উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩৫
লেখাঃ মিশু মনি
নাদিরের পার্টিতে এসে বেশ জড়োসড়ো হয়েই একদিকে দাঁড়িয়ে আছে জাহ্নবী। পরিচিত কোনো মুখ দেখতে না পেয়ে তার অস্বস্তি হচ্ছে। পান্নাবাহার আদৌ আসবে কী না, সেই ভাবনাও আন্দোলিত করছে তাকে।
হঠাৎ তন্বীর গলা শুনতে পেলো জাহ্নবী ‘হ্যালো আপু!’
জাহ্নবী মিষ্টি হেসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো তন্বীকে। তন্বী বলল, ‘আমাদের পার্টি দোতলায় হচ্ছে আপু। আসুন আমার সঙ্গে।’
তন্বীর পরনে রাজকীয় একটা পোষাক। তার মাথায় মুকুট বসিয়ে দিলেই পুরোদস্তুর রাজকন্যা মনে হবে তাকে। এই জমকালো পরিবেশে জাহ্নবী’র আজ নিজেকে নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। জীবনে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই মেয়েটা নিজের নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগতো। আজ তার এই অভাববোধ নেই। এইমুহুর্তে জাহ্নবীর মনে হচ্ছে, একটা মেয়ে সুন্দর জামাকাপড় পরে সুন্দরভাবে সাজগোজ করলেও তার আত্মবিশ্বাসে দারুণ প্রভাব পড়ে।
নাদির পায়ে হেঁটে এগিয়ে এল জাহ্নবী’র কাছে। জাহ্নবী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ‘স্যার আপনাকে দেখে আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে!’
‘আনন্দ হলে বুঝতে হবে আমার জন্য আপনার মায়া আছে।’
‘তা তো আছেই স্যার।’
‘ এখানে স্যার স্যার করবেন না প্লিজ। আমার অফিসের তেমন কাউকে আসতে বলিনি। যাদের দেখতে পাচ্ছেন, সবাই আমার ফ্যামিলি মেম্বার আর ফ্রেন্ডস। অফিসের হাতেগোনা দুই একজনকে বলেছি।’
‘স্যার আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ গুলোর মাঝে আমিও আছি!’
‘হা হা হা। আপনি অবশ্যই কাছের একজন হয়ে উঠেছেন। আপনার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে গত কয়েকদিনে একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। সেটা আপনি মানুন বা না মানুন। আপনাকে ইনভাইট না করে থাকতে পারিনি।’
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হাসল জাহ্নবী। তার আনন্দ বেড়ে গুলো বহুগুণে। নাদির অন্য দিকে চলে গেলে সে ভীষণ একা হয়ে পড়ল। তন্বী আজ আনন্দে ঝলমল করছে। এখন তার মাথায় একটা হিরের মুকুট। সত্যিই তাকে রাজকন্যার মতো লাগছে এখন। এত আনন্দের ভেতর তার নিজেকে নীড়হারা পাখি বলে মনে হতে লাগল। কারণ এখানে কেউই তার পরিচিত নেই।
জাহ্নবী চোখ ঘুরিয়ে খুঁজছে পান্নাবাহারকে। এই একটা মানুষই তার সবচেয়ে চেনা। কিন্তু এখনো দেখতে পায়নি তাকে। ধীরপায়ে জাহ্নবী ওপরের তলায় উঠে এলো। খোলা আকাশের নীচে বসতে ইচ্ছে করছে তার।
বৃক্ষলতার আড়াল থেকে হাসছে কিছু হলুদ রঙের বাতি। পাশেই স্মোকিং জোন। গুটিকয়েক ছেলে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। তাদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে এখান থেকে। গন্ধে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হল সে।
হঠাৎ মনে হল স্মোকিং জোনে তার পরিচিত একজন আছে। পান্নাবাহার!
চমকে উঠে পেছন ফিরল জাহ্নবী। পান্নাবাহারের এক হাত পকেটে। অন্যহাতে সিগারেট ফুঁকছে। সিগারেটে টান দিয়ে যখন আকাশে ধোঁয়া উড়িয়ে দিচ্ছে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল জাহ্নবী’র।
জাহ্নবী ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। মুহুর্ত বয়ে যেতে লাগল। ধীরেধীরে সবার সিগারেট খাওয়া ফুরালে আড্ডা ভঙ্গ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল ছেলে গুলো।
জাহ্নবী সাহস করে ওপরের দিকে এলো। এদিকটায় টেবিলে কিছু ছেলেমেয়ে বসে গল্প করছে। পাশ দিয়ে চলে গেল পান্নাবাহার। জাহ্নবী’র বক্ষমাঝে ছলাৎ করে উঠলো। পান্নাবাহারের সুঘ্রাণ বিমুগ্ধ করে ফেলল তাকে।
জাহ্নবীও দ্রুত নেমে এলো নীচে। নিজে থেকে পান্নাবাহারকে গিয়ে বলল, ‘ভাল আছেন?’
‘হ্যাঁ। আপনি?’
‘আমিও। সেদিন আমাদেরকে বিল দিতে দিলেন না কেন?’
‘আজকে বুঝি বিল দিতে এখানে এসেছেন?’
লজ্জা পেয়ে হাসল জাহ্নবী। সে খুব বোকার মতো প্রশ্ন করে বসেছে। মাথা নিচু করে হেসে জাহ্নবী বলল, ‘হুম বিল দিতেই এসেছি। আপনাকে আজ এক কাপ কফি খাওয়াতে চাই।’ দুরুদুরু বুকে সাহস করেই কথাটা বলে ফেলল জাহ্নবী।
‘আপনার দাওয়াত কবুল করলাম। এসব হৈ হুল্লোড় আমার একদম ভালো লাগে না। তন্বী রাগ করবে তাই আসা।’
পান্নাবাহার দ্রুত চলে যেতে যেতে পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল? যাবেন না?’
চমকে উঠলো জাহ্নবী। তার মুখে ফুটন্ত পদ্মফুলের ন্যায় হাসি ফুটে উঠল। পান্নাবাহারের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো সে। আশেপাশের টেবিল গুলোতে ছেলেমেয়েরা বসে গল্প করছে। তাদেরই কোনো এক ফাঁকে একটা ছোট্ট টেবিল আর টুলে জায়গা করে নিলো পান্নাবাহার।
জাহ্নবী তার মুখোমুখি বসল। বিপরীত দিকে বসা মানুষটা জানেনা এই মুহুর্তে কী এক অদ্ভুত ভয়ংকর ঝড় বইছে এখানে। যে ঝড় দেখতে পারবে না কেউই। কেবল একজন মানুষ সেই ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে উঠছে, আবার ফিরে পাচ্ছে আপন প্রাণ।
পান্নাবাহার বলল, ‘ওইদিন আপনাদেরকে অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। এজন্য সরি।’
‘আরে কী বলছেন! আপনাদের বন্ধুদের মাঝে আমাদেরও বেশ ভালো লাগছিল। আমরা বিব্রত হইনি।’
‘যাক, শুনে ভালো লাগল। কী খাবেন বলুন?’
‘আপনি খাবেন। আপনার ইচ্ছেমতো।’
পান্নাবাহার হেসে বলল, ‘এতটা সুযোগ দেবেন না। পেটে কিন্তু অনেক ক্ষুধা।’
জাহ্নবী মিষ্টি করে হাসল। কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। তার পেটে ক্ষুধা নেই, ক্ষুধা তার দু চোখে। পান্নাবাহারকে দুচোখ ভরে দেখতে না পারার তৃষ্ণা। কী ভয়ংকর এক দোটানার মধ্যে বাস করছে সে! কখনো ইচ্ছে করে পান্নাবাহারকে ভালবাসতে, আবার কখনো নিজের মনেই সে বলে বসে, ‘আমি আর কক্ষনো এই লোকটার কথা ভাব্বো না।’
পান্নাবাহার বলল, ‘ভয় পেয়ে গেলেন?’
‘না।’
‘ওকে বাবা আমি শুধু কফি দিতে বলি।’
‘এত দুঃখ দেবেন আমায়?’
পান্নাবাহারের চোখে চোখ রেখে কথাটা বলে ফেলল জাহ্নবী। চোখাচোখি হল দুজনার। পান্নাবাহারের চোখে জমে থাকা শক্তিশালী এক আকর্ষণ জাহ্নবীকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যেতে লাগল। মনে হচ্ছে এই বুঝি পৃথিবীটা দুলে উঠবে, সবকিছু হয়ে যাবে এলোমেলো।
নিজেকে সামলে নিল জাহ্নবী। তার দ্রুত হৃদস্পন্দিত হচ্ছে। পান্নাবাহার বলল, ‘আমি একটা ছোট সাইজের পিজ্জা দিতে বলি কী বলেন?’
‘ ছোট কেন, বড়টাই দিন না।’
‘ম্যাডাম, ছোট টাই খেয়ে শেষ করতে পারবেন না।’
জাহ্নবী ম্লান হাসল। চোখ নামিয়ে নিয়ে আপনমনে ভাবছে জাহ্নবী, ‘এ আমার কী হল আজ! কেন এমন করে একটা মানুষ আমার জীবনে এসে গেল, কেন এভাবে আমি মানুষটার প্রতি একটু একটু করে দূর্বল হয়ে পড়ছি? জানিনা। এত কেন’র উত্তর নেই পৃথিবীতে। এভাবে বারবার আমাদের দেখা হওয়ার মানে কী এই, প্রকৃতি আমাদের এক করে দিতে চায়? এত দীর্ঘকাল পেরিয়ে আমার জীবনেও এলো বসন্ত!’
ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছে জাহ্নবী। পান্নাবাহার ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখল। বেশ কিছুক্ষণ স্ক্রল করল সে। জাহ্নবী ফোনের মৃদু আলোয় আলোকিত তার মুখটা পরখ করছিল।
মুহুর্ত থমকে আছে আজ। জাহ্নবী এমনটাই চেয়েছিল। দুজনে মুখোমুখি বসে থাকবে, হয়তো থাকবে দুজনেই চুপচাপ। তবুও সেই মুহুর্তকে তার মনে হবে, জগতের সবচেয়ে সেরা সময়। এখন সেই সময়ের ভেতর বাস করছে জাহ্নবী।
কিন্তু মুহুর্ত ফুরিয়ে এলো একসময়। হঠাৎ একটা ছয় বছর বয়সী মেয়ে এসে পান্নাবাহারের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, ‘বাবা তুমি এখানে, আমি কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে।’
‘ওরে আমার মা রে, তুমি একা একা ওপরে এসেছো কেন?’
‘তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছি।’
‘যদি হারিয়ে যাও?’
মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরল পান্নাবাহার। জাহ্নবী মুহুর্তের জন্য নিশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। বাচ্চাটা ওকে ‘বাবা’ ডাকছে কেন!
তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল মুহুর্তেই। পান্নাবাহার বলল, ‘এটা আমার মেয়ে, ক্লারা। আমার কলিজার টুকরা।’
‘আপনার মেয়ে!’ অস্ফুটে কথাটা বলে জাহ্নবী চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মনে হচ্ছে এখন সত্যি সত্যিই দুলছে পুরো পৃথিবী। তাকে বিধ্বস্ত হওয়া থেকে এবার আর জেগে ওঠাবে না প্রকৃতি।
পান্নাবাহার বলল, ‘তোমার আম্মু খুঁজবে তো সোনা।’
‘আম্মুও খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পড়বে।’
‘আমার কলিজাটা। তোমার আম্মু আজ তোমাকে পরীর মতো করে সাজিয়ে দিয়েছে।’
পান্নাবাহার ক্লারার মাথায় চুমু খেয়ে আদর করল ওকে। জাহ্নবী কিছু শুনতে পাচ্ছে না আর। তার কাছে মিথ্যে মনে হচ্ছে সবকিছু।
ক্লারা বলল, ‘এই আন্টিটা কে বাবা?’
‘তুমিই তো বললে আন্টি।’
ক্লারা হাসতে হাসতে ওর বাবার গাল ধরে আদর করে দিতে লাগল। পিজ্জা ও কফি চলে এলো খানিকক্ষণ পরেই। ক্লারা বলল, ‘বাবা তুমি আমাকে আর মাকে রেখেই পিজ্জা খাচ্ছো এখানে? আম্মুকেও ডাকো আমরা একসঙ্গে খাই।’
‘না মামণি। এই আন্টি পিজ্জা খাওয়ার জন্য অর্ডার দিয়েছে। আম্মু আসলে তো পুরোটাই খেয়ে ফেলবে।’
‘আমার আম্মু কি রাক্ষস?’
পান্নাবাহার উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে ক্লারাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। জাহ্নবী আর বসে থাকতে পারছে না। পান্নাবাহার যখন তাকে পিজ্জার স্লাইস তুলে নিতে অনুরোধ করল, জাহ্নবী বিব্রত হয়ে মোবাইল বের করে ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল, ‘সরি, আমার একটা খারাপ খবর এসেছে। আমাকে এক্ষুনি উঠতে হবে।’
‘সে কী! কী হয়েছে?’
‘ব্যক্তিগত কিছু। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’
দ্রুতবেগে সেখান থেকে নিচে নেমে এল জাহ্নবী। রিসিপশনে এসে বিল পরিশোধ করে দিয়ে নাদিরের কাছে গেল।
নাদির জাহ্নবী’র বিধ্বস্ত মুখ দেখেই আন্দাজ করেছে কিছু একটা হয়েছে। সে বারবার জানতে চাইলো, ‘কোনো সমস্যা আমাকে বলুন?’
‘আপনাকে বলতে পারবো না স্যার। কিন্তু আমাকে এখনই যেতে হবে।’
‘এক মিনিট দাঁড়ান।’
জাহ্নবী দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এই শহরের দালান কোঠা, মানুষ জন সবকিছুই ভয়ংকর লাগছে তার। হঠাৎ পাশ থেকে ক্লারার কণ্ঠ শুনতে পেলো, ‘আম্মু, ওপরে চলো। পিজ্জা খাবো।’
‘এখন না মামণি।’
‘আব্বু একাই একটা পিজ্জা নিয়ে বসে আছে। অনেক বড় পিজ্জা। আব্বু একা শেষ করতে পারবে না। আমাদেরকে গিয়ে শেষ করে ফেলতে হবে। চলো।’
জাহ্নবী পাশ ফিরে তাকাল। পান্নাবাহারের স্ত্রীকে দেখে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। অপূর্ব দেখতে একটা মেয়ে। পরনে স্লিভলেজ গাউন, গলায় একটা হিরার নেকলেস জ্বলজ্বল করছে। তার মাধুর্যতাপূর্ণ হাসিই এখানে তাকে সবার চাইতে আলাদা করে তুলেছে। তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হল জাহ্নবী’র। পান্নাবাহারকে নিয়ে স্বপ্ন সাজানোর দুঃসাহস সত্যিই তাকে মানায় না। যার স্ত্রীকে ঘরভর্তি লোকজনের মধ্যে সহজেই আলাদা যায় কেবল তার রূপ ও মাধুর্যতার কারণে।
জাহ্নবী আর এক মুহুর্তও দাঁড়াল না। নাদিরকে বলল ‘স্যার আমি আসি?’
নাদির বলল, ‘পার্সেলটা দিতে বলেছি। এক মিনিট দাঁড়ান প্লিজ।’
বেয়ারা একটা পার্সেল এনে জাহ্নবী’র দিকে এগিয়ে দিলো। নাদিরকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুতপদে বেরিয়ে এলো জাহ্নবী। দরজার দিকে আসতে আসতে এক পলক তাকাল ক্লারা ও তার মায়ের দিকে। মা ও মেয়ে হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে যাচ্ছে। তারপর! তিনজন বসে হাসাহাসি করতে করতে পিজ্জা খাবে, নিশ্চয়ই মেয়েটা অভিমানী গলায় বলবে, ‘তুমি একা একা পিজ্জা খাচ্ছো কেন?’
পান্নাবাহার উত্তর দেবে, ‘তোমাদের নিয়ে খাবো বলেই অর্ডার দিলাম।’
আর তখন ক্লারা বলে উঠবে, ‘না আম্মু, একটা আন্টি এই পিজ্জা অর্ডার দিয়েছিল।’
ক্লারার মা খুব রাগ করে জানতে চাইবে, ‘কোন মেয়ের সঙ্গে বসে ছিলে?’
পান্নাবাহার অভিমান ভাঙাতে আমতা আমতা করে কান ধরে সরি বলবে। জড়িয়ে ধরবে তাকে। তাদের এইসব দৃশুগুলোকে কল্পনা করেই জাহ্নবী ক্রমশ যেন মাটির নিচে চলে যেতে লাগল, এমন বোধ হচ্ছিল তার।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা গাড়ি ডেকে তাতে উঠে পড়ল জাহ্নবী। বাকি পথটা কীভাবে সে বাসায় ফিরেছে নিজেও জানেনা।
বাসায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গা থেকে খুলে ফেলল শাড়ি ও ব্লাউজ। বাথরুমে ঢুকে জাল দিয়ে প্রচণ্ড রাগের বেগে ঘষে ঘষে গাল থেকে মেক আপ তোলার চেষ্টা করল। মুহুর্তেই লালচে হয়ে জ্বালা করতে লাগল মুখ। জাহ্নবী স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ল মেঝেতে। বুকের জ্বালার চাইতে কোনোকিছু তো তীব্র হতে পারে না।
কতক্ষণ কেঁদেছে তা নিজেও জানেনা জাহ্নবী। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো একজন স্তব্ধ, চোয়াল শক্ত করে রাখা মেয়ে। ঝড়ের পর সবকিছু শান্ত হয়ে গেছে হঠাৎ ই।
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩৬
লেখাঃ মিশু মনি
গত এক সপ্তাহ বড় বোনের কোনো খোঁজ না পেয়ে জাহ্নবী’র বাসায় চলে এসেছে ভায়োলেট। এসে বেশ অবাক হতে হল। জাহ্নবী’র জানালার পর্দার সঙ্গে ঝলমল করছে অসংখ্য তারার মতো বাতি। পুরো ঘরে হালকা নীল আভা। সাদা চাদরের ওপর জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে জাহ্নবী।
ভায়োলেটকে পেয়ে জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘তোর ফোন ধরিনি বলে কষ্ট পেয়েছিস?’
‘না তো। এত সামান্য কারণে আমি কষ্ট পাই না আপু। হয়তো ব্যস্ত ছিলে।’
‘না। ফ্রি ছিলাম। ইচ্ছে করেই ধরিনি।’
‘সে কী! কেন?’
বেশ অবাক শোনালো ভায়োলেটের গলা। জাহ্নবী বলল, ‘কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।’
‘আচ্ছা। এখন কী কথা বলতে ইচ্ছে করছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভেবে বলো। ইচ্ছে না করলে চলে যাবো।’
হাসলো জাহ্নবী। বিছানা থেকে উঠে এসে ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ভাল আছিস? আজকে গায়ে পারফিউম মেখেছিস যে?’
‘মনটা ফুরফুরে ছিল সেজন্য। রান্না করা আছে?’
‘না, করতে হবে।’
‘আজকে আর রান্না করো না। বাইরে খাবো।’
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে। আমার কাছে কিন্তু তেমন টাকা নেই। মাস শেষ কিন্তু বেতন পাইনি এখনও।’
ভায়োলেট বলল, ‘আমি খাওয়াবো।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে জাহ্নবী জিজ্ঞেস করল, ‘সামার কেমন আছে রে?’
‘যন্ত্রণার মধ্যে আছে। সেদিন মায়ের সঙ্গে ওর কথা কাটাকাটি হয়েছে। মা প্রতিদিন অর্ণবের পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। মুখ ফুটে বিয়ের কথা না বললেও মায়ের কথার ধরন শুনে আমরা বুঝি, মা দ্রুত বিয়ের দায়িত্ব সেরে ফেলতে চান। মেজোপু খুব রেগে আছে মা’র ওপর। অর্ণবের সঙ্গেও রেগে আছে। মা এর মধ্যে দুইবার অর্ণবকে বাসায় দাওয়াত করেছে। মেজোপু কথা বলেনি তেমন একটা। কিন্তু সেদিন মা যখন বললেন অর্ণবের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যেতে, আপু আর রাগ সামলাতে পারেনি।’
জাহ্নবী উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো, ‘সব বলে দিয়েছে?’
‘না। তবে রাগারাগি করেছে। সে তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, মা যেন এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে এইসব।’
জাহ্নবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সামারের মাথাটা একটু গরম। আমি কখনো ওর মতো কথা বলতে পারতাম না।’
‘আমিও পারবো না।’
‘আচ্ছা ভায়োলেট, তোকে যদি বাড়ি থেকে হঠাৎ বিয়ে দিয়ে দেয়, তুই বিয়ে করবি?’
ভায়োলেট কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, ‘এরকম প্রশ্ন নিয়ে কখনো ভাবিনি। যেহেতু দুজন বড় বোন আছে। তবে যতদূর মনে হচ্ছে, আমি বিয়ে করতাম না।’
ম্লান হাসল জাহ্নবী। ভায়োলেটের জোরাজোরিতে জামা বদলে তৈরি হল সে। বাসার কাছেই একটা সুসজ্জিত রেস্তোরাঁয় খেতে এসে জাহ্নবী’র বিষণ্ণতা কাটতে শুরু করেছে। ভায়োলেটের মেজাজটা আজ রৌদ্রজ্জ্বল দিনের আলোর মতোই ফুরফুরে৷ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্পগুজব করল তারা।
জাভেদ আলী সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ জমিয়ে রেখেছেন একটা নিজের বাড়ি করবেন বলে। ঢাকা শহরের মতো উচ্চাভিলাষী শহরে নিজের বাড়ি করার মত সামর্থ্য তার নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিন কক্ষের একটা ফ্ল্যাট বানাবেন। সহকর্মীরা মিলে জমি কিনে রেখেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। প্রত্যেক তলায় দুইটা করে ফ্ল্যাট হবে৷ তিন তলার ফ্ল্যাট টা নেবেন জাভেদ আলী। আজকাল বাড়ি তৈরির কাজ নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। জাভেদ আলী অনেক উত্তেজিত, তার বহু বছরের স্বপ্ন পূর্ণ হতে চলেছে। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে নিজের বাসায় থাকবেন তিনি। ফ্ল্যাটের ডিজাইন করবেন মনের মতো। ড্রয়িংরুমের সঙ্গে থাকবে ওপেন কিচেন। পারভীন খুশিমনে রান্না করবেন, সোফায় বসে ঘ্রাণে বিমোহিত হয়ে বাঁকা চোখে তাকাবেন তিনি। দেখবেন ঘামে ভিজে উঠেছে পারভীন। শেষ বয়সে এইটুকুই তো তার সাধ।
সেসব নিয়েই কথা হচ্ছিল দুই বোনের মাঝে। জাহ্নবী আনন্দিত গলায় বলল, ‘আব্বু অনেক খুশি হবে যেদিন আমরা ফ্ল্যাটে উঠবো তাই না?’
‘হুম। কিন্তু কতটা খুশি আসলেই হবে বুঝতে পারছি না।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলো ভায়োলেট। জাহ্নবী বলল, ‘এরকম ভাবছিস কেন?’
‘কেন যেন মনে হচ্ছে বাবা আর মা একাই সেই বাড়িতে উঠবেন। আমরা তিনবোন থাকবো তিন জায়গায়। মায়ের খুশি হওয়ার কথা থাকলেও তিনি তখন খুশি হতে পারবেন না। আর বাবা? বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে। এত সাধের ফ্ল্যাটে তিনি মেয়েদেরকে ছাড়া একা থাকবেন কী করে!’
জাহ্নবী বেশ অবাক হল ছোটবোনের কথা শুনে। ভায়োলেটের হাতের ওপর হাত রেখে জাহ্নবী বলল, ‘তোর কেন এরকম আশংকা হচ্ছে রে?’
‘সময় হলে দেখতে পারবে আপু। আমার যা মনে হচ্ছে তাই বললাম।’
‘এর আগেই কী তোদেরও বিয়ে হয়ে যাবে?’
ভায়োলেট গম্ভীর মুখে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উত্তর দিলো, ‘আমি তো কখনো বিয়েই করবো না।’
সময় বয়ে যেতে লাগল তার আপন গতিতে। হেমন্ত পেরিয়ে চলে এলো শীতের আমেজ। ভোরবেলা মৃদু কুয়াশা পড়ে। ফজরের নামাজ শেষে জাহ্নবী ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে৷ আজকাল অফিসের কাজে বড্ড ব্যস্ত সময় কাটে জাহ্নবী’র।
অফিস থেকে বের হওয়ার সময় নাদির সাহেব জাহ্নবীকে ডেকে তার একটা ভালো খবর জানালেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা নতুন স্টার্টআপ শুরু করতে যাচ্ছেন। প্রয়োজন হলে জাহ্নবী’র সহায়তা আশা করেন তিনি। জাহ্নবী কথাটা শুনে বেশ অবাক হল। নাদির তার মেধাকে ভীষণ গুরুত্ব দেয় যেটা দেখে অবাক হতেও ওর ভালো লাগে। সম্মানিত হতে কে না ভালবাসে?
জাহ্নবী স্যারকে আশ্বস্ত করেছিল, স্যারের জন্য যেকোনো কঠিন কাজ করে দিতে দ্বিধা করবে না সে।
কয়েকদিন পরই নাদির জাহ্নবীকে একটা মিটিংয়ের আমন্ত্রণ জানাল। অফিস শেষে একটা রেস্তোরাঁয় বসবে তাদের মিটিং।
জাহ্নবী বিস্মিত গলায় বলল, ‘স্যার আপনি আমাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন, আমার অবিশ্বাস্য লাগছে।’
‘You are a talented, responsible, hard working girl. That’s why I prefer You. সবচেয়ে বড় কথা, আপনি কাজের প্রতি সবসময়ই অনেস্ট।’
জাহ্নবী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হাসল। সন্ধ্যার পরই মিটিংয়ে যেতে হবে তার। তাই অফিসের পর বাসায় এসে জামাকাপড় বদলে হালকা নাস্তা খেয়েই বেরিয়ে পড়ল সে।
জ্যামের কারণে দেরি হল পৌঁছাতে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখল ছোট্ট একটা কেবিনে ম্লান আলোয় গোল টেবিলে বসেছে তাদের মিটিং৷ নাদিরের সামনে খোলা ল্যাপটপ। আশেপাশে জন চারেক মানুষ।
জাহ্নবী চেয়ার টেনে বসার সঙ্গে সঙ্গেই পান্নাবাহারের সঙ্গে মুখোমুখি দৃষ্টি বিনিময় হল। অপ্রস্তুত বোধ করল সে। এই মিটিংয়ে পান্নাবাহার থাকবে সেটা তার কল্পনাতেও আসেনি। সেই পার্টির রাতের পর সে এক ঝাপটায় পান্নাবাহারকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল। দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে জাহ্নবী নাদিরকে বলল, ‘গুড ইভনিং স্যার।’
নাদির হাত তুলে বলল, ‘এখানে আমি আপনার স্যার নই। উই আর ফ্রেন্ডস, ওকে?’
হতবাক চাহনি নিয়ে কয়েক পলক চেয়ে রইল সে। নাদির বলল, ‘এখানে যারা আছেন সবাই অনেক ব্রিলিয়ান্ট আর ক্রিয়েটিভ। আমি বেশ কিছু প্রশ্ন করব, আপনারা সেগুলোর উত্তর নিয়ে ভাব্বেন। এভাবে নতুন কিছু আইডিয়া বেরিয়ে আসবে। সেটা হবে অনেক ইনোভেটিভ।’
জাহ্নবী জানতে চাইল, ‘স্যার আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
মুচকি হেসে নাদির বলল, ‘আমরা আলোচনা শুরু করলেই বুঝতে পারবেন। আপনার চা পছন্দ নাকি কফি?’
পান্নাবাহার তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো, ‘ওনার জন্য এখনই খাবারের অর্ডার দেয়ার দরকার নেই। আগে মিটিংটা শেষ হোক তারপর অর্ডার দেয়া ভালো। না মানে খাবার এসে গেলে যদি ওনার জরুরি কল আসে তাহলে তো মিটিংটায় আমরা একজন ইম্পরট্যান্ট ব্যক্তিকে হারাবো।’
জাহ্নবী হতবাক না হয়ে পারল না। শব্দ করে হাসল নাদির। হাসি ফুরাতেই বলে ফেলল, ‘তুই কি সেদিন খাবার অর্ডার দিয়ে আর খেতে পারিস নি নাকি?’
‘উনি আমাকে কফি খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল। কফি আর পিজ্জা দিতে বললাম। ওনার জরুরি কল এলো তখনই। পরে সেই পিজ্জা আমি, ক্লারা আর কায়ানাথ মিলে খেয়েছি।’
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলল। পান্নাবাহারের স্ত্রী’র নাম তাহলে কায়ানাথ! নামটা শুনে ভেতরে এক ধরনের জ্বলুনি অনুভব করল সে। দ্রুত বলল, ‘আমি জরুরি মিটিংয়ে ফোন ফ্লাইট মুড করে রাখি।’
পান্নাবাহার বলল, ‘তাই নাকি? জরুরি মিটিং আপনার কাছে উড়ে বেড়ানোর মতো ফিল এনে দেয় বুঝি?’
হেসে উঠল সবাই। জাহ্নবী’র হঠাৎ কী হয়ে গেল কে জানে! প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে উত্তর দিলো, ‘এমন ক্রিয়েটিভ মানুষদের সঙ্গে কারও স্বপ্ন নিয়ে মিটিং করতে পারাটা তো ওড়ার মতোই একটা বিষয়।’
হাত তালি দিয়ে নাদির বলল, ‘ওহ ম্যান, দ্যাটস গ্রেইট! সরি, ওহ ওম্যান। হা হা। ইউ আর রিয়েলি আ জিনিয়াস।’
জাহ্নবী সগর্বে মাথা সোজা করে বসল। ভেতর থেকে এক ধরনের পরিতৃপ্তি অনুভব করল সে। এই অনুভূতির সঙ্গে এটাই তার প্রথম পরিচয়। এতটা আনন্দ নিয়ে সে নাদিরের প্রত্যেকটা কথা শুনলো যে, দারুণ কিছু আইডিয়ার কথা বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। নিজের কাছেই নিজেকে আজ অবিশ্বাস্য লাগছে জাহ্নবী’র।
মিটিং শেষে খাওয়াদাওয়ার পর্ব চলতে লাগল অনেক্ষণ ধরে। কখনো হুট করে পান্নাবাহারের দিকে দৃষ্টি চলে গেলে জাহ্নবী ম্লান হেসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার আজ সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই এই মানুষটার পেছনে নষ্ট করার।
মিটিং শেষে বেরিয়ে একটা রিকশায় উঠল জাহ্নবী। হৃদয়ে দোল লাগানো বাতাসে নিজেকে মেলে ধরল। কল দিলো ভায়োলেটকে।
হ্যালো ভায়োলেট..
‘হুম আপু। বলো?’
‘আজকে আমি একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি। জানিস?’
‘না তো। কী জিনিস আপু?’
জাহ্নবী ঝলমলে গলায় বলল, ‘আমার মাঝে আত্মবিশ্বাসের অনেক অভাব ছিল। তাই আমি এতদিন একটা মরা মানুষ হয়ে ছিলাম। সত্যিই একটা মানুষের সব থেকে বড় শক্তি তার আত্মবিশ্বাস। নিজের প্রশংসা করছি না, তবে আমি জানি আমি মানুষটা জ্ঞানী, অনেক কিছু জানি, অনেক ক্রিয়েটিভ বিষয় চিন্তা করতে পারি। কিন্তু আমি কখনো সেসব প্রকাশ করার সুযোগ পাইনি, কখনো নিজেকে মেলে ধরতে চাইনি। পরীক্ষায় খাতায় ছোট্ট সুযোগ পেতাম বলে সব পরীক্ষায় সেরা রেজাল্ট করেছি। কিন্তু এরপরও আমার কখনো নিজের ওপর আস্থা ছিল না। ভাবতাম, আমি একটা মরা। আজ আমার মনে হচ্ছে এই আত্মবিশ্বাস জিনিসটা অর্জন করতে পেরেছি। অল্প হলেও পেরেছি।’
এক ঊর্ধ্বশ্বাসে দ্রুত কথাগুলো বলে গেল জাহ্নবী। ভায়োলেট খুশি খুশি কণ্ঠে বলল, ‘তোমার আনন্দ দেখে আমারও খুব আনন্দ হচ্ছে আপু। তোমার এই উপলব্ধি দেখবে তোমার জীবনটাই বদলে দেবে।’
‘হ্যাঁ রে। সবকিছু বদলে দিচ্ছে। আমি পারবো অনেক কিছু করতে, আমার সেই যোগ্যতা আছে। এই ভাবনাটাই এতদিন আমার মাথায় আসেনি। আজ সবকিছু খুব অন্যরকম লাগছে রে।’
ভায়োলেট হাসতে হাসতে বলল, ‘আহ কী যে শান্তি লাগছে আপু! তুমি কক্ষনো এভাবে মন খুলে তোমার অনুভূতির কথা আমাকে বলোনি।’
লজ্জা পাওয়া গলায় জাহ্নবী বলল, ‘সত্যিই তাই। আজকে আমার বাসায় আসবি? অনেক আড্ডা দিবো। আজকে রুশোকে নিয়ে কোনো কথা শুনবো না। আজকে শুধু আনন্দের কথা শুনব।’
ভায়োলেট বলল, ‘আসবো আপু। আমিও তোমাকে আমার অনেক আনন্দের কথা শোনাবো। তুমি এতদিন জানতে চেয়েছিলে আমি কেমন জীবন চাই, আমি কী চাই, সবই বলবো আজকে।’
জাহ্নবী’র ইচ্ছে করল খুশিতে রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে নাচানাচি করতে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সে বলল, ‘সত্যি! আমি কত্ত অপেক্ষা করে আছি শোনার জন্য।’
‘হ্যাঁ আপু। সব বলবো। শুধু তাই নয়, আজকে তোমার কাঁধে একটা কঠিন দায়িত্ব তুলে দেবো। জানিনা আসলেই কাজটা করা উচিৎ কী না, কিন্তু করতে হবে আপু। এই দুঃসাহসিক কাজটা না করলে আমি কখনো আমি থাকবো না। আমার এতদিনের জমানো স্বপ্ন পূরণ করাটাও সহজ হবে না।’
জাহ্নবী কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো, ‘কী সেই দুঃসাহসিক কাজ যেটা আমাকে করতে হবে? কীসের ই বা স্বপ্ন!’
‘আজকে এসে সব বলবো আপু।’
জাহ্নবীর রিকশায় বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। একদিকে তীব্র খুশিতে তার ইচ্ছে করছে পাগলের মত নাচতে, অন্যদিকে ভায়োলেটের রহস্য জানার জন্য বুকের ভেতর উত্তেজনারা তেজী হয়ে ফুটে উঠছে। কখন জানতে পারবে সে সবকিছু!
চলবে..
উপন্যাসঃ মেঘফুল
পরিচ্ছেদঃ ৩৭
লেখাঃ মিশু মনি
রাত গভীর হলে জাহ্নবী ও ভায়োলেট বারান্দায় এসে বসল। আজকের রাতটা জাহ্নবী’র জীবনে অবিস্মরণীয় একটা রাত হতে চলেছে। যার উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না সে। আদরের বোন ভায়োলেটের রহস্য জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছটফট করছে।
রাস্তায় গাড়ির চলাচল নেই বললেই চলে। নিস্তব্ধ চারপাশ। বারান্দার বৃক্ষলতা গুলোও বেশ বড় হয়ে উঠেছে, সবুজে ছেয়ে যাচ্ছে বারান্দা’টা। গল্প করার জন্য আগেই জাহ্নবী বারান্দা গুছিয়ে রেখেছে।
ভায়োলেট আরাম করে বসল। মৃদু আলোতে দুই বোন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কী কথা বলতে চায় ভায়োলেট!
জাহ্নবী বলল, ‘আর তর সইছে না। বল না প্লিজ?’
‘কী বলবো?’
‘যা যা বলতে চেয়েছিলি। আমাকে কীসের দায়িত্ব দিবি তুই?
ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘খুব কঠিন দায়িত্ব কিন্তু।’
‘উফফ এত রহস্য করছিস কেন? পাজি মেয়ে কোথাকার।’
হো হো শব্দে হেসে উঠল ভায়োলেট। জাহ্নবীর এই অস্থিরতা দেখতে তার ভালো লাগছে।
জাহ্নবী বলল, ‘যাঃ এবার উঠে যাবো কিন্তু।’
ভায়োলেট ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘রাগ করো না আপু। বলছি। তোমাকে আমি তোমার স্বপ্নের মতো জীবন এনে দেবো। তুমি সবসময় চেয়েছো না, একটা খোলা বারান্দা ওয়ালা বাসায় থাকবে, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজবে?’
‘আমার স্বপ্ন পূর্ণ করে দেয়াটা কি তোর স্বপ্ন?’
ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘ঠিক তা নয়। অনেক ব্যাপার আছে।’
‘ধেৎ আর ভাল্লাগছে না। বড্ড রহস্য করছিস তুই।’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘আপু, একটা সময় আমিও স্বপ্ন দেখতাম একটা ছোট্ট পুরনো বাড়িতে আছি, স্বপ্নের সংসার হবে আমার আর রুশোর। কিন্তু রুশো আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর আমি আর এই স্বপ্ন কখনো দেখিনি।’
জাহ্নবী বলল, ‘মন খারাপ করিস না। আজকে রুশোকে নিয়ে কোনো কথা বলবো না বলেছিলাম।’
ভায়োলেট বলল, ‘হুম। তোমাকে এখন একটা জরুরি কথা বলবো। আমি দীর্ঘদিন ধরে একটা স্টার্টআপ প্লান করছি। নিজেকে প্রস্তুত করতে আমার দেড় বছর সময় লেগেছে। এখন মোটামুটি সবকিছু রেডি, আর আমিও প্রস্তুত। শুধু ইনভেস্টমেন্ট পেলেই বিজনেসটা শুরু করবো।’
জাহ্নবী উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চাইলো, ‘সত্যি বলছিস! এটা তো খুবই ভালো খবর।’
‘আরও একটা ভালো খবর আছে।’
‘তারাতাড়ি বল।’
‘এই বিজনেসে তুমি আমার সঙ্গী হবে। তোমাকে সিইও বানিয়ে দেবো। কারণ, এই জগতে একমাত্র তুমিই আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত আর তুমিই এর যোগ্য।’
‘কী!’
‘হুম। তবে শুরুতে বেতন পাবে খুব সামান্য। বিজনেসটা দাঁড় করানো পর্যন্ত বেতন দিতে পারবো না। ততদিন তোমার চাকরিটাও চালিয়ে যেও।’
অবিশ্বাস্য ভঙ্গীতে তাকিয়ে রইল জাহ্নবী। ভায়োলেট নামের ছোট্ট বোনটাকে হঠাৎ করেই তার খুব বড় মনে হচ্ছে। চোখ ভিজে উঠতে লাগল তার।
ভায়োলেট বলল, ‘এখন খারাপ খবরটা বলবো।’
‘খারাপ খবর আবার কী!’
‘তিন বছরের মধ্যে আশাকরি আমার ইনভেস্টমেন্ট উঠে আসবে। তারপর বিজনেসের দায়িত্ব তোমার কাঁধে দিয়ে আমি হারিয়ে যাবো।’
এতক্ষণে চমকে উঠলো জাহ্নবী। আবছা আলোয় পাশে বসে থাকা ভায়োলেটকে ওর সত্যিই আজ সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। হতবিহ্বল অবস্থা কাটিয়ে সে জানতে চাইলো, ‘বুঝলাম না, কোথায় হারিয়ে যাবি তুই?’
ভায়োলেট বলল, ‘সেটা এখনো ঠিক করিনি। হারিয়ে যেতে টাকার দরকার। তাই আগে শক্ত একটা অর্থনৈতিক খুঁটি দাঁড় করাবো যাতে কখনো টাকার সমস্যায় না পড়ি। তুমি আমার বিজনেসটাকে নিজের সন্তানের মতো আঁকড়ে থাকবে। আমার প্রয়োজনীয় খরচটুকু শুধু আমাকে পাঠালেই হবে।’
জাহ্নবী উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো, ‘কোথায় যাবি তুই ভায়োলেট? কেন যাবি?’
ভায়োলেট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আপু এই সমাজে থাকতে আমার ভালো লাগে না। এত নেগেটিভিটি, এত নোংরা একটা সমাজব্যবস্থা, সবকিছুর ভীড়ে জীবনটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। রুশোকে হারানোর পর থেকে একটা মুহুর্তও নিজের ভেতর শান্তি জিনিসটা অনুভব করিনি আমি। রুশো চেয়েছিল আমি অনেক বড় হই। ওর সেই স্বপ্ন পূরণ করবো। বিজনেসটাকে দেশের সেরা একটা ব্রাণ্ডে পরিণত করবো। রুশো কোনোদিন জানতে পারবে কী না জানিনা, তবে আমি এটা করবো-ই। তারপর দুম করে নিরুদ্দেশ।’
‘আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবি?’
ভায়োলেট জাহ্নবী’র দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘তুমিও গেলে আমার ব্যবসাটাকে দেখে রাখবে কে?’
‘বড় কঠিন দায়িত্ব দিচ্ছিস আমাকে।’
হাসলো ভায়োলেট। জাহ্নবীর হাত চেপে ধরে সে বলল, ‘মাঝেমাঝে তুমি আমার কাছে ভ্যাকেশন কাটাতে যাবে।’
‘আচ্ছা!’
জাহ্নবী’র দৃষ্টিতে বিস্ময়। রাতের অন্ধকার আকাশের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে রইল সে। তারপর বলল, ‘তুই সত্যি সত্যি স্বপ্নের মতো জীবন পেতে যাচ্ছিস।’
‘না রে আপু। জীবনটা এত সহজ না। এটা তো শুধুমাত্র আমার স্বপ্নের কথা বললাম। পুরো পথটাই এখনো বাকি। আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী। তিনি সবসময় আমাদের চাইতে শ্রেষ্ঠ কোনো পরিকল্পনা করে রাখেন আমাদের জন্য। সবই আল্লাহর হাতে। আমরা শুধু স্বপ্ন দেখতে পারি আর চেষ্টা করতে পারি।’
জাহ্নবী বলল, ‘হুম। তুই হারিয়ে যাবি, ভাবতেই আমার কেমন যেন লাগছে!’
‘ভয় লাগছে?’
‘একটু তো লাগছে ই। দেশের যা অবস্থা! আচ্ছা, তুই কোথায় হারিয়ে যেতে চাস?’
ভায়োলেট উত্তর দিলো, ‘এই ধরো ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের কোনো একটা ছোট্ট দ্বীপে। যেখানে মানুষের বসতি নেই বললেই চলে, কোলাহল নেই, জীবনের জটিলতা নেই। একটা সাজানো গোছানো ভিলা নিয়ে সেখানে থাকবো৷ রান্না করবো, খাবো, ঘুমাবো, সমুদ্রে বোট নিয়ে যাবো মাছ ধরতে। আর ভিডিও কলে তোমার সঙ্গে মিটিং করবো।’
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে হেসে ফেলল ভায়োলেট। মন খারাপ ভাবটা কাটতে শুরু করেছে তার। উৎসুক হয়ে বলল, ‘দারুণ তো! তবে এটা খুব কঠিন কাজ রে। আমি এত বড় স্বপ্ন জীবনেও দেখতে পারতাম না। কোনো মেয়েই পারবে না মনেহয়।’
‘হা হা হা। এরকম ইচ্ছে অনেকেরই হয়। দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে। একা থাকার ইচ্ছে। কিন্তু কেউ পূর্ণ করতে পারার দুঃসাহসিক কাজ হাতে নেয় না। আমি এই রিস্ক নিতে চাই।’
‘তুই অনেক সাহসী। অনেক।’
‘তোমাকেও অনেক সাহস দেখাতে হবে আপু।’
‘সাহস তো অলরেডি দেখিয়েছি। সাহস না হলে বাসা থেকে বেরিয়ে এখানে এসে থাকতে পারতাম? তুই আমাকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছিস। তোর স্বপ্নের মতো সবকিছু হলে আমি আরও স্বাধীন একটা জীবন পাবো। আমি একটা প্রতিষ্ঠান চালাবো, মা গো! ভাবতেই পারছি না।’
ভায়োলেট হেসে বলল, ‘পারবে। আমার মাথায় বিজনেস প্লান আসার পরের দিনই চাইলে দশ বিশ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করতে পারতাম, করিনি। দেড় বছরের বেশী সময় ধরে প্লানটাকে মজবুত করেছি, নিজেকে তৈরি করেছি। তুমিও তৈরি করতে পারবে আপু।’
‘ভায়োলেট, তুই যেখানে যাবি সেখানে তোর একা লাগবে না?’
‘হাজারটা মানুষের ভীড়ে থেকেও তো একা লাগে আপু। তারচেয়ে রূপকথার জগতে গিয়ে একা থাকা ভালো না?’
‘রূপকথার জগত ই তো! আমার ইচ্ছে করছে এখনই ওখানে ঘুরতে যাই।’
‘ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডে অনেক খরচ আপু।’
‘যদি এত টাকা আমাদের না হয়?’
‘না হলে ফ্রান্স কিংবা সুইডেনের কোনো নির্জন জংলা গ্রামে গিয়ে একটা ছোট্ট বাড়ি করে থাকবো।’
‘ইস! তোর কথা শুনে আমার চোখের সামনে ঝলমলে রৌদ্রজ্বল দিনে একটা ঘন নীল পাহাড়ে ঘেরা সমুদ্র ভেসে উঠছে। সমুদ্রের কাছাকাছি একটা ভিলা। আবার এখন দেখছি বরফে ঢাকা একটা নির্জন জায়গায় একটা ছোট্ট বাড়ি। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না ভায়োলেট। এই স্বপ্ন দেখে তুই কীভাবে অপেক্ষা করছিস?’
ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘রুশোকে ছাড়া বেঁচে আছি, আর এটা তো…’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ভায়োলেট। তারপর উঠে গেল কফি বানাতে। জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে বসে রইল। সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে তার কাছে। রূপকথার গল্পের মতো। আকাশে মিটমিট করে কয়েকটা তারা জ্বলতে দেখে বুকের ভেতর কোথায় যেন স্বপ্নও জ্বলজ্বল করে উঠল।
কফির মগ হাতে নিয়ে এসে বসলো ভায়োলেট। বলল,
এসব তো স্বপ্নের কথা বললাম। এখন বাস্তবে ফিরে আসো। সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপ টা আমাদেরকে এখন নিতে হবে। শুনলে তোমার হার্টবিট বন্ধ হয়ে যায় কী না ভাবছি।’
জাহ্নবী চমকে পাশ ফিরল, ‘আরও কী বাকি আছে!’
‘আগে কফিটা শেষ করো। শান্ত হও তারপর বলছি।’
জাহ্নবী হাত বাড়িয়ে কফির মগ নিলো। খোলা চুলে ভায়োলেট এসে বসলো তার পাশে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিয়ে ভায়োলেট বলল, ‘ ‘আমি ছিলাম ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। সবসময় ভালো রেজাল্ট করে এসেছি। রুশো আমাকে সবসময় বড় বড় স্বপ্নের কথা বলত। ইন্টারমিডিয়েটে আমি যখন জঘন্য একটা রেজাল্ট করলাম, লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারছিলাম না, আমি সেদিন রুশোকেই সব দোষ দিয়েছিলাম। ওকে বলি, তুমি আমার লাইফে আসার কারণেই আমার এই অবস্থা। অনেক বিশ্রীভাবে কথা শুনিয়েছিলাম ওকে। রুশো একটা জবাবও দেয়নি। চুপচাপ শুনেছে। তবুও আমাকে বুঝিয়েছে, যা হবার হয়েছে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নাও। হয়তো অনেকদিন বোঝানোর পরও ও দেখেছে আমি কিছুতেই ঠিক হচ্ছি না, দিনদিন পাগলামি বেড়েই চলেছে, সে কারণেই কী না জানিনা, রুশো হুট করে হারিয়ে গেল। কেউ ওর খোঁজ দিতে পারলো না। ওর পরিবারের লোকজনও না। রুশো এমনভাবে হারিয়ে গেল, আর কখনো খুঁজে পেলাম না তাকে। বেশ কয়েক মাস পর একদিন দেখলাম ওদের বাসায় তালা দেয়া। পুরো পরিবারটাই চোখের পলকে হারিয়ে গেল আমার কাছ থেকে।’
জাহ্নবী কোনো শব্দ করতে পারল না। নিষ্পলক চোখে সে ভায়োলেটকে দেখছে। নির্বিকার ভঙ্গীতে কফির মগে চুমুক দিয়ে ভায়োলেট বলল, ‘কখনো মনেহয় রুশো আমার আশেপাশেই আছে, কখনো মনেহয় বিয়ে করে হয়তো সংসার সাজিয়েছে, আবার কখনো ভয় হয়, ও হয়তো আমার ওপর অভিমান করে পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কী না!’
জাহ্নবী খানিক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিলো, ‘রুশো তোর ভালো চেয়েছিল। সত্যি বলতে আমরা কেউই তোর কাছে তখন ওরকমটা আশা করিনি। রুশোও হয়তো অপরাধবোধে ভুগছিল।’
‘অপরাধবোধ কী আজও কমেনি আপু?’
ভায়োলেটের নির্বিকার কণ্ঠে বিস্ফারিত হল রাগ। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘এবার রুশোর স্বপ্নই আমি পূরণ করতে চাই। তারপর কোনো একদিন সে আমাকে খুঁজবে সরি বলার জন্য। কিন্তু আমাকে আর পাবে না। ততদিনে আমিও হারিয়ে যাবো।’
‘ভায়োলেট, প্লিজ বোন আর কষ্ট পাস না।’
‘এখন আর কষ্ট পাই না। কষ্টের পালা শেষ। আমার একাকীত্ব সয়ে গেছে।’
‘তোরও রুশোকে সরি বলা উচিৎ ছিল।’
‘জানি। সেটা বলার সুযোগ দেয়নি। পাগলের মতো খুঁজেছি আমি ওকে। একদিন সেও আমাকে খুঁজবে সরি বলার জন্য। আমিও সুযোগ দেবো না।’
ভায়োলেট চোখ মুছে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল, ‘যাইহোক, এখন তোমাকে একটা সিরিয়াস কথা বলি।’
‘বল।’
‘আমার বিজনেসে ইনভেস্ট করার জন্য প্রথম ধাপে বিশ লক্ষ টাকা দরকার। পরের ধাপে আরও বেশী দরকার হতে পারে। সবমিলিয়ে পঞ্চাশ লাখের মতো হলে আমি দ্রুত সময়ের মধ্যে ভালো একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারবো।’
জাহ্নবী কফির মগ ধরে রাখতে পারছে না। হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। ভায়োলেট বলল, ‘কী হল?
‘তুই পঞ্চাশ হাজার চেয়েছিস, সেটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল তাই পেরেছি। কিন্তু বোন, পঞ্চাশ লক্ষ তো এ জীবনে সম্ভব না!’
বড় বড় চোখে জাহ্নবীকে চেয়ে থাকতে দেখে ভায়োলেট মুচকি হেসে বলল, ‘জানি। আমি অল্প করে ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজ করতে পারবো। কিন্তু এভাবে তো অনেক বছর লাগবে আমার ব্যবসা দাঁড় করাতে। তাছাড়া ওদেরকে পারসেন্টেজ দিতে দিতেই আমি শেষ, নিজের স্বপ্নটাকে গড়ে তুলবো কখন? আমার ক্যাশ টাকা দরকার।’
‘তাহলে বোন ডাকাতি করতে হবে। ব্যাংক ডাকাতি ছাড়া উপায় দেখছি না। এত টাকা কোথায় পাবি তুই?’
ভায়োলেট জাহ্নবী’র হাত খপ করে ধরে বলল, ‘আব্বুর কাছে চাইবো।’
‘তোর মাথা খারাপ!’ জাহ্নবী অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে ফেলল।
পরিবারের সবাই জানে জাভেদ আলীর সারা বছরের সঞ্চয় আর পেনশনের টাকা মিলিয়ে তিনি ষাট লাখের মতো টাকা রেখেছেন নিজের ফ্ল্যাটের কাজ সম্পন্ন করার জন্য। জমি কিনে ফেলে রেখেছেন দীর্ঘদিন। অনেকের প্রস্তুতি বাকি ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ির কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। ওই বাড়িতে মাত্র একটা ফ্ল্যাট পাবেন জাভেদ আলী। যেটার বিনিময় মূল্য প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। সেই টাকা তিনি কীভাবে মেয়েদেরকে দিয়ে দেবেন! এটা তো পঞ্চাশ ষাট টাকা নয়।
জাহ্নবী এতক্ষণে কল্পনার রঙিন জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এসেছে। আর এই বাস্তব জগতটা তার কাছে ভীষণ কঠিন। কল্পনা করা যতটা সহজ, বাস্তবে বাস করাটা তার চাইতে দ্বিগুণ কঠিন।
ভায়োলেট বলল, ‘আমি জানি এটা ভয়ংকর রিস্কি একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। কিন্তু আমার স্টার্টআপের জন্য এই রিস্ক নিতেই হবে আপু। আমি তিন বছরের মধ্যেই বাবার পুরো টাকাটা দিয়ে দিতে পারবো আশাকরি।’
‘আর ফ্ল্যাটের কাজ?’
ভায়োলেট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘অপশন এক, সবাইকে বোঝাতে হবে। সবাই সবার ফ্ল্যাটের কাজ করবে, বাবারটা বাকি থাকবে। তিন বছর সময় নেবে বাবা। এর মধ্যে যদি আমরা টাকা ম্যানেজ করতে পারি, আস্তে আস্তে কাজ হবে আর নয়তো ফ্ল্যাটটা অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করা ছাড়া উপায় নেই।’
জাহ্নবী শিউরে উঠে বলল, ‘বাবা শুনলে ভীষণ অবাক হবে ভায়োলেট। বাবা আমাদের শখ আহ্লাদ পূরণ করে মানে এই না যে আমাদেরকে ছেলে খেলার মতো এতগুলো টাকা দিয়ে দেবে। আর তাছাড়া আম্মু শুনলে নির্ঘাত স্ট্রোক করবে।’
ভায়োলেট বলল, ‘আমরা দুইজন মিলে বাবার সঙ্গে বসবো। প্রথমে বিশ লাখ চাইবো। বাড়ির কাজ শুরু হতে হতে আরও মাস ছয়েক লেগে যাবে তুমি দেখো। ততদিনে আমার ব্যবসা শুরু করে দেবো। আমাদের ডেভেলপমেন্ট দেখলে দ্বিতীয় ধাপে বাবা নিজেই টাকা দেবেন আশাকরি।’
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বুঝতে পারছি না কী করা উচিত। আমার হাত পা কাঁপছে।’
ভায়োলেট জাহ্নবী’র হাত ধরল। টের পেলো সত্যিই তার হাত কাঁপছে। এমন ভয়ংকর কম্পনের ভেতরেও দুই বোন ঠিকই ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠল। কিন্তু ভয়ংকর পদক্ষেপ, জাভেদ আলীকে তারা রাজি করাবে কী করে!
চলবে..