উন্মুক্ত লাইব্রেরী পর্ব-১৩+১৪

0
71

#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা

১৩.

অনেকটা অপেক্ষার পর অপারেশন শেষ হয়েছে।অজানা ভয়ে কাতর ছিলো এতক্ষণ অব্দি অন্বেষা। অস্থিরতায় মাথা গরম হয়ে ঘাম ঝরছিলো।সাব্বির অনেকবার অনেক প্রশ্ন করেছে।জবাব দিতে পারেনি।সেই মুহূর্তে অন্বেষা নিজেই ছিলো সাব্বিরের চেয়ে বেশি নির্বোধ।পায়ের অপারেশন শরীরে তেমন ফারাক না ফেললেও এনেসথেসিয়ার প্রভাব কমে গেলে প্রচন্ড ব্যথা হবে।স্বাভাবিক একটি চামড়ার উপর কাটাছেঁড়া চারটে খানি কথা নয়।

সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দৌঁড়ের উপর থাকেন। অপারেশন শেষে ছোট্ট একটা কথা বলেছেন “অল ওকে”।ব্যাস!এতটুকুই।

ক্যাবিন খালি নেই।বাধ্য হয়ে ওয়ার্ডে শিফট করা হলো বর্ণকে।খিটখিটে মেজাজ তার।ভারী বিরক্ত অন্বেষার উপর।সাব্বির বর্ণকে দেখে ভীষণ খুশি।পায়ের ব্যান্ডেজ এর দিকে একবার চায়।আরেকবার বর্ণের দিকে। অন্বেষা দুই দিকের পর্দা টেনে পাশে বসলো।নমনীয় সুরে প্রশ্ন করলো,

“কেমন লাগছে?”

তুচ্ছ হেসে বর্ণ বলে,

“সেই মজা লাগতাছে। থিয়েটারে রং বেরঙের নমুনা দেইখা আইলাম।এখন তোমারে দেখতাছি।পায়ের মধ্যে ইয়া বড় প্লাস্টার।এত মজা আমার জীবনেও লাগে নাই”

অন্বেষা চোখ বুঁজে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে।হয়তো কোনো পরিস্থিতিতেই বর্ণের ক্যাটক্যাট করা থামবে না।হাতে প্রেসক্রিপশন। ওষুধ আনতে হবে।সাথে দুপুরের খাবার।আজ ভার্সিটির ক্লাস কামাই করেছে সাথে অফিস থেকেও ছুটি নিয়েছে।তবে বাড়ি গিয়ে রাঁধতেই হবে। অন্বেষা বললো,

“সাব্বির তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে থাকো।আমি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসি। ওষুধও আনতে হবে।”

সাব্বির মাথা দোলায়।বর্ণ নির্বিকার দৃষ্টি ফেলে অন্বেষার যাওয়ার পানে।তাকে দেখলে সুপ্ত মনে একটাই প্রশ্ন জাগে। ‘ এতকিছু?তাও বর্ণের জন্য?কেনো?কি কারণে?’ দৃষ্টির বাহিরে চলে গেলে নজর পড়লো পায়ে।চিনচিন করে ব্যথা উঠছে।অনুভব করলো এই ব্যথা। পা হতে যেনো দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করতে শুরু করলো ব্যথা।বর্ণের ঠোঁট শুকিয়ে চৌচির। মস্তিষ্কে উদ্ভট উদ্যম জাগে।কিছুতেই কাবু হওয়া যাবে না এই পীড়ার।বেদনায় ধরে ফেললে নিজেকে পরাজিত মনে হবে।হোক ব্যথা!আরো বেড়ে যাক।আজ পরখ হয়ে যাক বর্ণের ধৈর্যের সীমা কতটুকু?নিজের বিচিত্র অনুভবগুলো উপলব্ধি করতে শুরু করে।

সাব্বির জিজ্ঞেস করলো, “ও ভাইজান পাও ব্যথা করেনি?”

নিজের মধ্যেই হারিয়ে বর্ণ বলে উঠলো,

“হ করে।কিন্তু ব্যথা ভাল্লাগতাছে রে সাব্বির…কি আজব ছটফটে অনুভূতি…টনটন করে একেকটা রগ!রক্তের মত এদিক ওদিক দৌঁড় পারে”

________

অন্বেষা খাবার নিয়েছে। সাথে দরকারি ঔষধ।একটুপর নার্স এসে বর্ণকে ইনজেকশন দিবেন।খাবার প্যাক হওয়ার পর চলে গেলো ওয়ান টাইম প্লেট এবং গ্লাস কিনতে।সবকিছু হাতে নিয়ে তবেই ফিরতি পথে হাঁটা শুরু করে।কিছু সময় থামলো।আকাশের দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে।যেনো এই হাসি তার বাবা মা দেখছে।তাদের বুঝাতে চাইছে সে খুব খুশি।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অনেকদিন পর।এত ভালো লাগছে কেনো জানা নেই।তবে মনের মাঝে অন্যরকম প্রশান্তির দোলা।

ভাগ্যিস টাকাগুলো পেয়েছিল।নয়তো কিছুই করতে পারতো না।আগামীকাল গিয়ে একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলবে।কিছু টাকা রেখে বাকি টাকা ব্যাংকে জমা করে আসবে।এসব ভাবতে ভাবতে তিনশত চার নম্বর ওয়ার্ডে হাজির অন্বেষা।সামনের দৃশ্যে চোখ ছানাবড়া।অপারেশন করা পা অন্য পায়ে তুলে রাজার হালতে শুয়ে আছে বর্ণ। অন্বেষা দৌঁড়ে গেলো।তাড়াহুড়ো করে পা নামিয়ে ধমকে বললো,

“তোমার কি জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? পা তুলে রেখেছিলে কেনো?”

“আমার জ্ঞান বুদ্ধি নাই।যা আছিলো তোমার লগে থাইকা ওইটাও শেষ!”

“আমাকে ইচ্ছে করে বিরক্ত করছো তাই না?”

“তোমার মনে হয়না তুমি আমার লেইগা বেশি বেশি বাড়াবাড়ি করতাছো।”

অন্বেষা জবাব দিলো না।নার্সকে ডেকে জানলো খাবার দেওয়া যাবে কিনা।সেলাইন শেষ হয়ে এসেছে। নার্স এর কথামত পনেরো মিনিট পর খাওয়ানো যাবে।ততক্ষণে অন্বেষা সাব্বিরকে খাবার দিয়ে বসলো চেয়ারে।ক্লান্ত লাগছে ভীষন।

হুট করে বর্ণের তরফ থেকে অভাবনীয় প্রশ্ন আসে,

“তুমি খাইবা না?”

অন্বেষা চাইলো বর্ণের পানে।মুখ বর্ণহীন। নিষ্পলক চেয়ে প্রশ্নটি করেছে বোঝা গেলো। অন্বেষা কোনো জবাব দিলো না।নিজের খাওয়ার কথা ভাবেনি এখনও। উল্টো অন্য পাত্রে খাবার বেড়ে সাব্বিরের উদ্দেশ্যে বললো,

“তুমি খেয়ে তোমার ভাইজানকে খাইয়ে দিতে পারবে না?”

সাব্বির মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিতে যাচ্ছিলো।তখনই বর্ণ বললো,

“আমি ঠ্যাং দিয়া খাই না।হাত দিয়া খাই।”

অন্বেষা গুরুত্ব দিলো না এবারও।সাব্বিরের দিকে চেয়ে রইলো জবাবের আশায়।বর্ণ ক্যাটক্যাটে গলায় বলে উঠে,

“আমার হাত সহি সালামত আছে।নিজের খাওয়া নিজে খাইবার পারুম।রং তামাশা করা লাগবো না।”

অন্বেষা সাব্বিরের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

“আমি বিকেলে বাড়ি যাবো।রান্না করতে হবে।তুমি থাকবে এখানে?”

“হ আপা থাকুম।আমার আম্মারে কইছি সন্ধ্যায় আইতে। কাম শেষ কইরা আইবো”

“আচ্ছা।কি কাজ করে তোমার মা?”

“আম্মা মাইনষের বাড়ি বাড়ি কাম করে।আর আব্বায় রিকশা চালায়।”

ভালো লাগে শুনতে যে পৃথিবীতে এখনও সৎ কর্ম করে কেউ বেঁচে আছে।অন্যদিকে খারাপ লাগে সৎ থাকার পরও ভালো থাকা হয়না।সাব্বির এর অবস্থা ঠিক এমন। অন্বেষা স্নেহের দৃষ্টিতে তাকায় সাব্বিরের দিকে।ধুলোবালি মাখা মলিন মুখ।বিকাশ হয়নি তার ঠিকমতো।সতেরো বছর হলেও দেহে আর আচরণে কোনো ছাপ নেই।

কিছুসময় পর অন্বেষা বর্ণের দিকে তাকায়।নিজে থেকেই খাবার নিয়ে খেতে শুরু করেছে। খিঁচে মুখ কুচকাচ্ছে বারংবার।অলৌকিকভাবে মনে হলো ব্যথা হচ্ছে নাতো আবার?শুধায় নরম গলায়,

“ব্যথা হচ্ছে?”

ঘাড়ত্যাড়ার মত উত্তর দিলো, “না”

ইতিমধ্যে নার্স এসেছে।খাওয়া শেষে অন্বেষা জানায় ব্যথার কথা। নার্স পেইন কিলার দিলেন।বললেন তিনদিন পর ছেড়ে দেওয়া হবে বর্ণকে।এটা শুনে বর্ণের বিরক্তি আকাশে।

_________

“জব্বার চাচা আজ খাবার দ্রুত নিয়ে যাবেন”

জব্বার চাচা ফোনের অন্যপাশে থেকে শুনলেন।ভীষণ ব্যস্ত শোনাচ্ছে অন্বেষার কন্ঠস্বর। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করেন,

“আম্মা তোমার তাড়া আছে নাকি আজকে কোনো?”

“হ্যাঁ চাচা।”

“এই বিকাল বেলা নিয়া গেলে এতগুলি খাবার নষ্ট হইবো।আমি কই রাখমু। ফ্রিজওতো নাই?”

বিষয়টা চিন্তার।আসলেই রাতের খাবার বিকেলে নিলে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে।ফোন লাউড স্পিকারে রেখে কথা বলছে অন্বেষা।জব্বার চাচাকে কলে রেখেই ভাবতে লাগলো উপায়।ঠিক তখনই সুদীপ্তা এসে চুলোর আঁচ কমিয়ে দেন।

বললেন,

“এই তোমার তরকারিতো পুড়ে যাচ্ছে”

হুশে এলো যেনো।দ্রুত কণ্ঠে জব্বার চাচাকে জানায় একটুপর কল করছে। সুদীপ্তা তার চিন্তিত মুখপানে চেয়ে বললো,

“তুমি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”

“না তেমন কিছু না”

সুদীপ্তা আশ্বাস দেওয়ার সুরে বললো,

“আমিতো তোমার বোনের মতো। বলো কোনো সমস্যা হলে।যদি পারি সমাধান করতে।তোমাকে যে ক’দিন যাবত দেখেছি শুধু খাটুনি করতে দেখছি।”

হতাশ চোখে চাইলো অন্বেষা সুদীপ্তার দিকে।সুন্দর তার মুখখানা।কেউ দেখলে বলবে বিরাট বড়লোক বাপের সুন্দরী বেটি।তবে বাস্তবতা ভিন্ন।আপন ভেবে বললো,

“আমাদের মত মানুষের জীবনের ওপর নাম পরিশ্রম।”

“তুমি কি হতাশ দিদিমনি?”

অন্বেষা ত্বরিত হাসলো।বললো,

“একদমই না। মাঝেমধ্যে ক্লান্ত হয়ে যাই।”

সুদীপ্তা খুব যত্ন করে অন্বেষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।বললো,

“আমি তোমায় সাহায্য করবো। বলো কি করতে হবে?”

“আপনি পারবেন না দিদি।আপনার ছোট বাচ্চা। আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না।”

সুদীপ্তা জোর করে অন্বেষার হাত থেকে খুন্তি নিয়ে নেয়।নিজেই নাড়াচাড়া করতে লাগলো তরকারি।বললো,

“দিদি যেহেতু ডেকেই ফেলেছো সেক্ষেত্রে আর কোনো কথা হবেনা। কার সাথে কথা বলছিলে বললে না যে?কি করতে হবে আমার বলো?”

অনেকটা সময় নিয়ে ভাবলো অন্বেষা।এভাবে কি তার ঘাড়ে চাপানো ঠিক হবে?ছোট বাচ্চা নিয়ে কি পারবেন এসব করতে?খারাপ দেখায়।সুদীপ্তা আবারো তাগাদা দিলেন।বাধ্য হয়ে অন্বেষা বললো,

“একজন চাচা আসবেন খাবার নিতে।সন্ধ্যা আটটায়।আমি থাকতে পারবো না।হাসপাতালে যেতে হবে।আপনি শুধু খাবারগুলো গরম করে বাটিতে করে তার কাছে দিয়ে দিলেই হবে।”

“মাত্র এইটুকু কাজ? পারবো।তুমি চাচার নাম্বার দাও আমায়।….আর হাসপাতালে যাবে কেনো?কে ভর্তি?’

অন্বেষা জবাবে বলে,

“আছে একজন আমার মতই।যার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেউ নেই..”

_________

অসুস্থ মানুষকে ফল খাওয়াতে হয়।মানুষ যদি জাতের হয় তবে তাকে খাওয়াতে কোনো সমস্যা হয়না।কিন্তু বর্ণকে তাদের স্বজাতি মনে হয়না কিছুতেই। ফল নাকচ করছে।খাবে না।এসব স্বাস্থ্যকর জিনিসে নাকি গা গুলিয়ে আসে তার। অন্বেষা তারপরও কেটে কেটে রাখলো তার সামনে।আজ মুখ থেকে কোনো প্রকার ত্যাড়া কথা বেরোচ্ছে না।বর্ণের কথার জবাব দিয়ে তর্কেও জোরালো না অন্বেষা।

ফল এগিয়ে দিয়ে বললো, “খাও”

বলে নিজের বই বের করে।দুটো চেয়ারে নিজের সংসার পেতে বসেছে অন্বেষা।বর্ণ বললো,

“সারারাত আমার লগে থাকবা?”

প্রশ্নটি শুনতে অদ্ভুত শুনায়। অদ্ভুত এর চেয়েও বেশি। অন্বেষা অসস্তি বোধ করে।বলে,

“উপায় নেই এছাড়া।”

বর্ণ থমথমে গলায় বলে উঠে,

“বাড়ি যাও।আমি নিজেরে সামলাইতে পারি একলাই”

অন্বেষা স্থির নয়নে বর্ণের দিকে চায়।সেভাবেই চেয়ে রইলো কিছু সময়। জবাব দিলো সময় নিয়ে।বলে,

“মাঝপথে একা ফেলে যাওয়ার মানুষ আমি নই”

কে জানে কথা ও দৃষ্টির গভীরত্ব পরিমাপ করতে পারলো কিনা বর্ণ?তবে জবাব দিলো,

“আমিতো কোনো পথেই আগাইতে চাই নাই।তুমি মাঝপথে কেমনে পৌঁছাইলা?”

অন্বেষা এমনটাই আশা করেছিলো।বর্ণের কাছে সবকিছুই তাসের পাতার মতো।তাছাড়াও অন্বেষা গুরুত্বহীন তার কাছে।তার জন্য একটি পুরো দিবস দিয়ে দিলো তাতে মনে হয় না তার কিছু আসে যায়।হয়তো একপাক্ষিকভাবে অন্বেষাই তার মলিন মুখ দেখে মায়া উজাড় করে যাচ্ছে।

অন্বেষা নিজের বই আর খাতা বের করলো।ছোট্ট টেবিলে আয়েশ করে বসে।তার দিকে নির্বিশেষ চেয়ে বর্ণ।ভাবসাব ভালো ঠেকলো না। মুখশ্রী তারই মতো বিবর্ণ।কি হলো হঠাৎ এই মেয়ের?সারাদিন পরখ করে অবশেষে প্রশ্ন করলো হৃদয়।

হাসপাতাল এর বেডের খালি অংশে কনুই ঠেকিয়ে পড়ায় মনোযোগী হয় অন্বেষা।বর্ণ ইচ্ছেকৃত চেপে গিয়ে জায়গা দিয়েছে তাকে।

“পড়ার নাটক করতাছো?জানি আমার লগে কথা না কওয়া লাগে?”

নজর বইয়ে রেখেই অন্বেষা বলে,

“যে সোজা মুখে জবাব দেয়না তার সাথে কিসের আলাপ?…তাছাড়াও আমার সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা”

“এমনেই সারারাইত বইয়া থাকবা?”

“অভ্যাস আছে রাত জেগে বসে পড়ার।কেনো তোমার চিন্তা হচ্ছে নাকি?”

“ঠ্যাকা পড়ছেতো আমার!”

“তাহলে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ঘুমাও”

বর্ণ দুহাত মাথার পেছনে একত্রিত করে শুয়ে পড়লো।একদম কোনায় তার বেড।দেয়ালের সাথে মিশে জোৎস্না দেখছে ছোট্ট জানালা হতে।ভাবছে বর্ণ।আজকালের বেশ কিছু কর্মকান্ড যা ঘটছে সবকিছুই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে।সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় কেউ তার ব্যাপারে ভাবছে।এই বিষয়টি মেনে নিতেই পারছে না বর্ণ।কিছুতেই না।ভাবনা চিন্তার ছেদ ঘটে আভাসে।মনে হলো অন্বেষা চেয়ে আছে তার দিকে।বর্ণ সেদিকে না তাকিয়ে বললো,

“আমারে নিয়া যে তোমার মনে জোনাকি পোকা উড়তাছে ঐগুলারে থামাও”

“তুমিও নিঃস্ব,আমিও…. সঙ্গ থাকলে ক্ষতি কি?আমি তোমার মত মজবুত নই।আমি ভেঙে পড়ি প্রায়শই।তোমার কাছে যা তুচ্ছ আমার কাছে খুব প্রিয়,মূল্যবান,প্রয়োজনীয়,আবশ্যক।”

হাসপাতালের বিছানায় মাথা পেতে অজ্ঞাতসারে তন্দ্রায় ডুবে অন্বেষা।তখন রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর।মিটমিটে যে তাঁরারা ছিলো?তারাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।তাদের হারিয়ে যাওয়া দেখেছে নির্ঘুম বর্ণের দুচোখ।নিঃশ্বাসের সাথে বুক উঠানামা করছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। উন্মত্তের ন্যায় অসহ্য পায়ের পীড়া অনুভব করতে করতে চোখ গেলো অন্বেষার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে।মায়া হওয়া উচিত?কেনো সে অনুভূতিহীন?গায়ে মাখে না কিছুই।আশপাশে তার মতো অনেকেই ব্যথাকাতর।তবে বর্ণ জানতে চায়, কতোটা?দ্বিগুণ?তিনগুণ?নাকি হাজারগুণ বেশি পীড়া তাদের?তার জন্য বরাদ্দ চাদর অন্বেষার গায়ে উড়িয়ে দিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বুজে।

চলবে……

#উন্মুক্ত_লাইব্রেরী
লেখা – আয্যাহ সূচনা

১৪.

সন্ধ্যা নামছে ব্যাপৃত ঢাকা নগরীতে। আকাশে লাল আভা মেখে সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবে গেছে। তখনও শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়নি।এবার যে নীড়ে ফেরার পালা।রাস্তায় যানবাহনের গর্জন দূর হতে কর্ণপাত হয়।আর মানুষের ভিড়ও একটু একটু করে পাতলা হয়। বাতাসে তখন একটা মিষ্টি শীতলতার পরশ, যেন দিনের ক্লান্তি মুছে দিয়ে রাতের স্বপ্নময়তার গল্প বলতে চায়।শহরের প্রতিটি ইট-পাথরের গায়ে লুকিয়ে আছে অগণিত অজানা বিবরণ।তারপরও মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সেই সন্ধ্যার বাড়ি ফেরার মুগ্ধতা।

“তুমি আমার মত একটা মানুষের লেইগা এত খাটা খাটনি কেন করতাছো?”

“কখনো কারো জন্য খাটুনির সুযোগ পাইনি তাই”

“ঢং মারাও?”

“কুৎসিত ভাষা! ছিঃ!”

ছন্নছাড়া অনুভূতিহীন বর্ণ।চেয়ে আছে অন্বেষার দিকে অর্থহীন চাহনিতে।বুকের মধ্যে থাকা অনুভুতি উৎপাদনে অকার্যকর হৃদপিন্ড বুঝতে পারছে না তাকে।হাসপাতালের বিছানার পাশে বসে অন্বেষা।সারা দিবা এবং রাত্রি।দুইদিন ধরে এমনি চলছে।তার নিঃশব্দ যত্নে কাটে প্রহর।অপারেশনের পর তদারকিতে কোনো কমতি নেই।এত যত্নে অভ্যস্ত নয় বর্ণ।অন্বেষার যত্নমাখা সেবায় অস্থির হয়ে উঠছে ক্ষণেক্ষণে।

“আমারে সারাজীবনের ঋণের তলে ফালাইবার চাও?”

“কিসের ঋণ?কোনো ঋণ নেইতো।”

“তোমার কথাবার্তা,আচরণ আমার অসহ্য লাগতাছে”

অন্বেষা দায়সারা ভাবে কথার উল্টো প্রশ্ন করলো,

“আচ্ছা তোমাকে ঋণী করলে তুমি ঋণ শোধ করতে?”

“আমারে চিনছো এতদিনে?”

“হ্যাঁ”

“ঋণ শোধ করার মতো সৎ মানুষ আমি না।”

স্বাভাবিক সুরেই অন্বেষা জবাব দেয়,

“ঠিক আছে।তাতেও কোনো সমস্যা নেই”

কি করে এই মেয়েটা এত ধৈর্যশীল?অভিযোগহীন সময় কাটছে তার।অন্বেষার মনের গভীরে যেন লুকিয়ে আছে আশার দিশা। বর্ণের শূন্য চোখ।ভাবশূন্য;জ্ঞানশূন্য।আজকাল পূর্বের অন্বেষার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।এতো ভারী পরিবর্তন।নাকি বর্ণের রঙে মেখে নিজের রং বদলালো?

অন্বেষা খাতায় কলম চালাতে চালাতে আকস্মিক হেসে বলে,

“তুমি বোর হচ্ছো তাইনা?মারামারি করতে পারছো না? রংবাজি,মাস্তানি কোনোটাই পারছো না?খুব খারাপ লাগছে তাই না?”

বর্ণ ডান পার্শ্বের ভ্রু উঁচু করে কঠিন গলায় বলে,

“মজা লইতাছো?”

“মজা কেনো নিবো?”

অন্বেষার ভাবসাব নেওয়া যাচ্ছে না আর।বর্ণ চাইছে সে ওর উপর বিরক্ত হোক।তর্ক করুক।এতে শান্তি মিলবে তার।কেউ তার প্রতি রাগ, বিরক্তি প্রকাশ করলে শান্তি মেলে।

“তুমি জানো আমি বন্দী থাকার মানুষ না।ইচ্ছা কইরা ঘায়ে মরিচ ঢলা দিবার আইছো পিশাচিনী?”

অন্বেষা পুনর্বার হাসে। বই খাতা বন্ধ করে পাশে রাখলো।সব গুছিয়েছে সুন্দর করে।আজকেই শেষ দিন।আগামীকাল সকালে ছুটি পেয়ে যাবে বর্ণ।একটু স্বস্তি মিললেও বর্ণের উপর কোনো ধরনের ভরসা নেই।বাড়ি ফেরার পর পাশাপাশি থাকা সম্ভব নয়।সে যাবে তার আস্তানায় আর অন্বেষা নিজের।

“তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?”

বর্ণ সাথে সাথে জবাব দেয়,

“কেউরে না।কেউরে ভালোবাসার মত বদনসিব আমার হয়নাই।”

অন্বেষা একবার চাইলো বর্ণের দিকে।পরপর পলক ঝাপটায় নিচে চেয়ে।মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে বললো,

“আমি তোমাকে গল্প বলি শুনো।”

“আমি হুনতে চাই না।”

“আচ্ছা বলি তারপরও”

বলে অন্বেষা হেসে উঠে ঠোঁট কামড়ে।বর্ণের মাথাটা নষ্ট হয়ে যাবে কিছুদিন পর।সে উপলব্ধি করতে পারছে।একা ছিলো বেশ ছিলো।

“তুমি আমার জিন্দেগীর অভিশপ্ত আত্মা।আমি বুঝতাছি আমার হাতে বেশিদিন নাকি নাই।”

“চুপ!মুখ বন্ধ আর কান খোলা রাখো।শুনতে না চাইলেও আমি জোর করে শুনাবো।আমার বলতে ভালো লাগে।এতদিন পাগলের মতো একা একা গল্প করেছি।এখন বর্ণ নামের একটা মক্কেল পেয়েছি।”

বর্ণের মস্তিষ্কের চেতনারা দলভুক্ত হয়ে আশ্চর্যের চরম উচ্চ সীমানায় গিয়েছে।অন্বেষা এমন আচরণ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে তারা লাফিয়ে মরবে।তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

অন্বেষা বলতে শুরু করে। বর্ণ খেয়াল করলো তাকে।গল্প বলতে নিলেই সে চায় শূন্যে,

“তোমার চেয়ে ভালো বিজনেস মাইন্ডতো আমার। জানো এই হাইফাই শহরে কিভাবে বেঁচে আছি?জানবে কি করে? আমিই বলি।আমার সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস থাকে।সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত। দেড়টা থেকে আমার অফিস।বেতন আট হাজার। রিসিপশনিস্ট এর কাজ কোচিং সেন্টারে।মাঝেমধ্যে পরীক্ষায় গার্ড দেই, খাতা সাজাই,প্রশ্ন বানাই। সব মিলিয়ে ভালোই।তারপর কি করি জানো? সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অফিস শেষ।সেখান থেকে যাই বাজারে।বাজারে আমার পরিচিত সবজি ওয়ালা আছে।”

অন্বেষার কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিলো।হুট করে পোকা নড়ে উঠে মগজের।ছটফট শুরু করে। অন্বেষাকে থামিয়ে বলতে লাগলো,

“বিয়া বইয়া যাও সবজি ওয়ালার লগে।তোমার লগে মানাইবো। সারাজীবন ফ্রি শাক সবজিও পাইবা।”

“চুপচাপ কথা শুনো! বাগড়া দিবে না।”

বিষম খেয়ে বসে রইলো এই আদেশে বর্ণ।নির্ঘাত ছেলে মানুষ হলে একটা চড় পড়তো গালে। অন্বেষা আপন মনে বলতে লাগলো আবার,

“সেখান থেকে সবজি কিনি। কিনে নিয়ে সাতজন হাঁদারামের জন্য রান্না করি।তারপর জব্বার চাচা আসে নিয়ে যায়।ওরা আবার মাসে দশ হাজার টাকার মতো দেয়।কত হলো? আঠারো হাজার।সেখান থেকে বাড়ি ভাড়া,যাতায়াত খরচ,আমার খাওয়া দাওয়া,বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ।”

তারপর অকস্মাৎ ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে খুব উৎসাহ নিয়ে বললো,

“জানো আমার দাদীর দেওয়া পুরোনো একটা সিন্দুক আছে।আমি সেখানে আমার বাড়তি টাকাগুলো রেখে দেই।যদিও খরচ হয়ে যায় মাস শেষ না হতেও।কিন্তু আমি দিব্যি আছি।”

ছোটখাটো বিষয়ে খুশি হতে পারে কয়জন?একজন নারী এই ঢাকা শহরে টিকে আছে।এটাই অনেক মনে হলো বর্ণের কাছে।তবে মুখে প্রকাশ করলো না।তার মনে যে প্রশ্নটি ছিলো সেটি করলো,

“হাঁদারাম কারা?”

অন্বেষা দুষ্টু হেসে জবাব দেয়,

“আছে একদল ব্যাচেলর।”

বর্ণের কেমন যেনো লাগলো।ভালো ঠেকেনি ব্যাপারটা।নিম্ন সুরে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

“ব্যাচেলরগো লেইগা রান্দো?’

অন্বেষার হাসির রেখা সেখানেই অটল।মিটমিট হেসে বলে,

“ওরা জানে ওদের জন্য জব্বার চাচার বউ রান্না করে পাঠায়।”

“তাইলে তুমিই জব্বার চাচার বউ!” বলে স্মিত হাসে বর্ণ।

“আরেহ ধুর!জব্বার চাচার বউ সেলাই এর কাজ করে।উনি চুলোর সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনা।চামড়া জ্বলে।তাই আমি ওনাদের জন্যও খাবার পাঠাই।”

“দিল দরিয়া!” তুচ্ছ কণ্ঠে বলে উঠে বর্ণ মাথা দুলিয়ে।

“তুমি কি করলে জীবনে? চিটারি বাটপারি ছাড়া?”

বর্ণ বলে, “ছিঁড়ছি!”

অন্বেষার মুখ ফুটে আপনাআপনি প্রশ্ন আসে, “কি?”

“বয়ে আকার বা ল বাল”

হতাশ অন্বেষা!বর্ণের প্রতি হতাশ।নাম বর্ণ অথচ জীবনে কোনো বর্ণের রং নেই।তাকে দেখলে মনে হয় ধূসর এক সত্তা।যার কিছুই নেই।আবার অনেককিছু আছে। অন্বেষা অবলীলায় বলে উঠে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে,

“আমি ভীষণ খুশি আমার এই জীবন নিয়ে। কারো সাথে কোনো লেনাদেনা নেই।তবে আছে কিছু অপূর্ণতা।তুমি বলো?”

“বর্ণ নিজের কাছে সমৃদ্ধ,বর্ণ নিজের কাছেই পূর্ণ”

________

বর্ণের অপারেশন করিয়ে হৃদয় থেকে ভারী একটা বোঝা নেমেছে। সবে মাত্র বাড়িতে গেছে সে। অন্বেষা দেই অব্দি যেতে পারেনি।তার দায়িত্ব দিয়েছে বড় কাঁধে।সাব্বির এবং তার বাবা মিলে বর্ণকে বাড়ি নিয়ে গেছে।পই পই করে সাব্বিরকে বুঝিয়ে এসেছে অন্বেষা।কোনোভাবেই যেনো ওকে একা না ছাড়ে।সারাক্ষণ আঠার মত লেগে থাকার আদেশ সাব্বির সাদরে গ্রহণ করেছে খুশি মনে।সেও তার ভাইজানের পাগল।সাথে থাকতে পারলেই শান্তি।

আজ সাব্বির ছেলেটার জন্য ভালো কাপড় আর জুতো নিয়ে যাবে।সেদিন তার পরিধেয় বস্ত্রের অবস্থা ছিল বেহাল।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার পূর্বেই সামনে সৌভিককে।আজ রাগ নয় বরং হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো,

“কি খবর সৌভিক ভাই?আজ এই রাস্তায়?”

সৌভিক সময় নিয়ে জবাব দিলো, “আসছিলাম কাজে।”

“কাজটা কি আমাকে দেখা?”

থতমত খায় সৌভিক খানিকটা। হতবুদ্ধির মত চেয়ে।মায়ের কথামত কাজ করলেও মুখে তেমন জো পায় না। অন্বেষা বলে,

“কি হলো সৌভিক ভাই?আপনার চাপা দেখছি সমান হয়ে গেছে।”

সৌভিকের সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল। আপনাআপনি হাত যায় গালে।প্রচণ্ড রকমের আঘাত পেয়েছিলো সেদিন। অন্বেষা সৌভিকের ভয়ার্ত মুখ দেখে আরো বেগ পেলো।বলে উঠে,

“জানেন সৌভিক ভাই?যে ছেলেটা আমাকে বাঁচালো আপনার হাত থেকে?সে আমার প্রেমিক। গুণ্ডা মাস্তান টাইপের একটু। একটা ছেলেকে অলমোস্ট মার্ডার করে ফেলেছিলো।আর হাত পা ভেঙে পঙ্গু করে দেয়া ওর প্রতিদিনের কাজ।”

সৌভিক উল্টো পথে হাঁটা ধরলো ধীরে সুস্থে। অন্বেষা চেনে তাকে। সে তার মায়ের হাতের মোহরা।ছোটবেলা থেকেই ভীতু রকমের ছেলে নাকি তার সাথে এসে জোরাজুরি করবে। অন্বেষা দুয়েক কদম এগিয়ে সৌভিককে বলে,

“কোথায় যাচ্ছেন সৌভিক ভাই? শুনুন আরেকটা জরুরি কথা।আপনার আর আপনার পরিবারের নামে জিডি করেছি।আপনাদের মতলব কখন বদলায় বলা মুশকিল বাপু।আপনার আম্মাজান এর কানে দিয়েন কথাটা।”

সৌভিককে ভয় দেখাতে পারে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে।কিসের জিডি?কিসের কি?যাচাই বাছাই না করেই মেনে নিলো।মনে মনে বেকুব বলে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে।সেখানে আরো দুটো আকর্ষণীয় মুখ।ঝুমা এবং রুম্পা।মৃদু হাসির চেয়ে ধারালো তলোয়ার হয়না শত্রুর জন্য। শত্রুরা অন্যের সুখেই পুড়ে বেশি।অন্বেষা স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি হাসি ফুটিয়ে হেঁটে চলে যায়।যাওয়ার পূর্বে তাদের অবাক মুখশ্রী দেখতে ভুল করেনি।

______

নিজের এলাকা,নিজের গোড়াপত্তন।গলির মুখে দোকানে চায়ের ধোঁয়া। আহা! একঝাঁক শান্তি এনে ঢেলে দিলো।অনেকদিন পর বাহিরের বাতাবরণের সাথে সাক্ষাত বর্ণের।এই শান্তি আর কোথায় মেলে না।এই ওলি গলির আনাচে কানাচেতে তার জীবনের গল্পের অনির্বচনীয় সুর বাজে। পুরান ঢাকার এই সন্ধ্যা, এই কোলাহলের,এখানে ফেলা প্রতিটি নিঃশ্বাস কাব্যের মত মধুর।

প্রিয় নাস্তা করতে বেরিয়েছে বর্ণ। তবে ব্যথাযুক্ত পা নিয়ে বেরোতেই মনে হলো নাহ!আজ বাকরখানি নয় বরং মোগলাই পরোটা বেশি টানছে। ঘ্রানে ঘ্রানে হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ায়।তবে হাত একদম খালি।না কাজে যেতে পেরেছে এতদিন না টিউশনে।

গলা উঁচু করে ডাকলো বর্ণ।বললো, “এই রাব্বী!”

হোটেল থেকে রাব্বী বেরিয়ে আসে।বর্ণকে চেনে সে। এসেই বলল,

“ক”

“হাতে মাল পাত্তি নাই বুঝছোস।কিন্তু পেট চু চু করতাছে।মোগলাই খাওয়াবি?”

রাব্বী জবাব দিলো, “টাকা ছাড়া কেমনে কি?”

“আরেহ দেস না শালার পুত।দিয়া দিমু টাকা”

ঠিক তখনই মেয়েলী কণ্ঠে দুজনের কথা বার্তায় ব্যাঘাত ঘটে।ফিরে তাকালো ডান দিকে।এতদিন দেখা সাক্ষাত ছিলো না। ফোনে আলাপ হয়েছে।জ্বালিয়ে মেরেছে বর্ণকে। অন্বেষাকে দেখে কপালে হাত রাখলো বর্ণ।বিড়বিড় করে বললো,

“আবার টপকাইছে বালডা!”

অন্বেষা রাব্বীর উদ্দেশ্যে বলে,

“ভাই দুটো মোগলাই দিন।আলাদা দিবেন।”

রাব্বী ভেতরে চলে গেলো। অন্বেষা বর্ণের দিকে চেয়ে বললো,

“কি খবর?পায়ের অবস্থা কেমন?”

“খবর আমার ভালোই আছিলো। তোমারে দেখলাম একশো নাম্বার বিপদ সংকেতে আছি।’

অন্বেষা তার কথাকে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীনভাবে শুনলো।এর প্রেক্ষিতে কোনো জবাব দেয়নি।বলে উঠে,

“ওষুধ নিয়েছো?”

বর্ণ বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,

“এক কথা কতবার জিগাও ছেমড়ি?এতদিন ফোনে জ্বালায়া শান্তি পাও নাই?”

“না পাইনি”

তাদের তর্কের মাঝে খাবার হাজির। অন্বেষা একটি প্যাকেট নিজে নিয়ে আরেকটি বর্ণের দিকে এগিয়ে দিলো।বর্ণ ক্ষেপে উঠে।বলে,

“কি চাও তুমি?আমি তোমারে কইছি আমারে খাওয়াও?কেন করতাছো এসব?আমারে নিচা দেহাইবার চাও?”

“ভুল বুঝা তোমার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্ণ।”

বর্ণ রূঢ় গলায় বলে,

“আমি ঠিকই বুঝতাছি।আমার কত অস্থির লাগতাছে নিজের কাছে জানো?আমি কোনোভাবে তোমার যত্ন মাইনা নিতে পারতাছি না।নিজের কাছে নিজেরে ছোট লাগতাছে। আমি বর্ণ দুইদিন না না খাইয়া বাঁচতে পারি। জিবলা সামলানোর মুরোদ আমার আছে।আর তুমি?আমারে জোর কইরা ঋণের তলে ফালাইতাছো?তুমি আমার অপারেশন করাইছো।আমার পিছনে খাটছো। এসব চিন্তা আমারে ঘুমাইবার দিতাছে না।যে মানুষ খালি পেটে আয়েশের ঘুম দিবার পারে ওই মানুষ আজকা তোমার কারণে ভরা পেটে নির্ঘুম।”

এতগুলো কথা বলে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো বর্ণ।অজান্তেই নিজেকে প্রকাশ করে ফেললো না?তার মাঝে এক বিচলন দেখা যাচ্ছে।প্রবল আত্মসম্মানবোধের।বর্ণ আবার বলে,

“বিটলামি ফাইজলামি করি তাই বইলা আমারে হালকাভাবে নিবা না কইলাম।আমার জেদ তোমারে নিয়া ধ্বংস হইবো।সময় আছে পিছে হইটা যাও”

বর্ণের এই নতুন রূপে ভিতরে ভিতরে অন্তর পুলকিত।যেদিন বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় মন সিন্দুকের দুয়ার খুলেছিলো কিছু সময়ের জন্য। আজ তার কথাগুলো অজান্তেই ভালো লাগছে অন্বেষার।ভালো লাগার কাছে বর্ণের রাগ তুচ্ছ মনে হলো বটে।

“চায়া আছো কেন!”

“আমি তোমার পর বলে মনে হচ্ছে যে আমি তোমার উপর দয়া দেখাচ্ছি?”

বর্ণ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে দুদিকে মাথা দুলিয়ে অস্থির স্বরে জবাব দেয়,

“আমি জানি না এতকিছু।আমার থিকা নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখো।আমি মানুষ ভালো না। সবাই জানে এলাকার বর্ণ খারাপ,বর্ণ মাস্তান।”

চোখ বুঁজে বিশেষ এক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে অন্বেষা। মন এবং মস্তিষ্কে ইতিমধ্যে তুমুল মতবিরোধ চলছে।এই বিবাদে কে জয়ী হবে সেটা আর দেখার প্রয়োজনবোধ করলো না অন্বেষা। শেষমেশ আকস্মিক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বললো,

“আমি ভালো খারাপের ভয় কম করি।করলে হয়তো একই ঘরে শত্রু নিয়ে বসবাস করতে পারতাম না।এই শহরে একা মেয়ে হয়ে টিকে থাকতে পারতাম না।আমাদের কোনো লেনাদেনা নেই এই সমাজের সাথে বর্ণ।আমরা আলাদা দেখো?আর পাঁচটা মানুষের মত আমাদের জীবন নয়।তবে এতদিনে তোমার সাথে সব কাকতালীয় সাক্ষাত ইঙ্গিত করে আমাদের দুজনের একে অপরের সঙ্গ দরকার।আমাদের দুজনকে আমরা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না।……আমার বলতে একদমই লজ্জা হচ্ছে না এই ছন্নছাড়া, ভবঘুরে,আধ পাগল বর্ণের চির সঙ্গ আমি চাই।তোমার জন্য না হোক আমার নিজের আত্মিক প্রশান্তির জন্য।একাকীত্ব ভীষণ ভয়ঙ্কর।আমি এই নিস্তব্ধতায় ভুগছি দীর্ঘকাল।এবার নাহয় আমার উপর দয়া দেখাও। হাত বাড়িয়ে এই ভয়াবহতা থেকে বের করে আনো।।”

চলবে……