এই ভালো এই খারাপ পর্ব-২২+২৩

0
202

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২২
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

মাছ কাটতে গিয়ে বুড়ো আঙুলের পেট কাটা গিয়েছে তিথির। কাজ করতে যাবে অথচ তার ভুল হবে না এটা অসম্ভব।

গতকাল ফ্যান মুছতে গিয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেল। এমনিতেই সে শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে মাথা ফেটে, বাথরুমে আছাড় খেয়ে। এখানে এসে একবার চেয়ার থেকে পড়লো, আবার আঙুল কাটলো।

মালেকা বেগম অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। দুধের শিশুটাকে ফেলে এসেছে। কতবড় পাষাণ মা সে? জামাই না হয় দুটো কথা শুনিয়েছে তাতে এভাবে চলে আসতে হলো?

ভালো ঘরে বিয়ে দেয়ায় কত নিশ্চিন্তে ছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েকদিন পর পর একেকটা ঝামেলা করে সে বাপের বাড়ি চলে আসে।

কিসের এত আত্ম অহমিকা তার? কিসের এত দেমাক? কি আছে তার বাপের? অমন বর-ঘর পেয়েছে কপাল করে। সেসব আঁকড়ে ধরে সুন্দর করে সংসার করবে তা না। কিসের বলে ঘনঘন বাপের বাড়িতে চলে আসে সে?

বাপ একদিন কামাই দশদিন বসে থাকে। দোকানে কেনাবেচা নেই, ছোট ভাইটা এখনো পড়াশোনা করছে। কে তার অসুখ বিসুখের চিকিৎসা খরচ দেবে? কেনই বা দেবে? যে অমন ছেলের ঘর করতে পারে না তার হাতে চাঁদ এনে দিলেও সে তার মূল্য দিতে পারবে না।

যতবার তিথি তার সামনে আসছে ততবারই তিনি বকাবকি করছেন। অন্যবার শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পর বাপের সাথে মিলে উনাকে জব্দ করলেও এবার তিথির কোনো সাড়াশব্দ নেই।

ছেলের জন্য কাঁদছে কিন্তু ছেলের খোঁজ নিতে পারছে না। তাকে ফোনে ব্লক করে রেখেছে আজলান শেখ এমনকি বাড়ির সব নাম্বার।

সে জানিয়েছে, এখানে না খেয়ে পড়ে থাকবে তবুও শ্বশুরবাড়িতে সে যাবে না। মায়ের মন তাই মেয়ে না খেয়ে ঘরে শুয়ে থাকলে উনার খারাপ লাগে, সংসার ভেঙেছে তাই দুঃখ হয়, বাচ্চার শোকে কাঁদছে তাই মায়া লাগে নয়ত চুলের ঝুঁটি ধরে বের করে দিত ঘর থেকে।

রাগে, দুঃখে উনি কাঁদতে বসেন। কত খুশি হয়েছিলেন একটা নাতি হওয়ায়। ভেবেছিলেন এই বুঝি তার সব পাগলামি চুটে যাবে।

মেয়েরা মা হওয়ার পর অনেক বদলে যায়। সংযত হয়। কিন্তু তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এল না। স্বামী সংসারের প্রতি হেয়ালি গেল না। এভাবে কি সংসার হয়?

এই যে এখন কাঁদছে, খাচ্ছে না, কথা বলছে না, কাজ করতে গিয়ে হাত পা কাটছে সবটাই বাচ্চাটার জন্য।

নইলে স্বামী সংসারের জন্য তার অত মায়া নেই। বাচ্চাকে ফেলে এসেছে বলে এত কান্নাকাটি নইলে আগেরবারের মতো উনার মুখে মুখে তর্ক করতো। আর বলতো, “কেন যাব ওই বাড়িতে? কেন যাবো ওই লোকের কাছে। আমি না গেলেই বাঁচি। ”

উনার বড্ড রাগ হয়। পেটে ধরেছেন তাই কঠোর হতে পারেন না। কিন্তু এভাবে যে সংসার হয় না তা উনি বুঝাতে পারেন না।

সংসার করতে অনেক ধৈর্য লাগে, অনেক সংযমী হতে হয়। স্বামী সংসারকে ভালোবাসতে হয়, আপন করতে হয়। যেটা উনার মেয়ে করেনি।

এখনো বাচ্চাটাকে পেয়ে গেলে সে স্বামী সংসারের দিকে ফিরেও তাকাবে না। অতবড় কলিজা তার আছে। বরঞ্চ ছেলেটা হওয়ার দেড়বছরের মধ্যে কোনো অভিযোগ আসেনি কেন এটা নিয়েই উনি ভাবছিলেন এতদিন। এত সহজে সে শোধরানোর নয়।

বিয়ের আগেও পাড়াপ্রতিবেশিরা কত কথা বলেছে। বিয়ে হবেনা, সংসার করতে পারবে না, ভালো ছেলে জুটবে না, শ্বশুরবাড়িতে ভাত জুটবে না।

চেয়ারম্যান বাড়ির এক ভাগ্নের সাথে সেবার কত কথা রটে গেল। সেই ছেলে তাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগলো। সেও কম না। বাপকে এসে আবদার করলো,

” আব্বা আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও। তোমার ঘাড়ে বসে আর কতদিন খাবো? আমার পড়াশোনা ভালো লাগে না। ও বলেছে আমাদের বিয়ে হলে তোমার দোকানটা সাড়িয়ে দেবে। নতুন মাল তুলে দেবে। তুমি বাজারের সবচাইতে বড় সওদাগর হবে। তারপর ধীরেধীরে ওর টাকা ওকে শোধ করে দেবে। ”

কিন্তু ওই ছেলেটা ওকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শেষমেশ কোথায় যেন পালিয়ে গেল। সেই থেকে বিয়ে করবে না বলে তিথি জেদ ধরলো।

“সবকটা ব্যাটামানুষ ভন্ড” বলে এমনভাবে বেঁকে বসলো মালেকা বেগম কত কেঁদেছেন শুধু বিয়ে দিতে পারবেন না ভেবে।

শেষমেশ উনার ভাইজির বিয়েতে আফতাব শেখ তিথিকে দেখে উনার ছেলের জন্য পছন্দ করেন। পছন্দের প্রথম কারণ তিথির কাছ থেকে উনি পানি চেয়েছিলেন তিথি একেবারে শরবত এনে দিয়েছিলো। দ্বিতীয় কারণ হয়ত তিনি এমন মেয়েই খুঁজছিলেন মনে মনে।

যেন লোকটা তার বহুদিনের পরিচিত অমনভাবে উনার সাথে গল্পসল্প জুড়ে দিয়েছিলো তিথি। আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন তাই আফতাব শেখ তিথিকে পুত্রবধূ করার সিদ্ধান্ত সেই বিয়েবাড়িতেই পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন।

