#আসমানী
#পর্ব_২০
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“কোনো মানুষ কি জীবনে সবদিক দিয়ে পারফেক্ট হয়?হয় না।আমিও হই নি।কি ছিল না আমার?ভালো স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি সবই ছিল।আমি পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট একটা জবও করতাম।টিউশনিও করতাম।ভালোই আয় ছিল আমার।তবুও সে মানলো না।সে আমাকে চাইলো না।কিসের কমতি ছিল আমার মধ্যে?আমার পরিবার নেই বলে?আমার মা-বাবা নেই বলে?জানো তোমরা ঐ মেয়ের বাবা আমাকে কি বলেছিল?বলেছে আমি নাকি জা*র*জ।আমি অনাথাশ্রমে ছিলাম বলেই নাকি আমি জা*র*জ, বেজন্মা।আমার মায়ের চরিত্র নিয়ে আমাকে কথা শুনাতে ছাড়লো না ওরা বাবা মেয়ে মিলে।আমি মানছি আমার মা নেই।জানিনা আমার মা কে,কোথায় আছে।আমাকে কীভাবে জন্ম দিয়েছে আর কেনই বা অনাথাশ্রমে ফেলে এসেছিল আমি তাও জানিনা।মা আমার।জন্ম দিয়েছে আমাকে।ঠকিয়েছে আমাকে।যদি তাকে খারাপ বলার অধিকার কারো থাকে,তাহলে সে হচ্ছি শুধু আমি।তাকে গালি দেওয়ার অধিকারও শুধুই আমার।ওরা বাবা মেয়ে কোন দেশের কি?ওর বাপের মেলা টাকা।আমার অতো টাকা নেই।শুধুমাত্র এই কারণে আমাকে রিজেক্ট করে দিল।সবার সামনে আমার পরিচয় নিয়ে কথা শোনালো।যারা জানতো না আমার পরিবারের কথা,তারাও সব জেনে গেল।তারাও আমার থেকে দূরে সরে গেল।আমি বন্ধুমহলেও সবার থেকে দূরে সরে গেলাম।সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।একদিন আমি এতো টাকা ইনকাম করবো যে আমার পিছনে মেয়ের বাবারা লাইন দিয়ে রাখবে।আমি আমার কাজটাকে তাই ভিন্ন পথে শুরু করলাম।নাহিদ ভার্সিটি থেকে বের হয়ে চাকরির পিছনে ছুটলো কারণ ওর একটা পরিবার ছিল।কিন্তু আমার কোনো পিছুটান নেই।আমিই সবাইকে লিড দিতাম।দলের অনেকেরই টাকার লোভ ছিল।আমি সেই সুযোগটাই কাজে লাগালাম।এই দুনিয়ায় ভালো মানুষের কোনো মূল্য থাকে না।কোনো মূল্য থাকে না।আমি যার তার টাকা ছিনতাই করা শুরু করলাম।ধীরে ধীরে আমার লোভ বেড়ে গেল।আমি ছোট ছোট বাচ্চাকেও এই কাজে লাগালাম।ওদেরও অনেকে আমার মতোই অনাথ।ওদেরও পেট আছে,ক্ষিধে আছে।কিন্তু তোমাদের এই সভ্য সমাজের সভ্য মানুষদের কানে ওদের এই কান্নার শব্দ ঢুকে না।আমি অনেক টাকার মালিক হয়ে গেলাম।তারপর আবার প্রস্তাব নিয়ে গেলাম ঐ মেয়ের বাবার কাছে।কিন্তু উনি সেইবারও আমাকে কুকুরের মতো দুরদুর করে তাড়িয়ে দিল।আর ঐ মেয়েটা আমাকে যা নয় তা বলে গালিগালাজ করলো।আমার নারী সমাজের উপর ঘেন্না এসে গেল।এরপর আমি মেয়েদের পাচার করা শুরু করলাম।চড়া দামে মেয়েদের আমি বাইরের দেশে বিক্রি করে দিতাম।আর কিছু কিছু মেয়েকে আমি প*তি*তা*ল*য়ে বিক্রি করে দিলাম।আমার সেই ভালোবাসার মানুষটাকেও আমি কিডন্যাপ করে চড়া মূল্যে কোনো এক পাড়ায় বিক্রি করে দিয়েছে।এখন শা*লী বুঝে কত ধানে কত কত।আমার নিষ্পাপ ভালোবাসার কোনো মূল্য দেয়নি আর এখন প্রতি রাতেই কত পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে হয় তাকে।”একদমে কথাগুলো বলে শয়তানের মতো হাসতে থাকে আরিয়ান।
তারপর কি মনে হতেই নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে,”স্যরি বস,যদিও এখন আর তুমি বস নেই।তোমার জায়গায় আমিই বস।সবাই আমাকেই বস মানে।যদিও আমি তোমাকেই বস মানি এবং বলি।তারপরও স্যরি যে আমার জন্য তুমি ফেঁসে গেলে।কতদিন আমাকে আঁটকে রাখবে ওরা?এই দুই এক বছর।তারপর ছেড়ে দিবে।তারপর আমি তোমাকেও বের করবো।চিন্তা করোনা তুমি আমি ঠিকই….”
