উষসী হাসবে বলে পর্ব-২১+২২

0
248

#উষসী_হাসবে_বলে (২১)
লিখা- Sidratul Muntaz

ইয়ামিনের কাঁধে মাথা রেখে তুষারপাত দেখছে উষসী। আজকের এই রাতটা স্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে। মন খারাপের বাতাস ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। ভেতরটা পুড়ছে। কেমন একটা কষ্টময় অনুভূতি বিঁধে আছে গলায় কাটার মতো।

” কাল আমি চলে যাচ্ছি, জানেন তো?”

” হুম।”

” আজ আমার খুব মনখারাপ।”

উষসীর কণ্ঠে হাহাকার টের পায় ইয়ামিন। মুচকি হেসে জানতে চাইল,” কেন?”

উষসী সামান্য রেগে বলল,” ভং ধরবেন না একদম। কেন আপনি জানেন না?”

ইয়ামিন তাকে আরও রাগিয়ে দিতে চাইল,” না তো। কেন? ছবির মতো সুন্দর দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছো বলে?”

উষসী বুঝতে পারে ইয়ামিন ইচ্ছাকৃত এমন করছে। সে রাগে না। খুব শান্ত স্বরে বলে,” না। এতোটাও সুন্দর না এই সুইজারল্যান্ড। ”

” তাই?” ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকায়। সে তো জানতো সুইজারল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দেশ। অথচ উষসী বলছে এতোটাও না!

উষসী মাথা উঠিয়ে বলল,” হুম। আমার মনে হয় সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য্যে একটা কৃত্রিমতা আছে। ওরা সুন্দর করে রাখে বলেই এই দেশ সুন্দর। আর বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর। আমরা নোংরা করে রাখি। তাও সুন্দর! ”

ইয়ামিন হাসল। উষসীর মনে যে একটা সুপ্ত দেশপ্রেম বোধ লুকিয়ে আছে তা সে জানতো না। এই ধরণের মানুষ ম’রে গেলেও নিজের দেশ ছাড়া অন্য দেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে না।

“কাল তাহলে সত্যি চলে যাচ্ছো?” বিমর্ষ গলায় প্রশ্নটা করে থেমে যায় ইয়ামিন। তাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখায়।

উষসী তার চোখের দিকে তাকায়। ইয়ামিনও একই সময় তাকায়। তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর।কাঁচঘরের সোনালি আবছা আলোয় উষসী স্পষ্ট দেখতে পায় দু’টো গভীর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কাঁদছেন নাকি?”

ইয়ামিন মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,” না তো!”

উষসী ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বেলে বলল,” দেখি, আপনার চোখ!”

সে কাছে আসতে নিলেই ইয়ামিন উঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সামনে যেয়ে একহাত পকেটে গুঁজে কাঁচের দেয়ালে ঠেস দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। উদাস দৃষ্টি মেলে।

উষসীর খুব হাসি পায় হঠাৎ। কাছে গিয়ে বলল,” আমি ব্রেকাপ করলাম বলে সেই কষ্টে কাঁদছেন নাকি?”

ইয়ামিন কাঠখোট্টা ভাবে ভর্ৎসনার সুরে বলল,” নিজেকে এতো প্রিসিয়াস ভেবো না।”

উষসীর হাসির মাত্রা আরও বাড়ে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,” যদি আমি প্রিসিয়াস না হই তাহলে এই শীতের রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আমার জন্য ভায়োলিন বাজাতেন না নিশ্চয়ই। ”

ইয়ামিন এবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি ভায়োলিন বাজাচ্ছিলাম নিজের জন্য। তুমি হঠাৎ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলে কেন? আমাদের না ব্রেকাপ?”

উষসী ইতস্তত করে বলল,” আপনি আমাকে ‘আই লভ ইউ’ বললেন কেন?”

ইয়ামিন ঘাড়ত্যাড়ার মতো বলল,” উত্তরে তুমিও তো ‘আই লভ ইউ টু’ বলেছো। এখন আমার কি মনে করা উচিৎ? ”

উষসী রেগে গেল। ভাঙবে তাও মচকাবে না এই লোক। তাই সেও কিছু স্বীকার করবে না। নিচ থেকে ভায়োলিন তুলে নিয়ে বলল,” কিছুই মনে করতে হবে না। আপনি বরং এটা বাজান। নিন, ধরুন।”

ইয়ামিন একপলক ভায়োলিনটার দিকে তাকাল। কিন্তু হাতে নিল না। আচমকা উষসীর হাত দু’টো পেছনে নিয়ে চেপে ধরল। চমকে উঠল উষসী। হাতের ভায়োলিন পড়ে গেল কার্পেটের উপর।

ইয়ামিন উদভ্রান্তের মতো একনাগাড়ে বলতে লাগল,”আমি প্রথম দেখেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম উষসী।সিলেটে তোমাকে দেখে তোমার মুখছবি ওই পেইন্টিং-এ বসাতে চেয়েছিলাম।এভাবে শুধু পেইন্টিং-এই না, আমার হৃদয়েও আসন গেঁড়ে বসে গেছো তুমি। তোমার আসল পরিচয় জেনে নিজের অনুভূতিকে ধামাচাপা দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি আমাকে নিষ্ক্রিয় থাকতে দাওনি।”

উষসী চোখ বড় বড় করে সব কথা শোনে। ইয়ামিন হাঁফ ছেড়ে একটু থামে। তার গরম নিশ্বাস প্রবাহিত হয় উষসীর মুখজুড়ে। সে স্তব্ধীভূত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইয়ামিন আবার বলল,”জোর করে ভালোবাসা আদায় করেছো না? এখন সেই ভালোবাসার পরিণামও ভুগতে হবে। আমি যে কোনো মূল্যে তোমাকে চাই উষসী। কারণ আমি কোনো টাইম পাসের প্রেম করিনি৷ আমার অনুভূতি এতো ঠুনকো ছিল না।”

উষসী স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। একটু পর সেও আচ্ছন্নের মতো বলল,” আমিও কোনো টাইম পাসের জন্য প্রেম করিনি। সত্যি ভালোবাসি আপনাকে।”

” তাহলে বার-বার এমন ব্রেকাপ গেইম কেন খেলছো?”

” আপনিই আমাকে বিভ্রান্ত করছেন। সত্যিটা কেন বলে দিচ্ছেন না? ”

ইয়ামিন এই পর্যায় উষসীকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। উষসী দুই কদম এগিয়ে এসে তার পিঠের দিকে চেয়ে বলতে থাকল,”আপুর ওই ভিডিওর সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু এইটুকু বলুন। আমি আর কিচ্ছু জানতে চাইব না।”

ইয়ামিন ঘুরে তাকাল। দরাজ গলায় বলল,” না নেই কোনো সম্পর্ক। আমি ওই বিষয়ে কিছুই জানতাম না। উত্তর পেয়েছো? হ্যাপি?”

উষসী আনন্দের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। তার চোখ দু’টো জলে ভরে উঠল। কাছে এসে ইয়ামিনের গলা জড়িয়ে ধরল পরম আদরে। ইয়ামিন বলল,” আমার এক কথাতেই সব মেনে নিলে?”

” আপনাকে নিজের থেকেও বিশ্বাস করি আমি। নাহলে এই মাঝরাতে উঠে আসতাম না আপনার কাছে।”

উষসীর মুখ খুশিতে ঝলমল করছে। ইয়ামিন নরম গলায় বলল,” আমাদের সামনে অনেক বড় বাঁধা উষসী। এক হওয়া এতো সহজ হবে না।”

” এখনি ভ’য় পাচ্ছেন আপনি?”

ইয়ামিন নিচু হয়ে উষসীর কপালে কপাল ঠেঁকিয়ে বেদনাময় কণ্ঠে বলল,” হ্যাঁ পাচ্ছি। তোমাকে হারানোর ভ’য়ে তটস্থ হয়ে যাচ্ছি আমি।”

উষসী হাসল। ইয়ামিন গাঢ় দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে চেয়ে বলল,” তোমাকে সামনে বসিয়ে পোর্ট্রেট আঁকার ইচ্ছেটা আর পূরণ হলো না। কাল চলেই যাচ্ছো। এতো তাড়া কিসের?”

” ডোনা আন্টি থাকতে চাইছেন না। তৃষাণ ভাইয়াও তাড়া দিচ্ছে। জানেন তো তৃষ্ণা আছে আমাদের সাথে। তারও মনখারাপ। বাচ্চা মানুষ যে এতোদিন মা ছাড়া থেকেছে এটাই অনেক। তবে পোর্ট্রেটের ব্যাপারটা আজকে রাতেও সম্ভব। অনেক সময় আছে।”

” এখন?”

” হুম। কেন? পারবেন না চার-পাঁচঘণ্টায়।”

” আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।” উষসী ফিচেল হাসল।

ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে বলল,” শর্ত তো আমি পূরণ করেছি। ভায়োলিন বাজিয়েছি তোমার জন্য।”

” এটা ছাড়াও অন্য আরেকটা শর্ত।”

” ঠিকাছে বলো।”

উষসী লাজুক ভঙ্গিতে বলল,” পোর্ট্রেট আঁকা শেষ হলে এবার ওটা আমাকে দিয়ে দিতে হবে। আপনার স্মৃতি হিসেবে সাথে নিয়ে যাবো।”

ইয়ামিন একটু দ্বিধান্বিত হয়ে চাইতেই উষসী অনুরোধের স্বরে বলল,” প্লিজ!”

” ঠিকাছে।”

উষসী যেতে যেতে বলল,” আরেকটা শর্ত।”

” আবার কি?”

“পোর্ট্রেট আঁকার সময় আপনাকে গান গাইতে হবে।”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আর কোনো শর্ত বাকি আছে ম্যাডাম?”

উষসী দুষ্ট হেসে বলল,” আপাতত এতটুকুই। বাকিগুলো মনে পড়লে বলব।”

ইয়ামিনের মনে হচ্ছে পোর্ট্রেট আঁকতে চেয়েও বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে সে। হাতে কফি নিয়ে বসে আছে উষসী। কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। একটু পরেই এটা ঠান্ডায় জমে যাবে। তখন আবার গরম করতে হবে। তাই সামনেই ওভেন রাখা হয়েছে। উষসী তাকিয়ে আছে ক্যানভাসের দিকে।

ইয়ামিন তার মুখোমুখি বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। উষসী কঠিন মুখে বলল,” শর্ত নাম্বার তিন, ভুলে গেছেন? গান গাইতে বলেছিলাম।”

ইয়ামিন বিব্রত মুখে বলল,” বুঝতে পারছি না এমন পরিস্থিতির সাথে কি গান যায়। কোনো গানই মাথায় আসছে না।”

” ঠিকাছে… আমি আপনাকে গান চুজ করে দিচ্ছি।”

এই কথা বলে সে নিজের ফোন হাতে নিল। প্লে লিস্টে ঢুকতেই শুনল ইয়ামিন আবেগজড়িত কণ্ঠে গাইতে শুরু করেছে,” এখন অনেক রাত,তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস..আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!
ছুঁয়ে দিলে হাত,আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা
চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়…”

উষসী এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। হার্টবিট মিস করল যেন।