আজলান শেখও বিয়েতে এসেছিলো কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে। বরযাত্রীদের সাথে এসেছিল, খেয়েদেয়ে সোজা চলে গিয়েছে।

প্রথম কারণ, সময়টা বর্ষাকাল হওয়ায় গ্রামের বাড়ির মাটি কর্দমাক্ত ছিল, পা ফেলতেও তার অস্বস্তি।

দ্বিতীয়ত সেখান থেকে কিছুটা দূরে গরুর গোয়াল, দেখেই ঘৃণা লাগছিলো।

তৃতীয়ত খাবার পরিবেশনকারী গ্রাম্য ছেলেগুলো একে অপরকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করছিলো যা শুনে কেউ তেমন প্রতিক্রিয়া করেনি।

চতুর্থ কারণ, টেবিলের উপর যে সাদা কাপড়টা বিছানো হয়েছিলো সেটাতে মাংসের ঝোলঝাল লেগেছিলো, আশেপাশে মাছি উড়ছিলো দু-একটা, আর গ্লাসগুলোতে চর্বির তেল।

পঞ্চম কারণটি একটু ভিন্ন। বহুকষ্টে আতিথেয়তা রক্ষা করার পর যখন সে তাড়াহুড়ো করছিলো কোনোমতে বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক সেই মুহূর্তে আফতাব শেখ তাকে ডেকে একটা গোলাপি পোশাক পড়া মেয়েকে দেখিয়ে বলল,

” ওকে দেখতে পারো। আধুনিকতার বাতাস গায়ে লাগেনি। তুমি যেমনটা চাইছো ঠিক তেমনটা। সহজ সরল অত মারপ্যাঁচ নেই মনে। মনের কথা আমাকে খুলে বলে ফেললো। বুঝতে পেরেছ আজলান শেখ? মাটির দলা। তুমি যেমন আকার দেবে তেমনই হবে। রঙ নিয়ে নিশ্চয়ই তোমার সমস্যা নেই কারণ তুমি ফর্সা, সুন্দরী, আধুনিকাদের পছন্দ করো না। এবার নিশ্চয়ই বলবে না একেও আমার পছন্দ না। দেখো, আমি ওকে তখন থেকে লক্ষ করছি এখানে এত এত সুদর্শন কুদর্শন বরপক্ষের ছেলেপেলে এসেছে ও একবারও ফিরে তাকালো না। ”

আজলান শেখ দেখলো মেয়েটা বরপক্ষের কাছ থেকে টাকা আদায় করার জন্য নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে। আঙুল তুলে ঝাঁজালো সুরে বলল,

” টাকা বাড়িয়ে না দিলে আজকে বউ পাবানা মনু। যাও বসে বসে হাড্ডি চিবাও। ”

আজলান বিরক্ত হয়ে সোজা বেরিয়ে এসেছিলো।
মেয়েটা শ্যামকালো হলেও চেহারা খারাপ না কিন্তু খারাপ ছিল তার ড্রেসসেন্স আর সাজগোজ।ননসেন্স।

মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে গিয়ে ভয়ে বুক কাঁপছিলো মালেকা বেগমের। যদি নামিদামী আসবাবপত্র আর বৈরাতী চেয়ে বসে তাহলে তো হাতছাড়া হয়ে যাবে এমন পাত্র। অত টাকা তিনি কোথায় পাবেন, কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো। বরপক্ষ কিছু চাইলো না তেমন।

মালেকা বেগমকে উনার মা প্রায়সময় বলতেন, মেয়েদের সুন্দর হওয়ার চাইতে কপাল সুন্দর হওয়া বেশি দরকার। তিথিরও যেন তেমনটাই হলো।

পাড়াপড়শিরা অবাক হয়ে গেল এমন সম্বন্ধ আসায়। হাঁটেবাজারে সবাই বরপক্ষের লোকের কানভারী করার চেষ্টা করলো কিন্তু ছেলে আইনের লোক হওয়ায় সেই চেষ্টায় কেউ তেমন সফল হতে পারেনি।

অমন ভালো ছেলে, যেমন পেশা তেমন দেখতে, বাড়ি-ঘর, ধন-দৌলত, মেয়ের এত সুখের কপাল দেখে মালেকা বেগম আর মফিজ সাহেব কতবার যে খোদাতায়ালার দরবারে শুকরিয়া জানালেন তার হিসেব নেই।

কিন্তু যার বিয়ে সে পুরোপুরি নির্বিকার। যেন সে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছে শ্বশুর বাড়িতে। স্বামীর প্রতি তার মায়া নেই, মুগ্ধতা নেই, সংসারের প্রতি কোনো টান নেই, দায় নেই। যেন সংসারটা তার কাছে চড়ুইভাতির মতো খেলা। স্বামী সংসারটা যেন তার নয়। একদিন তো বলেই বসলো,

” আম্মা তোমাদের জামাই আরেকটা বিয়ে করতে চাইলে বলবো করো গে। ওটাকে তুমি কাজের জায়গায় রেখো। এখানে না আনলে হবে। আমি ভালো বউ না হতে পারি কিন্তু ভালো সতীন হবো। ”

মালেকা বেগম কপাল চাপড়াতেই রেগেমেগে বলল,

” এই কথা কি এমনি এমনি বলছি আম্মা? আমার কোনো কাজ তার পছন্দ না তাই বলছি। আমার রান্না পছন্দ না, কাপড় ধোয়া পছন্দ না, হাঁটা পছন্দ না, খাওয়া পছন্দ না, সাজা পছন্দ না, কথা বলা পছন্দ না তাই তো বললাম। একটা পছন্দের বউ থাকুক তার। তখন দেখবে আমার সাথে খ্যাঁকখ্যাঁক করা বন্ধ করে দেবে। ”

মালেকা বেগম ভীষণ ভয়ে ভয়ে ছিলেন। তাদের অগাধ টাকাপয়সা আছে। দিনে দিনে বউ দিয়ে ফেলার ক্ষমতা আছে। যদি ছেলেটাও এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে? কিংবা আরেকটা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়?

আজকাল কত খবর কানে আসে এমন। বউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিচ্ছে এমনকি ছেলেপেলে অব্দি হয়ে যাচ্ছে। সেখানে তিথি নিজেই বিয়ে করতে বলছে। যদি ওর কথা শুনে ওই চিন্তা মাথায় নেয়? অন্যত্র সংসার পাতে তখন কি হবে?

