উষসী হাসবে বলে পর্ব-১৩+১৪

0
275

#উষসী_হাসবে_বলে (১৩)
লিখা- Sidratul Muntaz

গাড়িতে একা বসে হাঁসফাস করছে উষসী। আয়নায় চোখ যেতেই মনে পড়ে একটু আগের ঘটনা। ঘন শ্বাস ফেলে শান্ত হতে চায় সে। ভায়োলিন হাতে নেয়। একা একাই বাজানোর চেষ্টা করে। এমন সময় গাড়ির কাঁচে কড়া নাড়ে তৃষ্ণা৷ দরজা ঠেলে সে ভেতরে ঢুকতেই উষসী ইয়ামিনকে দেখার জন্য লাজুক ভঙ্গিতে, আড় দৃষ্টিতে বাইরে তাকাল এবং অবাক হয়ে দেখল সেখানে কেউ নেই।

“তোর আঙ্কেল কোথায়?”

তৃষ্ণা হাই তুলে বলল,” জানি না। আমার সাথে তো আসেনি। মনে হয় তার বড়’টা পেয়েছে।”

” বড়টা পেয়েছে মানে?”

” টয়লেটের কথা বলছি।”

উষসী মৃদু হাসল। চোখ সরু করে বলল,” দুষ্ট একটা! ”

তারপর একটু ভ্রু কুঁচকে বলল,” তোকে একা এতোদূর ছেড়ে দিল? নিজে এসে দিয়ে যেতে পারতো! যদি তোর কিছু হতো?”

” কি হবে আমার? আমি একাই আসতে পারি।”

তৃষ্ণার মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। তাকে কেউ ছোট বলে আন্ডারিস্টিমেট করলে তার রাগ হয়। নিজেকে সে বয়সের তুলনায় না জানি কত বড় ভাবে!

উষসী ভায়োলিনে মনোযোগ দিল। বিয়ের পর সে সবার আগে ইয়ামিনের থেকে ভায়োলিন বাজানো শিখবে। এই কথা চিন্তা করেই শিউরে উঠল। কি ভাবছে, কতটা ভেবে ফেলছে সে…. অবশ্য আজকের এই রাতের পর তার পুরো দুনিয়াই বদলে গেছে। একটা ছন্দময় সুন্দর নতুন সম্পর্কের দৃঢ় আবির্ভাব টের পাচ্ছে। চারদিকে কি অদ্ভুত সুগন্ধ! কি ভীষণ রঙিন এই রাত! উষসী আজকের এই রাত কোনোদিন ভুলবে না।

বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে যায়। এতোটা সময় কি কেউ বাথরুমে বসে থাকতে পারে? উষসীর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হতে শুরু করল।

” এখনও আসছে না কেন? তৃষ্ণা তুই কি শিউর উনি টয়লেটে গেছে নাকি অন্যকোথাও?”

তৃষ্ণা কপাল গুটিয়ে কিছু চিন্তা করে বলল,” টয়লেটেই তো দেখলাম। আমার মনে হয় কন্সটিপেশন হয়েছে।”

বলেই হেসে উঠল সে। উষসী ভায়োলিনের ডাঁট দিয়ে তার মাথায় মৃদু আঘাত করে বলল,” ফাজিল একটা!”

হঠাৎ শব্দে দু’জনেই চমকে ওঠে। ইয়ামিনের সিটের কাছে মোবাইলটা রাখা। সেটাই শব্দ করছে। ফোনটা কি তার ধরা উচিৎ নাকি উচিৎ না এই নিয়ে দ্বিধায় পড়ল উষসী। তারপর কি মনে করে ধরে ফেলল।

” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে একটা কোমল নারী কণ্ঠ বলল,” হ্যালো.. কে? ইয়ামিন কোথায়?”

” উনি তো এখানে নেই।”

” নেই মানে? তোমাদের একসাথে আসার কথা ছিল না? তুমি উষসী না?”

” হ্যাঁ। আমি উষসী৷ কিন্তু এই মুহূর্তে উনি আমার পাশে নেই। টয়লেটে গেছেন।”

” তোমরা কি ভেন্যুতে চলে এসেছো?”

” এখনও আসিনি। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামানো হয়েছে।”

ওই মেয়েটি চ’কারান্ত শব্দ করল। আফসোসে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল,” ওহ গড, কখন পৌঁছাবে তোমরা? এদিকে অডিয়েন্স পাগল করে ফেলছে আমাদের। অ্যাওয়ার্ড সিরিমনি সেই কখন শুরু হয়েছে। আমরা পরিস্থিতি সামলাতে হিমশীম খাচ্ছি। অথচ তোমরা করছোটা কি ওদিকে? মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে টয়লেট! সিরিয়াসলি?”

মেয়েটা সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষায় কথা বলছে।উষসীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি। সে একটু কঠিন গলায় বলল,” দেখুন, উনি মনে হয় আসতে চান না৷ কারণ এটা তো খুব জরুরী কিছু না…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠল,” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই জরুরী কিছু না? আর আসবে না মানে কি? তোমার কাজ হলো ওকে ঘাড় ধরে নিয়ে আসা বুঝেছ? ইয়ামিন তার ক্যারিয়ারের ফার্স্ট অ্যাওয়ার্ড পেতে যাচ্ছে। আর তুমি বলছো এটা জরুরী না? তাহলে কোনটা জরুরী? গাড়িতে করে লংড্রাইভে ঘুরে বেড়ানো, আশ্চর্য!”

উষসী চমকে উঠল। বিস্ময় নিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটি পুনরায় বলল,” বিশ্বাস করো আমি ইয়ামিনের ভালো জন্যই বলছি। ছেলেটা তার ক্যারিয়ার নিয়ে এতোটুকু সিরিয়াস না। কিন্তু এজ আ গার্লফ্রেন্ড কিংবা কাছের মানুষ হিসেবে তোমার উচিৎ ওকে বোঝানো। তুমিও যদি ওর মতো কেয়ারলেস হও তাহলে ইয়ামিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। যেটা তোমার নিজের জন্যেও ভালো হবে না৷ তাই বোঝার চেষ্টা করো। ইয়ামিনকে বুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসো। আজকের দিনের গুরুত্বটা ও যদি বুঝতো তাহলে এমন ইরেসপন্সিবলিটি দেখাতো না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও কিছুই বোঝে না। তোমার দায়িত্ব ওকে বোঝানো। না হলে কি লাভ ওর কাছের মানুষ হয়ে?”