কথা শেষ করতে পারে না আরিয়ান।তার আগেই আয়ুশ ওর মুখে সজোরে ঘুষি মারে।আরিয়ান চেয়ার সহ পড়ে যায় ফ্লোরে।তবুও তার মুখে তৃপ্তির হাসি
সে যে কোনো অপরাধ করেছে,সেটা তার মুখ দেখে বুঝার কোনো অবস্থা নেই।
আসমানী আরিয়ানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নাহিদের দিকে তাকায়।নাহিদ তখনো তাকিয়ে আছে আসমানীর দিকেই।আসমানী তাকাতেই একটু মুচকি হেসে বলে, “আমি বলেছিলাম না আসমানী,আমি তোমার পরিবারকে মারিনি?আমি তাদের চিনিও না।তবুও আমি দোষী।কারণ আমিই সবকিছুর মূল।আমি দোষী কারণ আমি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলাম।আমায় যে শাস্তি দিবে,আমি মাথা পেতে নিব।কিন্তু দয়া করে এটা বলোনা যে আমি তোমার বাবা-মা আর ভাই-বোনের মৃত্যুর জন্য দায়ী।প্লিজ এটা বলো না।আমার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখো না।”
আসমানী জলভরা চোখে উঠে চলে যায় সেখান থেকে।নিজের প্রতি কেমন ঘেন্না হচ্ছে তার।নিজের হাতে সে তার স্বামীকে গুলি করেছে।সে তার ভালোবাসার মানুষকে গুলি করেছে কিন্তু সে সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল।রাগ,ক্ষোভ আর অপরাধবোধে আসমানী নিজের হাত দিয়ে সজোরে ঘুষি মারে দেয়ালে।সাথে সাথে হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে।তার বাবার কথা সে রেখেছে।তার পরিবারের খুনীকে সে শাস্তি দিয়েছে।কিন্তু সে অন্য একজন ভালো মানুষের উপরও অন্যায় করেছে।ফ্লোরে বসে চিৎকার করতে থাকে সে।কিভাবে ক্ষমা করবে সে নিজেকে?যদি তার স্বামী মারা যেতো তার গুলিতে তবে কি সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতো?তার হাতে যদি একজন নির্দোষ মানুষের খুন হতো,তবে কি সে পারতো নিজে এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে?”
★★★
বাবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নাহিদ।সামনে তার বাবা-মা আর ভাই-বোন দাঁড়িয়ে আছে।অনেক অনুরোধ করে তার সাথে দেখা করতে এসেছে তারা।আসার আগে সবাই ভেবে এসেছিল কত কথাই বলবে তাকে।কিন্তু সামনা-সামনি এসে যেন মুখের কথা সব ফুরিয়ে গেছে।মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছে।নাতাশা মাথা নিচু করে আছে।নাবিল ভাইয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আর বাবা নির্বিকার।
নীরবতা ভেঙে নাহিদই বলে, “আমায় বকবে না বাবা?”
নাসিরুদ্দিন সাহেব মাথা তুলে বলে,”তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি বাবা।আমি তোমাকে বকা দিব কেন?”
বাবার মুখের এমন কথা হজম করতে পারেনা নাহিদ।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু।তার দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।তবুও সে দাঁড়িয়েই আছে।
নাসিরুদ্দিন সাহেব একটু খানি গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,”তোমার মনে আছে বাবা,ছোট বেলায় তোমাকে একটা গল্প মাঝেমাঝেই শুনাতাম।একজন মানুষের গল্প।যে মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসতো।সে সবচেয়ে বেশি খুশি হতো যদি তার বাড়িতে কোনো মুসাফির আশ্রয় নিতে আসতো।মনে আছে তোমার?একদিন এক মুসাফির এলো।মানুষটি ভীষণ খুশি হলো।তাকে যথাসম্ভব আপ্যায়ন করলো।তার সামনে খাবারের থালা রাখলো।কিন্তু লোকটি বিসমিল্লাহ বলে না খাওয়ার মানুষটি বুঝে গেল লোকটি আমাদের ধর্মের না।লোকটি বিধর্মী।মানুষটি রেগে তার সামনে থেকে ভাতের থালা কেড়ে নিল।তাকে পানিও পান করতে দিল না।পানির গ্লাসও কেড়ে নিল।তারপর তাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিল।কেন?শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মের মানুষ হওয়ায়। এরপর আল্লাহ লোকটির উপর নারাজ হলো।তাকে বললো,”খাওয়ার দেওয়ার মালিক তো আমি।তুমি কে তার থেকে খাবার কেড়ে নেওয়ার?সে ভালো হোক,মন্দ হোক সে আমার বান্দা।এতো বছর সে আমাকে ডাকেনি।তবুও তো আমি তার মুখের খাবার বন্ধ করিনি।তাকে সময় মতো রিজিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।তাহলে তুমি কেন এতো বড় অধর্মের কাজ করলে।তুমি তো ধার্মিক।”
একটু দম নিলেন নাসিরুদ্দিন সাহেব।নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমাকেও তো আল্লাহ ঐ লোকেদের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার জন্য কোনো আদেশ করেননি।আল্লাহ তাদের ঐ সম্পদ হালাল পথে উপার্জন করতে বলেছিল।কিন্তু তারা হারাম পথ বেছে নিয়েছিল।তারা তাদের পাপের শাস্তি পেতো।তুমি কে বাবা তাদের শাস্তি দেওয়ার?”
নাহিদ জেলের সেলের ভিতর থেকেই বলে,”আমার ভুল হয়ে গেছে।আমি বুঝতে পারিনি বাবা।আমি তোমার গল্প বুঝতে পারিনি ছোট বেলায়।তা হলে আমি এমন কখনোই করতাম না।”
নাসিরুদ্দিন সাহেব মুচকি হেসে বলে,”এখন আর বুঝে কোনো লাভ নেই বাবা।সময়ের বুঝা সময়ে না বুঝে অসময়ে বুঝে কোনো লাভ নেই।তোমার পাপের শাস্তি তুমি পাবে অবশ্যই।নিজের অজান্তেই অনেক লোকের ক্ষতি করেছো।তোমার পাপের ভাগীদার আমি আর তোমার মা ও হবো।কারণ আমরা তোমাকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি।”
শাহেদা বেগম নাহিদের হাত ধরে কিছু বলতেই যাবে কিন্তু তার আগেই একজন পুলিশ এসে বলে,”আপনাদের সময় শেষ।এখন আপনারা যান।”
শাহেদা বেগম জলভরা চোখে ছেলের হাতে চুমু খেয়ে নিজের ইচ্ছে না থাকলেও চলে যান সেখান থেকে।পুলিশ স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় দেখা হয় আসমানীর সাথে।আসমানী তাদের দেখে মাথা নিচু করে ফেলে।তাদের সামনে যাওয়ার মতো মুখ তার নেই।কিন্তু নাসিরুদ্দিন সাহেব তার কাছে এসে বলে,”আমার ছেলেটাকে মাফ করে দিও মা।ও কোনো কিছু বুঝে শুনে করেনি।আমাদেরও মাফ করে দিও।আমরা আমাদের ছেলেকে মানুষ করতে পারিনি।আর হ্যাঁ মা শোনো,আমাদের বাড়ির দরজা সবসময়ের জন্যই তোমার জন্য খোলা।তুমি আমাদের সাথে থাকতে পারো।কোনো সমস্যা নেই আমাদের।আগে যে ভাবে থাকতে,এখনও সেভাবেই থাকবে।”
কথাগুলো বলেই লোকটি সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটু হোঁচট খেয়ে তার এক পায়ের জুতা একটা টেবিলের তলায় ঢুকে যায়।লোকটি বোধ বিবেচনা হারিয়ে নিজেও হামাগুড়ি দিয়ে চেয়ারের নিচে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”আমার জুতো,আমার জুতোটা যেন কই গেল।এই তো,হ্যাঁ, এই তো পেয়েছি।”
প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন লোকটির এইরকম অবস্থা যেন কোনোভাবেই যেন সহ্য করতে পারছে না কেউ।নাতাশা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।আসমানী কোনো রকমে নিজেকে সামলে বলে,”কালকে উনাকে কোর্টে তোলা হবে।আপনারাও আসবেন দয়া করে।”
★★★
কোর্টের রায় অনুযায়ী নাহিদকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।আর আরিয়ানকে ৩০ বছর।যেহেতু সে নারী পাচারের সাথেও যুক্ত ছিল।সেই সাথে তার মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য এসাইলেমে পাঠানোর কথাও বলা হয়েছে।তাকে বিকৃতি মানসিকতার মানুষ বলে গন্য করা হয়েছে।
নাহিদকে যখন গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিল,আসমানী তখন তার সামনে গিয়ে বলে,”মনে আছে আপনার, আমি আপনাকে বলেছিলাম আপনার কিছু হয়ে গেলে আপনার পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার।কিন্তু আপনি কোনো অন্যায় করলে আমি নিজে হাতে আপনাকে গুলি করে দিব?”
নাহিদ মাথা নাড়ায়।আসমানী বলে,”আপনার পরিবারের দায়িত্ব আমার।কোনো চিন্তা করবেন না সেই বিষয়ে।আর আমি….”
“তুমি কি আসমানী?”
আসমানী চোখের জল মুছে বলে,”আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।”
নাহিদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে।আজ হোক, কাল হোক,তার আসমানী তারই থাকবে।সেই বা কম কিসে?
চলবে……
#আসমানী
#পর্ব_২১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“এটা কোন ধরনের সিদ্ধান্ত আসমানী?তোমার স্বামী তোমার কাছে নেই বলেই তুমি আমাদের থেকে দূরে চলে যাবে?আমরা তো আছি।তোমার শ্বশুর বাড়ির সব মানুষই আছে।তারা যথেষ্ট ভালো মানুষ।তুমি আমাদের সাথে না থাকো,তাদের সাথে থাকো।আর ১৪ বছর তো কম সময় না।অনেক বেশি একটা সময়।চাইলে নিজের জীবনটা নতুন করে গুছিয়েও নিতে পারো তুমি।চাইলেই নাহিদকে ডিভোর্স দিয়ে…”
“যথেষ্ট চাচা।যেটা বলছো,সেটা কখনোই সম্ভব না।মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়।সে বেঁচে থাকতে তো দূর সে মরে গেলেও আমি আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবো না।আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“কেন?কেন সম্ভব না?তুমি যতোই বলো না কেন,আমার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য কোনো না কোনো ভাবে তোমার স্বামীও দায়ী।কারণ সে-ই সবকিছুর লিডার।”
আসমানী নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”নাহ, চাচা।সে মোটেও দায়ী নন।সে এমন মানুষ নন।তুমি সবটা ভালোমতো জানো মা।আয়ুশ ভাইয়ার থেকে জেনে নিও।”
“ঠিক আছে।আমি মেনে নিচ্ছি।তাই বলে তুই এই দেশ ছেড়ে কেন যাবি?যাওয়ার কি খুব দরকার আছে?তুই চাকরিও ছেড়ে দিচ্ছিস।এইরকম পাগলামো করার কি খুব দরকার আছে?”
“দরকার আছে বড় চাচা।অবশ্যই দরকার আছে।দরকার আছে বলেই আমি যাচ্ছি।”
” আমাকে বল তোর কি দরকার?তুই দেশ ছেড়ে কেন যাচ্ছিস?”
আসমানীর চাচা হঠাৎ তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি ওকে কিছু বলছো না কেন?এতো শান্তভাবে কিভাবে আছো তুমি?তুমিও কি ওর এইভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিচ্ছো নাকি?”
স্বামীর প্রশ্নের জবাবে কিছুই বলে না সে।চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।আসমানীর চাচা আবার বলে,”কি আশ্চর্য!তুমিও এইরকম করলে কিভাবে হবে?তুমিও কি ওর মতো ছেলেমানুষী করবে নাকি?”
আসমানী রুম থেকে বের হতে হতে বলে,”আমি বেরুচ্ছি চাচা।আজকে না ও আসতে পারি।চিন্তা করোনা আমার জন্য।”
আসমানীর চাচা বেশ রেগে গিয়েই জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি,চাচা।ওদের এখন আমাকে প্রয়োজন।”
“এখন যাস না আসমানী।ওদের মনমানসিকতা ভালো নেই।তোর উপর রেগেও থাকতে পারে ওরা।”
“আমি ওদের চিনি চাচা।খুব ভালোভাবেই চিনি।ওরা আমায় কিছুই বলবে না।”
আসমানী আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় বাসা থেকে।আসমানীর চাচা তার স্ত্রীর সাথে চিল্লাপাল্লা করতে থাকে।কিন্তু আসমানীর চাচী বলে,”তোমাদের এই সভ্য সমাজে মেয়েটা টিকতে পারবে না।তাই সে চলে যাচ্ছে।”
“এখানে থাকতে না পারলে আমি সবকিছু বিক্রি করে এই শহর ছেড়ে চলে যাব।এখানে থাকবো না।অন্য শহরে যাব যেখানে আমাদের কেউই চিনবে না।আসমানীকেও চিনবে না।”
“আসমানী একা থাকলে আমিও এইটাই করতে বলতাম।কিন্তু সে আর একা নেই।সে এখন মা হতে যাচ্ছে।এই দেশে থাকলে ওর সন্তান একজন ডাকাতের সন্তানের পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠবে।বাচ্চাটা ভালোভাবে বাঁচতে পারবে না।ও চলে গেলেই ভালো হবে।সেখানে শান্তিতে বাঁচতে তো পারবে।”
আসমানীর চাচা কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ে।তার ভীষণ খারাপ লাগছে।কিন্তু এইরকম একটা খবরে তো তার খুশী হওয়া উচিত ছিল।কি এমন ক্ষতি হতো,যদি সবকিছু স্বাভাবিক থাকতো?আজ তো তার বড্ড সুখের দিন হতো।সে হয়তো মিষ্টি বিলিয়ে দিত সবার মাঝে।কিন্তু ভাগ্যের এ কি রকম নিষ্ঠুর পরিহাস?এতো বছর পর বাড়িতে একজন নতুন অতিথি আসছে অথচ তার আগমনে কোনো সুখ নেই।
★★★
“তুমি কি এখনো আমার উপর রেগে আছো নাতাশা?আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?আমি তো সবটা জানতাম না নাতাশা।না হলে তোমার ভাইয়াকে গুলি করতে পারতাম না আমি।”
নাতাশা চোখের পানি মুছে বলে,”আমি তোমার উপর রেগে নেই ভাবী।একটুও রেগে নেই।পরিস্থিতি আমায় রাগ করতে বারণ করে দিয়েছে।আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের মধ্যে কি চলছে।এখানে কেউ আর আমাদের সম্মান দিচ্ছে না ভাবী।কেউ দিচ্ছে না।আমার ভাইয়া এইরকম কাজ কি করে করতে পারলো আমরা কেউ জানি না।বাবা তাকেই সব দোষ দিয়েছে।বলেছে সেই নাকি সবকিছুর জন্য দায়ী।বাবা নিজেকে ব্যর্থ একজন মানুষ বলছে।কিন্তু তুমিই বলো,আমার বাবা কি ঐ রকম মানুষ?তুমি তো জানো,সে কতটা ভালো মানুষ।আমার বাবার চাকরিও প্রায় শেষের দিকে।আমরা জানিনা এখন আমরা কি করবো।মাথার উপর বড় ভাইটা থাকলে হয়তো এইসব কিছুই হতো না।”
আসমানী নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তোমাদের সব দায়িত্ব আমার।আমি যেখানেই থাকি না কেন,আমি তোমাদের খেয়াল রাখবো।আমার কথার কোনো অন্যথা হবে না।দেখে নিও।”
“ভাবী,মা তোমাকে ডাকছে।” দরজার সামনে দাঁড়ানো নাবিলকে দেখে আসমানী বলে,”তুমি যাও,আমি আসছি।”
★★★
“তুমি কি গর্ভবতী আসমানী?”
