এই ভালো এই খারাপ পর্ব-২৮+২৯

0
87

#এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_২৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

মালেকা বেগমের সাথে মেঝ ফুপুর তর্ক তীব্র হয়ে উঠেছে। মালেকা বেগম আজলানের বড় ফুপুদের সাথে বসে গল্পগুজবে মগ্ন ছিলেন। মফিজ সাহেবও আফতাব সাহেবের সাথে ছিলেন। ঘটনাস্থলে না থাকলেও মেঝ ফুপুর চেঁচামেচি শুনে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেল তাদের। মালেকা বেগম নীরবতা ভেঙে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলেন,

“আপনি আমার মেয়েকে বস্তি ডাকলেন কোন সাহসে? আমার মেয়ে বস্তিতে বড় হলেও অনেক ভালো শিক্ষা পেয়েছে। আপনি তো ভদ্রবাড়িতে বড় হয়ে সেটুকুও পাননি। আসার পর থেকে দেখছি মেয়েটা কাজের জন্য বাচ্চাটাকে পর্যন্ত কোলে নিতে পারছে না, সেখানে আপনার বড় বড় কথা। অনেকক্ষণ ধরে আপনার কথা শুনছি।”

মেঝ ফুপু বললেন, “মেয়েকে বেয়াদব বানিয়েছেন, সেটা স্বীকার করুন। মুরব্বিদের সাথে কি করে কথা বলতে হয় সেটা জানে না।”

মালেকা বেগম তীব্র কণ্ঠে বললেন,
“এখানে মুরব্বি তো আরও আছে। কারো সাথে তো বেয়াদবি করেনি। আপনার সাথে কেন করলো?”

মফিজ সাহেব রাগে কাঁপছেন, তবুও কিছু বললেন না। তিনি মালেকা বেগমকে বললেন, “আহা, থামো। বাদ দাও।”

মেঝ ফুপু বললেন, “আমার তো এখন আপনার জন্য মায়া হচ্ছে ভাইসাব। এই মা-মেয়ের জ্বালায় আপনি অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছেন না? এখন বুঝতে পারছি বীজ কিসের।”

তুষার বাবা আর মাকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। আফতাব শেখ এসে তীব্রভাবে ধমক দিয়ে বললেন, “আছিয়া, তুই চুপ করবি? অশান্তি লাগিয়ে দিয়েছিস গোটা বাড়িতে। কি শুরু করেছিস তোরা?”

বড় ফুপুও প্রতিবাদ করে বললেন, “আছিয়া, তুইও কি বাচ্চা মেয়ে হয়ে গেছিস? নতুন মা হয়েছে, বাচ্চার নামে বাজে কথা সইতে পারেনি। চুপ কর না।”

ছোট ফুপুও বড় ফুপুর মতো শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি বললেন, “আজলান ঘরের দিকে গেছে। কি হবে, কে জানে। তুমি একটু চুপ করবে মেঝোবু?”

আফতাব সাহেব মালেকা বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন, “বেয়াইন, মাথা ঠান্ডা করুন। সবাই রেগে গেলে তো হবে না। হেনা, তোর মাকে নিয়ে যা। আছিয়া, ঘরে যা। আর কোনো কথা নয়।”

মেঝ ফুপু বিড়বিড় করে বললেন, “কোথাথেকে আত্মীয় করেছে আল্লাহ জানে। পুরো ন্যাংটার গোষ্ঠী।”

তুষার ঘাড় ঘুরিয়ে আছিয়া বেগমের দিকে তাকাল। মালেকা বেগম তাকে টেনে নিয়ে গেলেন। তুষার বলল, “আম্মা, আপাকে বাড়ি নিয়ে চলো। এখানে একমুহূর্তও থাকবো না আমি। আপাকেও রাখবো না। এখানে সবকটা আপার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।”

আয়জা বলল, “তুষার, মাথা ঠান্ডা করো। ভাবির সামনে এসব বলো না।”

তুষার উত্তেজিতভাবে বলল।
“আপাকে যা ইচ্ছা তাই বললো ওই মহিলা। দুলাভাইও কিছু বললো না? আপাকে সবাই এভাবে কথা শোনায় নাকি?”

আয়জা শান্তভাবে বলল, “তুমি শান্ত হয়ে বসো ভাইয়া। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মফিজ সাহেব অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বললেন, “গোলামের ফুতটা কিছু বললো না আমার মেয়ের হয়ে। ওকে আমি ছাড়বো না।”

আজলান ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল তিথি ডোডোকে বিছানায় বসিয়ে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। সে হতবাক হয়ে গেল, মাথায় একাধিক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কি করতে চাইছে মেহবুব? বিস্ময়ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

— “কি করছো তুমি?”

তিথি ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। তার চোখে যেন রাগের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। এমন দৃশ্য দেখে আজলানের মনে ভীতির শিহরণ জাগিয়ে তুলেছে। আবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে নাকি? আশ্চর্য!

ঠিক তখনই আয়জা আর আম্বিয়া বেগম ঘরে এসে দাঁড়াল। তাদের চোখে উদ্বেগের ছায়া।
ডোডো বিছানায় বসে নিজের ছোট্ট চোখ দিয়ে মা আর বাবার দিকে তাকাচ্ছে। তার সরল দৃষ্টিতেও অস্থিরতা স্পষ্ট। মায়ের চেঁচামেচি শুনে সে ভড়কে গেছে। সে ছোট্ট করে আম্মা ডাকলো। তিথি শুনলো না।
আজলান এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে বলল,”আমার সাথে কথা বলো তুমি।”

তিথি তার চোখের দিকে তাকালো। বলল,

–“তুমি আমার সাথে একটা কথাও বলবে না। সবসময় আমাকে শাসন করতে চলে আসো। অথচ তোমার বাপের বোনকে কিচ্ছু বলতে পারোনি মুখের উপর?”

আজলান তাকে শান্ত হতে বলে বলল,”বাড়িভর্তি মানুষ। এখন কি করব আমি?”

তিথির চোখে ক্রোধমিশ্রিত জল। সে ব্যাগটা টেনে নিয়ে বলল,”এই বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে তোমার ফুপু আমাকে অপমান করে যা ইচ্ছা তাই।বলেছে। আমাকে সারাদিন বলে গেল আমি কিচ্ছু বলিনি, এখন সাহস পেয়ে আমার ছেলেকে বলছে। আমি একমুহূর্তও এই বাড়িতে থাকব না। দরকার পড়লে ভিক্ষে করে খাব, নইলে চায়ের দোকানে কাজ করে খাব। কিন্তু তোমার সাথে আমি থাকবো না।”

আয়জা এসে বলল,”ভাবি একটু শান্ত হও।”

ঘরটা থমথমে হয়ে উঠেছে। ডোডোর কান্নার করছে। ছোট্ট হাত দুটি বাড়িয়ে আয়জার কোলে উঠতে চাইলো সে।

তাকে সপাটে চড় বসিয়ে তিথি বলল, “চুপ করে বস। দরদ দেখাবি না। এখানে কেউ তোর আপন নয়। তুই খাচ্ছিস এটাতেও অনেকের সমস্যা। তোর মা তো কখনো খাবার দেখেনি। বস্তি থেকে উঠে এসেছে তুই সেই বস্তির ছেলে হয়ে এত ভালোমন্দ খাবি কেন?”

ডোডো তার মায়ের চড় খেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তাকে কাঁদতে দেখে আম্বিয়া বেগমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি চড়া গলায় বললেন,

“তুই তোর জামাইর উপর রাগছিস ভালো কথা। আমার নাতির গায়ে কেন হাত দিচ্ছিস? এটা কি তোর বাপের বাড়ি থেকে এনেছিস?”

ডোডোকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করতে লাগলেন তিনি। আজলান মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, “মা, তোমরা এখন যাও। ঘর খালি করো।”

আজলানের কথা শুনে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তিথির রাগ তখনও মাথার ভেতর আগুনের মতো জ্বলছিল। সে সোজা আজলানের দিকে তাকিয়ে বলল,

“এসব নাটক বন্ধ করো। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তো শুধু আমাকেই বের করতে পারো তুমি। তোমার শক্তি শুধু আমার উপর দেখাও। কারো মুখের উপর দুটো কথা বলার সাহস আছে তোমার? শুধু আমাকে জব্দ করতে শিখেছ। এই ছোটলোক বস্তি তোমার সাথে থাকবে না আর। দুটো ডাল ভাত আমার জুটে যাবে।”

আজলান শান্ত থাকার চেষ্টা করল। সে তিথির হাত ধরে রাখতে রাখলো, তিথি ঝাঁকিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। আজলান ধীরে বলল, “রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নিওনা মেহবুব।”

তিথির ক্ষোভ কমলো না। সে আরও জোরে হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে এতকথা শোনালো, তুমি একটা কথাও বললে না। আমি এই বাড়িতে শুধু ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য পড়ে আছি?”

আজলান কণ্ঠ উঁচু করে বলল, “কি বলব আমি? ফুপুকে বের করে দেব তাও এতগুলো মানুষের সামনে? বিয়েটা চুকে যাক। আমি বলব ফুপুকে।”

তিথি ক্ষিপ্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বলল, “কি বলবে? আমার বউকে আর বস্তি ডেকো না এটা বলবে? নাকি আমার বাচ্চার খাবারে নজর দিওনা বলবে? কোনটা?”

আজলান তিতির উত্তেজনা দেখে শান্তভাবে বলল, “মেহবুব, তুমি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছ ব্যাপারটাকে।”

তিথি চোখ মুছে বলল, “আমি চলে যাব আমার ছেলেকে নিয়ে। যাবই।”

আজলান তার হাত ছেড়ে দিল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তিথি তাড়াতাড়ি কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। আয়জা ঘরের বাইরে উঁকি দিয়ে তা দেখে আম্বিয়া বেগমকে বলল, “আম্মা, ভাবি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে।”

তার কণ্ঠে কান্না স্পষ্ট। ফুপুর ওপর তার রাগ হচ্ছে। আফতাব সাহেব এসে তিথির পাশে দাঁড়ালেন। তিথি আফতাব সাহেবকে দেখে চুপচাপ কাপড় ভরতে লাগলো। আফতাব সাহেব বললেন, “বৌমা, সবকিছু কানে নিতে নেই।”

তিথি তার দিকে ফিরিয়ে বলল, “কানে নিয়েছি? সকাল থেকে অনেককিছু বলে গেল আপনার বোন। কিচ্ছু কানে তুলিনি। তাই বলে একটা বাচ্চার খাবারে নজর দেবে? মানুষ আর কতক্ষণ সহ্য করবে? যাই বলো বাবা, তোমার এই ছেলের সাথে আমি আর থাকবো না। ও মনে করেছে দুটো ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য, ভালো থাকার জন্য আমাকে এখানে পড়ে থাকতে হচ্ছে, ও যা মনে করে, ওর আত্মীয়রাও মনে করে।”

আফতাব সাহেব বললেন, “আমি এক অকালকুষ্মাণ্ড জন্ম দিয়েছি সেটা তুমি আজ নতুন করে জানছো না।”

আজলান বাঁকা চোখে উনার দিকে তাকালো।
তিথি দৃঢ়ভাবে বলল, “না না, আমি থাকবো না।”

আম্বিয়া বেগম হতাশভাবে বললেন, “আজলান, তুই কিছু বলবি না? ও সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে।”

আজলান ফুঁসে উঠে বলল, “ও চলে যেতে চাইলে আমি করব? আমি তো আর ওর মতো হুটহাট সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। নিতে পারলে সব মিটে যেত। ও যা চাইছে তা যখন পারছি না, তখন ওর সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটাই ভালো।”

তিথির এই অবস্থা দেখে আয়জা তাড়াতাড়ি তার ব্যাগটা কেড়ে নিল। ব্যাগটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাবি, তুমি এভাবে যেও না, প্লিজ। তুমি চলে গেলে এতসব কে সামলাবে?”

তিথি অশ্রু সংবরণ করে বলল, “হ্যাঁ, তোমারও তো একই চিন্তা। ভাবি চলে গেলে এতকাজ কে করবে? এত ঝামেলা কে সামলাবে? ভাবির অপমানে তোমার কিছু যায় আসেনা। ছোটলোককে ছোটলোকই তো বলেছে।”

তিথির চোখ থেকে রাগ মিশ্রিত জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো। আফতাব শেখ তিথির এই অবস্থা দেখে মাথায় হাত রেখে বললেন, “আমি ওকে বকে এসেছি। ও আমার মা-বাবার বেয়াদব সন্তান, আমারও একটা আছে এমন একটা। কি করব এদের নিয়ে বলো।”

আজলান কিছু বলতে চাইলো কিন্তু বলল না।

আফতাব শেখ তিথিকে বুঝিয়ে বললেন, “তুমি যদি এখন চলে যাও, তাহলে তোমার জায়গাটা নড়বড়ে দেখাবে সবার সামনে। এটা তোমারই বাড়ি। তুমি যদি শক্ত হাতে এই সংসারের হাল ধরো, এরপর থেকে কেউ তোমাকে ছোটলোক বলার সাহস পাবে না। আমরা মরে গেলে তোমার ফুপু শ্বাশুড়িদের তোমার কাছেই আসতে হবে। ওদের আর ভাই নেই। ভাইপোর বৌও নেই।”

তিথি দৃঢ়ভাবে বলল, “আমাকে আটকে রাখার জন্য এখন এসব বলবেনই। তোমার বোনকে এমনটা বললে সে বলবে এটা তার বাপের বাড়ি। আমাকে বুঝ দিও না।”

আম্বিয়া বেগম এবার ধমকের স্বরে বললেন, “তুই এখনো কিছু বলবি না, আজলান?”

আজলান এবার ক্ষোভের চাপে রেগে গিয়ে বলল, “আশ্চর্য, এখন কি ওর পায়ে ধরতে হবে আমাকে? হাত ধরে অনুরোধ পর্যন্ত করলাম, ও শুনছে আমার কথা। যাক, দিয়ে দাও ডোডোকে।”

মালেকা বেগম ঘরে প্রবেশ করে বললেন, “এই তিথি, বোরকা নে। তোর আব্বা সিএনজি নিয়ে এসেছে।”

আম্বিয়া বেগম অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, “আপনিও মেয়ের পাগলামিতে সায় দিচ্ছেন বেয়াইন?”

মালেকা বেগম পাল্টা বললেন, “কি করব? আপনার ছেলের উপর যথেষ্ট ভরসা রেখেছি। সে তার বউয়ের অপমান চুপচাপ সহ্য করে বসে আছে। মনে হচ্ছে সে বেশ খুশিই হয়েছে। আপনার ননদ আমার সামনে যা যা বলেছে, এসব কি কোনো ভালো মানুষের কথা?”

আজলান এই মুহূর্তে তার মত পাল্টে বলল, “ও কোথাও যাবে না। ও আপনাদের মেয়ে কম, বাড়ির বউ বেশি।”

মালেকা বেগম তীব্র কণ্ঠে বললেন।
“বেশি বলেই তো এতকথা শুনিয়েছে তোমার ফুপু,”

আজলান বলল, “এসব অশান্তি সংসারে হয়েই থাকে।”

মফিজ সাহেব এসে বললেন, “না না, আমরা ওকে রাখবো না। আমরা ওর কথাগুলো এতদিন তেমন বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আজ স্বচক্ষে দেখলাম ওকে কিভাবে অপমান করা হয়। ও থাকবে না আর এই বাড়িতে। আমি আমার মেয়েকে নুনে ভাতে খাওয়াতে পারব।”

আজলান তিথিকে বলল, “মেহবুব, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, ডোডোকে নিয়ে তুমি কোত্থাও যাবে না। যদি যাও…”

তিথি তার পাল্টা প্রশ্ন করল, “যদি যাই?”

আজলান দাঁতে দাঁত পিষে রেগে শুধু চেয়ে রইলো, তার মনের অশান্তি ও বিরক্তি চক্ষু দিয়ে প্রকাশ করতে চাইছে সে। তিথি চোখ সরিয়ে ব্যাগের দিকে হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আজলান হনহনিয়ে এগিয়ে এসে তিথির হাত খপ করে ধরে টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। আম্বিয়া বেগমও দৌড় লাগালেন। আফতাব সাহেব দ্রুত পদক্ষেপে এসে আম্বিয়া বেগমের পথ আটকে বললেন, “ওদের ছেড়ে দাও।”

আজলান তিথিকে রূঢ়ভাবে ধরে ছাদের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। মফিজ সাহেব, মালেকা বেগম এবং অন্যান্যরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

তিথি বিরোধিতা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু আজলানের শক্তিশালী হাত থেকে তার মুক্তি পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আজলানের মুখে ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে। তিথির চোখে অসহায়তা ও ক্ষোভের মিশ্রণ স্পষ্ট। সে চেঁচিয়ে যাচ্ছে তবুও আজলান তাকে ছাড়ছেনা। তিথি হার মেনে নিল একপর্যায়ে।

ছাদে এখন কেউ নেই। স্টেজে কেকটা পড়ে আছে, এবং চেয়ার ও টেবিলগুলো সামানো এলোমেলো হয়ে আছে। তিথিকে এনে আজলান তার হাত থেকে ছেড়ে দিল। তিথি কাঁদছে। আজলান ছাদের দরজা বন্ধ করে তার সিদ্ধান্তের প্রতি দৃঢ়তা দেখিয়ে বলল, “তুমি আমাকে বিয়ে করতে বলেছিলে না তোমার কোন একটা বান্ধবীকে?”

তিথি ভাঙা স্বরে উত্তর দিল। “হ্যা,”

“তার নাম্বারটা এনে দিও।”

তিথি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। “কেন?”

আজলান সংকটের মুখে তাঁর সিদ্ধান্ত জানালো। বলল, “বিয়ে করব। তোমার সাথে আমার হবে না। তাই ঠিক আমি আরেকটা বিয়ে করব।”

তিথি নাক টানলো। আজলান তার বাহু চেপে ধরে বলল, “আমি ফেডআপ মেহবুব। আমি জেদী হলে তুমি গাধী। এরকম গাধীর সাথে আমি এক সেকেন্ডও থাকবো না আর।”

তিথির চোখের অবস্থা ভয়ংকর। তার চোখ ফুলে গেছে। আজলান তার চিরকালীন রাগের সুরে বলল, “যত ইচ্ছা কাঁদো। তোমার সতীন এলে ইচ্ছেমতো হেসো। তোমার বহুদিনের ইচ্ছা।”

তিথি কাঁদতে কাঁদতে গভীর শ্বাস টেনে বলল, “ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে।”

আজলান কপাল চেপে ধরে বলল, “তারপরও দাও। ওর বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসবো।”

আজলানের চাহনি ও কথায় তিথির মনোযোগ বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।

দুজনেই দু-জনের দিকে খেপাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
হঠাৎ করে মনে হলো, দূরত্ব তাদের মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্কের সেই মিষ্টি নিকটতা হারিয়ে দিয়েছে। যেন সময়ের স্রোতে ভেসে গিয়েছে তাদের প্রণয়ের চিরচেনা স্বামী স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা।

দীর্ঘদিন পর একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার পর তাদের চোখে চোখ পড়তেই যেন পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরে এল। এক মুহূর্তের জন্য, সবকিছু থেমে গেল।

আজলান বলল,”তোমার সতীন আমার গায়ের উপর পা তুলে ঘুমালে তোমার ভালো লাগবে?”

“খুব লাগবে।” তিথির কন্ঠস্বর ফাঁপা।

আজলান তার কোমর জড়িয়ে টেনে এনে বলল,”এভাবে টেনে এনে আদর করব। তোমার ভালো লাগবে?”

“খুব মজা লাগবে।”

আজলান হিংস্র হয়ে উঠে বলল,”তোমার কষ্ট হবে না বেয়াদ্দব?”

তিথি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল। “না।”

“কেন?”

তিথি একটু সময় নিয়ে বলল,

“আমি মরার আগে তুমি বিয়ে করতে পারলে তবেই তো।”

আজলান তার মনোরম চোখে অধিকারবোধের চিহ্ন দেখতে পেল। কি শান্তি এই অধিকারবোধের মধ্যে! আজলান শেখ তো এটাই চেয়ে এসেছে বরাবর।

নিজেকে সামলে নিয়ে তিথির গালটা মুছে দিয়ে আজলান বলল, “সব আটাময়দা তো ধুয়ে চলে গেল। সেজে কি লাভ হলো?”

তিথি তীব্র রেগে উঠে তার হাত সরানোর চেষ্টা করতেই, আজলান তাকে নিজের কাছে টেনে ধরে ধমকে উঠে বলল, “মেহবুব!”

তিথি স্তব্ধ হয়ে গেল। আজলানের কঠিন মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তার সাহস হারিয়ে গেল। আজলান ধীরে ধীরে তিথির কাছে এল, তার চোখে তীব্রতা এবং মৃদু তেজের মিশ্রণ। তাদের মাঝে শূন্যতা ক্রমশ সংকীর্ণ হতে লাগল।

এক স্নিগ্ধ মুহূর্তে, দুজনের ঠোঁট একে অপরের ঠোঁটে স্পর্শ করল। আজলান তিথির ঠোঁটে ধীরে ধীরে চুম্বন করল, যেন সেই চুম্বন সমস্ত কথা এবং অনুভূতি বহন করছে যেন। তিথি অবাক হয়ে তার প্রতিক্রিয়া দিল। হঠাৎ করেই, দুজনেই একে অপরের ঠোঁট কামড়ে ধরল, যেন তাদের ক্ষোভ আর রাগের সমস্ত অভ্যন্তরীণ আবেগ বাইরে বের হয়ে আসছে। চুম্বনের এই অস্থিরতা, ঝগড়ার উত্তেজনা আর অম্ল স্বাদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ থেকে তিথি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তুমি একশোটা বিয়ে করো। আমার কোনো আপত্তি নেই। এমন রাক্ষসের মতো কেউ চুমু খায় নাকি?”

আজলান হতভম্ব! তিথি তার বুকে কিল বসিয়ে বলল, “ছাড়ো। চিৎকার করে ক্যামেরাম্যানকে ডাকবো। তোমার ইজ্জতের দফারফা করতে আমার দু সেকেন্ড লাগবে আজলান শেখ।”

আজলান তাকে ছেড়ে দিল নির্লিপ্তভাবে। যেন কিছুই করেনি সে। নিজের ভাবগাম্ভীর্য ধরে রেখে টিস্যু দিয়ে নিজের মুখ মুছতে মুছতে বলল, “তুমি ছাদ থেকে নেমে সোজা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বুঝতে পারবে, কার ইজ্জতের দফারফা হয়ে গেছে।”

চলমান….

#এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_২৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

“বউ কি বললো?” আম্বিয়া বেগম একপ্রকার ছুটে এসে প্রশ্ন ছুঁড়লেন। আজলান সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,” কি বলবে? বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে চলে যাবে, এই বলছে।”

আম্বিয়া বেগম বললেন,”যাক বাবা একটু ঠান্ডা হলেই হলো। তোর ফুপু তো আবার ঢং শুরু করছে চলে যাওয়ার জন্য। তোর বাপ দরজা বন্ধ করে রাখছে।”

আয়জাকে নিয়ে যুবতীরা ছাদে চলে গেল। অনুষ্ঠান যথারীতি শুরু হয়েছে আবারও। তিথি ঘরে শাড়িটাড়ি খুলে ছুঁড়ে মেরেছে সেলোয়ার-কামিজ পড়ে বসে আছে। তাকে কি পেয়েছেটা কি? অমন শক্ত করে ধরে চুমু দিলেই সে সব ভুলে যাবে? বিয়েটা চুকে যাক এই আজলান শেখকে যদি সে কাঁদিয়ে না ছাড়ে তার নাম তিথি নয়।

ডোডো ঘুমিয়ে পড়েছে। তিথি তার দিকে ঝুঁকে গালে চুমু দিল। দোষ করবে বাপে, মাইর খায় ছেলে। ডোডোর গালে ঠোঁট চেপে তিথি বলল,

“ডোডো তোর বাপকে আমি ছাড়বো না। সুদে আসলে শোধ তুলব। তুই দেখিস।”

মালেকা বেগম এসে উঁকি দিয়ে বললেন,”হ্যা রে তোর আব্বা বলছে চলে যাওয়ার জন্য। আমরা যাই তাহলে।”

তিথি লাফ দিয়ে উঠে বলল,”কেন চলে যাবে কেন?”