উষসী জানে না তার এখন কি বলা উচিৎ। মেয়েটা তাকে ইয়ামিনের গার্লফ্রেন্ড বা কাছের মানুষ ভাবছে। এই নিয়ে লজ্জাও লাগল আবার অহংকারে শির উঁচুও হলো। সে কণ্ঠে কনফিডেন্স নিয়ে বলল,” ঠিকাছে। উনি এলে আমি বলে দেখবো।”

” শুধু বললেই হবে না। প্রমিস করো যে তুমি ইয়ামিনকে সময়মতো নিয়েও আসবে। আধঘণ্টার মধ্যেই এখানে আসতে হবে ওকে। এবার কিভাবে আনবে সেটা তোমার উপর ছাড়লাম।”

উষসী ফোন রেখে হাসল। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। নিজেকে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাপারটাও কেমন? ইয়ামিন একবারও তাকে এতো বড় গুরুত্বপূর্ণ দিনের কথাটা বলল না! গাড়ি থেকে নামার কথা চিন্তা করতে নিলেই দেখল দূরে লম্বা একটা কালো অবয়ব। মুখে হাসি ফুটল উষসীর। ইয়ামিন আসছে!

ইয়ামিনের চোখ-মুখ লালচে। মাথার চুলগুলো ভিজিয়ে পেছনে টেনে রেখেছে। দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। উষসীর শরীর ঝিমঝিম করে, এই মানুষটা তার একান্ত হতে যাচ্ছে… বিশ্বাসই হয় না!

গম্ভীর মুখ নিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল ইয়ামিন। এই শীতের মধ্যে সে হাত-মুখ কেন ধুঁয়েছে তার কারণ বোধগম্য হলো না। উষসী মুচকি হাসি নিয়ে বলল,” আজকে আপনার লাইফের এতোবড় একটা দিন… অথচ আপনি আমাকে জানালেন না?”

ইয়ামিন যেন উষসীর কথাই শুনতে পায়নি এমন একটা ভাব করে পেছনে তাকাল। তারপর ভারী কণ্ঠে বলল,” পেছনে যাও তুমি। তৃষ্ণা সামনে আসুক।”

তার রসকষহীন আচরণে উষসী অপ্রস্তুত হলো। কপাল কুঁচকাল। তৃষ্ণা উঠে বসতে বসতে বলল,” আমার ঘুম আসছে না। কিন্তু আমি এখানেই ঠিকাছি।”

ইয়ামিন আর কোনো কথা না বলে গাড়ি চালু করল। উষসী অবাক দৃষ্টিতে জানতে চাইল,” ওকে সামনে আসতে বললেন কেন? কোনো সমস্যা?”

ইয়ামিনের চোখ সামনে নিবদ্ধ, চোয়াল শক্ত। সে একটু চুপ থেকে শান্ত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল,” না।”

উষসী সহজ গলায় বলল,” আপনি আমাকে বললেন না কেন? আজ আপনি প্রথম অ্যাওয়ার্ড পেতে যাচ্ছেন! কি স্পেশাল মোমেন্ট! আরেকটু হলেই হ্যাম্পার হতে যাচ্ছিল আমার জন্য। প্লিজ, এখন সময় নষ্ট না করে দ্রুত ভেন্যুতে চলুন। হাতে মাত্র আধঘণ্টা সময় আছে।”

ইয়ামিন চোখ-মুখে ভাঁজ ফেলে তাকাল,” মানে? কিসের অ্যাওয়ার্ড?”

ভারী কাঠখোট্টা শোনায় ইয়ামিনের কণ্ঠ৷ তার আচরণে এহেন রুঢ়তা উষসীর কেমন অদ্ভুত লাগে। হঠাৎ করে টয়লেট থেকে ফেরার পর কি হয়েছে তার?

” একটা মেয়ে ফোন করেছিল। সে বলল এটা আপনার লাইফের ফার্স্ট অ্যাওয়ার্ড!”

” গুজবও হতে পারে। কে ফোন করেছিল?”

” আমি নাম জিজ্ঞেস করিনি। তবে কণ্ঠটা পরিচিত। হবে হয়তো কোনো স্টার। শুনুন, আপনার যাওয়া উচিৎ। ফ্যানরা অধীর আগ্রহ নিয়ে আপনার অপেক্ষায় আছে!”

ইয়ামিন কথা বলে না। তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং গম্ভীর দেখায়। কিছুটা বিরক্তও মনে হয়। অথচ চোখ দু’টো লাল। উষসীর চোখ এমন লাল হয় যখন সে কাঁদে।ইয়ামিনকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে রেগে আছে নাকি সত্যিই কেঁদেছে!

গাড়ি গন্তব্যের কাছে থামতেই এতো মানুষের ভীড় দেখে উষসী থতমত খায়। পৃথিবীতে পিঁপড়ের চেয়েও মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে মনে হয়। গাড়ির দরজা খুলতে দেরি হয়। কিন্তু মানুষদের হামলে পড়তে দেরি হয় না। এতোজনের চাপ নিতে না পেরে ধপাস করে লবিতে পড়ে যায় ইয়ামিন। কাঁধে ভীষণ ব্যথা হয় তার।

উষসী কোনমতে তৃষ্ণাকে নিয়ে ভীড় থেকে বের হয়ে এসেছে। এতো এতো মানুষকে কি দমানো যায়? সবার চোখে পানি। তারা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে। অন্তত একবার নিজের প্রিয় তারকাকে জড়িয়ে ধরবে বলে৷ তারা ধমক শুনেও চুপসায় না। বরং দ্বিগুণ আবেগ নিয়ে তেড়ে আসে। সেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ভাষায় বর্ণনা করার মতো না। উষসীর প্রচন্ড অস্বস্তি হয়। প্যারিসেও এতো ভীড় কেন থাকবে? এটা তো ইন্ডিয়া বা বাংলাদেশ না! ইয়ামিনের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কোনো ধারণাই তাহলে তার ছিল না। এমনি এমনি কি অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে? অথচ ব্যাপারটা নিয়ে ইয়ামিন নিজে কত উদাসীন!

উষসী এবার বুঝতে পারে ইয়ামিন কেন আসতে চায়নি! প্রথমত তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার মনখারাপ৷ কেন মনখারাপ তা অবশ্য উষসী এখনও ধরতে পারছে না। কিন্তু মনখারাপের মধ্যে তাকে মাথা ঠান্ডা করে ফ্যানদের সামলাতে হচ্ছে। কেউ তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে না। অবশেষে না পারতে সে বলেই ফেলল,” প্লিজ ডন্ট টাচ মি। লীভ মি।”

গার্ডরা সাথে সাথেই ধাক্কা, ধমক দিয়ে মানুষদের সরাতে শুরু করে। ইয়ামিন গটগট করে ভেতরে চলে যায়। কারো সাথে ছবি তোলে না। কাউকে অটোগ্রাফ দেয় না। এই ব্যাপারটা তার ইমেজের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। কালকেই হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাবে যে ইয়ামিন ইব্রাহীম অহংকারী। ভক্তদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। অথচ ভেতরের খবর কেউ জানে না। উষসী নিজেও তো জানে না!

