ইট পাটকেল পর্ব-২৬+২৭

0
949

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৬

স্টাডি রুমে বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে নূর। অনুভূতিহীন চোখে এক মনে তাকিয়ে আছে আশমিনের ডায়েরির দিকে।একটি মাত্র ডায়েরি জীবনের অনেক অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি টেনে দিয়েছে।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোর খামচে ধরে বসে আছে নূর। কান্না আটকানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরায় ঠোঁট কেটে র*ক্ত বেরিয়ে গেছে।ডায়েরি থেকে নজর সরিয়ে রক্তাক্ত চোখে তাকালো দেয়ালে টাঙ্গানো আশমিনের বিশাল ফ্রেমের ছবির দিকে। নিজেকে টেনে হিচড়ে দাড় করালো নূর। ডায়েরি টা জায়গা মতো রেখে আশমিনের ছবির সামনে এসে দাড়ালো।

— ধোকা! এত বড় ধোকা! (ছবিতে হাত বুলিয়ে) আপনাকে কি শাস্তি দেই বলুন তো মন্ত্রী সাহেব? কি নিখুঁত অভিনয় আপনার! আপনি তো নিজের পারফরম্যান্স দেখিয়ে দিলেন।এবার আমার টা দেখানোর পালা। অভিনয় করতে ভালো লাগে তাই না? তো চলুন,এক দফা টক্কর আমাদের মাঝেও হয়ে যাক(দাতে দাত চেপে)। আপনার চালে যদি আপনাকে মাত না দিয়েছি তো আমার নাম ও তেহজিব নূর শিকদার নয়।

আশমিন আসার পর থেকে নূর কে একবার ও দেখে নি। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে কপাল কুচকে চারিদিকে চোখ বুলালো সে।হাতের তাওয়াল টা বারান্দায় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়া রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। আশমিন নিচে এসে অস্থির গলায় বলল,

— নূর কোথায় আন্টি?

— বউমা তো অনেকক্ষণ আগে স্টাডি রুমে গিয়েছে। দুপুরের খাবার টাও ওখানেই খেয়েছে। নিচে তো আসতে দেখিনি।

আশমিন ভয়ার্ত চোখে তাকালো মায়া বেগমের দিকে। হুশ ফিরতেই এক প্রকার দৌড়ে গেল স্টাডি রুমের দিকে। মায়া বেগম প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিলো। শুধু বাড়ির লোক ই না, চেনা জানা সবাই জানে আশমিন নূর কে চোখে হারায়।শাজাহানের মতো নূরের জন্য নূরমহল বানিয়ে ফেললেও কেউ অবাক হবে না।সেফ কে নিজের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রুমের দিকে গেলেন মায়া বেগম। শরীর টা আজ খুব একটা ভালো না।জ্বর আসবে হয়তো। আমজাদ চৌধুরী তার দিকে ফিরেও তাকায় না।তাতে অবশ্য তার কষ্ট হয় না। বরং এমন নিখাত ভালবাসা দেখে মনে মনে তৃপ্তি পায় সে।

হুড়মুড় করে স্টাডি রুমে ঢুকতেই নূর আশমিনের দিকে চোখ তুলে তাকালো। নূরের হাতে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটি। আশমিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। নূর মুচকি হেসে বই রেখে উঠে দাড়ালো। ধীর পায়ে কাছে এসে আশমিনের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। আশমিন ও আগলে নিলো নূর কে।হৃদপিণ্ডের তীব্র ধুকপুকানি নূরের কানে এসে বারি খাচ্ছে। নূর বাকা হাসলো, ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল,

— ভয় পেয়েছেন নাকি মন্ত্রী সাহেব? এভাবে বুক কাপছে কেন?এভাবে তো অপরাধীর বুক কাপে। করেছেন নাকি কোন বড়সড় অপরাধ?

আশমিন হাত আলগা করে নূর কে নিজের সামনে আনলো।নূরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নূরের চোখ একেবারে শান্ত।হাসি হাসি মুখে সে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন নিজেকে শান্ত করলো। নূর কে নিজের সাথে চেপে ধরে আস্তে করে বললো,

— অপরাধ তো করেছি বউ।আজ সারাদিন বউয়ের খবর নিতে পারিনি।এটা তো গুরুতর অপরাধ। শাস্তি তো পেতেই হবে।

— হুম,আমি দিবো আপনাকে শাস্তি। আজ সারা রাত আমার সাথে বারান্দায় গল্প করে কাটাতে হবে। শাস্তি মঞ্জুর তো মন্ত্রী সাহেব?

