উমা পর্ব-৪৭+৪৮

0
330

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৭তম_পর্ব

রুদ্র হাটু গেড়ে নিয়ে বসে। মনোযোগ দিয়ে দৃষ্টি দেয় তার ছোট বউটির দিকে।তার ষোড়শী এখন আর ষোড়শী নেই। একজন পূর্ণ নারী। কিছুদিন বাদে একজন সন্তানের মা হবে সে। সন্তান জন্ম দেওয়া কতোটা কঠিন তা উমার চেহারা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। বমি করার দরুন চোখগুলো বসে গেছে উমার। খুব ক্লান্ত লাগছে তাকে। ঘুমটাও গত ল্রাতে ভালো হয় নি। উমার কোমড় জড়িয়ে ধীর স্বরে বলে,
“আমার উপর কখনো রাগ হয় না তোমার?”
“কেনো বলুন তো?”
“এই যে! আমি তোমাকে সময় নিতে পারি না, ব্যাস্ত থাকি নিজেকে নিয়ে। তোমার যত্ন নেই না।”

উমা মুচকি হেসে বলে,
“আপনি যা দিয়েছেন আমার জন্য যথেষ্ট। ভালোই তো আছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।”

রুদ্র জড়িয়ে ধরে উমাকে। গরম নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছিলো উমার ভেতরটা। তখন রুদ্র ধীর স্বরে বলে,
“তোমার এই উষ্ণ হৃদয়টা কখনো শীতল হবে না তো?”

রুদ্রের প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় উমা। কিছু বলার আগেই রুদ্র স্নিগ্ধ কন্ঠে আওড়ালো,
“আজ
ফাগুনের সকাল বেলায় আলোর
রঙটা ভিন্ন রকম
চাইছে সে রং রঙের দোলায়
আজ ফাগুনে তোমায় প্রথম

আজ ফাগুনের হাওয়ায় দখিন
ভালোবাসা আলোর ভেলায় দুলছে কুসুম
ভোরের
থেকে বাড়িয়ে দিচ্ছে মিষ্টি একটা কি পিপাসা তোমার
ঘ্রাণে আমার আমি যাচ্ছি মেখে

আজ ফাগুনে কিছু খোপায় ফাগুনের ঘর
তারই থেকে একটুকু দেয়
বাসন্তি প্রেম তার জন্য আমার
আমি ফাগুন বিভোর ফাগুন ছন্দ দুহাত
ভরে দিয়ে দিলেম”

ভোরের স্নিগ্ধ কিরণে গভীর নয়নে চাইলো উমা। রুদ্রের চোখের অজানা মায়ার সাগরে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পারছে। উমা আলতো হাতে রুদ্রের মুখখানা তুলে ধরলো, নিবিড় চুম্বন আকলো রুদ্রের ললাটে। রুদ্র নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো উমাকে। সময়টা যেনো থমকে গেছে। শীতল আবহাওয়ায় উষ্ণ আবেশে মত্ত রুদ্রের বিচলিত হৃদয়ে প্রসন্নতার ছোয়া বুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেনো উমার হৃদয়ের কর্ণিশে নিকষকৃষ্ণ ভয় উঁকি দিচ্ছে। ভয় হচ্ছে এই ভালোবাসার কোমল আবেশটি নীল বিষাক্ত যন্ত্রণায় পরিণত না হয়ে যায়। নামহীন ভয়ের কারণটি জানা নেই। তবে ভয়ের চিত্রটি খুব বিশ্রী দেখতে। বিশ্রী তার হাতপা। উমা আলিঙ্গন দৃঢ় করলো। এই মানুষটিকে হারাতে নারাজ সে। আপন বলতে তো এই কটা মানুষ ই রয়েছে।

