এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-২৬+২৭

0
365

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-২৬ (১৬+)
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
বছরের শেষ দিন।কুয়াশায় ছেয়ে থাকা পরিবেশ দেখতে দেখতে রূপন্তী নিজের জীবনের হিসেব মিলালো। দেশে আসার পর হুট করে বিয়ে হওয়া, স্বামী হিসেবে সায়নকে পাওয়া, তার প্রেমে নতুন করে পড়া,রিমির মৃত্যু, রিমির মৃত্যুর জন্য এই নীরব যুদ্ধ, সবই তার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত।
রিমির কথা মনে পড়তেই রূপন্তী ফোন ঘেটে তার রিপোর্টটা বের করলো।মুহুর্তের মাঝেই তার চোখজোড়া ঝাপ্সা হয়ে এলো।গতকাল রিমির পোস্ট মর্টেম যে করেছে তার সাথে কথা হয়েছে।তার ভাষ্যমতে,
– রিমির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্পেসিমেনের সেম্পল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ গণধর্ষন।পরবর্তীতে অনেক নির্যাতন করা হয়েছে।যো*নি পথে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে যার কারনে লেবিয়া মেজরা ভেদ করে মাইনোরাও ছিড়ে গেছে। এজন্যই এত ব্লিডিং হয়েছে।মাথার পিছনে এক খাবলা চুল নেই। খামছে ছিড়ে নেওয়া হয়েছে।বাকি ব্যাপার আপনি রিপোর্ট পড়ে বুঝবেন।সোজা ভাষায় বললে খুবই ব্রুটাল ছিলো এই মার্ডারটা। বাচ্চা মেয়েটাকে অপারেট করার সময় আমি নিজেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।এখন আপনি যদি প্রুফ করতে পারেন রিমির শরীরে রাফি এহমাদের স্পেসিমেন পাওয়া গেছে দ্যান ইয়েস,ইট উইল বি আ স্ট্রং এভিডেন্ট ফর ইউ।আমার জীবনের মায়া থাকলেও আমি কোর্টে সাক্ষী দিবো।বেস্ট অফ লাক ডক্টর।

কানে আজানের ধ্বনি এলো।রূপন্তী চোখ মুছতে লাগলো,এর মাঝেই ঘুমু ঘুমু পুরুষ কণ্ঠ কানে এসে বাড়ি খেলো,
– তোর জামাই মরেছে রূপু?!

একদম কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু বুঝতে দেওয়া যাবে না।না চাইতেও উত্তর দিলো,
-জামাই আছে নাকি যে মরবে?
সায়ন আহত গলায় বলল,
-এভাবে বলতে পারলি?
তারপর আবার স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
– তাহলে মাঝরাতে শীতের মধ্যে কোন প্রেমিকের জন্য চোখের পানি ফেলছিস?
– মার্ক বিয়ে করে ফেলেছে।
সায়ন ভ্রু কুঁচকে বলল,
– তো এখানে তোর কান্নার কারন কী?
রূপন্তী নিরাশ হওয়ার ভান করে বলল,
-ভেবেছিলাম ওকে জামাই বানাবো।
সায়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।তারপর মুখ ঝামটা মেরে “তুই আর তোর মার্ক গলা ধরাধরি করে জাহান্নামে যা!”বলতে বলতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
এত দুশ্চিন্তা, এত অশান্তির মাঝেও সায়নকে জ্বালাতে পেরে রূপন্তীর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
দুজনেই নামাজ পড়ে যখন শুলো তখন ভোর ছয়টা বাজে। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে রূপন্তী ছটফট করছে।এজন্য সায়নও ঘুমাতে পারছেনা।শেষে না পারতে ধমকে বলল,
– এমন মাগুর মাছের মতো লাফালাফি করছিস কেন?
রূপন্তী চোখ পিট পিট করতে করতে মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– মাগুর মাছ কীভাবে লাফায়?
– ঘুম ভাঙিয়ে মশকরা করিস না।থাপ্পড় মারবো একটা।
– আমার ঘুম আসছে না।
– তো মাটিতে নেমে লাফা। আমাকে ঘুমাতে দে।
বলে সায়ন উলটো ফিরে শুয়ে পড়লো। রূপন্তীও আর ভয়ে নড়চড়া করলো না।
মিনিট পনেরো বাদে সায়ন পিছে ফিরে দেখলো রূপন্তী সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে।সে কিছুই বলল না।এদিক ফিরে রূপন্তীকে কাছে টেনে বুকে আগলে জড়িয়ে ধরলো।রূপন্তী হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– এটা কি হলো?
সায়ন জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
– আর কথা বলিস না রূপু। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।ঘুমা!
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সায়ন নিজেই ঘুমিয়ে পড়লো।এতক্ষন এটারই অপেক্ষা করছিলো রূপন্তী।যখন টের পেলো সায়ন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন আরো ঘনিষ্ট হলো পুরুষালি শরীরটার সাথে। দুই হাতে গলা জড়িয়ে নাক ঠেকালো সায়নের গালে।মন,শরীর দুটোই শান্ত হয়ে গেলো।সায়নও ঘুমের মাঝে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো।হাড় কাপানো ঠান্ডায় দুই মানব-মানবী একে অপরেতে উষ্ণতার উৎস খুঁজে পেলো।
.
সকালে রূপন্তীর আগে সায়ন উঠলো।ওর গালে কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে ভালোমতো কম্বল জড়িয়ে বালিশে শুইয়ে দিয়ে সে উঠে গেলো।ফেশ হয়ে হাটতে বেরিয়ে গেলো।

রূপন্তীর ঘুম ভাঙলো সাড়ে নয়টার দিকে।চোখ মেলে প্রথমে সায়নকে খুঁজলো।পেলো না।ছেলেটার বুকে মুখ গুজে পুরো রাতে এই তিন ঘন্টা শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছে।
আস্তে ধীরে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো।আজ সবাই তাড়াতাড়ি চলে গেছে।সীমন্তীও নিজের অফিসে গেছে।বাড়িতে সায়ন, রূপন্তী আর তানিয়া ছাড়া কেও নেই। সীমন্তী অবশ্য দুপুরের পর চলে আসবে।
রূপন্তী পুরো বাড়ি খুঁজতে লাগলো সায়নকে।খোঁজার মাঝেই সায়ন ফেরত চলে আসলো।এই ঠান্ডার মাঝেও ঘেমে নেয়ে একাকার।রূপন্তীকে টেবিলে বসতে বলে নিজে গেলো ফ্রেশ হতে।রূপন্তী তানিয়াকে ডেকে বসতে বললে তানিয়ে জানালো সে খেয়েছে।তাই সে খাবার সার্ভ করতে লাগলে রূপন্তী মানা করলো।ওকে অন্য কাজ করতে বললো।
খানিক বাদে সায়ন নেমে আসলো।চেয়ার টেনে বসতেই রূপন্তী খাবার বেড়ে দিলো।খাওয়ার মাঝেই তানিয়া এসে সায়নকে বলল,
– ভাইয়া,আজকে তো বাড়ি যাবো।বড়মা বলেছে তুমি যাতে দিয়ে আসো।
– আচ্ছা। রেডি হ।এগারোটার দিকে বের হবো।
তানিয়া মাথা নেড়ে চলে যেতেই রূপন্তী সায়নকে জিজ্ঞেস করলো,
– ওর বাড়ি কতদূর?
– গাজীপুরের দিকে।
তারপর একটু থেমে যোগ করলো,
– যাবি নাকি?