শাশুড়ী মায়ের করা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে থাকে আসমানী।শাহেদা বেগম বুঝে যায় তার সন্দেহই ঠিক।এক নিদারুণ কষ্ট আর বাধ ভাঙ্গা আনন্দে সে কাঁদতে থাকে।আজকে তার বাড়িতে কত খুশির একটা খবর নিয়ে এসেছে মেয়েটা।অথচ সে খুশী হতে পারছে না।সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আজ হয়তো এই মধ্যবিত্তের ঘরে ছোট ছোট মাংশের টুকরা আর বেশি করে আলু দিয়ে বিরিয়ানি হতো।তার স্বামী হয়তো দইয়ের সাথে মিষ্টিও আনতো।সে হয়তো নিজের সামান্য আলংকার তার বৌমার হাতে পড়িয়ে দিত।কিন্তু এমন কিছুই হচ্ছে না।
“আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন আম্মা?”
শাহেদা বেগম বিগলিত হেসে বলে,”না মা।আমার ছেলে তার কর্মফল ভোগ করছে।তাকে তার পাপের শাস্তি তো পেতেই হবে।”
আসমানী মাথা নিচু করে থাকে।শাহেদা বেগম৷ বলে,”এখানে থেকে গেলে হয় না মা?”
আসমানী কাঁদতে কাঁদতে বলে,”হয় না মা।আমার সন্তান এখানে একজন খারাপ বাবার পরিচয়ে বড় হোক,তা আমি চাই না।এই নোংরা সমাজ আমার সন্তানকে ভালোভাবে বাঁচতে দিবে না মা।সে স্বাভাবিক ভাবে বড় হবে না।সবাই তাকে ভালোভাবে বাঁচতে দিবে না মা।আমি চাই না আমার সন্তান তার বাবাকে খারাপ চিনে বড় হোক,যখন আপনার ছেলে আমাদের কাছে ফিরে আসবে,তখন আমার সন্তানের বোধবুদ্ধি হবে।সে নিজেই বুঝতে পারবে তার বাবার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না।সে তার বাবাকে ভালভাবেই মেনে নিতে পারবে। কিন্তু এখানে থাকলে সে তার বাবাকে খারাপ মনে করবে।তার বাবাকে সহজে মেনে নিতে পারবে না।সেটা আমি চাই না।”
শাহেদা বেগমের ভীষণ ভালো লাগলো আসমানীর বিচার বুদ্ধি দেখে।মনে মনে ভাবলো,”আমার ছেলেকে যে মেয়েটা এখনও ভালোবাসে,সেটুকুই যথেষ্ট।”
★★★
“তুমিও কি বাকি সবার মতো আমাকে মেনে নিবে না দিশা?তুমিও কি আমার ভাইয়ের করা ভুলের শাস্তি আমাকে দিবে?”
দিশা মাথা নিচু করে বলে,”বাকি সবার মতো আমার মা তোমার ভাইয়ের কাজকে খারাপ বলছে।কিন্তু বাবা সাপোর্ট করছে।”
নাবিল বেশ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে,”আর তুমি?”
“আমি জানি না।কিন্তু ভালো তো আমি তোমাকে বেসেছি।তোমার ভাইকে নয়।”
দিশার কথায় নাবিল মুচকি হাসে।এত শত খারাপ সংবাদের মাঝেও তার ভালোবাসার মানুষটা যে তারই আছে,সেটাই তো তার কাছে দুঃস্বপ্ন।
★★★
ছাদে বসে একা একাই চন্দ্রবিলাশ করছে আসমানী।নিজের গর্ভের সন্তানের সাথে একা একাই কথা বলছে সে।সে জানে কোনো উত্তর সে পাবে না।তবুও বিরবির করছে সে।নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়েছে সে।নিজেকে ধাতস্থ করেছে আর কখনোই কষ্ট পাবে না সে।মাত্র তো ১৪ বছর।তখন তার সন্তানের বয়স কত হবে?হয়তো ১৩ বছর কিংবা তার একটু উপরে।
আসমানী খোলা আসমানের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি দেখছো তো আমার সই?দেখছো তো আমার কষ্ট?তুমিও কি কষ্টে আছো?তোমার আবার কিসের কষ্ট, তুমি তো একাই থাকো।তোমার তো কেউইই নেই৷তাই কাউকে হারানোর ভয়ও নেই।কিন্তু আমাকে দেখো,আমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।আমার গর্ভের সন্তানেরও আমি ছাড়া আর কেউই থাকবে না আমি ছাড়া।”
★★★
“মা,আসমানী ভাবীর চাচী কল করেছিলেন।আসমানী ভাবীর একটা মেয়ে হয়েছে।”
জায়নামাজে বসেই বহুদিন বাদে একটা সুখবর পেলো শাহেদা বেগম।হাসিমুখে বললো,”আলহামদুলিল্লাহ।”
নাতাশা নত মুখে বললো,”মা,একটা কথা বলি?
“বল।”
“পরেরবার ভাইয়ার সাথে দেখা করার সময় কি ভাইয়াকে বলবো বাবুর কথা?এখনও তো সে জানেই না কিছুই।”
“আসমানী তো বলতে নিষেধ করেছে।তাহলে আমার ছেলেটা কষ্ট পাবে।সন্তানের থেকে দূরে থাকার যে কষ্ট সেটা তো আমি বুঝি মা।”
নাতাশা তবুও বলে,”তার কি জানার অধিকার নেই মা?”
“আছে।কিন্তু সে আক্ষেপে হয়তো বুক ফেটে মরেই যাবে।নিজের সন্তানকে একনজর দেখার আর ছোঁয়ার জন্য তো সে হাঁসফাঁস করবে।”
“তুমি দেখবে বাবুকে মা?দেখো কি সুন্দর।যেন গোলাপ রানী।কেমন গোলাপী আভা ছড়িয়ে আছে পুরো মুখ জুড়ে।দেখো মা,কি মায়া ওর মুখে।মা,মা,মা আমি যদি ওকে একটা বারের জন্য কোলে নিয়ে আদর করতে পারতাম মা।” বলতে বলতেই নাতাশা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
শাহেদা বেগম মুচকি হেসে বলে,”দেখলি,কেমন কষ্ট হয়?আমার ছেলেটারও এমন কষ্ট হবে।”
পড়ন্ত বিকেলে ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে কত কিছুই ভাবছে নাসিরুদ্দিন সাহেব।জীবনটা হঠাৎ কেমন রঙহীন হয়ে গেল।মানুষের ছোট একটা ভুলের জন্য তার চারপাশের সবার জীবনও যে এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে,সেটা কখনোই ভাবে নি।হঠাৎ ছাদের রেলিঙের দিকে নজর পড়তেই তার বুকটা কেঁপে উঠে।কতটা উঁচু করে রেলিং দিয়েছিল সে।যাতে তার নাতী-নাতনীরা আরামে ছাদে বসে খেলা করতে পারে।হঠাৎই তার ভীষণ কান্না পায়।কিন্তু কোনোভাবে সে নিজেকে সামলে নেয়।কারণ সে জানে,পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই।
পরিশিষ্টঃনাহিদের দিন এখন ভালোই চলে।আসমানী তার জন্য অপেক্ষা করে আছে,সেটুকু আশা নিয়েই সে বেঁচে আছে।এই জেলে তার খুবে একটা অসুবিধে হয়না।সবাই যেন একটা পরিবারের মতো।তারা একসাথে ঘুমায়,একসাথে রান্না করে আর একসাথে খায়।তবে,বাকিদের থেকে দূরে গিয়েও সে আরও একটা কাজ করে।সময়ে অসময়ে সে ঐ নীল আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকে।জেলের উঁচু দেয়ালের বাইরে যেখানে আসমান মাটিতে গিয়ে মিশেছে, তার মনে হয় সেখানেই তার আসমানী আছে।
আজ কেউ একজন তার সাথে দেখা করতে এসেছে।কে এসেছে সেটা সে জানেনা।আসমানী আসবে না,সেটা সে জানে।এখানে শেষ যখন এসেছিল, তার অবস্থা দেখে মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।তাই আর সে আসে না।সে কোথায় আছে,সেটাও সে জানে না।কেউ তাকে বলেও না।সে কাউকে জিজ্ঞেসও করেনি।কারণ সে জানে,তার আসমানী তার অপেক্ষায় আছে।
“তোমার সাথে দেখা করতে কেউ এসেছে।যাও।”
জেলারের নির্দেশে নাহিদ অতিথিদের রুমে গিয়ে দেখে সেখানে আসমানীর ভাই আয়ুশ দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে দাঁড়িয়ে বলে,”কেমন আছো নাহিদ?”
নাহিদ মাথা নাড়ায়।
আয়ুশ হেসে বলে,”তুমি কি একটা কথা জানো,আমি আসমানীকে ছোট বেলা থেকেই ভালোবাসি?সেই ছোট্ট বেলা থেকে।”
নাহিদ মুচকি হাসে তার কথা শুনে।সে জানে সবকিছুই।
আয়ুশ বলে,”তোমাকে একটা কথা জানানোর জন্য এসেছি।বলতে পারো তোমাকে জ্বালানোর জন্য এসেছি।”
নাহিদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,”কি কথা?আমার আসমানীর কি কিছু হয়েছে নাকি?”
“হ্যাঁ,হয়েছে।”
নাহিদ ঘামতে থাকে।সে অধৈর্য হয়ে বলে,”কি হয়েছে আমার আসমানীর?কি হয়েছে ওর?ও কি ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, ঠিকই আছে।হয়েছে কি জানো?ওর একটা মেয়ে হয়েছে।অবশ্য এই দেশে না।আমেরিকায় চলে গিয়েছে সে।সেখানেই হয়েছে।তোমাকে কেন বললাম বলোতো?”
নাহিদের মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠে।কিন্তু একটা বারের জন্য সন্তানকে দেখতে না পারার কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
আয়ুশ আবার বলে,”নিজের সন্তানকে দেখতে না পাওয়ার কষ্টে কিভাবে তুমি জর্জরিত হও,সেটা আমি দেখতে চাই। তুমি কেমন অভাগা বাবা যে নিজের মেয়ের নামটাও জানো না।জানো তোমার মেয়ের নাম কি?”
“আনা।তাইনা?”
আয়ুশের মুখের হাসি উবে গেল।সে চেয়েছিল নাহিদ কষ্ট পাবে কিন্তু এখানে হলো উল্টোটা।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”তুমি কিভাবে জানো?”
নাহিদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “কারণ নামটা আমিই দিয়েছি। ”
আয়ুশকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাহিদ নিজের কামরায় ফিরে আসে।চোখ বন্ধ করে সে অনুভব করে তার সন্তানকে। মনে মনে আসমানীকে ধন্যবাদ দেয়।অন্ততপক্ষে তার সন্তান এমন একটা দেশে তো আছে যেখানে কেউ তাকে বলতে পারবে না,”তুই কয় আনা?দু আনা নাকি চার আনা?”
সমাপ্ত