এই জোছনা ধারায় পর্ব-৫+৬

0
259

#গল্পঃ_এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব |০৫|
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
—-
কেউ এ বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই বুঝে ফেলবে এখানে পলি বেগমই সর্বেসর্বা। তিনি যেন সাক্ষাৎ বাঘিনী। এত দাপট, আধিপত্য তার!

এশা গহনা আনতে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বেড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর বুকের ভেতরটা এমন ভাবে ধুকপুক করছে যেন হৃদযন্ত্রটা বিকল হয়ে যাবে। ফুয়াদ নিজে গিয়ে আনতে পারে না গহনা? ওকে কেন পাঠাচ্ছে! এ বাড়ির অন্য সবার মতই সে ও তো মায়ের প্রতি অনুগত। তার সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলার ক্ষমতা আছে। তাহলে পলি বেগমের কাছে গহনা থাকা নিয়ে সে এমন প্রতিক্রিয়া কেন করছে! এসব হেঁয়ালির মানে বুঝতে পারছে না এশা।

–দাঁড়িয়ে আছো কেন এভাবে? কতক্ষণ ধরে যেতে বলছি তোমাকে। আবার গিয়ে বলো না যে আমি গহনা চেয়ে পাঠিয়েছি। এসব মেয়েদের ব্যাপারে আমাকে জড়িয়ো না। তোমার গহনা তোমার কাছে থাকা উচিত সেজন্য আনবে।

পিছন থেকে ডেকে বলল ফুয়াদ। এশা এই কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে পলি বেগমের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। এই মুহুর্তে ওর মনে হচ্ছে ফুয়াদের অন্য কোনো পছন্দ আছে। সে বোধ হয় ওকে দিয়ে এসব কাণ্ড করিয়ে পলি বেগমের হাতে ওর প্রাণটা নাশ করাতে চাচ্ছে! তাহলে তার রাস্তা পরিষ্কার হবে।

পলি বেগম খাটের উপর বসে আছেন। তার চোখে ভারী চশমা। হাতে প্রতিদিনের হিসাবের
ডায়েরিটা। সেটির দিকে তাকিয়ে থেকেই এশাকে জিজ্ঞেস করল,

–কিছু বলবে?

ওর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার কাছে গহনা চাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া সহজ ব্যাপার। তীব্র সংকোচে ভয় ভয় মুখে এশা বলল,

–মা আমি শাড়ির সঙ্গে একটু গহনা পরতে চাচ্ছিলাম।

পলি বেগম এবার ভালো ভাবে চোখ তুলে তাকালেন এশার দিকে। প্রথমেই ওর পরনের সাদা চকচকে জামদানিটা নজরে পড়লো। এই শাড়ি তো ওকে বিয়তে দেয়নি।

–শাড়ি কোথায় পেয়েছো?

বউকে শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্যও কি এ বাড়ির ছেলেরা মায়ের থেকে অনুমতি নেয়? তা না হলে পলি বেগম এভাবে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

–আপনার ছেলে এনেছে।

–বাহ! বেশ সুন্দর দামী শাড়ি। বাসায়ও কি এভাবে দামী শাড়ির সঙ্গে স্বর্ণ গহনা পরতে?

এশার মুখটা ছোট হয়ে গেল। পলি বেগম ওকে কৌশলে অপমান করছেন! ও সহজ ভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল,

–না, বিয়ের আগে আমি তেমন শাড়ি পরতাম না।

–বিয়ের পর দামী শাড়ি পেয়েছো। আবার এত রাতে আমার কাছে গহনা চাইতে এসেছো।

এশা কিছু বলল না। ওর প্রবল আত্মসম্মান টানাপোড়েনের জীবনে নড়বড়ে হয়ে গেছে। কিন্তু একেবারে ধুয়ে মুছে যায়নি। অপমানে ওর কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

–মানুষ যত পায় তত চায়।

বিড়বিড় করে বললেন পলি বেগম। এরপর বিরক্ত মেজাজে খাট থেকে নেমে নিজের রুমের দক্ষিণ কোণে বেশ যত্নে রাখা লোহার ভারি সিন্দুকটা খুললেন। এই সিন্ধুক খানা তার নানার আমলের। নানার স্মৃতি হিসাবে তিনি এটি রেখে দিয়েছেন।

পলি বেগম সিন্দুক থেকে সব সময় পরার মত সাধারণ কিছু গহনা বের করে এশার হাতে দিলো। ফুয়াদ তো ওকে ওর সমস্ত গহনা নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। এই মুহুর্তে সেটা বলার কথা ভাবতেও এশার কলিজা কাঁপছে। ও পারবে না বলতে! তাতে যদি ফুয়াদ ওকে খুন করে ফেলে, করুক।

এশা থমথমে মুখে রুমে গেল। ফুয়াদ ওকে আর ঘাঁটালো না। ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলো। এরপর ওকে কাছে টেনে নিলো।

এশা নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিলো। কিন্তু ফুয়াদের স্পর্শে কোনো প্রেম খুঁজে পেল না। এ যেন কেবলই শারীরিক চাহিদা। দুই দিনের পরিচয়ে প্রেম খোঁজা নিজের বোকামি কিনা বুঝতে পারলো না! তবে এইটুকু পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারছে যে ওর সঙ্গে পাশের বালিশের মানুষটার মনের দূরত্ব এক পৃথিবী!
___

পলি বেগম ছিলেন ধনী বাপের একমাত্র মেয়ে। তার আর কোনো ভাই-বোন নেই। মনসুর উদ্দিন ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তার চেয়েও ধনী পরিবারে। কিন্তু পলি বেগমের আচার-ব্যবহারের কারণে সেই সংসার টিকলো না। আশেপাশের সকলের উপর আধিপত্য বিস্তার করা, কর্তৃত্ব ফলানোর অদ্ভুত নেশায় মত্ত তিনি।

পলি বেগমের প্রথম সংসার ভাঙার পর মনসুর উদ্দিন সিদ্ধান্ত নিলেন তার একমাত্র মেয়েকে দ্বিতীয় বার বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠাবেন না। বৃদ্ধ বয়সের একাকিত্বর কথা চিন্তা করে তিনি মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য এমন পাত্র খুঁজলেন যে ঘর জামাই থাকতে রাজি! কোনো ধনী পরিবারের সু-পাত্র এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক ছেলেই অর্থ সম্পদের লোভে পড়ে রাজি হলো। তাদের ভিতর শফিক আহমেদকে মনসুর উদ্দিন পছন্দ করলেন। অর্থবিত্ত কম থাকলেও শিক্ষিত, রুচিশীল, মার্জিত। তিনি এমন পাত্রই খুঁজিলেন।

ফুয়াদের বাবা শফিক আহমেদের তেমন কোনো আধিপত্য নেই এই সংসারে। এমনকি নিজের মা, বোনকে এ বাড়িতে দুই বেলা খাওয়ানোর জন্যও পলি বেগমের অনুমতির দরকার হয়।

মনসুর উদ্দিন গত হয়েছেন। তার সমস্ত সম্পত্তি পলি বেগম পেয়েছেন। এই পাঁচ তলা অভিজাত বাড়ি, বিশাল ফ্যামিলি বিজনেস সবকিছুই তো পলি বেগমের নামে। এ কারণেই তিনি এই সংসারের সর্বেসর্বা। তার কথা সকলে মেনে চলতে বাধ্য।

পলি বেগম সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান মানুষের উপর কর্তৃত্ব ফলিয়ে এবং বছরের পর বছর ধরে তিনি সেটাই করছেন। তার প্রায়ই আফসোস হয়, ইশ্! তিনি যদি মুঘল সম্রাজ্ঞী নুর জাহান হতেন! আরো কত ক্ষমতা থাকতো তার!
__

বাইরে সবে ভোরের আলো ফুটছে। এশা চোখ খুলে দেখলো ফুয়াদ পাশে নেই। এত সকালে সে কোথায় যায় কে জানে!

পলি বেগম ঘুম থেকে উঠতেই শম্পা চা নিয়ে হাজির হয়। চায়ে চিনি বেশি হয়েছে। পলি বেগম বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন,

–তোমার বাপের মাথা বানাইছো! এত চিনি দিয়েছো কেন?

শম্পা দ্রুত আরেক কাপ চা করে নিয়ে আসে। ওদিকে অর্পি কাঁদছে। তার কান্না থামানোর চেয়ে পলি বেগমের জন্য নতুন করে চা বানানো গুরুত্বপূর্ণ।

পলি বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন,

–তুমি আর মারুফা আগামী এক সপ্তাহ বাসার কোনো কাজ করবে না।

–তাহলে কাজ কে করবে?

–এশা করবে। মেয়েটার হাবভাব আমার ভালো লাগছে না। বিয়ের আগে তো ভালোই দেখছিলাম।

শম্পা মনে মনে খুব খুশি হলো। আগামী এক সপ্তাহ শান্তিতে কাটবে।
__

বাসায় মানুষ এগারো জন। একা একা সকালের নাস্তা বানাতেই এশার শ্বাস গরম হয়ে গেল। নাস্তা বানানোর পর পলি বেগম ওকে ডেকে দুপুরের রান্নার তালিকা ধরিয়ে দিলেন।

এত কাজ একা এশা কখনো করেনি। এত মানুষের রান্না! মারুফা আর শম্পা কেন কোনো কাজ করছে না–এই প্রশ্ন করার দুঃসাহস ওর নেই।

এশা রান্না ঘরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। কোনটা যে আগে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। এখন থেকে কি বাসার সব কাজ ওর একা করতে হবে?

ফুয়াদ বাসায় এসে দেখলো এশা রান্নাঘরে একা সমস্ত কাজ করছে। ও গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–কি ব্যাপার? তুমি একা কেন? বড় ভাবী, মেজো ভাবী?

–জানি না।

–জানো না মানে। তুমি একা কাজ করছো কেন? তুমি কি একা খাবে?

ফুয়াদ আজ আবার ওকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে। এশা জোরালো গলায় বলল,

–সমস্যা নেই। আমি পারবো।

–আমার সমস্যা আছে। মাকে গিয়ে বলো তুমি একা এত কাজ করতে পারবে না।

–পারবো আমি।

–তুমি নাকি পড়াশোনা করবে। অনার্স শেষ করবে। তুমি যদি এভাবে মুখ বুঁজে সব কাজ একা করা শুরু করো তাহলে কিন্তু সব তোমার উপরই চাপিয়ে দিবে। পড়াশোনার জন্য কোনো সময় পাবে না।

এই বলে ফুয়াদ চলে গেল। এশা অনেকক্ষণ যাবৎ ব্যাপারটা ভেবে পলি বেগমের কাছে গিয়ে বলল,

–মা এত কাজ আমি একা করতে পারছি না। ভাবীদের বলুন আমাকে সহযোগিতা করতে।

পলি বেগম চোখ বের করে তাকিয়ে থাকলেন এশার দিকে। তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে আছে।

(চলবে)..

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৬

এশার সাহস দেখে পলি বেগম চূড়ান্ত অবাক হয়। মারুফা আর শম্পা তো আজ পর্যন্ত এ ধরণের কথা বলার সাহস করেনি। তিনি যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে। আর এ মেয়ে কাল এসে আজই..। রাগে পলি বেগমের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। তবুও তিনি ঠাণ্ডা মেজাজে বলার চেষ্টা করলেন,

–তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো। এত কথা বলো কেন তুমি?

এশা নিচু গলায় বলল,

–এত রান্না একা করতে করতে তো বিকাল হয়ে যাবে।

এবার পলি বেগমের গলায় ক্রোধ প্রকাশ পেল,

–তুমি একাই দুপুরের মধ্যে সব রান্না শেষ করবে। এবং আজ থেকে প্রতিদিনই তুমি একা রান্না করবে।

এশা কোনো উত্তর দিলো না। পলি বেগমের মুখে মুখে তর্ক করার সাহস ওর নেই।

–এ বাড়িতে যদি আমার কথা মেনে চলতে না পারো তাহলে বাপের বাড়ি চলে যাও। তোমার তো অবশ্য বাপের বাড়িও নেই।

এশার চোখ ছলছল করছে। এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছে, এরচেয়ে যদি গরীব পরিবারের অল্প শিক্ষিত কাউকে বিয়ে করতো তাও একটু শান্তিতে থাকতে পারতো। এত প্রাচুর্য, আভিজাত্য দিয়ে কী হবে? এখানে একটু শান্তিতে নিঃশ্বাসও ফেলা যায় না।

এশা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওখান থেকে চলে আসলো। এরপর সব রান্নাবান্না একাই করতে লাগলো। কিন্তু ওর এত দুঃখ হচ্ছে! চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো।

ফুয়াদ নিজের রুমে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। নামীদামি একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও ওকে ফ্যামিলির ব্যবসা দেখতে হচ্ছে! সুইডেনের স্কলারশিপটা পেয়েও যেতে পারলো না শুধুমাত্র পলি বেগমের জন্য। ওর সাথের বন্ধু বান্ধব নিজের পছন্দ মত বিয়ে করে দেশ-বিদেশে ঝকঝকে জীবন কাটাচ্ছে। আর ও আটকে রয়েছে কি এক বিচ্ছিরি আটপৌরে জীবনে। যে জীবন ও কখনই চায়নি!

এই ব্যবসা এই পরিবার কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ খুঁজে পায় না ফুয়াদ। এশা মেয়েটা দেখতে সুন্দর। মাঝে মাঝে ভালো লাগে। কিরকম মিনমিনে স্বভাবের মেয়েটা। চারকুলে কেউ নেই বলে হয়ত কোনো কিছুর প্রতিবাদ করার সাহস করে না। এমন মেয়ে জীবনসঙ্গী হিসেবে ও কখনো কল্পনা করেনি।

পলি বেগম চেয়েছেন ফুয়াদের এই মেধাটা তাদের ব্যবসায় কাজে লাগুক। তার তিন ছেলে মিলে ব্যবসার হাল ধরলে ব্যবসাটা আরো এগিয়ে যাবে। বড় দুই ছেলে ব্যবসা নিয়ে মনোযোগী হলেও ফুয়াদ গত এক সপ্তাহে চার লাখ টাকার লোকসান করেছে।

শফিক আহমেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফুয়াদকে ডেকে বলল,

–এদিকে আসো তো একটু।

ব্যবসা সংক্রান্ত আলাপ ছাড়া শফিক আহমেদ অন্য কোনো বিষয়ে নাক গলান না। ফুয়াদ যে লোকসান করেছে নিশ্চয়ই তার জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে।

–দেখো তোমার মা যখন চেয়েছে তুমি এই ব্যবসায় থাকো তখন তোমাকে থাকতেই হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে তোমার ভিতর কোনো গুরুত্ব দেখছি না। চার লাখ টাকা লস হলো কীভাবে? তুমি কি ইচ্ছে করে করছো এসব?

ফুয়াদ গা ছাড়া ভাবে বলল,

–ব্যবসায় লাভ লস দুইটাই হবে। ইচ্ছে করে করবো কেন?

–তোমার মা জানলে কি হবে সেটা কি বুঝতে পারছো?

–কী হবে? কী হওয়ার বাকী আছে? যাও গিয়ে জানাও। ঘর জামাইদের সবকিছুর হিসাবই বউয়ের কাছে দিতে হয়।

শফিক আহমেদ চোখ লাল করে ছেলের দিকে তাকালেন। ফুয়াদ সে সবের তোয়াক্কা না করে ওখান থেকে উঠে এলো।

বিরক্ত মেজাজে রুমে এসে দেখলো এশা সদ্য গোসল সেরে বের হয়েছে। ওর রান্নাবান্না শেষ হয়েছে একটু আগে। ও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল গুলো খুলে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে দ্রুত শুকানোর চেষ্টা করছে। টেবিলে খাবার বেড়ে দিতে হবে। এই কাজও ওর ঘাড়ে পড়েছে। এশাকে দেখতে স্নিগ্ধ লাগছে ভীষণ। সকালের শিশির ভেজা ফুল দেখতে যে রকম স্নিগ্ধ লাগে। ফুয়াদ ওকে পিছন থেকে সাপের মত পেঁচিয়ে ধরলো। ও চুলে শ্যাম্পু করেছে বোধ হয়। খুব সুন্দর ঘ্রাণ আসছে।

–এত দেরি হলো কেন? রান্না কি একা একা করেছো?

এশা ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। ফুয়াদের মেজাজটা চট করে গরম হয়ে গেল। এশাকে নিজের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে বলল,

–কেন তোমাকে কি বলেছিলাম?

–মাকে বলেছিলাম কিন্তু…।

–কিন্তু কী? কীভাবে বলেছো? মিনমিন করে বলেছো?

এই বলে ফুয়াদ হঠাৎ করে এশার গালে চড় মেরে বসলো। ও গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। ফুয়াদ ওর গায়ে হাত তুলবে এটা ওর ধারণার বাইরে ছিলো।

মাত্র ক’দিন হলো বিয়ে হয়েছে। সদ্য বিবাহিত বউয়ের গায়ে এভাবে হাত তুলেও ফুয়াদের ভিতর কোনো অনুশোচনা দেখা গেল না। রাগের মাথায় মেরেছি কিংবা ভুল হয়েছে—এ ধরণের কিছু বলেও দুঃখ প্রকাশ করলো না।

এশা খাটের উপর বিমর্ষ মুখে বসে আছে। ফুয়াদ স্যুট বুট পরে তৈরি হয়ে এশাকে বলল,

–আমি দুইদিন বাড়ি ফিরবো না। আমাকে ফোনে পাওয়া যাবে না।

এশা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। ফুয়াদ বেড়িয়ে গেল। এশার জীবন আগে থেকেই এলোমেলো ছিলো। কিন্তু এখন একটু বেশি এলোমেলো মনে হচ্ছে। এই কয়দিনেই এ বাড়িতে থেকে এত হাঁপিয়ে গেছে যে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে!
__

রাতে এশার মেজো মামা ফোন দিয়ে বললেন,তোর মা সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে। তুই এক্ষুণি আয় তো। এশার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ও ফোন রেখে পলি বেগমের কাছে ছুটে গেল। অস্থির স্বরে বলল,

–মাকে দেখতে আমি এক্ষুণি হাসপাতালে যাবো।

এশার তীব্র অস্থিরতার বিপরীতে পলি বেগম ভীষণ গুরুত্বহীন ভাবে বলল,

–সকালে যেয়ো। এখন রাত হয়েছে। তাছাড়া ফুয়াদও বাসায় নেই।

এটা তো ঘরের সমস্ত কাজ করা কিংবা গহনার ব্যাপার নয় যে এশা মুখ বুঁজে মেনে নিবে। ও বলল,

–ড্রাইভার আছে তো। তাকে বলুন আমাকে একটু হাসপাতালে নামিয়ে দিতে।

পলি বেগম চাইলেই এটা করতে পারেন কিন্তু তিনি করবেন না। এই মেয়েটা কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে তার মেজাজ খারাপ করেছে। আজকে এটা ওর শাস্তি।

–বললাম তো সকালে যেয়ো।

এশা ধরে আসা গলায় বলল,

–আমার মা হাসপাতালে ভর্তি। মাথায় খুব আঘাত পেয়েছে। সকাল হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারবো না।

–তো তুমি কি করতে চাও? আমার অনুমতি ছাড়াই যেতে চাও?

পলি বেগম ভেবেছিলেন এশা অন্যান্য দিনের মত দমে যাবে। কিন্তু ও আবার বলল,

–আপনি অনুমতি দেন। আমি একাই যাবো।

–বাড়ির বউ রাতে একা বের হতে চাচ্ছো? তুমি এত সাহস পাও কোথায় বলো তো?

এশার এই মুহুর্তে কোনো কিছুকে পরোয়া করতে ইচ্ছে করছে না। ও ধৈর্য হারিয়ে বলল,

–আপনি অনুমতি না দিলে আমি আপনার অনুমতি ছাড়াই যাবো।

–তুমি আমার অনুমতি ছাড়া এ বাসার বাইরে পা ফেলো তো পারলে।

পলি বেগমকে হতভম্ব করে এশা বাসা থেকে বেড়িয়ে পরলো। এর জন্য কি হতে পারে সেই ভয় ও এই মুহূর্তে পাচ্ছে না।

এশা রিক্সা নিলো। মেজো মামা আবার ফোন করছেন। ওর বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠলো। ফোন ধরার সাহস হলো না। কোনো খারাপ খবর নয় তো? ফোনটা রিং হয়ে কেটে গেল।

ফুয়াদ কোথায় গেছে দুই দিনের জন্য? এই মানুষটা ওকে পছন্দ করে না, ভালোও বাসে না তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। তার মনের নাগাল পাওয়া ও সম্ভব না। এই দুঃখটা ও নাড়া দিলো হঠাৎ। এশা বার বার চোখ মুছতে লাগলো।

রিক্সা জ্যামে আটকা পড়েছে। এশার অস্থিরতা বাড়ে। হঠাৎ ওর অস্থির দৃষ্টি আটকে যায় একটা নীল রঙের বাইকের দিকে। যেটাতে ফুয়াদ বসে আছে। এবং তার পিছনে বসে আছে অত্যন্ত খোলামেলা পোশাকের একটা মেয়ে।
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা