এই ভালো এই খারাপ পর্ব-১২

0
88

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১২
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তারপরের দিন মালেকা বেগম এলেন মেয়েকে দেখার জন্য। সাজের নাশতা বানিয়ে এনেছেন। তিথি মাকে পেয়ে মহাখুশি।

মালেকা বেগম বললেন, ” জামাই কোথায় রে?”

তিথি নাশতা খেতে খেতে বললো, ” ও রাতে আসবে। তুমি বাবুর কাঁথাগুলো এনেছ আম্মা?”

মালেকা বেগম কাঁথাগুলো সব বের করলো ব্যাগ থেকে ।

তিথি সেগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাসলো। বলল, ” অনেক সুন্দর হয়েছে। ”

মালেকা বেগম বললেন,

” জামাইয়ের যদি পছন্দ না হয়? ”

তিথি বলল,

” পছন্দ হবে। ও আমাকে আরও বকবে। কেন জানো? এগুলো করতে তোমার কষ্ট হয়েছে তাই।”

” কি আর কষ্ট! আমার নাতি নাতনির জবাব এটুকু করতে পারব না? ”

মালেকা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ” হ্যা রে তোকে এখন বকাঝকা কম করে তাই না? ”

তিথি বলল, ” না সবসময় করে। করলেও আমার কি? আমার কিছু যায় আসে না। ”

মালেকা বেগম বেকুব বনে গেলেন। বললেন, “এটা কেমন কথা? ”

তিথি বললো, “ওসব তুমি বুঝবে না। স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার। ”

মালেকা বেগম বললেন, ” পাগলের মতো কথা। ”

___

আম্বিয়া বেগম নাশতা খেয়ে প্রশংসা করলেন। আজলানের জন্য পরিষ্কার দেখে কয়েকটা তুলে রাখলেন।

রাতে আজলান বাড়ি ফিরে মালেকা বেগমকে দেখে কুশলাদি বিনিময় করে বললো, ” তুষার আসেনি কেন? ”

” ও রাঁধতে বাঁধতে পারে। ওরা বাপ ছেলে রেঁধেবেড়ে খাবে তাই আসেনি। ”

” ওহহ। আচ্ছা বেশ, থাকুন। আমি ঘরে যাই। ”

বলেই ঘরে চলে গেল। তিথি মালেকা বেগমকে বলল,

” ভালো ভালো কথা শুনে পটে যেওনা। বড় চালাক লোক। ”

মালেকা বেগম বললেন, ” চুপ থাক। এমন ছেলে কপালে জুটেছে তার জন্য শুকরিয়া কর। হয়ছে বাপের মতো মাথামোটা। লাগামছাড়া কথা বলতে বলতে স্বভাব হয়ে গেছে। বেয়াদব কোথাকার। ”

তিথি গোলগোল চোখে মাকে চাইলো। মালেকা বেগম বললেন,

” হা করে কি দেখছিস? যা ঘরে যা। দেখ জামাইয়ের কিছু লাগে কিনা। ”

তিথি চোখ দুটো পিটপিট করে অবাক কন্ঠে তোতলাতে তোতলাতে বললো, ” আম্মা আম্মা তুমি আমাকে বেয়াদব ডেকেছ? তাও আমার শ্বশুরবাড়িতে বসে? তোমার কি দেমাক খারাপ হয়ে গেছে? তুমি আমার মা হয়ে অন্যের ছেলের হয়ে কথা বলছো? খবরদার বলছি আম্মা, তুমি যদি ওই লোককে লাই দাও, আমার দোষ বুঝাও, তাহলে আমি তোমাকে কালকেই বাড়ি পাঠিয়ে দেব। আব্বেশালা এমন মা তো জীবনে দেখিনি আমি। ”

মালেকা বেগম বললেন, ” আমার দুঃখ লাগে ছেলেটার জন্য। তোর মতো পাগলছাগল তার কপালে কি করে জুটলো। ”

তিথি মুখ মোচড়ে দিল। আম্বিয়া বেগম এসে বললো,

” তুই তোর মায়ের সাথেও ঝগড়া করছিস নাকি বউ?”

