#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (০৩)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে লজ্জাবতীলতার ন্যায় নু্য়ে পড়ে পিয়া। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে। যেন তানভীর তার সন্ধান না পায়। প্রগাঢ় ত্রপায় গা শিরশির করে কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে তার। কিঞ্চিৎ দূরে সরে জড়োসড়ো হয়ে বসে সে। হুট করে সারাজীবনের জন্য জীবনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া মানুষ সংস্পর্শে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে তার। ঢিপঢিপ করে দ্রুত গতিতে লাফিয়ে চলেছে বুকের বা পাশে থাকা হৃদযন্ত্রটা। কোনো এক অজানা অনুভূতি উঁকি দিয়েছে মনে কোণে। কি আশ্চর্য! কালকের আগেও সে এই মানুষটাকে চিনতো না। আর আজ! আজকের পর থেকে তার উপর যদি কারো বেশি অধিকার থেকে থাকে তাহলে এই মানুষটারই সবচেয়ে বেশি। ভীতি, সঙ্কা, লজ্জা, জড়তা এবং মনে উঁকি দেওয়া সম্পূর্ণ অজানা অনুভূতি। আবেশে চোখ বুঁজে নিল সে। অদ্ভুত সেই মিশ্র অনুভূতি অনুভব করতে লাগল। দৈবাৎ তার হাতে চাপ পড়তেই সম্বিৎ ফিরে তার। আড়চোখে চাইল হাতের দিকে। তানভীর এখনো আগের মতো তার হাতটা ধরে রেখেছে। আঙুলের ভাঁজে গলিয়ে দিয়েছে আঙুল।
‘ম্যাম আপনি কি রাজি? আমি কি দিবো? আপনি রাজি থাকলে আমার দিতে অসুবিধা নেই। আমি এক পায়ে খাঁড়া।’
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে পিয়ার। একের পর এক লাগামহীন কথা আর সে নিতে পারছে না। তানভীরের হাতের ভাঁজ থেকে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই সুঠাম দেহি বলবান মানুষটার সাথে কি সে পেরে উঠে? তানভীর হাতটা আরো শক্ত করে ধরে।
‘কেন বৃথা চেষ্টা করছেন মিসেস তানভীর এহতেশাম? হাতটা এতো সহজে ছেড়ে দিবো বলে তো ধরিনি। বরং এই হাতটা শক্ত করে ধরে হাতের মালিকের সাথে সারাজীবন কাটাবো বলেই ধরেছি। এতো সহজে তো ছাড়ছি না।’
তানভীরের কথা শুনে ভালো লাগায় ছেয়ে যায় পিয়ার অন্তঃস্থল। সবকিছু ছাপিয়ে তারও নিজের একজন হয়েছে। নিজের ভালো লাগা চেপে রাখে অন্তরে। মুখে প্রকাশ করল না। মৃদুস্বরে বলে,
‘ছাড়ুন না হাতটা। মানুষ দেখছে।’ কন্ঠে অনুনয় তার।
পুরো রেস্টুরেন্টে চোখ বুলায় তানভীর। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। কেউ পরিবার নিয়ে এসেছে। কেউ প্রেমিকা নিয়ে। কেউ কেউ আবার বন্ধু বান্ধবী নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তানভীর শব্দহীন হেসে জবাব দেয়,
‘দেখুক মানুষ। তাতে আমার কি? আমি কি অন্যের বউয়ের হাত ধরেছি নাকি?’
পিয়া অসহায় চোখে চাইতে দুষ্টু হাসে তানভীর।
‘বাচ্চাদের মতো এমন পাগলামি কেন করছেন?’
