উন্মুক্ত লাইব্রেরী পর্ব-১১+১২

0
206

#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা

১১.

সময়টা অগ্রহায়ণ এর মাঝামাঝি।পুরোনো আমলের এই বাড়ির ছোট্ট বারান্দায় বসে
অন্বেষার চন্দ্র বিলাস।নিস্তব্ধ রাতে ভেসে আসছে সুবাস।আকাশের নীলিমায় চোখ মেলে দেখলো তাঁরাদের মেলা চাঁদের আলোয় মাখা।ছোটবেলায় কত গল্প শুনেছে।এই চাঁদে নাকি বসবাস করে এক বুড়ি।সেসব আজ যেন সোনালী রূপকথা।চারপাশে নিঃশব্দে বয়ে যায় হালকা পবন।উদাসীন মন বিশাল এক ভাবনায় ভাসমান।বেহায়া মন আবার ছটফট করে।বলে,

“আজকাল বর্ণ নামক বিবর্ণ মানবের কথা বেশি বেশি ভাবছিস অন্না”

নিজের মনের কথার বিরোধিতা করে অন্বেষা একাকী বলতে লাগলো,

“ভাবছি কারণ আছে।আমার ওকে দেখলে ভীষণ মায়া হয়। সর্বশ্রান্ত মনে হয়।যেনো এক বিশাল সমুদ্র সমান কিছু লুকানো ওর মাঝে।”

অদ্ভুত!নিজের মনই প্রশ্ন করলো, “শুধুই সহানুভূতি নাকি এটি প্রেমানুভূতি?”

নিজের মনের প্রশ্নেই হচকচিয়ে উঠে অন্বেষা।দেহ টানটান করে বসলো।আনমনে বিড়বিড় করলো,

“কারো প্রতি মায়া থাকলেই কি সেটা প্রেম বলে গণ্য হয়?আমি বর্ণের চোখে হাহাকার দেখেছি।ওর অনেক গল্প আছে।অজানা,অন্তরালে।আমি বুঝি।আমার বাবা চলে যাওয়ার পূর্বে যে শিক্ষাগুলো দিয়ে গেছেন সবই আমার মনে আছে। বাবা বলতেন হোক সে কোনো নারী বা পুরুষ?গরীব অথবা ধনী।কারো প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি প্রকাশ করতে কখনো কার্পণ্য বোধ করতে বারণ করেছেন।নিজের হাত সবসময় বাড়িয়ে রাখতে বলেছেন।কারো প্রয়োজন হলেতো সে ধরবেই।”

মন যেনো ঠাট্টা করে বলে উঠলো,

“সত্যি এটাই অন্না তুই নিজের একাকীত্বকে কাটানোর সঙ্গী পেয়েছিস।কেনো বর্ণের গল্প আছে বুঝতে পারিস?কারণ তুই নিজেও একই নৌকার মাঝি।কঠোর আমি কেনো হুটহাট গলে যাই?”

অন্বেষা আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। এ কেমন বিবাদ?নিজের সাথেই নিজের।তবে সত্য!বহুকাল হতে একাকিত্ব নীরব চিৎকার করে যাচ্ছে।যেখানেই চায় শুধু মরুভূমি।এদিক ওদিক ফিরেছে মানুষের খোঁজে।যদি এমন কেউ মেলে?যাকে মনের কথা বলা যায়?পায়নি।ব্যর্থ হয়েছিল।তবে সেদিন বুড়িগঙ্গার তীরে অভিলাষে বলেছে,উজাড় করেছে মনের কথাগুলো বর্ণের নিকটে।

“বোধহয় দুটো বিচ্ছিন্ন খন্ডিত চিত্র একত্রে নতুন এক রঙিন ক্যানভাস সাজাবে”

______

“ফুপু আপনাকে দুইদিনের কথা বলেছিলাম।আজ পাঁচদিন হতে চললো।আগামীকাল আমার ফি জমা দেওয়ার শেষ দিন।কোনো রকম টাকা জোগাড় করে বাড়ির এডভ্যান্স দিয়েছি।মালপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে আমার ভ্যান ভাড়াও গিয়েছে।আপনি বুঝতে পারছেন আমি কত সমস্যার মধ্যে আছি?”

জেসমিন আক্তারকে তার বাড়ির নিচে ডেকেই রাগী সুরে কথা বলে যাচ্ছে অন্বেষা।বারবার বলার পরও টাকা দিচ্ছেন না তিনি।উল্টো অন্বেষার তীক্ষ্ম কন্ঠ শুনে অবাক।বললেন,

“তোমার টাকা যেমন মাইরা খাবো? বললামতো দিবো!একা থাইকা তোমার তেজ বাড়ছে!আগেতো এমন ছিলা না”

“পরিস্থিতি মানুষকে অনেককিছু শিখায় ফুপু।সাথে মানুষ চিনায়।আপনি জানেন আপনার ছেলে কি করেছে?”

সৌভিকের কথা আসতেই মুখের রং বদলে গেলো জেসমিন আক্তারের।দারুন উৎকণ্ঠা হয়ে প্রশ্ন করলেন,

“কি করেছে?”

“আমার নতুন বাড়ির সামনে গিয়ে অসভ্যের মতো আচরণ করেছে।আমার হাত ধরে টানাটানি করেছে।এসব কি শিখাচ্ছেন ছেলেকে?”

জেসমিন আক্তার কপট খাপ্পা স্বরে বলে উঠেন,

“অসম্ভব!আমার ছেলে এমন কিছুই করতে পারেনা”

অন্বেষা নিষ্ফল হেসে বললো,

“এই আধুনিক সমাজে সন্তানরা এমন অনেক কিছুই করে যেটা বাবা মা জানে না।আমি বলে দিচ্ছি আমাদের মধ্যে ভঙ্গুর যে সম্পর্কটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাও নষ্ট করবেন না।”

“তুমি হুমকি দিচ্ছ সম্পর্ক নষ্ট করার?”

“বাধ্য হচ্ছি!আমার টাকাটা?নূন্যতম আত্মসম্মান বোধ থাকলে দিয়ে দিন। কোথায় গেলো আপনার অহংকার আপনার গরিমা?আপনি না প্রায়ই আমাদের বাড়ি এসে বাবাকে বলতেন আপনার স্বামী হেন আপনার স্বামী তেন।স্বামীর সংসারে চাকচিক্য দেখে নিজের আপন রক্তের ভাইকে হাসির পাত্র বানাতেন।এখন দেখান অহংকার।টাকা দিয়ে বুঝিয়ে দিন আপনি আজও সমৃদ্ধশালী।পারবেন?না পারলে বুঝবো আপনারা কাঙ্গাল।”

গায়ে এসে কাটার মত বিধলো কথাগুলো। ফুঁসতে লাগলেন জেসমিন আক্তার।চোখে সেই ঝলক স্পষ্ট।তবে এই গরমি জ্বলসাতে পারলো না অন্বেষাকে।সে অকুতোভয়।সোজাসুজি ফুপুর চোখে চেয়ে আছে।জেসমিন আক্তার বললেন,

“এসব দুই তিন লাখ টাকা আমার কাছে অবহেলায় পড়ে থাকে।আর তুমি আত্মসম্মানহীন বলছো আমাকে?ভাই যাওয়ার আগে তোমাকে মানুষ বানিয়ে যেতে পারেনি। দাঁড়াও এখানেই দাঁড়াও।পুরো দুই লক্ষ টাকা নগদ এনে দিচ্ছি তোমাকে।”

জেসমিন আক্তার ধেইধেই করে উপরে চলে গেলেন।যাক এতদিনে তাহলে আত্মসম্মান বোধ জেগেছে।চোখ খিঁচে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অন্বেষা।মিনিট দশেক পর জেসমিন আক্তার নেমে এলেন।হাতের মুঠোয় মোটা খাম।একপ্রকার ছুঁড়ে দিলেন। অন্বেষা অকিঁচিৎ হাসলো।

জেসমিন আক্তার বলেন,

“কত ভালো অফার দিয়েছিলাম তোমাকে।আমার ঘরে আসার।মানুষের মতো বাঁচতে পারতা”

“এইযে সমাজের স্বনামধন্য বিত্তবান আপনারা?নিজেদের মানুষ বলে দাবী করেন আর অন্যকে অমানুষ।….সত্যি হচ্ছে মানুষ তারাই যাদের মানুষ বলে গণ্য করা হয়না।আসি”

______

শীতের অপেক্ষা করতে করতে অগ্রহায়নের মৃদু ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মেতে ঢাকা শহর।ভাগ্যিস ওয়েদার ফরকাস্ট দেখেছিলো অন্বেষা।আজ ছাতা নিয়েই বেরিয়েছে।যার দৌলতে টাকাগুলো নিরাপদ।দুই লক্ষ টাকা নয় যেনো আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে।এগুলো তার বাবার টাকা।মুখে জয়ের হাসি অন্বেষার।ব্যাগের এককোনে টাকা রেখেছে।বুকে চেপে আছে ব্যাগ।অন্যহাতে ছাতা।হুট করে মন খারাপ হলো।যে মানুষটা দুইলক্ষ টাকার ঊর্ধ্বে জমাতে পারেনি। ব্যাংকের সুদ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি তার পরিণতি কি হলো ভদ্রলোকের সমাজে? অপবাদী? নিমকহারাম?আর?আর মৃত্যু!

লম্বা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির গলিতে ঢুকতেই মনে হলো কেউ তার পিছু নিচ্ছে। শিস বাজাচ্ছে অনবরত। অন্বেষা ঘুরে তাকালো।দেখলো অর্ধ ভেজা বর্ণকে। কৃষ্ণাভ মুখে লম্বা চওড়া হাসি।দাঁত বের করে হাসছে অন্বেষার দিকে চেয়ে।ঝাঁকড়া চুল সিক্ত পরিপাটি হয়ে কপালে ঝুঁকে।পাগলের মত হাসছে।

অন্বেষা ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো, “কি?”

বর্ণ চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসে।বলে,

“কালকে আমারে খাওয়াইতে চাইছিলা।কই খাওয়ন কই?দাও!”

“সাথে নেই এখন….পাগলের মত অযথা কেনো হাসছো?”

“কি করুম?তোমার মুখ দেখলেই হাসি আহে।”

মুখে মানের রেশ।বুঝাতে চাইছে তার উপর রেগে আছে অন্বেষা।আধ পাগল লোকটা বুঝতে পারলে না!বললো,

“একটু পর বাড়ির নিচে এসে নিয়ে যেও।গেলাম আমি”

“তুমি কি আমার লগে গোসা করছো?”

ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো অন্বেষা চলে যাবে বলে।বর্ণের প্রশ্নে আবার ঘাড় ঘুরায়।ভার মুখের অবয়ব বজায় রেখে বললো,

“করলেও কি?”

“করো!না করছে কেঠা?আমার খাওয়ন দাও আমি যাইগা”

অন্বেষা দেখলো বর্ণ ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে।একটু একটু বৃষ্টি তাকে পুরোটাই কাকভেজা করে ফেললো।পাশেই একটা চায়ের দোকান।কোনো মানুষ নেই সেখানে। দোকানী একা বসে। অন্বেষা ছাতা বন্ধ করে শুষ্ক স্থানে গিয়ে বসলো। বর্ণও তাকে অনুসরণ করে এসে বেঞ্চিতে বসে।বর্ণ দোকানির দিকে চেয়ে বলে,

“আমগো দুইকাপ চা দেন চাচ্চা।বিল এই ছেমরি দিবো।বিরাট বড়লোক বুঝলেন!”

দোকানী বললো, “আচ্ছা”

বর্ণ অন্বেষার দিকে চেয়ে বলে,

“দিবা না?এক প্যাকেট সিগারেট লই?”

অন্বেষা আড়চোখে তাকায়। রুষ্ট চাহনি তার।চায়ের বিল দিতে ইচ্ছুক হলেও সিগারেট এর কথা শুনে দুটো বিল বর্ণের ঘাড়ে চাপাতে ইচ্ছে হচ্ছে।বর্ণ অন্বেষার মুখ পরখ করে বলে,

“এমন ঢং করতাছো কেন কও তো?এই দরদ দেখায়া খাইতে ডাকো আবার এহন ঘাড়ত্যাড়ামি!যেমন লাগে চিনোই না।”

অন্বেষা সাথে সাথে জবাব দিলো না।চায়ের কাপ আসে।এক চুমুক দিয়ে বলে,

“যতক্ষণ না তুমি তোমার পায়ের ব্যবস্থা করছো!ততদিন আমার সাথে তোমার কোনো আলাপ নেই।আবারো অপরিচিত হয়ে যাবো।”

“নাটকের শেষ নাই না?”

“নাহ নেই!”

“কইছিলাম জোর করতে না।”

অন্বেষা কিছুটা মুখ ঘুরায়।তবে তাকালো না বর্ণের দিকে।বললো,

“জোর করছি না।অপশন দিচ্ছি।….সরকারি হাসপাতালে বেশি টাকা লাগবে না।যা লাগে আমি আছিতো”

বর্ণ আবারো দুষ্টুমি করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো।মুখ রেডিওর মত ঝিরঝির করতেই থাকে তার।কিন্তু অন্বেষার শেষ বাক্যে কিছুটা থমকে গেলো। ‘ আমি আছিতো’ শব্দজোড়া ছোট কিন্তু বিশাল ভাবার্থ বহন করে।কয়লা রঙের মনে একটু হলেও ছুঁয়ে যায়।কিন্তু নিজের স্বভাব ছাড়লো না।বললো,

“দেহি কি করা যায়!”

“ভাববার সময় আগামীকাল পর্যন্ত।”

“আবার থ্রেট দাও!আমার মাথা গরম কইরো না।”

বর্ণ এক চুমুক চা আবার একবার সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধোঁয়া উড়াচ্ছে। অন্বেষা কিছুক্ষন চেয়ে রইলো বিবর্ণ মুখের দিকে।

“মদও খাও?”

তুচ্ছ হাসলো বর্ণ।বললো,

“মদ খাওয়ার যদি টাকা থাকতো? তাইলে আগে দুইবেলার জায়গায় চারবেলা ভাত গিলতাম। মদ ইজ ভেরি মাচ এক্সপেনসিভ।মাঝেমধ্যে সিগারেট খাই”

হৃদয়টা হুহু করে উঠলো অন্বেষার।কি নিদারুণভাবে বুকের মধ্যে লুকায়িত আর্তনাদ জাহির করে ফেললো!ফ্যাকাশে মুখে।কয়েক শব্দে দুমড়ে মুচড়ে রেখে দিলো চিত্ত।

“তোমার খারাপ লাগেনা মানুষ তোমাকে খারাপ চোখে দেখে যে?ইচ্ছে হয়না এই গুন্ডাগিরী ছেড়ে সঠিক পথে চলার?নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার?”

শূন্যে নাক মুখ হতে সিগারেট এর ধোঁয়া উড়িয়ে বর্ণ গম্ভীর গলায় বললো,

“কারে প্রমাণ করমু?কি কারণে? আপন মানুষরে?নাকি কোনো পররে?….আমারে ত্যাজ্য করার আগে আমার বাপের খারাপ লাগে নাই।আমার মা মরার তিনদিনের মাথায় অন্য বেটি ঘরে তুলতে আমার বাপেরতো কষ্ট লাগেনাই।আমার পশ্চাতে লাত্থি দিয়া সৎ মা ঘর থেকে যখন বাইর করছিলো আমার বাপের তখন মায়া হয় নাই।রক্তের মানুষ আমারে কুত্তার চোখে দেখছে তখনও আমার কষ্ট লাগে নাই।বর্ণের অন্তর নাই।কারে প্রমাণ করমু?যারা আজ আছে কাল নাই।আমার এসব সামাজিকতা ভাল্লাগে না।আমি যেমনে আছি বিন্দাস আছি।”

চলবে…

#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা

১২.

ডাক্তার সাহেব রাগারাগি করছেন।ভীষণ রকমের চটেছেন বর্ণ মহাশয়ের উপর।বর্ণ তাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে রীতিমতো।গলার আওয়াজ উচ্চ শুনলেই মাথা ঠিক থাকে না।আধ টাক ডাক্তারের মাথায় কখন বারি দিয়ে বসে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। দাঁতে দাঁত চেপে মূর্তি বনে রইলো।ফোঁসফোঁস করতে করতে অন্বেষার পানে তাকিয়ে দেখলো তার গুরুত্বহীন মুখ।বর্ণের মেজাজের দ্বার দ্বারলো না সে।

বর্ণের পা পরখ করে ডাক্তার অত্যন্ত মেজাজ দেখিয়ে জানিয়েছেন ছোট একটা দানার মত টিউমার ছিলো।সময় দিয়ে আদর যত্নে লালন করে বড় করেছে।টেস্ট ধরিয়ে দিলেন ডাক্তার। কড়া গলায় জানালেন আজই যেনো করানো হয়।আর যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন এর ব্যবস্থা করতে হবে।

বর্ণ অন্বেষা বেরিয়ে গেলো।উল্টো পথে পা বাড়ালে অন্বেষা শার্টের কলার পেছন থেকে চেপে ধরে আটকে দেয় তাকে।কিছু বলার পূর্বেই বর্ণ রাশভারী গলায় বললো,

“ভালো মানুষী দেখাইয়া তোমার কথা রাখছি।ডাক্তারের কাছে আইছি।এবার চলো এদিক থিকা।আমার ফিনাইল এর গন্ধ সহ্য হয়না।”

অন্বেষা প্রশ্ন করে,

“ডাক্তার কি বলেছে শুনোনি?টেস্ট করাতে হবে।”

“ডাক্টারগো কামই এটা। চলো”

“টেস্ট করিয়ে তারপরই বেরোবো।তার আগে নয়।”

রেগে যায় বর্ণ।তেড়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়।কাছাকাছি আকস্মিক বর্ণের ভয়ঙ্কর মুখ দেখে অন্বেষা প্রতিক্রিয়া শূন্য হয়ে চেয়ে রইলো।বর্ণ চোয়াল শক্ত করে ধীমা কণ্ঠে বলে,

“রক্ত চড়াইও মাথায়!আমার সময় হইলে আমি টেস্ট কইরা যামু।”

“এখনই সময়….কেনো আবার বেঁকে বসলে আমিতো সেটাই বুঝতে পারছি না”

বর্ণ কোনো জবাব দিলো না।কিভাবে বলতে তার কাছে টেস্ট এর টাকা বহন মত টাকা নেই।নিজের কাছেই নিজে ছোট হয়ে যাবে।সাথে অন্বেষার মনে দয়া জন্মাবে।যা কোনোভাবেই চায় না বর্ণ। দয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তার।

“টাকার কথা ভাবছো তাই না?”

মনে চলমান কথা বাস্তবে অন্বেষার মুখে শুনে চমকে উঠে বর্ণ।সঙ্গেসঙ্গে নিজেকে সামলে নিলো। দাঁতে দাঁত পিষে বর্ণ বলে,

“হ ভাবতাছি….নাই টাকা আমার কাছে!এখন কি করবা দয়া দেখাইবা না? দান কইরা মহান হইবা?আমারে মেরুদণ্ডহীন পোলা মানুষ বানাইবা”

কথাগুলো যেনো বিষ মিশ্রিত।ভুল বুঝছে বর্ণ। অন্বেষা বর্ণের দিকে চেয়ে বললো,

“মেরুদণ্ডহীন পুরুষ না হলে একটা সত্যি কথা বলো।এখন যদি তোমার জায়গায় আমি থাকতাম?আমার বিপদে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হতো।তুমি করতে না?”

“জানি না” দায়সারা ভাবে জবাব দেয় বর্ণ।

“দিতে কি না?”

বর্ণ ঠোঁট কামড়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে।কপালে গাঢ় ভাঁজ পরেছে।কয়েক সেকেন্ডের ভাবনার পর অন্বেষার দিকে সরু দৃষ্টি রেখে বললো,

“করতাম!কিন্তু তোমার সাবজেক্ট আলাদা”

“কারণ আমি মেয়ে তাইতো?আমি অবলা।আমাকে যে ইচ্ছে সাহায্য করতে পারে।বিশেষ করে ছেলেরা।যখন ইচ্ছে সহানুভূতি দেখাতে পারে,যখন তখন দান করতে পারে,দায়িত্ব নিতে পারে,ভরণ পোষণ দিতে পারে।আমারতো গায়ে লাগবে না।কারণ আমিতো মেয়ে।দুর্বল এবং অন্যের উপর নির্ভরশীল।”

“এসব খাজুইড়া আলাপ কেন পারতাছো।ধৈর্যের সীমা পাড় কইরো না আমার।চুপ আছি আর একটা কথা রাখছি দেইখা মনে কইরো না কিনা নিছো”

অন্বেষা করুন গলায় বললো,

“সবসময় পুরুষরাই কেনো?নারীরা কেনো নয়?…. আজ তুমি আমাকে সাহায্য করলে সেটা হতো গৌরবের।আমি তোমার জন্য কিছু করতে চাইছি সেটা আত্মসম্মানে লাগছে?কেনো নারীদের অবদানগুলো তোমাদের পৌরুষে আঘাত হানে?স্বাভাবিক চোখে দেখলে হয়না?”

বর্ণকে থামিয়ে রেখেছে কথার জেরে। গলাকে একটু বিশ্রাম দিয়ে আবার বললো,

“এখন বলবে এটাই সমাজের নিয়ম।….তাহলে আমিও প্রশ্ন করবো।…সমাজ তোমাকে কি দিয়েছে?”

লালবর্ণে রঞ্জিত অন্বেষার মুখপৃষ্ট নিকটে থেকেই দেখছে বর্ণ।স্থির হিয়ামিত নজর। অন্বেষার প্রতিটি কথা কর্ণপাত হয়েছে, বোধগম্যও বটে।সত্তয়াল করে বললো,

“আমার লেইগা তোমার কিসের এত চিন্তা?”

অন্ত:সারশূণ্য মস্তিষ্কে অন্বেষা জবাব দেয়, “জানি না।”

সময় নেয় অন্বেষা।বর্ণ নির্বিকার চেয়ে আছে। নেত্র পল্লব বারংবার ঝাপটে বললো,

“আমি কাউন্টারে বিল দিয়ে এসেছি। সিরিয়াল আসলে ডাকবে তোমাকে।চেয়ারে গিয়ে বসো”

বর্ণের কপালের রগ ফুটে আছে। কিছুটা ঝুঁকে বসে আছে।মেজাজ তুঙ্গে।নাকের পাটা ফুলেফেঁপে উঠছে দণ্ডে দণ্ডে।পুরুষের অহংবোধে জ্বলে পুড়ে ছাই।একবার তাকালো ক্রমাগত এদিক ওদিক হাঁটতে থাকা অন্বেষার দিকে।মজা করে বললেও ঘাড়ে শক্ত করে চেপে বসেছে সে।ছাড়বে না উল্টো তেজ দেখাবে।তার এমন হাঁটাচলা দেখে ইচ্ছে হলো চলে যাক এখান থেকে।যেমন ভাবলো তার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়।কিছু কদম এগিয়ে আবার ফিরে আসে। কোমরে হাত রেখে এদিক ওদিক চেয়ে হাঁসফাঁস করছে।ফিক করে হেসে উঠলো অন্বেষা।মাথার তার ছিড়া এই ছেলের।আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসেছে।বর্ণের নাম আসলে প্রবল অনিচ্ছা থাকতেও উঠে গেলো।

অন্বেষা হাঁটতে হাঁটতে বললো,

“তোমার জীবনের প্রতি কোনো দয়া মায়া নেই তাই না?”

“নাই”

অন্বেষা মৃদু হেসে বলে, “আচ্ছা”

ব্লাড টেস্ট করাতে এসে বিপত্তি বাঁধলো। বর্ণের মুখ বুলডোজারের মত চলতে শুরু করেছে। সিরিঞ্জ,তুলো ইত্যাদি সামগ্রী হাতড়ে দেখছে।বিরক্ত নার্স।এগিয়ে এসে বললো,

“হাত দিন।এগুলো রাখুন”

বর্ণ ডান পাশের ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,

“আপনার বাড়ি কই?”

নার্স এবং অন্বেষা দুজনেই অবাক।তার বাড়ি কই সেটা জেনে কি করবে? নার্স জবাব দিলেন,

“হবে কোনো জায়গায়”

“ভাব নিলেন?”

নার্স বিরক্তির সুরে প্রশ্ন করেন, “কেনো ভাব নিবো?”

“আপনি কি ভাবছেন ঠিকানা কইলে আমি আপনার বাড়িতে বিয়ার প্রস্তাব দিমু?আমার রুচি এত খারাপ না!”

