এই ভালো এই খারাপ পর্ব-১৯

0
198

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

বাথরুমে পড়ে মাথা ফেটে গেছে তিথির। হাতের কনুইতে আঘাত লেগেছে। পায়ের বুড়ো আঙুলটা মুচড়ে গেছে। হাসপাতালে সতের ঘন্টা কাটিয়ে এসে বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছিলো সে। আজলান সদর দপ্তরে গিয়েছে চারদিন হলো। এরিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে।

তিথি সেদিন শ্বশুরমশাইকে যারিফের কথা বলেছিলো। শোনার পর উনি কোনো মন্তব্য করেননি। তিথি ভয় পেয়ে গিয়েছিলো উনার নীরবতা দেখে কিন্তু খাওয়ার টেবিলে ছেলেকে হঠাৎ চ্যালেঞ্জ করে বসবেন এটা তিথি কল্পনাও করেননি। বাপ ছেলে দুজনেই ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়।

আজলান যাওয়ার পরদিনই যারিফের বাড়িতে গিয়েছেন আফতাব শেখ। কথাবার্তা সেড়ে এসেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দুজনের আকদ পড়িয়ে রাখবেন। যারিফের চাকরি হলে তখন তারা বউ তুলে নিয়ে যাবে। এইকথা আয়জা, তিথি আর উনি ছাড়া কেউ জানেন না। আম্বিয়া বেগম সন্দেহের চোখে দেখছিলেন সবাইকে। কিছু একটা হচ্ছে যেটা উনি বুঝতে পারছেন না। আজলান আজ ফিরবে। উনি ঠিক করলেন সবটা আজলানকে খুলে বলবেন।

আফতাব শেখ সন্তুষ্ট যারিফের বাবা মায়ের সাথে কথা বলে। যারিফ এমনিতেও শিক্ষিত ছেলে। তার একটা নাম আছে। পাশাপাশি ড্রাইভিং শিখেছিলো শখ করে। কিন্তু সেটাও আয়ের পথ বের করবে তা সে ভাবেনি। আজলান শেখের ড্রাইভার হিসেবে তিন বছর ধরে কাজ করে আসছে সে। এর আগে অনেকগুলো ড্রাইভার বদল হয়েছে আজলান শেখের। বেশিদিন টিকতো না কেউ। যারিফ কিভাবে স্থায়ী হয়ে গিয়েছে তা যারিফ নিজেও জানে না। তাই হয়ত সে স্যারের বিশ্বাসে আঘাত দিতে চাইনি। চেয়েছিলো নিজেকে যোগ্য করে তবেই সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কিন্তু তার আগেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। আফতাব শেখের সিদ্ধান্তেও সে খুশি হয়েছিলো এমন না। স্যারের কথা ভাবতেই তার খারাপ লাগছিলো। সে এমনটা চায়নি। একটু একটু করে অর্জন করা স্যারের সব বিশ্বাস, ভরসা এক লহমায় ধূলিসাৎ হয়ে যাবে যখন তিনি জানতে পারবেন উনার পিতার সমস্ত ষড়যন্ত্রের পেছনের শক্তপোক্ত হাতিয়ারটা সে নিজেই।

আফতাব শেখ সন্ধ্যা থেকে হৈহৈ করছিলেন আনন্দে। পাত্রপক্ষের মামাকে যা বলার উনি বলে দিয়েছেন। আম্বিয়া বেগম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন সবটা শুনে। শুধুমাত্র ছেলেকে হারানোর জন্য উনি মেয়ের এত ভালো সম্বন্ধটা ভেঙে দিলেন? যারিফের কথা উনি তখনও জানতে পারেননি। সমস্ত রাগ, ক্ষোভ সব গিয়ে পড়লো আয়জার উপর। আফতাব শেখ কড়া হুশিয়ারি দিলেন।

” আমার বাড়ি এটা। আমার মেয়ের গায়ে হাত দেয়ার আগে দশবার ভাববে। ”

আম্বিয়া বেগমের পায়ের তলার মাটি যেন নড়ে উঠলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না একজন বাবাও এমন করতে পারে। শ্বশুরমশাইয়ের হৈহল্লা আর গাড়ির হর্নের শব্দ কানে আসার পর তিথি নিজেকে ঘরে আর আটকে রাখতে পারেনি। বাবা ছেলের মধ্যে এখন শুরু হবে তুমুল যুদ্ধ। না আজলান শেখ দমবে, না আফতাব শেখ। দরজার নিকটে এসে দাঁড়িয়ে একনজরে বাবার দিকে চেয়ে রইলো আজলান। উনি আম্বিয়া বেগমকে বলে যাচ্ছেন,

” আমি এই বাড়ির মালিক। একমাত্র কর্তা। আমার সিদ্ধান্তই হবে শেষ কথা। আমার সিদ্ধান্তে আতিফার বিয়ে হয়েছে, আমার সিদ্ধান্তে ওর বিয়ে হয়েছে, আমার সিদ্ধান্তে আমার ছোট মেয়েরও বিয়ে হবে। আজলান শেখ, হা হা সে এখনো চেনেনি তার জন্মদাতাকে। সে চলে ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। ”

আম্বিয়া বেগম শাড়ি আঁচল মুখে গুঁজে গুমরে কেঁদে উঠে বললেন,

” তুমি বাবা নও। তুমি একটা পিশাচ। ”

তিথির চোখদুটো তখনো আজলানের দিকে নিবদ্ধ। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে চেয়ে আছে আফতাব শেখের দিকে। আফতাব শেখের দৃষ্টি তার উপর পড়ামাত্রই তিনি হৈহৈ করে উঠে বললেন,

” আসুন আসুন ডেপুটি কমান্ডার সাহেব। আপনার জন্য সুখবর। ”

আজলান আঁড়চোখে তিথি আর আয়জাকে দেখে নিল। তারপর বলল,

” আপনি যা করেছেন তা ভালো করেননি। এরজন্য আপনাকে ভুগতে হবে। ”

আয়জা কাঁদছে। আজলান তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়জা মাথা নামিয়ে কেঁদে যাচ্ছে একনাগাড়ে। আফতাব শেখ বললেন,

” কাঁদছিস কেন? তোর কোনো ভাইয়ের দরকার নেই। আমি আছি। তোর জন্য আমি একাই যথেষ্ট।”

আম্বিয়া বেগম এসে বললেন,

” আব্বা তোকে কি ওরা ফোন দিছে? কিছু বলেছে? ”

আজলান রেকর্ড ছেড়ে দিয়ে উপরে চলে গেল চুপচাপ। তার অতি শান্ত কন্ঠস্বর, চলনবলন তিথিকে শেষ করে দিচ্ছে। রেকর্ডের প্রতিটা কথা আয়জার চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, আজলান শেখের মতো একজন ডেপুটি কমান্ডারের পেশাদারিত্ব আর সততার দিকে আঙুল তোলা, আফতাব শেখের মতো মানুষের দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনামের উপর প্রশ্ন তোলা।

আম্বিয়া বেগম কাঁদতে লাগলেন। এত অপমান কার গায়ে সইবে?

_______

তিথি শরবতের গ্লাস নিয়ে ঘরে এসে আজলানকে খুঁজলো। ঘরে আলো নিভানো। কোচের উপর চোখ বুঁজে শুয়ে আছে সে। তিথি আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বলল,

” তুমি ওসব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। উনি উনার মেয়ের বিয়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানে দিক। আয়জাও সেটাই চায়। ”

আজলান চোখ খুললো চট করে। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,

” তুমি জানো ছেলেটা কে? ও নাম বলেছে? ”

তিথি তার দিকে শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলব। এটা খাও আগে। ”

আজলান শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো। বলল,

” এবার বলো। ”

তিথি গ্লাসটা নিতে চাইলে আজলান বলল,

” নাম বলতে বলছি। ”

তিথি বললো,

” এমন করো না প্লিজ। তুমি এত টাকা পয়সা খরচা করে বিয়ে দিবে কিন্তু আয়জা সুখী না হলে তখন কি করবে? উনি উনার মেয়ের বিয়ে যার সাথে ইচ্ছে দিক। তুমি ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। ”

আজলান গর্জে বলল,

” তোমাকে জাস্ট সত্যিটা বলতে বলছি ড্যাম। ”