বুদ্ধিশুদ্ধি ওয়ালা, চালাকচতুর সতীনের সাথে জামাই ভাগ করে নেয়া কি চারটে খানে কথা? কিন্তু মেয়েটাকে সেটা কে বোঝাবে? কে বোঝাবে পুরুষ মানুষের সামনে যা তা বলা যায় না। ওদের এত হেয়ালি সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না।

নেহাতই ছেলেটা ওর কোনো কথা পাত্তা দেয় না নইলে কবেই সংসারটা ভেঙে যেত। কবেই তার গায়ে ডিভোর্সির তকমা লেগে যেত।

কিন্তু তারমধ্যেই সুখবরটা কানে এল।

উনি মনেপ্রাণে চাইছিলেন কোলে একটা বাচ্চা-কাচ্চা আসুক। তাহলে সংসারে মন বসবে। জামাইয়ের প্রতি মন ঘামবে কিন্তু হলো কই? এবার চিরতরে বাড়ি চলে এল তাও বাচ্চাটাকে রেখে।

***

পাশের বাড়ির হাসিবের জন্য বউ এনেছে বছর খানেক হয়েছে। সে তিথিকে দেখতে এসেছিলো কয়েকবার। আজও এল দই চিঁড়া নিয়ে। তিথি কিছু খাচ্ছে না শুনে সে এনেছে তিথিকে খাওয়াতে। তিথির জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে তার। হাত কেটেছে, পায়ের আঙুল ফুলে ডবডবে হয়ে আছে,তারউপর মাথার ক্ষত শুকানোর ঔষধ ফুরিয়ে গেছে। ক্ষতটা এখনো সেড়ে উঠেনি। তারউপর চাচী যা ইচ্ছা তাই বলে বকছে। তিথির ঘরে তিথিকে দেখতে না পেয়ে সে পাকঘরে গেল। তিথির আঙুলে কাপড় জড়িয়ে দিতে দিতে মালেকা বেগম চেঁচাচ্ছেন,

” বাচ্চাটার হায় লাগছে তোর উপর। মা হয়ে কেমনে তারে ফেলে আসছোস তুই? কত বড় পাষাণ তুই। দেখ সেজন্য তোর হাত কাটছে, মাথা ফাটছে আর পায়ের আঙুল ফুলছে। বাচ্চাটার হায় লেগে মরবি তুই। ওরকম দুধের শিশু রেখে কোন মা একা একা বাপের বাড়ি চলে আসে?”

তিথি আঙুলে প্যাঁচানো কাপড়টার দিকে একনজরে চেয়ে রইলো। মালেকা বেগম বললেন,

” বাচ্চাটারে দুনিয়াতে না আনার জন্য কতকিছু করলি তুই। তোর মতো বেয়াক্কেলের পেটে অমন সোনার চান ধরছে এটাই বেশি। তুই কোন আক্কেলে তারে ফেলে আইলি? অন্যসময় একা একা লাফাইতে লাফাইতে চলে আসতি তখন কিছু বলিনি এখন কোন সাহসে এলি? ”

তিথি জবাব না দিয়ে পিঁড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কোনো জবাব না পেয়ে মালেকা বেগম আরও ফুঁসে উঠে বললেন,

” কুত্তার পেটে ঘি সইনা। তোর পেটেও অমন সোনার চান ধরছে সেটা তোর সইনায়। বাচ্চাটার জন্য তোর একটুও মায়া হইতেছে? হইতেছে না। কারণ তুই মা নামে কলঙ্ক। ”

তিথি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনি রুনা আটকে ফেললো। বলল,

” এগুলা নাও আপা। তোমার জন্য আনছি। খালি পেটে থাকা ভালো না। ”

তিথি হাত বাড়িয়ে নিল। বলল,

” খিদে লাগলে খাবো ভাবি। ”

রুনা বলল, ” তোমার বরের কাছে আমার মোবাইল থেকে ফোন দেয়া যাবে। আমার নাম্বার চেনেনা তাই ব্লক করবে না। দিবা? ”

তিথি কিছু সময় ভেবে বলল,

” দাও। ”

রুনা তার ফোনটা বাড়িয়ে দিল। তিথি আজলানের নাম্বার তুলে ফোন দিল। যখন রিং পড়ছিলো তখন বুকটা ধড়ফড় করছিলো তিথির। মনে হচ্ছিলো এক্ষুণি ডোডোর গলা শুনতে পাবে। তৃষ্ণার্ত বুকটা আরও তৃষ্ণাতুর হয়ে উঠলো যেন। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় এভাবে সাতবার ফোন দেয়ার পরেও আজলান ফোন তুললো না। তিথি ফোনটা রুনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” রিসিভ করছে না। ”

রুনা বলল, ” এখন কি করবে আপা? ”

তিথি বলল, ” দেখি কি করা যায়। ”

” চিঁড়া দইটুকু খেয়ে নাও আপা। ভালো লাগবে। না খেয়ে থেকো না। ডাক্তারের কাছে যাবে না? ”

তিথি বলল, ” যাব। আগে ডোডোর কোনো খবর পাই কিনা দেখি। ”

তিথি বলল, ” আচ্ছা ফোন দিলে আমাকে ডেকো।”

রুনা মাথা নেড়ে বললো ” আচ্ছা। ”

রুনা চলে যেতেই তিথি তার কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে রাখার সময় ডোডোর দুটো ছোট ছোট শার্ট-প্যান্ট পেল। আরামদায়ক বলে ডোডোকে অনেকবার পড়ানো হয়েছে সেগুলো। আসার সময় তার সাথে নিয়ে আসবে বলে স্যুটকেসে ভরে নিয়েছিলো। কাপড়গুলো হাতে নিতেই জনসন বেবি পাউডারের খুশবুতে তার মনটা যেন ভরে গেল। নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতেই মনে হলো এই তো ডোডোর গায়ের খুশবুটা। নাক চোখ চেপে খুশবুটা শুঁকতে শুঁকতে ঝরঝরে কেঁদে ফেললো তিথি।

_____________

রাত দশটা কি সাড়ে দশটা। তিথির চোখ লেগে এসেছিলো একপাশে কাত হয়ে পড়ায়। ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসতে গিয়ে পিঠে ভারী ব্যাথার অনুভব হলো। তারপরও সে চিৎকারটা অনুসরণ করে ঘর থেকে বের হলো। মালেকা বেগম তেড়ে এসে চুলের ঝুঁটি ধরে ঠেলে দিয়ে বললেন,

” ওই বউটার ঘরেও আগুন লাগায় দিছোস তুই। যাহ দেখ ওরে কেমন করে মারতেছে হাসিব। ”

তিথি দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে নামলো। হাসিব তার বউকে মেরেই চলেছে। তিথিকে দেখামাত্র রুনা ছুটে এসে বলল,

” আপা ওকে একটু বলো ওটা তোমার বর ছিল। আমি কোনো পরপুরুষের সাথে কথা বলছিলাম না। তোমার বর ফোন দিছিলো কিছুক্ষণ আগে। তোমার হাসিব ভাই রিসিভ করে পুরুষ কণ্ঠ শোনায় আমাকে মারতেছে সন্দেহ করে। ”

