#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩১
চারতলা একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এশা রিক্সা থামায়। গলির ভিতরে জৌলুসহীন বেশ পুরোনো বিল্ডিং। একটু বৃষ্টি হলে নিশ্চয়ই এখানে পানি জমে যায়। তবে ভাড়া কম।
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ও সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে। কলিং বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই মিনারা বেগম দরজা খুললেন। তিনি দরজার সামনেই অপেক্ষা করেছিলেন।
-মা, কেমন আছো?
নিস্তেজ, বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল এশা।
মিনারা বেগম এশার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই কিছুটা বিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
-এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে? আবার কি হইছে?
ওই বাড়িতে গণ্ডগোল, ফুয়াদকে পুলিশে দেওয়া, বাড়ি ছেড়ে এশার ফ্ল্যাটে উঠা–এসব মিনারা বেগম শুনেছেন। কিন্তু এশার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আবার কোনো ঝামেলা হয়েছে। ফুয়াদের চলে যাওয়ার খবর তিনি এখনো জানেন না।
-ফুয়াদ চলে গেছে মা।
এশা স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করলেও কেমন অসহায় শোনালো। ও দরজার সামনে থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে হেঁটে এসে খাটের উপর বসলো।
মেজো ভাইজানের দয়া আর সহযোগিতায় মিনারা বেগম নিজের ভাগের সম্পত্তি বুঝে পেয়েছেন। তা অবশ্য ভাইদের কাছেই বিক্রি করেছেন। এরপর এই দুই রুমের ছোট বাসাটা ভাড়া নিয়েছেন। বিয়ের পর থেকে মেয়েকে একবারের জন্যও নাইওর করতে পারেনি। মেয়ে জামাইকে একবেলা ভালো-মন্দ খাওয়াতে পারেনি। তবে এবার পারবেন। এই সস্তা, সাধারণ বাসায় নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সমাদর করতে পারবেন। তিনি সেজন্যই সবচেয়ে খুশি।
খাটের দিকে এগিয়ে এসে বিচলিত মুখে মিনারা বেগম প্রশ্ন করলো,
-ফুয়াদ চলে গেছে! কোথায় চলে গেছে?
-জানি না।
-জানিস না মানে? তোকে বলে যায়নি? কোথায় গেছে । কেন গেছে। কবে ফিরবে।
এশা ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-না। আমাকে কেন বলে যাবে! আমি কে! দেশের বাইরে চলে গেছে হয়ত।
মিনারা বেগম আরো বিচলিত হয়ে গেলেন,
-কি বলছিস!
-হয়ত আর ফিরবে না। আমাকে একটা চিঠি লিখে জানিয়েছে, সে চলে যাচ্ছে। একা নিজের মত বাঁচতে চায়। আমার জন্য কয়েক লাখ টাকা পাঠিয়েছে। আর তার ফ্ল্যাটে থাকতে বলেছে।
-কোথায় যাচ্ছে, কবে ফিরবে কিছুই বলে যায়নি?
-না, মা। যেখানে খুশি যাক। কিন্তু চিঠিটায় যদি একটা লাইনে কোথায়ও লিখে যেত যে, আমার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করো। আমি ওখানে থেকেই অপেক্ষা করতাম। দশ বছর বললে দশ বছর অপেক্ষা করতাম। এত নিষ্ঠুর! একটু দয়া মায়া হয়নি আমার জন্য।
এশার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো। ও দ্রুত চোখ মুছে বিরক্ত গলায় বলল,
-ধুর মা! আমি ওই লোকের জন্য কাঁদতে চাই না। বিয়ের আগে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। তাকেই এখনো ভুলতে পারেনি। আমি তার জীবনে কখনো কোথায়ও ছিলাম না।
মিনারা বেগম এশার পাশে বসলো। তিনি বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। জীবনে এই প্রথম তার নিজের বলে একটা থাকার জায়গা হলো। সেই আনন্দও এই মুহূর্তে ধুয়ে গেল। অর্থ, সম্পত্তি দেখে বিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে তিনি আগুনে ফেলেছেন। এই ভুল ঠিক করবে কীভাবে এখন!
-বাসায় এত বড় ঝামেলা হলো। ওর মা ওকে পুলিশে দিয়েছে। সব মিলিয়ে হয়ত মন মেজাজ খারাপ। তাই রাগ করে কোথায়ও গেছে। মন ঠিক হলে চলে আসবে।
মিনারা বেগম ব্যাপারটা এভাবে ভাবার চেষ্টা করলেন।
-চলে যাওয়ার প্ল্যান তার আগে থেকেই ছিলো। বিয়ে, সংসার এসব কিছু পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বহীন ব্যাপার তার কাছে।
হু হু করে বেড়িয়ে আসতে চাওয়া কান্না আটকে রাখার জোরালো চেষ্টায় এশার শরীর ঈষৎ কাঁপছে।
মিনারা বেগম বললেন,
-কাঁদতে ইচ্ছে করলে কাঁদ। কান্না চাপিয়ে রেখে কি হবে।
-টাকা আর ফ্ল্যাটের চাবি আমি তার মায়ের কাছে দিয়ে এসেছি। এসব দিয়ে আমার প্রতি করুণা দেখেয়েছি। রাস্তার কুকুর বিড়ালদের মানুষ যে মাঝে মাঝে হাত থেকে একটু খাবার ছুঁড়ে দেয়। সেরকম করুণা। একটা বার অপেক্ষা করার জন্য বলতে পারতো না বলো!
এত তুচ্ছ অবহেলা আমার আর ভালো লাগে না মা।
মেয়ের কান্না দেখে মিনারা বেগমের চোখ ভিজে যাচ্ছে। তিনি আল্লাহ তা’আলার কাছে সারাজীবন তার মেয়ের সুখ, শান্তি ভিক্ষা চেয়েছেন। আল্লাহ তার দোয়া কি কবুল করেননি? এত দ্রুত অধৈর্য হলে হবে না। মিনারা বেগম বললেন,
-ফুয়াদ ছেলেটাকে একবারে খারাপ মনে হয় না। মন-মেজাজ ঠিক হলে ফিরে আসবে দেখিস। আর ফ্ল্যাটের কথা তো ওর মা জানে না। তুই এভাবে জানিয়ে দিয়ে আসলি কেন? যদি আবার কোনো ঝামেলা হয়?
-ঝামেলা হওয়ার আর কি বাকী আছে! সে তার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে। এখন আর কোনো কিছুর পরোয়া করে না।
এশা চোখ-মুখ ওড়না দিয়ে ভালো করে মুছে বলল,
-জন্ম থেকে আমি তোমার ঘাড়ে চেপে আছি। তোমার জন্য কিছু করতে পারি নাই। আল্লাহ আমাকে কিছু করার ক্ষমতা কবে দিবেন জানি না। তোমার ঘাড়ে আবার চাপতে লজ্জা করছে আমার। কিন্তু কি করবো! যে মানুষটার কাছে আমার কোনো ভ্যালু নেই। যে ইচ্ছে হলে আমাকে রেখে চলে যেতে পারে। আমার প্রতি যার কোনো দায় না। একটু অপেক্ষা করতেও বলে যায়নি। তার করুণা নিয়ে ওখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
মিনারা বেগম কিছু বলার আগেই এশা ফের বলল,
-দুই-তিনটা টিউশন পড়াবো আমি। নিজের খরচ চালাতে পারবো। শুধু তোমার কাছে থাকবো।
মিনারা বেগম মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলল,
-কিরকম দূরের মানুষের মত কথা বলছিস তুই! তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস! কি করবি তুই আমার জন্য! তোর কিছু করার বয়স হয়েছে! উল্টো আমিই তোকে একটা ভালো জীবন দিতে পারি নাই রে মা। ওই বাড়িতে তোকে বিয়ে দিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি।
-আমি সেই ভুল শুধরাতে চাই মা। বিয়ের আগে প্রথমবার যখন আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল তখন ট্রাউজার আর জার্সি পরে এসেছে। আমি তার কাছে এখনো সেরকমই গুরুত্বহীন। কোনো পরিবর্তন নেই।
মিনারা বেগম ভেজা চোখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-একটু অপেক্ষা করে দেখ মা। বিয়ে তো আর ছেলেখেলা না।
-ছেলেখেলা নয় দেখেই তো অতকিছুর পরও আমি ওই বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে সংসার চায় না, বাচ্চা চায় না। দূরে চলে যেতে চায়। চলেও গেছে। বিয়ে তার কাছে ছেলেখেলা।
মিনারা বেগম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বসে রইলেন। এশা চোখ বুঁজে বালিশে মাথা দিলো। পায়ে আটকানো জুতা জুড়াও খুলেনি। ক্লান্ত শরীরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। মিনারা বেগম ওর পায়ের জুতা খুলে, বাথরুম থেকে বালতিতে করে পানি এনে পা ধুইয়ে দিলো। ওর পায়ের আঙুল গুলো একেবারে ওর বাপের আঙুলের মত লম্বা লম্বা হয়েছে।
__
রাতে কিসের খচখচানিতে পলি বেগমের ঘুম ভাঙে। তার হঠাৎ একটু ভয় ভয় করে উঠলো। এমনিতে তিনি ভিতু স্বভাবের মানুষ নন। কিন্তু এত বড় ফাঁকা বাড়িতে আজ শরীরটা ছমছম করে উঠছে।
তিনি উঠে আলো জ্বালায়। আশেপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না। হয়ত মনের ভুল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সবে সাড়ে এগারোটা বেজেছে। অথচ এই বাড়িতে রাত দেড়টা, দুইটার সময়ও কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যেত। আর এখন সারাদিনই বাড়িটা ভূতের বাড়ির মত নিস্তব্ধ থাকে।
তার কোলাহলপূর্ণ সোনার সংসারটা আজ ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে সুনসান হয়ে গেছে। এখনো কেউ তার কাছে ক্ষমা চাইতে আসছে না। এক এক জনের কত স্পর্ধা হয়েছে! পলি বেগমের আর সহ্য হচ্ছে না এসব নাটক। রাগে শুধু তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।
তিনি রুম থেকে বের হয়ে মালার কাছে যায়। মালা ওর ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পলি বেগম ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ক্রোধে ফেটে পড়ে বললেন,
-বাকী সবাই যা করার করছে! কিন্তু তোর বাপ…। গ্রামে গিয়ে নাকি বাপের ভিটায় থাকা শুরু করেছে। এই তালবাহানা আমার গায়ে আর সইছে না। পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করাবো বদমাশটাকে।
কাচা ঘুম ভাঙা চোখে মালা বিরক্ত ভাবে বলল,
-তুমি কি নিজের অনুভূতি গুলো ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারো না? নাকি অভ্যাস নেই? আব্বুকে মনে পড়লে ফোন দিয়ে আসতে বলো। পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করানোর কথা বলছো কেন!
পলি বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন,
-ওই ইতর লোককে আমার মনে পড়বে! আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। সবার আমার কাছেই আসতে হবে।
-আসতে হলে তো আসবেই। পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করানোর কি দরকার!
-ফুয়াদের ফোন বন্ধ। ও নাকি এই বাড়িতে আর জীবনে ফিরবে না। ওর সাথে এটাই নাকি আমার শেষ দেখা। ওদিকে ওর বউ এসে বলল ওর নাকি আলাদা ফ্ল্যাট রাখা ছিলো। আরো কিসব আবোলতাবোল বলে গেল। এরা সবাই মিলে আমার মাথা খারাপ করে দিবে। আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে। এদেরকে কীভাবে উপযুক্ত শায়েস্তা করতে পারি একটু বল।
মালা চোখ বুঁজে বলল,
-সবাইকে জেলে ভরে দাও।
-কেউ অফিসে যাচ্ছে না। ব্যবসা দেখছে না। আমাকে ডুবাতে চায় সব গুলোয়। আমি একা এই ব্যবসা কীভাবে সামলাবো। আরেক ছেলে আমার গাড়িটা ভেঙেচুরে রেখে গেছে। এদের জ্বালায় আমার বিষ খেয়ে মরতে হবে মনে হয়।
-মরে যাও।
-কি বললি তুই?
-বলছি আমার ঘুম পেয়েছে। যাও এখন।
পলি বেগম সারা বাড়িতে আলো জ্বালিয়ে দিলেন। রাগে তার শরীরের রক্ত চড়চড় করছে। তিনি কিছুক্ষণ অস্থির ভঙ্গিতে সোফায় বসে থেকে পুরো বাড়ি জুড়ে পায়চারি করলেন। মনে হচ্ছে এটা কোনো পরিত্যক্ত বাড়ি।
আলো জ্বালিয়ে রেখেই তিনি রুমে আসেন। ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছেন না। ফুয়াদ কোথায় গেছে? এশার সাথে ওর কি হয়েছে! রাহাত, ফয়সাল বউ নিয়ে কোথায় উঠেছে। শফিক আহমেদ তো টাকা পয়সা কিছু নিয়ে যাননি। তিনি গ্রামে গিয়ে কীভাবে চলছেন!
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩২
গলির মুখেই একটা ভাতের হোটেল। এশা বাসা থেকে বেড়িয়ে সেখান থেকে দুপুরের খাবার কিনে নিয়ে আসলো।
এই বাসায় এখনো রান্নাবান্নার মত ব্যবস্থা নেই। মিনারা বেগম এখানে উঠেছেনই তো গতকাল সকালে। শুধু মেজো মামা একটা খাট ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে, সেখানে বিছানা পেতে ঘুমানোর মত ব্যবস্থা হয়েছে।
ঘটনা হয়েছে খুব অল্প সময়ে। মিনারা বেগমের ভাইয়েরা ভেবেছিলেন এশা শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে তিনি সম্পত্তির ব্যাপার ভুলে যাবেন। কিন্তু এবার আর ভুললেন না। উল্টো মেজো ভাইয়ের বুদ্ধিতে সালিশ বসানোর কথা বলে বসলেন। সালিশ বসানোর কথা শুনেই তার ভাইদের টনক নড়ে। সালিশে তিনিই জিতবেন। এরচেয়ে আপোষ করাই ভালো।
কে কতটুকু সম্পত্তি পাবে তা তো আর অজানা নয়! মিনারা বেগম শক্ত মুখে বললেন, টাকা তার জরুরি প্রয়োজন। রাতের মধ্যেই সম্পত্তির দাম ধরে কিছু টাকা না দিলে তিনি বাইরে বিক্রি করে দিবেন। এরপর মেজো ভাইজানের তাড়ার মুখে রাতের মধ্যেই আপাতত অর্ধেক টাকা দিয়েছেন।
টাকা হাতে পেয়ে তিনি আর ভাইয়ের বাসায় এক মুহূর্তও থাকতে চাইলেন না। পরদিন ভোরে মেজো ভাইজানই তাকে এই বাসায় তুলে দিয়ে গেছেন। মেজো ভাইজানের পরিচিত। বহু আগে তিনি এই বাসায় থাকতেন সেই সুবাদে।
আল্লাহ মানুষকে একটা গতি করেই দেয় যেকোন উপায়ে। মিনারা বেগমের এত দ্রুত থাকার জায়গার ব্যবস্থা না হলে ওর তো ফুয়াদের ফ্ল্যাটেই থাকতে হতো।
এশা ভাত খেয়ে রুমের লাগোয়া ছোট একটা বারান্দা আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। মিনারা বেগম বাসায় নেই। হাড়ি পাতিল, থালাবাসন কিনতে গেছেন। ও তখন ঘুমিয়েছিল তাই ডাকেনি।
নিরাশ চেহারায় এশা দীর্ঘ সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। মানসিক ভাবে যতটা শক্ত থাকতে চাচ্ছে ততটা পারছে না। ও তো আর ফুয়াদের মত নিষ্ঠুর, নির্দয় না। শক্ত থাকতে পারলে তো আজ ক্লাসেই যেতো। ভাত খেতে গিয়েও কেন যেন গলা দিয়ে নামাতে কষ্ট হলো। কয়েক লোকমা খেয়ে উঠে পড়েছে।
হৃদয়-মন যতই জ্বলে পড়ুে অঙ্গার হোক, দুঃখকে এত প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ কই! ক্লাসে যেতে হবে। ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে হবে। দ্রুত টিউশন খোঁজার চেষ্টা করতে হবে।
খাটের উপর ফোন বাজছে। এশা কি ভেবে যেন একটু চমকে উঠে। ওর মন হয়ত ফুয়াদের ফোন কলের অপেক্ষায় আছে। এই মানুষটার প্রতি ওর সমস্ত আবেগ, অনুভূতি মুছে ফেলা দরকার। কিন্তু এসব মনের ব্যাপার। এক্ষুণি না পারলেও ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই সব মুছে ফেলতে পারবে। এরপর যদি কখনো সে ফিরে এসে ওর সামনে দাঁড়ায় ও যেন তাকে ঘৃণা করে ফিরিয়ে দিতে পারে।
এশা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সম্পা ভাবী ফোন করেছে। ওর অচেতন মন বোধ হয় হতাশ হলো।
-এশা তুমি কোথায় আছো?