তিথি উনার দিকে চেয়ে গম্ভীর মুখে তাকালো। কোনো কথা না বলে চলে গেল হনহনিয়ে হেঁটে। আম্বিয়া বেগম বললেন,

” ওর কথা বাদ দেন। চলেন, একটু চা খাই। আপনার বাপের বাড়িতে মনে হয় তেমন যাননা? ”

আম্বিয়া বেগমের বাপের বাড়ি আর মালেকা বেগমের বাপের বাড়ি একই এলাকায় তাই উনি মালেকা বেগমকে পেলেই বাপের বাড়ির গল্পগুজব শুরু করে দেন। দুজনের ভালোই জমে উঠেছে।

মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এই প্রথম এসেছে মালেকা বেগম। শুরু থেকে তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এখন যখন দেখতে পেলেন তারা সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির মানুষ তখন অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন তিনি। মেয়েটাকে আল্লাহ যেন একটু বুঝ দেন। সংসারটা ভাঙতে ভাঙতে জোড়া লেগেছে । শেষ রক্ষা যেন হয়।

_____

আজলান মপ দিয়ে ঘরের মেঝে মুছে, ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা মুছে, কাপড়চোপড় সব ওয়ারড্রবে ভাঁজ করে, বিছানার চাদর আর বালিশ পাল্টে নিল। তিনদিন পরপর সে বালিশের কভার পাল্টায়। চাদর সাতদিন পরপর পাল্টায়। ক্ষেত্রবিশেষে তিনদিন পরপর। তিথি বুঝে পায় না বেডশীটটা ময়লা হওয়ার আগেই ধুতে হবে কেন? সে আজলানের কাজ দেখে বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরে এসে বসে আছে। অত পরিষ্কার হলে যা নিজে করুক।

মালেকা বেগম আর আম্বিয়া বেগমকে গল্প করে হাসতে দেখে তার হিংসে হলো। মনে মনে আওড়ালো, ” আল্লাহ এদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দাও। কেউ আমাকে পাত্তাও দিচ্ছে না। ”

আয়জাও তাদের সাথে গল্পগুজবে যোগ দিয়েছে।
রমলা চাচীও। মা রমলা চাচী সম্পর্কে জানতে বড়ো আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিথি বললো,

” আম্মা আম্মা শুনো,

মালেকা বেগম ঝাড়ি মেরে বললেন,

” দরকারি কথা বলছি। মা মা করিস না তো। ”

তিথি রোষানলে দগ্ধ হলো। রেগে চেয়ে রইলো তাদের দিকে। তারপর শ্বাশুড়ি মায়ের পেছনে গিয়ে কাঁধ ধরে বললো,

” ও-মা ও-মা শুনো। ”

আম্বিয়া বেগম ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে বললেন,

” ছাড় ঢং করিস না তো। এমনিতে কোনোদিন মা ডাকিস? আজ মায়ের সামনে ভং ধরছে। ”

তিথি রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। রমলা চাচী বললো,

” কি লাগবে বউ? আমারে কও। ”

তিথি রাগ গিলে বলল,

” কিছু না। ”

আয়জা বললো,

” কিছু খেতে চাও? ”

তিথি জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেল। আজলান ওয়াশরুমে ঢুকেছে। তিথি দরজা ধাক্কাতেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বললো,

” হোয়াট হ্যাপেন্ড? এভাবে কেউ ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কায়? ”

তিথি তার গায়ে সাবান ফেনা দেখে বলল,

” আচ্ছা আচ্ছা তাড়াতাড়ি বের হও। ”

” ষ্টুপিড ” বলে দরজা বন্ধ করে দিল আজলান। গোসল সেড়ে বের হতেই দেখলো তিথি দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়। ভুরু কুঞ্চন করে বললো,

” কোনো সমস্যা? ”

তিথি বলল,

” আমার ভাল্লাগছেনা কিছু। ”

আজলান চোয়াল ঝুলিয়ে বললো,

” তো? ”

” আমার আম্মা সবাইকে হাত করে নিয়েছে। এমনকি আয়জাকেও। আমার সাথে কথা বলার কেউ নেই। একা একা ভালো লাগে না। ”

” তুমি একা কে বললো? ”

তিথি এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল,

” তাহলে তুমি কথা বলো। ”

আজলান মাথা মুছতে মুছতে বললো,

” মনে হচ্ছে আমার জন্য দরদ একেবারে উতলে উঠছে। ”

তিথি তাকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসে থাকলো। আজলান তার দিকে একপলক চেয়ে ভেজা কাপড়চোপড় নিয়ে বেরিয়ে গেল। ছাদে কাপড়গুলো শুকোতে দিয়ে এসে দরজার কাছে থামতেই শুনতে পেল তিথি একা একা কথা বলছে।

” তোকে কি তোর যমের হাতে তুলে দেব? নাকি ছেড়ে দেব? তুই কোন সাহসে এই ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলি রে মদন? তোর সাহস দেখে তো আমি অবাক। তুই আমার জামাইরে চিনোস? তোকে হাত দিয়ে ধরে হাত নোংরা করবে না বুঝলি? সোজা শুট করে দেবে। তুই আ আ আ বলে চিৎপটাং হয়ে মরে পড়ে থাকবি। তোর চৌদ্দ গুষ্ঠিও কিছু করতে পারবে না। ”

আজলান ভাজিয়ে দেয়া দরজা ঠেলে ভেতর ঢুকে দেখলো তিথির হাতে একটা আরশোলার ছা। মাথার লম্বা সুঁতোর মতো অ্যান্টেনা ধরে তাকে শাসিয়ে যাচ্ছে একনাগাড়ে। আজলান গর্জে উঠে ডাকলো,

” মেহবুব! ”

তিথি চমকে উঠলো। কিন্তু আরশোলাটিকে ছাড়লো না। বলল,

” একে গুলি করে মারো যাতে তার চৌদ্দ গুষ্ঠিও এই ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে না পারে। ”

আজলান দাঁত খিঁচিয়ে চেয়ে রইলো। তিথি আরশোলাটাকে ধরে তার সামনে নিয়ে এল। আজলান দরজার সামনে থেকে সরে পড়লো। বলল,

” বের হও এটা নিয়ে। ”

তিথি মাথা নেড়ে বলল,

” ওর একটা ব্যবস্থা করে আসি। তুমি গোসল করেছ সেটা মাথায় ছিল না। সরি বস। ”

বলেই বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, ” তোকে কুচিকুচি করে কেটে তেলে ভাজা ভাজা করে খাবো শালা মদন। তোর কত্তবড় সাহস! এই এই খবরদার নড়বি না। তোকে ছেড়ে দেব সেটা ভাবিস না ভুলেও। ”

আজলান ঘর কাঁপিয়ে হুংকার ছেড়ে বলল,

” মেহবুব তুমি ওটা ফেলে এসে গোসল করবে। ”

তিথি তার চিৎকার শুনে থেমে গেল। আজলান বলল,

” কিন্তু আমার ওয়াশরুমে না। ”

তিথি বললো, ” ওকে বস। তোমার মেজাজ অল্পতেই হট হয় কেন? ”

____________

মালেকা বেগম চারদিন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থেকে চলে গেলেন। ভেবেছিলেন দু’দিনও থাকা হবে না কিন্তু তিথির শ্বাশুড়িটাকে এত মনে ধরেছে। তুষারের কথা ভেবে চলে আসতে হলো নইলে আরও ক’টা দিন থাকতেন।
মা চলে যাওয়ার সময় তিথি হঠাৎ করে কেঁদে উঠলো। মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো। মালেকা বেগম আদর করে দিয়ে বললেন,

” কাঁদিস না। তোকে তো ওরা ভালো রাখছে। জামাইও তোকে কত চোখে হারায়। নিজের ঘর সংসারের প্রতি একটু মনোযোগ দে তিথি। এমন শ্বশুরবাড়ি কিন্তু কপাল করে পায় মেয়েরা। ”

তিথি উত্তর না দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তাকে ভালো রাখবে না কেন? তার পেটে ওদের বংশধর আছে তাই ভালো রাখছে। তার পেটে বাচ্চা আছে তাই ফাটাকেষ্ঠ তাকে চোখে হারাচ্ছে, আদর সোহাগ করছে। ওসব তো সব জামাইরা করে।

বউকে আদর সোহাগ করা জামাইয়ের জন্য ফরজ। তার জামাইও ব্যতিক্রম কিছু করছে না। কাল তার গালটাল ছিঁড়ে ফেললো দাঁড়িগুলোর ঘষায়। পুরুষ মানুষ চাপ দাঁড়ি রাখে বউয়ের গাল ঘষে দেয়ার জন্য। নইলে সেটার আর কোনো কাজ নেই।

_______

তন্মধ্যে তিথির ইনকোর্স পরীক্ষার ডেট পড়েছে। তিথির হাঁটতে চলতে বড়ো অসুবিধা। আর একটা মাস সময় আছে। তারও কম বলা যায়। আজলান বললো, ” ইনকোর্স পরীক্ষা এখন দিতে হবে না। ফাইনালের আগে দিলে হয়ে যাবে।”

তিথি বলল, ” কোনো পরীক্ষাই দিতে হবে না। বিবাহিত মেয়েদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে বরের বুকে ঘুমানো, বাচ্চা কাচ্চার হাগুমুতু পরিষ্কার করা আর নিয়ম করে বর আর শ্বাশুড়ির বকাঝকা শোনা। পড়ালেখাটেকা ওসব অবিবাহিত মেয়েদের কাজ। কোনো কাজবাজ না থাকলে মানুষ পড়াশোনার মতো ফালতু কাজ নিয়ে বিজি থাকে।”

আজলান চুপ করে শুনলো। কি বলবে সে? কি বলার আছে? কিছু বললেই তো সমস্যা। আবার না বললেও সমস্যা।

তিথি কিছুক্ষণ পর রাগত স্বরে বললো,

” আমি কি তোমার চালাকি বুঝিনা? তুমি আমাকে অশিক্ষিত মূর্খ বানিয়ে রাখতে চাও তাই পরীক্ষা দিতে দিচ্ছ না। আমাকে পরীক্ষা দেয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমার বাচ্চা পেট থেকে বেরিয়ে আসুক তারপর দেখো আমি কি করি। আমাকে অবলা পেয়ে তোমরা এখন যা ইচ্ছে তাই শুরু করে দিয়েছ। ”

আজলান তার ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে ধরে বলল, ” চুপ চুপ। রেডি হয়ে নাও। চেক-আপ করাতে যাবো। এটাই শেষ। ”

তিথি চুপচাপ রেডি হয়ে নিল। চেকআপ করাতে গিয়ে তসলিমা খাতুনের সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি তিথিকে একা একা লাউঞ্জে বসে থাকতে দেখে বললেন,

” আরেহ তিথি কি অবস্থা? কেমন আছে তুমি? ”

তিথি বলল, ” ভালো। আপনি কেমন আছেন? ‘

” খুব ভালো। তোমাকে দেখে আরও ভালো লাগছে। চেকআপ করাতে এসেছ বুঝি? ”

” জ্বি। ”

তসলিমা খাতুন একটু জিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,

” তোমার বরের সাথে সম্পর্ক এখন কেমন? ”

” আগের মতো। ”

” আগের মতো মানে? তোমাকে এখনো দূরছাই করে? ”

” হ্যা। ”

তসলিমা খাতুন হতাশ হয়ে বললো,

” তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব যত্নে আছো। আমি কত খুশি হলাম তোমাকে দেখে! ”

তিথি বললো, ” আমার বাচ্চা শেখ বংশের বাচ্চা। তাই ওর যত্ন তো সবাই করবেই। ”

তসলিমা খাতুন বললেন, ” তা ঠিক। তোমার বর তোমাকে একটুও ভালোবাসে না? ”

” না না ওসব ভালোবাসা টালোবাসা নেই। ভালোবাসলে তাকে মুক্ত পাখির মতো উড়তে দিতে হয়। আমার বর আমাকে পারেনা সারাদিন ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে। মন চাইলে কিছু খেতেও পারিনা। কত অজুহাত দেখাবে। একটু ঘুরতে যেতে চাইলে বলবে এই সময় কোথাও বেরোনো নিষেধ।”

” এখনো ঘর থেকে বের করে দেয়? ”

” হ্যা আগে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত এখন আলতো হাতে ধরে বের করে দেয় যাতে ওর বাচ্চা ব্যাথা না পায়। কত পল্টিবাজ দেখুন! ”

” তুমি কার সাথে এসেছ? ”

” আর কার সাথে? ”

” তোমার বরের সাথে? ”

” হ্যা দেখছেন না আমাকে একা রেখে কোথায় চলে গিয়েছে। ”

” ওহহ। ”

তখন গটগট পায়ে হেঁটে সেখানে আজলান এল। বলল,

” মেহবুব চলো। ”

তসলিমা খাতুন তাকে দেখে হাঁ করে চেয়ে রইলেন। আজলান তাকে দেখে বলল,

” আপনি? কেমন আছেন?”

তসলিমা খাতুন বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে হেসে বললেন,

” জ্বি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

আজলান বলল, ” আমিও ভালো আছি। ”

তসলিমা খাতুন হেসে বললেন,

” আপনার বধূর সাথে গল্প করছিলাম। বাচ্চার বাবার অনেক প্রশংসা করছিলো। ”

তিথি ভুরু কুঁচকে চাইলো। আজলান বলল,

” ওহহ তা জানি। ”

তসলিমা খাতুন হাসলেন। আজলান তিথিকে হাত ধরে তুলে বলল,

” আমরা আসি তাহলে। দেরী হয়ে যাচ্ছে। ”

” হ্যা যান। তিথি ভালো থেকো। শীঘ্রই সুখবর শুনবো। ”

তিথি যেতে যেতে আজলানকে বলল,

” আচ্ছা মহিলা মিথ্যে বললো কেন গো? ”

আজলান বলল,

” কারণ সবাই তোমার মতে ষ্টুপিড নয়। ”

” সবাই তোমার মতো পল্টিবাজ। তাই তো?”

” হ্যা হ্যা তাই। ডাক্তার যা যা জিজ্ঞেস করবে তাই তাই বলবে। আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলবে না।”

” ডাক্তার কি আমার তালতো ভাই যে ইয়ার্কি মারবো? ”

আজলান বিরক্ত হয়ে বলল,

” এত কথা কেন বলো? ”

” ডোডো যদি বোবা হয়? ”

____________

তিথিকে প্রায় সাতদিন আগে ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়েছিলো। ডেলিভারির সময় দিয়েছে আরও সাতদিন পর। কিন্তু তিথির ব্যাথা অনুভব হওয়ায় ডাক্তার বলেছিলো ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিতে। ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে হাউমাউ করে কেঁদে আম্বিয়া বেগমকে বলল,

” ও-মা আমি যদি ওখান থেকে আর না ফিরি তখন কি হবে? ”

আম্বিয়া বেগম রেগেমেগে বললেন, “কেমন অলক্ষুণে কথা বলছে দেখছিস খোকা?”

আজলান বললো, “ওখানে উন্নত চিকিৎসা দেয়। তুমি যাতে কষ্ট না পাও সেজন্য তোমাকে ভর্তি করানো হচ্ছে। ”

তিথি কাঁদতে লাগলো। রমলা চাচীকে বলল,

” আমার আচারের বয়ামটা বেড সাইট টেবিলে রাখা আছে। আমি ফিরে না এলে তুমি রেখে দিও। আলমিরায় লাল আর হলুদ রঙের যে শাড়িগুলো আছে ওগুলোও তুমি রেখে দিও। ”

রমলা চাচী মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

” তুমি কোথায় যাইবা? এটা তোমার বাড়ি। তোমাকে ফিরতে হইবো তো। তুমি তোমার বাবুরে নিয়ে ফিরবা। ”

” তাহলে মিষ্টি কিনে রাখিও। ”

” আচ্ছা আচ্ছা রাখবো। ”

” স্পঞ্জের মিষ্টি না কিন্তু। কালোজামুনের মিষ্টি। ”

আজলান বলল,

” ওকে। আর কিছু? ”

” দুই প্লেট ফুচকা, বেশি বেশি ঝাল আর বেশি বেশি টক দিয়ে। উপরে সিদ্ধ ডিমের লেয়ার থাকবে।
আর গরুর মাংস দিয়ে চটপটি। ”

” আর কিছু? ”

তিথি গাল মুছে বলল, ” এগুলো খাওয়ানোর হেডম নাই আবার বলে “আর কিছু” । কতবার খেতে চাইছি খেতে দাওনাই । ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” খাওয়ার পর বুক জ্বলে ছাই হয়ে যাইতেছে বলিস কেন? ”

আজলান কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ” ওকে, ওকে ফাইন। তুমি ফিরে এলে সব পাবে। ”

তিথি ব্যাথায় কাঁদতে লাগলো। আজলান কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ” তুমি তোমার কথা রাখলে আমি আমার কথা রাখবো। কাঁদবে না। তোমার ডোডোও কাঁদবে। ”

তিথি বলল, ” বাপের মতো বজ্জাত হয়ছে। শুধু আমাকে কষ্ট দেয়। সারাক্ষণ লাথি দেয়। আসুক একবার, পাই হাতের কাছে। পা দুটো যদি বেঁধে না রাখি। ”

ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময় তিথি আজলানকে শক্ত করে ধরে রাখলো। চেঁচিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো,

” তুমি না গেলে আমি ওখান থেকে পালিয়ে আসবো। ওরা আমার পেট কেটে ফেলবে। ”

আজলান মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

” আমি আছি। ”

তিথির প্রসববেদনা আরও গাঢ় হওয়ায় সে চিৎকার দিয়ে কাঁদছিলো।

তারপরের দিন ফজর নাগাদ তিথির ছেলে বাবু হলো। সি সেকশন করিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিলো। আজলান বলেছে, সি সেকশন করানোর। মা আর বাচ্চা দুজনেই যাতে সুস্থ থাকে। কিন্তু সি সেকশন করানোর আগেই তার নর্মাল ডেলিভারিতে বাচ্চা হয়ে গেছে।

হসপিটালের করিডোর মেতে উঠলো সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চার কান্নায়। মালেকা বেগম খুশিতে কেঁদে ফেললেন। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললেন, “আমার পাগলটা মা হয়ে গেছে। ও আল্লাহ তোমার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। বাচ্চাটা ওদের সংসারে যেন বরকত রহমত নিয়ে আসে। ”

আফতাব শেখ আজান দিলেন নাতিকে কোলে নিয়ে। আম্বিয়া বেগম নাতি পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। আজলান এসে দেখলো ধবধবে সাদা নরম তোয়ালের মধ্যে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটি হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মাথাভর্তি চুল, হৃষ্টপুষ্ট সবল দেহ।
আফতাব শেখ বললেন,

” বাচ্চার বাবা এসেছে। তাকে কোলে নিয়ে কালেমা পড়ে শোনাতে বলো। আর বলো বউ তার টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেই টাকায় যেন কালোজামুন আর ফুচকা, চটপটি কিনে নিয়ে আসে বউয়ের জন্য। ”

আজলান কিছু বললো না।
আম্বিয়া বেগম আজলানের কাছে এসে বললো,

” নে নে তোর ছেলেকে কোলে নে খোকা। ”

আজলান কোলে নিয়ে আয়জাকে বলল,

” তোর ভাবিকে দেখেছিস? ”

” হ্যা জ্ঞান ফেরার জন্য একটু সময় নেবে বললো।”

আজলান ছেলের কানে কালেমা পড়ে শোনালো। আয়জা বলল, ” আম্মা আম্মা দেখো চোখ মেলেছে। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ”

আম্বিয়া বেগম আজলানকে ফিসফিস করে বলল, ” মা চতুর ছেলে চতুর হবে না? দেখেছিস তোকে কেমন করে দেখছে? ”

আজলান বাচ্চার দিকে চেয়ে ভুরু নাচিয়ে বলল,

” শেখ বাড়ির মতো পাগলা গারদে জন্মানোর জন্য আপনাকে অভিনন্দন। ”

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হাত পা নেড়ে কেঁদে উঠলো সে।

____

তিথির যখন জ্ঞান ফিরলো তখন মা, শ্বাশুড়ি সবাই তাকে দেখতে এল। তিথি তখন কাঁদছে। আম্বিয়া বেগম বললেন,

” এই দেখ বউ তোর বাবু। ”

তিথি তাকে একনজর দেখে নিল। এই মোটাসোটা বাচ্চাটা তার পেটে ছিল? মালেকা বেগম বললেন,

” কাঁদিস না মা। দেখ দেখ। বলতো কার মতো হয়েছে। ”

তিথি কেঁদে বলল, ” কারো মতো লাগছেনা। এখন সব বাচ্চাই এক। সরো তো। ”

মালেকা বেগম রেগে গিয়ে বললেন, ” ওমা। ”

তিথি নাক টানতে টানতে কাঁদতে লাগলো। ওই ব্যাটা এখন আসবে না তাকে দেখতে। তার কাজ তো শেষ। এতদিন পেটে বাচ্চা ছিল বলে তাকে যত্নআত্তির করেছে। এখন তাকে ফিরেও দেখবে না।

আজলান আসতেই সবাই বেরিয়ে গেল। তিথি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো। আজলান তার পাশে বসে হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

” মেহবুব এদিকে ফিরো। কথা আছে। ”

তিথি ফিরলো না। গাল মুছতে লাগলো ঘনঘন। আজলান তার মুখটা ফিরিয়ে এনে দেখলো মুখটা একদিনের মধ্যেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে গেছে। তার দিকে ফেরামাত্রই চোখ ভরে ভরে জল নামলো তিথির। আজলান ঝুঁকে বলল,

” কেঁদো না। চলো বাড়ি যাই। তোমার জন্য কালোজামুন, ফুচকা, চটপটি সব রেডি আছে। ”

তিথি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদতে লাগলো জোরে জোরে। আজলান পুনরায় মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে ধমকে বলল,

” একদম কাঁদবে না। তুমি কেন কাঁদছো আমি জানি। কিন্তু এখন চুমু দেয়া যাবে না। ফ্রেশ হতে হবে। তারপর। ক্লিনিকে হাজারটা জার্মস আছে। ”

তিথি আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। আজলান পকেট থেকে একটা জিনিস বের করলো। তিথিকে বলল, ” এটা তোমার জন্য। ”

তিথি এবার নিজ থেকে ফিরে তাকালো। লিপস্টিক দেখে সজলনেত্রে হাসলো। আজলান লিপস্টিকের ঢাকনা খুলে তার ঠোঁটে লাগিয়ে দিল। তিথি ঠোঁট দুটো একে অপরের লাগিয়ে পাহ পাহ শব্দ করলো। আজলান বলল,

” খাওয়ার আগে টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলবে। ”

নার্স এসে তিথির ঠোঁটে লিপস্টিক দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো। তিথি কমলার খোয়া খেতে খেতে তাকে দেখলো আগাগোড়া। যথেষ্ট রূপবতী সে। বয়সও বেশি না। জ্ঞান ফেরার পর থেকে তিথি সন্দিগ্ধ চোখে তাকে দেখে যাচ্ছিলো। ফাটাকেষ্ঠর সাথে স্যার স্যার বলে কথা বলেই যাচ্ছে তখন থেকে। কথা বলছিস বল, মুখে এত হাসি কেন? তিথি রাগত স্বরে তাকে ডেকে বলল,

” এই মেয়ে আমার বাচ্চার বাপের সাথে তোমার কি চলে? ”

আজলান চলে আসায় নার্স মেয়েটা কোনোমতে পালিয়ে গেল। আজলান বাচ্চাকে দোল দিতে দিতে তিথিকে বলল,

” কি বলছিলে উনাকে? ”

তিথি বলল, ” কিছুনা। তুমি কোথাও বেরোনোর সময় হলদে রঙের লুঙ্গি, আর লাল রঙের শার্ট পড়বে। ”

আজলান বলল, ” আচ্ছা। লাল রঙের গামছাও গলায় পড়বো।

তিথি খেতে খেতে মৃদুস্বরে বলল, ” আমার নর্মাল ডেলিভারি হয়েছে না? ”

” হুম। ”

তিথি বলল, ” হবেই তো। আমার পেট কাটবে অত সাহস কার?”

তারপর বাচ্চার দিকে চেয়ে বলল, “ওকে এনেছ কেন? আমি ওকে আর খাওয়াতে পারব না। আমার সুড়সুড়ি লাগে। ”

আজলান ধমকে বলল, ” শাট আপ ওর খিদে পেয়েছে।”

চলমান….