তিথি হাঁ করে চেয়ে আছে তার দিকে। ঠোঁট আর চোখের কোণায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। হাসিবের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সে। বলল,

” তোমার মাথা কি গেছে? নতুন বউকে সবার সামনে মারতেছো? ”

হাসিব বেরিয়ে এসে বলল,

” জানে মেরে ফেলবো ওকে। ”

তিথি বলল, ” ওটা তোমার দুলাভাই ছিলো। আমি ভাবির ফোন থেকে কল দিছিলাম। না জেনেশুনে ভাবিকে এমন করে মারলে কেন? ”

হাসিবের মা তেড়ে এসে বলল, ” জামাইয়ের ঘর ছেড়ে এসেছিস দু’দিন হয়নি। এখন আমার ছেলের ঘর ভাঙতে নামছোস তুই অলক্ষ্মী কোথাকার! ওর ফোন থেকে তোর বরকে ফোন দিছোস কোন সাহসে? বেশরম মাইয়া। ”

তিথি বলল, ” ফালতু কথা বলবে না চাচী। হাসিব ভাই ভাবিকে এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।”

হাসিবের চোখে অপরাধবোধ দেখা দিলেও সে ক্ষেপাটে চোখে চেয়েই রইলো। রুনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” সত্যিটা এবার মানছো তো? আমার কথা পুরোটা না শুনে আমার গায়ে হাত তুলছো। ”

হাসিবের মা বললো, ” আর কাইন্দো না। ও ভুল বুঝে মারছে। কার মাথা গরম হইবো না বউয়ের ফোনে পরপুরুষ ফোন করলে। ”

তিথি বলল, ” ওকে ডাক্তারের নিয়ে যাও চাচী। ”

রুনা বলল, ” এতরাতে কিসের ডাক্তার? লাগবে না আমার ডাক্তার। ”

কেঁদেকেঁদে ঘরে চলে গেল সে। তিথি হাসিবের উদ্দেশ্যে বলল,

” গায়ে হাত তোলা খুব বাহাদুরি না? একবার ভাবো না কার গায়ে হাত তুলছো। ”

হাসিব চলে গেল গটগট পায়ে হেঁটে। তিথি তার ঘরে চলে এল। মালেকা বেগম বললেন,

“ওদের সংসারেও আগুন লাগিয়ে দিয়েছিস না হতচ্ছাড়ি? যেদিকে যাবি সেদিকেই আগুন লাগাবি তুই। বউটার কাছ থেকে কিছু শিখ। তোরে জামাই কোনোদিন মারেনাই তারপরও তুই ঢংঢং করে চলে এসেছিস এখানে। মারলে তখন কি করতি? ”

মফিজ সাহেব চুপ করে আছেন। অন্য সময় মেয়ের পক্ষে কথা বললেও এবার তিনি মেয়ের সিদ্ধান্তে বেশ ক্ষেপেছেন। অন্তত বাচ্চাটার কথা ভেবে ওর থেকে যাওয়া উচিত ছিল। তিথি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ ঢাকলো। মালেকা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,

” যেভাবে পারিস সেভাবে বাচ্চাটার কাছে যাহ। নইলে নিয়ে আয়। নইলে তোর খাওয়া বন্ধ এই বাড়িতে। অনেক সহ্য করছি তোর নকড়ামি। ”

______

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সবুজে ঘেরা বাংলোটার চারপাশে বড় বড় অশ্বত্থ গাছ, মুচকুন্দ চাঁপা ফুলের গাছ। দূরে একটা কয়েকটা বেলীফুলের গাছও আছে। এই গন্ধটা আজলান ঠিকঠাক সহ্য করতে পারেনা, অপরদিকে বেলীফুল তিথির ভীষণ প্রিয়। বেলীফুলের তেল হোক সাবান কিংবা পারফিউম এককথায় তিথি বেলীর পাগল। বিয়ের পরপর তাকে সবসময় বেলীফুল আনার কথা বলতো কিন্তু আজলান কখনো আনেনি। ওই গন্ধটা এতটা অসহনীয় লাগে তার এককথায় বমি চলে আসে। সে নিতে পারে না গন্ধটা। এখনো হিমেল বাতাসের সাথে বেলীর গন্ধ ভেসে আসছে। কি অসহ্য গন্ধ! ডোডো বাইরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সে যখন ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো তখন ঘুম থেকে উঠে তাকে এমনভাবে জাপ্টে ধরে ফেললো যেন বাবা আজ কোথাও গেলেই সে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। আজলান তাই কাজে যায়নি। বৃষ্টি দেখে যদিও বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে মরে গিয়েছিলো তারউপর ডোডোর এমন কান্না দেখে সে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করেছিলো।

শায়লা ডোডোর জন্য সাবুদানার পোরিজ বানিয়েছে। আজলান চামচে করে ডোডোকে একটু একটু করে খাওয়াচ্ছে আর জানালা দিয়ে পাখি দেখাচ্ছে। বৃষ্টিভেজা একটা কাক বসে আছে নারিকেল গাছের ডালে। সেটি গা ঝাড়ছে দেখে ডোডো হাসছে। আজলান তার গালে মুখ ঘষে আদর করে বলল,

” ওটা কি বাবা? ”

ডোডো তার দুঠোঁট নাচিয়ে বলল,

” আম মাম মা। ”

আজলান দেখলো ছোট কাকটার পাশে একটা বড় কাক এসে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁটে োএকটা আঁশজাতীয় খাবার। বাচ্চাকে সেটি যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। আজলান আরেক চামচ পোরিজ তুলে দিল তার সামনে। ডোডো খাওয়ার সময় নিজের গায়েও ফেললো। আজলানের গায়েও ফেললো। আজলান তাকে খাওয়ানো শেষে চেঞ্জ করে দিল তারপর নিজেও চেঞ্জ করে নিয়ে কোলে তুলে বলল

” চলুন নীচে যাই। ওখানে একটা দাদু আছে। ”

ডোডো উত্তেজিত হয়ে বলল, ” দাদ্দাহ। ”

আজলান বলল, ” হুম। ”

নীচে নামার সময় ডোডো যা খেয়েছে সব বমি করে দিল। আজলানের বুক ভেসে গেল দুধ সাদা সাবুদানায়। ডোডোর দিকে চোখ তুলে চাইতেই ডোডো ঠোঁট টানতে টানতে আচমকা চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। আজলান বলল,

” কিছু বলেছি আমি? বকিনি তো? আইজান!”

ডোডো কাঁদতে লাগলো। শায়লা এসে কোলে নিয়ে নিল। বলল,

” আপনি চেঞ্জ করে নিন স্যার। আমি ওকে রাখছি। ”

ডোডো কাঁদতে কাঁদতে আজলানের দিকে চেয়ে রইলো। তাহেরা বেগম এসে বলল,

” বাবা কি বকেছে বাবুকে? ”

আজলান যেতে যেতে বলল,

” এমনিই কাঁদছে। আমি এক্ষুণি আসছি। ”

শায়লা কত চেষ্টা করলো ডোডোর কান্না থামলো না। সে আরও একবার বমি করলো, পাতলা পায়খানা করলো। একবার নয়। দু-তিনবার। ডোডো নরম হয়ে পড়লো তারপর। আজলান তা দেখে ভয় পেয়ে গেল। শায়লাকে বলল,

” এমন হওয়ার কোনো কারণ দেখছিনা। কি খাইয়েছেন ওকে? ”

শায়লা ভয় পেয়ে গেল। তাহেরা বেগম বললেন,

” আগে ডাক্তার তো ডাকো বাবা। ”

আজলান দ্রুত ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো,

” বাচ্চা কি খায়? ”

আজলান বলল, ” ফর্মুলা, আর আজ পোরিজ খেয়েছে। মাঝেমধ্যে একটুা সেদ্ধ নুডলস আর দুটো ভাত। ভাত খায়নি কাল তাই আমি পোরিজ বানাতে বলেছিলাম। ”

ডাক্তার বলল,

” ফর্মুলা কত বার খাইয়েছেন কাল? ”

শায়লা বলল,

” সন্ধ্যায় একবার বানিয়েছিলাম স্যার। সেটা রাতে খেয়ে ঘুমিয়েছে আর কিছু খায়নি। ”

” মধ্যরাতে? ”

আজলান বলল, ” ফিডারে যা ছিল তা খেয়েছে। ”

ডাক্তার বললেন, ” দু’ঘন্টার বেশি হলে সেগুলো ফেলে দিতে হবে আর আপনারা বাসি ফর্মুলা খাইয়েছেন বাচ্চাটাকে? এখনো দেড়বছর চলছে তাকে ফর্মূলা খাওয়ানোর কি দরকার? বাচ্চার মা কে? আপনি? ”

শায়লা সোজা দাঁড়িয়ে রইলো। আজলান বলে উঠলো,

” নো। সিটার। বাচ্চার মা নেই। ওটা স্কিপ করে বাকি কথা বলুন ডক্টর। ”

ডাক্তার ক্ষণকাল চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন,

” আমি ঔষধ দিচ্ছি। তার পেটে গ্যাসও হয়েছে। বুকে কফ আছে মনে হচ্ছে। ঠান্ডা পানিতে গোসল করাবেন না। পানি গরম করে ঠান্ডা হয়ে এলে সেটা দিয়ে গোসল করাবেন । পানিটা বেশি ঠান্ডা হবে না, আবার গরমও থাকবে না। দু’ঘন্টা পরপর ফিডার পরিষ্কার করবেন । ”

আজলান ডোডোকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” আবার যদি বমি হয়? ”

” আমি ঔষধ দিচ্ছি। যেগুলো লিখে দিচ্ছি ওগুলো নিয়ে আসুন। ”

ঔষধ খাইয়ে দেয়ার পর ডোডো ঘুমিয়ে গেল। এই বাড়িতে প্রচুর মশা। মশার কয়েল জ্বালানো বারণ আজলান তাই একটা মশার ব্যাট কিনে এনেছে সাথে ডোডোর জন্য মশারি। একটা দোলনাও কিনে এনেছে। সেখানে ও বসে বসে খেলতেও পারবে, ঘুমাতেও পারবে। দোলনার সাথেও মশাটি ফিট করা আছে। আজলান তাকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে দোলনার কাছে অনেকক্ষণ বসে রইলো। তাহেরা বেগম এসে বলল,

” ঘুমিয়েছে? ”

” জ্বি। ”

” আসলে বেচারি শায়লা নিজেও বুঝতে পারেনি। ”

শায়লার নাম শোনামাত্রই আজলানের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। শায়লার কাছে গটগট পায়ে হেঁটে গিয়ে বলল,

” আপনি ওটা সন্ধ্যায় বানিয়েছেন আমাকে বলেননি কেন? আমি ভেবেছিলাম রাতে বানিয়েছেন। ”

শায়লা বলল, ” সরি স্যার। আর হবে না এমনটা। ”

আজলান বলল, ” হবে না মাইফুট। আপনার মন কোথায় থাকে? একটা বাচ্চার ভালোমন্দ না বুঝে রোবটের মতো কাজ করে গেলে আপনাকে আর রাখা হবে না। দরকার পড়লে চাকরি ছেড়ে বসে থাকবো আমি। ননসেন্স। ”

শায়লা শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহেরা বেগম এসে বললেন,

” মানুষ মাত্রেই ভুল আজলান। তুমি তোমার বোনকে নিয়ে এসো পারলে। সে তার ভাইপোকে ভালোমতো দেখভাল করবে। ”

আজলান বরাবরের মতো শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল,

” আইজানের জন্য আমি একাই যথেষ্ট। ”

তাহেরা বেগম বললেন,

” না একা যথেষ্ট না। শায়লা তোমাকে সাহায্য করছে। আমিও করছি। তারপরও তোমাকে বেগ পেতে হচ্ছে। বাচ্চা কেউ একা মানুষ করতে পারে না। ”

আজলান চলে গেল। ডোডো ঘুম থেকে উঠে চেঁচিয়ে উঠেছিলো কাউকে না দেখে। আজলান ওয়াশরুমে কাপড়চোপড় গুলো ধুচ্ছিলো। ডোডোর কান্না শুনে সে ছুটে এল। আজ ডোডোকে শায়লার হাতে ছাড়েনি সে। ছুটে এসে ডোডোকে কোলে তুলে নিয়ে আলতো করে গালে আদর করে বলল,

” গুড ইভিনিং বাবা। ”

ডোডো মুখ দিয়ে অসুস্থ রোগীদের মতো শব্দ করলো। আজলান বলল,

” আমরা কাল ঘুরতে যাবো। আপনাকে সুস্থ হতে হবে। ”

ডোডো তার দিকে পিটপিট করে চেয়ে থাকলো। আজলান ভুরু উঁচিয়ে বলল

” কি? ”

ডোডো বলল, ” এমম্যা। ”

আজলান তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাতদুটোর তালুতে চুমু দিয়ে বলল,

” আব্বা ডাকুন ”

ডোডো বলল, ” বেবেহ। ”

আজলান হেসে আরও কয়েকটা আদর দিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,

” ডু ইউ মিস ইয়োর মম আইজান? আই নৌ শী ইজ ইয়োর লাভলি মম, ইউ লাভ হার সো মাচ। বাট শী ইজ মাই ষ্টুপিড ওয়াইফ। আই অলসো নৌ দ্যাট শী লাভস ইউ ঠু, বাট ইটস ট্রুথ শী হেইটস ইয়োর ফাদার।

শী হেইটস মি মোর দ্যান শী লাভস ইউ।

দ্যাটস হোয়াই, হেইটরেড ফাইনালি ঔন আইজান। হেইট ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান লাভ।

ইউ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড আইজান, ঘৃণা আর ভালোবাসায় ঘর হয় না। আমি তোমার মায়ের সাথে ভালো থাকার চেষ্টা করেছি কিন্তু অসফল হয়েছি। আই ফেইলড মিজারেবলি এট দিজ পয়ন্ট। আয়েম এ ফেইলড হাসবেন্ড। বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি এ ফেইলড ফাদার। ”

ডোডো তার গলা জড়িয়ে ধরে নরম গালটা বাবার গালের সাথে লাগিয়ে রেখে বলল, ” আম মাম মা, আব বাব বা। ”

চলমান..