রাজশ্বী চটের ব্যাগখানা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। আজ শুক্রবার, সুমনের সাথে শিবপুরের ওখানে যেতে হবে। বেশ কটা গ্রাম রাতারাতি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। দখলে চলে আসছে অন্য মানুষ। অথচ ব্যাপারখানা সম্পূর্ণ ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে সূক্ষ্ণ নিপুনভাবে। দিদিকে মিথ্যে বলতে ভালো লাগে না রাজশ্বীর, কিন্তু সত্যটাও বলতে পারছে না। তাই সত্য লুকাতে হচ্ছে। মহাভারতেও যুধিষ্ঠির সত্য লুকিয়েছিলেন। রাজশ্বী তো পাপ কার্য করছে না, সে ন্যায়ের জন্য পথ বেছে নিয়েছে। পথখানা দূর্ঘম বিধায় দিদির হয়তো আপত্তি হবে৷ সেকারণেই সত্য লুকানো। রাজশ্বী ঘর থেকে বের হতেই মুখোমুখী হলো রুদ্রের। রাজশ্বীকে তৈরি দেখে সে সরু দৃষ্টিতে চাইলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
“যতদূর জানি আজ তোমার কলেজ নেই, কোথায় যাচ্ছো?”
“আজ ছাত্রের পরীক্ষা নিবো তো তাই”

বলেই তাকে পাশ কাটিয়ে হাটা ধরলে রুদ্র বলে উঠে,
“ছাত্রের বাসাটা কি ” সময়ের খবর” অফিস? শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করবো, কি লুকাচ্ছো?

শান্ত কন্ঠের কথাটা হিম ধরিয়ে দিলো রাজশ্বীর শিরদাঁড়ায়। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকালো সে। রুদ্র তখন বললো,
“আমি মানুষটা ভয়ংকর হলেও এতোটা খারাপ নই যে আমাকে মিথ্যে বলা লাগবে, যদি সত্যিটা বলো এমন ও হতে পারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।”

রাজশ্বী কিছুসময় চুপ থেকে বলে,
“আমি ওখানে ইন্টার্ণ হিসেবে কাজ করছি। বেশ কিছু মাস শাশ্বত দায়ের অফিসে কাজ করছি। দিদিকে জানাবেন না জামাইবাবু, দিদি রাগ করবে”
“যখন তোমার দিদি জানতে পারবে তখন? তখন কি বলবে”
“জানা নেই, তবে এখন জানাতে চাচ্ছি না।”
“সাংবাদিকতা ভয়ংকর পেশা। জীবনের ঝুকিও রয়েছে।”
“জানি, জীবনের ঝুকি তো সর্বত্র ই। আপনি রাজনীতিতে আসেন, ওখানে কি ঝুঁকি নেই? আছে। তাহলে শুধু ভয় পেয়ে লাভ আছে?”

রুদ্র রাজশ্বীর যুক্তিতে চুপ করে গেলো। বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“আমার নাম্বারটা রাখো, যদি কখনো কোনো ঝুঁকি অনুভব হয় আমাকে ফোন করবে, মনে থাকবে”

রাজশ্বী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। এর পর সে বেড়িয়ে গেলো। রুদ্র সরু দৃষ্টিতে রাজশ্বীর যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। তারপর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার।

২৪.
উষ্ণ রোদে আরাম কেদারায় বসে রয়েছেন অভিনব সিংহ। তার হাতের পাশে কাঠের টেবিলটিতে উষ্ণ গরম চা এবং আজকের খবরের কাগজটি রাখা৷ বার্ধক্য চোখে সোনালী বর্ডারের চশমাটা পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে পরিষ্কার করলো সে। তারপর খবরের কাগজটা হাতে নিলো সে। কাগজটি খুলতেই কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসলো তার। তখন ই দীপঙ্কর কড়া নাড়লো দরজায়। অভিনব চোখ ঘুরায়। দীপঙ্গকর ভীত চাহনীতে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। অভিনব সিংহ অভয় দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে দীপঙ্কর?”
“পুলিশ এসেছে জ্যেঠু……..

চলবে

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৮তম_পর্ব

২৪.
উষ্ণ রোদে আরাম কেদারায় বসে রয়েছেন অভিনব সিংহ। তার হাতের পাশে কাঠের টেবিলটিতে উষ্ণ গরম চা এবং আজকের খবরের কাগজটি রাখা৷ বার্ধক্য চোখের সোনালী বর্ডারের চশমাটা পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে পরিষ্কার করলো সে। তারপর খবরের কাগজটা হাতে নিলো সে। কাগজটি খুলতেই কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসলো তার। তখন ই দীপঙ্কর কড়া নাড়লো দরজায়। অভিনব চোখ ঘুরায়। দীপঙ্গকর ভীত চাহনীতে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। অভিনব সিংহ অভয় দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে দীপঙ্কর?”
“পুলিশ এসেছে জ্যেঠু, আপনাকে খুজছে। তাদের কাছে এরেস্ট ওয়ারেন্ট ও আছে।”

অভিনব সিংহ অবিচলিত দৃষ্টিতে চাইলো দীপঙ্করের দিকে। অভিনবের চাহনীতে নিজের বিচলিত হৃদয় শান্ত হয়ে গেলো দীপঙ্করের। মাঝে মাঝে জ্যেঠুকে খুব রহস্য জালের মতো ঠেকে তার কাছে। লোকটির বয়স ষাট ছুই ছুই কিন্তু তাকে কোনো কঠিন কথায় বিচলিত কিংবা ঘাবড়াতে দেখে নি। সকাল বেলা সূর্য উঠার সাথে সাথে পুলিশের আগমণ মোটেই শুভ কিছু না। তবুও লোকটি শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অভিনব পেপারখানা ভাজ করে উঠে দাঁড়ালো। সোনালী বর্ডারের চশমা চোখে পড়ে নিলো। তারপর এগিয়ে দীপঙ্গকরের সামনে দাঁড়ালো। শান্ত গলায় বললো,
“সকালের খবর পড়েছো?”
“না জ্যেঠু, কেনো?”
“আমি নিচে যাচ্ছি পড়ে নিও”

কথাটা বলে ঘর ছাড়লেন অভিনব সিংহ। দীপঙ্গকর ছোট টেবিল থেকে পত্রিকাটি হাতে নিলো। চোখ বিস্ফোরিত হলো তার। সম্মুখ পেজেই বড় করে লেখা,
“রক্তিম নদী ভাসিয়ে ক্ষমতার চূড়ায় অভিনব সিংহ”

হেডলাইন পড়েই দীপঙ্গকরের বুঝতে বাকি নেই কি লেখা বাকি প্রতিবেদনে। সে টেবিলে ছুড়ে মারলো পেপারটি। তারপর ছুটলো অভিনব সিংহের পেছনে।

লক্ষী দেবী পুজোর ঘরে ব্যস্ত, ফুলির মা থাকতে সব কিছু আগ থেকেই গুছিয়ে দিতো। ফলে তার কখনো কষ্ট করতে হয় নি। কিন্তু ফুলির মার যাবার পর থেকেই সব কাজ একা করতে হয়। আঁচল খানা মাথায় তুলে হাত জড়ো করে পুজো করছিলেন তিনি। তখন মৌমিতা ছুটে এলো, কম্পিত স্বরে বললো,
“জ্যেঠীমা, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। বাইরে পুলিশ এসেছে।”

মৌমিতার কথা শুনেও সে নড়লো না। তার গোপালের পুজোর সময় তিনি অনড় থাকেন। পুজো শেষ করা অবধি তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলো না মৌমিতা। ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গছে। প্রচন্ড উত্তেজনায় তার কপালে ঘাম জমছে। লক্ষী দেবী তার পুজোটা শেষ করলেন, তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
“হয়েছে কি? পুজোর সময় বিরক্ত করছিলে কেনো?”
“জ্যেঠী মা, বাইরে পুলিশ এসেছে। তারা জ্যেঠুকে ধরে নিয়ে যাবে, চলুন”

মৌমিতার কথায় নির্বিকার লক্ষী দেবী। যেনো এটা তার স্বামীর এমন পরিণতিটি তার পূর্বথেকেই জানা ছিলো। শান্ত কন্ঠে বলে,
“আমি যেয়ে কি হবে শুনি?”
“আপনার চিন্তা হচ্ছে না? জ্যেঠুর উপর না জানি কি সব দোষারোপ করছে”
“চিন্তা, একটা কথা কি জানো একটা সময় পর আর চিন্তা হয় না; তখন অভ্যেসে পরিণত হয়। এতো নতুন নয়। তুমি চিন্তাটি না করে বরং এক খানা কাজ করো, রুদ্রকে খবর দেবার ব্যাবস্থা করো।”

লক্ষী দেবীর এমন শান্ত কন্ঠে বিস্ময়ের সর্বোচ্চ আসমানে মৌমিতা। যতই হোক, স্বামীকে জেলে নিয়ে যাবে কথাটা যে কোনো স্ত্রীর মেনে নেওয়া কঠিন। মৌমিতা সময় নষ্ট করলো না। সে নিচে চলে গেলো। লক্ষী পেছনে ফিরে নিজের গোপালের প্রতিমূর্তির পানে চাইলো। তার চোখ ভিজে এলো অশ্রুতে। অশ্রুর কারণটা কেবল ই সেই জানে, মাঝে মাঝে তারোও তালা বাধা সরল মনের ইচ্ছে হয় একজন স্বাভাবিক স্ত্রীর ন্যায় সংসার করতে। যেখানে একটা স্বাভাবিক ভালোবাসার সুতোয় বাঁধা পরিবার থাকবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন ই থেকে যায়।

পুলিশ স্টেশনে আরো একবার ইন্টারোগেশন রুমে অভিনব সিংহ। ইতিমধ্যে তার রিমান্ডের ওয়ারেন্ট বেড়িয়ে গেছে। কিন্তু বয়সের মূল্য করে তার সাথে এখনো কোনো দূর্ব্যাবহার করা হয় নি। জামিনের জন্য ছুটছে দীপঙ্গকর। অভিনব সিংহ আয়েশ করে বসে রয়েছেন। সামনে শ্রাবণ বসে রয়েছে। তার মুখে এক রাশ বিরক্তি। সকাল সকাল ফোন এলো উপর মহল থেকে গ্রেফতার করতে হবে অভিনব সিংহ কে। সরকার বদলের পূর্বে দল দেখা হয় না, পত্রিকায় কলম খোঁচালেই তাকে জেলে নিতে হবে। মেজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে রেট দিয়েছেন। বড় বাজারের গুদামে চালের বস্তায় প্রায় দশ লক্ষ টাকার মাদকদ্রব্য পাওয়া গিয়েছে। সাথে পনেরো লক্ষের মতো টাকা এবং অস্ত্র। একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। শ্রাবণ ধীর স্বরে বললো,
“সময় নষ্ট করলে নষ্ট হবে। গত বারগুলো বেঁচে গেলেও এবার বাঁচবেন না। এবারের চোটে সব কিছু শেষ অভিনব বাবু। যতবার রেট দেওয়া হয়েছিলো কিছু পাওয়া যায় নি। কিন্তু এবারের ব্যাপারখানা সম্পূর্ণ আলাদা৷ এবার আপনার আমলারা জানার আগেই কর্মশেষ। লোকে বলে ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না— ভুল সব। আপনি তো ভাত ছড়িয়েছিলেন। লাভ কি! আরেকটা খবর জানেন? এসিস্ট্যান্ট আইজি সাসপেন্ড হয়েছেন। এবার মুখ খুলবেন?”

অভিনব সিংহ শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় শ্রাবণের দিকে। এবার সত্যি সব তার নাকের নিচে ঘটেছে। প্রতিবার শাশ্বত তার হাটু ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনোবার ই সফল হতে পারে নি। কারণ অভিনব সিংহের লোকেরা আগ থেকে তাকে সতর্ক করে ফেলতো। যার দরুন খুব চতুরতার সাথে প্রমাণ গায়েব করে ফেলতেন অভিনব সিংহ। কিন্তু এবার তেমন কিছু হয় নি, উপরন্তু তার গোপন ব্যাবসাগুলোও ধরা পড়ে গিয়েছে। এতোকাল সরকারি বহু টাকা সে আত্নসাৎ করেছিলেন। হিসেব ও নেই। পথের কাঁটাগুলোকে উপড়ে তুলে ফেলেছেন। শুধু শাশ্বতের বেলাতেই তিনি দূর্বলতা দেখিয়েছেন। কিন্তু শাশ্বতের পক্ষে এতো কিছু খুঁচিয়ে বের করা অসম্ভব। তবে তার জন্য এতো বড় গর্তটি কে খুড়বে? রুদ্র? অভিনব সিংহকে চুপ থাকতে দেখে সজোরে টেবিলে আঘাত করে শ্রাবণ। কর্কশ কন্ঠে শাসিয়ে বলে,
“দিবাস্বপ্ন দেখার সময় শেষ অভিনব সিংহ বাবু। মোট সাতখানা খুনের চার্জ ও হবে। তৈরি থাকুন। এবার মনোনয়ন পত্র তো দূরে থাক! জেল থেকেই বের হওয়া দুষ্কর হবে।”
“আমি তোমার মতো অসিদের পালি। আমার উকিল ব্যাতীত আমি কোনো উত্তর দিবো না। এগুলো বিরোধী পক্ষের চাল, সম্পূর্ণ সাজানো নীলনকশা”

শ্রাবণ টিটকারীর হাসি হাসে। তারপর বলে,
“বেশ আসুক আপনার উকিল”

তারপর সে উঠে দাঁড়ায়। কন্সটেবলকে বলে,
“উনাকে জেলে ভরুন, দেখবে যেনো ভালো খাতির দারি হয়”

বলেই বেড়িয়ে যায়। অভিনব সিংহ বসে থাকে পাথরের ন্যায়। তার কানে যেনো ধ্বনি আসছে। পরাজিত যুদ্ধের শঙ্গনাদ। তবে কি হেরেই গেছে সে!!!!

শিবপুর ইউনিয়নের দক্ষিণের গ্রামগুলো একের পর এক ফাঁকা হচ্ছে। মানুষগুলো রাতের আধারেই ঘর ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। সুমন এবং রাজশ্বী এসে পৌসেছে পালপাড়ায়৷ এখানে দু ঘর পর পর যদি কাউকে পাওয়া যায়। খালি ঘরগুলো ভাঙ্গার ব্যাবস্থা হচ্ছে। মানুষেরা ঘর ছেড়ে কেনো চলে যাচ্ছে কারোর ই জানা নেই। একটা চালের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে সুমন। একজন বৃদ্ধ দরজা খোলে। বৃদ্ধকে সালাম দেয় সুমন। বৃদ্ধের মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে তিনি অপ্রসন্ন। তার চোখ মুখ খিঁচে এসেছে। সুমন কথা শুরু করার চেষ্টা করে,
“চাচা, ভালো আছেন?”
“তা দিয়ে আপনের কি কাম?”
“না আসলে আপনি কেমন আছেন তাই জানতে চেয়েছিলাম?”
“আপনের কি মাথায় সিট আছে? তক্ত কইরেন না।”

বলেই দরজা আটকাতে গেলে রাজশ্বী এগিয়ে এসে বলে,
“চাচা, রাগ করবেন না। আমরা খবরের কাগজের লোক। আসলে এই গ্রাম নিয়ে একটা খবর ছাপাইতাম। তাই আপনার সাথে কটা কথা কইতে আইছি।”
“কি কথা?”
“আচ্ছা, গ্রামের মানুষ দিন দিন কমছে কেনো? তারা নাকি জমি বিক্রি করে চলে যাচ্ছে? কারণ কি?”

লোকটির মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। ভয়ে রক্তশূন্য মুখখানি রাজশ্বীর দৃষ্টি এড়ালো না। লোকটি আমতা আমতা করে বললো,
“তারা গেছে তাদের ইচ্ছা। আপনারা তো লোক ভালা না, এতে খবর বানানোর কি আছে?”
“আপনি বুঝছেন না চাচা, আপনাদের জমি বাড়ি যদি কেউ অন্যায় ভাবে দখল করে থাকে আমাদের জানাতে পারেন। সরকার থেকে সাহায্য পাবেন আপনারা।”

লোকটি আক্ষেপের স্বরে বললো,
“আর সরকার, সরকারের লোক ই মানুষের সাথে জড়িত। যান যান ভাগেন, ত্যাক্ত কইরেন না।”

বলেই মুখের উপর দরজা আটকে দেয় বৃদ্ধ। রাজশ্বী এবং সুমনের কথা বলার সুযোগটিও দিলো না। হতাশ সুমন বললো,
“এখন কি করবে?”
“একজন দরজা দিয়েছে, সবাই তো দেই নি। দেখি, কেউ না কেউ তো কথা বলবেই”

রাজশ্বী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মন বলছে, এরা ইচ্ছে করে গ্রামছাড়া হচ্ছে না। কেউ তাদের গ্রামছাড়া করছে। কিন্তু এই ভূমিদস্যুরা কারা‌!

নিজের কাজের ঘরে বসে রয়েছে রুদ্র। বেশ কিছু কাজ জমে গিয়েছে। ক দিন উমার সাথেই থেকেছে সে। সামনে মননোয়ন পত্র পূরণ করবে সে। তখন উমাকে সময় দেওয়া হবে না। তাই এই কদিন ঘুষ হিসেবে কাজ করেছে সে। অবশ্য উমার সাথে থাকার সময় বাহিরের জগতের কিছুই মনে থাকে না তার। তখন সে মিশে থাকে উমার মাঝে। তার ষোড়শীটি তার সর্বত্র জুড়ে থাকে। মন মস্তিষ্ক তখন মগ্ন থাকে তার উষ্ণতায়। তার চুলের সুবাসে লিপ্ত থাকতে ইচ্ছে হয় রুদ্রের। তার পদ্মের ন্যায় চোখের কাজলে মিশে থাকতে ইচ্ছে হয়। সময়টা কখন কেটে যায় হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। উমার দেখে দূরে থাকতে হবে ভেবেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা উৎপন্ন হয়। এ যেনো অধৈর্য্য যন্ত্রণা। এর মাঝেই টেলিফোনটা বেজে উঠে রুদ্রের। রুদ্রের কল্পনার জগতে বিঘ্ন ঘটে। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরে সে। খিটখিটে গলায় বলে,
“কে?”
“রুদ্র দা আমি দীপঙ্গকর”
“হ্যা বলো”
“দুঃসংবাদ আছে একটা”
“কি?”

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আছে রুদ্রের। দীপঙ্গকর কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“জ্যেঠুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আজ তো শুক্রবার তাই বেইল ও হচ্ছে না।”

দীপঙ্গকরের কথায় চরম অবাক হয় রুদ্র। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে বলে,
“কি বলছো”
“সত্যি বলছি রুদ্র দা, আমার মাথা কাজ করছে না। জ্যেঠী মা কেমন পাথরের ন্যায় বসে আসে। আপনি আসলে ভালো হতো।”
“আমি আসছি, মাকে চিন্তা না করতে বলো, রাখছি”

বলেই ফোন রেখে দেয় রুদ্র। তখন ঘরে প্রবেশ ঘরে উমার। রুদ্রের চিন্তিত মুখশ্রীতে সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে? এতো ব্যস্ত দেখাচ্ছে কেনো আপনাকে?”
“বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে৷ শুক্রবার বলে বেল হচ্ছে না।”
“এখন?”
“আমি ও বাড়ি যাচ্ছি। মা তো একা”
“আমিও যাই?”
“পাগল নাকি? ওখানে তোমার কাজ নেই। তুমি এখানে থাকো। নিজের খেয়াল রাখো। তোমার শরীর তো ভালো নেই। এই অবস্থায়।ও বাড়ি আমি নিবো না।”
“কিন্তু, মাকে সামলাবেন কিভাবে?”
“চিন্তা করো না, মৌমিতা আছে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো৷ পারলে তাকে এখানে নিজে আসবো”

উমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। রুদ্র বেড়িয়ে পড়ে৷ উমা হাত জড়ো করে বলে উঠে,
“দূর্গা, দূর্গা। দেখো মা, অযথা যেনো কেউ কষ্ট না পায়”

উমা পেছন ফিরে রুদ্রের কাজের টেবিলটি দেখে। লোকটি সব এলোমেলো করে গিয়েছে। উমা কাগজগুলো গুছিয়ে রাখতে থাকে। কাগজ গুছাতে গুছাতে একটা সাদা ফাইল হাতে পড়ে উমার। ফাইলটি খোল ছিলো বিধায় অসর্তকতায় বেশ কিছু দলিল বেড়িয়ে আসে। দলিল গুলো গুছাতে গুছাতে উমার চোখে পড়ে, দলিল গুলো নতুন। মাস খানেক পূর্বে বানানো হয়েছে। এক রাশ কৌতুহল হয় উমার। এই জমি গুলো কবে কিনেছে রুদ্র! সে তাকে এই বিষয়ে কিছুই জানায় নি। যদিও সে মংলায় জমি কেনার কথা বলেছিলো। খুতিয়ে দেখলে খেয়াল করে জমিগুলো শিবপুরের মৌজায় পড়েছে………

চলবে।