কিন্তু সে ইয়ামিনকে বোঝে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, সেলিব্রিটি হওয়াও সহজ কাজ না৷ তাদেরকে সাধারণ মানুষেরা সাধারণ ভাবতে পারে না। অথচ তারাও রক্ত-মাংসে মানুষ। ব্যক্তিগত জীবন, অনুভূতি, মেজাজ তাদেরও আছে। তারা কোনো পাবলিক প্রোপার্টি তো না!

উষসীর জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করা ছিল, ইয়ামিনের পাশেই বসেছে সে। তার পাশে তৃষ্ণা। ক্যামেরা বার-বার তাদের দিকে তাক করা হচ্ছে। উষসী মুখ ঢেকে কুল পাচ্ছে না। ভাগ্যিস শাড়ির নিচে জিন্স প্যান্ট পরেছিল। সে আসলে প্যান্ট ছাড়া শাড়ি পরতেই পারে না৷ তাই এখন শাড়ি খুলে ফেলায় ওভারকোটের সাথে জিন্স প্যান্ট খুব মানিয়ে গেছে। চারপাশে কত স্টার, নায়িকারা কত গ্ল্যামারাস! সবাই উষসীর সাথে কথা বলতে আসছে৷ যেন আজকের স্পেশাল গেস্ট সে।

উষসীর প্রিয় নায়িকা প্রিসিলা পর্যন্ত একবার এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”তোমার সাথে আলাপ করার খুব ইচ্ছে ছিল। কেমন আছো মিষ্টি মেয়ে? পেইন্টিং এর থেকেও বাস্তবে বেশি সুন্দর তুমি।”

উষসীর মুখ লজ্জায় ভরে ওঠে। সে কখনও ভাবেনি নিজের প্রিয় নায়িকার সাথে এভাবে তার দেখা হবে! প্রিসিলা নিজেই এসে তাকে আলিঙ্গন করেছেন! এটা কোনো স্বপ্ন নয়তো? উষসী কাঁপা স্বরে বলল,” আপনার সব মুভি আমি দেখি ম্যাম। আপনি আমার ফেভারিট স্টার।”

প্রিসিলা চোখ বড় করে নিজের বুকের উপর হাত রাখে। তীব্র আনন্দ মেশানো গলায় বলল,” ও মাই গড, আই এম ব্লেসড!”

উষসীর খুব ভালো লাগে। সবাই তার সাথে ছবি তুলতে থাকে। ইয়ামিনের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে একটা বিশেষ সুবিধা সে পাবে এটা আগেই আশা করেছিল। কিন্তু এতোটাও আশা করেনি। কেউ আবার তার দিকে ঈর্ষান্বিত নজরে তাকায়।

সিনিয়র এক্টরদের সাথে তার বেশ ভালো আলাপ জমলেও ইয়াংস্টাররা তাকে খুব বেশি পাত্তা দেয় না। জোর করে হাসি মুখে কথা বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাদের মধ্যে অহংকার বেশি। তবে এটা ঈর্ষাও হতে পারে। তাদের মতো সুন্দরী তারকা থাকতে ইয়ামিন একটা সাধারণ মেয়ের সাথে কেন প্রেম করবে? এটাই কি ঈর্ষার মূল কারণ? ব্যাপারটা কি তাদের ইগো হার্ট করে?

অ্যাওয়ার্ড সিরিমনির মূল আকর্ষণ শুরু হয়েছে। এখনি বেস্ট সিংগার অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করা হবে। সেজন্য বিখ্যাত সিনিয়র এক্টর মধুবালাকে ডাকা হয় স্টেজে। তিনি সানন্দে ঘোষণা করেন সিংগারের নাম-সাফওয়ান যোশমান।

কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর করতালির আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। উষসীর মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়। শুধু তার না, আশেপাশের মানুষের মুখভঙ্গিও বদলে যায়। প্রিসিলা তো চাপা স্বরে বলেই ফেলল,” ওহ শিট, সব জায়গায় পলিটিক্স।”

যেই মেয়েটি উষসীকে ফোন করেছিল সে বলল,” আমি ভাবতে পারিনি এবার এরকম হবে। নিজের কানে শুনেছিলাম সবচেয়ে বেশি ভোট ইয়ামিন পেয়েছে। অথচ তাকেই পুরষ্কার দেওয়া হয়নি। সাফওয়ান যোশমানকে টাকা দিয়ে আনা হয়েছে। তারা এমন কেন করলেন আমি বুঝতে পারছি না।”

একটা অপ্রীতিকর পরিবেশ তৈরী হয়। কিন্তু ক্যামেরার সামনে কেউ কিছুই বলতে পারে না। সাফওয়ান নিজেও জানতেন এবার বেস্ট সিংগার অ্যাওয়ার্ডটা শুধু ইয়ামিন ইব্রাহীমের। তবুও তিনি স্টেজে গেলেন এবং শুকনো হাসি দিয়ে পুরষ্কার গ্রহণ করলেন।

উষসী তার পাশের একজন বিখ্যাত ইউটউবারকে জিজ্ঞেস করল,” এমনটা কেন হলো? উনি কেন পুরষ্কার পাচ্ছেন?”

মেয়েটির নাম আজরা। সে বলল,” কারণ উনি সিনিয়র স্টার। আর ইয়ামিন ইব্রাহীম ইয়াংস্টার।”

” ইয়াংস্টার বলে কি অ্যাওয়ার্ড পাবে না? এটা কেমন কথা?”

আজরা বাঁকা হেসে বলল,” সে যদি কোনো স্টার কিড হতো তাহলে অ্যাওয়ার্ড পেতে অসুবিধাই হতো না।কিন্তু সে একটা সাধারণ ফ্যামিলির ছেলে হওয়ার কারণে অ্যাওয়ার্ড থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ তারই জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। আসল কথা হচ্ছে এই অনুষ্ঠানের প্রোডিউসারের সাথে সাফওয়ান যোশমানের সম্পর্ক ভালো। এটাই মিডিয়া পলিটিক্স!”

উষসীর এতো রাগ হয়, সবকিছু ভেঙে ফেলতে মন চায়। অথচ ইয়ামিনকে দেখো, কত নীরব আর শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন কিছুই হয়নি৷ তার জায়গায় উষসী থাকলে এতোক্ষণে এখান থেকে উঠে চলে যেতো।

অনুষ্ঠানের শেষদিকে সব স্টাররা এসে ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরে। কীর্তি নামের একটা মেয়ে তো কেঁদেও ফেলে। মেয়েটি ইয়ামিনকে পছন্দ করতো, প্রেমের প্রস্তাবও নাকি দিয়েছিল এমন গুঞ্জন আছে। ইয়ামিন প্রত্যাখ্যান করায় এখন তারা ভালো বন্ধু।

ইয়ামিন তার আশেপাশের সবাইকে বলছে,অ্যাওয়ার্ড নিয়ে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। বরং সে খুশি যে সাফওয়ানের মতো অভিজ্ঞ সিংগার অ্যাওয়ার্ডটা পেয়েছেন। তিনি খুবই গুণী শিল্পী৷ শুধু জনপ্রিয়তার উপর নির্ভর করে কাউকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিৎ না। প্রকৃত গুণের কদর সবার করা উচিৎ।

উষসীর বেশ হাসি পায়। কারণ এখানে উল্টো ঘটনা ঘটছে। যাকে সবার সান্ত্বনা দেওয়ার কথা, সে নিজেই সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে! ইউভান শেখ ইয়ামিনের কাঁধ চাপড়ে বললেন,” নেক্সট টাইম আমি এনশিউর করব যেন অ্যাওয়ার্ডটা তুমিই পাও।”

মনে মনে তিনি নিজেও ইয়ামিনকে ঈর্ষা করেন। কারণ বিখ্যাত ডিরেক্টর তাকে সিনেমার অফার দিয়েছেন। ইয়ামিন রাজি হয়নি। কিন্তু তাকে কনভিন্স করার চেষ্টা চলছে। যদি সে রাজি হয়ে যায় তাহলে মিডিয়া জগতে ইউভান শেখের দাপট কমে যাবে। এই ব্যাপারটা নিয়ে তিনি ভয়ে থাকেন। তবুও সবার সামনে মহান সাজার চেষ্টা করলেন।

যাওয়ার পথে উষসীদের গাড়িতে আরও কয়েকজন উঠে পড়ল। ইন্সট্রুমেন্টগুলো গাড়ির ডিকিতে রাখা হলো। এবার ইয়ামিন সিট ব্লক করেনি। উষসী অবশ্য আগেই ড্রাইভিং সিট-এর পাশের জায়গা দখল করে নিয়েছিল। ইয়ামিনের পাশে অন্যকেউ বসুক এটা সে চায় না।

পেছনে জায়গা নেই। ইয়াংস্টার জিহাদ আহমেদ, কীর্তি, আজরা আর ফাতিন খান বসেছেন। আজরা আর ফাতিন খানের মধ্যে এফেয়ার চলছে এমন একটা গুঞ্জন উঠেছিল একবার। ব্যাপারটা যে সত্যি তা এখন বোঝা গেল।পেছনে জায়গা হয়নি বলে তৃষ্ণাকে সামনে বসতে হয়েছে। তবে সে উষসীর কোলে বসবে না৷ তাই তারা একই সিটে পাশাপাশি বসেছে। খালা-ভাগ্নে দু’জনেই খুব রোগা-পাতলা হওয়ায় সুন্দর জায়গা হয়ে গেছে।

জিহাদ নানান কৌতুক বলে সবাইকে হাসানোর চেষ্টা করছে। বাকিরা হাসিতে ঢলে পড়লেও ইয়ামিনের মুখ গম্ভীর। যেন সে এই জগতে নেই। সবাই ধরেই নিয়েছে অ্যাওয়ার্ডের জন্য তার মনখারাপ। কিন্তু আসল খবর কেউ জানে না। একমাত্র ইয়ামিনের হৃদয় জানে কতটা পুড়ছে সে!

ইয়ামিন হঠাৎ একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বলল,” এক্সকিউজ মি, আমি একটু আসছি।”

জিহাদ বলল,” কোথায় নামছো সিংগার? আমিও আসব নাকি?”

” নো নীড।” ঠান্ডা স্বরে এই কথা বলে ইয়ামিন চলে যায়।

উষসী কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। ইয়ামিনের হাব-ভাব সুবিধার ঠেঁকছে না। সে উষসীর সাথে একবারও কথা বলেনি৷ কারো সাথেই প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না! একটু পর উষসীও নামে। এতোক্ষণ গাড়িতে বসে অবলোকন করেছিল ইয়ামিন রাস্তার ওই পারে গেছে। উষসী তাকে অনুসরণ করে যায়। একটা পাবের মধ্যে ঢুকে কিছু বোতল কেনে ইয়ামিন। তারপর সেগুলো ভালোমতো প্যাকেট করায়। যাতে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে না পারে।

উষসী অবশ্য তাকে ধরতে পারে না৷ এর আগেই ইয়ামিন তার জিনিস নিয়ে ফিরে আসে। মাঝপথে উষসীকে পেয়ে একটু চমকায় সে। তারপর জিজ্ঞেস করল,” তুমি কেন নেমেছো?”

” আপনার আসতে দেরি হচ্ছিল তাই আমার টেনশন লাগছিল। কি হয়েছে আপনার?”

উষসীর দৃষ্টি কোমল। চেহারায় একটা মায়া ভাব লেপ্টে আছে। ইয়ামিন অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল,” কিছু না, চলো যাই।”

উষসী হাত ধরে থামায় তাকে,” দাঁড়ান।”

ইয়ামিন চোখ তুলে তাকায়। উষসী তরল গলায় বলল,” আমি জানি আপনার মনখারাপ। আপনি অ্যাওয়ার্ডের বিষয়টা আগেই জানতে পেরেছিলেন, তাই না? এজন্যই আগে থেকে মনখারাপ করে ছিলেন। কীর্তি আপু বলছিল এটা নাকি সবার জন্য স্বপ্নের মতো। আপনার স্বপ্নটা ভেঙে গেছে তাই একটু মনখারাপ করা স্বাভাবিক। কিন্তু মোটেও হাল ছাড়বেন না, প্লিজ। আপনাকে সবাই ভীষণ পছন্দ করে। একদিন দেখবেন আপনি এমন জায়গায় পৌঁছে যাবেন যে সাফওয়ান যোশমানও আপনাকে ছুঁতে পারবে না।”

ইয়ামিন তাকিয়ে থাকে। সে নাম, যশ, খ্যাতি কিছু চায়নি জীবনে। শুধু একটা সাধারণ জীবন চেয়েছিল। পরিপূর্ণ ভালোবাসায় ভরা একটা সুখের জীবন। সেটুকুও কপালে নেই। এর চেয়ে আফসোসের ব্যাপার আর কি হতে পারে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু বলল,” হুম।”

উষসী ভাবল, ইয়ামিনের মনের বিষণ্ণতা কাটানো দরকার। সামান্য একটা অ্যাওয়ার্ডের জন্য সে মনখারাপ করে থাকবে, এটা কেমন কথা? উষসী ইয়ামিনের হাতের উপর হাত রাখল।

“আমি আপনার পাশে সবসময় থাকব। আপনার খুশির জন্য যা করতে হয়, সব করব। এতোদিন আপনি আমার খেয়াল রেখেছেন৷ এবার আমার পালা।”

“শোধ দিতে চাও?” রাশভারী কণ্ঠে জানতে চাইল ইয়ামিন।

” নিশ্চয়ই চাই।”উষসী মাথা নেড়ে হাসল।

” কিভাবে শোধ করবে?”