আশমিন চোখে হাসলো। নূরের কপালে চুমু খেয়ে ঘোর লাগা গলায় বলল,

— এমন শাস্তি আমি সারাজীবন পেতে চাই বউ।

আশমিনের কাছে আসায় গা গুলিয়ে উঠলো নূরের। নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাড়ালো। আশমিন ভ্রু কুচকে ফেললো। নূরের ঠোঁটের দিকে চোখ যেতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। দ্রুত পায়ে এসে নূরের গাল চেপে ধরলো।কাটা জায়গায় স্লাইড করতে করতে বললো,

— এভাবে কাটলো কিভাবে? ঠোঁট কামড়েছো কেন?এখন আমি চুমু খাবো কোথায়?

প্রথম কথা গুলো রাগ করে বললেও শেষ কথা টা দুঃখী দুঃখী গলায় বলল আশমিন। নূর শান্ত চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। অভিনয়েও বুঝি ভালবাসা এতো নিখুঁত হয়!

— এই মেয়ে,কথা বলছো না কেন?

আশমিনের ধমকের পিঠে কিছু বলার আগেই মাথা ঘুরে উঠলো নূরের। ঝাপসা চোখে একবার আশমিনের দিকে তাকিয়ে ঢলে পরতেই আশমিন আগলে নিলো নূর কে। অস্থির গলায় ডাকতে লাগলো,,

— বউ!কি হয়েছে তোমার? নূররর,,,,

নূর কে কোলে তুলে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতেই চিৎকার করে সবাই কে ডাকলো আশমিন।বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে ফোন করলো ডক্টর কে।ততক্ষণে বাড়ির সবাই এসে পড়েছে।লুবানা গিয়ে নূরের হাত পা মালিশ করতে লাগলো। মায়া বেগম চোখে পানি ছিটিয়ে দিলেও নূরের জ্ঞান ফিরলো না।আশমিন পাগলের মতো নূর কে ডেকে যাচ্ছে বারবার। লুবানার ছোট ভাই লিমন এক কোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে আশমিন কে ভয় পায়।এখন আশমিনের পাগলামি দেখে আরো ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছে।আমজাদ চৌধুরী চিন্তিত গলায় বলল,

— এভাবে বসে থেকো না। ওকে হসপিটাল নিয়ে যাও।

আশমিন আর এক মুহুর্ত দেড়ি করলো না।নূর কে কোলে তুলে রুম থেকে বেরুতেই সানভি হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করলো ডক্টর নিয়ে।আশমিন আবার নূর কে রিমে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো।সবাই কে বেরিয়ে যেতে বলতেই আশমিনের ভয়ংকর দৃষ্টিতে দমে গেল ডক্টর। সবাই বেরিয়ে গেল ও আশমিম নূরের হাত ধরে তার পাশেই বসে রইলো। ডক্টর চেকআপ করে মুচকি হেসে আশমিনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— অভিনন্দন স্যার।সি ইজ প্রেগন্যান্ট। অতিরিক্ত চিন্তার জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।এখন ওনার রেস্ট প্রয়োজন। আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালের আগে ঘুম ভাঙ্গবেনা।কাল হসপিটালে গিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে আনবেন।তাহলে ম্যামের কন্ডিশন ভালো ভাবে বোঝা যাবে।

ডক্টরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আশমিন।তার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে,”সি ইজ প্রেগন্যান্ট “ডাক্তারের বাকি কথা তার কানে গেলো কি না বোঝা গেলো না।ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতেই ডাক্তার মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। আশমিন একমনে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূরের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আশমিনের হাতের মুঠোয় থাকা নূরের হাতটার কয়েকটা নখ ভেঙে গিয়েছে। আশমিন হালকা ঝুকে জরিয়ে ধরলো নূর কে।উত্তেজনায় তার পুরো শরীর কাপছে। মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে।

নিচে লুবানার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সানভি ধমকেও তাকে থামাতে পারছেনা।

— এভাবে চিৎকার করছো কেন সাবানা?অসভ্যের মতো চিৎকার করা বন্ধ করো।ছিঃ, কি গলা।মনে হচ্ছে ফাটা বাসের ভিতর আটকে পরা ইদুর কিচমিচ করছে।

লুবানা সমস্ত আনন্দ ভুলে ফুসে উঠলো। কটমট করে তাকালো সানভির দিকে।

— ও হ্যালো,মি.কবরস্থানের বাসিন্দা। আমার নাম লুবানা।লু,,বা,,না।নট সাবানা। আর আমার গলা মোটেও ইদুরের মতো নয়।আপনার কানে সমস্যা।লক্কর ঝক্কর যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘুরে বেরাতে লজ্জা করে না আপনার?তাজ্জব ব্যাপার!

সানভি রাগী চোখে তাকিয়ে আছে লুবানার দিকে। মেয়ের সাহস দেখে অবাক হচ্ছে সে।আর এদিকে লিমন দুজনের ঝগড়া দেখছে আর হাই তুলছে।আমজাদ চৌধুরী আর মায়া বেগম নূরের রুমে গিয়েছে। না হলে ইজ্জত পানি পানি হয়ে যেতো এই মেয়ের জন্য।

— দেখো মেয়ে,, বেশি বারাবাড়ি করবে না। না হলে ছাদে তুলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো।বেয়াদবির একটা আদব থাকা দরকার।

— হুহ,,আসছে ধাক্কা দিতে।বলি হাড়গোড় সব ঠিক যায়গায় আছে তো?আগে চেক করে আসুন।দেখা গেলো চোখ কানের মতো হাড্ডি ও দুই একটা কবরে রেখে এসেছেন।

লুবানা মুখ বাকিয়ে চলে গেলো। সানভি কটমট করতে করতে লিমন কে বললো,

— দেখেছো? দেখেছো কেমন বেয়াদব?

লিমন হচকচিয়ে গেলো। জোর পুর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,

— জ্বি ভাইয়া।ছোট বেলা থেকেই দেখছি।

আশমিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমজাদ চৌধুরী।ছলের খুশির পরিমাণ তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দাম্ভিক হাসি দিলো।আমজাদ চৌধুরী ভ্রু কুচকে তাকালো ছেলের দিকে। নিশ্চিত এখন বেহায়া মার্কা কিছু বলবে।এখানে মায়া বেগম ও আছে।আমজাদ চৌধুরী আর লজ্জায় পরতে চাইলো না। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিতেই আশমিন তার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,

— একা যাচ্ছো কেন? তোমার বউ নিয়ে যাও।একা গেলে সুখবর পাবো কিভাবে।ওষুধে তো কাজ করার কথা।খাচ্ছো তো ঠিকঠাক? মনের মধ্যে দুষ্টু আমজাদ চৌধুরী উকি দেয়নি এখনো? নাহ,, টিউবলাইট হয়ে যাও নি তো আবার?

আমজাদ চৌধুরী মনে মনে কয়েক ঘা লাগালেন ছেলের গালে। এরকম একটা বজ্জাত ছেলে তার ই কেন হতে হলো! দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলেন তিনি।বাকি ইজ্জত টুকু এই ছেলের হাত থেকে বাচিয়ে রাখতে হবে।নিজেকে মাঝে মাঝে অসহায় রমনী মনে হয়।আর আশমিন কে রাস্তার বখাটে।

চলবে

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৭

রাতের আকাশে অজস্র তারার মেলা বসেছে।চারিদিকের ভ্যাপসা গরমের কারনে সবার জীবন ওষ্ঠাগত। ছাদের দোলনায় বসে গরমের তীব্রতা আন্দাজ করতে পারছে নূর। সারাদিন এসির ভেতর থেকে গরমের তীব্রতা উপভোগ করার সুযোগ হয় না।পূর্বপুরুষদের অর্জনের জন্য এই বিলাসবহুল জীবন তার।কি হতো যদি এতো বিলাসিতা না থাকতো?আর পাচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো তারাও না হয় সংগ্রাম করে বেচে থাকতো।দামী গাড়িতে না চড়ে লোকাল বাসে চড়ে সবার মতো সাধারণ জীবন যাপন করতো। দিন শেষে আপন মানুষগুলো কে পাশে তো পাওয়া যেতো। কি হবে এতো অর্থ পতিপত্তি দিয়ে।আভিজাত্য যদি দিন শেষে নিঃসঙ্গতা দেয় সেই আভিজাত্য তো অভিশাপ স্বরুপ। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নূরের।পেটে হাত রেখে অনুভব করলো নিজের অস্তিত্ব কে। মা হওয়ার সংবাদ তাকে আশমিন ই দিয়েছে। চোখে মুখে তার কি নিদারুণ জোত্যি ছিল।ভাবতেই নূরের ঠোঁটে বিষাদের হাসি ফুটে উঠলো। কি হতো তাকে একটু ভালবাসলে? মিথ্যা ভালবাসি না বলে সত্যি ঘৃণা করি বলে নাহয় গু*লি ই করে দিতো।মৃ*ত্যু যন্ত্রণা হয়তো এই মিথ্যার যন্ত্রণার থেকে কম ই হতো। এই যে ক্ষনে ক্ষনে বুক ভারি হয়ে আসে।কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে থেকে মরণ যন্ত্রণা দেয়।এর চেয়ে কি মৃত্যু ভালো ছিল না?
আহা কষ্ট! এই কষ্ট তার পিছু কেন ছারছে না?আর কতটা যন্ত্রণা ভোগ করলে কষ্ট তাকে রেহাই দিবে?

— এখানে কি করছো নূর?

আমজাদ চৌধুরীর কথায় চোখ তুলে তাকালো নূর।বিষাদমাখা হাসি দিয়ে আবার আকাশ দেখায় মন দিলো। আজকাল কাউকে তার সহ্য হয় না। আসেপাশের সবাইকে প্রতারক মনে হয়। এতো মানুষের ভিড়ে তার কেন একজন আপন মানুষ নেই এই ভেবেই দিনের অর্ধেক টা সময় কেটে যায়।

আমজাদ চৌধুরী এসে নূরের পাশে বসলো। নূরের মলিন চেহারা দেখে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো। কিছু না করেও এই মেয়েটাকেই সব কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেন?

— রাত হয়ে গেছে তো মা।এই সময়ে এভাবে এখানে বসে থাকতে নেই।

— ঘরেই যদি জান নেয়ার মানুষ থাকে তাহলে বাইরে আর কিসের ভয়?

আমজাদ চৌধুরী হচকচিয়ে গেলো। হতভম্ব গলায় বলল,

— কি বলছো মা?

— একটা গল্প শুনবে আংকেল? এক অভাগী রাজকুমারীর গল্প।

আমজাদ চৌধুরী শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। নূর হালকা হেসে বলতে শুরু করলো,

— এক দেশে এক রাজকুমারী ছিল।রাজা রানীর চোখের মনি। হেসে খেলে তাদের জীবন পার হচ্ছিল। একদিন হুট করেই তাদের জীবনে অতীত হানা দিল।রাজার বোন প্রেমে পড়েছিল এক ভীনদেশী যুবকের।রাজার অগোচরে রেজিষ্ট্রি করে বিয়েও করেছিল তারা।
একমাত্র বোনের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি রাজা।ক্ষুব্ধ হয়ে বোনের কাছে গেলো জবাব চাইতে। বোন নিজের ভালোবাসার কথা জানালে রাজা তাদের মানতে অস্বীকৃতি জানান। বোন ও জেদ ধরে রাজার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়।রানী দুজন কে থামাতে ব্যর্থ হলে রাজার বোন কে বোঝায় আপাতত রাজার কথা মেনে নিতে। বোন তাকে অপমান করতে পিছ পা হয় না। বড় বোনের মতো ভাবির গায়ে হাত তুলতে ও পিছ পা হয় না। প্রেয়সীর গায়ে আঘাত সহ্য করতে পারে না রাজা।সকল রাগ গিয়ে জমা হয় ভীনদেশী যুবকের উপর। আঘাত করে বসে বোনের স্বামী কে।দুর্ঘটনা বশত মৃত্যু হয় তার। স্বামীর মৃত্যুর শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যায় বোন। মৃত্যুর কারণ ধামাচাপা দিলেও বোনের নজরে থেকে যায় আজীবন দোষী। দুই মাসের অন্তসত্তা বোন কে নিয়ে বারবার আফসোস করতে থাকে রাজা।বোনের নীরবতা তাকে বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে নিজের অপরাধ দেখিয়ে দিচ্ছিলো। হাতে পায়ে ধরেও ক্ষমা পায় নি সে। নয় মাস পরে এক ফুটফুটে ছেলের জন্ম দেয় সে। ছেলে জন্ম দেয়ার তিন মাস পর বিয়ে করে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে। যাকে ভালোবাসলেও আজ পর্যন্ত স্বামীর অধিকার দিতে পারে নি। নিজের প্রথম ভালবাসাকে ভুলে এগিয়ে যেতে পারে নি সে। ছেলে কে সব সময় নিজের থেকে দূরে রেখেছে সে।ছেলের মুখের আদল বারবার তাকে তার ভালবাসার মানুষ টির কথা মনে করিয়ে দিতো। যাকে তার ভাই খু*ন করেছে। প্রতিশোধের আগুনে বারবার নিজের স্বত্তা কে জ্বালিয়ে ভাইকে ধ্বংসের খেলার নেমেছে সে। ক্ষমা করার ভান করে তাকে বারবার আঘাত করেছে।ঠান্ডা মাথায় তার প্রিয়তমা স্ত্রী কে খু*ন করে এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দিয়েছে। দেখাশোনার নাম করে রাজার আদরের রাজকুমারী কে চাকরানীর মতো ট্রিট করেছে। প্রথম স্বামীর বোন কে দিয়ে রাজা কে সিডিউস করেছে। সেই সন্তানদের কেই তাকে ধ্বংস করার কাজে লাগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলেকে দিয়ে,,,,(তাচ্ছিল্যের হেসে)

আচ্ছা আংকেল, এক ভুলের কতো শাস্তি হয় বলো তো? অনুশোচনার চেয়ে বড় শাস্তি কি এই পৃথিবীতে আর কিছু আছে? এখন রাজকুমারী যদি প্রতিশোধ নিতে চায়! তার মাকে খু*ন করার প্রতিশোধ, তার শৈশব, কৈশোর নষ্ট করার প্রতিশোধ, মিথ্যা সম্পর্কে বেধে দেয়ার প্রতিশোধ, ভালবাসার নামে ঠকানোর প্রতিশোধ, তাকে এই পৃথিবীতে পুরোপুরি এতিম করে দেয়ার প্রতিশোধ, তাকে প্রতারণার মতো মরণ যন্ত্রণা দেয়ার প্রতিশোধ। তখন রাজকুমারী অপরাধী হবে না তো? কিছু না করেও সেই তো সবচেয়ে বেশি শাস্তি পেলো।তার প্রতিশোধ নেয়া অন্যায় হবে না তাই না?

আমজাদ চৌধুরীর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পরছে।নূরের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার।এই তিক্ত সত্যি গুলো নূর কিভাবে জানলো তা নিয়েও মাথা ব্যথা নেই। আশমিন তার ছেলে না হলেও সে তাকে জীবনের চেয়ে ও বেশি ভালোবাসে। নিজের বুকে রেখে মানুষ করেছে তাকে।কখনো বুঝতে দেয় নি সে তার নিজের ছেলে না। একটা সময় এসে আশমিন ও সত্যি টা জেনে যায়। সত্য হচ্ছে সূর্যের আলোর মতো। হাজার মেঘের আড়ালে ঢাকা পরলেও তা একসময় প্রকাশ পাবেই। আশমিন সত্যি টা জানলে ও সবসময় না জানার ভান করে থেকেছে। আগের চেয়ে বেশি তার সাথে শুরু করে। বন্ধুর মতো মিশেছে তার সাথে। এক সিগারেট দুই জন ভাগ করে খেয়েছে কতো। তার বাবা হয়ে সে এখনো ভার্জিন সেই আফসোসে কতো কতো হতাশার শ্বাস ফেলেছে। শুধু মাত্র কামিনীর প্রতিশোধের নেশা সব কিছু শেষ করে দিল। নূরের অসমাপ্ত কথার রেশ প্রমান করছে সে আরো অনেক কিছু জানে।আর চুপ থাকার মেয়েও সে না।ছেলের জন্য বুকের ভিতর আনচান করতে লাগলো আমজাদ চৌধুরীর। সে জানে তার ছেলে কতটা হিংস্র। ঠান্ডা মাথায় বাঘ শিকার করার মতো ছেলে তার।

আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে চুপসে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নূর। তাকে আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বললো,

— চিন্তা করো না আংকেল।আমি প্রতিশোধ নিবো না।প্রতিশোধ শুধু ধ্বংস করে। আমি চাইনা আমার সন্তান আমার মতো জীবন পাক। মন্ত্রী সাহেব কে কিছু জানিয়ো না। সম্পর্কে আর কোন দূরত্ব চাই না আমি। স্বামী সন্তান নিয়ে শান্তিতে সংসার করতে চাই।

আমজাদ চৌধুরী স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। নূরের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ভরাট গলায় বললো,,

— কষ্ট পেয়ো না মা। সব কিছু বাদ দিলেও এ কথা সত্যি, আশমিন তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসে।ওর ধ্যান ধারণা একমাত্র তুমি। তোমার শূন্যতা ওকে কতটা উন্মাদ করে দেয় তা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই। ওকে কষ্ট দিয়ো না।তারাতাড়ি নিচে চলে এসো।আশমিন এসে তোমাকে এখানে দেখলে রাগ করবে।

নূর মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।আমজাদ চৌধুরী ধীর পায়ে নেমে গেলো ছাদ থেকে। নূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,,

— যে ভালবাসা আমাকে বারবার আঘাত করছে সে ভালবাসা দিয়ে আমি কি করবো আংকেল?আমি তাকে কষ্ট দিবো না। সে নিজেই তার কষ্টের কারণ হবে।সব থেকেও সে থাকবে নিঃস্বঙ্গ।যে বিষাদের সাগরে সে আমাকে ফেলে দিয়েছে সেই বিষাদের স্বাদ সে পাবে না তা কি করে হতে পারে? আশমিন জায়িন চৌধুরী যদি তার মায়ের ছেলে হয় তাহলে তেহজিব নূর শিকদার ও তার বাবার মেয়ে।ধোকার পাল্টা জবাব দেয়া তার রক্তের বৈশিষ্ট্য।

— বউ,,,

আশমিনের ক্লান্ত গলা শুনে চোখ তুলে তাকালো নূর।সাদা পাঞ্জাবি তে রাজপুত্রের মতো লাগছে আশমিন কে। মুচকি হেসে হাত বারিয়ে দিল নূর।আশমিন নূরের হাত ধরে ধপ করে এসে বসে পরলো নূরের পাশে। নূরের হাতে চুমু খেয়ে এক হাতে জরিয়ে ধরলো তাকে।নূর ও বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি মেরে আশমিনের বুকে গা এলিয়ে দিলো।

— ছাদে আসতে নিষেধ করেছি না? এতো গুলো সিরি বেয়ে উঠতে কষ্ট হবে তো তোমার। আমি যখন বাসায় থাকবো তখন আমাকে বলবে।আমি কোলে করে নিয়ে আসবো তোমাকে।

আশমিনের কুচকানো মুখ দেখে হেসে ফেললো নূর।কাধে থুতনি ঠেকিয়ে নির্মিশেষে তাকিয়ে রইলো আশমিনের ক্লান্ত চেহারার দিকে।

— এভাবে তাকিয়ে থেকো না তো।আমার লজ্জা লাগে।

— আপনার লজ্জা ও লাগে(অবাক হয়ে)?

— আমি খুব লাজুক ছেলে বুঝলে? প্রথম যেদিন তোমাকে গভীর ভাবে ছুয়েছিলাম সেদিন আমি দুই সেকেন্ড লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। ভাবা যায়! ইসসস,,এতো লজ্জার জন্যই তো সুখবর পেতে বারো দিন দেড়ি হলো। এতো লজ্জা নিয়ে তো বছর বছর বাবা হতে পারবো না।কেমন বউ তুমি?বরের লজ্জা ভাঙ্গাতে পারো না।

নূর হতভম্ব হয়ে রাগ করতেও ভুলে গেলো। দুই মিনিট আশমিনের গলা চেপে ধরার অদম্য ইচ্ছা টাকে ঘুম পারিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো।

চলবে,,,