#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩০ (বিবাহ স্পেশাল)
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
আদ্র ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। কান্না করতে করতে হেঁচকি উঠে গেছে। শরীর অসম্ভব রকমে কাঁপছে। ঠিক করে দাঁড়াতে পারছি না। আদ্র ভাই আমাকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়ে বললেন,
“কাঁদছিস কেন? তোর আদ্র ভাই চলে এসেছে তো। আদ্র থাকতে তোকে অন্য কেউ তার বানাতে পারবে না। তুই শুধু আদ্র’র”
তাও আমার কান্না থামছে না। হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে উঠলাম,
“তুমি কোথায় ছিলে আদ্র ভাই? এতো দেরি করে আসলে কেন? আর একটু হলেই তো আমি শেষ হয়ে যেতাম। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও আদ্র ভাই, আমি বাড়ি যাবো”
“কাঁদতে বারণ করছি রোদ। তুই জানিস না তোর চোখের অশ্রু আমায় পীড়া দেয়। আঘাত করে আমার বুকে”
আমার কান্না থামার নাম নেই। আদ্র ভাই আমাকে তার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শুভ ভাইয়ের কাছে দিয়ে বলল,
“শুভ ভাই ওকে একটু ধরো। ওর শরীর প্রচন্ড দুর্বল পড়ে দেখা যাবে মাথা ঘুরে পরে যাবে”
শুভ ভাই আমাকে আগলে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। একটু আগের দৃশ্য মাথায় ঘুরছে। ইভান ভাই পুনরায় এসে আমায় এভাবেই কাঁদতে দেখে কিছুটা রেগে গিয়েছিলেন। রাগী কণ্ঠে বলল,
“এভাবেই কার জন্য কাঁদছিস? কেউ আসবে না তোকে বাঁচাতে। বিয়ের ড্রেস পড়িস নি কেন? বলছি না বিয়ের সাজে সাজতে”
তেজ দেখিয়ে বললাম,
“বিয়ের সাজে সাজবো তো আমি বটেই তবে তোমার মতো নি*কৃষ্ট মানুষের জন্য না”
“তাহলে কার জন্য সাজবি শুনি? সারাজীবন তোকে আমার জন্য সাজতে হবে মাথায় ঢুকিয়ে নে কথাটা”
আমি মনে মনে শুধু আল্লাহ কে ডেকে চলেছি। তিনি যেন আমায় এর হাত থেকে বাচিয়ে নেন। আমার আদ্র ভাই যেন আমাকে খুঁজে পায়। আচ্ছা আদ্র ভাই কি জানে আমাকে ইভান ভাই এখানে নিয়ে এসেছে? আমি চিন্তায় মশগুল এমন সময় ইভান ভাই বলল,
“ঠিক আছে তোকে বউ সাজতে হবে না। কিন্তু বিয়ে এখনই হবে”
অতঃপর বাহিরে থাকা কারো উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“কাজী সাহেব আপনি ভিতরে আসেন”
রুমের দরজা দিয়ে হুজুর মতো একটা লোক হাতে কয়েকটা খাতার মতো কিছু নিয়ে ঢুকলেন। তার সাথে আরো একজন মধ্যেবয়স্ক লোক। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। আমি শুধু এক মনে আল্লাহ কে ডেকে চলেছি। কাজী সাহেব বলল,
“এই বিয়েতে আপনি রাজি থাকলে বলেন মা কবুল”
আমি কিছুই বলছি না। ‘থ’ মেরে বিছানার এক কোণে বসে রয়েছি। কাজী সাহেব আবার বললেন আমি তাও কিছু বলছি না। ইভান ভাই আমার সামনে বসে ধমক দিয়ে বললেন,
“কি হলো কবুল বলছিস না কেন?”
“বলেছি না আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। কথা কানে যায় না”
ইভান ভাই কাজীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“কাজী সাহেব আপনি কাবিন নামা দেন। ও কবুল পড়ে বলবে”
কাজী সাহেবের কাছ থেকে কাবিন নামা নিয়ে আমার সামনে রেখে বললেন,
“কবুল বলা লাগবে না। সাইন করে দে”
“বললা তো আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। দরকার পড়লে ম*রে যাবো তাও আপনার মতো নি*কৃষ্ট মানুষকে বিয়ে করবো না”
ইভান ভাই আমাকে জোর করছেন সাইন করার জন্য এমন সময় বাহিরে গন্ডগোলের শব্দ হচ্ছে। দরজায় এক লাত্থি দিয়ে কেউ দরজা ভেঙ্গে ফেলল। সোজা এসে এক লাত্থি দিয়ে ইভান ভাইকে দূরে ফেলে দিলো। সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম। রাগান্বিত রূপে আদ্র ভাই। এতক্ষন তো এই মানুষটার জন্য আমি অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম। আদ্র ভাইকে দেখে মনে সাহস পেলাম। এক দৌড়ে বিছানা থেকে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আদ্র ভাইয়ের প্রশস্ত বুকে।
——
শুভ ভাই আমায় বোঝাচ্ছেন। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি তাকিয়ে আছি আদ্র ভাইয়ের দিকে। উনি গাঁয়ের কোট খুলে পাশে ছুঁয়ে ফেলে দিলেন। শার্ট এর হাতা তুলে কনুই পর্যন্ত গোটালেন। নিচে পড়ে থাকা ইভান ভাইকে তুলে নাক বরাবর ঘুসি দিলেন। ইভান ভাই ছিটকে দূরে পরে গেলেন। আদ্র ভাই ইভান ভাইকে তুলে ইচ্ছে মত মারছে। আদ্র ভাইকে ভয়ংকর মনে হচ্ছে। উনার মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। চোখ লাল হয়ে গেছে। উনি যেন নিজের মাঝে। বেধড়ক ভাবে মারছে ইভান ভাইকে। ইভান ভাইয়ের অবস্থা নাজেহাল। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, ঠোঁটের কোণ কেটে গিয়েছে। আদ্র ভাই থামার নাম নিচ্ছে না। দিগ্বিদিক শুন্য হয়ে ইভান ভাইকে মেরেছেন। এক পর্যায়ে ইভান ভাইয়ের শার্ট এর কলার ধরে বলে উঠলেন,
“প্রথম বার তোকে ছেড়ে দিয়েছিলাম কারণ তখন রোদ তোকে পছন্দ করতো। কিছু বলিনি তোকে। তোকে রোদ পছন্দ করে বলে নিজে শেষ হয়েছি তাও তোদের মাঝে আসিনি। ওকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলি। আমি নতুন রূপে গড়ে নিয়েছিলাম আবার এসেছিস ওর জীবনটা নষ্ট করতে? এইবার তোকে সেই সুযোগ দিবো না। তোকে বলেছিলাম না রোদ এর আশেপাশে না যেতে। কথা কানে যায় না? তোর অনেক শখ তাই না রোদকে বিয়ে করার? আজকে তোর সব শখ আমি মিটিয়ে দিবো। কার কলিজায় তুই হাত দিয়েছিস টা তুই নিজেও জানিস না। ভাই বলে ছাড় পাবি সেটা ভাবিস না। আমার রৌদ্রময়ীকে যে আঘাত করবে তাকে পস্তাতে হবে। অনেক বাজে ভাবে পস্তাতে হবে”
আদ্র ভাই ইভান ভাইকে আবার মারা শুরু করলো। ইভান ভাইয়ের অবস্থা করুণ। কেউ আদ্র ভাইয়ের কাছে আগাচ্ছে না। পাশে কাজী, সেই লোকটা আর ইভান ভাইয়ের এক বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। ইভান ভাইয়ের নাজেহাল অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে। শুভ ভাইয়ের হাত ঝাঁকিয়ে বলে উঠলাম,
“শুভ ভাই আদ্র ভাইকে থামাও। উনি নিজের মাঝে নাই। ওনাকে থামাও। নাহয় ইভান ভাইয়ের কিছু হয়ে যাবে”
শুভ ভাই নিশ্চল কণ্ঠে বলল,
“এই শাস্তি টা ওর প্রাপ্য। ও বড্ড বেড়েছিল”
শুভ ভাইয়ের থেকে এই উত্তর আশা করিনি। আরো কিছুক্ষণ পর আদ্র ভাই থালেন। পাশে রাখা চেয়ারে ধুপ করে বসে পড়লেন। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা তার। নিচে পড়ে আছে ইভান ভাই। আদ্র ভাই বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাজী সাহেব মিনিমিনে স্বরে বলে উঠলো,
“বিয়ে টা কি হবে? নাকি হবে না”
আদ্র ভাই রক্তিম চোখে তার দিকে তাকালেন। বেচারা কাজী সাহেব ভয় পেয়ে গেছে। তিনি চুপ করে গেলেন। সত্যিই বলতে আদ্র ভাইয়ের এই রূপ দেখে আমার নিজেরও ভয় লাগছে। আদ্র ভাইয়ের এমন ভয়ংকর রূপ আমি এর আগে কখনো দেখিনি। সেদিন সেই ছেলেটাকে মারলেও এতটা বাজে ভাবে আঘাত করেনি। আজ যেন নতুন এক আদ্র ভাইকে দেখছি। আদ্র ভাই বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। ঘামে ভিজে একাকার অবস্থা ওনার। সকালে ইন করা শার্ট এখন এলোমেলো হয়ে আছে। চুলগুলো পুরো অগোছালো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ছোঁয়া। আদ্র ভাই উঠে এসে আমার কাছে দাঁড়ালেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্র ভাই হুট্ করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন আমার সামনে। ওনার এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার হবি রৌদ্রময়ী? সারাজীবন এই বুকে আগলে রাখবো তোকে। আমার রাজ্যের রানী বানিয়ে রাখবো। আমি তোকে হারাতে চাই না রৌদ্রময়ী তোকে নিয়ে যে আমার বড্ড হয়। তোকে হারানোর ভয় আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। তোকে নিয়ে ভয় হয় আমার। সারাজীবনের জন্য আমার হাতে হাত রাখবি?”
আদ্র ভাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ওনার করুণ চাহনি। কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে কি বলা বা করা উচিত কিছুই মাথায় আসছে না। শুভ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ ভাই হয়তো আমার চোখের চাহনি বুঝতে পারলেন। তাই নিজ থেকেই বললেন,
“রাজি হয়ে যা পাখি। আজকে তোকে না পেয়ে ওর যেই অবস্থা হয়েছিলো সেটা বলে বুঝানোর মতো না। একপ্রকার পা*গল হয়ে গিয়েছিল আদ্র। তোকে হারানোর ভয় ওর মধ্যে স্পষ্ট ছিলো। তোকে হারানোর ভয়ে বেচারা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে ওকে শান্ত করেছি। ভাই হিসেবে বলবো রাজি হয়ে যা। বিশ্বাস করতে পারিস তোর এই ভাইকে”
শুভ ভাইয়ের কথা শুনে ভাবনায় বসলাম। আদ্র ভাই ফের বললে উঠলো,
“আমার হয়ে যা রৌদ্রময়ী। রানী করে রাখবো তোকে”
লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। হাত বাড়িয়ে দিলাম আদ্র ভাইয়ের হাতে। আদ্র ভাই উঠে আমার হাত শক্ত করে নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। নিজেও পাশে বসলেন। কাজী সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কাজী সাহেব বিয়ে আজকে হবে তবে সেটা আমার আর আমার রৌদ্রময়ীর। বিয়ে পড়ানো শুরু করেন কাজী সাহেব”
কাজী সাহেব ভিত কণ্ঠে বলল,
“পড়ে আবার আমায় কিছু করবে না তো?”
