#এক_আকাশ_রুদ্ধশ্বাস
#পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“খবর পেলে শুধু কবর দিবি৷ আর কিছু না।”
খাঁন বংশের সম্মানিত মাতবর খাঁন নিয়াজী। গ্রামের অন্যতম জমিদার ও মোড়ল। মুরুব্বিদের যেকোনো সভায় তার নাম ডাক থাকে আগে। নানান নালিশে, সালিশে সারাজীবন অন্যের বিচার করে গেলো সে। গ্রামের কত ছেলেমেয়ে এমন পালিয়ে গেলো রাত বিরেতে, তাকে ডেকে বিচার বসালো পরিবারগুলো। কখনো অপমান, কখনো সম্মান সহিত কত বিয়ে টিকিয়ে দিলো; আর যা টিকানোর মতো নয়, তাতে বিচ্ছেদ করানোর মাধ্যমে আপোষ করে গেলো এতো এতো বছর ধরে। উপযুক্ত বিচারে নিজের সম্মানও বাড়িয়ে নিয়েছে ক্রমে ক্রমে। আজ কি না দীর্ঘকালের সঞ্চিত সম্মান মুছে নিজেকে দাঁড় করাবে বিচারের কাঠগড়ায়? অসম্ভব! কোনো বিচার ডাকা হবে না৷ শুধু খালাস চলবে। তিলে তিলে গড়া সম্মান ধূলিসাৎ হতে দেওয়া এতো সহজ নয়। কন্যা বিসর্জন দিবে। বংশের উপর কলঙ্ক লাগিয়েছে তারই কন্যা। বিগত দুই যুগের রেকর্ডে আর এমন দাগ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। গ্রামে বেশ কয়েক বংশের উপস্থিতি আছে। এপর্যন্ত সুনামে সবচেয়ে উঁচুতে ছিল তাদের খাঁন বংশ। প্রতিপত্তি, মর্যাদাপূর্ণ একটা স্তম্ভ আছে তাদের। স্তম্ভে কালছাপ দিয়ে যে কন্যা পিতার নামে কলঙ্কের দাগ ফেলে, সে কন্যার পরিচয়ে পরিচিত হবেন না তিনি। নাম ধুবে না, দাগ মুছে দিবে চিরতরে।
এতোটাই ক্রোধানল দাউদাউ করছে নিয়াজীর দেহ মস্তিষ্ক জুড়ে। সারারাত স্বস্তি পায়নি একটা মুহুর্তের জন্য। এতো কষ্টে সন্তান লালন পালন করা; স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া; স্বপ্ন গড়া; সবকিছু আজ উচ্চস্বরে স্লোগান তুলে, “বৃথা, বৃথা, বৃথা!” জীবনের পরিশ্রম, প্রচেষ্টা থাকে শেষে সফলতা লাভের জন্য। তার এতো প্রচেষ্টার শেষ কেন তবে ব্যর্থতার গান গাইবে? এই নির্মমতা মেনে নেওয়ার নয়। কী ছিলো না তার? কীসের দহনে পুড়বে তবে? বোনদের মধ্যে বড়জনের একমাত্র ছেলেটারও ছিলো বিঘা চারেক জমি। সুদর্শন আর কর্মদক্ষতায় তার ছোট পুত্র থেকেও এগিয়ে। তারউপর কন্যা তাঁর দুইটা বোনেরই চোখের মণি। তাই চেয়েছিলো বোনের বাড়িতেই পাঠাবে। নিজ গণ্ডিতে রেখে দিবে। বৃক্ষচ্ছায়ার সুখ চোখে ধরলো না মেয়ের। তাকে পছন্দ না-ই বা করলি, প্রাচুর্যের নগরীতে একটা ভালো ঘর কী জুটানো যেতো না তবুও? মানুষ স্বপ্ন গড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে৷ তার কন্যা তাকিয়েছে মাটির নীড়ে। দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি করে গেছে ঘরে। এই ক্ষতে ওষুধ না দিলে চলবে না।
গায়ে ওড়না জড়িয়ে মাথাসহ ঢেকে নিয়েছে নওরিন। পিচ ঢালাই রাস্তা ছুঁয়ে গাড়িতে উঠে গেছে বাস স্ট্যান্ডের ঠিকানায়। তারপর বাসে চড়ে নাটোর রেলওয়ে স্টেশন ছুঁবে। শাবাব তার খালার বাড়ি যাওয়ার চিন্তায় আছে আপাতত। রানী নগরের ট্রেন ধরবে। যদিও খালার বাড়ি থাকার তেমন সুব্যবস্থা নেই, কিন্তু পৌঁছাতে পারলে ওদিকেই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে খালা। এখান থেকে তো যেতে হবে আপাতত। তার আগে ডাক্তার দেখাতে হবে৷ এতো বড়ো ক্ষত বড়ো রকমের দুশ্চিন্তা হয়ে চেপে আছে নওরিনের মাথায়। ধরা পড়ার সংশয়ে প্রতি গজের পথ অতিক্রম করতে করতেও কেবল মনে হচ্ছিলো, এখনো রক্ত ঝরছে; এখনো ব্যথা বেড়েই চলেছে। যতটা বাড়লে শাবাব চুপ করে বসে থাকতে পারে, নড়াচড়ায় অনিহা প্রকাশ করতে পারে।
ধুলোমাখা শুষ্ক মহাসড়ক। পথে মিশে আছে ধূলির ধূলিধ্বজ। বৃষ্টির আগমন নেই আজ দিন কতক! ব্যস্ত সকালে অবিরত যান চলাচল করেছে। দুপুর হতে চললো বলে। সূর্যের কিরণ ভালোই তাপ দিয়ে চলেছে। একেকটা গাড়ি ছুঁটে আর ধূলিধ্বজের উদ্ভব ঘটে। নিশ্বাসে নিশ্বাসে দূষিত বায়ু চাপে। ওড়নায় নাক চেপে ধরে নওরিন শাবাবের পাশাপাশি চলে। বাসে উঠতে রাস্তা পারাপার হতে হবে। শাবাব এতোক্ষণ পাশাপাশি হাঁটলেও রাস্তা পার হতে নওরিনের হাতটা ধরে নিয়েছে। নিজের বেহাল দশার দিকে কেন একটু নজর দিতে পারছে না লোকটা, তা ভাবতেই দুঃখ হলো নওরিনের৷ ওপাশে ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য টানলো, গেলো না। বাস ধরার তাড়া তার। মুখ মলিন রেখে নওরিন রাস্তা পার হলো। এপাশে এসে আবার ডিসপেনসারি নজরে পড়তেই সে চলাচলা থামিয়ে দিলো। শাবাবের হাত টান পড়ায় পিছু ফিরে তাকায়।
“কী হলো?”
“আপনি আগে চিকিৎসা করাবেন কি না?”
“ব্যস্ত সময়ে জেদ করো না তো বারেবারে।”
“এর চেয়ে বেশি জরুরী এখন আর কিছু দেখছি না। আপনি আমাকে ঠিকমতো দেখতে পর্যন্ত দেননি, কতটা ক্ষত হলো!”
“চলো৷ গাড়িতে উঠে দেখাবো।”
“আমি গাড়িতে উঠবো না। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো। কোনোদিকে যাবো না।”
শাবাব হাত ছেড়ে দিয়ে হতাশার নিশ্বাস ফেলে। রাস্তার দিকে হালকা চোখ ঘুরিয়ে আনে পূর্বাবস্থায়। তা দেখে নওরিন বলে,
“বিরক্ত হলেন যেন?”
“তুমি বিরক্ত করে গেলে, আমি বিরক্ত হবো না?”
“না, হবেন না।”
“ঠিক আছে, দেখো। লোকেও দেখুক আর জানতে আসুক, কী হয়েছে; কীভাবে হয়েছে।”
কিঞ্চিৎ চাপা বিরক্তির সাথে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে শাবাব। নওরিন তার হাত ধরে বাধা দিয়ে বলে,
“ওই ডিসপেনসারিতে দেখবো।”
শাবাব ভালোই বুঝতে পারছে, ডাক্তার না দেখিয়ে ছাড়বে না নওরিন। অথচ শাবাব চাইছে না এখন ডাক্তারের কাছে যেতে। অযুহাত তোলে,
“স্টেশনের ওদিকে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নিবো, চলো।”
“আগে ডাক্তার, তারপর স্টেশন।”
“ক্ষুধা লাগেনি?”
“না।”
“কিন্তু, আমার লেগেছে।”
বাধ্য হয়ে শাবাব তার হাত ধরে ডিসপেনসারির পথে পা বাড়িয়েছে। তবে ডিসপেনসারিতে যায়নি, দোতলায় ছোট পরিধির একটা নতুন হসপিটাল আছে। এটি সম্পর্কে জানতো না নওরিন৷ আগে কখনো দেখা হয়নি। এখানে জরুরী বিভাগে শাবাবের ট্রিটমেন্ট চললো। ড্রেসিং করানোর সময় নওরিন কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বাঁধা শার্ট খোলতেই হৃদয়টা ধক করে উঠেছে তার। ভোরে নিজেই শার্ট বেঁধে দিল, কিন্তু আলোর ঘাটতি থাকায় ক্ষতের স্পষ্টতা বুঝে উঠতে পারেনি। এখন সুস্পষ্ট দেখতে পেয়ে মন গহীনে আরেক ক্ষতের সৃষ্টি হলো। দাঁয়ের কোপে, চামড়া কেটে মাংস পর্যন্ত হা হয়ে আছে। পিঠের অর্ধাংশ রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। শার্ট খুলে নেওয়াতে তাতে টান পড়ে আবার তাজা রক্ত বের হতে শুরু করেছে। খুলে নেওয়া সাদা নীলের চেকশার্টটাও আধা রঙিন হয়ে আছে। সারা রাতের রক্ত এতে কালচে লাল দাগ বসিয়েছে। জীবাণুনাশক তুলায় চেপে যতবার স্পর্শ করলো ডাক্তার, ততবার শিউরে উঠেছে পুরো দেহখান। তার প্রতিটি শিউরানোতে নওরিনের হৃদয়পিণ্ডতে আঘাত করে যাচ্ছিলো। চোখের অঝোর ধারা আর বলতে কী? নিজ পরিবার নিয়ে চরম লজ্জিত সে। এতোটা অমানুষিক হিংস্র না হলেও কি পারতো না? এ-ও তো কারো পরিবার, রক্তে মাংসে গড়া মানুষ!
চিকিৎসা শেষে হসপিটালেই ওয়েটিংরুমে একটু বিশ্রাম নেয় শাবাব। চলার মতো শক্তি পাচ্ছিলো না। ক্ষতের জ্বালা এবার ওষুধে বেড়েছে। হয়তো সাময়িক, তবুও অসহনীয় হয়ে পড়েছে। নতুন করে যেন আবার অবশ হতে লেগেছে দেহটা। মাথা থেকে পায়ের পাতা অব্দি বিষিয়ে আসছে। সুস্পষ্ট না বললেও নওরিনের কষ্ট হচ্ছিলো অতিরঞ্জন ব্যথাকে ভেবে। পাশে বসে নিজের কাঁধ পেতে দিয়েছিলো মাথা এলিয়ে বিশ্রাম করতে। মিনিট দশেক চোখ বুজে পড়ে রইলো শাবাব। এরপর মনে হলো, একদম না খেয়ে আছে প্রায় দিন কাটতে চললো বলে। দৌড়াদৌড়ির ক্লান্তি শ্রান্তি তো আর কম ভোগান্তিতে ফেলেনি। প্রিয়তমার চোখের গভীরে পর্যন্ত ছেঁয়ে আছে দুর্বলতা। তার আগে করতে হবে জুতার ব্যবস্থা। নওরিনের পায়েও ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। পায়ে পলি জড়িয়ে নিচ তলায় এসে স্বল্পমূল্যে জুতো কিনে নিয়েছে। পকেটের চিন্তায় আরও ভালো লাগছে না শাবাবের। বাড়িতে যোগাযোগ করার সুযোগ পাচ্ছে না, সাহায্য চাওয়ার; কিংবা কী অবস্থা চলছে ওদিকের তা জানার। পালানোর মতো পর্যাপ্ত অর্থের ব্যবস্থাও ছিলো না সাথে। যা আছে, তাতে চালিয়ে নিচ্ছে কোনোমতে। হোটেলে খাওয়া সেরে ধীরে পায়ে হেঁটে তারা বাসে উঠে। বসে একদম পেছনের সিটে। নওরিনের পায়ের দিকে উঁকিঝুঁকিতে দেখে জানতে চায়,
“ব্যথা কমেছে, না বেড়েছে?”
নওরিন শুষ্ক দৃষ্টি তোলে তার দিকে। জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন জুড়ে শাবাবের কাছে।
“নিজেকে নিয়ে আপনার কোনো পরোয়া নেই কেন?”
শাবাবের ক্লান্ত মুখ স্মিত হাসে৷
“আমার পরোয়া করার জন্য একটা পৃথিবী আছে।”
“তাই?”
“একদম।”
“এই পৃথিবী হারিয়ে গেলে তখন কে করবে?”
“এই পৃথিবীটা হারানোর আগে যেন আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি।”
“আপনি আমাকে একা করে রেখে হারিয়ে যেতে পারবেন?”
নওরিনের কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্যথিত হয় শাবাব। টুপ করে ঝরে পড়া অশ্রুকণা হাতের তালুতে নিয়ে নেয় সঙ্গে সঙ্গে। বৃদ্ধা আঙুলে চোখের প্রান্ত মুছে হালকা করে মাথা নেড়ে উত্তর করে,
“না। পারবো না।”
সদ্য অশ্রু ঝরানো চোখ দুটো হাসতে চায়, কিন্তু মুখে হাসি উঠে না নওরিনের। হৃদয়ের ব্যথা দেহকেও ছাড়ে না। গত সন্ধ্যায় কীভাবে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে, আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন। এখন পর্যন্ত কীভাবে বেঁচে আছে, তা-ও তিনিই ভালো জানেন। এতো জানা, এতো সাধন করা বান্দার পক্ষে সম্ভবপর কাজ নয়। দুঃসাধ্যের সময়গুলো রবের করুণায় স্বাপ্নিকভাবেই কেটে গেছে। নয়তো গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো।
এই যেমনটা শাবাবের পরিবারের উপর দিয়ে যাচ্ছে গল্পডানা। সকাল সকাল নওরিনের ছোট ভাই সৈকত খাঁন দুচারজন সাঙ্গ পাঙ্গ সাথে নিয়ে এসে তল্লাশির জেরে বাড়িঘর উলট পালট করে গেলো। শাবাবের পিতামাতাকে হুমকি দিয়ে সদ্য উনিশে পা দেওয়া বোনটাকে বিনা দোষে তুলে নিয়ে গেলো!
চলবে…