#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২৮
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
একধ্যানে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছি সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। তার চিন্তা ভাবনা কতটাই না সুন্দর। যেমন সুদর্শন পুরুষ তেমনই সুশীল তার চিন্তা ধারা। এই মানুষটা আমায় ক্ষনে ক্ষনে মুগ্ধ করে। তার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। আমিও ক্যাবলাকান্তের মতো তার প্রেমের পরে যাই। দুজনে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে গল্প করছি। গল্প করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে তার ঠিক নেই। দমকা হাওয়ায় চুল গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এক গুচ্ছ চুল এসে পড়লো মুখের ওপর। সরাতে নিবো তার আগে আদ্র ভাই হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আদ্র ভাইকে বললাম,
“আদ্র ভাই এখন চলো নিচে যাই। আমায় পড়তে বসতে হবে। অনেক পড়া জমে আছে”
বলে পিছু ফিরে চলে আসতে নিবো এমন সময় পিছন থেকে আদ্র ভাই আমার চুল টেনে ধরলো। চুলগুলো উনার হাতে পেঁচাতে শুরু করেছে। চুলে টান খাওয়ায় আমি একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছি। একসময় পিঠ দিয়ে ঠেকলো আদ্র ভাইয়ের প্রশস্ত বুকে। আদ্র ভাইকে নিজের এতটা কাছে অনুভব করে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। আদ্র ভাই কিছুটা ঝুঁকলো। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“ভালোবাসি রৌদ্রময়ী”
উনার মুখে ‘রৌদ্রময়ী’ ডাকটা শুনলে মনের মাঝে অন্যরকম অনুভূতি হয়। শীতলতা ছেয়ে যায় পুরো শরীর জুড়ে। এক নিমিষেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। এক ডাকটায় যেন মাদকতা মেশানো। নেশার মতো টানে আমায়। হার্ট এতো ফার্স্ট বিট করছে মনে হয় এই বুঝি লাফ দিয়ে বের হয়ে যাবে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। আদ্র ভাইয়ের দিকে ফিরে কিছু বলবো তার আগেই উনি বলে উঠলেন,
“তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে। যা গিয়ে পড়তে বস”
কথা না বাড়িয়ে আরেক বার আদ্র ভাইকে দেখে নিয়ে নিচে নেমে এলাম। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসেছি। এতদিন আদ্র ভাইয়ের সেবা করতে যেয়ে পড়াশোনায় একটুও মনোযোগ দেওয়া হয়নি। ক্লাসে যতটুকু নোট করছি ততটুকুই। পুরো টেবিল জুড়ে বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনটা রেখে কোনটা পড়বো বুঝতে পারছি না। পড়তে পড়তে একটা বিষয়ে আটকে গেলাম অনেক চেষ্টা করেও টপিকটা মাথায় ঢুকাতে পারছি না। বিছানায় রাখা ওড়না গাঁয়ে জড়িয়ে ছুট লাগলাম শুভ ভাইয়ের রুমে। ভাইয়া বাসায় আছে নাকি কি জানি? আদ্র ভাইয়ের রুম সামনে পড়তেই উঁকি দিলাম। সাহেব কোলের মাঝে ল্যাপটপ নিয়ে কি যেন টাইপ করছে। দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু। এখনো সুস্থ হতে পারলো না ঠিক মতো উনি কাজ নিয়ে বসে পড়ছে। কাজ পাগল লোক কোথাকার। তাকে দেখা বাদ দিয়ে শুভ ভাইয়ের রুমে গেলাম। শুভ ভাই বই নিয়ে বসেছে। ডাক্তার হওয়ার পড়ও তার পড়াশোনার শেষ নেই। সময় পেলেই বই নিয়ে বসে পড়েন। বই পড়ে যে তিনি কি পায় আল্লাহ মালুম। আমায় তো ধরে বেঁধে পড়তে বসাতে হয়। শুভ ভাইয়ের পাশের চেয়ার টেনে বসলাম। শুভ ভাই বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন।
“কিরে পাখি তুই হটাৎ আমার রুমে? কোনো দরকার?”
মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বললাম,
“সামনে পরীক্ষা আর দেখো আমার কতো কতো পড়া বাকি। একটা টপিক পড়লে অন্য টা ভুলে যাচ্ছি, সেটা রিভাইস করতে নিলে আগেরটা ভুলে যাচ্ছি। যাচ্ছে তাই অবস্থা”
শুভ ভাই আমার দিকে ফিরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন করবি না। আমি জানি আমার পাখি পারবে। মন দিয়ে টপিক গুলো বোঝার চেষ্টা করে তাহলেই দেখবি পারবি। কোনো তাড়াহুড়ো করবি না”
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।
“ঠিক আছে। এখন আমাকে এই টপিক টা একটু বুঝিয়ে দাও তো”
“কোন টপিক দেখি?”
শুভ ভাইকে নোট বের করে দেখালাম। তিনি আমায় খুব সুন্দর করে পয়েন্ট টু পয়েন্ট নোট করে বুঝিয়ে দিলেন। শুভ ভাইয়ের রুম থেকেই বেরিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।
——-
দুপুরে খেয়ে নিজের রুমে বসে রেস্ট নিচ্ছি। এমন সময় রুদ্র ভাইয়ের ডাক। এই ভর দুপুর বেলা আমার ভাইয়ের আমায় এতো জরুরি তলব পড়লো কেন? ভ্রু কুঁচকে এলো। এমনি তো আমায় ডাকে না। রুদ্র ভাইয়ের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি হলো ডাকছো কেন?”
রুদ্র ভাই বেক্কেলের মতো দাঁত কেলিয়ে বলল,
“তুই আমার সোনা বনু না। তোকে ডাকবো না তো কাকে ডাকবো বল”
এতো সুন্দর করে বলছে তার মানে নিঃঘাত কোনো কারণ আছে। নাহয় আমার হা*রমি ভাই আমায় এতো আদর করে ডাকবে এটা স্বপ্নে ভাবাও বোকামো।
“আল্হাদ না দেখিয়ে ঝেড়ে কাশো দেখি”
“ভালো বনু আমার, শার্ট টা একটু ইস্ত্রি করে দে না। আমার তাড়া আছে নাহয় আমিই করে নিতাম”
“ও আচ্ছা এই কারণ”
“করে দে না বনু”
“করে দিতে পারি। কিন্তু এর বদলে আমায় কি দিবে?”
“তোকে মিষ্টি একটা ভাবি গিফট করব”
“ভাবি দিয়ে আমি কি করবো?”
“তাহলে কি চাই বল?”
“টাকা দেও শপিং করবো”
রুদ্র ভাই আমার দিকে তাকালো। বলল,
“নিজের ভাইয়ের কাছে অন্তত ধান্দাবাজি করিস না? একটু তো দয়া মায়া কর এই গরিবের ওপর”
“নো দয়া মায়া। অনলি টাকা”
রুদ্র ভাই হতাশ কণ্ঠে বলল,
“ঠিক আছে নিস। এখন ঝটপট শার্টটা আয়রন করে দে”
রুদ্র ভাইয়ের রুম থেকে কচকচে হাজার টাকার দুইটা নোট নিয়ে লাফাতে লাফাতে নিজের রুমে এলাম। মাঝে মাঝে ভাইদের সাথে একটু আকটু ধান্দাবাজি না করলেই নয়। আলমারি খুলে টাকা রেখে পাশে তাকাতেই নজর পড়লো একটা জিনিসের দিকে। হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম নুপুর। এটা আদ্র ভাইয়ের দেওয়া নুপুর জোড়া। তখন যদি এই মানুষটার ভালোবাসা সম্পর্কে জানতাম তাহলে কোনো দিনও ইভান ভাইকে এই নুপুরের হাত দিতে দিতাম না। ছুড়ে ফেলা তো দূর। ইভান ভাই যাওয়ার পর তার দেওয়া লকেট আর নুপুর ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। যেই মানুষটা আমায় ভালোবাসেনি, অপমান করেছে, আমার আবেগ নিয়ে খেলেছে তার জিনিস আমি কখনোই আমার কাছে রাখবো না। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলাম নুপুর জোড়া। সেদিন ইভান ভাই যাওয়ার পর নুপুর গুলো তুলে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। হটাৎ করে ইচ্ছে হলো নুপুর গুলো পড়বো। নুপুরের রিনঝিন শব্দ বিমহিত করে আমায়। কিন্তু নিজের হাতে পড়তে ইচ্ছে করছে না। যার দেওয়া নুপুর তার হাত থেকেই পড়বো। ছুট লাগলাম আদ্র ভাইয়ের রুমে। আদ্র ভাই ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কার সাথে যেন বলছে। আদ্র ভাইয়ের সামনে যেয়ে ডেকে উঠলাম,
“আদ্র ভাই”
উনি কথা বলা ছেড়ে আমার দিকে তাকালেন। ওপর পাশের মানুষটাকে,
“রাখছি পরে কথা হবে”
বলে রেখে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি বলবি? বল”
“তুমি কল কেটে দিলে কেন? কথা শেষ করে নিতে”
“সবার আগে আমার রৌদ্রময়ী তারপর আমার সকল কাজ”
আদ্র ভাইয়ের সামনে নুপুর জোড়া ধরলাম। উনি কিছু বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে বললেন,
“কি?”
“পড়িয়ে দাও”
উনি কথা না বলে বিছানায় থেকে উঠে গেলেন। আমায় বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে হাঁটু গেরে নিচে বসে পড়লেন। আমার পা তুলে তার উরুর ওপর রেখে নুপুর পড়ানো শুরু করলেন। আমি এক নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্র ভাই এতো মন দিয়ে নুপুর পড়াচ্ছেন মনে হচ্ছে যেন কোনো রাজ কার্য করছেন। নুপুর পড়ানোর মাঝে মাঝে আদ্র ভাইয়ের হাতের স্পর্শ পায়ে লাগছে। উনার স্পর্শ লাগতেই শিউরে উঠছি। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে নিজের টা নিজেই পড়া উচিত ছিলো। আদ্র ভাই নুপুর পড়ানোর মাঝে আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন। কি তীক্ষ্ণ সেই চাহনি। এই তীক্ষ্ণ চাহনি নিমিষেই আমায় খু*ন করে ফেলে। তার তীক্ষ্ণ চোখের দিকে তাকানোর মতো সাহস আমার নেই। উনার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় আমি একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছি। অতল গহীন সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছি। আদ্র ভাইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। তাড়াহুড়ো করে উঠে যেতে যেতে বললাম,
“আদ্র ভাই আমি আসছি”
চলে আসতে নিবো এমন সময় আদ্র ভাই বলে উঠলো,
“কথায় কথায় ভাই ডাকলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবো বলে দিলাম”
“এ্যা”
“এ্যা নয় হ্যাঁ, কথাটা মনে রাখিস”
আদ্র ভাইকে কিছু না বলে নিজের রুমে চলে এলাম।
——
রাতের শহর নিস্তব্ধতায় ঘেরা। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। ছাদে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আকাশে চাঁদ নেই। তাঁরার মেলা বসেছে পারো আকাশ জুড়ে। এক মনে তাকিয়ে আকাশ দেখছি। পড়া শেষ করে উঠে শরীর টা ম্যাচম্যাচ করছিলো। তাই ভাবলাম ছাদে ঘুরে আশা যাক। পুরো বাড়ির মধ্যে ছাদ, ব্যালকনি আর বাগান আমার সবচেয়ে প্ৰিয় জায়গা। ভালো না লাগলে ছাদে এসে দোলনায় বসে থাকতে আমার বড্ড ভালো লাগে।
এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় কেউ এসে পাশে বসলো। পাশে বসা মানুষটাকে দেখে ছিটকে দূরে সরে এলাম। মানুষটা বলে উঠলো,
“ওভাবে সিটকে সরে গেলি যে? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”
কিছুই বললাম না। উনার সাথে কথা বলার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে না। চলে আসতে নিলে হাত ধরে আটকে দিলেন।
“কি সমস্যা হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়ুন”
“তোর সাথে আমার কথা আছে। চুপচাপ শোন তাহলে হাত ছেড়ে দিবো”
কথা বাড়ালাম না। কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লাম।
“কি সমস্যা রোদ? ইগনোর কেন করছিস? আমায় দেখলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিস কেন? আমি ক্ষমা চেয়েছি তো?”
“ক্ষমা আপনাকে সেই কবেই করে দিয়েছি। এবার হাত ছাড়ুন আমার”
“ঠিক আছি হাত ছেড়ে দিলাম। তবে তোকে আমার কথা শুনতে হবে”
ইভান ভাই হাত ছেড়ে দিলেন। তার থেকে দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালাম।
“কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন”
“আমার হওয়া যায় না রোদ। আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি রোদ। আমার তোকে চাই”
“বললাম তো আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি”
“কাকে?”
“আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই”
দুজনের মাঝে নীরবতা। নীরবতকে বিদায় দিয়ে ইভান ভাই বলে উঠলো,
“তোর সেই ভালোবাসার মানুষটা কি আদ্র?”
চকিতে ইভান ভাইয়ের দিকে তাকালাম। ইভান ভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই”
“ভালোবাসি তোকে রোদ পাখি”
“আমি আপনার ভালোবাসা না জেদ”
ইভান ভাই করুণ চোখে চেয়ে বললেন,
“আমার হয়ে যা না প্লিজ”
“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন মিস্টার ইফরান খান ইভান রোদকে পাওয়া খুব সহজ, হারিয়ে ফেলা তার চেয়েও সহজ। তবে একবার হারিয়ে ফেললে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। অসম্ভব মানে অসম্ভব”
ইভান ভাই আমার চোখে চোখে রেখে তেজ নিয়ে বলে উঠলো,
“আমার তোকে চাই মানে চাই। সেটা যেভাবেই হোক তোকে আমার হতেই হবে”
#চলবে?