” আপনার মন যেন ভালো হয় এমন কিছু করব।”

ইয়ামিন তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে মৃদু হাসল। এই মুহূর্তে পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই তার মন ভালো করার। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভালোবাসা তার জন্য নিষিদ্ধ! তার নিয়তিতে সুখ নামের কোনো উপাদান নেই।তাহলে কার সাধ্যি আছে তাকে সুখী করার? তবুও সে বলল,” কি করবে তুমি?”

উষসী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। চোখে তার একরাশ মায়া। ইয়ামিন তাকায় না ওই চোখের দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তখনি উষসী খুব আলতো করে ইয়ামিনের গালে চুমু দেয়, চমকে ওঠে ইয়ামিন।

উষসী চাপা স্বরে বলল,” মনখারাপ কমেছে?”

তারপর জবাবের অপেক্ষা না করেই দ্রুত সামনে হাঁটতে থাকে। ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে তার। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে থাকে স্থিরমূর্তির মতোন। স্বগতোক্তি করে বলল,” না।”

তারপর বুকের কাছে হাত রেখে বলল,” বেড়ে গেছে।”

আগের চেয়ে আরও অনেক মন খারাপ আর হতাশ লাগছে এখন। তুমুল তৃষ্ণায় খা খা করা গলায় একফোঁটা পানি পড়লে কারো তৃষ্ণা মেটে না৷ বরং পানি খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে যায়। ইয়ামিনের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। তার তৃষ্ণা বহুগুণ বেড়ে গেছে।আগের চেয়ে বেশি তোলপাড় শুরু হয়েছে মনে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে ক্রমশ। কিন্তু এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তাকে উষসীর সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে।

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (১৪)
লিখা- Sidratul Muntaz

রেডিসনের সামনে গাড়ি থামে। সবার আগে নামল ইয়ামিন। তারপর জিহাদ, আজরা, কীর্তি, ফাতিন খান। প্রত্যেকে পর্যায়ক্রমে ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরে আজকের ঘটনার জন্য সান্ত্বনা দেয়। ইয়ামিন বিরক্ত গলায় বলে, সে এসব নিয়ে ভাবতে চায় না৷ সবাই যে যার মতো চলে যায় রুমে। সবশেষে নামে উষসী আর তৃষ্ণা। এতোক্ষণ তৃষ্ণা খুব ছটফট করছিল। গাড়ি থেকে নামতেই সে উষসীর হাত ছেড়ে ভেতরে দৌড়াতে থাকে।

উষসী উচ্চগলায় বলল,” আস্তে বাবা, পড়ে যাবি।”

কে শোনে কার কথা? তৃষ্ণা ফটাফট ভেতরে ঢুকে যায়। সে রুম খুঁজে নিতে পারবে এই বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ তাই উষসী আর তাকে নিয়ে বিচলিত হয় না। নরম দৃষ্টিতে ইয়ামিনের দিকে তাকায়।

ইয়ামিন তার জিনিসগুলো ডিকি থেকে বের করায় ব্যস্ত। মুখের অবস্থা খুব মলিন। যেন তার মধ্যে প্রাণ নেই। এখনও এতোটুকু হাসতে দেখা যায়নি তাকে। এভাবে উষসীর ভালো লাগছে না। অ্যাওয়ার্ড কি এমন জিনিস যার জন্য হাসি ভুলে যেতে হবে?

ইয়ামিনের হাতে ক্যানভাস দেখে উষসী প্রশ্ন করল,” আপনি আমার ছবি আঁকবেন না? কখন আঁকবেন?”

তারপর সে চমৎকার করে হাসল। যেন তার হাসি দেখে ইয়ামিনের মন ভালো হয়। অথচ তার প্রতিটি কথা, হাসি ইয়ামিনের মনে বিষাদের গাঢ়ত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে!

ইয়ামিন নিশ্চল কণ্ঠে বলল,” এখন আমি খুব টায়ার্ড। সকালে এসো৷ তখন কথা হবে৷ গুড নাইট।”

উষসীর হাসিটা মুছে যায়। ইয়ামিন তাকে পরোক্ষে চলে যেতে বলছে। ইয়ামিন রাফিকে ডাকে। সে এসে জিনিসগুলো ভেতরে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে থাকে। উষসী নিচু স্বরে বলল,” গুড নাইট।”

তারপর ধীরপায়ে হেঁটে রুমে চলে এলো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। রুমে আসার পর মনে পড়ে… শাড়িটা গাড়িতেই রয়ে গেছে। সিটের একপাশে ভাঁজ করে রেখেছিল। আবার কি যাবে? উষসী গেল না৷ পরে নিয়ে আসলেই হলো। আপাতত ইয়ামিনকে একটু একা থাকতে দেওয়াই ভালো। মনখারাপের সময় মানুষের একাকিত্ব দরকার হয়।

ইয়ামিন গাড়ি পার্ক করার সময় উষসীর শাড়িটা খেয়াল করে। সাথে সাথেই লুফে নেয়। এই শাড়ির খোঁজে নিশ্চয়ই উষু আসবে তার কাছে। কিন্তু সে দেবে না। বলবে খুঁজে পায়নি। উষসীকে পাওয়ার স্বপ্ন সে দেখতে পারে না। অন্তত তার কাছে একটা শাড়ি থাকুক!

উষসী ক্লান্তি অনুভব করছে। একটু ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবে এটাই তার পরিকল্পনা। তৃষ্ণা আইপ্যাড নিয়ে বসে গেছে।

” তোর কি ক্লান্ত লাগে না?” উষসী বিরক্তি প্রকাশ করল।

তৃষ্ণা দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে চেয়ে অন্যদিকে ঘুরল। অর্থাৎ সে এই মুহূর্তে মনোযোগ দিয়ে গেইম খেলবে। কারো কথা শুনবে না!

উষসী ঘরে ঢুকতেই দেখল প্রিয়ন্তী উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়৷ তার মুখভঙ্গি অভিব্যক্তিহীন। কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগছে। আজ কি সবারই মনখারাপের দিন নাকি? উষসীর নিজেরও কেমন বিষণ্ণবোধ হচ্ছে! সে বিছানায় এসে বসতেই প্রিয়ন্তী ভাবলেশহীন গলায় বলল,

” তোর আপু ফোন করেছিল। আমি বলেছি তুই আর তৃষ্ণা ঘুমাচ্ছিস। এখন একবার ফোন দিয়ে কথা বলে নে। আর ওরা যেন বুঝতে না পারে তোরা এতোক্ষণ বাইরে ছিলিস।”

প্রিয়ন্তীর কণ্ঠে কেমন একটা বিষাদের সুর। উষসী চুপসে যায়। উষ্ণতাদের ফোন দিয়ে তৃষ্ণাকে নিয়ে ভিডিওকলে কথা বলে কিছুক্ষণ। তারপর ডোনাদের ফোন করে। ডোনা কিছুক্ষণ গল্প করেন তৃষ্ণার সাথে তারপর উষসীর সাথে। উষসী একপর্যায় বলল,” শিমলা আন্টি কোথায়?”

” সে তো এখানে নেই। তার ছেলের সাথে কথা বলছে ল্যাপটপে। ডাকব?”

” না দরকার নেই। কথা বলুক। আমি এখন রাখছি।”

উষসী ফোন রেখে একটু স্বস্তি অনুভব করল। মায়ের সাথে কথা বললে নিশ্চয়ই ইয়ামিনের মন ভালো হবে! সে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে নিলেই প্রিয়ন্তী ডাকল,” শোন।”

” হ্যাঁ, বলো আপু।”

প্রিয়ন্তীর চোখ দু’টো লালচে, মুখভঙ্গি শক্ত। সে বলল,” কাল আমরা সুইজারল্যান্ড চলে যাচ্ছি। সকালের ট্রেনে। টিকিট কাটা হয়েছে। এখনি গোছগাছ শেষ করে ফেল। যেন সকালে লেইট না হয়। আমি ঘুমাচ্ছি। লাইটটা অফ করে দিস।”

কথা শেষ করে প্রিয়ন্তী কমফোর্টারের নিচে ঢুকে যেতে উদ্যত হলো। তখনি উষসী তড়িঘড়ি করে বলল,” ইয়ামিনও কি যাবে আমাদের সাথে?”

চোখ তুলে গরম দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়ন্তী। তখনি উষসী সংশোধন করল,” মানে ইয়ামিন ভাইয়া….”

প্রিয়ন্তী কঠিন গলায় বলল,” সে কেন যাবে? তার কি আমাদের সাথে যাওয়ার কথা ছিল? তাছাড়া এখানে তার অনেক কাজ আছে।”

” আমাদেরও তো এতো দ্রুত যাওয়ার কথা ছিল না। এখানে এসেছি মাত্র দুইদিন হয়েছে। আমরা সবাই তো একসাথে বেরও হইনি একবার।”

” শপিং যথেষ্ট হয়েছে আর লাগবে না৷ এবার আমরা ফিরছি।”

প্রিয়ন্তী তার বক্তব্য শেষ করে চোখ বোজার আগেই উষসী প্রস্তাব করল, “চলো না কাল একবার বের হই আমরা? সুইজারল্যান্ডে না হয় রাতের ট্রেনে যাবো। সময় তো আছেই। সকালেই কেন যেতে হবে? এতো কিসের তাড়া?”

প্রিয়ন্তী ধমকের স্বরে বলল,” আমার থেকে বেশি বোঝার চেষ্টা করছিস তুই? আমি বলেছি সকালে যাব, তার মানে সকালেই।”

প্রিয়ন্তী রিমোট দিয়ে লাইট নিভিয়ে চোখ বুজল। উষসী দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতোন৷ হঠাৎ তার কি হয়েছে? এমন রেগে আছে কেন? তৃষ্ণা আইপ্যাডে গেইমস খেলছে। সে আলোতেই আশপাশটা একটু দেখা যাচ্ছে। উষসী সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে দিল আবার।

বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাল প্রিয়ন্তী,” উফ, তোর সমস্যাটা কি?”

উষসী প্রিয়ন্তীর সামনে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসল। অনুরোধ করে বলল,” প্লিজ আপু, অন্তত আর একটা দিন থাকি? প্লিজ! ইয়ামিন ভাইয়ার মন একদম ভালো নেই। আজ অ্যাওয়ার্ড শো-তে…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রিয়ন্তী ধমকানি দিয়ে উঠল,” আমার ভাইয়ের মন ভালো কি খারাপ তা নিয়ে তোর এতো মাথা ব্যথা কিসের? তোকে কি ওর মন ভালো রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে? বল হয়েছে?”

উষসী থতমত খায়। চুপ হয়ে যায় বিস্ময়ে। প্রিয়ন্তী উঠে বসে বলল,” বেশি বাড়াবাড়ি করিস না উষু। কোথায় ইয়ামিন আর কোথায় তুই! একটু বুঝে-শুনে কদম ফেলার চেষ্টা কর। যে জিনিস জীবনে সম্ভব না সেটা নিয়ে অযথা স্বপ্ন দেখিস না। দিনশেষে কষ্ট তুই-ই পাবি। আমি নিজের জন্য বলছি না। তোকে সাবধান করছি।”

উষসী কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে চেয়ে রইল। তারপর ঢোক গিলে বলল,” তুমি যা বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো আপু। আমাদের মেলা-মেশাটা কি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?”

প্রিয়ন্তী ক্ষুব্ধ গলায় বলল,” এটা কি পছন্দ হওয়ার মতো বিষয়? তুই নিজে জানিস না তুই কি করছিস? তোর কি কোনো আক্কেল নেই? ইয়ামিনের সাথে তোর পরিবারের একটা খারাপ অতীত আছে৷ সেটা নিশ্চয়ই ভুলে যাসনি। তখন না হয় তুই আট-নয় বছরের বাচ্চা ছিলি। কিন্তু এখন আর তুই বাচ্চা না৷ তাহলে কেন অবুঝের মতো অনিশ্চয়তায় পা বাড়াচ্ছিস?”

উষসীর চোখে অশ্রু টলমল করে। সে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল৷ তারপর বলল,” ইয়ামিন তোমার ভাই হয়। তুমি কি চাও না সে একটু খুশি থাকুক?”

প্রিয়ন্তী এগিয়ে এসে বলল,” আমি অবশ্যই আমার ভাইয়ের খুশি চাই৷ সে এমনিতেও মন ভেঙে বসে আছে৷ আমি চাই সে আবার কারো প্রেমে পড়ুক। নতুন করে কাউকে ভালোবাসুক। কিন্তু সেই মেয়েটা তুই হতে পারবি না উষু। কারণ তুই ওর জীবনে এলে ওর জীবনটা নরক হয়ে যাবে। সেটা তুই নিজেও খুব ভালো করে জানিস। তাহলে কেন এতো বড় ভুল করলি?”

প্রিয়ন্তী গর্জন করে উঠতেই উষসীর চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। পেছনে তৃষ্ণা আইপ্যাড রেখে দিয়েছে। কাঁচুমাচু হয়ে দেখছে সবকিছু। হয়তো একটু ভয়ও পেয়েছে। ফুপসকে সে কখনও এভাবে চেঁচাতে দেখেনি। আর এন্টসকেও কাঁদতে দেখেনি। এসব যখন হচ্ছে তার মানে নিশ্চয়ই পরিস্থিতি ভ’য়ংকর। এতোটুকু বোঝার জ্ঞান তার আছে৷

উষসী ভবিষ্যতের ভ’য়াবহতা চিন্তা করে স্তব্ধ হয়ে যায়৷ এতোদিন এসব তার মাথায় আসেনি কেন? প্রিয়ন্তী স্বগতোক্তি করল,” তুই না হয় আবেগে ভাসছিস, তোর বয়সটাই এমন। কিন্তু ইয়ামিন কিভাবে এটা করতে পারল? সে তো যথেষ্ট ম্যাচিউর। তাকে এমন ছেলেমানুষী মানায় না!”

তারপর উষসীর দিকে তাকিয়ে দাপট নিয়ে বলল,” আমি তোদের প্রশ্রয় দিবো না এতোবড় ভুলের জন্য। ইয়ামিন যেমন আমার ভাই, তৃষাণও আমার ভাই৷ দু’জনকেই আমি ভালো করে চিনি। তৃষাণ কখনও তোদের সম্পর্ক মানবে না। আর ইয়ামিন দ্বিতীয়বার প্রেমে ব্যর্থ হলে ধ্বংস হয়ে যাবে!”

উষসীর হঠাৎ করেই মনে পড়ে আজকের ঘটনাগুলো। ইয়ামিনের মন খারাপের উৎস কি শুধুই অ্যাওয়ার্ড নাকি অন্যকিছু? ব্যাপারটা মাথায় আসতেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। ক্ষিপ্র কদম ফেলে যেতে লাগল বাইরে। প্রিয়ন্তী পিছু ডাকল,” উষু!”

একবারও না থেমে উষসী বেরিয়ে গেল৷ ক্রোধে চোয়াল শক্ত হলো প্রিয়ন্তীর। এই মেয়ে কি করতে চাইছে? সর্বনাশ ডাকবে নাকি? সেও যাওয়ার জন্য বিছানা ছাড়লেই তৃষ্ণা মৃদু কণ্ঠে বলল,” ফুপস, আই এম হাঙ্গরি।”

থেমে দাঁড়াল প্রিয়ন্তী। আদরের ভাতিজার অসহায় মুখ দেখে মায়া হলো। ছেলেটা কতক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে কে জানে? সে মোলায়েম গলায় বলল,” আমি আসছি বাবা।”

তৃষ্ণা বলল,” প্লিজ… কুড ইউ প্লিহ গিভ মি সাম অরেঞ্জ জুস?”

ইচ্ছে করেই প্রিয়ন্তীকে আটকাতে চাইছে তৃষ্ণা৷ কারণ সে চায় না তার এন্টস আরও বকা খাক৷ প্রিয়ন্তীও তার মায়াময় মুখ দেখে গলে গেল। তার হাত ধরে বলল,” আচ্ছা চলো আমরা ফুডশপে যাই।”

ইয়ামিনের ঘরের দরজায় এসে কড়া নাড়ে উষসী। মিসেস শিমলার সাথে কথা শেষ করে মাত্র বিছানায় গা এলিয়েছে ইয়ামিন। পাশের ঘরেই শুয়েছিল ফারদিন। সে এসে দরজাটা খোলে। উষসী অনুরোধের স্বরে বলল,” ফারদিন ভাই, আপনি একটু প্রিয়ন্তী আপুর ঘরে যাবেন প্লিজ? তার মনে হয় শরীরটা ভালো নেই।”

” বলো কি? আমি আসছি এখনি।”

তার পায়ে মোজা ছিল৷ কোনমতে জুতোটা পরেই বাইরে যায়। উষসী এবার ভেতরে ঢুকেই দরজা আটকে দেয়। জোরালো শব্দ হয়। ফারদিন ঘুরে তাকায়, বোকা হয়ে যায়।

ইয়ামিন শোয়া থেকে উঠে বসল৷ কে এসেছে দেখার জন্য উঁকি দিল। হঠাৎ উষসীকে ঢুকতে দেখেই ভ্যাবাচেকা খায় সে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। বুকের ভেতর চিনচিন করে। অনুভূতি শূন্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” তুমি? এতোরাতে কেন এসেছো?”

” আপনার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

এইটুকু বলেই খপ করে একটা চেয়ার টেনে সামনে বসে যায় উষসী। ইয়ামিন মাথা নুইয়ে নিচে তাকিয়ে থাকে। উষসী আদেশ জারি করল,” আমার দিকে তাকান।”

ইয়ামিন নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে তাকাল। উষসী সরাসরি বলল,” আমি খুব স্ট্রেইট ফরয়ার্ড। মনের কথা চেপে রেখে ভাণ করতে পারি না। তাই বলছি… আই লভ ইউ। ডু ইউ লভ মি? অর নট?”

ইয়ামিনের হার্টবিট বেড়ে যায় উষসীর ওই বড় বড় চোখের দিকে চেয়ে। এই মুহূর্তে তার একটা হার্ট এটাক হতে হতে হয় না। সে নিজেকে শান্ত রেখে খুব সাবধানে বলল,” আর ইউ কিডিং মি?”

উষসী রাগে দিশেহারা হয়ে ওঠে। কণ্ঠে উত্তাপ নিয়ে বলল,” রাত বারোটা বাজে আমি নিশ্চয়ই তামাশা করতে আসিনি! গাড়িতে তখন আপনি আমাকে কিস করতে চেয়েছিলেন। সে কথা আমি ভুলিনি। এটা কিভাবে সম্ভব হয় যদি ভালো না বাসেন?”

ইয়ামিন খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” কিস করার জন্য ভালোবাসা কম্পালসারি এটা তোমাকে কে বলল? আই জাস্ট ফাইন্ড ইউ অ্যাট্রাকটিভ! ”

পুরো শরীর জ্বলে উঠল উষসীর৷ রাগে উন্মাদ হয়ে ইয়ামিনের ফুল স্লিভ টি-শার্টের কলার চেপে ধরল,” নিচের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা নয়, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলুন৷ আমাকে ভালোবাসেন না আপনি? শুধু আকর্ষণের জন্য কিস করতে চেয়েছিলেন? আমি আপনার কাছে আকর্ষণের বস্তু?”

ইয়ামিন উষসীর চোখের দিকে তাকিয়েই বলল,” হ্যাঁ।”

উষসী ধাক্কা মেরে ইয়ামিনের কলার ছেড়ে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” তাহলে আপনার এই অবস্থা কেন? সামান্য একটা অ্যাওয়ার্ডের জন্য ইয়ামিন ইব্রাহীম আপসেট? এটা তো হতে পারে না!”

ইয়ামিন তাকিয়ে রইল। ক্ষণমুহূর্ত পার হতেই বলল,” তাহলে কি আমি তোমার প্রেমে পড়ে আপসেট? এটাই শুনতে চাইছো তুমি? নিজেকে সবসময় এতো প্রিসিয়াস কেন ভাবো? ইউ আর নট মাচ স্পেশাল ফর মি।”

উষসী কিড়মিড় করে বলল,”মিথ্যা বলার জন্যেও যোগ্যতা লাগে ইয়ামিন ইব্রাহীম। সেই যোগ্যতা আপনার নেই। যদি সত্যিই আমি স্পেশাল না হই তাহলে আমার শাড়ি আপনার বালিশের তলায় কি করছে?”

এই কথা বলেই উষসী বালিশের নিচ থেকে শাড়ির কোণা ধরে টান মারে। সুরসুর করে বেরিয়ে আসে পুরো শাড়িটা। ইয়ামিন হকচকায়। ধরা পড়ে অপ্রস্তুত হয়। কোনমতে মাথা নিচু করে দুইহাতে চোখ ঢাকে। উষসীর ঠোঁটে তখন বিজয়ীর হাসি। সে চেয়ারে বসতে বসতে ভাব নিয়ে বলল,” আমার জন্য আপনি এতো পাগল হয়ে যাচ্ছেন… প্রিসিয়াস তো আমি অবশ্যই। কিন্তু সেটা স্বীকার কর‍তে কি আপনার ইগো হার্ট হয় ইয়ামিন ইব্রাহীম?”

ইয়ামিন উত্তর দেয় না। চোখ থেকে হাত সরিয়ে এবার শুধু মুখের উপর রাখে। নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দেয়ালের দিকে। উষসী ঝুঁকে এসে বলল,” ইয়ামিন ইব্রাহীম একটা সাধারণ মেয়ের জন্যে এতোটা আপসেট… অথচ মুখ দিয়ে স্বীকার করার সাহস নেই। কি অদ্ভুত তাই না?”

ইয়ামিন এবারও চুপ করে থাকে। উষসী হাসতে শুরু করল। তারপর রাগী কণ্ঠে বলল,” আপনি এতোটা কাওয়ার্ড জানলে আমি কখনও আপনার প্রেমে পড়তাম না… সত্যি বলছি!”

এই কথা বলে শাড়িটা রেখেই উষসী চলে যেতে নেয়। তখন ইয়ামিন আচমকা চেপে ধরে তার হাত। তাকে ঘুরিয়ে নিজের কাছে এনে কাঁধ চেপে ধরল। উষসীর চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে যায় আকস্মিক আক্রমণে।

ইয়ামিন তার মুখের উপর ঝুঁকে প্রশ্ন করল কাঠখোট্টা গলায়,” তুমি পারবে স্বীকার করতে যে আমাকে ভালোবাসো?”

” আমি অলরেডি স্বীকার করেছি। আপনার মতো মিথ্যা বলিনি!” উষসীর কণ্ঠে আত্মগৌরব।

ইয়ামিন এবার বলল,” আমার সামনে না, সবার সামনে স্বীকার করতে হবে। সবাইকে ছেড়ে শুধু আমার হাত ধরতে হবে। আমার সাথে থাকতে হলে তোমার ভাইয়া আর আপুর কাছে কোনোদিন ফিরে যেতে পারবে না। তারা তোমার মুখও দেখতে চাইবে না হয়তো।”

উষসীর মুখের রঙ বদলায় এবার। সাদা কাগজের মতো নিঃসাড় হয়ে যায়। ইয়ামিন অনমনীয় কণ্ঠে বলল,”পারবে সবাইকে ছেড়ে শুধু আমার হাত ধরতে? সাহসীর মতো ভালোবাসা স্বীকার করেছো না? তাহলে এবার সাহসী কাজ করে দেখাতে পারবে? নাকি সাহসটা শুধু মুখে মুখেই?”

উষসীর জবান থেমে গেছে। ইয়ামিন চেপে ধরে রেখেছে তার একটা হাত। সেই হাত হঠাৎ করেই ছাড়িয়ে নিল উষসী। ইয়ামিন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসে। সে জানতো এটাই হবে!

উষসী উঠে দাঁড়াল৷ দ্রুত চলে যেতে নিচ্ছিল৷ তারপর কি ভেবে আবার পেছনে তাকায়। ফিরে এসে বলল,” আমি আপনাকে সবকিছু ছেড়ে আসার মতোই ভালোবাসি। কিন্তু তৃষাণ ভাইয়ের সাথে বেইমানি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাবার মৃত্যুর পর তিনি ছায়ার মতো আমার পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন। সেই কথা আমি ভুলতে পারব না। এতোবড় অকৃতজ্ঞ আমি হতে পারব না।”

ইয়ামিন দেয়ালের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,” আমিও চাই না আমার জন্য তুমি পরিবার ছেড়ে দাও। ভালো থেকো।”

উষসী চেয়ার টেনে পুনরায় ইয়ামিনের সামনে বসল। ব্যাকুল হয়ে বলল,” কিন্তু আপনাকে ছাড়া ভালো থাকা অসম্ভব এখন!”

ইয়ামিন কাতর দৃষ্টিতে তাকায়। উষসী চুপ করে তাকিয়ে থাকে। ইয়ামিনও তাকিয়ে আছে৷ তারা দু’জনেই অনেক কাছে। ফুডশপে তখন গান বাজছে। কিছু লিরিক্স স্পষ্টভাবে তাদের কানে এলো। পরিস্থিতির সাথে গানের বুলি এতো মিলে গেল যে দু’জনেই স্তব্ধ!

” Baby just hold my hand,
Be my girl, I will be your man..
I see the universe in your eyes…”

থমথমে নীরবতা, শুধু গানের মিউজিক কানে আসছে। উষসী ইয়ামিনের হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। ইয়ামিন গভীর শান্ত গলায় বলল,” তোমার আপু আর ভাইয়া নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে অনেক প্রশংসা করে!”

” হুম৷ আপনি তাদের জীবন জ্বালিয়ে শেষ করেছেন। কত সুন্দর প্রশংসা!”

ইয়ামিন হেসে জিজ্ঞেস করল,” তবুও আমার প্রেমে পড়লে কিভাবে?”

” মেয়েদের সবসময় খারাপ ছেলেদের প্রতি কৌতুহল থাকে। আর সেই কৌতুহল থেকেই প্রেম হয়, জানেন না?”

ইয়ামিন আবারও হাসল। ভারী গলায় বলল,” এটা সম্ভব না উষসী।”

আবারও শোনা যায় গানের লিরিক্স,” Baby just hold my hand,
Be my girl, I will be your man..
I see the universe in your eyes…”

ইয়ামিন বিবশের মতো তাকিয়ে থাকে উষসীর বড় বড় চোখের দিকে। সে সত্যিই ওই সুন্দর চোখে ইউনিভার্স দেখতে পাচ্ছে। শুধু ইউনিভার্স না, সাথে ব্ল্যাকহোল। যেখানে ঝাঁপ দিলেই মৃত্যু নিশ্চিত! তবে বিষাদে ভরা এই জীবনের চেয়ে সেই মৃ’ত্যুই বুঝি অনেক বেশি স্বস্তির…

চলবে