তিথি কেঁদে উঠলো। আজলান কপাল চেপে ধরে বলল,

” তোমার মাথায় কি হয়েছে? ”

তিথি বলল, ” বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। ”

আজলান তার ব্যান্ডেজ ছুঁয়ে বলল,

” ভালো কাজ করেছ। তোমার কাজ আমাকে জ্বালানো। তুমি এটা ছাড়া কিছু পারো না। ভবিষ্যতেও এই কাজটা করবে। ”

তিথি বলল, ” তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি।”

আজলান খেঁকিয়ে উঠে বলল, ” আমি কষ্ট পাচ্ছি তোমাকে সেটা কে বললো? আমি কষ্ট পাইনি। কষ্ট আমাকে ছুঁতে পারেনা। আমি অবাক হচ্ছি এটা ভেবে তারা বাপ মেয়ে মিলে আমার সাথে এমনটা কি করে করলো? ”

তিথি বললো, ” তুমি প্লিজ শান্ত হও। ”

আজলান বলল, ” না পারবো না। আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো। ও ছেলেটার নাম জানো না তুমি? কি নাম ওর? কোথায় থাকে? জানো না এটা বলো না। আকদের তারিখ পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে। ”

তিথি বিনা সঙ্কোচে বলল, ” যারিফ। ”

আজলান পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করলো, ” যারিফ, যারিফ, যারিফ। ”

তারপর চমকে গিয়ে ফিরে তাকালো তিথির চোখ বরাবর। চোখে অপার বিস্ময়।

________

আজলান কপালের উপর হাত রেখে লম্বা হয়ে চুপ করে শুয়েছিলো। আয়জা দরজা মেলে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে ভাইয়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকলো অনেকক্ষণ। আজলান ফোঁপানির শব্দে চোখের উপর হতে হাত সরিয়ে নিয়েছে। মেঝেতে হাঁটু রেখে পায়ের কাছে আয়জাকে বসে থাকতে দেখে সে জিজ্ঞেস করলো,

” কি চাই এখানে? ”

আয়জা কান্নার শব্দ একটু বাড়লো। বলল,

” আমাকে মাফ করে দাও ভাইয়া। তুমি মত না দিলে এসব বিয়েটিয়ে কিচ্ছু হবে না। ”

আজলান পা সরিয়ে নিয়ে বলল,

” আমি ঘুমোচ্ছি। বিরক্ত করিস না। ”

আয়জা কাঁদতে লাগলো। আজলান চুপ করে রইলো। আয়জা বলল,

” তুমি অপমানিত হও এটা আমি চাইনি ভাইয়া। ”

আজলান বলল,

” আমি কৈফিয়ত চাইনি। তুই যাহ এখান থেকে। ”

আয়জা তার পায়ের কাছে পড়ে কাঁদতে লাগলো। আজলান অনেকক্ষণ পর বিছানা থেকে নেমে গেল। বলল,

” যারিফ ভালো ছেলে। ও তোকে ভালো রাখবে। তোর বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু আসল কথা হচ্ছে তোর বিয়েতে আমি থাকতে পারবো না। সম্ভব না। তুই যাহ এখন। ”

আয়জা বলল,

” এমন করো না ভাইয়। আব্বা করেছে যা করার আমি এমন কিছু করতে বলিনি যাতে তোমার অপমান হয়। আমি আব্বাকে কিচ্ছু বলিনি। আমি শুধু ভাবিকে বলেছি…..

আজলান ঘাড় ফিরিয়ে ভ্রুকুটি করে বলল,

” ভাবি? মেহবুব সব জানতো? ”

আয়জা আমতাআমতা করে বলল,

” না মানে..

তিথি তখনি কফির মগ নিয়ে এল। আজলান বলল,

” তুই যা এখন। ”

আয়জা বলল,

” না ভাবি এমন কিছু বলেনি। তুমি ভাবিকে ভুল বুঝো না। ”

আজলান তার হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তিথি কফির মগটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। আজলান তার পেছনে হেঁটে এসে জিজ্ঞেস করলো,

” তুমিও সুযোগটা লুফে নিলে? আসল ষড়যন্ত্রকারী দেখছি আমার বউ। ”

চলমান..
রিচেক করিনি।