কাজী সাহেবের কথা শুনে আদ্র ভাই হেসে দিলেন। হাসি মুখেজবাব দিলেন,
“না কিছু বলবো না। আপনি এদিকে এসে বিয়ে পড়ান”
কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। হটাৎ আদ্র ভাই উঠে ইভান ভাইয়ের দেওয়া ডালা থেকে লাল রঙের ওড়না এনে আমার মাথায় পড়িয়ে দিলেন। কাজী সাহেব ফের বলে উঠলেন,
“এই বিয়েতে রাজি থাকলে বলেন মা কবুল”
আড়চোখে শুভ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। বুকের মাঝেডিপ ডিপ শব্দ হচ্ছে। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করছি এটা কি ঠিক হচ্ছে? আদ্র ভাই নিজের হাতের মাঝে হাত নিয়ে আশ্বাস দিলেন। চোখ বুঝে শ্বাস নিয়ে কাঙ্খিত শব্দটা বলে দিলাম। আদ্র ভাইকে বলতে বলা হলে উনি ফট করে একনিঃশ্বাসে বলে দিলেন। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন এই মুহুর্তটার অপেক্ষা করছেন। সবাই একসাথে বলে উঠলো,
“আলহামদুলিল্লাহ”
——-
গাড়িতে বসে আছি। পুরো গাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা। আদ্র ভাই ড্রাইভ করছেন। আমি পাশে বসে এক মনে রাস্তা দেখছি। আজকে সারাদিনে আমার সাথে হওয়া সকল ঘটনার হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ও আমি সিঙ্গেল ছিলাম। আর এখন বিবাহিত।। জীবন আসলেই কখন কোন মোড় চলে আসে কেউ জানে না। পাশে থাকা মানুষটা এখন আমার…! আমার এ যেয়ে আটকে গেলাম। এখন তাকে আর ভাই বলা যাবে না। মানুষটা যে আমার বর। কিন্তু বাসায় যেয়ে কিভাবে কি বলবো সেটাই বুঝতে পারছি না। আড়চোখে উনার দিকে তাকালাম। মহাশয় এক মনে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়ি আসে থামলো বাড়ির সামনে। উনি নেমে দরজা খুলে দিলেন। ভদ্র মেয়ের মতো নেমে এলাম। দুজনের মাঝে নীরবতা। কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না। চলে আসতে নিবো এমন সময় পিছন থেকে আদ্র ভাই বলে উঠলো,
“আমি কি তোকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি রৌদ্রময়ী?”
পিছু ঘুরে তাকালাম। আদ্র ভাই হুট্ করে এসে জড়িয়ে ধরলেন। শক্ত আলিঙ্গন যাকে বলে। দুজনের মাঝে নেই কোনো দূরত্ব। কিছুক্ষন এভাবে জড়িয়ে রেখে বললেন,
“জানিস আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই শুধু আমার। আর কারো না। আমার রৌদ্রময়ী শুধু আমার। তাকে আমার কাছ থেকে আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না,কেউ না”
কিছুই বললাম না। নীরবে উনার কথা শুনে যাচ্ছি। আদ্র ভাইয়ের কণ্ঠটা কেমন কাঁপছে। আদ্র ভাই কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
“আমার রৌদ্রময়ী, আমার বউ”
#চলবে?
#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩১
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
নিশিথে ধরিত্রী জুড়ে তমিস্রা’র বিচরণ। দমকা হাওয়া বইছে। পুরো ব্যালকনি জুড়ে আলো আঁধারের খেলা। চারপাশ অন্ধকার থাকলেও ব্যালকনিতে থাকা ছোটো ছোটো লাইট গুলো জ্বলছে। গালে হাত দিয়ে ভাবনার শহরে বিচরণ করছি। সকাল থেকে বিকেলের মাঝের এই টুকু সময়ে জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন টা হয়ে গেল। এখন আমি কারো স্ত্রী, তাও আবার সেই ব্যক্তির যাকে আমি ভালোবাসি। বিষয়টা ভাবতেই পুরো শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে যায়। কিন্তু কথা হলো বাড়িতে যখন বিষয়টা জানবে তখন তাঁদের রিয়েকশন কেমন হবে? তারা কি মেনে নিবে? নাকি? আর কিছু ভাবতে পারলাম না। মনের মাঝে ধক করে উঠলো। পরোক্ষনে ভাবলাম আদ্র ভাই সবার প্রিয় ছেলে তাকে না মানার মতো কোনো কারণ নেই। এমনিতে আমাদের বাড়ির সবাই আদ্র ভাই বলতে অজ্ঞান। তাকে সবাই বড্ড আদর করে। একমাত্র বোনের একমাত্র পুত্র বলে কথা। তার ওপর তার ব্যক্তিত্ব। সব মিলিয়ে সবাই ওনাকে অনেক ভালোবাসে। সো নো টেনশন। এমন সময় রুমে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। দৌড়ে রুমে এসে দেখলাম মহাশয়ের ফোন। সেই সময় বিদায় দিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো কথা হয়নি আমাদের মাঝে। স্ক্রিনে উনার নাম দেখে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এই মানুষটা এখন আমার বর। ভাবতেই মনে মাঝে অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। দেখতে দেখতে কল কেটে গেল। আবার পুনরায় বেজে উঠলো। নিজেকে সামলে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠ,
“ছাদে আয়”
অবাক হয়ে গেলাম। এখন এই রাতে আমি ছাদে যেয়ে কি করবো? একা একা ভুতেদের সাথে গল্প করবো?
“ছাদে কেন?”
“আসতে বলছি আয়। ১ মিনিটও যেন দেরি না হয়”
কল কেটে গেল। মাথায় ভাবনা আসলেও সেটা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। সুন্দর করে গাঁয়ে ওড়না জড়িয়ে হাঁটা দিলাম ছাদের উদ্দেশ্যে।
পুরো ছাদ জুড়ে অন্ধকার। ছাদের দরজা খুলতেই কেউ একজন হাত ধরে টান দিলো। আচমকা আক্রমণে যেয়ে পড়লাম সামনের মানুষটার প্রশস্ত বুকে। সামনের মানুষটা কোমর চেপে তার সাথে মিশিয়ে নিলেন। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। কে এই অজ্ঞাত ব্যক্তি। চিৎকার করতে নিবো এমন সময় ছাদের লাইট জ্বলে উঠলো। লাইটের আলোতে সামনের মানুষটাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার সদ্য বিয়ে করা বর মানে আদ্র ভাই। কিছুটা রাগী সুরে বললাম,
“এভাবে কেউ আচমকা হাত ধরে টানে? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি”
“সামান্য হাত ধরে টান দেওয়ায় যদি ভয় পাস তাহলে ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে?”
“মানে?”
“কিছু না”
“তুমি এখানে কি করছো? বাড়ি যাও নি”
“সদ্য বিয়ে করা বউ রেখে কি বাড়িতে মন টিকে? তাই চলে এসেছি”
“কখন এলে?”
“কিছুক্ষণ আগে। মেঝ মা সরি শাশুড়ি আম্মু কতো যত্ন করে খাওয়ালেন আমায়। তোর সেদিকে খেয়াল আছে? তোর যে একটা বেচারা বর জুটেছে সে খেয়াল আছে? নাকি সেটাও ভুলেছিস?”
বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,
“নিজের সত্ত্বা কে ভুলে গেলেও তাকে কি ভোলা যায়?”
“বিরবির করে কি বলছিস?”
“কিছু না। তুমি বলো এখানে এসেছো কেন?”
“বাসর করতে?”
আদ্র ভাইয়ের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলাম। তোতলানো কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“মানে? কি বলছো?”
“দেখ আজকে আমাদের বিয়ে হয়েছে আর বিয়ের রাত মানে বাসর রাত। তো বাসর রাতে বর বউয়ের কাছে কেন আসে বলতো?”
উনার কথা শুনে ঢোক গিললাম। না বুঝার ভান ধরে বললাম,
“আমি জানি না। এই তুমি আমাকে ছাড়ো তো। আমি এখানে থাকবো না নিচে যাবো। ছাড়ো”
আদ্র ভাইয়ের বুকে ধাক্কা দিয়ে উনার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি তবে পারছি আর কই। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে থেমে গেলাম। এতক্ষন ধাক্কা দিয়েও আদ্র ভাইকে নিজের থেকে এক চুল পরিমান সরাতে পারিনি। তাই শান্ত হয়ে গেলাম। আদ্র ভাই আমার কাজে শব্দ করে হেসে দিলেন।
“তুই কি ভেবেছিস এমন মশা মার্কা শরীর নিয়ে তুই আমাকে সরাতে পারবি? ভাবনা ভুল। মজা করছিলাম এতক্ষন। এমনি তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই চলে এসেছি। ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আমি সবার আগে তোর বন্ধু, যাকে নির্দ্বিধায় সব কিছু বলা যায়। যার সাথে মুহূর্তেই মিশে যাওয়া যায়, যার কাছে তোর কোনো সংকোচ নেই। তারপর যেয়ে তোর বর। তাই বর ভেবে দূরে সরে যাস না যেন”
আমি চুপ করে আছি। কিছু বলছি না। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছি।
“চল দোলনায় যেয়ে বসি”
আদ্র ভাই হাত ধরে দোলনায় নিয়ে বসিয়ে দিলেন। নিজে বসলেন আমার পাশে। আকাশে মস্ত বড় থালার ন্যায় চাঁদ। পুরো আকাশে জুড়ে আছে। আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি চাঁদের দিকে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম পাশে বসা আদ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উল্টোদিক ঘুরে চাঁদ দেখছি। হটাৎ আদ্র ভাই আমাকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। আমার পিঠ যেয়ে ঠেকলো আদ্র ভাইয়ের বুকে। আদ্র ভাই আবেশে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন আমায় । আমি লজ্জায় রাঙা হয়ে যাচ্ছি। লজ্জায় গাল গুলো গরম হয়ে উঠছে। দুজনের মাঝে নীরবতা। কেউ কিছু বলছি না। নীরবে নিভৃতে অনুভব করছি একে অপরকে। এমনি সময় উনার সাথে গল্প জুড়ে দিলেও আজ লজ্জা লাগছে। উনার সাথে কথা বলতে গেলেও লজ্জারা কেমন ঘিরে ধরে আমায়।
“কি হলো আজকে এতো চুপচাপ যে?”
“চুপচাপ কোথায়?”
“এইযে প্রতিদিনের মতো গল্পের সমাহার নিয়ে বলছিস না। সারাদিন কি কি করলি তা নিয়েও বক বক করছিস না। কারণ কি?”
“কারণ কিছুই না। এমনি”
আমায় কথা বলতে না দেখে আদ্র ভাই নিজে থেকেই গল্প জুড়ে দিলেন। আমিও তার সাথে সায় দিচ্ছি। আবার আগের মতো উনার সাথে ফ্রি হয়ে গিয়েছি। অস্বস্থিরা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। আচমকা মনে প্ৰশ্ন এলো আদ্র ভাই কিভাবে আমার খোঁজ পেলেন? এটা তো জানাই হলো না। তাই ফট করে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“আচ্ছা আদ্র ভাই তুমি আমায় খুঁজে পেলে কিভাবে? আর জানলেই বা কি করে যে আমায় ইভান ভাই তুলে নিয়ে গেছে?”
আদ্র ভাই আমার প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দম নিয়ে বলা শুরু করলো,
“সকাল বেলা তোরা বেরিয়ে পড়তেই মন টা কেমন হাঁসফাঁস করছিলো। অফিসে গিয়ে কাজের মাঝেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। কেমন জানো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি আমার খুব কাছের কিছু হারিয়ে ফেলছি। দুপুর নাগাদ মেঝ মামীর কল। হটাৎ মামীর কল পেয়ে ভ্রু কুঁচকে এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকেই মামী কান্না করতে করতে বলে উঠলো,
“বাবা আদ্র রোদ এখনো বাসায় আসেনি, ফোন করছি তাও রিসিভ করছে না । তুই জানিস ও কোথায়?”
“ইভা বাড়িতে এসেছে? ওকে কল দিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ। ইভা বলল ও বন্ধুদের সাথে আছে। রোদ নাকি অনেক আগেই বাড়ির উদ্যেশে বেরিয়েছে কিন্তু এখনো বাড়ি আসেনি। দেখতো বাবা ও কোথায়?”
“ঠিক আছে মামি তুমি চিন্তা করো না আমি দেখছি”
কল কেটে ইভা কে কল করলাম। ইভা জানালো তুই বেরিয়ে গেছিস আরো আগে। ওর থেকেও কোনো ইনফরমেশন পেলাম না। মাথা কাজ করছিলো না। ফোন দিলাম শুভ ভাইকে, ভাইয়া ব্যাস্ত ছিলো। কোনো রকমে কথা বলে রেখে দিলো। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ফোন দিলাম মামীকে।
“মামী আজকে বাড়ি থেকে কে গিয়েছিল ওদের আনতে?”
“জলিল ভাই গিয়েছিল”
“ঠিক আছে”
জলিল কাকার নাম্বার আমার কাছে আগেই ছিলো। ডায়াল করলাম তার নাম্বারে। উনাকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বলল ইভান নাকি কাকাকে বাজারে পাঠিয়েছে আর ও গেছে তোদের আনতে। তখনই বুঝেছিলাম সব ইভানের চাল। মামীকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম উনি যেন চিন্তা না করে, তুই আমার সাথে আছিস। শুভ ভাইকে আবার ফোন দিলাম। সোজা গাড়ি নিয়ে মেডিকেলের সামনে চলে গেলাম। শুভ ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম,
“শুভ ভাই ইভান রোদকে কোথাও নিয়ে গেছে। রোদ এখনো বাড়ি ফিরেনি। শুভ ভাই আমি আমার রোদ কে কোথায় খুঁজবো বলো? ইভান ওকে নিয়ে কোথায় গেছে? ও রোদের সাথে কিছু করবে না তো? আমার ভয় হচ্ছে”
শুভ ভাই আমায় শান্তনা দিলো। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে বসলাম কিভাবে তোকে খুঁজে বের করা যায়? তখন মাথায় এলো লোকেশন ট্র্যাকের কথা। অতঃপর তোর ফোন ট্র্যাক করলাম। লোকেশন দেখাচ্ছিল শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা গ্রামের। লোকেশন ট্রেস করতে করতে চলে গেলাম। বাড়ির বাইরে কয়েকজন ছিলো। তাঁদের তোর ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেই ওরা কেমন ঘাবড়ে গেল। আমার সন্দেহ হলো। ওদের জেরা করতেই ওরা বলে দিলো। তারপরের ঘটনা তো তুই জানিস”
আদ্র ভাই বলা শেষ করে লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে নিঃশাসের সাথে সাথে সকল কষ্ট উড়িয়ে দিচ্ছেন। মানুষটা আমার জন্য এতটা করছে ভেবে মনে মনে শান্তি পেলাম। আদ্র ভাই কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“আজকে যদি আমি তোকে হারিয়ে ফেলতাম তবে আমি নিঃস্ব হয়ে যেতাম। আমি যে তোকে ছাড়া এক মুহুর্তও কল্পনা করতে পারিনা রৌদ্রময়ী। তুই আমার, শুধু আমার। আমায় ছেড়ে যাস না কখনো। তোকে ছাড়া আমি পা*গল হয়ে যাবো, পুরো উন্মাদ যাকে বলে”
“কথা দিচ্ছি আমি সজ্ঞানে তোমায় ছেড়ে যাবো না। সারাজীবন তোমার বুকে মাথা রেখে তোমার হয়েই রয়ে যাবো”
দুজনের মাঝে নীরবতা। একে অপরকে আলিঙ্গনে অনুভব করছি। এ অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। কোনো কিছু প্রাপ্তির অনুভূতি।
“আচ্ছা আদ্র ভাই বাড়িতে আমাদের বিয়ের বিষয়ে বললে না কেন?”
“এমনি বড় মামু ইভানের ওপর রেগে আছে। এখন যদি ওর এই কর্মকান্ড মামুর সামনে প্রকাশ হয় তবে মামু নিঃঘাত ওকে তেজ্য করবে। তুই তো মামুর রাগ সম্পর্কে জানিস। ইভান ওর কর্মের ফল কিছুটা হলেও পেয়েছে । তাই আমি চাইনা ও পরিবার থেকে আলাদা হোক”
“পড়ে যদি আমাদের বিয়ে নিয়ে সমস্যা হয় বা আব্বু আমায় অন্য কোথাও বিয়ে দিতে চায়, তখন?
“আমি আছি কি করতে? তোর ছোটো মাথায় এতো টেনশন নিতে হবে না। তোর ইয়ার ফাইনালের পর আব্বু-আম্মু কে পাঠাবো মামুর কাছে। তারপর একদম লাল টুকটুকে বউ রূপে তোকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো”
আদ্র ভাইয়ের মুখে ‘বউ’ ডাকটা শুনলেই শরীর বেয়ে শিহরণ বয়ে যায়। কি মধুর সেই ডাক। ইচ্ছে হয় উনার মুখ থেকে সারাদিন বউ ডাক শুনতে। আদ্র ভাই আমাকে নিজের বাহুডোরে থেকে ছাড়িয়ে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। পকেট হাতড়ে একটা ডায়মন্ড এর রিং সামনে ধরে বলল,
“আমার সারাজীবনের সঙ্গী হবি রৌদ্রময়ী? যতনে আগলে রাখবো তোকে বহুডোরে। আমার আকাশে ঘুড়ি হবি? পুরো আকাশ জুড়ে যার বসবাস থাকবে। আমার আকাশের চাঁদ হবি? আলো ছড়িয়ে দিবি আমার আঁধারে ঢাকা পুরো শহর জুড়ে। আমায় তোর চন্দ্রবিলাসের সঙ্গী বানাবি? অল্প স্বল্প গল্প সাথে ধোয়া ওঠা গরম কফির সাথে কেটে যাবে রাত্রি। আমায় তোর বৃষ্টিবিলাসের সঙ্গী বানাবি? তুই আবেশে বৃষ্টিকে গাঁয়ে মাখবি আমি দূর থেকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখবো। সব শেষে বলবো আমার ঘরের রানী হবি? পুরো ঘর এবং আমি জুড়ে যার বিচরণ থাকবে”
আদ্র ভাই থামলেন। আমি একটু একটু করে কাঁপতে থাকা আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম। আদ্র ভাই রিং পড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেলেন। শিউরে উঠলাম। উঠে দাঁড়িয়ে গালে হাত রেখে কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলেন। এই ছোঁয়ায় নেই অপবিত্রতা, আছে একগুচ্ছ ভালোবাসার অনুভূতি। আবেশে চোখে বুজে নিলাম। নীরবে নিভৃতে কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। অতঃপর দুজনে পুনরায় মেতে উঠলাম গল্পে।
#চলবে?