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তিথি কপালের ব্যান্ডেজটা খোলার জন্য ডাক্তারের কাছে এসেছে। সাথে পায়ের বুড়ো আঙুলটাও দেখাবে। বুড়ো আঙুলটার কোণা ফুলে পুঁজ জমে আছে। ব্যাথায় কাল সারারাত ঘুম হয়নি। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে একটা ফার্মেসির সামনে বসেছিলো সে। একটা কলা পাউরুটি কিনে খেতে খেতে ভাবলো, এখানে ফ্যাক্সির দোকান থেকে আজলান শেখকে একবার ফোন দেবে। কিন্তু আয়জা বলেছে সে সিম চেঞ্জ করে ফেলেছে। ফোন দিয়েও লাভ হবে না। রাস্তায় একটা কুকুর তার হাতে পাউরুটি দেখে ছুটে এসেছে ইতোমধ্যে। জিহ্বা লম্বা করে হাঁপাচ্ছে। তিথি তার দিকে বাকি পাউরুটিটা ছুঁড়ে মারলো। তারপর ঔষধগুলো কিনে নিল।

টাকাগুলো ডোডোর আকিকার সময়কার টাকা। টাকাগুলো খরচ করতে গিয়ে তিথির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আজ পাঁচদিন হয়ে গেছে সে ডোডোকে দেখেনি। কেমন আছে সেটা অব্দি জানে না। এমন দুঃসময়ও তার জীবনে আসবে তা সে কখনোই ভাবেনি। এর আগে কবে এমন কষ্টে ভুগেছে সে মনে পড়ে না। সত্যিই মনে পড়ে না। মনে হচ্ছে এর আগের সমস্ত দুঃখগুলো এটার কাছে হালকা, তুচ্ছ। ডোডোটা তার একটা অংশ জুড়ে আছে। কি যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। কি যেন নেই তার কাছে। ভীষণ নিঃসঙ্গ, একা, অসহায় লাগছে নিজেকে। এমন খারাপ সময়ের সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ তার।

ফার্মেসিতে তার পরপর আরও অনেকেই এসেছে।
একটা মহিলা এসে তার পাশে বসলো। বলল,

” আপনি কি এখানকার মানুষ? ”

তিথি মহিলাটিকে আগাগোড়া দেখলো। মহিলাটিকে দেখে মনে হচ্ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৌ। গায়ে দামী বোরকা, মাথায় সোনালী রঙের হিজাব। যেটা বেশি চোখে পড়লো সেটা তার গোলাপি ঠোঁট, আর চোখের পাপড়ি। তিথি সুন্দর কাউকে দেখে প্রশংসা না করে পারে না। মহিলাটির কোলে একটা তিন-চার বছরের শিশু। তিথি জবাব দিল,

” হ্যা। ”

মহিলাটি তার পাশে বসলো। বলল,

” আমি এখানে নতুন এসেছি। বাচ্চার বাবার মামার বাড়ি। কিছুই চিনতে পারছিনা। ”

তিথির চোখ বাচ্চাটার দিকে আটকে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল,

” বয়স কত ওর? ”

” চারে পড়েছে। আপনি কোথায় থাকেন? ”

” জলিল চেয়ারম্যানের বাড়িতে। ”

মহিলাটি অবাককন্ঠে বলল,

” ওহহ তাই! উনি আমার মামা শ্বশুর। ”

তিথি বাচ্চাটাকে আদর করতে মগ্ন হয়ে গেল। বাচ্চাটার হাসিটা সুন্দর। তার কোলে উঠে এসেছে ইতোমধ্যে। গায়ে অসম্ভব সুন্দর একটা ঘ্রাণ। কিন্তু ডোডোর মতো নয়। ডোডোরটা সব সুগন্ধিকে হার মানাবে। কত আদুরে, মায়াময়। ওটা শুঁকলেই যেন মন ভরে যায়। কেমন আছে কে জানে তার বাচ্চাটা। তিথির চোখদুটো সজল হয়ে উঠলো। তন্মধ্যে একটা পুরুষ কন্ঠস্বর শুনতে পেল সে।

” তোমরা এখানে? তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে আমি পাগলপ্রায়। ”

মহিলাটি তার স্বামীর কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে ফিরে তাকালো। তিথি দ্বিগুণ চমকে উঠলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তার চাইতে দ্বিগুণ বিস্ময়ে চেয়ে আছে সেই লোকটি।

” তুমি? ”

মহিলাটি তাদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল,

” আপনারা একে অপরকে চেনেন? ”

লোকটা বলল, ” হ্যা চিনি। চলো তোমাকে গাড়িতে তুলে দেই। ”

মহিলাটি কত রকমের প্রশ্ন করলো। লোকটা মহিলাটিকে নিয়ে চলে গেল বাচ্চাটাকে আদর করতে করতে। তিথি মহিলাটির দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। বয়স বোধহয় তার চাইতে দু এক বছরের বেশি হবে। কত লম্বা! কত সুন্দর! এই অসম্ভব সুন্দর মেয়েটা কি জানে তার স্বামী একজন ভয়ানক রকমের বেঈমান?
তিথির বুকটা ভার হয়ে এল। যতটা ভার হয়ে এলে নিঃশ্বাস ফেলতে অব্দি কষ্ট হয়। চোখ বুঁজে চোখের জল ঝড়াতে ভুলে যায় ঠিক ততখানি। চারপাশটা অন্ধকার ঠেকলো তার চোখে। বেঈমানটা ভালো আছে দিনশেষে কিন্তু সে ভালো নেই কেন?

বহুকষ্টে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো একটা রিকশার জন্য। খুব শীঘ্রই বৃষ্টি নামবে। ওর মনের মতো আকাশেও মেঘ গর্জন করছে। কেমন নীরব আর্তনাদের মতো। বিকট শব্দ নেই অথচ কেমন ভয়ংকর।

রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ খেয়াল করলো পাশে একজন এসে দাঁড়িয়েছে।

” তিথি?কেমন আছো? বাড়িতে কবে এসেছ? ”

তিথি রিকশা থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোনো রিকশা থামাতে পারলো না।
লোকটার দিকে না ফিরে বলল,

” ওটা তোমার বউ? ”

” হ্যা। ”

তিথি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” তোমার বউ খুব সুন্দর। তোমার বাচ্চাটাও খুব আদুরে। তুমি অনেক সুখী তাই না? ”

” আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কি অবস্থা? ”

তিথি কেমন যেন উত্তেজিত বোধ করছিলো তখন। কম্পিত কন্ঠে বলল,

” আমিও সুখী। আমারও একটা বাচ্চা আছে। ”

” বয়স কত? ”

” দেড় বছরে পড়েছে। খুব আদুরে। একদম পুতুলের মতো ছোট। ”

লোকটা চুপ করে রইলো। তিথি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো। কখন যে একটা রিকশা থামবে? লোকটা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

” তোমার বর শুনেছি একজন র‍্যাব।”

তিথি সগর্বে বলল,

” হ্যা। অনেক বড় অফিসার। ডেপুটি কমান্ডার। ”

হায় আল্লাহ, এতকিছু কখন মনে রেখেছে সে? স্বাভাবিক ভাবে কেউ প্রশ্ন করলে বোধহয় বলতেও পারতো না।

” তোমার বরের নাম আজলান শেখ? ”

তিথি চমকে উঠলো। তুমি কিভাবে চেনো জিজ্ঞেস করতে যাবে তখুনি মনে পড়লো প্রশাসনের লোক তাই চিনতেই পারে। ওকে তো টিভিতে দেখায়। তাই বললো,

” হ্যা, আজলান শেখ। তুমি ওকে চেনো তাহলে। অবশ্য চিনবে না কেন? ওকে চেনে না এমন কেউ নেই বাংলাদেশে। ”

” আমি খুশি হয়েছি তুমি সুখে আছো শুনে। ”

তিথির মন কেঁদে উঠলো কিন্তু মুখটা স্বাভাবিক। মন কেঁদে উঠে বলল, ” না না আমি সুখে নেই বেঈমান। আমি একটুও সুখে নেই। কেন সুখে নেই আমি? ”

তিথি বলল, ” তুমি কি ভেবেছ, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে আমার বিয়েশাদি হবে না? ”

” আমি তোমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে যাইনি। ”

” জানি। তোমার বাবা তোমাকে ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে। আমি কালো বেঁটেখাটো মেয়ে। তোমার কোনো দোষ নেই। আমি তোমার কোনো দোষ দিচ্ছি না। কারো কোনো দোষ নেই। সব ভালোই ভালোই হয়েছে। তুমিও ভালো কাউকে পেয়েছ। আমিও। ”

রায়হান বলল, ” হ্যা, তা ঠিক। এখানে একা এসেছ? মনে হচ্ছিলো খুঁড়িয়ে হাঁটছো? ”

তিথি বলল, ” ওই আঙুলে একটু চোট পেয়েছিলাম। ”

রায়হান বলল,

” তুমি আমার উপর রেগে নেই তো? ”

তিথি সাথে সাথে বলল,

” না না। রেগে থাকবো কেন? কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ”

রায়হান বলল,

” কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনো আমার উপর ক্ষেপে আছো। ”

একটা রিকশা এসে থামলো তখুনি। তিথি রিকশায় উঠতে যাবে তখুনি থেমে গিয়ে বলল,

” আমি ক্ষেপে থাকলেও কি যায় আসে? শেষবারের মতো একটা কথা বলে যাই তোমাকে। কাউকে কথা দেয়ার আগে তোমার মা বাবা, তোমার মামা চাচাদের কথা ভেবো। যা করতে পারবে না, তার আশা কাউকে দেখিওনা। তুমি আমার আশা ভঙ্গ করেছ তাতে বেশিদিন কষ্ট ভোগ করতে হয়নি আমাকে। তেমন কিছুই হয়নি।
কিন্তু তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিলে, তাই এখন কাউকে সহজে বিশ্বাস করে উঠতে পারিনা আমি । মিথ্যে মিথ্যে স্বপ্ন দেখানো কত সহজ তাই না? যদি হয় আমার মতো বোকা হাঁদা। তুমি ভালো থেকো। তোমার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই আর। ”

রিকশায় উঠে পড়লো তিথি। তার কিছুক্ষণের মধ্যে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সারারাস্তা ভর সে ভেবে কূল পেল না “কেন সে ভালো নেই? ”

তাকে কেউ একজন ছেড়ে গিয়েছে, সে কালো বেঁটেখাটো তাতে কি? তার তো সব আছে।

ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরতে দেখে মালেকা বেগম বকছেন তিথিকে। তিথি বোরকা খুলে, ভেজা সেলোয়ার-কামিজ নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো আনমনে। মালেকা বেগম বললেন,

” কাপড় পাল্টা বলছি তিথি। জ্বরটর হলে আমি কিচ্ছু করতে পারবো না। একটা কানাকড়ি নেই আমার কাছে। ”

তিথি মায়ের দিকে ফিরে চাইলো। মালেকা বেগম তার হাত থেকে বোরকাটা নেয়ার সময় তিথি উনার হাতটা ধরলো। মালেকা বেগম বললেন,

” পায়ের আঙুলের জন্য ডাক্তার ঔষধ দিছে? ”

তিথি মাথা দুলিয়ে আবদার করে বলল,

” আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো আম্মা। ”

মালেকা বেগম হকচকিয়ে গেলেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই তিথি কেঁদে উঠে বলল,

” শুধু আমি ভালো নেই আম্মা। সবাই ভালো আছে। বেঈমানটা কত সুখে সংসার করছে বউ বাচ্চা নিয়ে। আর আমার কাছে আমার বাচ্চাটা অব্দি নেই। কিচ্ছু নেই আমার। কেউ নেই। ”

_______

ডোডোর কান্না আজ একটুর জন্যও থামেনি। থামছে তো কিছুক্ষণ পরপর আবার কাঁদছে। তাহেরা বেগমসহ নাকানিচুবানি খেয়েছেন তাকে সামলাতে গিয়ে। শায়লার হাতে কোনো কাজ উঠেনি। তাহেরা বেগম না থাকলে দুপুরে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হতো। ঘুমোচ্ছেও না। যতক্ষণ কোলে নিয়ে বাইরে হাঁটছে ততক্ষণ শান্ত। ঘরে প্রবেশ করামাত্রই কান্না শুরু। আজলানের কাছে খবর পৌঁছানো হয়েছে কিন্তু তার কাজের এত চাপ সে বাড়ি ফিরেছে প্রায় রাত সাড়ে ন’টায়। তাদের একটা মিশন চলছে এখন। অস্ত্র পাচারকারীদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। চাইলেও ডোডোর কথা সে ভাবতে পারছে না। বাড়ি ফিরে দেখতে পেল ডোডো কাঁদছে। তাও মেঝেতে বসে। তাকে দেখামাত্রই হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে এল। আজলান কোলে তুলে দুগালে আদর করতেই ডোডো আরও চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলো। শায়লা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল,

” সরি স্যার। আজ সারাদিন এভাবে কেঁদেছে। আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো তারও সুযোগ পাইনি। ”

” আন্টি কোথায়? ”

” রান্না শেষ করে উনি এশার নামাজ পড়ছেন। রান্নাবান্না আজ উনিই করেছেন। বাবু আজ এতটা জ্বালিয়েছে যে আমি রান্নার কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারিনি।”

আজলান বলল,

” তাই বলে মেঝেতে বসিয়ে রাখবেন? মেঝে ঠান্ডা সেটা আপনার মাথায় নেই? ওর ঠান্ডা লেগেছে এমনিতেই। ”

শায়লা চোখ নামিয়ে রেখে বলল,

” সরি স্যার। ”

” সবসময় সরিতে কাজ হয় না। যান আপনি এখন। ”

শায়লা বেরিয়ে গেল চুপচাপ। আজলান ডোডোকে আদর করলো। তারপর কাপড়চোপড় পাল্টে দিয়ে নতুন কাপড় পরালো। তার ছোট্ট গাড়িটাতে বসিয়ে দিয়ে বলল,

” বাবা গোসল করবে। কাঁদবে না ঠিক আছে? ”

ডোডো ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো। আজলান ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে ওয়াশরুমে ঢুকতেই ডোডো চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। আজলান দরজা খোলা রেখে বলল,

” বাবা আছি এখানে। কোথাও যাচ্ছি না আর। ”

ডোডো তার দু-হাতে ছোট্ট ফিডারটা ধরে চুুকচুক করে খেতে খেতে বলল,

” আমমাহ। ”

আজলান তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে গায়ে সাবান লাগালো। কথা বলতে বলতে গোসল সেড়ে নিল। তারপর গোসল সেড়ে ছেলেকে নিয়ে নীচে এসে খেতে বসতেই তাহেরা বেগম বললেন,

” এখন শান্ত হয়ে আছে। সারাদিন কেঁদেছে আজ। একটুও থামেনি। এতটুকুন বাচ্চাকে কি মা ছাড়া সহজে রাখা যায়? সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করেই যাচ্ছে। মা চিনে ফেলেছে ও। ”

আজলান খেতে লাগলো। ডোডোকেও একটু একটু খাওয়ালো। খেতে খেতে ভাবলো ডোডো আজ সবাইকে জ্বালিয়ে মেরেছে তাই ওরাও নিশ্চয়ই একবার হলেও ধমক টমক দিয়েছে।

শায়লা মাছের বাটি নিয়ে টেবিলের উপর রাখতেই শব্দ হলো কিঞ্চিৎ। যদিও বাসনকোসনের শব্দ হওয়া বারণ। সেই শব্দ শুনে ডোডো চোখ তুলতেই শায়লাকে দেখলো। দেখামাত্রই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আজলানকে জাপ্টে ধরে রাখলো। শায়লা ভড়কে গেল। আজ সকাল দশটার দিকে “আমমমা আমমমা ” ডেকে তার বুক খামচাচ্ছিলো বাচ্চাটা। ভীষণ জোরে একটা ধমক দিয়েছিলো সে। সেই থেকে কান্না শুরু করেছে আর থামেনি। ভাগ্যিস তাহেরা বেগম দেখেননি। আজলান ভুরু কুঁচকে একবার শায়লাকে একবার ডোডোকে দেখে নিল। শায়লা হাত বাড়িয়ে বলল,

” চলো আমরা ঘুরে আসি। ”

ডোডো হাত পা নেড়ে কাঁদতে লাগলো। আজলান কোনোমতো খেয়ে উঠে গেল তাকে বুকে জড়িয়ে। বলল,

” মা? মায়ের কাছে যাবে তুমি? ”

ডোডো কান্না একটু থামিয়ে তার মুখে মুখে,

” মা মা মা। ”

আজলান তার ছোট্ট কপালে তার কপাল ঠেকিয়ে বলল,

” কি করব আমি? ”

ডোডো হেঁচকি তুলে বলল,

” আম মাম মা। ”

আজলান ঘরে চলে এল। আয়জাকে ফোন করতে গিয়ে থেমে গেল। ফোন ঘাটতে ঘাটতে একটা রেকর্ড খুঁজে পেল সে। তিথি সেদিন ফোন করে ডোডোকে তার গলা শোনাচ্ছিলো। সে রেকর্ডটা ছেড়ে দিয়ে ডোডোকে বলল,

” তোমার মা এখানে। কথা বলো। ”

তিথি ওর কানের কাছে ফোন রেখে হ্যালো হ্যালো করেছে এর আগে। সে তা বুঝে। হাত পা লাফিয়ে উঠে জোরেশোরে ডেকে বলল,

” আমমম মা। ”

আজলান অবাকচোখে চেয়ে রইলো। রেকর্ডটা কানকাড়া শুনতে লাগলো সে। রেকর্ডে তিথির স্পষ্ট কন্ঠস্বরটা শোনা যাচ্ছে।

” ডোডো, এই ডোডো কথা বল। তোর বাপ শুনছে। আব্বাহ ডাক। এই বোবা ছেলে। হা করে চাইয়া থাকোস ক্যান? কথা বল। কথা বলতে বলছি ডোডো। ”

ডোডো কানকাড়া করে চুপটি করে শুনে আছে। আজলান দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো। ডোডো ফোনটার সাথে কান লাগিয়ে তার উপর শুয়ে থাকলো। মুখে কি একটা যেন অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে গেল। তারপর কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লো।
আজলান তাকে বুকে টেনে নিল। একদম বুকের উপর তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে আম্বিয়া বেগমের ফোনে কল দিল। রিসিভ করামাত্রই আম্বিয়া বেগমের আহাজারি শুরু করে বলল,

” আমার ঘরদোর আন্ধার করে তোরা কই চলে গেলি বাপ? আমি কি এমন দোষ করছি যে এতবড় শাস্তি দিতেছোস তোরা। এতবড় শাস্তি দিস না। আমার নাতিটারে কোথায় রাখছিস তুই? ”

আজলান ক্ষীণ স্বরে বলল, ” ও তোমার কাছে আর ফোন দিয়েছে মা? ”

চলমান…..

রিচেক করিনি