#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৭
শুক্রবার হওয়ায় ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে বেলায় হওয়ার আরো সমস্যা। ফুয়াদ ওর বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে শেষমেশ এশাকে একটা হাসপাতালে নিয়ে আসে। এখানকার পরিবেশ তেমন ভালো না। কিন্তু একজন ডাক্তার পাওয়া গেল।
এশা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। তার চেহারা খুব ম্লান, পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। গায়ের জ্বর এখনো কমেনি। ঘন্টাখানেক আগে ওষুধ খাইয়েছে। ডাক্তার বলেছে রাতের ভিতর জ্বর কমে যাবে। ফুয়াদ একটু পর পর ওর কপালে হাত দিয়ে দেখছে। রাতটা হাসপাতালেই থাকতে হবে। বিছানা একজনের। সেখানে এশা শুয়ে আছে। ফুয়াদ একটু জায়গা করে ওর পাশে বসলো। পুরো রাত জেগেই কাটাতে হবে।
ফুয়াদ এশার পাশে বসে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। মোবাইল চালানো ছাড়া আপাতত করার কিছু নেই। সুস্মিতার নম্বর থেকে দুইটা কল এসেছে ঘন্টা দুয়েক আগে। ও বিস্মিত হয় সাথে কৌতূহলীও।
ওদের সম্পর্ক ভেঙেছে সেই কবে। এরপর ও বিয়ে করলো। দায়সারা ভাবে এশার সঙ্গে সংসারটাও করে যাচ্ছে। এর ভিতর সুস্মিতা কোনো ভাবেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। এমনও না যে ফুয়াদ যোগাযোগের কোনো রাস্তা রাখেনি। ফোন নম্বর, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ সব আগের মতই আছে। আজ হঠাৎ কীসের জন্য হুট করে ও বাসায় হাজির হলো! এখন আবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে!
এশার হাত দুইটা বুকের উপর ভাঁজ করে রাখা। সে হঠাৎ বুক থেকে ডান হাতটা নামিয়ে পাশে রাখলো। সেটি ধীরে ধীরে ফুয়াদের আঙুল স্পর্শ করলো। ফোনের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে ফুয়াদ সেদিকে তাকালো। এশার কপালে, গালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আগের মতই আছে। ডাক্তার কি ওষুধ দিলো! তাকে এখন পাওয়াও যাবে না। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই!
ফুয়াদ ভেবেছিল একটু বাইরে বের হয়ে সুস্মিতার কল ব্যাক করবে। সাথে সিগারেটও খেয়ে আসবে। কিন্তু এশা এমন ভাবে হাত ধরেছে, মনে হচ্ছে সে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আশ্রয় খুঁজছে। ফুয়াদ আর হাত ছাড়িয়ে বাইরে গেল না। এশার পাশেই থাকলো। ওর দিকে কিছুটা ঝুঁকে মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,
-আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? শরীর খুব খারাপ লাগছে? ভয় পাচ্ছো তুমি?
এশার থেকে কোনো উত্তর আসলো না। সে আগের মতই চোখ বুঁজে আছে। এবং ফুয়াদের হাত ছেড়ে দিলো।
ফুয়াদ এবার নিজ থেকেই ওর হাত ধরলো। যাতে ওর ভয় কমে, ভরসা পায়।
-হাত ছাড়লে কেন? তুমি তো আমাকে ভালো মুশকিলে ফেলেছো। কথা বলছো না, কিছু না।
প্রত্যুত্তরে এশা কিছুটা অস্ফুট গলায় ওর মায়ের কথা বলল। কি বলেছে ফুয়াদ পরিষ্কার শুনতে পেল না।
-তোমার মাকে আসতে বলব?
-হু।
-এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে। এত রাতে আসতে পারবে? সকালে বলি তার চেয়ে।
-হুম।
-তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।
এশার মুখ কাতর দেখালো। ফুয়াদ হাত থেকে ফোনটা রেখে একটু এগিয়ে ওর মাথার কাছে বসলো। খোঁপা করা চুল গুলো খুলে দিয়ে চুলের ভিতর আঙুল চালিয়ে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করলো। ও যাতে একটু ঘুমাতে পারে।
এই বাড়তি আদিখ্যেতা কেন করছে ও জানে না। এসব করার মত কোনো দায়বদ্ধতা নেই ওর। তবুও করছে। জ্বর এখনো ছাড়ছে না। সেটা নিয়েও ভিতরে ভিতরে সামান্য দুশ্চিন্তা অনুভব করছে। ফুয়াদের ধারণা এইটুকু দুশ্চিন্তা হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক। চোখের সামনে অপরিচিত কারো অসুস্থতা দেখলেও মানুষের একটু খারাপ লাগে। এশার প্রতি ভিন্ন কোনো অনুভূতি থেকে এই দুশ্চিন্তা হচ্ছে না— ফুয়াদ নিজের মনকে সেটাই বিশ্বাস করাতে চাচ্ছে।
এশা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর গায়ের জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। রাতও প্রায় শেষ। ফুয়াদ ওর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো। জীবনে এই প্রথম অসুস্থ কারো পাশে পুরো রাত জেগে কাটিয়েছে। এছাড়া আর কি করার ছিল! শুধু জ্বর কেন, ওই বাড়িতে এরচেয়ে সাংঘাতিক কোনো অসুখ হলেও এশাকে নিয়ে হাসপাতালে আসার মত ও ছাড়া আর কে আছে!
ফুয়াদ বিছানা থেকে উঠে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। বাইরের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ফুয়াদকে উদাস দেখালো। না চাইতেও ও অনেক কিছুতে বোধ হয় আটকে যাচ্ছে।
এশা সকালে চোখ মেলে প্রথমেই দেখলো ফুয়াদের সারা রাত জাগা ক্লান্ত মুখটা। ও ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। শরীর দুর্বল লাগছে। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে।
-আপনি সারা রাত জেগে ছিলেন?
বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল এশা। ফুয়াদ হেঁয়ালি করে বলল,
-না, তোমার পাশে ঘুমিয়েছিলাম। দেখোনি?
এই বিছানায় দুইজন ঘুমানো অসম্ভব। এশা তাকিয়ে দেখলো। ফুয়াদের হেঁয়ালি ধরতে ওর একটু সময় লাগলো।
-তোমার শরীর কেমন তাই বলো? বাসায় যেতে পারবে? নাকি হাসপাতালেই থাকতে হবে?
-জ্বর তো কমেই গেছে। হাসপাতালে থেকে কি করবো? আর জ্বরের জন্য হাসপাতালে আনার কোনো দরকার ছিলো না। এমনিতেই কমে যেত।
ফুয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এশাকে হাসপাতালে এনে কি ও বাড়াবাড়ি রকমের দরদ দেখিয়ে ফেলেছে? জ্বরে বেহুঁশ মানুষকে হাসপাতালে আনা স্বাভাবিক নাকি বাসায় রাখা স্বাভাবিক? এই মুহূর্তে ও সেটা বুঝতে পারছে না। কারো কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে।
__
বাড়ির পরিবেশ যেরকম হওয়ার কথা সেরকমই। থমথমে, নিরিবিলি। ভয়ানক কালবৈশাখীর আগের নীরবতা যেন।
ফুয়াদ এশাকে নিয়ে সকালেই বাসায় ফিরলো। জ্বর ছাড়লেও এশার শরীর কেমন নিস্তেজ লাগছে। ও চোখ বুঁজে শুয়ে থাকলো।
ফুয়াদ গোসলে ঢুকলো। সারা রাত নির্ঘুম থেকে মাথা ধরেছে। সে দ্রুত গোসল সেরে তৈরি হয়ে বাইরে বের হলো। জরুরি কাজ আছে তার।
এর ভিতর হঠাৎ মারুফা এসে এশার দরজায় উঁকি দিয়ে বলল,
-এশা তোমার মা এসেছে।
এশার মনে হলো ও ভুল শুনেছে। ও এক লাফে উঠে বসল।
-কে এসেছে? কি বললেন ভাবী?
-তোমার মা এসেছে। লিভিং রুমে বসেছে।
মাকে তো ও আসতে বলেনি। ফুয়াদ কি ফোন করেছিল? সেটাই হবে বোধ হয়। এশা খুশি হতে গিয়েও পারলো না। এই বাড়িতে ওর এত দুঃখ, যন্ত্রণার কথা মা যদি জেনে যায়? মানুষটা তাহলে প্রচণ্ড আঘাত পাবে, ভীষণ কষ্টে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
পলি বেগম নিশ্চয়ই তার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন না। যদি অপমান করে বসেন? মায়ের অপমান কেউ সহ্য করতে পারে! মাকে ওর খুব দেখতে ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু তাকে কখনো এই বাড়িতে আসতে বলতো না ও।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে অস্থির হয়ে এশা লিভিং রুমে হাজির হয়। মিনারা বেগত উতলা হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। এশাও নিঃশব্দে চোখ মুছে। এই প্রথম তিনি বেয়াই বাড়ি এসেছেন। তাও বিনা দাওয়াতে। এশা কাল রাতে হাসপাতালে ছিলো শুনে তিনি না এসে থাকতে পারেননি।
-তোর শরীর এখন কেমন মা? রাতে আমাকে ফোন দিস নাই কেন?
মিনারা বেগম আবার চোখ মুছলেন। বিয়ে পর মেয়েকে এখনো নাইওর করতে পারেনি। নাইওর করে কোথায় রাখবে! মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে কত ছোট হয়ে থাকে! কত দুঃখ যে মিনারা বেগমের বুকের মধ্যে!
এশা মায়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
-কান্না বন্ধ করো। ঠিক আছি আমি এখন। তেমন কিছু হয়নি না। সামান্য জ্বর হয়েছিল।
-এরকম শুকিয়ে গেছিস কেন তুই? নাক মুখ চেপে ছোট হয়ে গেছে!
মাকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করবে? কি খাওয়াবে তাকে এখন? কোনো আয়োজন করতে গেলে কি পলি বেগম ঝামেলা করবে? এশা খুব আতঙ্কিত আর অসহায় বোধ করছে। কি করবে বুঝতে পারছে না।
-বেয়াই-বেয়াইন কোথায়? তাদের ডাক দে।
মিনারা বেগম বললেন। এশা ভয়ে ভয়ে পা ফেলে মিনারা বেগমকে ডাকতে গেল। ও এই মুহুর্তে মনে মনে কেবল আল্লাহ কাছে দোয়া করছে যেন এই বাড়িতে মিনারা বেগমকে অপমানিত না হতে হয়। কিংবা তার সামনে ওর অপমান না হয়।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৮
পলি বেগমের রুম আটকানো। মারুফা এশাকে গম্ভীর মুখে জানালো,
-মা বাসায় নেই। মালা আপার বাসায় গেছেন।
মালা ফুয়াদের বোন। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন। সকাল সকাল মালা ফোন করে জানিয়েছে তার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। এই খবর শোনা মাত্রই পলি বেগম আর শফিক আহমেদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে দশ কেজি মিষ্টি, কয়েক ঝুড়ি ফলমূল নিয়ে মেয়ের বাসায় গেছেন।
এই খবরে সবাই খুশি হলেও সম্পা আতঙ্কিত হলো। প্রথম বাচ্চার সময় মালা এই বাড়িতে ছিলো। তার যখন যেটা খেতে ইচ্ছে করে সাথে সাথে হাজির করা, কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে রাত জেগে হাত-পা মালিশ করে দেওয়া, মাথা টিপে দেওয়া সহ যাবতীয় সমস্ত কিছু মারুফা আর সম্পাকেই করতে হয়েছে। সাথে সংসারের কাজ তো আছেই। একদিন রাত দুইটার দিকে মালা ডেকে বলল তার দুধ চিতই খেতে ইচ্ছে করছে। অগত্যা সেই রাতেই বানাতে হলো।
এবারও নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম হবে না। নিজের মেয়ের বেলায় ষোলআনা। ওদের বেলায় এক আনাও না। নিষ্ঠুর মহিলা কোথাকার!
এশা একটু সংকোচ করে মারুফাকে বলল,
-ভাবী মা এখানে প্রথম এসেছে। দুপুরে না খাইয়ে ছাড়ি কীভাবে!
মারুফা মুখ ঝামটা মেরে বলল,
-ওসব আমি জানি না। তোমার আবার কারো কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করা লাগে নাকি! যা ইচ্ছে করো।
এশার এত মন খারাপ লাগছে! বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে মারুফা ভাবী শুধু শুধু ওকে অপছন্দ করে। ও তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। নিজ থেকে কিছু করারও সাহস পাচ্ছে না। পলি বেগম এমনিতেই ওর উপর খুব ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন।
একটু নাশতার আয়োজনও করতে পারলো না মিনারা বেগমের জন্য। কোন মুখে এখন তার সামনে যাবে! এশা খুব লজ্জায় পড়লো। শেষমেশ ও বাসার কাছের খাবার হোটেলটা থেকে নাশতা কিনে এনে পলি বেগমের সামনে দিলো।
-তোমার বেয়াই-বেয়াইন তার মেয়ের বাসায় গেছে।
এশা মিনারা বেগমকে জানালো।
-আসবে কখন?
-এসে পড়বে। থাকবে না।
-তাদের সঙ্গে দেখা না করে যাই কীভাবে!
-কোথায় যাবে তুমি? দুইদিন থাকবে এখানে।
এশার কথায় জোর নেই।
-কি যে বলিস পাগলের মত। শোন মা, আমি কিছু টাকা-পয়সা জোগাড় করতে পারলে তোকে আর ফুয়াদকে বেড়াতে নিবো তোর মামার বাসায়।
এশা ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-ঠিক আছে।
মিনারা বেগম চারদিকে তাকায়। কী দামী সব আসবাবপত্র, সবকিছু ঝকঝকে তকতকে। এত জৌলুস, আভিজাত্যের মধ্যেও তার মেয়ের মুখটা এমন মলিন কেন?
খাওয়ার মাঝে মিনারা বেগম বললেন,
-আমার এভাবে আসা বোধ হয় উচিত হয়নি। কিন্তু তোর অসুস্থতার কথা শুনে এত অস্থির লাগলো। মনে হলো তোর মুখটা না দেখে শান্তি পাবো না। আয় হাঁ কর। তোকে একটু খাইয়ে দিই।
-জ্বর মুখে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা। তুমি খাও। আর এভাবে এসেছো তাতে কিছু হয়নি।
মিনারা বেগমের ধীরে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস। পলি বেগম এসে যদি এই দৃশ্য দেখে আবার কি বলে বসবে! মা একটু তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করতো যদি! তাকে দ্রুত খাওয়ার কথাও তো বলা যায় না। এশা মনে মনে ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে।
পলি বেগম আর শফিক আহমেদ হাস্যোজ্জ্বল মুখে বাসায় ঢুকলেন। খাওয়া শেষে মিনারা বেগমকে এশা ওর রুমে নিয়ে এসেছে। লিভিং রুমে কতক্ষণ বসিয়ে রাখবে! সম্পাও এসেছে রুমে মিনারা বেগমের সাথে দেখা করতে। ইদানিং সম্পা আর এশার সখ্যতা দেখলে মারুফার শরীর জ্বলে। এশা সম্পাকেও ওর দলে ভাগিয়েছে। আর কি কি যে করবে এই মেয়ে।
পলি বেগম বাসায় আসার সাথে সাথে মারুফা গিয়ে তাকে জানালো,
-এশা আর ফুয়াদ বাসায় ফিরেছে। এশার মা এসেছে ওকে দেখতে। তাকে সে বাইরে থেকে খাবারদাবার কিনে এনে খাইয়েছে। এখন তারা দুজন আর সম্পা মিলে রুমে বসে গল্পগুজব করছে।
ফুয়াদকে বিয়ে করানোর পরই পলি বেগমের মনের শান্তি নষ্ট হয়েছে। বাড়ির নিয়ম-শৃঙ্খলা সব ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে। সকলের সামনে পলি বেগমকে অমান্য করে তাকে অপমান করছে এশা। সবাই তাকে মেনে চলতে পারলে, ও কেন পারবে না! শুরু থেকেই এই মেয়েটা তার প্রতি আনুগত্য ছিলো না। ওদিকে ফুয়াদও তার কথা পরোয়া না করে বউকে কোলে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এসব কিছুই পলি বেগমের জন্য অপমানের।
পলি বেগম শক্ত মুখে মারুফাকে বলল,
-আজ দুপুরে শুধু ডাল রান্না করো আর শাক ভাজি করো।
-ঠিক আছে।
মারুফার একেবারে মন মত হয়েছে। ও এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে দশ বছর। এক বাচ্চার মা ও হয়েছে। এত বছর ধরে ও সব সহ্য আসছে আর ওদিকে একজন কাল এসে আজই কি হাবভাব করছে!
মিনারা বেগম হাসি মুখে বেয়াই-বেয়াইনের সাথে দেখা করতে গেলেন। আন্তরিক গলায় সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কেমন আছেন আপনারা? এশার অসুস্থতার কথা শুনে এভাবে হুট করে চলে আসলাম। এসে আপনাদের বাসায় পেলাম না।
মিনারা বেগমের আন্তরিকতার বিপরীতে তাদের নীরস দেখালো। পলি বেগমের মুখে তো উপচে পড়া বিরক্ত। দম্ভ, অহংকারটাও চোখে পড়।
শফিক আহমেদ কিছুটা দায়সারা ভাবে প্রত্যুত্তর করলেন,
-জি ভালো আছি।
এই বলে তিনি বেড়িয়ে পড়লেন। মিনারা বেগম কেমন আছেন, সামান্য সৌজন্যতা দেখিয়ে সেটিও জিজ্ঞেস করলো না।
পলি বেগম চেয়ারে বসে আছেন। তিনি কোনো কথাবার্তা বলছেন না। মিনারা বেগমের দিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। যেন তিনি অদৃশ্য কিছু। মিনারা বেগম অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে বসতে পর্যন্ত বললেন না। তার খুব বিব্রত আর অপমানিত বোধ হচ্ছে। এই বাড়ির মানুষ গুলোর মধ্যে নূন্যতম সৌজন্যতা নেই, আন্তরিকতা নেই। মানুষকে মানুষ বলে গন্য করে না। এখানে এশা কেমন আছে তাহলে? তার বুকের ভেতরটা মোচড় দেয়।
নিজের এই অপমানের কথা মেয়েকে বললেন না মিনারা বেগম। কিন্তু তার মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। এশার কাছে এসে বলল,
-বেয়াই-বেয়াইনের সাথে দেখা তো হলো। তোকেও মন ভরে দেখলাম মা। ফুয়াদের ফিরতে বোধ হয় দুপুর হবে। আমি এখন যাই তাহলে।
বেয়াই-বেয়াইনের সাথে দেখা করার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ভালো হয়নি তার, এশা সেটা আন্দাজ করতে পারছে। তাকে কি অপমান করেছে? ওর বুকের ভিতরে ছুরির তীব্র আঘাতের মত যন্ত্রণা হচ্ছে। এই ব্যাপারে মিনারা বেগমকে ও কোনো প্রশ্ন করলো না। মায়ের অপমানের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না।
এশা খুব অনুনয় করে বলল,
-তুমি দুপুরে খেয়ে যাও মা! নয়ত আমি অনেক কষ্ট পাবো।
বেয়াই-বেয়াইনের ওরকম আচরণের পর দুপুরে তার গলা দিয়ে খাবার নামবে না। কিন্তু মেয়ের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। অনুরোধের ঢেঁকি গিলে থাকতে হলো।
এশা ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। আজ নিজ হাতে মায়ের জন্য ভালো আয়োজন করবে। তাতে যত ঝামেলা হওয়ার হোক। এই মুহূর্তে ওর কিছু পরোয়া করতে ইচ্ছে করছে না।
এশাকে মাছ, মাংস বের করতে দেখে মারুফা বলল,
-মা আজ শুধু ডাল আর শাক রান্না করতে বলেছেন।
ও মারুফার কথা গ্রাহ্য করলো না। সম্পা ওর পক্ষে কথা বলল,
-এশার মা প্রথমবার এসেছে এই বাড়িতে। তাকে শুধু ডাল আর শাক দিয়ে ভাত খাওয়াবে? ভাবী তুমিও দেখছি দিন দিন মায়ের মতই হয়ে যাচ্ছো।
মারুফা রেগেমেগে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
-মুখ সামলে কথা বলো তুমি। দিন দিন তোমাদের সাহস খুব বাড়ছে। এত সাহস ভাল না।
সম্পা আর কিছু বলল না। এশা নিজের মত রান্না করতে লাগলো। মিনারা বেগমের পছন্দের বড় কাতলা মাছ রান্না করছে।
__
ফুয়াদ কল দিয়ে এশাকে জানালো, সে আজ বাসায় ফিরবে না। বাইরে লাঞ্চ করবে।
দুপুরে খাবার সময় হলে এশা মিনারা বেগমকে ডাকলেন। তিনি টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করলেন,
-বেয়াই-বেয়াইনে খাবে না? তারা কোথায়?
-খাবে। আসছে।
এশা ব্যস্ত হাতে খাবারদাবার বাড়তে লাগলো।
খাবার টেবিলে এসে পলি বেগমের চোখ পরম আশ্চর্যে কপালে উঠে গেল। তিনি মিনারা বেগমের সামনেই প্রায় চিৎকার করে মারুফাকে জিজ্ঞেস করল,
-আজকে শুধু ডাল আর শাক রাঁধতে বলিনি আমি?
মারুফা বলল,
-আমি ডাল আর শাকই রান্না করেছি। বাকী সব এশা করেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় মিনারা বেগম হতভম্ব, বিমূঢ় হয়ে গেলেন। এশা অন্যান্য দিনের মত পলি বেগমকে ভয় না পেয়ে উঁচু গলায় বলল,
-আমার মা প্রথম এই বাড়িতে এসেছে। তাকে শুধু ডাল আর শাক দিতে খেতে দিবো? এই আপনার আভিজাত্য, বড়লোকি!
মুখের উপর এত বড় কথা শুনে পলি বেগম কিছুক্ষণ বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে থাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে তার সেই বিস্ময় দারুণ ক্রোধে গড়ালো। তিনি ক্ষুব্ধ গলায় চেঁচিয়ে মিনারা বেগমকে বললেন,
-বিনা দাওয়াতে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসেছেন আবার খেতে বসে পড়ছেন।
মিনারা বেগম একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ধীরে ধীরে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। লজ্জা আর অপমানে মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে তার। তার মেয়ে..তার এশা..যাকে আঁকড়ে ধরে তিনি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে, তার বুকের মানিক এতটা দুরবস্থায় আছে শ্বশুর বাড়িতে! কেন এত অর্থবিত্ত দেখে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে গেল! মিনারা বেগমের বুকের ভিতর চূর্ণবিচূর্ণ, রক্তাক্ত হতে লাগলো কেবল।
পলি বেগম ফেটে পড়া ক্রোধ নিয়ে টেবিলে বেড়ে রাখা খাবার গুলো ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো।
-তোর মত ছোট লোকের বাচ্চা বউ করে এনেছি যাতে মাথা নিচু করে চলিস। কিন্তু তুই এই বাড়িতে আসার পর থেকেই আমার সংসারে অশান্তি শুরু করেছিস। আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিস।
অতিরিক্ত রাগে পলি বেগমের শ্বাস রোধ হয়ে আসছে। তিনি হাঁপাতে লাগলো।
এশা বিধ্বস্ত গলায় মিনারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-মা তুমি এই বাড়ি থেকে চলে যাও। আর কখনো এসো না। এই মহিলা মানসিক ভাবে অসুস্থ। এই মহিলার চিকিৎসা দরকার।
শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রে জড়ো করে এশার গালে চড় বসিয়ে দিলো পলি বেগম। দ্বিতীয় চড় দিতে উদ্যত হতেই মিনারা বেগম তার হাত ধরে ফেললেন।
এরপর তিনি এশাকে বললেন,
-তুই আমার সাথে চল।
-কোথায় যাবো মা?
পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব যেন ওর গলায়। মিনারা বেগম এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এশার হাত ধরে টেনে ওই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলেন।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা