#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-১৮
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
– জন্মের পর পর ই মা মারা গেলো।বাবা তিন বছরের জন্য ছিলো।সে স্মৃতি আমার একদমই মনে নেই।তিনি হয়তবা জানতেন তার মৃত্যু যেকোনো সময় হতে পারে।সব সম্পত্তি আমার নামে উইল করে মাদারের কাছে রেখে দিলেন। আমাকে নানা-নানি কিংবা দাদা-দাদির কাছে না রেখে রাখলেন এতিমখানায়। মাদারই বলতে গেলে আমায় বড় করলেন। বাবা ফিল্ড থেকে ফিরলে আমাকে নিয়ে যেতেন। তারপর আবার রেখে যেতেন।তেমনই একদিন বর্ডারের কাছে এক মিশনে গিয়ে শহীদ হলেন।ছোট্ট আমার এসব কিছুই মনে ছিলো না।বড় হয়ে মাদারের কাছে শুনলাম সব। মিসেস রহমানও পরবর্তীতে নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করলেন।নিজেকে পড়াশোনার মাঝে ডুবিয়ে ফেললাম।দিন শেষে যখন ঘুমাতে যেতাম, তখন আমার সব অভিযোগ শুরু হতো।নিজের জীবনের প্রতি নিজেরই অনিহা চলে আসতে লাগলো।এতিম খানার অন্যান্য বাচ্চাদের দেখতাম।এদেরও তো বাবা মা নেই। তবুও কত হাসিখুশি।সবাই যতই হাসিখুশি থাকুক, দিন শেষে একেকজনের বুক থেকে কান্নার দলাটা অশ্রু স্বরূপ বেরিয়ে আসতো।ক্লাস সেভেন থেকে ওরাও আমার সাথে মিশা বন্ধ করে দিলো।কারণ আমি পড়াশোনা করে সবার কাছে প্রশংসা শুনতাম।এতিমখানার মালিকে এসে আমার খবর নিতেন,ওদের ওভাবে নিতো না।আমিও একা হয়ে গেলাম।মাদার আমাকে ভালোবাসলেও এত বাচ্চার মধ্যে আলাদা করে আগলে রাখতে পারতেন না।একা একা বড় হতে লাগলাম।সবাই ভাবতো আমি প্রচুর ভাব নেই। অথচ কেউ বুঝতো না আমি নিজে থেকে মিশতে পারি না।মেডিকেলে ঢোকার পর ফ্রেন্ড বলতে তোকে আর ফাহাদকে পেলাম।কেননা তোরা নিজে থেকে এসে আমাকে এপ্রোচ করতি।
এতটুকু বলে রূপন্তী থামলো।চোখ ভর্তি পানি নিয়ে পিছু ফিরতেই দেখতে পেলো আরাদ্ধা দাঁড়ানো।দরজার কাছে আরহান দাঁড়ানো আর তার পিছে ফাহাদ।
রূপন্তী এবার হু হু করে কেঁদে দিলো। আরাদ্ধা দ্রুত কাছে এসে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরলো।রূপন্তী কান্নার কারণে হোক বা যেটাই হোক, খুব সুন্দর করে নিজের মনের কথা প্রকাশ করলো।হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– আমার কখনো কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। শুধুমাত্র ভালোবাসার অভাব ছিলো।মাথার উপর ছাউনি হিসেবে কেউ ছিলো না।কেউ ছিলো না যে আমাকে ভালোবাসবে। কেউ ছিলো না যে আমাকে আগলে রাখবে। আমি বিয়েটা যত না ম্যামের কথায় করেছি,তার চেয়ে বেশি নিজের ইচ্ছায় করেছি।কতদিন আর একা থাকতাম?!আই নিডেড সামওয়ান!যে আমাকে ভালোবাসবে,আমাকে আগলে রাখবে। আমিও তাক ভালোবাসবো। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে তাকে নিজের জীবনে জড়িয়ে রাখবো। কিন্তু সবার কপাল এক হয় না!সায়নকে ছেড়ে দিলেও আমি অন্য কারো সাথে আর সংসার করতে পারবো না।এই ছেলেটাকে আমি নিজের অজান্তেই আমার জীবনের একাংশ বানিয়ে ফেলেছি।ওর জন্য আমি ম্যাটার না করলেও আমার জন্য ও ম্যাটার করে।অনেক ম্যাটার করে।কিন্তু সম্ভব না রে দোস্ত!
এতটুকু বলা শেষ করে রূপন্তী অঝোরে কাঁদতে লাগলো।আরাদ্ধা আস্তে করে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিলো।
এতক্ষন কান্না করার কারনে, সাথে সারাদিন কাজ করেছে,সব মিলিয় রূপন্তীর চোখ ভারি হয়ে এলো।কিছুক্ষনের মাঝেই তার চোখ লেগে এলো।
আরাদ্ধা যখন দেখলো রূপন্তী নিস্তেজ হয়ে গেছে,তখন আস্তে করে ওকে শুইয়ে দিলো।এরপর আস্তে করে তিনজনই বেরিয়ে এলো।
বাইরে রুমের পাশে সায়ন দাঁড়ানো ছিলো।এতক্ষন সব কথা সেও শুনেছে।
ওদের বের হতে দেখে সে নিজের রুমে চলে গেলো।ওরাও পিছে পিছে ওর সাথে গেলো।
পরিবেশ হুট করে কেমন গুমোট হয়ে গেছে।শীতের রাত, সব নীরব।সায়ন চুপ করে বিছানায় বসে আছে। বাকিরাও চুপ। আরাদ্ধা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উঠে এসে সায়নের সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
– যা বলবো তার একটা কথাও অস্বীকার করবি না।
সায়ন মাথা তুলে তাকাতেই সে প্রশ্ন করলো,
– রূপন্তী যে তোর প্রতি উইক সেটা তুই নিজেও জানতি?
– হুম।
আরাদ্ধা এবার ক্ষেপে গেলো।শ্রাগ করে বলে উঠলো,
– ওকে ভালোবাসিস না ভালো কথা, এভাবে খোঁটা দিবি?স্টুডেন্ট লাইফেও এমন করেছিস। মেয়েটা তোর ওইসব কথায় রীতিনীতি ইন্সিকিউর ফিল করতো।রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাতো।আমি জয়ামাকে বলেও তোকে ঠিক করতে পারি নাই।
একটু থেমে আবার যোগ করলো,
– আমি বুঝলাম না। কয়েকদিন পর সেপারেশনে চলে যাবি, এই কয়টাদিনও তোদের ভেজাল না করলে হয় না? সায়ন তুই জানিস না তুই আজকে কি করেছিস। লাইফে তো কোনো প্রকার স্ট্রাগল করিস নাই। বাপ মা যখন যা লাগতো মুখের সামনে তুলে ধরতো।
সায়ন এবার হালকা গলায় বলে উঠলো,
– আমি আসলে সেভাবে বলতে চাই নাই।কিভাবে যে কি হয়ে গেলো!আর রূপন্তী যে আমার কথায় আগে কষ্ট পেতো সেটা আমি বুঝতাম না।কারন ও আমার প্রতিটা কথায় নিজেকে ডিফেন্ড করতো।আমারও মজা লাগতো ওর সাথে তর্ক করতে।তবে আজ যে আমি ওকে ভয়ানকভাবে আঘাত করেছি, সেটা আমি নিজেও জানি। এবং আমি সেটার জন্য অনুতপ্ত।ওকে আমি নিজের চেহারা আর দেখাতে পারবো না।
– তোর দেখানো লাগবে না।ও নিজেই তোর সামনে আর আসবে না।
আবার সব নীরব। আরাদ্ধা এক ফাঁকে উঠে চলে গেলো। তার অসহ্য লাগছে সব কিছু।আরাদ্ধা চলে যাওয়ার পর এবার আরহান সায়নের পাশে এসে বসলো।ওর কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
– আমাকে একটা কথা বলতো সায়ন। বিয়ের মতো সম্পর্কটা তোর কাছে কতটুকু গুরত্বপূর্ণ?
– বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ক হয় না। সেটা আমিও জানি, তুমিও জানো।
আরহান এবার গাঢ় কণ্ঠে বলল,
– তাহলে তোর একবার মনে হলো না এত সুন্দর একটা সম্পর্ককে সুযোগ দিয়ে দেখতে?চেষ্টা করতে অপর মানুষটাকে ভালোবাসার?তোর তো ভালোবাসার কেউ ছিলোও না যে তুই রূপন্তীকে ভালোবাসতে পারবি না।তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সায়ন একটা কথাও বলল না।
আরহানই আবার বলল,
– কারণটা আমি বলি? কারণটা হলো তুই রূপন্তীকে সেভাবে এক্সেপ্টই করিস নাই। তোর কাছে সবসময় মনে হতো তোদের ম্যাচ হয় না।দুইজন দুই রকম।কোনো চেষ্টা ছাড়াই মনে হতো সেটা। তুই কখনো নিজের বউয়ের দিকে ভালো করে তাকিয়েছিস?তাকালে দেখতি কত মায়াবি আদুরে একটা মেয়েকে নিজের বউ রূপে পেয়ছিস। রূপন্তী ভালোবাসা পায় নাই।একবার যদি ভালোবাসা দিতে পারিস তখন দেখবি মেয়েটা কত আহ্লাদী!একটা কথা আছে না, “ডোন্ট জাজ আ বুক বাই ইটস কভার!”, ওর ব্যাপারটাও একই। আমার কাছে এটা মনে হলো আরাদ্ধার কাছে রূপন্তীর বিভিন্ন কথা শুনে। ওকে রুড মনে হবে,ভাব নেয় মনে হবে, আসলে সেটা নয়।মেয়েটা একা!বড্ড একা! আমি বলব একটু ভালোবাসার চেষ্টা কর।তখনো যদি মনে হয় আসলে সম্ভব না, তাহলে পিছিয়ে আসিস। কিন্ত এখনই চেষ্টা না করে এত তাড়াহুড়ো করিস না।
আরহানও নিজের কথা শেষ করে চলে গেলো।
এবার শুধুমাত্র বন্ধুকে রুমে দেখে সায়ন বলে উঠলো,
-ফাহাদ,দোস্ত তুই ই বল,একটা মানুষকে শুধু তার রূপ দেখে ভালোবাসবো?এটাতো নিজেকে ঠকানোর সাথে মানুষটাকেও ঠকানো।
ফাহাদ তখন বন্ধুর পিঠে হাত রেখে বলল,
– তাহলে চেষ্টা কর মনটাকে ভালোবাসার। যদি একবার পারিস, দেখবি তাকে ছাড়া আর কিছুই বুঝবি না।পরিশিষ্ট আমিও একই কথা বলব,মেয়েটাকে ভালোবাসার মানুষের বড্ড অভাব।আজ নিজেই ওকে স্বীকার করতে দেখলি যে ও তোর প্রতি দূর্বল।সে যদি তোর থেকে ভালোবাসাটা পায়,নিজের সবটা দিয়ে তোকে আকড়ে ধরবে। একটু চেষ্টা করে দেখ না দোস্ত!যদি ভালোবাসতে পারিস!
.
সায়ন ধীর পায়ে রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।বেড সাইডের ল্যাম্পটা জ্বলছে। বিছানার কাছে যেতেই মায়াবী চেহারাটা নজর কাড়লো।সন্ধ্যায় এসে চেঞ্জ করলেও হাত মুখ ধোয়া পড়েনি।যার দরুন কান্নাকাটির ফলে চোখের কাজলে লেপ্টে গেছে। আস্তে করে মুখের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো।এবং প্রথমবারে মতো উপলদ্ধি করলো মেয়েটা প্রচন্ড মায়াবী। তার চেয়ে বেশি আদুরে! সায়ন জানতো রূপন্তী সুন্দরী।সুন্দরীদের চেহারায় একটা কাট কাট ভাব থাকে।কিন্তু রূপন্তীর ক্ষেত্রে সেটা নয়।এই যে আদুরে চেহারাটা দেখে মন চাচ্ছে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিতে।
এই মেয়েটাকে ভয়ানক একটা আঘাত দিয়েছে মনে হতে নিজের বুকেই যন্ত্রনা অনুভব করলো।আজ দুপুরেও করেছে। কিন্তু সেটা রূপন্তীকে দেখে। যখন তাদের ছবি তুলছিলো, তখন সে প্রথমবারের মতো মেয়েটাকে খেয়াল করেছিলো।কি যে সুন্দর লাগছিলো!
সায়ন শুধু আজকে নয়,আরো অনেক দিন থেকে রূপন্তীর প্রতি নিজের অনুভূতির কিছু বদল খেয়াল করেছে। এই যে মেয়েটা ওকে রাতে না দেখে গেলে ঘুম না হওয়া, দুইদিন কথা না হলে খারাপ লাগা, এসব তো অন্যকিছুই বোঝায় তাই না?
দুটো ছেলে মেয়ে একসাথে থাকছে, তাদের মধ্যে হালাল একটা সম্পর্ক আছে। তাহলে তো শারিরীক আকর্ষণ কাজ করবেই।কিন্তু মন থেকে ভালো না বাসলে আজ হোক বা কাল সম্পর্কে তিক্ততা আসতোই।সে সময় নিতে চেয়েছে এবং এখনো সে নিজের অনুভূতি নিয়ে সন্দিহান।অথচ বাকিরা তাকেই দোষী ভাবলো।অবশ্য তার দোষ আছে।
তার এসব ভাবনার মাঝেই রূপন্তী নড়ে উঠলো।সোজা হয়ে শুলো।সায়ন এবার পুরো চেহারা ভালোমতো অবলোকন করলো।গালে শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো।নাকটা এখনো লাল হয়ে আছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মন চাইলো মেয়েটাকে এক্ষুনি উঠিয়ে বুকে চেপে ধরতে।ক্ষমা চাইতে।কিন্তু আপাতত সেটা সম্ভব না। তবে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর কাজটা করে বসলো।সজ্ঞানে মাথা নিচু করে পুষ্পকূট তুল্য অধর দুটোতে নিজের অধর চেপে পরপর দুটো চুমু খেলো। খেয়ে সে নিজেই বেকুব হয়ে গেলো।ঘোরের বশে করে ফেলেছে।রূপন্তী এতদিন তার কপালে চুমু খেতো, অথচ সে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসে আছে। কি আর করার?!তাছাড়া তারই তো বউ!সে চুম্মাবে, থাপড়াবে যা ইচ্ছে করবে,কার কী?
নিজেকে বিভিন্ন বুঝ দিয়ে রূপন্তীর কপালে একটা চুমু খেয়ে উঠে গেলো।লাইট অফ করে দিয়ে সেও অপর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো।এখন মাথার মধ্যে ঘুরছে রূপন্তীর কাছে ক্ষমা কিভাবে চাবে। ভাবনার মাঝেই রূপন্তী আবার নড়ে উঠলো।অভ্যাসবশত বালিশ ভেবে গিয়ে আবারও সায়নকে জড়িয়ে ধরলো।জাগনা থাকলে এই ভুল সে জীবনেও করতো না।গতবার সায়ন যা করলো,রূপন্তীর সেল্ফ রেস্পেক্ট বলেও তো কিছু আছে!আবার সে সজ্ঞানে এটাও জানলো না তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া মানুষটার মনে যে সে একটা শিরশির অনুভূতির সৃষ্টি ঘটিয়েছে!
অপরদিকে রূপন্তীকে আকড়ে ধরা মানুষটাও জানলো না যে “ভালোবাসতে সময় লাগে “, কথাটা ভুল।কেননা সে নিজেই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। যদি টের পেতো, তবে সেই মুহূর্তেই নিজের কথা ফিরিয়ে নিতো।
#চলবে।
#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-১৯
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
রূপন্তীর ঘুম ভাঙলো নয়টার দিকে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলো।এতক্ষন ঘুমিয়েছে সে?!রাতের কথা মনে হতেই তার মনটা খিঁচে আসলো।ইশ!তার যদি বাবা-মা থাকতো তাইলে কেও তাকে অপমান করতে পারতো না।কিন্তু ওই যে!সবার ভাগ্য ভালো হয় না!তেমনই রূপন্তীর কপালে মানুষের ভালোবাসা নেই!
উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়ালো।তারপর আবার একটা খোপা করে ওয়াশরুমে চলে গেল। হাত মুখ দয়ে সবে বের হয়েছে তখনি রুমের দরজা খুলে গেলো।সাথে সাথে সায়নের মাথাটাকে উঁকি দিতে দেখা গেলো।তারপর রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ইতিউতি করতে করতে রূপন্তীর দিকে তাকালো।
রূপন্তী প্রথমে ভ্রু কুঁচকে কাহিনী দেখেলেও এরপর কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখালোনা। সে এক মনে বিছানা ঠিক করলো, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের স্কিন কেয়ারের পালা শেষ করলো।সায়ন তখনো একই ভাবে দাঁড়ানো।
রূপন্তী চেয়েছিলো ছেলেটাকে পুরোপুরি ইগ্নোর করতে। কিন্তু দরজার সামনে যেভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে, এভাবে সে বের হতে পারবে না।তাই সায়নে দিকে না তাকিয়েই থমথমে গলায় বলল,
– সামনে থেকে সর। আমি বের হবো।।
সায়ন এক মিলিমিটারও নড়লো না।রূপন্তী এবার রেগে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সায়নের গভীর চাহনি দেখে সে ভড়কালো। তবে সেটা প্রকাশ না করে সে একই ভাবে বলল,
– সরতে বলেছি না?কানে কম শুনিস?
সায়ন তখন হুট করে একটা কাজ করে বসলো।হাটু গেড়ে রূপন্তীর সামনে বসে পড়লো।কান ধরে ক্ষমার সুরে বলল,
– মাফ করে দে দোস্ত। আমি কালকে ইচ্ছা করে কিছু বলি নাই।তুই তো জানিস ই আমি একটু পাগল আছি।প্লিজ তুই মনে কিছু রাখিস না। সরি!সরি! সরি!
সায়নের এই কান্ডে রূপন্তী থতমত খেলেও পরে কথাগুলো শুনে মুখ ফিরিয়ে নিলো।ধরা গলায় বলল,
– তোর কখনোই আমার কোনো ভালো দিক চোখে পড়েনি।তবে তোর কথা ঠিক। আমার লিমিটে থাকা উচিৎ। আমার মতো অভাগাদের কম কথা বলা উচিৎ।
সায়ন ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে।রূপন্তীর কথাগুলো তার বুকে এসে লেগেছে।সে কিছু বলবে তার আগেই দেখলো সামনে দাঁড়ানো অভিমানীনি চোখের কোটর জলে ভরে উঠেছে। সে কি করবে বুঝতে না পেরে এগিয়ে এসে রূপন্তীকে আলগাভাবে জড়িয়ে ধরলো।এরপর আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
– সরি তো!আর কখনো খারাপ কথা বলবো না। বললে তুই আমার কান কেটে ফেলিস।
সায়নের আস্কারা পেয়ে রূপন্তী এবার কেঁদে দিলো। সায়ন আলগাভাবে জড়িয়ে ধরলেও রূপন্তী ওকে শক্তভাবে জাপ্টে ধরলো।লম্বায় অত ব্যবধান না থাকায় মুখ গুজলো সায়নের কাধ আর গলার মাঝে।ক্রন্দনরত গলায় নিজেও আহ্লাদী কণ্ঠে অভিযোগ জানালো,
– আমার সাথে একটু সুন্দর করে কথা বলা যায় না?সব সময় আমাকে খোটা মেরে কথা বলিস তুই।আমার খুব খারাপ লাগে সায়ন!
সায়ন কি বলবে বুঝতে পারলো না।রূপন্তীর মাথায় আলতোভাবে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
– আর বলবো না।প্রমিস!
রূপন্তী যখন একটু শান্ত হলো তখন সায়ন তখন হুট করে বলল,
– আয়হায়!তুই কি একটু মোটা হয়েছিস?শরীরে মনে হয় মাংস বেড়েছে।
রূপন্তী এক ঝটকায় মাথা তুলে সায়নের দিকে তাকালো।আতঙ্কিত গলায় বলল,
– তাই না!?
সায়নকে ছেড়ে আয়নার সামনে এসে ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখলো।
তারপর “আজ থেকেই ডাইট করবো।যাই মধু পানি খাই” বলতে বলতে সায়নকে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো।পিছে রেখে গেলো হতভম্ব,স্তব্ধ সায়নকে।
‘মেয়েমানুষ এর মন বোঝা দায়’,ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
ছুটির দিন থাকাতে বাকিরাই আস্তে ধীরে উঠলো। সবাই যখন নাস্তা করতে বসলো তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। নাস্তা সায়নই বাহিরে গিয়ে নিয়ে এসেছে। তাই রূপন্তীর আর বানানো লাগেনি।সবাই ঠিক করেছিলো আজ লাঞ্চ বাহিরে কোথাও করবে। কিন্তু রূপন্তী মানা করে দিয়েছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সেটাও বলেনি।
তবে কারণটা নাস্তার টেবিলে বসতেই স্পষ্ট হয়ে গেলো।সবার প্লেটে নানরুটি, চিকেন স্যুপ,ডাল-ভাজি। আর রূপন্তীর প্লেটে গড়াগড়ি খাচ্ছে দুটো সিদ্ধ ডিম এবং গুটি কয়েকে গাজরের টুকরা।সবাই কিছুক্ষন গোল গোল চোখ করে রূপন্তীর দিকে তাকিয়ে রইলো।সায়ন রূপন্তীর বরাবর চেয়ারেই বসা ছিলো।সে এই কাহিনী দেখে মাথা চাপড়ে এরপর রূপন্তীর সামনে হাত জোড় করে মিনতি করে বলল,
– মাফ কর মা!তুই যেমন আছিস ঠিক আছিস। এসব ছাইপাশ খাওয়ার কোনো দরকার নাই তোর।
সায়নের কথা শুনে আরাদ্ধা মেঘস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
– তুই এই বেকুবকে আবার কি বলেছিস?
সায়ন কিছু বলতে যাবে তার আগেই রূপন্তী থামিয়ে দিলো।তারপর আরাদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ও তো আজ খেয়াল করেছে। আমি আরো অনেকদিন থেকেই ঠিক করেছি আবার ডায়েট করবো,জিম করবো।আমার চার কেজি ওজন বেড়ে গিয়েছে।
এরপর নিজের পেটের উপর হাত দিয়ে দুটি চাপড় মেরে বলল,
– দেখ ভুড়িটা কেমন বেড়ে গিয়েছে!
সবাই ওর কথা শুনে একবার নিজেদের পেটের দিকে তাকালো। রূপন্তী যদি মোটা হয় তবে ওরা কী?একটা ছোটাখাটো হাতি?
