুকনো ঢোক গিলে বলে,” সেদিন না বললে এ কথার পুনরাবৃত্তি হবে না কখনো।আজ আবারও…..!এই কারণেই আমি বিয়ে নামোক সম্পর্কে জড়াতে চাই নি পাখি”
পাখি একরাশ বিব্রতবোধ নিয়ে শানের কাঁধে হাত রেখে বলে,”কোথাও কোন ভুল হচ্ছে নাতো!”
“কি রকম?”,পাখির দিকে মুখ করে বলে শান
পাখি শুকনো ঠোঁটটা জিহ্বায় ভিজিয়ে বলে,” এমনও তো হতে পারে আপনার মেডিকেল রিপোর্টটা ভুল।”
ভ্রুকুচকে পাখির দিকে তাকায় শান।পরোক্ষণে হেসে বলে,”আমরা মিরাকলে বিশ্বাস করি।তুমিও তাই চাইছো আমি বুঝতে পেরেছি”
“না মানে, সেরকম টা নয়।আপনার বাবা যেমন এতো বড় একটা সত্যি হাজার হাজার মিথ্যে দিয়ে এতোগুলো বছর লুকিয়ে রাখতে পেরেছেন তেমন যদি আপনার মেডিকেল রিপোর্টের ব্যপারেও হয়!”
কুঞ্চিত ভ্রুজোড়া সোজা করে শান বলে,”তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি”
“যদি জানতে পারেন আপনার বাবা মিথ্যে বলেছে যে, আপনি কোনদিনও বাবা হতে পারবেন না তখন কি কর……”
“যদি এরকম টা হয় তাহলে পৃথিবীতে আমার থেকে খুশি মনে হয় না আর কেউ হবে।কিন্তু সেটা হবে না জান”, পাখির মুখটা দুইহাতে তুলে বলে শান
একটু সরে এসে হাতের ঘরিটা, চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে,” রিপোর্টে আমি নিজেও চোখ বুলিয়েছি।ফলাফল শূন্য।রিপোর্টে স্পষ্ট সবটাই লেখা আছে”
বলেই পাখির নাকটা টেনে দেয় শান।সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলে দিতে ইশারা করে বলে,”এক্সপেকটেশন কিলস হ্যাপিনেস….তাই এই আশাটা রেখো না।তবে তুমি চাইলে আমরা অন্য ব্যবস্থা নিতে পারব”
পাখি শার্টের বোতাম খুলে শার্টটা খুলে দেয়।চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ তার।ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে,”আমি তো কোন অন্যায় করি নি তাহলে ভয় কেন পাচ্ছি?”
আপনাআপনি হাতটা পেটের উপর চলে যায় পাখির।একদৃষ্টে মেঝের দিকে তাকিয়ে ভাবে,”তাহলে আমার পেটে কি!”
“কিসের এতো দূঃচিন্তা করছো?দেখেছো শরীরের অবস্থা কি হয়েছে তোমার?কিছু জিজ্ঞেসা করলেও বলছো না।আমায় কাছে ঘেঁষতেও দিচ্ছো না তেমন”
শানের কথায় চমকে ফিরে স্মিত হেসে পাখি বলে,”কিছু না”
🌸🌸
আধাঘন্টা পর শান ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়।তোয়ালে টা এগিয়ে দেয় পাখির দিকে।বিছানায় বসে মাথা এগিয়ে বলে,”আমি একজন ডাক্তার পাখি।ভুলে যেও না।কোন সমস্যা হলে তোমার আমার সাথে শেয়ার করা উচিত”
পাখি মাথাটা মুছিয়ে এগিয়ে যায় ড্রয়ারের কাছে। ভাবতে থাকে কিভাবে সে কি করবে?কিভাবে জানাবে শানকে।
শান যদি ভুল বোঝে!ভুল বুঝে সারাজীবনের মতো ত্যাগ করে!
এমন হাজারও দ্বিধাদ্বন্দে পরে যায় পাখি।
শান একটু এগিয়ে এসে দেখার চেষ্টা করতেই পাখি শানের মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ায়।
কাপা কাপা হাতে স্ট্রিপ নিয়ে আবারও ওয়াশরুমে চলে যায়।তখনও প্রেগন্যান্সি পজিটিভই আসে।আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরে পাখি।দরজা চাপড়িয়ে শান উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,”পাখি কি হলো তোমার?দরজা খোল?”
দুই তিন বার দরজা ধাক্কাতেই ফট করে দরজা খোলে পাখি।
চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে পুরো।থমথমে মুখে হাতের স্ট্রিপ টা এগিয়ে দেয় শানের দিকে।শান হাত বাড়িয়ে সেটা নেয়।
চলবে……..