উষ্ণ আঁচে ভালোবাসা পর্ব-১৩+১৪

0
4

#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (১৩)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘তাহলে আমি কে?’ কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করল পিয়া। চোখজোড়া টলমল করছে।

‘আমার বিয়ে করা বউ।’ তানভীরের ভাবলেশহীন জবাব। তখনো কফিতে মগ্ন সে।

উত্তরটা যেন পিয়ার পছন্দ হলো না। ভেবেছিল অনুভূতি মিশিয়ে আরো কিছু বলবে। কিন্তু তানভীর বলল না। ওখানেই থেমে গেলো। নাক ফোলায় সে। রাগ আর অভিমান জড়ো হয় একসাথে। কিছু একটা বলতে চাইলো। কিন্তু অভিমান ঠেলে কন্ঠনালী দিয়ে কথাগুলো আর বেরুতে পারলো না। নেত্রপল্লব ভিজে উঠতেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ওমনি খপ করে পিয়ার হাতটা ধরে ফেলে তানভীর।

‘আমি আমার কথা এখনো সম্পূর্ণ করিনি।’

পিয়া তানভীরের দিকে তাকাতেই তানভীর চোখের ইশারায় বসতে বলল। পিয়া নড়ল না। এক চুল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তানভীর তপ্ত শ্বাস ফেলে।

‘শান্ত হয়ে বসো। আমি সবকিছু বলবো তোমায়।’

পিয়ার মন নরম হয়। নাক টেনে আগের জায়গায় এসে বসল। তানভীর একটা টিস্যু এগিয়ে দিল তার দিকে।

‘এতো ঠুনকো বিষয়ে মানুষ কাঁদে?’

পিয়া ফের নাক টানে।

‘এখন আমি যদি বলি আমার একটা বয়ফ্রেন্ড আছে তখন দেখা যাবে ব্যাপারটা ঠুনকো নাকি সিরিয়াস।’

তানভীর চোখ পিটপিটিয়ে চাইলো পিয়ার দিকে। তারপরই হেসে উঠলো মৃদুশব্দে। গা জ্বলে উঠে পিয়ার। নাক ফুলিয়ে চোখ গরম করে তাকায় তানভীরের দিকে।

পিয়ার একটা হাত মুঠোবন্দি করে তানভীর। হাতের বাঁধন ক্রমান্বয়ে জোরালো হয়।

‘সেদিন যা দেখেছিলে সে আমার অনাকাঙ্ক্ষিত অতীত। যাকে জোর করে আমার উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল অনেকে। আর তুমি? তুমি আমার বর্তমান, ভবিষ্যত এবং আমার জীবনের সবকিছু। যে সম্পর্কের টান থাকবে পরকাল পর্যন্ত।’

পিয়ার চাহনি শীতল হয়। পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে তানভীরের দিকে।

তানভীর পিয়ার চোখে চোখ রাখে। পুনরায় বলল,

‘তুমি আমার প্রেম। আমার সমস্ত অনুভূতি। আমার চোখের শান্তি। যাকে এক পলক দেখেই তার প্রতিচ্ছবি হৃদয়ে এঁকেছি যত্ন করে। তুমি সেই মানুষ যাকে পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজেছি অলিতে-গলিতে।’

পিয়ার চোখ আবারও টলমল করে উঠে। অভিমানে নয়। তীব্র অনুভূতির পিষ্টনে। ঠিক এই মুহূর্তে তানভীরের বুকে মাথা রাখা লোভ হয় তার। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলতে চায়,

‘এতো ভালো কেন বাসেন আমাকে? এতো ভালোবাসেন বলেই তো আমার হারিয়ে ফেলার ভয় হয়।’

কথাগুলো বলা হয়ে ওঠে না তার। মানুষের আনাগোনায় মনের ইচ্ছে, আকুতি মনেই চেপে রাখল সে।

তানভীর আরো একটা টিস্যু এগিয়ে দিল,

‘চোখের পানি মুছো। হাজারো ব্যস্ততা পায়ে ঠেলে তোমার চোখের পানি দেখার জন্য আমি আসিনি।’

পিয়া মুখ ভেংচি দেয়। বিড়বিড় করে বলে,

‘নিজে কাঁদিয়ে এখন আবার ঢং করতে আসছে।’

তানভীর ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই পিয়া পুনরায় বলল,

‘ওই আপদ আপনার অনাকাঙ্ক্ষিত অতীত হলে সেদিন আপনার হাত জড়িয়ে ধরেছিল কেন? আর আপনি বা ওমন করে দাঁত কেলাচ্ছিলেন কেন?’

‘আমি দাঁত কেলাচ্ছিলাম?’ জানতে চায় তানভীর।

পিয়া জোর গলায় বলে,

‘ আমি স্পষ্ট দেখেছি আপনি খেঁক খেঁক করে হাসছিলেন।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তানভীর।

‘ওকে ফাইন আমি হাসছিলাম। এই হাসি পর্যন্তই থাকো। আর গভীরে যাওয়ার দরকার নেই। কখন আবার বলে বসো জড়িয়েও ধরেছি।’

দাঁত কিড়মিড় করে ক্রোধান্বিত চোখে তাকাল পিয়া। তানভীর প্রসঙ্গে ফিরে আসে।

‘সেদিন ওখানে গিয়েছিলাম একটা কাজে। কোথা টিনা এসে আমার একহাত জড়িয়ে ধরে। হাজার চেয়ে ছাড়াতে পারলাম না। নিকৃষ্ট ভাষায় অপমানও করেছি। উল্টো বলে রাস্তা পার করে দিতে নইলে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে।’

‘ওহ বলল আর আপনিও ভয় পেয়ে ডেং ডেং করে রাজি হয়ে গেলেন?’

‘ওটা ডেং ডেং করে রাজি হওয়া না। বলো বাধ্য হয়ে। ও যদি চিৎকার চেঁচামেচি করতো তবে পরিস্থিতি অনূকূলে থাকতো না। মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হতো। সমস্ত দোষ এসে পড়তো আমার ঘাড়ে। কারণ আমি পুরুষ।’

পিয়া মুখে আধার নামে। নত স্বরে বলে, ‘ওসব বাহানা।’

শান্ত, অনিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে তানভীর। সময় গড়ায়। পিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে নখ খুঁটতে লাগল।

‘পিয়া লুক এট মাই আই’স।’

আচমকা কথায় পিয়া যেন কেঁপে উঠল। তানভীরের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নখের দিকে।

‘পিয়া আমার চোখের দিকে তাকাও তুমি।’ তানভীরের বলিষ্ঠ স্বর।

না চাইতেও পিয়া তানভীরের চোখের দিকে তাকাল।

‘কী দেখতে পাও।’

দুজনের চোখ দুজনাতে নিবদ্ধ। পিয়ার মুখে কোনো কথা নেই। তানভীরের প্রেমময়ী চাহনিতে যেন একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে সে।

‘প্রণয়ের উত্তাল ঢেউ কি চোখে পড়ে না? প্রেমের তীব্র সুবাস কি নাকে আসে না?’

পিয়া জবাব দিতে পারে না। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে চোখের গভীরতায়।

‘আমি যদি টিনা ছুঁয়ার বাহানা খুঁজতাম তবে তোমার জায়গায় আজ সে থাকবো। ইউ নো হোয়াট? আমি যদি এখন বলি আমি টিনাকে বিয়ে করবো আর সে কাউকে কিছু জানাতে পারবে না। তাহলে টিনা দশ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে হাজির হবে। ইভেন এটাও চিন্তা করবে না আমি বিবাহিত। কিংবা যদি বলি ওকে নিয়ে কোনো রিসোর্টে একান্তে সময় কাটাবো তুমি জাস্ট ভাবতে পারবে না ও কি করবে। ওর কেবল আমাকেই চাই। যদি টিনাকে ছুঁয়ে দেয়ার আকাঙ্খা আমার থাকতো তবে তোমাকে চলতি পথে একপলক দেখে চিনতে পারতাম না। আর না ছয়মাসের মধ্যে তোমার সমস্ত তথ্য বের করে বউ বানিয়ে নিজের করতাম। টিনার যেমন কেবল আমাকে চাই আমারও কেবল তোমাকেই চাই। এবং সেটা আমৃত্যু।’

‘ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে পরে ছেড়ে যাবেন না তো?’

পিয়ার নিস্তেজ গলায় করা প্রশ্নটা শুনে বুকের ভেতরটা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল তানভীর।

‘ছেড়ে যাওয়ার জন্য হাতটা ধরিনি। সারাজীবন ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবো বলে আমার করে নিয়েছি।’

_________________

তাহমিনা হক তিন চার পদের পিঠা জামাল এহতেশামের সামনে সাজিয়ে দিতেই বেশ অবাক হলেন তিনি। শামুক পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, মুগ পাকন, নারকেলপুলি। বাহারী নকশায় আকর্ষণীয় পিঠা ছেড়ে উনার নজর গেলো তাওয়ায় টেলে নেওয়া ম্যারা পিঠার দিকে। একপাশে মাংসের ঝোল আর আরেক পাশে পাটায় পিষে বানানো ভর্তা। খুশিতে চকচক করে উঠে উনার দুই চোখ। মুহূর্তেই যেন খিদে পেয়ে গেল। কাল বিলম্ব না করে একটা পিঠা মাঝখানে দুই ভাগ করে ঝোলে ডুবিয়ে মুখে পুরে নিলেন। চোখ বন্ধ করে খুব আয়েশ করে খাচ্ছেন তিনি। শীত এলে গ্রামে ম্যারা পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। শহরে তেমন একটা দেখা যায় না। বাকি অর্ধেক পিঠায় একটু ভর্তা নিয়ে পুনরায় মুখে দিলেন।

‘মিনা আজ কত দিন পর ম্যারা পিঠা খাচ্ছি। আমি আজকে এগুলোই খাবো। আমাকে কিন্তু কিছু বলতে পারবে।’

মুখের টা শেষ হতেই আরো একটা পিঠা নিয়ে মাঝ বরাবর ভাগ করলেন। টেলে নেওয়া পিঠা থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে।

‘এগুলো আবার কখন করলে তুমি?’

‘আমি কিছু করিনি তো।’

খাওয়া থামিয়ে তাহমিনা হকের দিকে তাকালেন জামাল এহতেশাম। জিজ্ঞাসাসূচক চাহনিতে তাকিয়ে বললেন,

‘তবে?’

‘পিয়ার বাবা এসেছিল। শীত তো শেষের দিকে তাই মেয়ের জামাই বাড়িতে পিঠাপুলি দিয়ে গেলেন। বিকেল পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু তুমি তো ফিরলে সন্ধ্যার পর।’

তাহমিনা হকের সহজসরল স্বীকারোক্তি। তবে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো জামাল এহতেশামের। দাঁত কিড়মিড় করে উঠে দাঁড়ালেন। ক্রোধান্বিত গলায় প্রশ্ন করলেন,

‘আগে বললে না কেন?’

কপাল কুঁচকে গেলো তাহমিনা হকের।

‘আগে বললে কি হতো? খেতে না?’

‘না খেতাম না। ওখান থেকে দিয়ে গেছে শুনলে ছুঁয়েও দেখতাম না।’

তাহমিনা হক গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,

‘খেয়ে তো ফেলেছো। সাজিয়ে রাখা খাবার ফেলে উঠতে নেই।’

তিনি ফিরেও তাকালেন না পিঠা গুলোর দিকে। কাঠ কাঠ গলায় বললেন,

‘আজই শেষ। এরপর যেন ও বাড়িতে থেকে আর কিছু না আসে। আমি গরীব কিংবা মিসকিন নই যে ছেলের শ্বশুরবাড়ির থেকে পাঠানো খাবার খাবো।’

‘এখানে গরীব বা মিসকিনের কথা কোথা থেকে আসছে? যার কিছু নেই সেও তার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পিঠাপুলি পাঠায়। এটা যার যার শখ। আমি আমার মেয়েকে দেইনা? আমি তো এগুলো চেয়েও আনিনি।’

‘এতোকিছু শুনতে ইচ্ছুক নই আমি।’

তাহমিনা হক চাপা স্বরে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

‘ভদ্রলোক এতো শখ করে আনলেন তুমি খাবে না?’

তিনি ‘না’ বলেই হাঁটা ধরলেন রুমের দিকে। তাহমিনা হক খেঁকিয়ে উঠলেন।

‘ছেলের বউয়ের হাতে বানানো পায়েস খেতে পারে আর বেয়াইর আনা পিঠা খেতে গেলে উনার ঢং শুরু হয়।’

জামাল এহতেশাম কথাটা শুনলেন কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। উত্তর দিতে গেলে ঝামেলা আরো বাড়বে।

______________

রাত বাড়ছে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরে বাস করা প্রতিটি মানুষ এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কোথাও কোথাও দুই একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে যাচ্ছে। হঠাৎই কোনো বিকট শব্দ হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন তাহমিনা হক। আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সারা শরীর কাঁপছে উনার। হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে ক্ষিপ্র গতিতে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। পাশে হাত রাখতেই ভয়টা যেন আরো দ্বিগুণ হয়। পাশে কেউ নেই। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। মনে মনে আওড়ালেন,

‘রাতে তো রাগ করে ঔষধ খেলো না। তবে কি ডায়াবেটিস কমে গেল? কোনো অঘটন ঘটেনি তো আবার?’

কথাগুলো ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে তাহমিনা হকের। তড়িঘড়ি করে নামেন খাট থেকে। অন্ধকারেই ছুটলেন ওয়াশরুমের দিকে। ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কা দিতেই,,,,,

#চলবে

#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (১৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

আলো নিভিয়ে রাখা বাথরুমে কোনো মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই। বুকটদ ছ্যাৎ করে উঠে তাহমিনা হকের। ভয়ের মাত্রা আরো দ্বিগুণ হয়। ভয়ে আতঙ্কে মাথায় উ্লটোপাল্টা চিন্তাগুলো যেন আরো জেঁকে বসেছে। চোখ ভিজে উঠছে বারংবার । বাচ্চাদের মতো নাক টানেন। এখনই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবেন এমন অবস্থা। ব্যতিব্যস্ত পায়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলেন রান্নাঘরে আলো জ্বলছে। টুংটাং শব্দও আসছে। পায়ের গতি বাড়ালেন তিনি। রান্নাঘরে পা রেখেই যেন কলিজায় পানি এলো তাহমিনা হকের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

জামাল এহতেশাম প্লেটে ভাত নিয়ে তরকারির হাড়ি চুলোর উপর বসিয়ে রেখেছেন। গ্যাস বার্নার দিয়ে চুলো জ্বালানোর চেষ্টা সেই কখন থেকে করেই যাচ্ছেন কিন্তু চুলো জ্বালাতে পারছেন না।

তাহমিনা হককে নজর আসতেই তিনি আপনমনে বলেন,

‘খাওয়ার পরের ঔষধগুলো তো খালি পেটে খেতে পারবো না। তাই আরকি। তুমি ঘুমোচ্ছিলে বলে আর বিরক্ত করিনি।’

জামাল এহতেশামের পায়ের কাছে কিছু একটা দেখার আগ পর্যন্ত ঘটনাটা স্বাভাবিকই মনে হয়েছে তাহমিনা হকের। এরপরই বিড়বিড় করলেন, ‘ভাঙবে তবু মচকাবে না।’

তাহমিনা হক জামাল এহতেশামের কাছে যেতেই তিনি কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালেন । চুলো জ্বালিয়ে মাটির তাওয়া বসালেন গরম হওয়ার জন্য। তারপর ফ্রিজ থেকে ম্যারাপিঠা নামিয়ে আনতেই তেতে উঠলেন জামাল এহতেশাম।

‘এগুলো কিসের জন্য বের করেছো? আমি কি বলেছি এসব আমি খাবো?’

তাওয়া গরম হতেই একে একে সবগুলো পিঠা ঢেলে দিলেন তিনি। চুলোর আচঁ কমিয়ে জবাব দিলেন,

‘কি আশ্চর্য! আমি কি একবারও বলেছি এগুলো তোমার জন্য গরম করেছি?’

মিইয়ে যান জামাল এহতেশাম। এমন উত্তর যেন তিনি একেবারেই আশা করেননি।

তাহমিনা হক আপনমনে একটু পর পর পিঠাগুলো উল্টেপাল্টে দিচ্ছেন। আচমকাই জামাল এহতেশামের পায়ের কাছে নুয়ে কিছু একটা হাতে নিলেন তিনি।

‘যা পারো না তা করতে যাও কেন?’

থেমে পুনরায় বলেন,

‘মানে যা লুকাতে পারো না তা লুকাতে যাও কেন?’

ধরা পড়া চোরের মতো কাঁচুমাচু করতে লাগলেন জামাল এহতেশাম। দৃষ্টি লুকাতে ব্যস্ত তিনি। শক্ত ম্যারাপিঠার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করেন,

‘এটা এখানে কিভাবে এলো আমি কি জানি?’

‘এক্টিং খুব বাজে হচ্ছে এহতেশাম। পরের বার এর থেকে বেটার এক্টিং করার চেষ্টা করবে।’

পা দিয়ে ট্রাশ ক্যানের ঢাকনা খুলতেই ছোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তাহমিনা হকের। আরো অনেকগুলো পিঠা এখানে ফেলে হয়েছে যেগুলো তিনি সন্ধ্যায় গরম করেছিলেন। আবার সাথে ভাঙা একটা কাঁচের বাটিও দেখা যাচ্ছে। তখন আসলে কিসের আওয়াজ পেয়েছেন তা আর বুঝতে বাকি রইল না।

তাহমিনা হক দৌড়ে জামাল এহতেশামের কাছে এলেন। দু-হাত উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন কোথাও কেটেছে কিনা। ছলছল করে উঠে উনার দু-চোখ।

‘কোথাও লেগেছে তোমার? আমাকে একবার ডাকলে কি হতো? তুমি রান্নাঘরে কখনো এসেছো? না আমি আসতে দিয়েছি? এতো ইগো কেন তোমার? ইগো সরিয়ে সবার সাথে মিশার চেষ্টা করো দেখবে স্বর্গ সুখ পাবে।’

হাজারো ঝগড়া, মান অভিমান আর লড়াইয়ের বাইরে যে নিখাদ ভালোবাসা তাহমিনা হকের মধ্যে বিদ্যমান তা কখনো উপেক্ষা করতে পারবেন না জামাল এহতেশাম। মাঝ বয়সে এসেও ঠিক এইখানে দূর্বল তিনি। নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে একহাতে কাছে টেনে নিলেন।

‘কিছু হয়নি আমার।’

তাহমিনা হক নাক টানেন।

‘তুমি টেবিলে যাও আমি আসছি।’

এতোক্ষণ দুজনের কান্ডকারখানা দেখছিল তানভীর। আওয়াজ হতেই তারও ঘুম হালকা হয়ে এসেছিল। চোর এসেছে ভেবে রুম থেকে বের হয়েছে। মা বাবার আবেগঘন মুহুর্ত আসতেই দ্রুতই দৃষ্টি নামিয়ে নিল। পা বাড়ায় রুমের দিকে। নৈঃশব্দ্যে একগাল হেসে আওড়ায়,

‘একসাথে বুড়ো হতে চাই রাজমহিষী। যেন মা বাবার মতো আমরাও আমাদের সন্তানদের নিয়ে ঝগড়া করতে পারি।’

______________________

বেলাল শেখ মসজিদ থেকে ফজর নামাজ শেষ করে এসে গা এলিয়ে দিলেন বিছানায়।

নামাজ শেষ করে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন শিরিন আহমেদ। আয়াত শেষ করে কুরআন শরীফে চুমু দিয়ে যথাস্থানে রেখে স্বামীর শিয়রের পাশে বসলেন। কপালে হাত রাখতেই বেলাল শেখ পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালেন।

‘আবার শুয়ে পড়লে যে। শরীর খারাপ নাকি?’

বেলাল শেখ নাবোধক মাথা ঝাঁকান।

‘রাতে ভালো ঘুম হয়নি আমার। তাই চোখগুলো কেমন জ্বলছে।’

সকালে সোনালী রোদ উঁকি দিয়েছে। পর্দা ভেদ করে এক চিলতে রোদ এসে বিকিরণ ছড়ায় কক্ষজুড়ে।

বেলাল শেখ আধশোয়া হয়ে বসলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

‘দিন দিন স্বর্ণের দাম বেড়েই চলেছে। পিয়ার বালাগুলো এখনো আনতে পারলাম না। ৫০ হাজার টাকা ঘাটতি। ব্যবসাও দিন দিন মন্দা যাচ্ছে। একটা দোকান বন্ধ। আরেকটাও যে কবে বন্ধ হয়ে যায়।’

এসবের চিন্তা যে শিরিন আহমেদের হয় না এমন না। তবে তিনি প্রকাশ করেন না।কেবল আল্লাহর কাছে সাহায্য চান।

‘আল্লাহ ভরসা পিয়ার বাবা। তিনি একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। তবে আমি বলি কি তুমি আবার আগের মতো দোকানে বসো। কর্মচারী ছেলে দুটোকে না আমার একটু বিশ্বাস হয় না। বেচাকেনা তো ভালোই হয়। ব্যবসা তো মন্দা যাওয়ার কথা না।’

কপালে হাত ঠেকালেন বেলাল শেখ। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,

‘সেটাই করতে হবে। দুইদিন পর মেয়ের অনুষ্ঠান। টাকার দরকার। একটা মাত্র মেয়ে আমার। কোনোকিছুর কমতি রাখতে চাই না। বালা দু’টো আনতে হবে। তারপর আবার নেকলেস গড়াতে দিতে হবে। এগুলো তো আমার মেয়ের আমার কাছে পাওনা তাই না। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে টেনশন মুক্ত থাকি। কোনদিন আবার বেয়াইন বলে বসেন, বেয়াই আমার ঘরের বউ আমি এখন ঘরে তুলবো।’

শিরিন আহমেদ নামাজের হিজাব খুলে গুছিয়ে রাখলেন।

‘তুমি বিশ্রাম নাও। আমি রান্নাঘরে গেলাম। নাস্তা করে এক পলক গিয়ে দোকানের হিসাবের খাতাটা দেখো ক্ষন।’

বেলাল শেখও ‘হুম’ বলে চোখ বুঁজে রইলেন।

__________________

রাতে যেমন শীত কাবু করে দিনে তেমন কাঠফাটা রোদ্দুরে গলা শুকিয়ে আসে। পিয়া আজ আবারও এসেছে তার শ্বশুরের সাথে দেখা করার জন্য। আজ কোনোকিছু নিয়ে আসেনি। আজ এসেছে সে নিজে আবদার করবে বলে।

অফিসে ঢুকতেই পিওন এক গাল হেসে সালাম দিল,

‘আসসালামু আলাইকুম, মা।’

পিয়া চোখ পিট পিট করে তাকাল। সালামের জবাব দিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে,

‘আপনি আমাকে সালাম দিলেন?’

তিনি সরল মনে জবাব দিলেন,

‘হ, দিলাম। ম্যাডাম কইছে আপনি আমাগো ছোডো স্যারের বউ। আপনি যহন আইবেন আপনারে যেন তহনই যাইতে দেই স্যারের রুমে।’

‘যাইহোক চাচা আপনি আমাকে আগে সালাম দিয়েন না। আপনি আমার বয়সে বড়। এখন বলেন বাবা রুমে আছেন?’

মাঝবয়েসী লোকটা মাথা ঝাঁকাতেই পিয়া জামাল এহতেশামের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।

কেবিনের দরজা ধাক্কা দিয়েই বলে উঠল, ‘বাবা আসবো?’

কেবিনে উপস্থিত তিনজনই যেন চমকে উঠে। তাদের থেকেও বেশি অবাক হয় পিয়া। টিনাকে এখানে এভাবে বসে থাকতে দেখে। টিনাকে দেখামাত্রই পিয়ার মুখের উৎফুল্লতা বিলীন হয়ে যায়। নেমে আসে ঘোর তমসা।

টিনা হয়তো কাঁদছিল। চোখের পানি মুছে জামাল এহতেশামকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আঙ্কেল আজকাল আপনার কেবিনে যে কেউ যখন তখন ঢুকে পড়তে পারে নাকি? আগে তো আপনি আপনার কেবিনে যাকে তাকে এলাউ করতেন না।’

তারপর থেমে আবারও বলল, ‘বাপি আজকাল তোমাদের অফিসে যে কেউ হুটহাট প্রবেশ করার পারমিশন দিয়ে রেখেছো নাকি?’

একেকটা কথা যেন তীরের ফলার মতো হৃদপিণ্ডে বিঁধে পিয়ার। অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হয়। নিজের সমস্ত খারাপ মাটিচাপা দেয় এই আশায় জামাল এহতেশাম কিছু বলবেন। কিন্তু পিয়াকে অবাক করে দিয়ে জামাল এহতেশাম টুঁশব্দও করলেন না।

পিয়া তারপরও কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করল, ‘বাবা বেশি ব্যস্ত আপনি? আমি কি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করবো?’

জামাল এহতেশামকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না গোলাম মোস্তফা। তার আগেই চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন পিওন মোবারক মিয়াকে। মোবারক মিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পড়লেন গোলাম মোস্তফার তোপের মুখে,

‘কোথায় থাকো তুমি? কে অফিসে আসে আর কে যায় কোনো খবর নেই? এখানে জরুরি মিটিং হচ্ছে কে না কে এসে কেবিনে ঢুকে যাচ্ছে। রাস্কেল তোমাদের মাস শেষে বেতন কি মুখ দেখে দেই?’

#চলবে