আরাদ্ধা এবার হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে বলল,
– এসব ন্যাকামি বন্ধ কর ফকিন্নি।তোর ফিগার অনেক সুন্দর!সবচেয়ে বড় কথা এদেশের খাবার দাবার,ওয়েদারের সাথে তুই এসব করে কূল পাবি না।তোর প্রেশার এমনেও লো থাকে।এর মধ্যে সারদিন খাটিস।পরে অজ্ঞান হয়ে যাবি।তুই জিমটা করতে পারিস ফিট থাকার জন্য। কিন্তু খাবার দাবার মেইনটেইন করার দরকার নেই।
রূপন্তী মনে হয় কথাগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো।সে খুবই উচ্ছলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
– ব্রো, আমার অজ্ঞান হওয়ার স্বভাব আছে। অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে মাঝেমধ্যেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতাম।তখন ডাইট করা লাগতো না, আমি খাওয়ার সময় পেতাম বা।এজন্যই মূলত শুকিয়ে গেছি।
ফাহাদ তখন আগ্রহী হয়ে হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– তারপর?অজ্ঞান হয়ে কতক্ষন রাস্তায় পড়ে থাকতি?
রূপন্তী তখন হাসতে হাসতে বলল,
– আরে আমার মার্ক নামে একটা কলিগ ছিলো।আমাকে খুবই পছন্দ করতো।হি ওয়াজ দ্যা ফার্স্ট পারসন যে আমাকে রুম ডেটের বদলে ডিরেক্ট বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছিলো।
সায়ন তখন দাঁত কিড়মিড় করতে ক্রতে জিজ্ঞেস করলো,
– তাহলে করলি না কেন?অন্তত আমার ঘাড়ে এসে তো ঝুলতি না।
– আরে আমার তো প্ল্যান ছিলো দেশে চলে আসবো।মার্ক তো আসবে না।
তারপর একটু উদাস হয়ে বলল,
-এখন মনে হচ্ছে ছেলেটাকে রিজেক্ট করা উচিৎ হয় নাই।
ফাহাদ মিটিমিটি করে হাসতে হাসতে বন্ধুর কাহিনী দেখলো।সায়ন যে হাতের রুটিটা মুঠোতে পুরে ভর্তা করে ফেলেছে তা মনে হয় সে নিজেও জানে।ভর্তা তো কিছুই না, বেচারার শরীরে যে আগুনের হলকা লেগেছে, তা তাপ হিসেবে বের হলে রুটি ভর্তা হতো না, কয়লা হয়ে যেতো।
রূপন্তী এরপর নিজেই আবার বলতে শুরু করলো,
– আমি তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে সারা রাত পড়তাম আর দিনে ডিউটি করতাম।মার্ককে রিজেক্ট করার পরও আমার সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে। ওই আমাকে পিক করতো আবার ড্রপ করতো।আর আমার মূলত শরীর খারাপ হতো সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার সময়।এজন্য মার্ক সবসময় নিজের কাছে আমার জন্য খাবার রাখতো। মাঝেমধ্যেই খাইয়েও দিতো।আর অজ্ঞান হলেও ওই আবার জ্ঞান ফিরাতো। তাই বললাম অভ্যাস আছে।
আরাদ্ধা তখন শক্ত কণ্ঠে বলল,
– এখানে মার্ক নেই যে তোর খেয়াল রাখবে। তাই বলছি এসব ঢং বন্ধ কর।
সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করলো।সায়ন এক ফাকে উঠে গেলো।
দুপুরে সবাই গুলশানেরই একটা হোটেলে গিয়ে লাঞ্চ করলো।এরপর কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে ফাহাদ,আরাদ্ধারা সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে নিলো।আগামীকাল থেকে আবার সবার ব্যস্ত জীবন!
সারাদিন ঘোরাফেরা করে রাতে যখন রূপন্তী শোয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে,তখন সায়ন এলো।টেবিলের উপর গাড়ির চাবি রেখে বলল,
– কাল তো ঢাকার বাহিরে যাবি,গাড়ি নিয়ে যাস। আর কোথায় কোন হসপিটালে বসবি,আমকে এড্রেস পাঠিয়ে দিস।
#চলবে।