– না।
– যেতে আসতে সময় লাগে প্রচুর।এতক্ষন বাসায় একা থাকবি?চল সাথে, ওইদিকে সুন্দর একটা বাংলা রেস্টুরেন্ট আসছে। ওইখানে লাঞ্চ করবো।
রূপন্তী ভাবলো কিছুক্ষন।বাসায় বসে থাকা মানে চিন্তা করা।এর চেয়ে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। তাই রাজি হয়ে গেলো।
এগারোটায় বের হওয়ার কথা থাকলেও ওরা তার আগেই বের হয়ে গেলো।মানুষ মনে হয় সব কক্সবাজার-বান্দরবন ঘুরতে গেছে।রাস্তা ফাঁকা। সাড়ে বারোটার মধ্যে গাজীপুর পৌঁছে গেলো।সায়ন মাঝখান দিয়ে গাড়ি থামিয়ে মিষ্টি আর ফলমূল কিনলো।তারপর তানিয়ার বাড়ির সামনে এসে ওকে জিনিসপাতিগুলো ধরিয়ে দিলো।রূপন্তী ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে দিলো।
তানিয়া অনেক্ষন জোরাজুরি করলো বাড়িতে আসার জন্য। সায়ন শেষমেষ না পারতে ওর দিকে ঝুকে চোখ মেরে ফিসফিস করে বলল,
– আজ একটু তোর ভাবিকে নিয়ে ঘুরি। আমরা অন্য একদিন আসবো।
তানিয়া মুখ চেপে হাসলো। ওদের বিদায় দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো।
এরপর আরো আধ ঘন্টা পর ওরা মাটির ঘর নামক একটা রেস্টুরেন্টে এসে থামলো।রেস্টুরেন্টের বাহিরে বড় খোলা জায়গা। সেখানে বসার জায়গা আছে,দোলনা আছে।ওর বাহিরে ঘুরলো কিছুক্ষন,তারপর খেতে ঢুকলো।
দুজনেই খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলো।বলা বাহুল্য খাবার খুবই মজা ছিলো।
দুজনের বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাগরিব পার হয়ে গেলো।ততক্ষনে জয়া আর সীমন্তী বাড়ি ফিরেছে।
এবার রূপন্তী আর সায়ন ফ্রেশ হয়ে আসার পর সবাই মিলে এবার রাতের আয়োজন করতে লাগলো।রূপন্তী ফ্রাইড রাইস আর ব্রাউনি বানালো। জয়া সবজি বানালো।সায়ন আর সীমন্তী মিলে মুরগিগুলো আর মাছগুলো মেরিনেট করলো।ঠিক আটটার সময় তারিফ সাহেব আসলেন,তার পর পর ই রায়ান আসলো।
সাড়ে নয়টার দিকে সবকিছু নিয়ে সবাই ছাদে উঠে গেলো।সায়ন আর রায়ান মিলে চুলা জ্বালালো।
এরপর একটা একটা করে মুরগি আর মাছগুলো গ্রিল স্ট্যান্ডের উপর রাখতে লাগলো।
ঠিক দশটার দিকে আরাদ্ধারা চলে আসলো।ওরা সাথে এত্তগুলো বাজি,ফানুস নিয়ে এসেছে। এর মাঝে মেয়েরা নিচে নেমে শাড়ি পড়ে সাজগোজ করে আসলো।
ঠিক বারোটার সময় সবাই ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে চিল্লিয়ে উঠলো।একে একে সকলে মিলে ফানুস উড়ালো, বাজি ফাটালো।হুলুস্থুল অবস্থা!
এরপর সবাই ছাদে পাটি বিছিয়ে খেতে বসলো।সেরকম একটা আড্ডা দিয়ে সবাই রাত তিনটার দিকে ঘুমোতে গেলো।
রূপন্তীর ফাহাদ আর আরাদ্ধার সাথে কথা বলে রুমে আসতে একটু দেরি হলো।সায়ন আরো আগে চলে এসেছে।
রূপন্তী এসে দেখলো সায়ন সবে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে।রূপন্তীও জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে ঢুকবে তার আগেই সায়ন থামিয়ে দিলো।তারপর একটা আংটি বের করে রূপন্তীকে পড়িয়ে দিলো।খুবই সাধারণ একটা আংটি। উপরে একটা ডায়মন্ডের ছোট্ট পাথর।কিন্তু এই সাধারণ জিনিসটা তার মন জয় করে নিতে এক সেকেন্ডও নিলো না।ঠোঁটে ফুটে উঠলো চওড়া হাসি।সেটা দেখে সায়নও শান্তি অনুভব করলো।রূপন্তীর আংটি পড়া হাতটা উঠিয়ে সেখানে চুমু খেলো।রূপন্তী মিহি কণ্ঠ ‘আসছি’ বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সায়নও শুয়ে পড়লো।
রূপন্তী বের হয়ে সময় নিয়ে শরীরে বডি বাটার মাখলো।তারপর লাইটা অফ করে সায়নের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়লো। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
– থ্যাংকস ফর দ্যা গিফট দোস্ত।
সায়ন ওর সাথে ঘেষে শুলো।কানে ফিসফিস করে বলল,’শুধু গিফট মনে হলো?’
রূপন্তীর ভেতরটা টলে উঠলো।তবুও স্বাভাবিক থেকে বলল,
– অন্য কিছু তো মনে হওয়ার কথা না।
সায়ন এবার আর কোন রাখঢাক রাখলো না।রূপন্তীর টিশার্ট ভেদ করে ওর পেটে হাত রাখলো।পেছন থেকে জাপ্টে ধরে ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
– অবুঝ হওয়ার ভান করিস না রূপু
রূপন্তীর ততক্ষনে চোখের কোটর ভরে উঠেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষন চুপ রইলো সে।সায়নের স্পর্শ ততক্ষনে তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে।
রূপন্তী একসময় বলে উঠল,”আমার কিছুদিন সময় দরকার সায়ন।”
সায়ন আরো কিছুক্ষন ওর ঘাড়ে মুখ গুজে পড়ে রইলো।তারপর মুখ উঠিয়ে পেছন থেকেই ওর গালে একটা চুমু খেয়ে উলটো পাশ ফিরে শুয়ে পরলো।সেটা কি তীব্র অভিমান থেকে করলো নাকি রূপন্তী বুঝলো না।তবে তার চোখের অশ্রু ততক্ষনে গাল বেয়ে পড়তে শুরু করেছে।
দুজন মানুষের একে অপরের নিকট অনুভুতিগুলো স্বচ্ছ। একবারও মুখ ফুটে বলার দরকার নেই ‘ভালোবাসি’।দুজনেই জানে একে অপরের মনে কতটুকু জায়গা ধারন করেছে।
রূপন্তী মনে মনে একটা কথাই বলে উঠলো,
“আরো আগে কেন কাছে টানলি না সায়ন?সবসময় ভুল সময়গুলিতে কেন আসিস আমার জীবনে?!”
#চলবে।

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-২৭
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
সুন্দর তিনটা দিন কাটিয়ে আজ সায়নরা আবার ঢাকা ফেরত যাচ্ছে।নয় তারিখ কক্সবাজার যাবে। সেজন্য আবার সব মিলিয়ে এক সপ্তাহ ছুটি নিবে। এজন্য এখন আর বেশি দিন নিতে পারেনি।
সেদিন রাতের পর রূপন্তী খুব ভয় পেয়েছিলো সায়ন তার উপর অভিমান করেছে নাকি। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকেই সায়ন স্বাভাবিক।এই কয়দিন ধরে রূপন্তীর সাথে মারামারি,ঝগড়াঝাটি সব ঠিকঠাক মতোই করেছে।তবে রূপন্তীর প্রতি তার খেয়ালের দিকটিতে চোখে পড়ার মতো বদল এসেছে। রূপন্তী না খাওয়া পর্যন্ত নিজে খাবে না,না ঘুমানো পর্যন্ত নিজে ঘুমাবে না।
মূল কথা রূপন্তীর নিজেকে এখন বাচ্চা মনে হয়।যাকে আগলে রেখে তার সবকিছু করে দেওয়া হয়।এমনটাই তো সে চেয়েছিলো!কিন্ত পরিস্থিতি সব সময় কূলে থাকে না।
গত তিন দিন রাফির কোনো রেস্পন্স পায়নি। এটাই রূপন্তীকে বেশি ভাবাচ্ছে। ঠিক যেনো ঝড়ের আগের পূর্বাভাস!