ইয়ামিন চোখ তুলে আবার গাইতে লাগল,” কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি, পাখার ব্লেডের তালে সোজাসুজি কথা বলি।”

উষসীর শরীর ঝিমঝিম করছে। তার সাদা মুখ রাঙা হয়ে যায়। ইয়ামিন এমন একটা গান ধরবে সে ভাবতেও পারেনি। আগে জানলে গান শোনার আবদারই করতো না।

ইয়ামিন গলা উঁচিয়ে গাইছে,” আমি ভাবতে পারি নি,
তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার
শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ
আমি থামতে পারি নি,
তোমার গালে নরম দুঃখ
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ।”

এমনিতেও ওই কণ্ঠ শুনলে সে এলোমেলো হয়ে পড়ে। তার উপর এমন একটা গান শুনে রীতিমতো সংকোচে লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে পড়েছে। সবসময় ইয়ামিনের গান শুনলে তার কান্না পেতো, কিন্তু আজ এমন লাগছে কেন?এই লোক তো গান গেয়ে শুধু কাঁদানোয় না, ভ*য়ংকর লজ্জা দিতেও এক্সপার্ট!

উষসীর অস্বাভাবিকতা টের পেয়ে ইয়ামিন তুলি রেখে উঠে এলো। হাত বাড়িয়ে বলল,” উষু, আর ইউ অলরাইট?”

উষসী কাঁপা কণ্ঠে বলল,” আপনি গান গাইতে গাইতে ওভাবে আমাকে দেখছিলেন কেন?”

ইয়ামিন নিচু হয়ে বলল,” তোমাকে চেরিফুলের মতো সুন্দর লাগছে উষসী। আমি চোখ ফেরাতে পারছি না।”

উষসী তার গায়ের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে বলল,” আমি যদি এখন ম’রে যাই তাহলে সেই দায় আপনার। ”

ইয়ামিন তাকে দ্রুত হাতে কোলে উঠিয়ে বলল,” আমি আজীবনের জন্য সব দা’য় নিতে প্রস্তুত। কিন্তু এতো সহজে তোমাকে মা’রবো না৷ ডন্ট ওরি।”

সে উষসীকে বিছানায় এনে শোয়ালো। উষসী কাঁপা কণ্ঠে বলল,” মাঝরাতে আপনার ঘরে আসাই আমার ভুল হয়েছে।”

ইয়ামিন নিচু কণ্ঠে বলল,” কিছু ভুলের মাশুল অনেক দাম দিয়ে দিতে হয় উষসী।”

উষসী চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইয়ামিন একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। উষসী একহাতে খামচে ধরে আছে তার জ্যাকেট। চোখের পাপড়ি কাঁপছে তিরতির করে। ঠোঁট নেড়ে অনবরত বিড়বিড় করছে মেয়েটা। ইয়ামিনের মন চাইল এই মুহূর্তে ওই ঠোঁটের নড়ন শিথিল করে দিতে। কিন্তু মনের আকাঙ্খাকে প্রশ্রয় দিল না। সে কোনো কলঙ্ক রাখতে চায় না ভালোবাসায়।

উষসীর হাত ছাড়িয়ে উঠে বসল সে। এতোক্ষণ পর চোখ মেলে তাকাল উষসী। বুকের মধ্যে অদ্ভুত তোলপাড়ের শব্দটা শান্ত হয়ে গেল হঠাৎ। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে বলল,” চলো বাইরে যাই।”

উষসী অস্বস্তি নিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর ক্যানভাসের দিকে চেয়ে বলল,” ছবি?”

ইয়ামিন বলল,” ট্রাকচার এঁকে রেখেছি। বাকি কাজ পরে করব। তুমি ভেবো না। বাংলাদেশে গেলেও তোমার কাছে এটা পৌঁছে যাবে।”

উষসী হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল। ইয়ামিন তাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা হ্রদের সামনে এসে থামল। আজ আকাশে পূর্ণ চন্দ্রিমা। জোৎস্নায় থৈ থৈ করছে চারিপাশ। তুলোর মতো বরফগুলো ঝরে পড়ছে এদিক-সেদিক। মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে চাঁদ গলে পড়ছে!

উষসী বিবশের মতো বলল,” আজকের রাতটা স্বপ্নের মতো। আমি কোনোদিন ভুলব না এই রাত!”

ইয়ামিন দুই হাত ধরে বলল,” আজকের রাতটা শুধু আমাদের।”

উষসী হেসে মাথা ঝাঁকাল। চাঁদের আলোতে সবকিছু খুব মায়াবী লাগছে। উষসীর সুন্দর হাসি আরও লক্ষগুণ সুন্দর হয়ে উঠেছে। ইয়ামিন মুগ্ধ হয়ে দেখছে। উষসী উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,” আমার এখানে এতো ভালো লাগছে যে নাচতে ইচ্ছে করছে!”

“ডান্স করবে উষসী?” কোমল গলায় প্রশ্ন করল ইয়ামিন।

উষসী সংকোচ নিয়ে আশেপাশে চেয়ে বলল,” এই রাস্তায়?”

” আমরা ছাড়া আর কেউ নেই এখানে!”

উষসী চোখে আনন্দের জল চিকচিক করে উঠল। আপ্লুত স্বরে বলল,” আপনার সাথে শুধু ডান্স কেন? ম’রে যেতেও আমার কোনো আপত্তি নেই আজ।”

ইয়ামিন হাত বাড়িয়ে দিল। উষসী এবার বলল,” কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

ইয়ামিন একটা ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়ল,” বলো শর্তের রাণী।”

” আপনাকে গান গাইতে হবে।”

ইয়ামিন এবার কোনো কথা ছাড়াই গান শুরু করল,”Ye rateen mausam nadi
Ka kinaara ye chanchal hawa
Kaha do dilon ne ki mil kar
Kabhi na honge kabhi ham juda
Ye raaten ye mausam nadi ka
Kinaara ye chanchal hawa….”

উষসী কাপল ডান্স এর আগে কখনও করেনি। সে শুধু ইয়ামিনের নির্দেশনা অনুযায়ী হাত-পা নাড়িয়ে যাচ্ছে। ইয়ামিন ঝট করে তাকে কোলে তুলে নিচ্ছে আবার ফট করে নামিয়ে হাত ধরে ঘুরাচ্ছে। উষসীর বেশ মজা লাগছে। তার শরীরের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ইয়ামিনের হাতে। মনে হচ্ছে এভাবে আজীবন ডান্স করে গেলেও ক্লান্তি আসবে না!

প্রায় আধঘণ্টা ডান্স করে ওরা ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর বসল। উষসী কি ভেবে যেন বলল,” চলুন, আমরা বিয়ে করে ফেলি। তাহলে আর আলাদা হওয়ার ভ*য় থাকবে না।”

সহসা এমন অদ্ভুত কথা শুনে ইয়ামিন হেসে ফেলল। উষসীর গাল টিপে আফসোস নিয়ে বলল,” আমার অবুঝ পরী, বড় হও আগে। তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে?”

তার এমন কথায় ক্ষেপে উঠল উষসী। হঠাৎ তার কলার চেপে ধরে খটমট করে বলল,” বয়স হয়নি মানে? কি বলতে চান? আমি বাচ্চা?”

” আমার কাছে বয়সের তুলনায় তুমি পিচ্চি!”

” তাহলে এই আমার সাথে প্রেম করেছেন কেন? কথায় কথায় কিস করেছেন কেন পিচ্চিকে?আর এখন বিয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই আমি পিচ্চি হয়ে গেলাম?”

তারপর অভিমানে অভিযোগ করে বলল,” আমি কাল চলে যাচ্ছি জেনেও আপনার মায়া হচ্ছে না একটু? পাষণ্ড লোক!”

” কি করতে পারি আমি? তোমাকে আটকে রাখব? একটা উপায় অবশ্য আছে…”

” কি উপায়?” উষসীর চোখ ঝলমল করে ওঠে।

ইয়ামিন মৃদু হেসে বলল,” আমাদের সাথে নরওয়ে চলো।”

” নরওয়ে?”

” হুম৷ কাল আমি আর মা প্যারিস যাচ্ছি। সেখানের কিছু কাজ সেড়ে শ্যুটিং এর জন্য নরওয়ে যেতে হবে। তুমিও আমাদের সাথে যাবে। আর ডোনা আন্টি, তৃষ্ণা ওদের আহমেদ আঙ্কেলের সাথে পাঠিয়ে দাও। তুমি থেকে যাও।”

উষসী মুখ গোঁজ করে বলল,” অসম্ভব। ডোনা আন্টি রাজি হবেন না।”

” মা বললে রাজি হতেও পারে।”

” শুধু আপনার মা কেন? চৌদ্দ গুষ্টি এসে বললেও রাজি হবেন না।”

ইয়ামিন আশ্চর্য হয়ে শুধাল,” কেন?”

উষসী মুখ ফুলিয়ে বলল,” উনি আমাদের রিলেশনের ব্যাপারে জানে।”

” কি?” ইয়ামিন হতচকিত।

উষসী হতাশ গলায় বলল,” প্রিয়ন্তি আপু বলেছিল। তখন আমি অনেক বকা খেয়েছি। বাড়ি গিয়ে এসব তৃষাণ ভাইয়ের কানে না গেলেই হলো। ”

” উনি জেনেও কিছু বলেনি তোমাকে? স্ট্রেইঞ্জ!”

” বলেছে। অতীতের হিস্ট্রি শুনিয়েছে।”

ইয়ামিন বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে বলল,” তবুও তুমি উনার কথা বিশ্বাস না করে আমাকে বিশ্বাস করেছো?”

উষসী মুচকি হেসে বলল,” আপনার প্রতি বিশ্বাস আছে বলেই তো আপনাকে ভালোবাসি আমি। তাছাড়া আজকের পর বিশ্বাসটা আরও দৃঢ় হয়ে গেছে।”

ইয়ামিন হাঁ করে তাকিয়ে আছে। উষসী গাঢ় দৃষ্টিতে বলল,” বুঝেছেন মিস্টার সিংগার?”

ইয়ামিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,”এভাবে তাকিয়ো না। বেশিক্ষণ নিজেকে সামলে রাখতে পারব না কিন্তু৷ আমি আবার অতো মহাপুরুষ নই।”

উষসী খিলখিল করে হেসে উঠল।তারা দীর্ঘরাত পর্যন্ত গল্প করে কাটাল। আগামীকাল তাদের বিচ্ছেদ হবে এই কথা যেন দু’জনেই ভুলে গেছিল। স্বপ্নময় একটা রাত কেটে যায়।

সূর্যের তীর্যক আলোয় চোখ মেলতে পারছে না উষসী। সাদা-কালো আলপ্সের কোল ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে উত্তপ্ত সোনালী আলো। সবুজ ঘাসের সাদা বরফকুচি গলে শিশিরে রূপান্তর হয়েছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে! ইয়ামিন ঘুমাচ্ছে কার্পেটের উপর। আহারে বেচারা… ঠান্ডা লেগে যায় যদি? ঠান্ডা কার্পেটের উপর তার শুয়ে থাকতে কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই!

উষসী পরম যত্নে ইয়ামিনের মাথাটা নিজের কোলে রাখে। তখনি ইয়ামিন চোখ তুলে তাকায়। উষসী অবাক হয়ে বলল,” আপনি ঘুমাননি?”

উষসীর লালচে ফোলা মুখটার দিকে চেয়ে ইয়ামিন জড়ানো গলায় বলল,” আমি খুব লাইট স্লিপার। তুমি উঠে আমার মাথায় হাত রাখতেই ঘুম ভেঙে গেছিল।”

” তাহলে এতোক্ষণ উঠেননি কেন?”

” দেখতে চাইছিলাম তুমি কি করো!”

উষসী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। ইয়ামিন উঠে বসে বিভোর কণ্ঠে বলল,” আমি প্রতিদিন এভাবে জাগতে চাই উষসী। এই সুন্দর হাসি দিয়ে আমার সকাল শুরু হবে।”

উষসী পাগলামি করে রাতের কথাটা আবারও বলল,” চলুন তাহলে বিয়ে করে ফেলি।”

ইয়ামিন হেসে বলল,” তুমি যে এতো পাগল সেটা তোমাকে দেখলে বোঝা যায় না।”

উষসী মুখ গোমরা করে ফেলল। ইয়ামিন মোবাইলের ঘড়ি দেখে বলল,” তোমাদের ফ্লাইট কখন?”

” নয়টার দিকে হয়তো।”

ইয়ামিন চমকে উঠে বলল,” অলরেডি আটটা বাজে। নিশ্চয়ই সবাই জেগে গেছে। আমাদের খুঁজছে। বাড়ি চলো উষসী, দ্রুত।”

উষসীর মন কেমন বিষাদে ছেয়ে গেল। এখন তাদের বিদায় বেলা। ভাবতেই বুকের ভেতর হু হু করতে লাগল। চোখের পাতায় শিশিরকণার মতো জমে উঠল অশ্রু। আবার কবে দেখা হবে, কে জানে?

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (২২)
লিখা- Sidratul Muntaz

শিমলা লিভিংরুমে অগোছালো অবস্থায় পায়চারী করছেন। মাত্র ঘুম ভেঙেছে তাঁর। সকালটা শুরুই হয়েছে একটা দুঃসংবাদ দিয়ে। ঘুম থেকে উঠে এহেন খারাপ খবর শুনে তিনি এলোমেলো হয়ে পড়েছেন। মেয়েটার জন্য তাঁর মায়া হচ্ছে। আহারে মেয়েটা! তার তো কোনো দোষ ছিল না।

শিমলার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে৷ তিনি ইয়ামিনকে জোর করে সেদিন রেস্টুরেন্টে না পাঠালে এসব কিছুই হতো না৷ না, এবার আর দেরি করে যাবে না। দেশে ফিরেই সবার আগে ইয়ামিনের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

এসব যখন তিনি ভাবছেন তখনি হন্তদন্ত ভেতরে ঢুকে ইয়ামিন আর উষসী। তারা একে-অপরের হাত ধরেছিল। শিমলাকে লিভিংরুমে দেখে ভ*য়ে হাত ছেড়ে দেয় উষসী। তার বুক ঢিপঢিপ করছে।

শিমলা নিজের দুশ্চিন্তায় মত্ত। তিনি যেন কিছুই খেয়াল করলেন না। উষসীকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে ইয়ামিনের কাছে এসে অস্থির চিত্তে বললেন,” বাবা, একটা তো ব্লেন্ডার হয়ে গেছে। ইটস ডিজাস্টার!”

ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,” কি হয়েছে মা?”

শিমলা বিচলিত, দ্বিধাজড়িত দৃষ্টিতে চাইলেন উষসীর দিকে। উষসী নির্মল হেসে বলল,” আমি উপরে যাচ্ছি। ডোনা আন্টি কি উঠেছে আন্টি?”

” জানি না… গিয়ে দেখো।” হেলার স্বরে শিমলা জবাবটা দেন। তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নেন জিহ্বা দিয়ে।

উষসী বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে। মা ছেলের মধ্যে দাঁড়ানো ঠিক নয়। সে উপরে চলে যেতে থাকে। কেউ এখনও ওঠেনি মনে হয়। সিঁড়ির গোঁড়ায় পা রাখতেই উষসী শুনল শিমলার উত্তেজিত গলা,” ফাবিয়াহ সু*ইসাইড এটেম্পট করতে নিয়েছিল বাবা।”

উষসী ঘুরে তাকায়। ইয়ামিন আশ্চর্য গলায় বলল,” কে ফাবিয়াহ?”

শিমলা রাগান্বিত গলায় বললেন,” ফাবিয়াহর কথা মনে নেই? তোর ফিয়্যান্সে। যার সাথে তোর এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা। ফায়া!”

এইটুকু শুনেই উষসী তার মনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা টের পায়। কাটার মতো অস্বস্তিবোধ যেন জেঁকে ধরে পুরো শরীরটা। সে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দ্রুত উপরে চলে যায়।

ইয়ামিন অসন্তুষ্ট মুখে বলল,” সু*ইসাইড কেন করতে গিয়েছিল ও? কি হয়েছে?”

শিমলা একহাতে নিজের মুখে মালিশ করে বললেন,” তোরা যে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে গিয়েছিলি সেখানে হয়তো কোনো সাংবাদিক ছিল৷ গোপনে ছবি তুলে রেখেছিল তোদের। ছবিতে তোর মুখে মাস্ক থাকলেও ফাবিয়াহর মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। আর ব্যাপারটা খুবই বাজেভাবে ভাইরাল হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এসব নিয়ে আজে-বাজে নিউজ হচ্ছে। ”

” হোয়াট!” ইয়ামিনের যেন ব্যাপারটা বিশ্বাস হলো না। সে এতো সাবধানে চলা-ফেরা করে। তার একটা পারসোনাল মিটিং কিভাবে এমন ভাইরাল হয়? তাছাড়া সেদিন তো রেস্টুরেন্টে সে নিজের গাড়িতে করেও যায়নি। উষসীর গাড়িতে গিয়েছিল। সুতরাং খারাপ কিছু হওয়ার সুযোগই নেই। তাহলে কিভাবে?

শিমলা আক্ষেপ নিয়ে বললেন,” ফায়া খুবই কনজার্ভেটিভ মাইন্ডের মেয়ে। সে জীবনে একটা প্রেম পর্যন্ত করেনি। সারাজীবন লেখা-পড়া নিয়ে থেকেছে। কঠিন পরিশ্রম করে ডাক্তারি পাশ করেছে। সেই মেয়েকে নিয়ে এখন মানুষ নেগেটিভ আলোচনা করছে। এসব সহ্য করতে না পেরে ও ঘুমের ঔষধ খেয়েছিল।”

ইয়ামিনের খুবই বিরক্ত লাগছে। ধীরপায়ে সোফার হাতলের উপর বসল সে। নিজের জন্য নয় বরং তার জন্য একটা মেয়ের এতো সর্বনাশ হয়ে গেল এই কথা ভেবেই খারাপটা লাগছে। এমন বেহুদা একটা অকাজ কোন স্টুপিড করল? আচ্ছা, এমন কিছু যদি উষসীর সাথেও হয়? ব্যাপারটা চিন্তা করেই একটু শিউরে উঠল ইয়ামিন।ভাগ্যিস এটা বাংলাদেশ নয়। নাহলে দেখা যেতো তাদের হাত ধরে হাঁটার ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে।

শিমলা ইয়ামিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” বাবা, আমাদের দ্রুত কিছু করা উচিৎ। এখানে আসার আগে তোর আর ফায়ার এংগেজমেন্ট সেরে আসা উচিৎ ছিল। তাহলে মানুষ এসব নিয়ে এতো গুজব রটাতে পারতো না।”

ইয়ামিন বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। প্রায় হতভম্ব গলায় বলল,” এসবের সাথে এংগেজমেন্টের সম্পর্ক কি?”

” আশ্চর্য, এংগেজমেন্ট হলে কি মানুষ এতো গুজব ছড়াতে পারতো? ফিয়্যান্সের সাথে তুই পারসোনালি মিট করতেই পারিস। এটা নিয়ে এতো ক্রিটিসিজম হতো না। সবাই কিন্তু এখন বিষয়টা খুব বাঁকাভাবে দেখছে। আর বেটা সাংবাদিকও কম ফাজিল না। সুযোগ পেয়ে রঙ-চঙ মেখে এমনভাবে খবর উপস্থাপন করেছে সে সবাই হামলে পড়েছে। বাবা, ব্যাপারটা তোর ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি হতে পারে।”

ইয়ামিন ত্যক্ত হয়ে নিজের গাল থেকে মায়ের হাত সরিয়ে বলল,” সামান্য একটা ব্যাপার মা। তুমি এতো টেন্সড হচ্ছো কেন এটা নিয়ে?”

” তোর কাছে এটা সামান্য হতে পারে। কিন্তু ফাবিয়ার কাছে সামান্য না। ওর চরিত্রে কিন্তু একটা কলঙ্ক লেগে গেল।”

ইয়ামিন তার চোখমুখ কঠিন বানিয়ে জিজ্ঞেস করল,” এখন আমাকে কি করতে হবে সেই কলঙ্ক মোছার জন্য? ওকে বিয়ে করতে হবে নাকি?”

শিমলা নরম সুরে বললেন,” বিয়েটা তো আগে থেকেই ঠিক ছিল। তুই না নিজের মুখে বলেছিলি আমি যাকে চুজ করব তাকেই বিয়ে করবি?”

প্রশ্নটা করেই মিষ্টি করে হাসলেন শিমলা। ইয়ামিন নিরাসক্ত গলায় বলল,” নট এট অল। তখন আমার পছন্দের কেউ ছিল না তাই বলেছিলাম। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না মা।”

শিমলার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দপ করে নিভে যায় এমন কথা শুনে। তিনি আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে শুধালেন,” এর মানে কি? এখন কি তোর পছন্দের কেউ আছে?”

ইয়ামিন চুপ করে থাকে। শিমলা অবাক হয়ে বললেন,” মেয়েটা কি উষসী?”

ইয়ামিন গভীর শ্বাস নিয়ে জানালার দিকে চাইল। তার নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ তা বুঝতে আর বাকি রইল না শিমলার। তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বললেন,” ইয়া মা’বুদ! এটাই মনে হয় বাকি ছিল। দুনিয়াতে কি আর কোনো মেয়ে নেই না বাবা? শেষমেষ উষু? আরে ও তো একটা বাচ্চা মেয়ে!”

ইয়ামিন বলল,” তাতে কি হয়েছে মা? বাবার সাথে যখন তোমার বিয়ে হয় তখন তুমি উষুর চেয়েও ছোট ছিলে। আর বাবা আমার চেয়েও বড় ছিল। তোমাদের সংসার হয়নি? তোমরা কি হ্যাপি না?”

শিমলা হাহাকার করে বললেন,” সেই যুগ আর এই যুগ এক হলো! আর তোর কি মনে হয় উষুকে ওর ফ্যামিলি এতো দ্রুত বিয়ে দিবে?”

ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে বলল,” বিয়ে না দিলে অপেক্ষা করব। ইটস নট আ বিগ ডিল। আমি তো এখনি বিয়ে করার জন্য ম’রে যাচ্ছি না।”

শিমলা রুক্ষ গলায় বললেন,” ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে তোর বিয়ের বয়স ফুঁড়িয়ে যাবে।”

” ফুঁড়িয়ে যাক!” ইয়ামিন দায়সারা।

ছেলের এমন সিরিয়াসনেস দেখে শিমলা থমকালেন। ভ*য়ের একটা স্রোত প্রবাহিত হলো তার শিরদাঁড়ায়। তিনি থমথমে কণ্ঠে বললেন,” আর ফাবিয়াহর কি হবে?”

” আমি দেশে ফিরে এই বিষয়টা সলভ করব মা। আমাকে একটু সময় দাও। আর এটা একটা বাজে ইন্সিডেন্ট। এই জন্য বাধ্য হয়ে ওকে বিয়ে করার কিছু নেই। যেহেতু আমি এখন অন্যকাউকে ভালোবাসি। তাই প্রশ্নই আসে না।”

ইয়ামিন এই কথা বলে চলে যাচ্ছিল। শিমলা পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন,” এই অন্যকাউকে নিয়েই আমার প্রবলেম। মেয়েটা উষু না হয়ে অন্যকেউ হলে আমার কোনো প্রবলেম ছিল না!”

ইয়ামিন মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে চলেই গেল।

প্রিয়ন্তি আর ফারদিন সকাল নয়টার মধ্যেই এয়ারপোর্টে হাজির হয়েছে। একটু পরেই সবাই ইমিগ্রেশনের জন্য ঢুকবে। এর আগে বিদায় পর্ব হচ্ছে। ডোনা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। ফারদিনকে বললেন,” তোমার ভরসায় মেয়েটাকে রেখে যাচ্ছি বাবা। ছোট থেকে কষ্টে বড় হয়েছে মেয়েটা। ওকে আগলে রেখো প্লিজ।”

ফারদিন বিনয়ের সাথে বলল,” চিন্তা করবেন না মা। আপনাকে তো বললাম আর কিছুদিন আমাদের সাথে থাকুন। আপনি চলে যাচ্ছেন বলে প্রিয়র তো খুব মনখারাপ।”

” সে আর সম্ভব না বাবা। তোমরা বরং দ্রুত বাংলাদেশে এসো।”

” নিশ্চয়ই আসব। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”

উষসী একপাশে ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার দেহ এখানে থাকলেও মন এখানে নেই। শিমলা এয়ারপোর্টে আসেননি। উষুরা যখন বের হচ্ছে তখন ইয়ামিনের ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। ইচ্ছে করেই তাকে বিদায় জানাতে যায়নি উষসী। এখন খুব আফসোস হচ্ছে… শেষবার একটু দেখা হলো না! কেমন পিপাসার মতো লাগছে। যে পিপাসা পানি খেলে মিটবে না।

তার কান্না পাচ্ছিল খুব। ইয়ামিনকে সে নিজের কান্না দেখাতে চায় না। তাই সে না আসায় ভালোই হয়েছে। কিন্তু এখন যে হাঁফফাস লাগছে! প্রিয়ন্তি হঠাৎ উষসীর পাশে এসে দাঁড়ালো। মিনমিন করে বলল,” আসার আগে ইয়ামিনকে বলে আসিসনি তুই?”

চমকে উঠল উষসী। অপ্রতিভ হয়ে বলল,” না, উনি কি তোমাকে ফোন করেছিল?”

প্রিয়ন্তি আশেপাশে চেয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলল,” হুম। খুব রেগে আছে!”

ভ’য়ে একটু ঢোক গিলল উষসী। ইতস্তত করে বলল,” আচ্ছা, আমি ফোন করছি…”

” দরকার নেই। এদিকে আয়।”

প্রিয়ন্তি হাত ধরে উষসীকে টেনে গাড়ির সামনে নিয়ে এলো। তারপর বলল,” উঠে পড়।”

উষসী চোখ বড় করে বলল,” কি বলছো প্রিয় আপু? আমরা কি এখন আবার বাসায় যাব? সময় তো নেই হাতে।”

প্রিয়ন্তি চড় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে বলল,” একটা দিবো তোকে। কিচ্ছু বুঝিস না তাই না? গাড়িটা কার? ভালো করে তাকা সামনে।”

উষসী দেখল এটা ইয়ামিনের গাড়ি। শিউরে উঠল সে। এর মানে কি… বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেল না। এর আগেই পেছনের দরজা খুলে ইয়ামিন মাথা বের করল।তারপর হাত ধরে টেনে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। দরজা আটকে দিল অনায়াসে।

প্রিয়ন্তি কিছুই হয়নি এমন ভাব করে পাহারাদারের মতো বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। ডোনা হঠাৎ দূর থেকে জিজ্ঞেস করলেন,” প্রিয়, উষু কোথায়? তোর সাথেই না ছিল?”

