উষ্ণ আঁচে ভালোবাসা পর্ব-০৪

0
3

#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (০৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

রক্তলাল চোখে পিয়ার দিকে তাকাতেই ভড়কে গেল তানভীর। হঠাৎই পিয়ার চোখজোড়ায় ঈষৎ ক্ষোভ দেখে গুটিয়ে নিলো নিজেকে। ওই স্নিগ্ধ অক্ষিযুগলে কখনো অভিমান লুকানোর প্রচেষ্টা আবার কখনো রাগ। এই লুকোচুরি খেলা দেখে মনে মনে হাসল সে।

তানভীরের আগুন লাল চোখ দেখে খানিক ভয় পেলেও বুঝতে দিলো না তাকে পিয়া। নিজের জায়গা থেকে নড়ল না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অদৃশ্য এক সাহস সঞ্চার হয়েছে তার অন্তঃস্থলে। তাকে যেন তার জায়গা থেকে নড়ানো দুঃসাধ্য।

‘আমি যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি তোমাকে?’ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে তানভীর।

পিয়া নিশ্চুপ। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। নীরব অভিমান গলা চেপে ধরেছে তার।

‘উত্তর দিচ্ছো না যে। আমি কি যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি?’ ফের তানভীরের প্রশ্ন কর্ণগোচর হয় পিয়ার। কিন্তু পিয়া এবারেও নিশ্চুপ।

‘তুমি জানো না বিয়ের পর যে স্বামীর অনুমতি নিয়ে চলতে হয় ইচ এন্ড এভরি সেকেন্ড?’

কথাটা শোনার সাথে সাথে পিয়া প্রখর দৃষ্টিতে তাকায় তানভীরের দিকে। চোখের চাহনি দিয়েই যেন ভস্ম করে দিবে।

তীক্ষ্ণ চোখে কয়েক সেকেন্ড পিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে তানভীর।

‘বাব্বাহ্! একটু আগেই তো লজ্জা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল। হঠাৎ কি হলো ম্যাম? আচমকা এমন রণমুর্তি ধারন করলেন। আমি কিন্তু ভীষণ ভয় পাচ্ছি। এই যে আমার বুকের বাঁ পাশটায় হাতে রেখে দেখেন ভয়ে কেমন ধড়ফড় ধড়ফড় করছে।’

কথাগুলো বলেই পিয়ার লালাভ মুখের দিকে নিমেষহীন তাকিয়ে থাকে সে। নিষ্পলক চোখজোড়ায় দুষ্টুমির রেখা। সহসাই তানভীরের মনে পড়ে কিছুক্ষণ আগের ফোনকলের কথা। ফোনে কথা বলার পরই পিয়া এমন অদ্ভুত আচরণ করছে। মনে মনে বুদ্ধি আঁটে পিয়া কে জ্বালানোর জন্য। রগড় গলায় বলল,

‘জেলাসির আগুনে জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছেন বুঝি? ইশ! আমার যে কি লাগছে না। অন্তর পুড়া গন্ধ নাকে আসতেই কলিজা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আমার। ম্যাম কি একদিনেই আমার প্রেমে পড়ে গেলেন?’

ধরা পড়তে চায় না পিয়া। একদিনের ব্যবধানেই যে কারো অস্তিত্ব, উপস্থিতি, প্রেমবাক্য হৃদয়ে খুব সূক্ষ্ণভাবে দাগ কেটে যায় নিজের সাথে না ঘটলে কখনো বুঝতেই পারতো না। মানুষটার পাশে বসার পর থেকে ক্ষণে ক্ষণে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীর আর মনে। চাপা এক অধিকারবোধ ঝাপটে ধরেছে তাকে। তড়িঘড়ি করে বলল,

‘কি,,,কিসের জেলাসি? সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমার ফিরতে হবে। যে বাসায় সাবলেট থাকি সে বাসার আন্টি না হয় অনেক প্রশ্ন করবেন। আর বিয়ের ব্যাপারে এখনো কেউ জানে না।’

‘আচ্ছা তাই?’

পিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দেয়,

‘হুম তাই।’

____________________

ড্রয়িংরুমের তিন আসনের সোফার ঠিক মাঝখানে বসে আছেন জামাল এহতেশাম। রক্তিম চোখ, কপালে ফুলে ওঠা শিরা, দাঁতে দাঁত চেপে রাখা মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ রাগান্বিত তিনি। রাগের প্রকোপে নিঃশ্বাস ফেলছেন অতি দ্রুত। উনার রাগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছেন সামনে বসে থাকা ভাবলেশহীন উনার স্ত্রী। জামাল এহতেশামকে কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে একটার পর একটা টিভির চ্যানেল বদলে চলেছেন ভদ্র মহিলা।

‘কার পারমিশন নিয়ে ছেলের বিয়ে দিলে তুমি মিনা?’

মনমতো একটা চ্যানেল সামনে আসতেই পা গুটিয়ে আরাম করে বসেন তাহমিনা হক। প্রশ্নটা শুনেও না শোনার ভান করলেন তিনি।

জবাবের আশায় কিছুক্ষণ তাহমিনা হকের দিকে তাকিয়ে রইলেন জামাল এহতেশাম। আশানুরূপ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পুনরায় বললেন,

‘আমার চট্টগ্রাম যাওয়ার ফয়দাটাই লুটে নিলে তোমরা তিনজন। বাবা হিসেবে কি ছেলের বিয়েতে থাকার আমার কোনো অধিকার ছিল না? নাকি আমাকে জানানো প্রয়োজনই মনে করোনি তোমরা? তোমাদের কাছে আমি এতোটাই ফেলনা?’

শেষের কথাগুলো বেশ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন তিনি। বলা চলে স্ত্রীকে মানসিক ভাবে দমন করার জন্য এক প্রকার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলেন।

এতেও কাজ হলো না। তাহমিনা হক নিজের মতো করে টিভি দেখেই চলেছেন। কথাগুলো কান অব্দি পৌঁছালেও হৃদয় অব্দি পৌঁছাতে পারল না।

এক মিনিট দুই মিনিট করে দশ মিনিট অতিক্রম করল ঘড়ির কাঁটা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো বেড়ে গেল জামাল এহতেশামের রাগ। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রন করতে পারলেন না। গলার টাই ঢিলে করে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।

‘ক্যান ইউ হিয়ার মি তাহমিনা? আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। উত্তর দাও। আমি কি পরিবারের এতোটাই ফেলনা যে আমার ছেলের বিয়ে আর আমাকেই জানানো হলো না।’

মিনা থেকে তাহমিনা। জামাল এহতেশাম যখন প্রচন্ড রেগে যান তখনই পুরো নামে সম্বোধন করেন তাহমিনা হককে।

তাহমিনা হক টিভি বন্ধ করে ফিরলেন স্বামীর দিকে। ছাড়লেন দীর্ঘশ্বাস। তারপর শুরু করলেন বলা।

‘প্রথমত একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের বিয়ে দিতে কারো পারমিশন লাগে না। যখন সে ছেলে নিজেই বিয়েতে রাজি। আর দ্বিতীয়ত তুমি একদম ঠিক ধরেছো তোমার চট্টগ্রাম যাওয়ার ফয়দাটাই আমরা লুটে নিয়েছি। কারণ তুমি থাকলে এই বিয়েটা দেওয়া কখনোই সম্ভব হতো না।’

জামাল এহতেশাম কিছু বলতে চাইলেন। তাহমিনা হক বলতে দিলেন না। হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন উনাকে।

‘জবাব চেয়েছো জবাব দিচ্ছি। মাঝখানে কথা বলবে না।’

থমথমে মুখে থেমে গেলেন তিনি। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধে মুষ্টিবদ্ধ করে নিলেন হাত। তাহমিনা হক ফের বলতে শুরু করলেন,

‘বাবার অধিকার? কোন অধিকারের কথা বলছো? কোন বাবা মেয়ের বিয়ের দিন অফিসে মিটিং রাখে? জীবনে টাকা পয়সাই সব? নাকি টাকা দিয়ে দিলাম আর সন্তানের বাবার অভাব পূরণ হয়ে গেল। কোনটা? জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। বাবার কতগুলো দায়িত্ব থাকে। কোনোদিন বলতে পারবে হাসিমুখে আমাদের সাথে কয়েক মিনিট কথা বলেছো? আমাদের একটু সময় দিয়েছো? ছুটির দিনে কোথাও ঘুরতে নিয়ে গিয়েছো? আমার ছেলে মেয়ে দু’টোর বাবা থেকেও না থাকার মতো। আমার জীবনটা তো শেষ সাথে আমার ছেলে মেয়ে দু’টোর জীবন শেষ।’

ছলছল করে ওঠে তাহমিনা হকের চোখ। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল।

‘ব্যবসা,ব্যবসা আর ব্যবসা করে এই পর্যন্ত। আমার প্রাপ্য সময়টুকু আমি তোমার কাছ থেকে পাইনি। ছেলে তোমাকে বার বার বলেছে তার পছন্দের কথা। পাত্তা দাওনি। এড়িয়ে গিয়েছো। ৪০% পার্টনারশিপ পাওয়ার লোভে বিজনেস পার্টনারের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে চাইছো। একবারও কি ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছো ওই মেয়েকে তোমার ছেলের পছন্দ কিনা? তাকে বিয়ে করলে ছেলেটা সুখী হবে কি না? আজ এসেছো বাবার অধিকার নিয়ে। স্ত্রীর পাশে শুয়ে থাকলেই সময় দেওয়া বলে না আর মাস শেষে কতগুলো টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই বাবা হওয়া যায় না।’

‘বর্তমানে টাকা ছাড়া জগৎ চলে না। ছেলেমেয়ের সুখের চিন্তা করা কি আমার অন্যায়? মেয়েটাও আমার কথা শুনলো না। এখন ছেলেটাও।’

‘এহতেশাম, টাকা ছাড়া আসলেই জীবন চলে না। এরমানে এই না যে সংসার ছেলেমেয়ের কথা ভুলে গিয়ে তুমি টাকার পিছনে দৌড়াবে। খুব সাধারণভাবেও জীবন পার করা যায়।’

‘তোমরা তিনজন একদিন ঠিক বুঝবে। আমি তোমাদের ভালো চেয়েছিলাম সেটাও বুঝবে। কিন্তু সময় খোয়ানোর পরে।’

এতোক্ষণ নমনীয় স্বরে অনেক কথা বললেও এবার তেতে উঠলেন তাহমিনা হক। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,

‘আমাদের কারোরই এতো বেশি বুঝার প্রয়োজন নেই। যতটুকু বুঝি আলহামদুলিল্লাহ। তুমিই বুঝতে থাকো সব। বুঝতে বুঝতে তোমার ওই পার্টনারের মেয়েকে তুমিই বিয়ে করে ফেলো। আমি কিছু বলবো না। এতে অন্তত আমার ছেলেটা মুক্তি পাবে।’

______________

তানভীরের কাঁধে হাত রেখে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে পিয়ার। হৃদয়ের হাঁক-ডাক ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ধক! ধক! ধক! পিয়া মনে প্রশ্ন ভীড় জমায়, ‘লোকটা কি হৃদয়ের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছে? হয়তো না। শুনতে পেলে হয়তো বলতো, ‘একি রাজমহিষী? আপনার হৃদয়ের ধুকপুক শব্দ যে আমি শুনতে পাচ্ছি। আপনার কি বেশিই প্রেম প্রেম পাচ্ছে? বাইক থামাবো? জড়িয়ে ধরবো আপনাকে? জড়িয়ে ধরলে দেখবেন ধুকপুক করতে থাকা অশান্ত হৃদয় একদম শান্ত হয়ে যাবে।’

মাঝ রাস্তায় তানভীর বাইক থামিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। ব্যাপারটা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে পিয়ার। ভাবতে ভাবতে তানভীরের কাঁধ থেকে হাত সরাতে নিলেই তানভীর বলে উঠে,

‘কাঁধ থেকে হাত সরালে বাইকের স্পিড এমন বাড়াবো জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হবেন।’

‘জড়িয়ে ধরা’ মনে মনে চিন্তা করলো আর শুনতে হলো কথাটা। না না এই মাঝ রাস্তায় বজ্জাত পুরুষ মানুষকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না সে। পিয়া নিশ্চিত যে পরিমাণ নির্লজ্জ এই লোক। লোকজন তোয়াক্কা না করে একবার জড়িয়ে ধরলে আর ছাড়বে না। তারচেয়ে বরং কাঁধে হাত থাকুক। হাত না সরালেও মনে মনে তুলোধুনো করতে ভুলল না।

পিয়ার গন্তব্য আসার একটু আগেই বলল,

‘এখানেই নামিয়ে দিন।’

বাইক থামায় তানভীর। মাথা থেকে হেলমেট নামিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘বাসা তো আরো সামনে। এখান থেকে তো অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে।’

ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল পিয়ার। কপালে পরে ভাঁজ।

‘আমার বাসা আরো একটু সামনে আপনি জানলেন কি করে?’

মুচকি হেসে মাথা চুলকায় তানভীর।

‘যাকে মনের ঘরে ঠাঁই দিয়েছি তার ঠিকানা বের করা কি এমন কাজ?’

প্রসঙ্গ বাদ দেয় পিয়া। আবছা অন্ধকার নিকষকৃষ্ণ আঁধারে রূপ নিচ্ছে। কথা বাড়ালেই সময় ফুরাবে।

‘বিয়ের ব্যাপারটা কেউ জানে না। সাবলেটে থাকি তো৷ আপনাকে আমার সাথে দেখলে অনেকে খারাপ ভাবতে পারে।’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো নিজ গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় পিয়া। কয়েক কদম দেওয়ার পরই শুনতে পেল তানভীরের আকুল কন্ঠে এক আবদার,

‘কালকেও কি একটু রাজমহিষীর সঙ্গ পাওয়া যাবে?’

পা থমকে যায় পিয়ার। কয়েক সেকেন্ড পরে জবাব দেয়,

‘কাল বিকেলে টিউশন আছে আমার।’

‘তাহলে আমি টিউশন নিয়ে যাই?’

করুন স্বরে করা আবদার উপেক্ষা করার সাধ্য যেন পিয়ার নেই।

‘ বিকেল ৪টা থেকে থেকে টিউশন আমার।’

পিয়ার উত্তরটা যে হ্যা বোধক চট করে বুঝে ফেলল তানভীর। উৎফুল্ল স্বরে প্রশ্ন করল,

‘তা হলে সাড়ে তিনটায় আমি এখানে দাঁড়াবো?’

পিয়া জবাব দেয়,

‘আপনার মর্জি।’

আবারও কদম ফেলে সামনের দিকে যেতে লাগল পিয়া। আচমকাই তানভীর বলে উঠে,

‘আর একটু দাঁড়াবে?’

না চাইতেও দাঁড়াতে হয় পিয়াকে। কেন জানি লোকটার কথা চেয়েও এড়িয়ে যেতে পারে না সে।

বড় কদম ফেলে পিয়ার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় তানভীর। কোনোরকম বলা কওয়া ছাড়াই ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল কপালে।

পিয়া থমকাল, চমকাল। আকস্মিক প্রেমময়ী স্পর্শে কেঁপে উঠল অন্তঃস্থল। অসাড় হয়ে এলো দেহ।

‘কেমন জানি অপূর্ণ অপূর্ণ লাগছিল নিজেকে। আর তোমার কপালখানিও আমার ঠোঁটকে সেই কখন থেকে ডাকছিল। বার বার বলছিল ছুঁয়ে দাও আমাকে। তাই,,,’

কথা শেষ করতে দিল না তানভীরকে। কপাল যে চুমু খাওয়ার জন্য আজ প্রথম শুনল সে। একছুটে সেখান থেকে পালাল পিয়া। মানুষটার সামনে যতই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে মানুষ ততই তাকে লজ্জার চাদরে আচ্ছাদিত করে দিচ্ছে তাকে।

পিয়ার যাওয়ার পানে চেয়ে তানভীর সশব্দে বলে উঠে,

‘নিজেকে লজ্জায় মুড়িয়ে যতদূরই যাও না কেন, তোমার মনের শেষ গন্তব্য যেন আমার মনই হয়।’

#চলবে