ওরা ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে সকাল এগারোটার দিকে।দুজনেই হসপিটালে গিয়ে ইভেনিং সিফট করবে। এখন প্রায় বারোটা বাজে। সায়ন এক মনে ড্রাইভ করছে। মাঝে টুকটাক কথা বলছে। ঠিক সেই সময় ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।চেক করে দেখলো তাফসির মেসেজ,
“মিট মি আর্জেন্টলি।”
রূপন্তী উত্তর দিলো,
– সম্ভব না আপু। ব্যাস্ত আছি।
তাফসির উত্তর আসলো,
– তাহলে কল দে। তুই কি শুরু করেছিস?একা একা এসব করতে পারবি না।
– আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারবো না আপু।খালি দোয়া করো আমি যাতে বাচ্চাটার সুবিচার পাইয়ে দিতে পারি।
– পাগলামি করিস না।একা একা এসব করতে পারবি না।রাফি এহমাদের নাম আমরা আরো অনেক আগে থেকে শুনেছি।হি ইজ হরিবল।ডোন্ট ইউ ডেয়ার রূপু!
– এখানেই সমস্যা। কারো হেল্প নিতে পারছি না।নিজের জন্য কেনো অন্য মানুষের জীবন নিয়ে খেলবো?!
– সায়ন জানে?
– উহু।আমার কসম আপু,সায়ন,আরাদ্ধা এরা কেউ যাতে না জানে!
– এসব বলিস না রূপ।তুই একা এসব করতে পারবি না।
রূপন্তী আর কোনো উত্তর দিলো না।ইদানীং শরীরটাও দূর্বল লাগে। যদিও এই কয়দিন বাড়িতে হাতির মতো খেয়েছে।তবুও, মানসিক অশান্তি থাকলে কোনো কিছুই ভালো লাগে না।
ওরা বাসায় পৌছালো দুইটার দিকে।গোসল আসার আগেই করে এসেছে। সায়ন এসেই খাবার অর্ডার দিয়ে দিলো।দুজন নিজেদের ফাইলপত্র গুছানোর মাঝেই খাবার চলে এলো।
একসাথে খাওয়াদাওয়া করে দুজন একসাথেই বের হলো।রূপন্তীকে ওর হসপিটালে নামিয়ে সায়ন চলে গেলো।

রাতে দুজনের ফিরতেই দেরি হলো। রূপন্তী আলসেমি করে না খেয়ে শুতে যেতেই সায়ন হুমকি-ধমকি দিয়ে জোর করে খাওয়ালো। যাদের প্রেশারের সমস্যা থাকে তাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে একদম অবহেলা করা উচিৎ নয়।ডাক্তার হয়েও রূপন্তী এত মূর্খ কেন সেটা নিয়ে অনেক্ষন ঝাড়লো সে।

পরের পাঁচ দিন উল্কার গতিতে কেটে গেলো। কক্সবাজারেরে এই ট্যুরে রূপন্তী যেতে চায় নাই।বাকিরা ধরে বেঁধে নিচ্ছে। এই গ্রুপটা মূলত মেডিকেলে তাদের বাংলাদেশি কয়েকজনের গ্রুপ। এর মধ্যে কাপল আছ চার জোড়া যারা একই মেডিকেল থেকে বের হয়েছে। সায়ন-রূপন্তী,মাহা-সাফওয়ান,এই চারজন ব্যাচমেট।বাকি দুজন ছেলেও ব্যাচমেট কিন্তু বউ জুনিয়র ছিলো।যার দরুন সায়নরা তাদেরও চিনে।বাদ বাকি আছে আরাদ্ধা আর আরেকটা মেয়ে যাদের পার্টনার অন্য জায়গার।
কোনো একটা কারণে এদের সবার যোগাযোগ ছিলো।মাঝখান দিয়ে রূপন্তী হারিয়ে গিয়েছিলো।দেশে আসার পর আবার যোগাযোগ হয়েছে।
আরাদ্ধাদের প্রথমে যাওয়ার কথা ছিলো না। এখন সে আর আরহানও যাচ্ছে। ফাহাদ যেতে পারছে না।তার নাকি কি কাজ আছে?
তাদের পরশু সকালে ফ্লাইট। রূপন্তী আর সায়ন ঠিক করলো এতদিন পর যেহেতু বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা হচ্ছে,তাহলে কিছু গিফট দেওয়া উচিৎ।
পরেরদিন তাই তারা মার্কেটে গেলো এবং আবারো দুজন ঝগড়াঝাটি করে বাসায় ফিরলো।রাতে ফেরত এসে হুলুস্থুল করে গোছগাছ শেষ করলো।
ঠিক পরেরদিন সকাল ৮টা বেজে ১৫ মিনিটে তাদের ফ্লাইট।ফাহাদ নিজে না গেলেও ওদের চারজনকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসলো।কারণ এয়ারপোর্টের বাহিরে বাকিদের সাথে দেখা হবে।
মোট ছয় জোড়া কাপল,অলঅর্থাৎ বারোজন যাচ্ছে।মাহা-সাফওয়ান,আরাদ্ধা-আরহান, রাইসা- আহনাফ,রূপন্তী-সায়ন,নোলক-তানভীর এবং স্নিগ্ধা-জায়ান।
আরহান বাদে বাকি সবাই ডাক্তার।ওদের মনে হচ্ছে ঠিক আগের মতো সবাই মিলে মেডিকেল ক্যাম্পিং এ যাচ্ছে।যদিও তখন অনেক মানুষ থাকতো।
কুয়াশা থাকায় প্লেন ছাড়তে দেরি হলো।৮টা১৫ এর প্লেন ছাড়লো ৮টা ৩০ এ।ওরা কক্সবাজার এয়ারপোর্টে পৌঁছালো ঠিক ৯টা ১৫ এ।নেমে রানওয়েতেই এক পালা ফটোশুট হয়ে গেছে।
আরহানের সাথে বাকি সবার খুব ভালো ভাব হয়ে গেছে।
বুকিং দেওয়া ছিলো সায়মন বিচ হোটেলে। হোটেলের সামনে সমুদ্র দেখেই এখানে বুকিং দেওয়া।তিনটা সি ভিউ রুম।একটা মাউন্টেন ভিউ। আর একটা স্যুট। সেটা অবশ্য সি ভিউ। বুকিং এর কাজটা সায়ন নিজে করেছে। স্যুটটা আরাদ্ধাদের সাথে নিয়েছে। বাকি চারটা রুম চার কাপলের মাঝে লটারি হলো।মাহা-সাফওয়া হিল ভিউ রুম পেলো।ঠিক করা হলো যেহেতু দুই রাত থাকা হবে।পরের রাতে তাদের সি ভউ রুম দেওয়া হবে।অন্য কোনো কাপল ওদের রুমে চলে যাবে।
চেকইন দুইটার সময়।তাই কেউই রুমে ঢুকতে পারলো না।লাগেজ হোটেলের দায়িত্বে দিয়ে তারা বের হয়ে গেলো ঘোরাঘুরি উদ্দ্যেশ্যে। প্রথমে নাস্তা করলো।এরপর ঠিক করলো ইনানী বিচে যাবে।চাঁদের গাড়ি ভাড়া নিয়ে এই ছয় জোড়া মানব-মানবী রওয়ানা দিলো সুন্দর কিছু মুহুর্ত উপভোগ করার উদ্দ্যেশে। ইনানী পৌঁছালো একটার দিকে। সবার ব্যাকপ্যাকেই এক্সট্রা এক সেট কাপড় আছে তাই সমুদ্রে নামতে কেউই দ্বিধাবোধ করলো না।প্রায় দেড় ঘন্টার মতো লাফালাফি করে একে একে চেঞ্জিং রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে আসলো।
এরপর সকলে মিলে লাঞ্চ করতে পাশেই নতুন একটা রেস্টুরেন্টে বসলো।খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে বিকাল চারটা বেজে গেলো।
বের হয়ে ঠিক করলো এখন হোটেলে ফিরবে। একটু রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যার দিকে পুলে নামবে। তারপর হাটতে বের হবে এবং একেবারে ডিনার করে রুমে ফিরবে৷
হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৫টা বেজে গেলো।রুমে গিয়ে সবার আগে সবাই গোসল করলো।তারপর মাগরিব পড়ে আর এক সেকেন্ডও ব্যায় না করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।শীতকাল হওয়ায় সন্ধ্যা এখন তাড়াতাড়ি হয়।ঠিক সাড়ে ছয়টায় পুলে নামবে সবাই ঠিক হয়েছিলো। কিন্তু সবাই এত ক্লান্ত যে কেউই আজ পুলে নামতে চাচ্ছে না। তাই একটু রেস্ট নিয়ে সাড়ে সাতটার দিকে সবাই আবার বের হলো।পাশের একটা দোকান থেকে শিঙারা আর চা খেলো।তারপর হাটতে লাগলো লাবনী বিচের দিকে।
সাড়ে দশটার দিকে ঘোরাঘুরি শেষে ডিনার করে হোটেলে ফিরলো সবাই।লবিতে দাঁড়িয়ে আগামীকালের প্ল্যান করা হলো।আগামীকাল সকাল নয়টার দিকে সবাই নাস্তা করতে নামবে।আগামী দুই দিনের নাস্তা কম্পলিমেন্টারি তাই বাহিরে যাওয়া লাগবে না।এরপর সবাই মিলে সুগন্ধা বিচে গোসল করতে যাবে।এরপর ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে দুপুরেবমহেশখালী তে স্বর্ণমন্দির দেখতে যাবে।
সব ঠিকঠাক করে যে যার রুমে চলে গেলো।কিন্তু রূপন্তীরা রুমে এসে আড্ডায় বসলো। বারান্দায় ফ্লোরে গোল হয়ে বসেছে চারজন। গল্পের অভাব নেই।এক ফাঁকে আরহান রূপন্তীকে জিজ্ঞেস করলো,
– তোর কি কিছু হয়েছে রূপন্তী?আজ সারাদিন চুপচাপ ছিলি।
রূপন্তী কিছু বলার আগেই সায়ন বলল,
– গত দশ পনেরো দিন ধরেই এমন মনমরা হয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না।

রূপন্তী বাঁধা দিয়ে বলল,
– না ভাইয়া। আজক অনেক ক্লান্ত লাগছিলো তো। তাই অত কথা বলি নাই।

ওরা আধ ঘন্টার মতো আড্ডা দিলো।তারপর এশা পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সবাই ঘুমে কুপোকাত।
.
পরেরদিন সকালে এলার্মের শব্দে রূপন্তী নড়তে চাইলেও পারলো না।চোখ খুলে আবিষ্কার করলো সায়ন গলায় মুখে গুজে একদম কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।রূপন্তী আরো কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে রাখলো।ঠিক তখন দরজায় আরাদ্ধা নক দিয়ে বলল,
– দোস্ত, নাস্তার জন্য ডাকছে সবাই।
– তোরা শুরু কর।আমরা আসছি।
সায়নকে ঠেলেঠুলে উঠে বসলো।তারপর একটা ধাক্কা মেরে বলল,
– আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আমি বের হওয়ার পরপরই তুই ঢুকবি।
জামাকাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে।মিনিট পনেরো বাদে বের হয়ে দেখলো সায়ন রূপন্তীর ফোনটা হাতে নিয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে।রূপন্তী গিয়ে একটা চাপড় মারতেই হাই তুলতে তুলতে বলল,
– কে জানি তোকে কল দিতে দিতে ইন্তেকাল করেছে।
– বাজে বকিস না। যা ফ্রেশ হও।
সায়ন হেলে-ধুলে ওয়াশরুমে গেলো।রূপন্তী ফোন হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।একটা আননোন নাম্বার থেকে পাঁচ বার কল এসেছে। রূপন্তী কল ব্যাক করতেই মোটা পুরুষালী কণ্ঠ শ্রবণ হলো,
– কি অবস্থা সুইটহার্ট?!
– কে?
– চিনলা না? আমি রাফি।
– কী দরকার?
– ওহহো!খবর পাও নি?
রূপন্তী কলিজে ছ্যাৎ করে উঠলো। বাবা মার কারো কিছু হয়নি তো?গতকাল থেকে কথা হয়নি।তবুও নিজেকে ধাতস্ত করে বলল,
– কিসের খবর?
-সেটা তুমি নিজেই পাবে ডার্লিং।যেটাই হোক, আমি দেশে ফিরেছি তিন দিন আগে। লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম।আমার পিছে পড়া বন্ধ করো। আদারওয়াইজ বি রেডি!
#চলবে।