সম্পা ভাবী উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
-মায়ের কাছে আছি ভাবী। আপনাদের কি অবস্থা? কেমন আছেন?
-কি শুনছি ফুয়াদ নাকি নিখোঁজ! ওর ফোনও বন্ধ পাচ্ছি।
-হুম।
-তুমি সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় আসো তো।
-এখন ইচ্ছে করছে না। অন্যদিন।
-হুট করে সবকিছু কেমন পাল্টে গেল। এক এক জন এক এক জায়গায় ছিটকে গেছি।
-আপনার শরীরটা কেমন এখন?
-বেশি ভালো না। ফুয়াদ কোথায় যেতে পারে বলো তো! ওকে খুঁজছো না?
-কোথায় খুঁজবো। সে কি হারিয়ে গেছে যে খুঁজবো!
-তোমার কোনো অসুবিধা হলে আমাদের জানাইয়ো। দ্বিধা করো না বুঝছো? আমাদের শাশুড়ি আম্মা নাকি ফুয়াদকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এশা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
-আপনারা ফুয়াদের খোঁজ পেলে আমার সাথে একবার যোগাযোগ করতে বলবেন। মনের বিরুদ্ধে তো আর সংসার হয় না ভাবী। আমিই তাকে ছেড়ে দিবো।
-কি বলছো! তুমি ওকে ছেড়ে দিয়ে কোথায় যাবে?
-তাকে ধরে রেখেই বা কি করবো? তার মনে কখনো আমার জায়গা হবে না। হওয়ার হলে এতদিনেই হতো।
-এসব তোমার রাগের মাথার কথা। মাথা ঠাণ্ডা করো। ফুয়াদ অনেক ভালো ছেলে। নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ও অনেক গুলো ধাক্কা খেয়েছে তো। তাই মনস্থির করতে পারছে না।
-তাকে তো আর আমি খারাপ বলিনি । তার মনে অন্য কারো জন্য প্রেম। মনের ব্যাপার মানুষ চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাছাড়া আমার মত সাধারণ মেয়ে বিয়ে করার কথাও তিনি কখনো ভাবেননি। তার চিন্তা ভাবনা অন্য ধরণের। বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে। তার সাথে কোনো ভাবে যোগাযোগ করতে পারলে বলবেন, আমি তাকে নিঃশর্তে ছেড়ে দিবো। এরপর আপনারা ধুমধাম করে তার আর সুস্মিতার বিয়ে দিয়েন।
-কি আবোলতাবোল বলছো! তোমার মাথাটাও কি গেছে!
-আবোলতাবোল না ভাবী। এটা ছাড়া আপনার দেবরের মনস্থির করার তো আর কোনো উপায় নেই।
মিনারা বেগম কেনাকাটা করে ফিরেছেন। এশা ফোন রেখে সবকিছু গোছগাছ করতে তাকে সাহায্য করতে লাগলো। রাতেই দুই মা-মেয়ের ছোট্ট এই সংসারে চুলা জ্বললো।
__
এই থমথমে, সুনসান বাড়ির এক কোণে পলি বেগম চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। তিনি একটু আগে অফিস থেকে ফিরেছেন। ব্যবসার হালচাল ভালো যাচ্ছে না। বাড়িটাও কেমন মরা মরা লাগছে। কর্তৃত্ব ফলানোর জন্য কাউকে পাচ্ছেন না। তার সাহায্য ছাড়াই সবাই নিজের মত থাকতে পারছে সে নিয়েও অন্তর্জ্বালা কম হচ্ছে না।
তার ছেলে গুলো কত সেয়ান! একটা বারও আসলো না। আর শফিক আহমেদ তো সবচেয়ে বড় সেয়ান!
শুধু মালা তার কাছে আছে বলে! নয়ত এত বড় বাড়িতে তিনি একা কীভাবে থাকতেন। মালাকে ওর স্বামী নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি যেতে দেননি। মালার দেখাশোনার জন্য একজন মেয়ে রেখেছেন। বাসার কাজের জন্যও আলাদা মানুষ রেখেছেন।
কাজের মেয়েটাকে ডেকে পলি বেগম এক গ্লাস জুস দিতে বললেন। তার বুকের ভিতর কিরকম অস্থির লাগছে। নিজের অজান্তেই একাকিত্ব তাকে গ্রাস করছে। কিন্তু তিনি সে কথা মানতে নারাজ। তার কাউকে প্রয়োজন হয়না। এই অভ্যস্ত অহংকার ছেড়ে অন্য কোনো চিন্তা প্রশ্রয় দিচ্ছেন না।
জুস গ্লাস শেষ করার পরই পলি বেগমের মাথার ভিতর কিরকম ঝিমঝিম করে উঠলো। তিনি শক্ত হয়ে চেয়ারের উপর বসে থাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তার শরীর ছেড়ে দিলো। চোখ দুইটি বুঁজে আসলো। জ্ঞান হারিয়ে তিনি চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন।
কাজের মেয়ে দুইটা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। মালা ওর ছেলেকে নিয়ে একটু বাইরে বের হয়েছে। পলি বেগম জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে আছেন তা কেউ দেখেনি।
মালাকে দেখাশোনার জন্য যে মেয়েটাকে রাখা হয়েছে ও পলি বেগমকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলো অনেকক্ষণ পর। মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু এই বাড়িতে চিৎকার শুনে ছুটে আসার মত কেউ নেই।
ওরা দুইজন আর দারোয়ান মিলে পলি বেগমকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ফয়সাল, রাহাত, ফুয়াদ, শফিক আহমেদ সবার কাছে ফোন করলেন দারোয়ান। কেউই তার ফোন ধরেনি। মালার ফোন নম্বর জানা নেই। তাই ওকে কল দিয়ে জানাতে পারলো না।
__
দুপুরের দিকে বৃষ্টি নেমেছে। গলির রাস্তাটায় পানি জমেছে। এশা সালোয়ার একটু টাখনুর উপরে তুলে সাবধানে পা ফেলে হেঁটে বাসার দিকে যাচ্ছে। ক্লাস শেষে একটা টিউশন করিয়েছে। আপাতত একটাই জোগাড় করতে পেরেছে।
এশা বাসায় ঢুকেই হুড়মুড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শরীরটা কয়দিন যাবৎ কেমন দুর্বল লাগছে। সকালে উঠেই পেট মোচড়ে বমি আসে।
-আবার মাথা ব্যথা করছে নাকি তোর?
মিনারা বেগম জিজ্ঞেস করলেন।
এশা চোখ বুঁজেই ক্লান্ত গলায় বলল,
-না। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।
-রাতে ঠিকমতো ঘুমাস না। কয়েক লোকমা ভাত খাস। শরীরে শক্তি আসবে কই থেকে? তার উপর ক্লাস, টিউশন। মা রে এত চিন্তা করিস না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।
-প্রতিদিন সকালে এমন বমি আসে! নতুন টিউশন। শুরু করেছি এক মাসও হয়নি। না গিয়েও উপায় নেই। গলির মাথা পর্যন্ত যেতেই আমার পা দুইটা দুর্বল হয়ে আসে।
মিনারা বেগম কিছুক্ষণ পর বললেন,
-একবার প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করে দেখ তো।
এশা ম্লান মুখে একটু হাসার চেষ্টা করলো,
-আরে ধুর!
দিনে-রাতে এক মুহূর্তের জন্যও মাথা থেকে দুশ্চিন্তাই নামাতে পারছে না। শরীর তো খারাপ হবেই!
এর ভিতর এশাকে মালা ফোন করলো। এই অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ফোন কলে ও চমকালো।
মালা ফোন করেই ব্যগ্র আর অস্থির গলায় বলল,
-এশা, মা খুব অসুস্থ। ফুয়াদের ফোন তো বন্ধই। আব্বু, ফয়সাল ভাইয়া, রাহাত কেউই আমার ফোন ধরছে না। রাঈদের বাবাও ঢাকার বাইরে। আমি একা কি করবো বুঝতে পারছি না! তুমি একটু ওদের কাছে ফোন দাও। তোমার ফোন নিশ্চয়ই ধরবে।
-ঠিক আছে। আমি এক্ষুণি ফোন দিচ্ছি।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা