এই জোছনা ধারায় পর্ব-০৯

0
237

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৯

এশা বোকার মত তাকিয়ে রইল। ফুয়াদ দরজা ঠেলে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেয়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। এশা ভিতরে না ঢুকে বোকা বোকা চেহারায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ফুয়াদ আবার দরজার কাছে এগিয়ে গেল।

–কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো।

বাসায় ঢুকতেই এশার চোখে পড়ে একটি লিভিং রুম। রুমটার মাঝ বরাবর মাদুর বিছানো। এক কোণে দুইটি লবি চেয়ার এবং সেন্টার টেবিল বসানো। দুই কোণে দুইটি কাঠের ফুলের স্ট্যান্ড। অত্যন্ত রুচিশীল কায়দায় সাজানো।

এরপর একটা বেডরুম দেখতে পেল। ছিমছাম, গোছালো। রুমে আসবাবপত্র বলতে একটি খাট। একটি বেড সাইট টেবিল। সেটির উপর রাখা ল্যাম্প। বড় একটি আয়না এবং বিন ব্যাগ চেয়ার।

এশা আর একটু চোখ ঘুরিয়ে ছোট একটা রান্নাঘর দেখতে পেল। তবে সেখানে খুব একটা রান্নাবান্না হয় না বলেই বুঝা যাচ্ছে।

এশা বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

–এটি কার বাসা?

ফুয়াদ স্বাভাবিক ভাবে বলল,

–আমার। টাকায় কেনা নয় ভাড়ায়।

গতকাল থেকে টানা কয়েক ঘন্টা বাইক চালিয়েছে ফুয়াদ। ঢাকার বাইরেও গিয়েছে বাইক নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে। তার উপর সমস্ত রাত আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছে। ও ক্লান্ত শরীরে চেয়ারে বসে চোখ বুঁজে।

এশা বিচলিত হয়। ফুয়াদের আলাদা ফ্ল্যাট রয়েছে! এটি কি স্বাভাবিক ব্যাপার? ফুয়াদ যে খুবই স্বাভাবিক ভাবে ব্যাপারটা প্রকাশ করছে।

–আলাদা ফ্ল্যাট কেন নিয়েছেন?

ফুয়াদ চোখ মেলে এশার দিকে তাকিয়ে বলল,

–এত অবাক হওয়ার কিছু নেই এতে। আমি ছোট বেলা থেকেই স্বাধীনচেতা। বাড়িতে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা পাইনি বলে ভার্সিটি লাইফ থেকেই নিজের জন্য বাইরে একটা থাকার জায়গা রাখতাম। এই যেমন ধরো বন্ধুদের মেসে একটা সীট রেখে দিতাম। মাঝে মাঝে গিয়ে নিজের মত গিয়ে একটু সময় কাটাতাম। এই বাসাটাও সেরকম। নাথিং এলস।

এশা কিছু বলল না। ও মনে মনে খুব বিস্মিত হয়েছে। ফুয়াদ আবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

–আরে অন্য কোনো ব্যাপার নেই। মেয়েটেয়ে নিয়ে থাকি না এখানে। সেরকম হলে তোমাকে নিয়ে আসতাম না।

–আমি বলিনি মেয়ে নিয়ে থাকেন এখানে।

–তোমাদের মেয়েদের মাথায় প্রথমেই এসব চিন্তা আসে। সেটা আবার বলতে হবে কেন! এ্যানিকে আমার বাইকে দেখে গার্লফ্রেন্ডই ভাবতে হলো! বন্ধুও হতে পারে তা ভাবোনি কেন?

–এরকম বন্ধু আমার কখনো ছিলো না। তাই ভাবতে পারিনি।

কথাটা এশা আস্তে করে বললেও ফুয়াদের কানে গেল।

–আমি সিগারেট ধরাবো। যাও শোবার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। তার আগে খাটের নিচ থেকে আমার অ্যাশট্রেটা একটু দিয়ে যাও।

এশা অ্যাশট্রে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,

–আপনার এই ফ্ল্যাটের কথা বাসার কেউ জানে?

ফুয়াদ সিগারেট ধরিয়ে উত্তর দিলো,

–না। পলি বেগম জানলে আমাকে ক্রসফায়ার করবে।

এশা রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। বহু দিন পর ও যেন একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। সূবর্ণা কিংবা পলি বেগম কারো ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হচ্ছে না।

রুমের খোলা দরজা দিয়ে এশা একটু উঁকি দিলো লিভিং রুমের দিকে। ফুয়াদ এখনো চেয়ারে বসে দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে আরাম করে ফুকছে। একটা হালকা সবুজ রঙের শার্ট তার পরনে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো। এশার মনের ভিতর নতুন করে যেন একটা রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে। দেখতে-শুনতে, চলন-বলনে এমন সুদর্শন পুরুষের প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয় ওর খুব। ইশ্! এই চমৎকার মানুষটা যদি ওকে একটু ভালোবাসে তাহলে বোধ হয় ওর কোনো দুঃখ ই থাকবে না।

ফুয়াদ সিগারেট শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে শোবার রুমের দিকে পা বাড়ায়। এশা দ্রুত উঁকি দেওয়া বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।

ফুয়াদ এসে জিজ্ঞেস করল,

–এশা ঘুমিয়েছো?

ও ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,

–উঁহু। চোখ বুঁজে আছি। মাথা ব্যথা করছে।

ফুয়াদ কোথা থেকে যেন একটা পেইন রিলিফ মলম বের করে এশার মাথার কাছে বসলো। এরপর সেটি ওর কপালে লাগিয়ে দুই আঙুল দিয়ে মালিশ করে দিতে লাগলো।

এশার এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। সামান্য এইটুকু যত্নে ও যেন জীবনের সমস্ত কষ্ট ভুলে গেল। কী আশ্চর্য ব্যাপার! একটু ভালোবাসা, যত্নের এত কাঙাল ও!

–আগের চেয়ে ভালো লাগছে?

ফুয়াদ জানতে চাইলো। এশা বলল,

–হুঁ।

এই মুহূর্তে ওর সবই ভালো লাগছে। ফুয়াদের শরীর থেকে আসা সিগারেটের গন্ধও ভালো লাগছে।

–রাতে কি খাবে? তোমার পছন্দের মাংস আর ভাত নাকি অন্য কিছু?

–এখানে কী রান্না করার সবকিছু আছে?

–আছে। তুমি রান্না করবে? আমি বাইরে থেকে আনাবো ভাবছি।

এশা উঠে বসে বলল,

–আপনি কি খেতে পছন্দ করেন বলুন। আমি রান্না করে দিচ্ছি।

–আমার পছন্দের রান্না করতে হবে না। আমি আমার পছন্দ মত বাইরে সব সময়ই খাই। তুমি তো বাড়িতে সেটা পারো না।

এশা মনে মনে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে। আসলেই পারে না! পলি বেগমের অনুমতি দরকার হয়। অনুমতি মিললেও শুধু নিজে একা কিছু রেঁধে খাওয়া যায় না। সকলের জন্য রাঁধতে হয়। মহা ঝামেলার ব্যাপার!

ফুয়াদ কাকে যেন ফোন করে রান্নার জন্য যা যা দরকার আনার ফরমাশ দিলো। এশা বিছানা ছেড়ে নেমে ব্যালকনির দিকে গেল। ছোট্ট একটা ব্যালকনি। পুরোটা জুড়ে ফুলের টব রাখা। কিন্তু অধিকাংশই গাছই শুকিয়ে গেছে।

ফুয়াদ বলল,

–এখানে তো মাঝে মাঝে আসি। গাছ গুলোতে পানি দেওয়া হয় না এজন্য শুকিয়ে যায়।

–আপনার বাসাটা খুব সুন্দর।

–থ্যাংক ইউ।

এরপর ফুয়াদ বলল,

–বাসায় যে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়ে আসছো সেটা কি তোমার মাথায় আছে? সামলাবে কীভাবে?

এখানে এসে অমন ভয়াবহ ব্যাপার ও কীভাবে যে বেমালুম ভুলে গেল! এখন মনে পড়তেই আবার ভয় করছে।

–জানি না। মায়ের এক্সিডেন্টের খবর শুনে আমি কীভাবে না গিয়ে থাকি!

–এক কাজ করো। কাল মাথায় ব্যান্ডেজ করে বাসায় যাও। গিয়ে বলো যে মাথায় আঘাত পেয়ে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছো। এছাড়া রেহাই পাবে না।

–আপনার মা আমার মাথায় আর একটা আঘাত করে স্মৃতি ফিরিয়ে দিবে।

ফুয়াদ হাসলো। এর ভিতর কলিং বেল বেজে উঠে। খলিল চাচা বাজার নিয়ে এসেছে বোধ হয়। তিনি এই বাসার দারোয়ান। ফুয়াদ এশাকে রান্না ঘরের সব কিছু দেখিয়ে দিলো।

এশা আবার জিজ্ঞেস করল,

–আপনারা জন্য কি রান্না করবো? আপনি কি খেতে চান?

–এই মুহূর্তে তোমাকে একটা চুমু ছাড়া আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।

এশা একটু লজ্জা পেল। ওর ভিন্ন একটা অনুভূতি হলো। এর আগে কেবল শরীরের টানেই কাছে নিয়েছে ওকে। আজ এটি যেন প্রেমের আবেদন।

–থাক। এখন না, রাতে। আমি এখন একটু বের হবো। আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।

এশা তীব্র আশাহত হলো! ওর মন খারাপ হলো! ও ফুয়াদের সঙ্গ উপভোগ করছিলো। ওর জোর গলায় বলতে ইচ্ছে করছে, আপনি কোথায়ও যেতে পারবেন না এখন। কিন্তু সেটা কিরকম একটু অনধিকার চর্চা মনে হচ্ছে। অধিকার খাটানোর মত জোর পেল না।

ফুয়াদ গায়ের শার্টটা বদলে নিলো। এরপর রান্নাঘরে এশার কাছে এসে বলল,

–আমার প্রতি বেশি ভালোবাসা, মায়া-টান করো না। হঠাৎ যেকোন মুহূর্তে শুনবে আমি দেশের বাইরে চলে গেছি। কত বছর পর ফিরবো জানি না।

এশা বিমূঢ় হয়ে তাকালো। ফুয়াদ হঠাৎ ওর ঠোঁট জোড়ায় একটা চুমু খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা