উষ্ণ আঁচে ভালোবাসা পর্ব-০৬

0
2

#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (০৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম নাম)

শিরদাঁড়া বেয়ে প্রবাহিত হয় তরল স্রোত। লজ্জায় কান দিয়ে বেরুচ্ছে গরম ধোঁয়া। কনকনে এই শীতে কপাল বেয়ে নামে চিকন ঘাম। অসাড় হয়ে আসে দেহখানি। নিজেকে বড্ড দূর্বল লাগছে পিয়ার। ভালোবাসি শব্দটা যেন শিকারীর সূঁচালো তীরের ন্যায় হৃদপিণ্ডে বিঁধেছে তীক্ষ্ণভাবে। বাম হাতটা মুঠ করতে চাইল। কিন্তু শক্তিতে কুলালো না।
ভালোবাসা! এই কথাটার এতো জোর? গায়ের সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে এক লহমায়। তাকে একদম নিস্তেজ করে দিয়েছে।

আবারো নীরবতার চাদরে দুজনেই দুজনকে আড়াল করে নিয়েছে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না।

তানভীর চুপ রইল উত্তর জানার জন্য। পিয়া চুপ রইল উত্তর নেই বলে। কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেছে সে। কথাটা সে এর আগেও বহুজনের কাছ থেকে বহুবার শুনেছে। কিন্তু হৃদয়ের দোরগোড়ায় কড়া নাড়তে পারেনি কোনোবারই। কিন্তু এইবার যে শিকারী তার নিশানা ভুল করেনি। তার সর্বাঙ্গ নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকট ঝড় তুলেছে অন্তঃস্থলে।

ভোঁতা মস্তিষ্কে শয়তানি কিলবিলিয়ে ওঠে পিয়ার। তানভীর তাকে সামনে দেখলেই এটা ওটা বলে লজ্জা দেয়। আজ লজ্জা পাওয়ার পালা তানভীরের।

‘ক,,,,কেউ সালাম দিলে সালামের জবাব দিতে হয়। আগেই উল্টোপাল্টা কথা বলতে হয় না। সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব।’

তানভীর লাজুক হেসে মাথা চুলকায়।

‘ইয়ে,,, মানে কথাটা আগেই ঠোঁটের অগ্রভাগে এনে রেখেছিলাম। তুমি হ্যালো বলার সাথে সাথে বলবো বলে। ওয়ালাইকুমুস সালাম।’

তারপর আবারও নীরবতা নেমে আসে। কেউ যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সময় গড়ায়। তানভীর মৃদুস্বরে জানতে চাইল,

‘এতো রাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে খুব বিরক্ত করলাম বুঝি?’

একটু নরমাল হয় পিয়া। রগড় গলায় জবাব দেয়,

‘না না বিরক্ত হবো কেন? রাতের বেলা কেউ ফোনে কথা বলতে চাইলে এতে বিরক্ত হওয়ার কি আছে? মাঝরাতই তো। মাঝরাতে কেউ ঘুমায় নাকি?’

আবারও লাজু হাসে তানভীর। কথাটা যে খুঁচা মে”রে বলেছে বুঝতে বাকি নেই তার।

‘বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই জনাবা। আমি এখন থেকে এভাবেই তোমাকে জ্বালাবো, বিরক্ত করবো।’

ফজরের ওয়াক্ত ঘনিয়ে আসছে। এই নিকষকৃষ্ণ আঁধার কেটে যাবে একটু একটু করে। পিয়া বারান্দার গ্রিলে হেলান দেয়। হতাশা মিশ্রিত স্বরে বলল,

‘বাবা ধরে বেঁধে পাগলের সাথে বিয়ে দিয়েছে। এখন তো এসব সহ্য করতে হবেই। উপায় নেই তো।’

নৈঃশব্দ্যে হাসে তানভীর। কণ্ঠে তুলে ছন্দের ঝংকার।

‘ আমি স্বামী হওয়ার আগে প্রেমিক হতে চাই। শরীর ছোঁয়ার আগে মন ছুঁতে চাই। কপালে প্রণয়ের চিহ্ন এঁকে তারপর ঠোঁটে ঠোঁট মিলাতে চাই।’

পিয়া মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনে যায়। ঘোরের মাঝেই বলে ফেলে,

‘তা প্রেমিক পুরুষ হওয়ার জন্যই বুঝি এতোরাতে এই ব্যর্থ ফোনালাপ?’

শব্দযোগে হাসে তানভীর।

‘কে বলল ব্যর্থ ফোনালাপ? না মানে কেউ একজন যে একটু একটু করে আমার প্রেমে পরছে আমি কিন্তু একটুও টের পাচ্ছি না। একদম না।’

হতবিহ্বল পিয়া। লোকটা এতদূর থেকেও তার মনোভাব বুঝতে পেরেছে ভেবেই আঁতকে উঠল সে। তাহলে কি দৃষ্টির লক্ষ্যেই শুরু করবে পাল্টা অনুভূতির বর্ষণ? ভাবনার মাঝেই তানভীর ফের বলল,

‘মধ্যরাতে প্রেমিকার ঘুম জড়ানো স্বর প্রেমিকের কাছে অমৃতের মতো।’

পিয়া লাজুক স্বরে জানতে চায়,

‘ অমৃত নাকি তিতা করলার রস খেয়ে দেখেছিলেন বুঝি?’

‘খাইনি। তবে খাবো। সময় হউক। অসময়ে খেলে ভেজাল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।’

ধমকে ওঠে পিয়া, ‘অসভ্য।’

__________________

‘আজকে তো তোমার অফ ডে। তাই না?’

‘হুম।’

জামাল এহতেশামের করা প্রশ্নের জবাব দিয়ে আবারও নাস্তায় মনোযোগ দেয় তানভীর।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন জামাল এহতেশাম।

‘নাস্তা শেষ করে রুমে এসো। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমার সাথে।’

জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে তানভীর জানতে চায়,

‘কোন ব্যাপারে?’

তেঁতে উঠেন জামাল এহতেশাম। যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। একটু সুযোগ পাবে আর নিজের ভেতরের সব রাগ উগলাতে পারে।

‘কৈফিয়ত দিতে হবে আমার তোমাকে? আমি কোন ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলবো কি বলবো না সেই কৈফিয়ত দিতে হবে? এতোটা বড় হয়ে গিয়েছো তোমরা?’

মুহুর্তে আহাম্মক বনে গেল তানভীর। সে তো খুুব সাধারন একটা কথাই জিজ্ঞেস করেছে।

‘এই গলা নামিয়ে কথা বলো এহতেশাম। সাতসকালে চিৎকার চেঁচামেচি করবে না। ও এমন কিছু বলেনি যে তোমার এমন রিয়েক্ট করতে হবে।’

ক্রোধান্বিত চোখে তাহমিনা হকের দিকে তাকাতেই তাহমিনা হক আরো রেগে গেলেন।

‘অযথা রাগ দেখাবে না। জীবন টা ওর। তাই ওর যাকে পছন্দ তাকে নিয়েই সংসার করবে। তোমার পছন্দের মেয়েকে নিয়ে না। আর তুমি যদি এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করো তো আমার ভাবতে হবে তোমার সাথে আমি সংসারটা করবো কি না।’

খাওয়া অসম্পূর্ণ রেখেই চলে গেলেন তিনি। এখানে থাকলে আরো বড়সড় ঝামেলা হবে।

ঘটনা বুঝতে আর বাকি নেই তানভীরের। আর আগেও যে বাকবিতন্ডা হয়েছে সেটাও বুঝতে পেরেছে সে।

রাগে, ক্ষোভে ফুঁসছেন জামাল এহতেশাম।

হাত ধুয়ে বাবার পিছনে এসে দাঁড়ায় তানভীর। খুব কোমল গলায় বলে,

‘তোমার আর আমার মাঝে যে দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে সেটা কি বুঝতে পারছো বাবা?’

জামাল এহতেশাম চেয়ার চেপে ধরলেন।

‘অপছন্দের মেয়েকে বিয়ে করলে আমি কতটা সুখী হবো? সারাটা জীবন একসাথে থাকতে পারবো কিনা? নাকি মাঝপথে ভাঙনের সৃষ্টি হবে সেই সম্পর্কের? ভেবে দেখেছো একটা বার?’

‘ভালোই তো নিজের ভালোটা আজকাল অনেক বুঝো। নিজেদের জন্য নিজেরাই যথেষ্ট। আর সাথে তো তোমাদের মা আছেই। এখন আর বাবার দরকার হয় না। বাবা তো আর এখন না থাকলেও চলে। তোমার বোনেরও বাবার প্রয়োজন নাই আর তোমারও নাই।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তানভীর। নিস্তেজ গলায় ফের বলল,

‘যতদিন পৃথিবীতে মানুষ বাঁচে ততদিনই বাবার প্রয়োজন আছে। বাবা হচ্ছে বটগাছ। সবল হউক আর দূর্বল হউক সমস্ত ঝড় ঝাপটা বাবা নামক মানুষটার উপর বয়ে যায়। বাবার প্রয়োজন কখনো ফুরায় না। তবে বাবাকেও বুঝতে হবে সন্তানের পছন্দ অপছন্দ। কার সঙ্গে ভালো থাকবে কার সঙ্গে খারাপ থাকবে। অপছন্দের মানুষের সাথে সারাজীবন পার করা যায় না।’

_____________

বেলাল শেখ ইজি চেয়ারে বসে চিন্তায় মগ্ন। পিছন থেকে শিরিন আহমেদ কাঁধে হাত রাখতেই পিলে চমকে উঠে উনার।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওহ তুমি?’

পাশে বসলেন শিরিন আহমেদ। ‘কিছু ভাবছিলে?’

‘তেমন কিছু না।’

‘আজকে বেরুবে না?’

‘এ বেলায় আর যাবো না। বিকেলের দিকে একটু যাবো খন। ছেলে দুটোকে বলে এসেছি এবেলায় যেন দোকানটা একটু সামলে নেয়।’

‘হ্যা গো?’

‘বলো।’

‘বেয়াই আর ফোন দিয়েছিল?’

তপ্ত শ্বাস ফেলে জবাব দিলেন, ‘কল রিসিভও করেনি আর কল ব্যাকও করেনি।’

আচমকাই শিরিন আহমেদের হাতটা মুঠোবন্দি করে নিলেন তিনি।

‘আমি ভুল করে ফেললাম না তো? আমার কি উনার সাথে কথা বলে তারপর বিয়েতে মত দেওয়া উচিত ছিল?’

‘যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এতোকিছু ভেবে লাভ আছে?’

‘আমারই বা দোষ কিসে? আমি তো উনার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম। উনিই তো যোগাযোগের বাইরে ছিল। আর উনারাও এভাবে পিছে পড়ে ছিল। আমি কিন্তু সব খোঁজ খবর নিয়েই মেয়ে বিয়ে দিয়েছি।’

‘দেখো এতো টেনশন করো না তো। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।’

______________________

আবাসিক এলাকার গেইটের বাইরে একটা কালো রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। গাড়ির কাঁচ নামতেই একটা মাঝ বয়সী লোক দৌড়ে গাড়ি সামনে এসে দাঁড়ায়।

‘এখনই বের হবে?’

‘জ্বি স্যার। এখন বের হবে নয়তো আরো পাঁচ মিনিট পর।’

‘তুমি সিউর?’

‘জ্বি স্যার। এক সপ্তাহ যাবৎ নজরে রেখেছি। প্রতিটা সময় আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।’

কথার মাঝেই টার্গেট করা মানুষটা গেইট দিয়ে বের হয়। গাড়ির ভেতরে থাকা লোকটা তীক্ষ্ণ নজরে অবলোকন করলেন। তারপর কোনোকিছু না বলে সাঁই সাঁই করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন চোখের পলকে।

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।