#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (১৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
জল বহুদূর গড়িয়েছে। ঘটনার বিশ মিনিটের মাথায় অফিসে এসে উপস্থিত হন তাহমিনা হক। তিনি এসে পিয়ার দেখা না পেলেও গোলাম মোস্তফা এবং টিনার দেখা ঠিকই পেয়েছেন। তারা তখনো জামাল এহতেশামের কেবিনে বসে কথা বলছিল।
কেবিনে ঢুকার পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন তিনি মনে করেননি। দরজা ভালো করে লক করে টিনার গালে সপাটে চড় বসিয়ে দিলেন। তেড়ে গেলেন জামাল এহতেশামের দিকে। আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল উপস্থিত সবাই। কি থেকে কি হয়ে গেল বোধগম্য হতে সময় নেয় সবাই।
টিনা যতক্ষনে টের পেয়েছে কেউ তার গালে চড় বসিয়েছে ততক্ষণে সে তার বাবার বুকে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে।
‘ভাবি আপনার এতোবড় সাহস আপনি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললেন?’ গর্জন করে উঠলেন গোলাম মোস্তফা। রাগে ফুঁসছেন তিনি।
দাঁতে দাঁত পিষেন তাহমিনা হক। মাত্রাতিরিক্ত রাগে কাঁপছেন তিনি।
‘হ্যা, মারলাম। আপনার ওয়াইফ বেঁচে থাকলে যেই কাজটা করতো সেই কাজটাই করেছি আমি। মা মরা মেয়ে বলে আদরে আদরে বাঁদর নয় আস্তো বেয়াদব বানিয়েছেন। কোথায় কি বলতে হয় সেই শিক্ষাটুকু দেন নি।’
এতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে থাকলে মুখ খুলেন জামাল এহতেশাম। কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলেন,
‘এটা আমার অফিস মিনা। তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো।’
তাহমিনা হক আবারও চড়াও হলেন জামাল এহতেশামের দিকে।
‘তোমার বাড়ির বউকে তোমারই সামনে কোথাকার কে অপমান করেছে অনর্গল যাচ্ছেতাই বলেছে। তুমি তখন চুপ ছিলে। সেটা বাড়াবাড়ি ছিল না?’
প্রচন্ড রাগে কথা আটকে আসছে তাহমিনা হকের। তিনি থেমে গেলেন। রাগের পারদ একটু কমতেই ঠান্ডা গলায় ফের বললেন,
‘মেয়েটাকে তুমি ছেলের বউ হিসেবে না মানলেও অস্বীকার করতে পারবে না। মানো আর নাই মানো মেয়েটা এখন তোমার বাড়ির সম্মান। আর সেই সম্মান রক্ষা করার দায়িত্বও তোমার।’
টিনা নাক টেনে সেই কখন থেকে কেঁদেই চলেছে। এটা ওটা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন গোলাম মোস্তফা। টিনার থামার নাম নেই।
চোখের পানি মুছে টিনা। মাথা উঁচিয়ে ন্যাকা স্বরে বলল,
‘আমি আপনার মেয়ে হলে আমাকে এভাবে চড় দিতে পারতেন আন্টি?’
পিছন ফিরে তাকালেন তাহমিনা হক। চোখের চাহনি শান্ত। সেই শান্ত চাহনি নিপাতিত হয় টিনার গালে। আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তাহমিনা হকের বিন্দু পরিমাণ মায়া হয় না। বরং ইচ্ছে জাগে অপর গালেও আরো একটা চড় বসিয়ে দিতে।
‘আমার মেয়ে হলে শুধু চড় না গলা চেপে ধরতাম। বিবাহিত জানার পরও যে মেয়ে একজন পুরুষের পিছনে পড়ে থাকে সেই চরিত্রহীন মেয়েকে আমি বাঁচিয়ে রাখতাম না।’
‘ভাবি!’ চিৎকার করে উঠেন গোলাম মোস্তফা।
তাহমিনা হক এক পলক জামাল এহতেশামের দিকে তাকালেন। তিনি তখনো নির্বিকার।
‘আপনি কিন্তু আপনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।’
গোলাম মোস্তফার কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না তাহমিনা হক। তবে গোলাম মোস্তফাকে বাঁধা দেয় টিনা।
‘ছাড়ো না বাপি। এতো উত্তেজিত হয়ো না। আন্টিই তো। আমার মা থাকলে কি আমাকে বকা দিতো না? আমাকে শাসন করতো না?’
নাক সিটকান তাহমিনা হক। দৃষ্টি ফিরান জামাল এহতেশামের দিকে।
‘আমি আমার মেয়ের কাছে চলে যাচ্ছি। যে পুরুষ মানুষের সামনে তার বাড়ির বউকে বাহিরের মানুষ অপমান করে, হুমকি দেয় কিন্তু সেই পুরুষ মানুষ চুপ থাকে তার সাথে একই বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
থেমে গিয়ে পুনরায় গোলাম মোস্তফাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘আগের নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হন। তারপর আরেকজনকে তার সীমা চিনাতে আসবেন।’
তাহমিনা হক চলে যেতেই গোলাম মোস্তফা বলেন,
‘এহতেশাম সাহেব ব্যাপারটা মীমাংসা হওয়া দরকার। এবং সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আপনার হাতে। আমি আপনাকে দুইদিন সময় দিলাম। আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে আপনার স্ত্রী। আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন। আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না।’
________________
বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা। ঘরনী বাড়িতে নেই। পুরো বাড়ি যেন এলোমেলো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
মাছের পঁচা গন্ধ আসতেই তানভীর নাক চেপে রান্নাঘরে গেল। একপাশে অবহেলায় পড়ে আছে কেটে ধুয়ে রাখা কিছু সবজি আরেক পাশে মাছ। সেই মাছ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
তানভীর মায়ের নাম্বারে কল করে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হয়।
‘সবজি আর মাছগুলো কি করবো মা? মাছ থেকে গন্ধ আসছে।’
‘ট্রাশ ক্যানে ফেলে দে।’ ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে কল কে’টে দিলেন তাহমিনা হক।
তানভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে সত্যি সত্যি সবজি আর মাছগুলো ট্রাশ ক্যানে ফেলে দিল। দুইকাপ কফি বানিয়ে পা বাড়ালো জামাল এহতেশামের কাছে।
দরজার কাছে এসেই তানভীর গলা ঝেড়ে বলল,
‘বাবা আসবো ভিতরে?’
চোখ বুঁজে কপালে হাত রেখে শুয়ে ছিলেন জামাল এহতেশাম। আজকের দিনের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত তিনি। তানভীরের গলার আওয়াজ পেয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত তখন সাড়ে বারোটা। নিস্তেজ আওয়াজ পাওয়া গেল জামাল এহতেশামের, ‘আয়।’
তানভীর রুমে ঢুকেই এক কাপ কফি এগিয়ে দিল তার বাবার দিকে। কফির কড়া ঘ্রাণ নাকে আসতেই তিনি ফের বললেন,
‘এখন কফি? আমার তো তাহলে আজকে আর ঘুম আসবে না।’
‘একদিন না ঘুমালে কিছু হবে না বাবা। এই মৃত্যুপুরীতে না বাবা আর ছেলে মিলে আজকের রাতটা গল্প করে কাটিয়ে দিলাম।’
জামাল এহতেশাম কফির কাপটা হাতে নিলেন। তানভীরও বালিশে হেলান দিয়ে বসলো।
বাবা আর ছেলে একসাথে কফিতে চুমুক দেয়।
তানভীর কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেঝের দিকে।
‘তুমি বরাবরই কাজ পাগল মানুষ তাই না বাবা? আর সেজন্যই তুমি আর আমরা দুই ভাইবোনের দূরত্ব একটু বেশি।’
হাত থেমে যায় জামাল এহতেশামের। অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে রাখলেন তিনি। ছেলের চোখে চোখ রাখার সাহস হলো না। গত হওয়া দিনের ঘটনাও যে আলোচনায় আসবে বুঝতে আর বাকি নেই উনার।
‘মায়ের সাথে আমাদের সান্নিধ্য একটু বেশি। একটু না অনেকটা। বলতে পারো আমাদের জীবনের প্রথম বন্ধু হলো মা। মা’ই একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে অকপটে আমরা আমাদের প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য, গোপনীয় সব কথা শেয়ার করতে পারি। আমাদের পছন্দকে মা একটু বেশি প্রাধান্য দেয়। যার ফলাফল তোমরা টিনএজের মতো ঝগড়া করো।’
বলেই হু হা করে হাসতে লাগল তানভীর। হাসতে হাসতে চোখের কোণে পানি জমে তার। ভেজা চোখের কোণ সে খুব দ্রুতই মুছে নিলো।
এরপর নীরবতা নামে আবার। কারো মুখে কোনো রাঁ নেই। জামাল এহতেশামের কাছে আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার মতো কোনো কথা নেই। তাই তিনি একদম চুপ আছেন। অন্যদিকে তানভীর সময় নিচ্ছে আরো কিছু বলার জন্য।
‘আমি যখন প্রথমবার পিয়া কে দেখি তখন ও একদম বাচ্চা। ক্লাস নাইন কিংবা টেনে পড়ে। আবার ক্লাস এইট ও হতে পারে।’
পিয়ার প্রসঙ্গ আসতেই জামাল এহতেশাম যেন থমকালেন কিঞ্চিৎ।
‘সেই সময়টাতে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল এই মেয়েটাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। এক পলক দেখায় মনে হয়েছে আমার দৃষ্টি শীতল হয়েছে।’
এতটুকু বলেই তানভীর থেমে যায়। নীরব থাকে কয়েক মুহুর্ত। পুনরায় বলল,
‘তোমার সাথে কখনো এসব নিয়ে আলোচনা করিনি আমি। নিজের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে আলোচনা করার জায়গাটা তো তুমি তৈরি করোনি। তাই অস্বস্তি হচ্ছে। তারপরও কিছু কথা তোমার জানা প্রয়োজন। আমি কী আমার কথা এগিয়ে নিবো?’
জামাল এহতেশাম কিছু বলতে চাইলেন। কি ভেবে যেন আর বললেন না। শুধু ছোট্ট করে বলেন,
‘বলো তুমি। আজকের আলোচনায় যদি আমাদের দূরত্ব একটু হলেও কমে।’
তানভীর নড়েচড়ে বসে। কফি প্রায় শেষের পথে।
‘বাবা সেদিনের পর আমি অনেকগুলো রাত ঘুমোতে পারিনি। শুধু এই ভেবে মেয়েটা অব্দি কিভাবে আমি পৌঁছাবো। মায়ের কোলে মাথা রেখে ওই এক পলক দেখার গল্প শতবার করেছি। মা কখনো বিরক্ত হয়নি। বরং আগ্রহ নিয়ে শুনতো সবসময়। মায়ের কাছে বায়না ধরতাম মা তুমি আল্লাহর কাছে বলো যেন আমাদের আবার দেখা হয়। আর সেই মেয়েকে যেন আমার বউ করতে পারি। মা হাসতো। কেবল হাসতো।এরপর কেটে যায় অনেকগুলো বছর । আবার দেখা হয় আমাদের। আমি পিয়ার সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করি। মাকে জানাই। সেদিন আমার থেকে বেশি খুশি বোধ হয় মা’ই হয়েছিল। তারপর তোমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার অনুপস্থিতিতে বিয়ের ব্যবস্থা করে। মা জানতো তুমি ঢাকাতে থাকলে এই বিয়ে সম্ভব না।’
দম নিলো তানভীর। অনর্গল কথা বলে যেন গলা শুকিয়ে এসেছে। কফির কাপে শেষ চুমুকটা দিলো সে। জামাল এহতেশাম কফি শেষ করে তানভীরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তানভীর খালি কাপটা কোথায় রাখবে ভেবে না পেয়ে মেঝেতেই রাখল। আকস্মিক বলে বসল,
‘মাকে যদি কেউ অপমান করে তোমার কেমন লাগবে?’
#চলবে
#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (১৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
ভীষণ চমকালেন জামাল এহতেশাম। স্তম্ভিত চোখে একবার তানভীরকে পরখ দ্রুত নামিয়ে নিলেন দৃষ্টি। আজ ছেলের কাছে পদে পদে কাবু হচ্ছেন। প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ তিনি। তাই রইলেন নিরুত্তর।
তানভীর তাকিয়ে রইলো উত্তর আশায়। দৃষ্টি একদম প্রখর এবং স্থির। জামাল এহতেশামের কপালে জমায়েত হওয়া বিন্দু বিন্দু ঘাম। তানভীরের তা চোখ এড়ায় না।
তানভীরের বলিষ্ঠ কন্ঠ দিয়ে স্ফুরিত হয়,
‘সংসার না করলেও পিয়া আমার স্ত্রী। কবুল বলে গ্রহন করেছি আমি। আমার স্ত্রীকে সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমারই। তাকে অপমান করা কথাগুলো যে গলা দিয়ে বের হয়েছে সেই গলার চেপে ধরে সারাজীবনের মতো কথা বন্ধ করার সাহস আমার আছে। কিন্তু সেই শিক্ষাটুকু আমার মা আমাকে দেননি।’
জামাল এহতেশাম এদিক ওদিক তাকিয়ে হাসফাস করতে লাগেন। লজ্জায় ছেলের চোখে চোখ রাখতে পারছেন না তিনি। প্রতিটা কথা ধ্রুব সত্য। তানভীর আবারও মুখ খুলে। আজ যেন কেবল তানভীরের বলার দিন।
‘তোমার সামনে আমার মাকে কেউ একজন হুমকি দিয়ে কথা বলে। আর তুমি চুপ ছিলে সেই সময়। সন্তান হয়ে যদি প্রশ্ন করি তোমাকে স্বামী হিসেবে কতটা যোগ্য তুমি। উত্তর দিতে পারবে?’
জামাল এহতেশাম এবারে উত্তর দিতে পারলেন না। স্বামী হিসেবে তিনি কতটা যোগ্য এই উত্তরটা আসলেই উনার কাছে নেই।
_________________
টিউশন থেকে ফেরার পথে এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনার সাক্ষী হয় পিয়া। পিক-আপ ভ্যান জনৈক এক ভদ্রলোককে চাপা দিয়ে সাঁই সাঁই বেগে চলে গেলো। এক্সিডেন্ট স্পট আর পিয়ার বেশ খানিকটা দূরত্ব থাকলেও সবকিছুই সে দেখেছে। এরকম একটা দূর্ঘটনা চোখের সামনে দেখে একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তেই চোখের সামনে কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারছে না। পিয়ার পা কাঁপতে থাকে। সামনে কদম ফেলার সাহস পায় না। হুড়োহুড়ি সেখানে জট পাকিয়ে যায়। এক এক করে আশেপাশের সবাই দৌড়াদৌড়ি করে সেদিকে যাচ্ছে। পিয়াই কেবল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জোরে জোরে শ্বাস নিলো পিয়া। একটু সাহস সঞ্চার করে পা বাড়ায় নিজের গন্তব্যে। মনে মনে ভাবলো ভুলেও জট পাকানো জায়গার দিকে সে তাকাবে না। নয়তো র*ক্ত দেখে সে নিজেই এখন অসুস্থ হয়ে যাবে। ব্যাগটা চেপে ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরটা যেন ধীরে ধীরে আরো দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। পিয়ার ভীতসন্ত্রস্ত পা চলতে চলতে ঠিক জট পাকানো জায়গায় এসেই থেমে গেলো। সামনে কদম ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করল কিন্তু পারল। পথের মধ্যে যেন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিবেক। মনে হচ্ছে বিবেক চিৎকার করে বলছে, ‘একজন মানুষকে বিপদে ফেলে চলে যেতে পারবি তুই পিয়া? এটাই তোর মানবিকতা?’
পিয়া যেতে পারেনি নিজের গন্তব্যে। র*ক্তভীতি ডিঙিয়ে ভীর ঠেলে যায় দূর্ঘটনার শিকার হওয়া মানুষটাকে একটা নজর দেখতে।
র*ক্তে মাখামাখি মুখটা দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে পিয়ার। ‘বাবা’ বলে আর্তনাদ করেই বসে পড়ল সে। চোখ ভিজে ওঠে বুক ভেঙে আসে তার। হাত পা জোড়া কাঁপতে কাঁপতে ঠান্ডা হয়ে আসে। এতোগুলো মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে পিয়া চিৎকার করে উঠল,
‘আপনারা মানুষ? আপনাদের কি বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়েছে? একটা মানুষ মা*রা যাচ্ছে আর আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন।’
পিয়া তড়িঘড়ি করে জামাল এহতেশামের মাথাটা কোলে তুলে নিলো। র*ক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো তার হাত আর গায়ের জামা ওড়না। জামাল এহতেশামের নিস্তেজ হাতে থাকা চকলেট ফ্লেভারের কোণ আইসক্রিমটাও যেন র*ক্তে গোসল করেছে।
‘বাবা আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমাকে? কথা বলুন না বাবা। আপনার কিছু হবে না। আপনাকে আমি এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাবো। কথা বলুন না বাবা।’
পিয়ার কান্নার মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছতে নিলেই দৃষ্টিগোচর হয় তার র*ক্তাক্ত হাত। আজ রক্তভীতি না থাকলেও আজ হচ্ছে হারিয়ে ফেলার ভয়। পিয়া আবারও আর্তনাদ করে উঠে,
‘আপনারা প্লিজ কেউ একটা গাড়ি ডাকুন না। আমার বাবাকে দয়া করে বাঁচান।’
ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল,
‘উনি আপনার বাবা?’
‘শ্বশুর।’ এটা বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। তারপর দৃঢ় গলায় বলল, ‘ হ্যা আমার বাবা। আপনারা প্লিজ একটা কিছু করুন। বাঁচান উনাকে। মনে হচ্ছে শরীরের সব রক্ত বের হয়ে যাবে।’
‘আপনি শান্ত হন। একজন গিয়েছে গাড়ির জন্য । এখনি নিয়ে আসবে।’
বলতে বলতে একটা সিএনজি এসে থামল সেখানে।
___________________
ক্লান্ত বিকেল!
কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আমার ল্যাপটপে আপনমনে কাজ করছে তানভীর। আচমকা মোবাইল বেজে উঠতেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল সে। দৃষ্টি বুলায় মোবাইলের দিকে। স্ক্রিনে রাজমহিষী নাম দেখেই ঠোঁট প্রসারিত হয় তার। বিলম্ব করলো না দ্রুত হাতে ফোন উঠালো সে।
‘তিনদিন পর অভিমান কমলো তবে আমার রাজমহিষীর? দয়া হলো আপনার? কথা বলতে ইচ্ছে হলো এই অধমের সাথে?’
সেদিনের ঘটনার পর তানভীর হাজার চেয়েও পিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়নি। পিয়া না কল রিসিভ করেছে না মেসেজের রিপ্লাই করেছে। তানভীর তার বাসার সামনেও দাঁড়িয়েছিল। তবে পিয়ার দেখা পায়নি।
‘আপনি কোথায়? র*ক্ত বাবা আসুন।’
হেঁচকি ওঠা কন্ঠ স্বর। কান্নামাখা গলায় অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণ কতগুলো শব্দ। পিলে চমকে উঠে তানভীরের। বুকের ভেতরে উদিত হয় ভয়ের সূরু। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। চকিত গলায় জানতে চাইল,
‘কী হয়েছে পিয়া? তোমার বাবার কিছু হয়েছে। বুঝতে পারছি না তো। স্পষ্ট করে বলো না।’
তানভীরের কন্ঠস্বর কাঁপছে। ভয়ে টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
পিয়া অস্পষ্ট স্বরে থেমে থেমে আবারও কতগুলো কথা বলল,
‘সব র*ক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি ভিজে যাচ্ছি। ঢাকা মেডিকেল।’
তারপর ঠাস করে কল কে’টে গেলো। এরপর হাজার কল করেও পিয়াকে পাওয়া গেলো না। যতবারই পিয়ার নাম্বারে ডায়াল করেছে ততবারই ভেসে এসেছে অপরিচিত মহিলা কন্ঠস্বর।
‘আপনি যে নম্বরে ডায়াল করেছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল সুইচ অফ নাউ।’
ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে আসে তানভীরের। এসির মধ্যেও ঘামতে থাকে টেনশনে। এলোমেলো পায়ে পায়চারী করে কতক্ষণ। ব্রেইন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছে না সে। পিয়ার সেই আধভাঙা কথাগুলোও স্পষ্ট নয়। কার কি হয়েছে সেটাও বোধগম্য নয়।
তানভীরের তখনই মনে পড়ে পিয়ার বলা শেষ কথাটা ‘ঢাকা মেডিকেল’। এখন সেখানে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
গলার টাই ঢিলে ছুটলো সেই গন্তব্যে।
_______________
হাসপাতাল যেমন আনন্দ করার জায়গা। ঠিক তেমনি জীবন থেকে চিরতরে আনন্দ হারিয়ে যাওয়ার জায়গাও। নবজাতক শিশু যখন ভূমিষ্ট হয় পরিবারে যেমন খুশির অন্ত থাকে না। তেমন করে দীর্ঘদিন জীবন আর মৃত্যুর সাথে লড়াই করার পর কেউ যখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ আল্লাহর জিম্মায় চলে যান সেই পরিবারে নেমে আসে শোক। বেডে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর আর্তনাদ শুনলে একজন সুস্থ মানুষের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে।
উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছে তানভীর। চোখেমুখে একরাশ অসহায়ত্ব।জরুরি বিভাগে এসে এতো মানুষের ভীড়ে পাগলের মতো খোঁজে বেড়াচ্ছে পিয়াকে। খুঁজতে খুঁজতে আবার কল লাগায় পিয়ার নাম্বারে। ফলাফল শূন্য। জরুরি বিভাগে আরেক দফা খুঁজলো। কাউকেই দেখতে পেলো না।
ঘামে জুবুথুবু অবস্থা তানভীরের।বেরিয়ে এলো বাইরে। চাতক পাখির মতো দেখতে লাগল রোগী নিয়ে আসা অটোরিকশা, সিএনজি আর এ্যাম্বুলেন্সগুলোর দিকে।
ঠিক তখনই একটা সিএনজি এসে থামল তার সামনে। সিএনজি থেকে নামে পিয়া।
র*ক্তে রঞ্জিত পিয়ার জামা ওড়না। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হওয়া চোখ। শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট। আঁতকে উঠল তানভীর। টিউশন থেকে ফেরার পথে এক্সি*ডে*ন্ট করেছে? কথাটা মস্তিষ্কে ঘুরতেই দম বন্ধ হয়ে আসে তার। জনাকীর্ণ পরিবেশের কাউকে তোয়াক্কা না করে একছুটে গিয়ে পিয়া জড়িয়ে ধরলো। এমনভাবে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো যেন কোনো বিপদ তাকে স্পর্শ না করে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে শক্ত হয় হাতের বাঁধন। সাথে তানভীরের আতংকিত কন্ঠস্বর,
‘র*ক্তে লেপ্টানো দেহ তোমার। হৃদয়ে পীড়ন হচ্ছে আমার। তোমার সমস্ত শারীরিক যন্ত্রণা আমার হয়ে যাক।কষ্টেরা আমায় গিলে নিক।’
#চলবে