বিরক্তি মাত্রা ছাড়ালো।ক্ষেপে যাচ্ছে।শুধু দায়িত্বের দায়ে কিছু বলতে পারছে না। অন্বেষা এগিয়ে আসে।চোখ রাঙিয়ে তাকে চুপ থাকার ইশারা করছে।বর্ণ আবার বললো,

“এই ছেড়ির চোখ দুইটা অপারেশন কইরা কেউরে দান করতে পারবেন?উহু দান না,বেইচ্যা দেন!হাফ টাকা আপনার হাফ আমার”

নার্স নিজেকে দমাতে না পেরে ভারী গলায় বললেন,

“আপনি চুপ থাকুন।আমাকে আমার কাজ করতে দিন”

নার্স তার রাগ দেখাতে শুরু করলো বর্ণের হাতের উপর।বর্ণ বলে,

“আমি মানুষ…মানুষের মতোই রক্ত নেন।কইলাম তো আমি আপনার বাড়িতে বিয়ার প্রস্তাব দিমু না যান”

নার্স দ্রুত নিজের কাজ সেরে বর্ণকে বাহিরে পাঠিয়ে দিলো। কোথা থেকে এসেছে এই ইতর লোক?মুখে লাগাম নেই একেবারেই। অন্বেষার মেজাজও ভারী খারাপ।পারলে এখনই মাথায় আঘাত করে মাথা দুইভাগ করে ফেলতো।ঢাকা মেডিকেল থেকে আসে দুজনেই।বর্ণ যাবে কাজে।আর অন্বেষা বাড়িতে।

বর্ণ হাঁটতে হাঁটতে বললো,

“কত টাকা খরচ গেলো হিসাব দিওতো”

অন্বেষা তার কথা শুনে বিড়বিড় করে বলে,

“মেল ইগো!”

“কিছু কইলা?”

“নাহ! কোথায় যাবে এখন?কাজে?”

“হ”

“রাতের খাবার?”

“রাইতে খাই না আমি”

বলে চলে গেলো বর্ণ।এক মুহুর্ত দাঁড়ায়নি।

_______

“ভাইজান কই?আমার ভাইজান কই?”

অন্বেষা সামনে সাব্বির।বরাবরের মতই তার হাত মুখ আর কাপড়ের অবস্থা নাজেহাল।পায়ের জুতোটাও ছিঁড়ে গেছে।কে জানে কোথা থেকে খবর পেলো?দৌঁড়ে এসেছে হাসপাতালে। অন্বেষা শাসানোর সুরে বললো,

“তুমি একা এখানে কি করে আসলে?”

“ভাইজান এর খবর পাইয়া আইছি”

“তোমার একা আসা মোটেও ঠিক হয়নি।”

সাব্বির লম্বা চওড়া হাসি দিলো।বললো,

“আপনে কি আমারে পোলাপান ভাবছেন আপা?আমি কিন্তু পোলাপান না।আমার বয়স সতেরো।বাউনা আমি।লম্বা হই না।ছোটবেলা থিকাই এই সমস্যা”

অন্বেষা তার কথায় ঠোঁট কামড়ে হাসে।কি সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল কথা বলার ভঙ্গিমা।প্রাণ জুড়ায় সাধারণের মাঝে অসাধারণ খুঁজে।সাব্বির এর মাথায় হাত রেখে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

“আঠারোর নিচে সবাই শিশু বুঝলে।আর রইলো তোমার ভাইয়ের কথা?তাকে ডাক্তার চেক আপ করছেন।একটু পর পায়ের অপারেশন হবে।”

মুখটা শুকনো দেখালো সাব্বিরের।যেনো ভীষণ চিন্তা তার। অন্বেষার দিকে মলিন মুখে তাকিয়ে বলে,

“ভাই একবারে ঠিক হইয়া যাইবো না?”

“হ্যাঁ…একদম ঠিক হয়ে যাবে।”

“আমি থাকি?”

সাব্বিরের মুখের দিকে চেয়ে না করতে পারলো না।সম্মতি দিলো থাকার। তবে একটি বরাদ্দকৃত স্থানে বসতে বলা হলো। অন্বেষা এগিয়ে যায়। ডাক্তার চেক আপ করে বেড়িয়েছেন মাত্র।দুপুর একটায় শুরু হবে অপারেশন।এখন বাজে বারোটা বিশ। অন্বেষা সাব্বিরকেতো আশ্বাস দিলো কিন্তু নিজেকে? ডাক্তারের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো,

“সব ঠিক আছে স্যার?”

“আপাতত ঠিক আছে।কিন্তু আপনার হাসবেন্ড বড্ড বেশি কথা বলে।বিরক্ত করে ছেড়েছে।”

হচকচিয়ে উঠলো অন্বেষা।কি থেকে কি বলে?সম্পর্ক না জেনে হাসবেন্ড বানিয়ে দিলো।অস্থির আর অসস্তিবোধ শুরু হলো অন্বেষার মাঝে।ডাক্তার চলে যেতে চাইলে আবার ডেকে বললো,

“স্যার অপারেশনের পর সব ঠিক থাকবে?”

“ভাগ্যিস অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার আগে নিয়ে এসেছেন।আমরা আমাদের বেস্ট ট্রাই করবো। ওটিতে নেওয়ার আগে দেখা করে আসুন।”

এক তপ্ত রৌদ্রোজ্জ্বল দ্বিপ্রহরে সাক্ষাত হয়েছিলো ছন্নছাড়া এলোমেলো পুরুষের সাথে।কি করে জীবনের সাথে জুড়ে গেলো?অবশ্য অজান্তে সুযোগ দিয়েছে অন্বেষা নিজেই।সম্পূর্ণ অচৈতন্যে। বেডে শুয়ে অশান্ত; অতিষ্ঠ বর্ণ।বিবর্ণ মানব পৃষ্ঠ।একেবারেই সন্তুষ্ট নয় সেই ব্যাপারে যা ঘটতে চলেছে তার সাথে। রংহীন মনের কোথাও একটা উশখুশ ভাব রয়েই গেছে। অন্বেষাকে আসতে দেখে মুখ কুঁচকে ফেলে।অসন্তোষে ঘেরা তাকানি।

অন্বেষা পাশে এসে দাঁড়ালো।দ্বিধা দ্বন্দ ব্যতীত প্রশ্ন করলো,

“ভয় হচ্ছে?”

বর্ণ জবাবে উল্টো শুধায়, “ভয়?আমার?”

“হুম! তোমারতো আবার ডর ভয় নেই।অন্য কোনো সমস্যা? হাঁসফাঁস করছো যে?”

“আমার ভাল্লাগতাছে না এগুলি!কাটাছেঁড়া করবো।আবার ঔষধ খাওয়া লাগবো, হাঁটা যাইবো না।আমি একদিন বাইরে না গেলে আমার দম বন্ধ লাগে।”

অন্বেষা বুঝানোর সুরে বলে,

“অল্প কিছুদিনের ব্যাপার।এরপর দৌঁড়ে বেড়াবে।”

“আমি এহনও দৌঁড়াইবার পারি। দেখবা?”

“না না কোনো দরকার নেই।”

বর্ণ চুপ হয়ে রইলো।বারবার পায়ের দিকে চাইছে।কপালে আঙ্গুল ঘষছে।সাতাশ বছরের এক তাগড়া পুরুষকে এমন ওলটপালট লাগলো অন্বেষার কাছে।শক্ত মানব মুখে শিশুসুলভ ছায়া।ইচ্ছে হলো উষ্কখুষ্ক চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে শান্ত করতে। পরক্ষণেই ভাবে, এসব ভাবনার মানে কি? ছ্যাঁচড়ামো হয়ে যাবে।কোনো পোক্ত সম্পর্ক বিহীন এক নারী এক পর পুরুষের মাথায় হাত বুলাচ্ছে।দৃষ্টিকটু দেখায়,অনুভব করায়ও বটে।নিজের চিন্তার উপর খানিক লজ্জা হয়।

অন্যমনস্ক অন্বেষার ভাবুক মুখের দিকে চেয়ে বর্ণ বললো,

“মাইয়া তুমি একটা চিজ!আমারে টাইনা আইনা ডাক্তারের ছুরির নিচে শোয়ায় ছাড়লা!”

বাস্তব জগতে ফিরে এলো অন্বেষা।বর্ণ যা বলেছে ঠিকঠাক শুনেছে।হেসে জবাবে বললো,

“সত্যিই!তোমার মত ক্ষ্যাপা ষাঁড়কে এই পর্যন্ত এনে আমি নিজের প্রতি গর্বিত”

চলবে…..