উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন পর্ব-৩৬

0
3

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩৬
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

মেঘে ঢাকা আকাশে চাঁদের দেখা নেই। অন্ধকার বিরাজ করছে চারপাশে। মৃদু বাতাস বইছে একটু পর পর। হাওয়ার তালে তালে উড়ে চলেছে উন্মুক্ত কেশগুচ্ছ। গোছালো চুল গুলো মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তবে সেদিকে খেয়াল নেই আমার। কোন চিন্তায় যে মগ্ন হয়ে আছি কে জানে। ধ্যান ভাঙলো রোশনির ডাকে।
“আপু? এই আপু? কোথায় হারিয়ে গেছো? সেই কখন থেকে ডাকছি তোমার খেয়াল নেই”

ভাবনা থেকে বেরিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি হয়েছে ডাকছিস কেন?”

“বড় আম্মু ডাকছে তোমায়। বলেছে এই অসুস্থ শরীরে বেশিক্ষন ছাদে না থাকতে। নিচে চলো সবাই আড্ডা দিচ্ছে”

“তুই যা আমি আসছি”

রোশনি চলে গেল। আরো একটু সময় থেকে আমিও নেমে এলাম। নিচে আড্ডা বসেছে সবার। আম্মু, বড় আম্মু, ছোট আম্মু, ভাবি, ইভা, আর রোশনি মিলে গল্প করছে। আমাকে দেখেই বড় আম্মু ডাক দিলো,
“রোদ সোনা এদিকে আয়”

ভদ্র মেয়ের মতো বড় আম্মুর পাশে যেয়ে বসালাম। বড় আম্মু কপালে হাতে রেখে তাপমাত্রা চেক করলো। অতঃপর বলল,
“জ্বর তো এখনো আছে। শরীর যথেষ্ট গরম এই অসুস্থ শরীর নিয়ে ছাদে কি করছিস সোনা?”

“সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসে আর ভালো লাগছিলো না তাই ছাদে মুক্ত পরিবেশে হাওয়া খেতে গিয়েছিলাম”

বড় আম্মু আমায়র মাথা তার কোলে রেখে বলল,
“তুই শুয়ে থাক আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দেখিস ভালো লাগবে”

বড় আম্মু কথা মতো শুয়ে পড়লাম। সবাই মিলে গল্প করছে আমিও তাঁদের সাথে তাল দিচ্ছি। একটু পর পর একেক জনের কথা শুনে খিলখিল করে হাসছি। আমাদের দেখে মনে হবে না আমরা মা মেয়েরা বসে আড্ডা দিচ্ছি। কেউ দেখলে বলবে বন্ধুরা বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছি। ভাবি একটু পর পর মজার মজার কথা বলছে আর আমরা হাসতে হাসতে একে অপরের গাঁয়ে ঢোলে পড়ছি। আমাদের হাসি ঠাট্টার মাঝে উপস্থিত হলো আদ্র মহাশয়। আদ্র কে দেখে বড় আম্মু জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু লাগবে বাবা?”

“তেমন কিছু না। তোমরা আড্ডা দেও”

আদ্রর কণ্ঠ পেয়ে উনার দিকে ফিরে তাকালাম। চোখেচোখি হলো দুজনার। লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললাম। সকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল। আচমকা উনি আমার ওপর ভর করে চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,
“সারারাত নিজে পুড়েছিস জ্বরের তাপে, আমায় পুড়িয়েছিস ভালোবাসার অনলে। এখন তোর নিস্তার নেই রৌদ্রময়ী”

কি করবেন উনি? ভীতু চোখে আদ্রর দিকে তাকিয়ে আছি। উনি তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। চোখ তো নয় যেন তীক্ষ্ণ তীর। এই বুঝি বিধলো আমার বুকে। আদ্র একটু একটু করে হেলে পড়ছে আমার দিকে। এদিক ওদিক যে সরবে সে অবস্থাও নেই। উনি আমায় উনার দুই হাতের মাঝে আটকে রেখেছে। আদ্র কেমন নেশালো চোখে তাকিয়ে আছে। তার ঐ নেশালো চোখে আমি আমার ধ্বংস দেখতে পাচ্ছি। তবে কি আজ আমার ধ্বংস নিশ্চিত? উনি একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। মনের মাঝে হাতুড়ি পেটা করছে। হৃদস্পন্দন অবসম্ভ গতিতে বেড়ে গেছে। বুক ওঠানামা করছে। আদ্র ঝুঁকে রয়েছে আমার ওপরে। উনার নিঃশ্বাস মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। ওনাকে এতটা কাছে দেখে হার্ট বিট এতটাই বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে এই বুঝি আমার হার্ট বাবাজি বেরিয়ে হাতে চলে আসবে। আদ্রর চোখের চাহনি অস্বাভাবিক। উনি প্রথমে কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। অতঃপর দুই গালে একে দিলো ভালোবাসার স্পর্শ। আমি চোখ বুজে রয়েছি। না পারছি উনাকে কিছু বলতে আর না পারছি ওনাকে নিজের ওপর থেকে সরাতে। আমার অবস্থা বেহাল। আদ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার অধর পানে। অধরে অধর মিলিত হবে এমন সময় কেউ দরজায় নক করলো। আদ্র হুসে ফিরলো। ‘চ’ সূচক শব্দ করে দূরে সরিয়ে নিল মুখ। দরজায় আবার কে যেন নক করলো। আমি উনার বিরক্তি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কে?”

“আমি, দরজা খোল”

আদ্র বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। বিরবির করে বসে উঠলো,
“এই শা*লী নামক প্যারার জন্য বউয়ের সাথে শান্তি মতো রোমান্সও করা যাবে না দেখছি। এদের জ্বালায় আমাকে সারাজীবন বিবাহিত বেচেলারই থাকতে হবে মনে হচ্ছে । না এটা মেনে নেওয়া যায় না। খুব শীঘ্রই বউ তুলে নিয়ে চলে যাবো”

উনি উঠে বিছানা থেকে নেমে গেলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে উনার কার্যকলাপ দেখছি।
“আমি ব্যালকনিতে যাচ্ছি। তুই গিয়ে দরজা খুলে দে”

আদ্র ব্যালকনিতে চলে গেল। আমি বিছানা থেকে নেমে নিজেকে ঠিকঠাক করে দরজা খুলে দিলাম। ইভা ভিতরে ঢুকে কপালে হাত দিয়ে বলল,
“তোর নাকি রাতে জ্বর এসেছিলো? আম্মু বলল”

“হ্যাঁ এসেছিলো”

“এখন ঠিক আছিস?”

“জ্বর এখন অনেকটাই কম”

“হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কেউ সারারাত জেগে সেবা করলে কি আর জ্বর থাকে বল? তার সেবায় অটোমেটিক জ্বর সেরে যাওয়ার কথা”

ইভার কথার মানে বুঝতে পেরে লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেললাম। ও জানলো কিভাবে যে আদ্র সারারাত আমার সেবা করছে? কে বলল ওকে? ইভা ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“বনু সামথিং সামথিং?”

কিছুটা ধমকের স্বরে বললাম,
“তুই বাজে বকা বন্ধ করবি?”

“আমি বললেই বাজে বকা আর সারারাত তোমার সেবা করা, নিজের খাওয়ার আগে তোমাকে খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দেওয়া, তার অসুস্থতায় তোমার আকুলতা আমায় কি বোকা মনে হয়? দুজনকে দেখে তো একদম লাভ বার্ড মনে হয়। আজকে একটা লাভার নেই বলে জ্বরে পড়ে থাকলেও কেউ খবর নেয় না সেবা তো দূরের কথা, আফসোস”

ইভা শেষের কথা গুলো এক রাশ আফসোস নিয়ে বলল। মনে হয় বেচারির কতো কষ্ট। ওর কান টেনে ধরে বললাম,
“ঢং বাদ দে। তুই আর পিয়াসও যে কম যাস না সেটা আমিও জানি। আজকে একটা বয়ফ্রেন্ড নাই বলে রেস্টুরেন্টে ঘুরতে যেতে পারি না, কেউ নোটও করে দেয় না, আরো কতো কি”

আমিও ইভার মতো আফসোসের সুরেই কথা গুলো বললাম। আমার ওর টোন কপি করা দেখে ইভা ফিক করে হেসে দিলো। আমিও ওর সাথে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে ইভা ব্যালকনির দিকে তাকালো। অতঃপর কাশি দিয়ে বলল,
“আদ্র ভাই কষ্ট করে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না আপনা, রুমে আসতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না”

ওর কথা শুনে জিভে কামড় দিলাম। শেষ পর্যন্ত ইভার কাছে ধরা খেয়ে গেলাম। ইভা আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“এই জন্যই বুঝি দরজার খুলতে দেরি হচ্ছিলো?”

লজ্জায় আমার মাথা কাঁটা যাচ্ছে। ও যে কি বোঝাতে চাইছে আমি সেটা হারে হারে বুঝতে পারছি। আজ এই আদ্র নামক বজ্জাত লোকটা জন্য এভাবে ওর সামনে আমায় লজ্জা পেতে হচ্ছে। আদ্র ব্যালকনি থেকে রুমে আসতেই ইভা জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছেন আদ্র ভাই?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই?”

“এইতো ভালো”

ইভা কিছু বলবে তার আগেই আদ্র আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“আমি বাইরে যাচ্ছি কিছু কাজ আছে। দরকার ছাড়া বিছানা থেকে নামবি না বলে দিলাম। কিছু লাগলে বড় মা বা মেঝ মাকে ডাকবি। এছাড়া কোনো প্রয়োজন হলে আমায় কল দিবি, মনে থাকবে?”

আমি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালাম। উনি গট গট পায়ে চলে গেলেন। নাহয় দুজনকে একসাথে লজ্জায় পড়তে হতো। আদ্র চলে যেতে ইভা আমার দিকে তাকিয়ে মুখে চব্বিশ ক্যারেটের হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কবে থেকে চলছে এসব বনু? চোখের সামনে দুজন প্রেম করে গেলি আর বুঝতেও পরলাম না, কি বোকা আমি। নিজের মাথা নিজেরই দেয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে করছে। তোদের দেখে মনে হয় পুরো জামাই বউ। কি সুন্দর মিষ্টি কথা কিছু দরকার হলে আমায় কল দিস। আমিতো পুরো ফিদা বনু”

“তুই তোর বাজে কথা নিয়ে সরবি নাকি লাত্থি খাবি?”

“এমন করিস কেন? একটু তো মজাই করছিলাম। শোন আজ কি হয়েছে”

ইভা ওর আর পিয়াসের কথা শুরু করে দিলো। আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। এই মেয়েটা একটু কিছু হলেই আমায় বলতে চলে আসবে। আমায় না বললে নাকি ওর ভালো লাগে না। কথাগুলো পেটের মাঝে ঘুরঘুর করে। আমায় না বলা পর্যন্ত ওর শান্তি নেই। আমিও চুপটি করে বসে ওর কথা শুনি। ইভার সাথে গল্প করে সময়টা ভালোই কেটেছে। নাহয় বিছানায় শুয়ে শুয়ে বোর হতে হতো। অনেকক্ষন আড্ডা দিয়ে ইভা ওর রুমে চলে গেল।
——

দুপুরের সময় রোদের তাপে নাজেহাল অবস্থা। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে রয়েছি। পর পর চারটা ক্লাসে করে ক্লান্ত। ক্যান্টিনে একজন আরেকজনের ওপর হেলান দিয়ে বসে আছি। ফাইনালি ক্লাস শেষ হলো। বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিয়ে বাহিরে এলাম। দুজনে উঠে বসলাম গাড়িতে। সারা রাস্তা এটা ওটা নিয়ে গল্প করতে করতেই সময় কেটে গেল। বাড়িতে ঢুকে কপাল কুঁচকে এলো। দরজার সামনে অনেক মানুষের জুতো। বাড়িতে কি কেউ এসেছে? ড্রয়িং রুম থেকেও মানুষের কথার শব্দ ভেসে আসছে। ইভার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কিরে বনু বাড়িতে কি কেউ এসেছে?”

“আমি কিভাবে বলবো বল? তুই যেখানে আমিও তো সেখানেই”

“চল ভিতরে যেয়ে দেখি”

দুজন ভিতরে ঢুকে দেখলাম ড্রয়িং রুমের সোফায় বসা অনেক মানুষ। তাঁদের মাঝে ঈশিতা আপু, আর শিহাব ভাইয়া, তার বাবা-মা, আর বিয়ের দিন যেই ছেলেটা আমাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করেছিল সেই ছেলেটা। কপাল কুঁচকে এলো। এরা এখন এই সময় আমাদের বাড়িতে কি করছে? ইভা জিজ্ঞেস করলো,
“বনু এই হাদারাম গাধা কি করছে আমাদের বাসায়? এটাকে তো আমার দেখতেই মন চায়না। কেমন বেহায়ার মত বিয়ের দিন ঘুরঘুর করছিলো। পারছিলাম না ধরে কেলানি দিতে”

আমি কিছু না বলে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের দেখে বড় আম্মু এগিয়ে এলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলে,
“এসে গেছিস? যা ফ্রেশ হয়ে নে”

ইভা জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মু ওনারা কেন এসেছে?”

“পড়ে জানতে পারবে। এখন ওপরে যেয়ে ফ্রেশ হও”

দুজন ওপরে চলে এলাম। ইভা ওর রুমে না গিয়ে আমার রুমে চলে এলো। দুজনে বসে ভাবছিলাম এদের হুট করে বাড়ি আসার কারণ কি? তবে বুঝতে পারছি না। এর মাঝেই ঈশিতা আপু এলে। এসেই জড়িয়ে ধরে হালচাল জিজ্ঞেস করলো। আপুর খুশির যেন শেষ নেই। আমি আপুকে বলে উঠলাম,
“তোমায় অনেক মিস করছি আপু। তুমি থাকলে আমাদের আড্ডাটা কতো জমজমাট হতো। মিস করি সেই সময়টা”

“আমায় যেন আর মিস না করসি সেই ব্যবস্থাই করছি। দুবোন একসাথে থাকবো”

আপুর কথার মানে বুঝতে পারলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
“মানে? কি বলছো? তুমি আর আমি একসাথে থাকবো কিভাবে?”

“জানতে পারবি। ওয়েট কর”

আপু উৎফুল্ল মনে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
“আজকে আমি অনেক খুশিরে রোদ। অনেক খুশি”

“কেন?”

আপু কিছু বলবে এমন সময় শিহাব ভাইয়ার ডাক। আপু আমাদের থাকতে বলে চলে গেল। আমি আর ইভা একে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছি। দুজনের কেউ কিছু বুঝতে পারছি না। এই সময় রোশনি এলো রুমের সামনে। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলে,
“তোমারা কি জানো ঈশিতা আপুরা কেন আসছে?”

আমরা দুজন মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝালাম। রোশনি রুমে ঢুকে ফিসফিস করে বলল,
“আমি জানি। শুনতে চাও?”

আমরা দুজন মাথায় নেড়ে সায় জানালাম। রোশনি আগের মতো ফিসফিস করেই বলল,
“ঈশিতা আপুর ওই হাদারাম গাধা মার্কা দেবরের জন্য রোদ আপুকে বউ বানিয়ে নিয়ে যেতে চায়। এই আমি যে তোমাদের আগে ভাগে বলে দিলাম এটা কাউকে বলো না যেন। আমি যাই তোমরা থাকো”

রোশনি যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেল।

#চলবে?