পিয়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল তানভীর। মৃদু, মোহনীয় স্বরে বলল,
‘কারন সমস্ত পাগলামি যে জমিয়ে রেখেছিলাম বউকে দেখাবো বলে। বউকে বিরক্ত করবো বলে। ফাইনালি বউকে জ্বালানোর দিন এসেছে। সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইছি না মিসেস তানভীর এহতেশাম।’
নিষ্পলক ক্লান্তহীন চোখে তানভীরের দিকে চেয়ে রয় পিয়া। হুট করেই তার লজ্জা আর জড়তা কাটতে শুরু করেছে। পাশে থাকা সুদর্শন পুরুষটির দিকে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে তার। মন বলছে, চেয়ে থাক। মানুষ টা তো তোরই। নির্লজ্জ, বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকার অধিকার একমাত্র তোরই আছে।
কাজল টানা দুচোখের অক্ষিকোটরে যখন গভীর অনুভূতি উপচে পড়ার উপক্রম ঠিক তখনই চোখ টিপে তানভীর। রগড় গলায় কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘মিসেস কি তার মিস্টারের প্রেমে পড়ে গেল? কাজল টানা দুচোখের চাহনি যে এটাই বলছে।’
বিলম্ব করে না পিয়া। তড়িঘড়ি করে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মাথা উঁচু করতে পারছে না সে।
‘লজ্জা পাচ্ছেন কেন মিস? স্যরি মিসেস। আমার প্রেমে পড়ার অধিকার কেবল আল্লাহ আপনাকেই দিয়েছে। আর কাউকে না। এই অধিকার হাতছাড়া করবেন না। না হলে পরে শেষ বয়সে কিন্তু আফসোস করতে হবে।’
ফাঁকা ঢোক গিলে পিয়া। যতটুকু সাহস সঞ্চার করে তানভীরের দিকে সে তাকিয়ে ছিল। সেই সাহস আবারও শূন্যে মিলিয়ে গেছে। পিপাসায় কাঠ হয়ে আসছে গলা। সাথে অনুভব করছে অম্লজানের সংকট। নিঃশ্বাস আটকে আসছে তার।
তানভীরের মোবাইল বেজে উঠতেই সে পিয়ার হাত ছাড়ে। পুরুষালি হাতের বাঁধন থেকে নিজের হাত মুক্ত হতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। এতগুলো মানুষের সামনে হাত ধরায় ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল তার।
পিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তানভীর। ক্ষণকাল চুপ থেকে স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কিছু নেই। হাত ছেড়েছি। কল টা পিক করে নেই। এরপর সোজা জড়িয়ে ধরবো। বুকটা কেমন নিশপিশ করছে বউয়ের স্পর্শ পাওয়ার জন্য। জাস্ট ওয়েট।’
কথাটা কর্ণগোচর হতে দেরি হলো কিন্তু পিয়ার জমে যেতে দেরি হলো না। আড়চোখে তানভীরের দিকে তাকাতেই সে পুনরায় চোখ মা’র’ল।
পিয়ার থেকে মনোযোগ সরায় তানভীর। পকেট থেকে মোবাইল বের করার আগেই রিং হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ওয়ান মিসডকল এর জায়গায় ক্লিক করার আগেই পুনরায় বেজে উঠল মোবাইল। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা নামের দিকে তাকিয়ে মুখের ভাবভঙ্গি পাল্টে গেল তানভীরের। অত্যধিক রাগে যেন চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে তার। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ফেলল সে। চোখ বুঁজে বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করল কল সে রিসিভ করবে না। পরক্ষণেই মনে পড়ল যতক্ষণ না সে কল রিসিভ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বেহায়া মেয়েটা কলের উপর কল দিয়েই যাবে। নতমস্তকে বসে থাকা পিয়ার দিকে এক পলক চাইল সে। এই মেয়েটার জন্য হলেও তাকে শান্ত থাকতে হবে। মেয়েটাকে নিজের রাগটা সে আপাতত দেখাতে চাইছে না। ধীরে ধীরে যখন অভ্যস্থ হয়ে যাবে তখন এই মেয়েটাই হবে তার রাগ প্রশমনের কারণ। জ্বলন্ত শিখার ন্যায় উত্তপ্ত রাগকে বরফ গলা শীতল পানির মতো ঠান্ডা করে ফেলবে উষ্ণ আলিঙ্গনে।
তানভীর কল রিসিভ করে কানে ঠেকায়। নিরব থাকে। কোনো প্রকার শব্দ করে না। কয়েক সেকেন্ড পরে ওপাশ থেকে ভেসে আসে কান্নার ফ্যাচফ্যাচ শব্দ। ক্রমান্বয়ে তা বাড়তেই থাকে। বিরক্ত হয় সে। চেপে রাখা রাগের পারদ তরতর করে বাড়তে থাকে। দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ স্বরে বলল,
‘এভাবে নাটক করার জন্য কল করেছো আমাকে? তাহলে স্যরি টু সে তোমার এই বস্তা পঁচা নাটক আর ন্যাকা কান্না শুনার সময় আমার নেই।’
মুহূর্তে তানভীরের নম্র স্বরের পরিবর্তে এমন রূঢ় স্বর শুনে আঁতকে উঠল পিয়া। ভয়ার্ত চোখে তানভীরের দিকে চমকে উঠে সে। তানভীরের অগ্নি স্ফূরিত চোখ দেখে শুকনো ঢোক গিলে পিয়া। ভয়ে গুটিয়ে নিল নিজেকে। চোখে মুখে ফুটে ওঠছে আতঙ্ক।
সহসা তানভীরের নজর পিয়ার দিকে যেতেই নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালাল। গলার স্বর স্বাভাবিক করে ফের বলল,
‘কি বলার জন্য কল করেছো সেটা বলো। তোমার মতো এত আজাইরা সময় আমার নেই।’
পিয়া দেয়াল ঘেঁষে বসে। মোবাইলের ওপাশ থেকে কি বলল শুনতে না পেলেও ফের কর্ণগোচর তানভীরের বলা কথা,
‘হ্যা করেছি আমি বিয়ে। মেয়ে পছন্দ হয়েছে ব্যস বিয়ে করে নিয়েছি।’
কথাটুকু বলে বেশ কিছুক্ষন চুপ থাকে তানভীর। কয়েক মুহুর্ত কে’টে যাওয়ার পর আবারও বলল,
‘দেখ পাগলামি করো না। তোমাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি তোমার জন্য আমি কিছু ফিল করি না। আর না তোমাকে আমার ভালো লাগে। তাহলে তোমার সাথে আমার জীবন জড়াবো কোন যুক্তিতে? যাকে আমার ভালো লেগেছে। যার জন্য আমি টান অনুভব করেছি তাকেই জড়িয়ে নিয়েছি জীবনের সাথে।’
পিয়া ক্ষণকাল থম মে’রে থাকে। শেষের কথাগুলো শুনে বুঝতে পারল কোনো মেয়ের ফোনকল এটা। যে তার স্বামীকে পছন্দ করে। হুট করেই তার বুকের ভেতরটা তীক্ষ্ণ ভাবে জ্বলতে থাকে । হারিয়ে ফেলার ক্ষীণ ভয় বাসা বাঁধে মনে। হয় প্রগাঢ় অভিমান। কিন্তু কেন? এখানে অভিমানের কিছুই নেই। আর না সে তো মানুষটাকে ভালো করে চিনে। আর না ছিল তাদের মাঝে বহুদিনের পরিচয়। তবে কি এটাই পবিত্র সম্পর্কের টান? তিন কবুলের শক্তি? হয়তো বা। চাপা অভিমানে তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
সহসাই কানে ঠেকল সুমধুর কন্ঠে মৃদু আজানের ধ্বনি। ধ্যান ভঙ্গ হয় পিয়ার। স্থান ত্যাগ করার ছুতো পেতেই বিলম্ব করল না। হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াল।
পিয়া উঠে দাঁড়াতেই ভ্রু কুঁচকে তাকায় তানভীর। মোবাইল পকেটে রেখে জানতে চায়,
‘দাঁড়িয়েছো কেন? কোনো সমস্যা?’
পিয়া থমথমে গলায় জবাব দেয়,
‘বাসায় যাবো আমি।’
ফের বদলে যায় তানভীরের মুখের আদল। রক্তলাল চোখে পিয়ার দিকে তাকাতেই,,,,,
#চলবে