উষ্ণ আঁচে ভালোবাসা পর্ব-২১+২২

0
3

#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (২১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘পিয়াকে আ*ঘা*ত করার সাহস আপনি কোথায় পেলেন? কে আপনি?’

তানভীর উত্তেজিত হয়ে পড়ে।

তানভীরের হুঙ্কারে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন জামাল এহতেশাম আর তারেক।

তানভীরের শরীর কাঁপছে। চোখজোড়া টকটকে লাল।

‘পুলিশের কাছে গেলে ৪৮ ঘন্টাও আর আমরা অপেক্ষা করবো না। তার আগেই,,,,,

এইটুকু বলে আবারও বিকট শব্দে হাসতে লাগলো লোকটা।

হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় তানভীর। ফুলে উঠেছে তার কপালের শিরা। দাঁত কিড়মিড় করে সে।

‘আমার পিয়া কোথায়?’

কর্ণগোচর হয় পিয়ার ফোঁপানোর নিনাদ। আকুতি করছে সে।

‘আমাকে বাঁচান তানভীর। আমাকে বাঁচান।’

এরপর লাইন কে’টে গেলো। ধপ করে মেঝেতে বসে যায় তানভীর। হাতে থাকা মোবাইলটা ছিটকে পড়ল দূরে গিয়ে।

উৎকন্ঠিত সকলে। সকলের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার রেখা। ভয়ে মায়ের বুকে লেপ্টে আছে মিষ্টি। তাহমিনা হক ছেলের পাশে বসলেন। কোমল হাত খানা রাখলেন তানভীরের মাথায়।

তানভীর টলমলে চোখে চাইলো মায়ের দিকে। নিস্তেজ গলায় বলল,

‘ওরা আমার পিয়ার গায়ে হাত তুলেছে মা। ওরা আমার পিয়াকে তুলে নিয়ে গেছে।’

মুখ চাওয়া চাওয়ি করে তারেক আর জামাল এহতেশাম।

তানভীর পুনরায় বলল, ‘মুক্তিপণ দাবি করেছে।’

তারেক দ্রুত গতিতে তানভীরের মোবাইল হাতে নেয়। কল লিস্ট চেক করে পিয়ার নাম্বারটা পায়।সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,

‘ভাবির নাম্বার থেকে কল এসেছে?’

তানভীর মাথা ঝাঁকায়। বিলম্ব করে না তারেক দ্রুত পিয়ার নাম্বারে আবার ডায়াল করে। দূর্ভাগ্যবশত পিয়ার নাম্বারে আর কানেক্ট করা যায়নি। আগেই মোবাইল বন্ধ করে ফেলেছে কি*ড*ন্যাপার।

তারেক কাকে যেন কল করে।

‘আমি একটা নাম্বার পাঠাচ্ছি। একটু আগে এটা লোকেশন কোথায় ছিল তা ট্রেস করে আমাকে জানাও।’

তানভীর চিৎকার করে উঠে, ‘না।’

তারেক জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। তানভীর হাতজোড় করে।

‘পুলিশ ইনভলভ হলে ওরা আমার পিয়াকে মে’রে ফেলবে।’

তারেক তানভীরের কাঁধে হাত রাখে।

‘অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার কথা বলছো?’

আর্তনাদ করে ওঠে তানভীর ।

‘কিছু দেওয়ার কথা বলছি না। আমি শুধু আমার পিয়াকে চাই। আমার জীবিত পিয়াকে। আর কিচ্ছু না।’

‘ইয়েস, আমাদের যেমন সুস্থ সবল পিয়াকে চাই। ঠিক তেমনি অপরাধীকেও চাই। আর আমরা তো বলবো না যে পুলিশ ওকে ধরতে যাচ্ছে।’

জামাল এহতেশাম খোঁড়াতে খোঁড়াতে ধপ করে সোফায় বসলেন। তাহমিনা হকের মনোযোগ কেবল ছেলের দিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন অনবরত।

তারেক পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

‘কোথায় টাকা দিতে হবে লোকেশন বলেছে?’

তানভীর না বোধক মাথা নাড়ায়।

তারেক বিশ্বজয়ের হাসি দিলো।

‘প্লাস পয়েন্ট। তারমানে লোকেশন বলার জন্য আবারও কল করতে পারে।’

তানভীর অসহায় নেত্রে তাকায়। করুণ স্বরে বলল,

‘ওরা টের পেলে আমার পিয়ার কোনো ক্ষত করে দিবে না তো?’

তারেক আশস্ত করে। ‘ভরসা রাখো।’

তানভীর ভরসা করতে পারে না। সেকেন্ডে সেকেন্ডে তার কেবল ভয় বাড়ে। প্রিয়তমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

মোবাইল বেজে উঠল তারেকের হাতে। খেয়াল করে দেখে তানভীরের মোবাইল। স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে শ্বশুর বাবা নাম।

‘তোমার শ্বশুর ফোন দিয়েছে।’

তারেক কল রিসিভ করে লাউডে দিল। শোনা গেলো বেলাল শেখের আর্তনাদ।

‘তানভীর বাবা আমার মেয়ে, আমার কলিজার টুকরা। আমার মেয়ে ওদের কাছে। যে মেয়েকে আমি এখন পর্যন্ত ফুলের টোকা দেইনি সে মেয়ে কে ওরা আ*ঘাত করেছে।’

‘আঙ্কেল আমি তারেক। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।’

‘তোমার আন্টি বেহুশ হয়ে পড়ে আছে বাবা। চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়েছি চোখ খুলছে না। একদিকে মেয়ের টেনশন অন্যদিকে তোমার আন্টি।বড্ড অসহায় লাগছে বাবা।’

তাহমিনা হক ছোঁ মে*রে মোবাইল নিয়ে নিলেন।ভণিতা না করেই বললেন,

‘এই মুহুর্তে আপনাদের একা থাকা ঠিক না। আমি কাউকে পাঠাচ্ছি। বেয়ানকে নিয়ে আমাদের এখানে চলে আসুন।’

বেলাল শেখের জবাবের আশা না করে কল কে’টে দেন তিনি। পুনরায় বলেন,

‘তারেক তুমি যাও। নিয়ে আসো উনাদের। উনারা একা থাকা অনেক রিস্ক। তানভীর তুই ও যা। তোকে দেখলে তারা একটু ভরসা পাবে।’

তানভীর নড়ল না। একচুলও না। এ-ই জগতে যেন সে নেই। তাহমিনা হক রেগে গেলেন। গর্জে উঠেন তিনি।

‘বিপদে ভেঙে পড়ার শিক্ষা আমি তোকে দিয়েছি? বলেছি না বিপদ আসলে ঠান্ডা মাথায় সামাল দিতে। তারেকের সাথে যা।’

না চাইতেও উঠল সে। উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়াল। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,

‘পিয়াকে পাবো তো মা?’

ছেলের মাথায় মুখে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেন তিনি।

‘ইনশাআল্লাহ।’

বেজে উঠল তারেকে মোবাইল। বিলম্ব না করে সে রিসিভ করল।

‘লোকেশন ট্রেস করেছো?’

ওপাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। তারেক পুনরায় বলল,

‘নাম্বার টা নজরে রাখো। এটা যেকোনো সময় ওপেন হতে পারে। এটার লোকেশন আমার প্রয়োজন।’

তানভীর হম্বিতম্বি করে জিজ্ঞেস করে,

‘লোকেশন জানতে পারলে তারেক?’

তারেক কথা শেষ করে মোবাইল পকেটে রাখে। মাথা নেড়ে সায় জানায়।’

‘দিয়া বাড়ির দিকে আছে। তবে পিয়ার মোবাইল বন্ধ। তবে মনে হয় না ওরা আর দিয়াবাড়ি থাকবে।’

তানভীর উন্মাদের মতো তারেকের হাত ধরে টানে। তাড়া দিয়ে বলে,

‘তবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো দিয়া বাড়ির দিকে। আমিও যাবো।’

হাত ছাড়িয়ে নেয় তারেক।

‘কি হলো?’ প্রশ্ন করে তানভীর।

‘তোমাকে নেওয়া যাবে না।’

তারেক কথায় পাগলামি বাড়ে তানভীরের।

‘না না। আমি যাবো। তুমি না নিলে আমি একাই যাবো।’

তারেক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

‘তুমি আমার সাথে যাওয়া টা রিস্ক।’

‘আমি ওতো কিছু জানি না। আমি যাবো মানে যাবো। ওরা আমার পিয়ার গায়ে হাত তুলেছে। আমি কাউকে ছাড়বো না।’

তানভীরের কাঁধে হাত রাখে তারেক। বোঝানোর চেষ্টা করে।

‘আমি এবং আমার ফোর্স যাবো সিভিলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুঁজবো। বাই এ্যানি চান্স ওরা যদি তুমি গেলে চিনে যায় তবে পিয়ার জন্য ভয়ংকর বিপদ হবে।’

তানভীর নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক ভুল কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

‘আমি আসি তবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। দিয়া বাড়ি যেতেও সময় লাগবে।’

তানভীর বেপরোয়া হয়ে উঠে। যাওয়ার জন্য রীতিমতো বেড়ে যায় তার পাগলামি। তারেক পড়ে যায় বিপাকে। সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান তাহমিনা হক।

‘তানভীর তুমি কি চাচ্ছো? মেয়েটার বিপদ?’ তাহমিনা হক প্রশ্ন করলেন কঠিন গলায়।

তানভীর কিঞ্চিৎ শান্ত হয়। নরম হয় স্বর।

‘মনে মানে না মা।’

‘তুমি কিন্তু তারেকের সময় নষ্ট করছো আর পিয়ার আরো বিপদ ডেকে আনছো। ও এতোক্ষণে অনেকটা পথ চলে যেতে পারতো।’

তানভীর আস্তে করে বলে, ‘তুমি যাও তারেক।’

তারেক বিলম্ব করলো না। কাকে যেন ফোন করতে করতে ঝড়ের গতিতে চলে গেলো।

‘চলো পিয়ার বাবা মায়ের কাছে। আমিও তোমার সাথে যাবো। তোমাকে একা ছাড়া যাবে না।’

________________

জায়নামাজে লুটিয়ে পড়ে আছেন শিরিন আহমেদ। কখনো ডুকরে কেঁদে উঠছেন তো কখনো দুহাত তোলে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছেন। কখনো বা নিস্তব্ধতায় মুড়িয়ে নিচ্ছেন নিজেকে।

অদূরে বসে আছেন বেলাল শেখ। অনুভূতিশূন্য তিনি। একরাতের ব্যবধানে চোখমুখের অবস্থা নাজেহাল।

যোহরের আজান পড়েছে। বেলাল শেখ চোখজোড়া বন্ধ করে নিলেন। কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো টেরই পেলেন না তিনি। আজান শেষ হলো। রৌদ্রজ্বল আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। বুকের ভেতরটায় ছ্যাৎ করে উঠে। চারিদিকে কেবল হাহাকার। যেন একটু একটু করে সব আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর তিনি বাবা হয়েও কিছু করতে পারছেন না।

তাহমিনা হক এলেন। শিরিন আহমেদ কে স্পর্শ করতেই হুড়মুড় করে উঠে বসেন।

‘আমার পিয়া? আমার পিয়া এসেছে বুঝি?’

তাহমিনা হক এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ান। শিরিন আহমেদ ফুঁপিয়ে উঠলেন। লুটিয়ে পড়লেন আবারও জায়নামাজের পাটিতে।

‘আল্লাহ আমার কলিজার টুকরাকে ফিরিয়ে দাও। আমার বুকটা খালি করো না মা’বুদ।’

‘পিয়া ফিরবে বেয়ান। পিয়া ফিরবে। তার আগে আপনাকে তো কিছু খেয়ে সুস্থ থাকতে হবে।’

শিরিন আহমেদ অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,

‘আমার মানিক আমার বুকে না ফিরলে কিছু খাবো না আমি। কিচ্ছু না।’

___________________

রকিং চেয়ারে দুলছেন জামাল এহতেশাম। খোলা জানালা দিয়ে গরম বাতাস গায়ে লাগছে। জানালা ভেদ করে আসা প্রখর রোদ স্পর্শ করেছে পা। অথচ সেদিন উনার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। চোখ বন্ধ করে আঙ্গুল নাড়াচ্ছেন আর কিছু একটা ভেবে চলেছেন তিনি।

বাইরে থেকে তারেক এসে সোজা জামাল এহতেশামের রুমে ঢুকলো। উসকোখুসকো চুল তার। সারারাতের নির্ঘুমে চোখ জোড়া ঈষৎ লাল। শুষ্ক ঠোঁট। ক্লান্ত তার দেহ।

‘বাবা?’

জামাল এহতেশাম চোখ মেলে তাকালেন। নিরেট গলায় প্রশ্ন করলেন,

‘কি খবর?’

তারেক এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে। পরক্ষণেই তার কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। ভাবুক গলায় বলল,

‘কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না,,,,,,,

কানে মিষ্টির কান্নার আওয়াজ আসতেই থেমে যায় তারেক। চুপচাপ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।

মিষ্টির কান্না থামাতে থামাতে এদিকে আসছিলো আফরিন। তারেকের গলার আওয়াজ পেয়ে বাবা মায়ের রুমে উঁকি দেয় সে। তারেক কে এখানে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে।

‘তুমি কখন এলে?’

‘এখনই।’

‘ভাবির কোনো খবর পেলে?’

তারেক এপাশ-ওপাশ মাথা দুলায়।

আফরিন সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো,

‘ তবে আমাদের রুমে না গিয়ে এখানে কি করছো?’

তারেক আইঢাই করে। প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য প্রশ্ন করে,

‘তানভীর কোথায়?’

সরু চোখে তাকায় আফরিন। জামাল এহতেশাম কে সামনে দেখে কঠিন গলায় কিছু বলতে গিয়েও বলে না।

‘ভাইয়া কোথাও একটা গেলো। বলল চিন্তা না করতে।’

_________________

নিরিবিলি পরিবেশ। ছায়া যুক্ত একটা বেঞ্চিতে বসে আছে তানভীর আর তানিয়া। দুপুর বিধায় জনমানসের সংখ্যাও কম।

অস্বস্তি আর জড়তা নিয়ে বান্ধবীর স্বামীর পাশে বসে আছে তানিয়া। মিউয়ে যাওয়া চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ এই জরুরি তলবের কারণ অর্থোদ্ধার করতে পারছে না সে।

তানভীর দৃঢ় কন্ঠে জানতে চাইলো,

‘পিয়া কোথায় তানিয়া?’

তানিয়া কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়। মিনমিনে স্বরে উত্তর করলো,

‘সে তো আপনি জানেন ভাইয়া। পিয়াকে আপনার কাছে রেখে আমায় কেন জিজ্ঞেস করছেন?’

তানভীর বুঝলোনা কথার মানে। কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ।

‘মানে?’

তানিয়া বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসে। চোখ পিটপিটিয়ে বলল,

‘দুইজন যুক্তি করে আমাকে বোকা বানাতে এসেছেন তাই তো? প্রাঙ্ক করছেন আমার সাথে? পিয়া তো আপনার কাছে।’

তানভীর নিরেট গলায় বলল,

‘পিয়াকে কেউ অপহরণ করেছে।’

তানিয়া ধপ করে দাঁড়িয়ে গেলো। কোলের উপরে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগটা গড়িয়ে পড়ল নিচে। মুখের হাসি হাসি ভাবটা উবে গেলো তার। কঠোরতা ভর করে আনন জুড়ে।

‘মজা করছেন আমার সাথে? যদি মজা করেন তবে এখানেই থেমে যান। কারন পিয়া আমার বান্ধবী কম বোন বেশি।’

‘মুক্তিপণ ৩০ লাখ।’

রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে যায় তানিয়ার মুখ। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো জিভ দিয়ে। শরীর তার কাঁপছে। কণ্ঠনালী তিরতির করে কাঁপছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে গলায়। তানভীরের চোখ বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা বলছে না। তানিয়া উদ্বিগ্ন গলায় বলল

‘না না টা কি করে হতে পারে। পিয়ার তো কাল আপনাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল।’

ঝটকা খায় তানভীর। হম্বিতম্বি করে প্রশ্ন করলো

‘মানে?’

তানিয়া উদ্ভ্রান্তের মতো ব্যাগ হাতরে মোবাইল বের করলো। মেসেঞ্জার থেকে গতকাল পিয়ার পাঠানো মেসেজটা দেখায় তানভীর কে।

‘আমি না ফিরলে চিন্তা করিস না।’

তানভীর বিলম্ব না করে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

‘খোলে বলো।’

তানিয়া ব্যাগ থেকে আবারও পানির বোতল বের করে। ঢকঢক করে মুহুর্তেই অর্ধেক বোতল খালি করে ফেলল।

‘আপনার বাবা মিট করেছিল পিয়ার সাথে। একটা শাড়ি দিয়ে বলেছিলেন কাল আপনাদের বাসায় যেতে। বিরাট সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। আর ও যখন মেসেজটা পাঠায় আমি ভেবেছি আপনারা হয়তো হানিমুনে যাবেন। সেজন্য কাল না ফিরাতে ওতো টেনশন করিনি। টেনশন করার তো অবকাশই ছিলো না। কিন্তু আজ এটা কি বললেন।’

বলেই ঠোঁট কামড়ে ধরে সে। গণ্ডদেশে চিক চিক করছে নোনাজল। তানিয়া হাতজোড় করে তানভীরের সামনে।

‘আমার বান্ধবীকে বাঁচান ভাইয়া।’

কিছুই কানে গেলো না তানভীরের। ক্ষীণ আশার আলো পাবার জন্য এসেছিলো সে। তবে কি পুরো পথটাই তার সামনে জ্বল জ্বল করছে এখন? তানভীর আপনমনে বিড়বিড় করে,

‘পিয়ার কিডন্যাপটাই ছিলো টিনার জন্য স্পেশাল সারপ্রাইজ? তবে কি সবকিছুর পিছনে বাবা?’

#চলবে

#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (২২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

বেলা নেমে এসেছে। চারিদিকে ভ্যাপসা গরম আর ক্লান্তি ভাব। হয়তো গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা এখনই দিচ্ছে। জামাল এহতেশাম রকিং চেয়ারে তখনো দুলছিলেন। আর আঙুল নাচিয়ে কিছু একটা হিসাব করছিলেন।

উন্মাদের মতো জামাল এহতেশামের কক্ষে এলো তানভীর। দরজায় হাতের থাবা দিতেই বিকট শব্দ হলো। মনোযোগ নষ্ট হয় ভদ্রলোকের। কপাল কুঁচকে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তবে মুখে কিছু বললেন না।

বিকট শব্দ হতেই এদিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে সবাই। তানভীরের পিছনে তানিয়া কে দেখে অদ্ভুত চোখে তাকান তাহমিনা হক। তিনি তানিয়াকে আগে কখনো দেখেননি। চিনতে অসুবিধা হলো উনার।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধীর পায়ে এলেন শিরিন আহমেদ আর বেলাল শেখও।

তানিয়া কে দেখা মাত্রই শিরিন আহমেদ দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন। নিভু নিভু গলায় বললেন,

‘আমার মানিক কোথায় গেলোরে মা? আমার কলিজার টুকরা কই? আমার বুকটা যে ফেটে যায়।’

তাহমিনা হক তানিয়া কে না চিনলেও বুঝতে পারলেন মেয়েটা তাদের পরিচিত।

রক্তচক্ষু তানভীরের। কপালের শিরা ফুলে উঠেছে রাগে। ফুস ফুস করে সাপের মতো নিঃশ্বাস ফেলছে সে।

‘তানিয়া বলো সবটা।’

সবার চোখেমুখে বিস্ময়। কী বলবে তানিয়া? শিরিন আহমেদ তানিয়া কে ছাড়লেন। চোখের পানি মুছে টলতে টলতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন।

তানিয়া ভয়ার্ত চোখে এক নজর সবাইকে দেখলেন। ভয়ে ফাঁকা ঢুক গিলল সে। তানভীর পুনরায় বলল,

‘ভয় পেয়ো না তানিয়া। সত্যিটা বলো। তোমার সিকিউরিটির দায়িত্ব আমার।’

ভয়ে গলা শুকায় তানিয়ার। তটস্থ গলায় থেমে থেমে বলল,

‘ঠা,,ঠান্ডা পানি হবে?’

‘আফরিন এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।’

মিষ্টিকে তারেকের কোলে দিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো একগ্লাস ঠান্ডা পানি তানিয়ার হাতে দিলো আফরিন। পানি খেয়ে তানিয়া বলা শুরু করলো,

‘আট দশ দিন আগের ঘটনা। টিউশন শেষ করে বাসায় আসতে আসতে ওর প্রায় সন্ধ্যা হয়। তবে ওর সেদিন আসতে অনেক দেরি হচ্ছিল। দেরি দেখে আমি বেশ চিন্তায় পড়ে যাই। ফোন করাতে বলল ওর দেরি হবে চিন্তা না করতে। তারপর,,,,,

******
রাত সাড়ে আটটা কি নয়টা। পিয়া একটা শাড়ি বিছানার উপর রেখেই ধপ করে শুয়ে পড়লো। তানিয়া বই বন্ধ করে শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে বলে,

‘শাড়িটা দেখতে তো বেশ।’

গাল ফোলায় তানিয়া। অভিমানে গলায় পুনরায় বলল,

‘তুই শপিংয়ে গেলি আর আমাকে বললি না?’

পিয়া লাজুক হাসল। চোখে চিকচিক করে আনন্দের অশ্রু।

‘ইট’স তোহফা ফ্রম শ্বশুরবাবা।’

তানিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। কান চুলকে বলল,

‘আবার বল।’

পিয়া আবেশে চোখ বুঁজে নিলো। চিবুক স্পর্শ করে চোখের জল। এতে নেই বিষাদ। আর না বিষন্নতা। আছে কেবল অনাবিল সুখ।

‘মায়ের শাড়ি ছেলের বউকে দিয়ে আহবান করেছে মা হওয়ার জন্য। ছেলের বউ নয় মা রূপে আগে বাড়িতে প্রবেশ করার জন্য। জীবনে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই তানিয়া। মন জয় করতে গিয়েছিলাম। সরাসরি মায়ের জায়গাটাই যে পেয়ে যাবো বুঝিনি।’

অত্যোধিক আবেগে পিয়ার গলা ধরে আসছে বার বার। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট।

তানিয়ার বিশ্বাস হয় না। সন্দিহান গলায় বলল,

‘এখানে কোনো মতলব নেই তো পিয়া?’

পিয়া মাথা দুলায়।

‘উহ্! মুখ মিথ্যা বললেও চোখ কখনো মিথ্যা বলে না। আমি উনার চোখে অনুশোচনা দেখেছি। আবার কৃতজ্ঞতাবোধও দেখেছি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে করুণ স্বরে মা বলে ডেকেছেন তিনি। এই ডাকে কোনো মতলব নেই। থাকতে পারে না।’

পিয়ার গালে আলতো করে হাত রাখে।

‘তোর চাওয়ায় কোনো ভুল ছিলো না। আর না ছিল পাপ। তুই ধৈর্য্য ধরেছিস। তাই আল্লাহ তোকে দু’হাত ভরে দিয়েছে।’

পিয়া চট করে উঠে বসে। শাড়িটা কোলের উপরে নিলো। আলতো করে হাত রাখে শাড়ির উপর।

‘একটা মানুষ কি পরিমাণ রুচিশীল হলে তার পছন্দ এতোটা উন্নত হতে পারে? কত বছর আগের পুরোনো শাড়ি। অথচ বোঝার জো নেই যে এটা পুরোনো। শাড়িটা দেখে বুঝাই যাচ্ছে উনার পছন্দ মারাত্মক ছিল। উনি বোধহয় সেই সময় অনেক স্মার্ট ছিলেন।’

পিয়ার চোখজোড়া সরু হয়ে আসে। কপালের উপর এলোমেলো হয়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো ফুঁউউ দিয়ে উড়ালো। শাড়িটার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো সে।

‘নেক্সট মিশন শ্বশুরের সৎমা হয়ে আপন মায়ের যতগুলো শাড়ি আছে সবগুলো শাড়ি আত্মসাৎ করা।’

*********

‘তারপর গতকাল পিয়া সেই শাড়ি পরে সকাল দশটার দিকে বের হয়। আমি কাল ওর চোখে যে উপচে পড়া আনন্দ দেখেছি তা আর কখনো দেখিনি। বের হওয়ার সময় কিছু না বললেও ঘন্টাখানিক পরে ওই মেসেজ টা পাঠায়। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম আঙ্কেল হয়তো আপনাদের জন্য হানিমুন ট্রিপের ব্যবস্থা করেছে।’

তানভীরের রাগ প্রশমিত হয়। চোখে ভাসমান হয় বিষাদ, বেদনা আর হাহাকার। সে অনুনয় করে শুধালো,

‘আমার পিয়া কোথায় বাবা?’

‘শুধু বাবা না তুমিও কিছু জানো তাই না তারেক?’ হুট করেই বলে বসলো আফরিন।

তারেক চকিত চোখে তাকাতেই আফরিন পুনরায় বলে,

‘মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না একদম। গতকাল ভাবির অপহরণের ফোন আসার কিছুক্ষণ আগে বদ্ধঘরে বাবার সাথে তোমার কি কথা থাকতে পারে? আজকে বাইরে থেকে এসে সোজা বাবার কাছেই কেন আসতে হবে? তোমার আর বাবার তো দহরমমহরম সম্পর্ক না। হুট করেই এতোটা কাছাকাছি চলে গেলে তাও এমন মুহুর্তে। ব্যাপারটা সন্দেহজনক নয় কি?’

তারেক অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না।

গতকাল বার বার স্পেশাল সারপ্রাইজের কথা বলা। চিন্তিত থাকা। ফোনে ওরকম করে কারো সাথে কথা বলা। বাইরে থেকে এসে তারেকের ওভাবে দরজা বন্ধ করে কথা বলা। হিসাব তো মিলে যাচ্ছে। তবে তাহমিনা হক বিশ্বাস করতে চাইছেন না। জামাল এহতেশাম কাউকে অপহরণ করতে পারে? মন সায় জানালো না। স্বামীর মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছেন তিনি। কেমন গোলকধাঁধায় আটকে পড়লেন।

‘পিয়াকে ইমোশনালী কাবু করে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলে। যেন গুম করে ফেললেও কেউ টের না পায়। আর মুক্তিপণের টাকা চাওয়াটা জাস্ট আই ওয়াশ ছিলো তাই না বাবা? নয়তো লোকেশন কেন বলল না? তুমি আর তোমার বিজনেস পার্টনার মিলে পিয়াকে অপহরণ করেছো তাইতো? ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে যাবে আর লোকেশন না জানার কারনে আমরা টাকা দিতে পারবো না। আর সেই সুযোগটাই তোমরা কাজে লাগাবে। এম আই রাইট?

মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে তাহমিনা হকের। মনে মনে ভাবলেন আসলেই তো।

তানভীর আচমকাই লুটিয়ে পড়ে জামাল এহতেশামের সামনে। জড়িয়ে ধরে দুই পা। কাতর স্বরে বলল,

‘বাবা! ও বাবা! তুমি জানো আমার পিয়া কোথায় আছে তাই না? মেয়েটাকে কিছু করো না। বাবা আমি এই মেয়েটাকে একবার চোখের আড়াল করে শহরের অলিতে-গলিতে খুঁজেছি। নসীবে ছিলো বলেই হয়তো আবার মিলিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ। ছেলে হিসেবে আমার উপর একটু দয়া করো। আমাকে নিঃস্ব করে দিও না। আমি ম*রে যাবো। ফিরিয়ে দাও না আমার পিয়াকে।’

‘ভাই সাহেব?’

সবার নজর যায় শিরিন আহমেদের দিকে। করজোড়ে জামাল এহতেশামের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।

‘নাড়ী ছেঁড়া মানিক আমার সে।’

তিনি আঁচল পাতলেন। বিয়োগান্ত স্বরে বলেন,

‘আমার মানিক কে ভিক্ষা চাইছি আপনার কাছে। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। আপনার ছেলের ছায়াও মাড়াতে দিবো না। শুধু আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিন।’

অঝোরে কাঁদতে লাগলেন তিনি। স্ত্রীকে দু’হাতে আগলে নেন বেলাল শেখ।

‘এহতেশাম?’ নিষ্প্রাণ গলায় ডাকলেন তাহমিনা হক। পুনরায় বলেন,

‘তুমি সত্যি,,,,

তাহমিনা হকের কথাটা শেষ করতে দেয় না তারেক। তার আগেই চিৎকার করে উঠে সে।

‘আল্লাহর দোহাই লাগে আপনারা বাবাকে ব্লেইম দেওয়া বন্ধ করেন। যে মানুষটা নিজে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আজ দাঁড়ানোর জন্য স্ক্রেচের সাহায্য নিতে হয় তাকে অন্তত অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না কেউ।’

#চলবে