প্রিয়ন্তি বলল,” ওয়াশরুমে গেছে মা। একটু পরেই চলে আসবে।”

” আচ্ছা।”

উষসী মাথা নিচু করে বসে আছে। আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই ইয়ামিন তার মুখ উপরে তুলে ঠোঁটে দীর্ঘ চুমু বসিয়ে দিল। প্রথমে বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে উঠল উষসী। তারপর ধীরে ধীরে সামলে নিল নিজেকে। আলতো হাতে চেপে ধরল ইয়ামিনের ওভারকোট। সময়ের সাথে গভীর হলো স্পর্শ। উষসীর চোখ থেকে ঝরে পড়ছে তৃপ্তির অশ্রু। সে পৃথিবী ভুলে যেতে রাজি, তবুও বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারবে না।

ইয়ামিন বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে ছাড়ল। মৃদু হেসে বলল,” আমাকে না জানিয়ে চলে আসার শাস্তি এটা।”

ততক্ষণে উষসীর পুরো মুখ অশ্রুতে ভিজে গেছে। ইয়ামিন পরম আদরে তার চোখ মুছে দিল। উষসী অপরাধী গলায় বলল,” আই এম স্যরি। আপনাকে না জানিয়ে আসতে চাইনি। কিন্তু আমার খুব কান্না পাচ্ছিল।”

ইয়ামিন জড়ানো গলায় বলল,” আমার মিষ্টি সুহাসিনী, বিশ্বাস করো এই বিচ্ছেদটা খুব সাময়িক। আমাদের আবার দেখা হবে। আমি খুব দ্রুতই বাংলাদেশে আসব। তারপর তোমাকে বিয়ে করে একদম আমার কাছে নিয়ে আসব। কথা দিলাম। আই প্রমিস ইউ।”

এই কথা বলেই উষসীর হাত ধরে সেই হাতে চুমু দিল ইয়ামিন। উষসী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সত্যিই কি এতো সহজ সবকিছু? তাদের সম্পর্কের সমীকরণ যে খুব জটিল! সামনে বড় কোনো ঝড় উঠবে তার আভাস টের পাচ্ছে উষসী। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই কথা তুলে মন আরও খারাপ করতে চাইল না। ইয়ামিনের বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে বলল,” আমি আপনাকে খুব মিস করব। এই পুরো সময়টাকে খুব মিস করব। স্বপ্নের মতো কেটেছে দিনগুলো। আর আজকের দিনটাকে মনে হচ্ছে সুন্দর কোনো স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার পর নিষ্ঠুর বাস্তবতা!”

ইয়ামিন তার পকেট থেকে কিছু বের করল। তারপর সটান উষসীর আঙুলে পরিয়ে দিল জিনিসটা। অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকাল উষসী। তার হাতে ভীষণ সুন্দর সবুজ পাথরের একটা রিং। ইয়ামিন বলল,” এটা প্যারিস থেকে এনেছিলাম তোমার জন্য। এখন থেকে তুমি এংগেজড। শুধু আমার। কেউ চাইলেও নিয়ে যেতে পারবে না।”

উষসী কোনো কথা বলল না। শুধু হাসল। ইয়ামিনের আত্মবিশ্বাস দেখে তার ভালো লাগছে। স্বপ্ন দেখতে মন চাইছে। যে স্বপ্ন পূরণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। তবুও মন সেদিকেই ছুটছে!

হঠাৎ কিছুক্ষণ আগের ব্যাপারটা মনে পড়ে উষসীর। শিমলা ইয়ামিনের বিয়ের কথা বলছিলেন ফাবিয়াহ নামের কোন মেয়ের সাথে! সে করবে না ভেবেও অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল,” আচ্ছা, তখন আন্টি আপনাকে কি বলছিলেন? মানে খুব টেন্সড মনে হচ্ছিল আন্টিকে।”

ইয়ামিন অবজ্ঞার স্বরে বলল,” তেমন কিছু না। সব ঠিকাছে। তোমার এসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। সাবধানে প্লেনে ওঠো। পৌঁছে অবশ্যই ফোন কোর। আর টেইক কেয়ার।”

ইয়ামিন জড়িয়ে ধরল উষসীকে। তারা গভীর আলিঙ্গনে লিপ্ত হলো। উষসীর কপালটা অজস্র চু’মুতে ভরিয়ে দিল ইয়ামিন। তখনি বাইরে থেকে দরজায় টোকা দিল প্রিয়ন্তি ” এহেম, এহেম, দেরি হচ্ছে কিন্তু। উষু দ্রুত বের হ।”

উষসী ইয়ামিনের দিকে চেয়ে কোমল কণ্ঠে বলল,” যাই?”

ইয়ামিন মৃদু হাসল। বিষাদমাখা গলায় বলল,” ঠিকাছে যাও।”

” তাহলে ছাড়ুন!”

ইয়ামিন মন ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,” যেও না।”

উষসী হেসে ফেলল,” পিচ্চি তো আমি৷ তাহলে ছেলেমানুষি আপনি কেন করছেন?”

” আমাকে ছেড়ে তো তুমি যাচ্ছো। তাই এতোটুকু ছেলেমানুষি করার অধিকার আমার আছে।”

” আর আপনি বুঝি কখনও আমাকে ছেড়ে যাবেন না?”

” কক্ষনও না।” ইয়ামিনের কণ্ঠ দৃঢ়।

উষসী লাজুক হেসে বলল,” ঠিকাছে। মনে থাকে যেন।”

প্রিয়ন্তি আবার টোকা দিল। এবার খুব জোরে। উষসী বাধ্য হয়ে বেরিয়ে এলো।

বিমানে ওঠার পর মন গুমোট অন্ধকারে ঢেকে যেতে লাগল তার। বিমান যত উপরে উঠছে ততই তাদের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। অজানা শঙ্কায় বুক দুরু দুরু করছে। এই দূরত্ব ঘুচবে তো একদিন? উষসী জানালার কাছেই বসেছিল। মাঝখানে তৃষ্ণা। তার পাশে ডোনা। সাদা মেঘের দল আর প্রকৃতির অপরূপ মাধুর্য্য তার মনখারাপ একটুও কমাতে পারল না। সে পুরোটা সময় হাতের আংটিটার দিকে তাকিয়ে ছিল। সবুজ পাথরের মধ্যে যেন ইয়ামিনকেই দেখতে পাচ্ছিল উষসী।

চলবে