“তুষার থাকতে চাচ্ছে না।”

“কোথাও যাবে না। গেলে আর আসবে না। আমার মাথা আর খারাপ করো না আম্মা। যাও।”

মালেকা বেগম বললেন,”তোর ফুপুশ্বাশুড়িকে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখতে হয়ছে।”

তিথি বলল,”ওসব কথা বাদ দাও। তোমার শরীর খারাপ লাগলে ডোডোর পাশে শুয়ে থাকো। আব্বা আমার শ্বশুরের ঘরে থাকবে। তুষারের ব্যবস্থা আমি করব।”

মালেকা বেগম সংকোচের সাথে জানতে চাইলেন,”জামাই আসবে না?”

“না না আসবে না। ও এই ঘরে আসবে না আর।”

মালেকা বেগম বিছানা উঠে বসলেন। ডোডোকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে বলল,

“তোর বড় ফুপু, ছোট ফুপুশ্বাশুড়ি ভালো মানুষ। মাঝখান থেকে এটা বেশি কুচুটেগিরি করছে। কেন করছে সেটাও বুঝতে পারছি আমি।”

তিথি বলল,”করুক গে। ওসব কানে তুলিনা আমি। ওর মেয়ে সংসার করতে পারেনি এটা ওর কপালের দোষ। আমার নাকি। তোমার জামাইয়েরও না। ওর মেয়েই তার ভাইপোকে ছেড়ে চলে গেছে। কেউ ওকে তাড়ায়নি।”

মালেকা বেগম বলল,”তারপরও সাবধানে থাকিস।”

তিথি বলল,”সাবধানে না থাকলে ডোডোর আব্বাকে নিয়ে যাবে বলছো?”

মালেকা বেগম বলল,”ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারিস না? ছেলেদের মাথা ঘুরতে বেশি সময় লাগেনা। তোর জামাই যেমন ফুপুভক্ত। কিছু বললো না দেখলিই তো। ছাড় দিবিনা একদম।”

তিথি চুপ করে রইলো। মালেকা বেগমের পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,”তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই আম্মা।”

মালেকা বেগম বললেন,”এখানে যা অবস্থা দেখছি। জামাই তোর হয়ে কথা না বললে তো সমস্যা।”

মা মেয়ের কথার ফাঁকে হঠাৎ নিজস্ব গতিতে হেঁটে ঘরে ঢুকে পড়ে আজলান। মালেকা বেগমকে দেখে কপালের একপাশ চুলকে বলল,

“ওহ আপনি থাকুন। আমি ছাদে যাচ্ছি।”

মালেকা বেগম দ্রুত উঠে পড়লেন। বললেন,

“না না আমি চলে যাচ্ছি। যেওনা। তোমার শরীর খারাপ।”

আজলান তিথির দিকে একটুখানি তাকিয়ে বলল,”না আমি আছি। আপনি থাকুন।”

সে বেরিয়ে গেল। তিথি মৃদু হেসে বলল,”শ্বাশুড়িকে আজ ডরাইছে আম্মা। তুমি ফাটিয়ে দিয়েছ।”

“ফাইজলামি করিস না তিথি। আমি যাচ্ছি। যা ডেকে নিয়ে আয়।”

তিথি বলল “মাথা খারাপ হয়নি আমার। ও ওর বোনের গায়ে হলুদে নেচে আসুক। আমি আর বাচ্চা ঘুমাই। এই ডোডো তুই ভুসভুস করে ঘুমাচ্ছিস কেন বেয়াদব। ওঠ।”

মালেকা বেগম বলল,”আহা ডাকিস না। ঘুমাক।”

তিথি ডোডোর গালে গাল চেপে ধরে বলল,”কত জোরে মারছি আম্মা। বড় হয়ে জানতে পারলে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে।”

মালেকা বেগম বললেন,”ফালতু কথা সবসময় তোর মুখে। সর, আমি যাই।”

মালেকা বেগম চলে গেলেন। তিথি উনার পিছু পিছু ছাদে চলে এল। আয়জার বান্ধবী আর কাজিনরা মিলে নাচানাচি করছে। তিথিকে দেখামাত্র সবাই হৈচৈ করে উঠে বলল,

“তিথি ভাবি চলে এসেছে। ভাবি চলে এসো। আমাদের একটাই ভাবি।”

তিথি বলল,”আমার বাচ্চা ঘুমোচ্ছে।”

ওর কথা না শুনে সবাই তাকে টেনে নিয়ে গেল। লুঙ্গি ডান্স গানে নাচানাচি চলছে। তিথি তাদের মাঝখানে পড়ে ফেঁসে গেল। সবার ফাঁকে সেও নেচে নিয়েছে। এত নাচানাচির ভীড়ে না নেচে থাকা যায় নাকি? ঘাম ছুটে গেল নাচানাচি করতে গিয়ে। টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে আম্বিয়া বেগমের পাশে বসতে যাবে তখুনি দেখলো বুকে হাত ভাঁজ করে আজলান শেখ দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ নাচানাচি দেখছিলো। তিথির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তিথির হঠাৎ করে লজ্জা লাগলো। হুহ, তাকানো দেখে মনে হচ্ছে এই প্রথম বউকে দেখছে। যত্তসব ঢং। আয়জা আর তার বান্ধবীরা কালা চশমা গানে নাচছে। আয়জা তিথিকে কালো চশমা পড়িয়ে দিয়ে টেনে নিয়ে গেল।

তা দেখে আম্বিয়া বেগম আজলানের দিকে কোণাচোখে একপলক তাকালো। এত শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে উনি অবাক হয়েছেন। বউ এমন তিড়িংবিড়িং নেচে চলেছে আর সে কিছু বলছেনা।

আফতাব শেখ হাততালি দিয়ে বললেন,”বৌমা তোমার বরকেও নিয়ে যাও। জীবনে মিষ্টি জিনিসটার সাথে একটু সাক্ষাৎ হওয়া দরকার।”

তিথি বলল,” আরে গরে গরে মুখেরেতে কালা কালা চশমা..

আম্বিয়া বেগম ফিক করে হেসে উঠলেন। পাশ থেকে বড়ফুপু বললেন,”আজলানের চেহারাটা দেখেছ?”

আম্বিয়া বেগম বললেন,”বউকে এখন তেল মারছে। চলে যাবে বলায় ভয় পাইছে ”

“ভয়ও পায় আজকাল।”

“ও যেমন বউ। ভয় পাবে না? কে বলবে এই মেয়ে কিছুক্ষণ কেঁদেকেটে একসা করেছে।”

তিথি নাচানাচিতে এতটা ব্যস্ত হয়ে গেল আজলান কে সেটাই ভুলে গেল। তিথির গলা শুকিয়ে এসেছে। সে পানি খেয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দেখলো আজলানের কোলে ডোডো! গোলগোল করে তাকিয়ে নাচ দেখছে। মাকে দেখে হাত দুটো মাথার উপর তুলে দিয়ে সে উপরে লাফ দিয়ে উঠলো। তিথি এসে বলল,

“ঘুম শেষ?”

ডোডো তার মাথায় তুলে দেয়া সানগ্লাস কেড়ে নিতে হাত বাড়ালো। তিথি তাকে কোলে টেনে নিয়ে দুগালে টাপুসটুপুস চুমু খেয়ে নিয়ে চলে গেল। ডোডো লাফাচ্ছে তার কোলে। আয়জা তাকে দেখে হাসতে লাগলো। গান বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ডোডো চমকে উঠে চারপাশে তাকালো। তিথি বলল,

“শেষ গান শেষ।”

ডোডো গোলগাল চোখে তাকিয়ে থাকলো। আম্বিয়া বেগম এসে বললেন,”হয়েছে এবার ঘরে যা। আজলান ঝিমাচ্ছে।”

তিথি দেখলো ঘুম পাওয়ায় আজলানের চোখদুটো লালচে হয়ে গেছে। বোনের বিয়ে বলেই হয়ত এই প্রথম হাসি তামাশার মাঝে সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কোনোকালেই তার এসব পছন্দ না। তারউপর বউটাও এরকম। এখন নিজের পছন্দের বাইরেও গিয়েও কাজ করতে হয়। দেখা যাচ্ছে তাতেই সব শান্তি।

সাউন্ডবক্সে আবারও নাচগান বেজে উঠেছে। ডোডো আবার লাফ দিয়ে উঠলো। তিথি হেসে উঠে বলল,”পাজি ছেলে কোথাকার। তোর বাপ দেখ এখনি মনে হয় ঝিমিয়ে পড়ে যাবে। বুইড়া ব্যাটা একা ভয় পাচ্ছে ঘরে। চল ঘুম পাড়িয়ে আসি।”

আজলানের সামনে এসে সে বলল,”আমি অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ঘুমাবো।”

আজলান কিছু বলল না। তিথি বলল,”কেউ ঝিমিয়ে পড়ে গেলে আমার দোষ নেই।”

আজলান তীর্যকভাবে বলল,”কালা চশমা পড়ে নাচছিলে কোমর দুলিয়ে। ভালোই তো লাগছিলো। কোনো ভদ্র পরিবারের বউ এভাবে নাচে?”

তিথি বলল,”এটা ভদ্র পরিবার সেটা কে বললো?”

আজলান বলল,”যাও নাচো।”

তিথি বলল,”একশো বার নাচবো। তোমার কি তাতে?”

আজলান চিড়বিড় করে উঠে বলল,

“এসব ভিডিও করছে দেখছো না?”

নিজের রাগ সে সামলাতে পারছেনা শত চেষ্টা স্বত্বেও। বেরিয়েই এল। তিথির হাত খপ করে ধরে বলল,

“চলো। আর কোনো কথা নয়। যথেষ্ট নেচেছ।”

তিথিকে টেনে নিয়ে চলে গেল সে। আম্বিয়া বেগম আফতাব শেখের উদ্দেশ্য বললেন,

“দেখলে তো? তোমাকে বলেছিলাম আমি। ও পছন্দ করে না মানে করে না।”

“ও চুপ করে ছিল বলে মনে করেছি বউকে একটু ছাড় দিয়েছে। কিন্তু খেপে আছে কে জানতো? বউ কাঁদলেও দোষ, নাচলেও দোষ। মেয়েটাকে শান্তি দিল না।”

মফিজ সাহেব এককোণায় বসে ঝিমচ্ছিলেন। তিথিকে টেনে নিয়ে যেতে দেখে চোখদুটো উনার বড়বড় হয়ে গেছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,

“আমার মেয়েটারে হাসিখুশি দেখলেই গোলামের ফুতের জ্বলে। হারামি। ”

আজলান তিথিকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ডোডো উল্টাপাল্টা শব্দ করে ছাদ থেকে কেন তাদের মা ছেলেকে নিয়ে এসেছে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আজলান তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তিথিকে টেনে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে নতুন খয়েরী রঙের নাইট ড্রেস ছুঁড়ে মেরে চলে গেল। তিথি সেলোয়ার-কামিজ পাল্টে গা মুছে ধুয়ে ঢিলেঢালা নাইটিটা পড়ে বেরিয়ে এসে বিড়বিড়িয়ে বলল,

“এসব বেয়াদ্দব পোশাক পড়তে বলে আবার নিজেকে ভদ্রলোক দাবি করে? নূন্যতম হায়া শরম।নেই। মানুষ বৌয়ের জন্য এসব পোশাক কিনে?”

তিথি হাতমুখ মুছে মুখে নাইটক্রিম মাখতে যাচ্ছিলো। আজলান চোখের উপর হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপর দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁটদুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ সপ্তম আসমানে। তিথি মুখ মোচড়ে লাইট নিভিয়ে এল। ডোডো আজলানের ওপাশে শুয়েছে। মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। তিথি শুয়ে পড়লো বেশ সাবধানে। ডোডো আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। ডোডোর বাপও। তিথি বিড়বিড় করে বলল “আমার বাচ্চাটাকে সরিয়ে ফেলেছে।”

সে আজলানের উপর দিয়ে ডোডোর নিজের কাছে নিয়ে আসার জন হাত বাড়ানোমাত্রই আজলান তাকে এমনভাবে ছুঁড়ে মারলো সে পড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠামাত্রই আজলান ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। তিথি বলল,”মরে গেলাম, মরে গেলাম।”

আজলান ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বলল,”কোথায় লেগেছে? উফ মুসিবত। কোথায় লেগেছে বলো।” শেষে ধমকে উঠলো সে। তিথি তার হাত ধরে পিঠের নীচে দিয়ে বলল,

“পিঠে।”

আজলান বলল,”বেশি লেগেছে?”

“খুব।”

আজলান বলল,” দেখাও।”

তিথি লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল,”ধুর দেখাবো কিভাবে? কি এক মরার কাপড় পড়ছি। শুধু উপরে উঠে যাচ্ছে।”

আজলান বিরক্ত হয়ে বলল,”তোমার লাগেনি তাই তো?”

তিথি দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,”না।”

আজলানের মুখ শক্ত হয়ে উঠলো। তিথি মাথা দুলিয়ে বলল,”হ্যা হ্যা।”

আজলান বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে ক্যালেন্ডারের ভাঁজ নিয়ে রোল করতে করতে বলল,

“তুমি নিজে ঘুমাবে নাকি, ঘুমাতে দেবে?”

তিথি একলাফে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে পালঙ্কের পেছনে লুকিয়ে গিয়ে বলল,

“ও আল্লাহ! তুমি আমাকে মারবে নাকি এখন?”

আজলান ক্যালেন্ডারের রোলটা নিয়ে এগিয়ে এল। তিথির দৌড়ে অন্য জায়গায় সরে দাঁড়ালো। বউ বর দৌড় ছুট খেলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আজলান শেষে বিছানায় বসে দু’হাত পেছনে ঠেলে ভার নিয়ন্ত্রণ করে তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার চোখে ঘুম নেই মেহবুব?”

তিথি ধীরপায়ে এগিয়ে এসে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওটা ফেলে দাও। ঘুমিয়ে পড়বো এখন।”

আজলান রোলটা ফেলে দিল, আর ঠিক তখনই তিথি তার কোলে এসে চেপে বসে পড়ল। তার কণ্ঠে মিষ্টি অনুরোধ, “চলো ঘুমিয়ে পড়ি।”

আজলানকে ধাক্কা দিতে গিয়ে, নিজেই হঠাৎ শক্ত দু’হাতের মধ্যে বন্দী হয়ে গেল তিথি। মুহূর্তের মধ্যে আজলান তাকে কাছে টেনে নিল, এবং তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকা জ্বালাময় আবেগ প্রকাশ পেল গলার ভাঁজে পড়া কঠিন, আগ্রাসী চুম্বনগুলোতে। এই চুম্বনগুলো যেন আজলানের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ আর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। আজলানের আগ্রাসী চুম্বন থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়ে তিথি শ্বাস নিতে নিতে বলে উঠল, “ওহ আল্লাহ রে! ডোডো দেখলে দুজনকেই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেবে। কি নির্লজ্জ মা বাপ তার। ছিহ!

চলমান….